গুমের তালিকা দীর্ঘ হচ্ছে কিন্তু-
জিবলু রহমান : দেশে অব্যাহতভাবে চলছে রাষ্ট্রীয় নিরাপত্তা বাহিনীর হাতে গুম-নির্যাতন। রাজনৈতিক দলের নেতা-কর্মী, ব্যবসায়ী, শিক্ষার্থী ও সাধারণ নাগরিকরা নির্যাতনের শিকার হচ্ছেন। পুলিশ ও র্যাব সদস্যরা নাগরিকদের ধরে অজ্ঞাত স্থানে নিয়ে নির্যাতন চালাচ্ছে। আবার অনেককে গুমও করা হচ্ছে। ঢাকার উত্তরা, শ্যামপুর, শনির আখড়া, কদমতলী ওয়াসা পুকুরপাড়, মিরপুর, পল্লবী, যাত্রাবাড়ী, কেরানিগঞ্জ, আশুলিয়া, দক্ষিণ খান, খিলক্ষেত, সাভারসহ কয়েকটি এলাকায় নৃশংস হত্যার ঘটনা বেশি ঘটছে। ঢাকার বাইরে সিলেট, বরিশাল, খুলনা, গাজীপুর, চট্টগ্রাম, কক্সবাজার, বান্দরবান, রাঙ্গামাটি, কুষ্টিয়া, মেহেরপুর, চুয়াডাঙ্গা এলাকায়ও এ ধরনের ঘটনা ঘটছে। সন্ত্রাসীরা নিহতদের শরীর থেকে মাথা বিচ্ছিন্ন করে অঙ্গ-প্রত্যঙ্গও গুম করছে।বর্তমান হাসিনা সরকারের সময় সিলেটের বাসিন্দা হিসেবে গুমের তালিকায় নাম এসেছে সিলেট বিভাগীয় বিএনপির সাংগঠনিক সম্পাদক ও জেলার সভাপতি এম ইলিয়াস আলীর। ১৮ এপ্রিল ২০১২ রাতে সিলেটের বিশ্বনাথ থানায় ২৪ ঘণ্টা আগে ‘নিখোঁজ' ইলিয়াসকে প্রধান আসামী করে চাঁদাবাজি, ভাংচুর ও অগ্নিসংযোগের অভিযোগে মামলা করেছেন বিশ্বনাথ উপজেলা আওয়ামী লীগের শ্রম বিষয়ক সম্পাদক বশারত আলী বাছা। ইলিয়াস নিখোঁজের ২৪ ঘণ্টা পর রাত ২টার সময় ১১ বছর আগের একটা মামলা করা হলো। এত রাতে মামলাটি করাটা কেন এত জরুরি ছিল? সে প্রশ্নও তুলেছেন প্রবীণ আইনজীবী ব্যারিস্টার রফিক-উল-হক।বশারত আলী মামলায় প্রধান আসামী ইলিয়াসসহ চার জনের নাম উল্লেখ করে অজ্ঞাতনামা আরো ১০-১৫ জনকে আসামী করেছেন। ইলিয়াস ছাড়া অন্য তিন আসামী হলেন উপজেলা বিএনপি সহ-সভাপতি সোহেল আহমেদ চৌধুরী, সাবেক দফতর সম্পাদক কলমন্দর আলী, বিশ্বনাথের রামপাশা ইউনিয়ন বিএনপির সাবেক সভাপতি আজাদ নুর।১৯ এপ্রিল তাঁর খোঁজ চেয়ে তার স্ত্রী তাহসিনা রুশদীর লুনা হাইকোর্টে একটি রিট আবেদন করেছেন। এই রিট আবেদনে লুনা অভিযোগ করেছেন, তার স্বামীকে আইন-শৃক্মখলা বাহিনী ধরে নিয়ে গেছে। একই দিন ইলিয়াস আলীর খোঁজ চেয়ে বিএনপির ৬ সদস্যের একটি প্রতিনিধি দল স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর সঙ্গে দেখা করেন। বিএনপি নিয়মতান্ত্রিকভাবে সব কিছু করলেও বেফাঁস বক্তব্যের তালিকায় ১নং থাকা প্রতিযোগী শেখ হvাসনা এবারও পিছিয়ে নেই।১৯ এপ্রিল ২০১২ মুজিব নগর দিবস উপলক্ষে আওয়ামী লীগের আলোচনা সভায় প্রধান অতিথির বক্তব্যে বিরোধীদলীয় নেতা খালেদা জিয়ার নির্দেশে ইলিয়াস আলী লুকিয়ে আছেন বলে দাবি করেছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। ইলিয়াসকে আইন-শৃক্মখলা বাহিনী কর্তৃক গুমের অভিযোগ নাকচ করে দিয়ে তিনি বলেন, আন্দোলনের ইস্যু তৈরি করতেই হারিস চৌধুরীর মতো নেত্রীর (বেগম জিয়া) নির্দেশে সে লুকিয়ে থাকতে পারে। ইস্যু তৈরি করার জন্য নেত্রী হয়তো বলেছেন, ‘লুকিয়ে থাকো'। তিনি আন্দোলনের ইস্যু না পেয়ে ইস্যু তৈরির জন্য নতুন নতুন নাটক সাজিয়ে যাচ্ছেন। ইস্যু তৈরির জন্য নতুন আর কি খেলায় মেতেছেন তা উনিই ভাল জানেন।২১ এপ্রিল ২০১২ ঢাকা উত্তরা সিটি কর্পোরেশনের মেয়র প্রার্থী আওয়ামী লীগের সাবেক সাংগঠনিক সম্পাদক মাহমুদুর রহমান মান্নার সভাপতিত্বে জাতীয় প্রেস ক্লাবে আয়োজিত এক নাগরিক সমাবেশে প্রধান অতিথির বক্তব্যে ইলিয়াস নিখোঁজ হওয়ার ঘটনায় সরকারের প্রতি অঙ্গুলি নির্দেশ করে সিনিয়র আইনজীবী ব্যারিস্টার রফিক-উল-হক বলেছেন, সুরঞ্জিত সেনগুপ্তের ইস্যুটি ধামাচাপা দিতেই ইলিয়াস আলীর ইস্যু সৃষ্টি করা হয়েছে। গুম হওয়ার পর ১০ বছর আগের ঘটনা নিয়ে দুটি মামলা করার মধ্যদিয়েই এটা প্রমাণিত হয়েছে। আগামীতে আরও ইলিয়াস নাটক সরকার করতে পারে বলে আশঙ্কা প্রকাশ করে তিনি বলেন, এসব ঘটনার মধ্য দিয়ে সরকার মানুষকে বোকা বানাচ্ছে।রফিক-উল-হক প্রশ্ন তুলে বলেন, ইলিয়াস গুম হওয়ার পর সরকার রাত ১২টার সময় পুলিশ কীভাবে তার বিরুদ্ধে ১০ বছর আগের ঘটনা নিয়ে মামলা নিল? তাই এটা নিশ্চিত করে বলা যায়, সুরঞ্জিতের কেসকে চাপা দিতেই ইলিয়াসের গুমের ঘটনা ঘটানো হয়েছে।সুরঞ্জিত সেনের ঘটনার প্রসঙ্গ তুলে এই সিনিয়র আইনজীবী বলেন, ৭০ লাখ টাকা কোনো বড় বিষয় নয়। সুরঞ্জিত সাহেব পচা শামুকে পা দিয়েছেন, তার পা কেটে ফেলা হয়েছে কিন্তু যারা ৪০০ কোটি টাকা দিয়ে ব্যাংকের অনুমোদন নিয়েছেন তাদের অর্থের উৎস নিয়ে প্রশ্ন উঠলেও কোনো ব্যবস্থা নেয়া হয়নি। কারও বৈধ উপার্জনে এভাবে ব্যাংক পাওয়া সহজ নয়। দেশে এমন একজন লোক পাওয়া যাবে না যারা সাদা ২০ কোটি টাকা করে শেয়ার কিনেছেন।ইলিয়াস আলীর গুম সম্পর্কে তিনি আরো বলেন, এভাবে একে অপরকে গুম করবে, এটি গণতন্ত্র নয়। মুখে গণতন্ত্র বললে লাভ হবে না। সবাইকে কাজের মাধ্যমে প্রমাণ করতে হবে। আজ এক ইলিয়াস গুম হয়েছে, কাল আরেক ইলিয়াস গুম হবে, এভাবে গণতন্ত্র টিকতে পারে না। আসলে গণতন্ত্রের কথা বলে আমাদের বোকা বানানো হচ্ছে। আমরা এক পা এগিয়ে গেলে আবার দুই পা পেছনে চলে যাই। আমরা চাই দেশে সত্যিকার গণতন্ত্র ফিরে আসুক।স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী, পুলিশ, র্যাবসহ আইন-শৃক্মখলা রক্ষাকারী বাহিনী বলছে তারা কিছুই জানেন না। যদি তার ব্যাপারে কোনই খোঁজ না থাকে তাহলে সিলেটের বিশ্বনাথে কেন এত রাতে মামলা হলো।আসলে বাছার মামলার মাধ্যমে অনেকটা পরিষ্কার হয়ে গেছে যে, ইলিয়াস আওয়ামী সরকারের হেফাজতেই আছে। যদি বিরোধী দলের আন্দোলনের মুখে তাকে জনসম্মুখে আনতেই হয় তখন তাকে ওই মামলায় গ্রেফতার দেখানো হবে কারণ চাঁদাবাজির মামলায় প্রথমেই জামিন হয় না।তৃতীয় দফা আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসার পর থেকেই বছরজুড়ে আলোচিত হচ্ছে গুম, অনেক ক্ষেত্রে দেখা যাচ্ছে সংবাদপত্রে প্রকাশিত হচ্ছে অজ্ঞাত লাশ-এর তথ্য। আইনশৃক্মখলা বাহিনীর পরিচয়ে মাইক্রোবাসে উঠিয়ে নেয়ার পর আর খোঁজ মেলে না। কারও কারও লাশ পাওয়া গেলেও অনেকে একেবারেই নিখোঁজ। লাশটি পর্যন্ত মেলে না। পরিবার-পরিজন খোঁজাখুঁজির পর আশায় বুক বেধে থাকেন লাশটি অন্তত পাওয়া যাবে। কোথাও অজ্ঞাত লাশের সংবাদ পেলে সেখানে ছোটেন তারা। একটি অজ্ঞাত লাশের খোঁজ পেলে দশটি পরিবার হাজির হন হাসপাতাল মর্গে।ভুক্তভোগী পরিবারগুলোর স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে আবেদন, আদালতে রিট, র্যাব গোয়েন্দা কার্যালয়ে খোঁজ এবং থানা পুলিশের কাছে ধরনা দিতে দিতে তারা ক্লান্ত, হতাশাগ্রস্ত এবং মর্মাহত। প্রতিবাদের ভাষা হারিয়ে ফেলেছে।গুম, আইনশৃক্মখলা বাহিনীর পরিচয়ে অপহরণের পর লাশ উদ্ধার, নিখোঁজ হওয়ার পর আর খবর মিলছে না এরকম সংবাদ দেশের মানুষের মধ্যে নতুন করে উদ্বেগ দেখা দিয়েছে। ঘর থেকে বের হলে নিরাপদে ফিরতে পারবে কি না বা নিজের লাশটি আত্মীয়-স্বজন পাবে কি না এ নিয়ে মানুষের মধ্যে নতুন করে উদ্বেগ উৎকণ্ঠা বিরাজ করছে।মাঝেমধ্যে র্যাব বা পুলিশ হেফাজতে দীর্ঘদিন আটক থাকার পর এদের কেউ কেউ ফিরে আসছে। ছেড়ে দেয়ার সময় হুমকি দেয়া হচ্ছে গণমাধ্যমের সঙ্গে কথা বললে ক্রসফায়ারে দেয়া হবে।মানবাধিকার সংগঠনগুলো অব্যাহতভাবে এসব ঘটনার প্রতিবাদ জানালেও কোনো সমাধান হচ্ছে না। এ পরিস্থিতিতে আন্তর্জাতিক অঙ্গনেও নিরাপত্তা বাহিনীর গুম-হত্যার বিরুদ্ধে প্রতিবাদ চলছে।৩১ জানুয়ারি ২০১২ নেদারল্যান্ডসের হেগে অবস্থিত আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালতে হত্যা, অপহরণ, গুম ও মানবাধিকার লঙ্ঘনসহ ৫টি অভিযোগ এনে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে যে অভিযোগ দায়ের করা হয়েছে তাতে ফুটে ওঠেছে মানবাধিকার লঙ্ঘনের চিত্র।আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালতের বিধি অনুযায়ী যে কোন দেশের ক্ষুব্ধ নাগরিক নির্যাতনের শিকার হয়ে তার নিজ দেশের রাষ্ট্রপ্রধান কিংবা অপর কোন দায়িত্বশীল ব্যক্তিবর্গের বিরুদ্ধে অভিযোগ দায়ের করতে পারেন। অভিযোগকারীরা ক্ষতিগ্রস্ত হয়ে আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালতে প্রতিকার চাইলে আদালত অভিযোগ যাচাই-বাছাই শেষে অনুসন্ধান ও তদন্ত করে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেবেন। অভিযোগের সত্যতা পেলে তারা অভিযুক্তদের বিরুদ্ধে গ্রেফতারি পরোয়ানা জারিসহ যে কোন আইনী ব্যবস্থা নিতে পারেন।আরজিতে শেখ হাসিনা ছাড়াও স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী সাহারা খাতুন, পুলিশের সাবেক আইজিপি নূর মোহাম্মদ, বর্তমান আইজিপি এইচএম খন্দকার ও র্যাবের মহাপরিচালক মোখলেছুর রহমানের বিরুদ্ধে অভিন্ন অভিযোগ আনা হয়েছে। ব্রিটেনে বসবাসরত বাংলাদেশী নাগরিক তাজউদ্দিন, মোহাম্মদ আব্দুস সালাম, দেওয়ান এএম চৌধুরী, মোহাম্মদ শামীম হুসাইন ও বাহাউদ্দিন যৌথভাবে এ অভিযোগ দায়ের করেন।অভিযোগে বাংলাদেশের বিদ্যমান অবনতিশীল মানবাধিকার পরিস্থিতি অনুসন্ধান শেষে অভিযুক্তদের বিরুদ্ধে ১৯৯৮ সালের রোম স্টেটিউটের ৬ ও ৭ নং ধারা, জেনেভা কনভেনশন, আইসিসির ৯৪ নং ধারা অনুযায়ী ব্যবস্থা গ্রহণের আবেদন জানানো হয়।তাদের এ অভিযোগের সমর্থনে তারা মানবাধিকার সংগঠন হিউম্যান রাইটস ওয়াচ ও অধিকার-এর ২০১১ সালের প্রতিবেদন, এশিয়ান হিউম্যান রাইটস কমিশন এবং বাংলাদেশের মানবাধিকার পরিস্থিতি নিয়ে বিভিন্ন দেশের পত্র-পত্রিকায় প্রকাশিত রিপোর্ট পেশ করেন। আরজিতে শেখ হাসিনার তিন বছরের শাসনামলে খুন, অপহরণ, গুম, পিলখানায় বিডিআর সদর দফতরে সেনা কর্মকর্তা হত্যাকান্ড, বিচারবহির্ভূত হত্যা, নিরাপত্তা হেফাজতে রেখে নির্যাতনের মাধ্যমে হত্যা, সাধারণ নাগরিকদের ওপর পীড়ন, সাংবাদিক নির্যাতনসহ রাষ্ট্রযন্ত্রকে ব্যবহার করে বিভিন্ন ধরনের অপরাধের বিবরণ দেয়া হয়। আরজিতে ‘পিলখানা হত্যাকান্ডকে গণহত্যা হিসেবে উল্লেখ করে এর পূর্ণাঙ্গ তদন্ত ও বিচারের প্রার্থনা জানানো হয়।আরজিতে বলা হয়, বাংলাদেশের মানবাধিকার পরিস্থিতি বর্তমানে বিপজ্জনক পর্যায়ে গিয়ে পৌঁছেছে। শেখ হাসিনার সরকার ২০০৯ সালের জানুয়ারি মাসে দায়িত্ব গ্রহণের পর প্রথম মাসেই ৩৬ জন নিহত ও ২১৪০ জন আহত হয়। ওই সময়ে বিচারবহির্ভূত হত্যার শিকার হন ২৪ জন। দায়িত্ব গ্রহণের প্রথম বছরেই ২৫১ জন নিহত হয়। একই সময়ে বিচারবহির্ভূত হত্যাকান্ডের শিকার হন আরও ১৪০ জন। বিরোধী রাজনৈতিক দলের ১৬ হাজার ৪৫১ জন গ্রেফতার ও নির্যাতনের শিকার হন। আরজিতে ২০১০ সালের অক্টোবর মাসের নির্যাতনের বিবরণ তুলে ধরে বলা হয়েছে, শুধু এক মাসেই রাজনৈতিক সহিংসতায় ২৪ জন নিহত হন। গ্রেফতার ও নির্যাতনের শিকার হন ১৯ জন সাংবাদিক। ওই মাসে বিচারবহির্ভূত হত্যার শিকার হন ১১ জন। ২০১১ সালে বিচারবহির্ভূত হত্যার শিকার হন ৮৪ জন, সরকারি বাহিনীর হাতে নির্যাতনের পর মারা যায় আরও ১৭ জন। নিরাপত্তা হেফাজতে থাকা অবস্থায় ১৪০ জনের মৃত্যু হয়েছে। গুম হয়েছে ৩০ জন।আরজিতে আরও বলা হয়েছে, বাংলাদেশের মানবাধিকার পরিস্থিতি অত্যন্ত বিপজ্জনক পর্যায়ে এসে পৌঁছেছে। কোনো অভিযোগ ছাড়াই আটক, অপহরণ, বিরোধী দলের ওপর নির্যাতন, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও তার সরকারের সমালোচনাকারী ব্যক্তিদের ওপর নির্যাতনের মতো ঘটনা প্রতিনিয়ত ঘটছে। পুলিশ ও র্যাব ক্রসফায়ারের নামে নিয়মিত মানুষ খুন করে চলেছে। সরকার এসব বাহিনীকে দলীয় বাহিনী হিসেবে ব্যবহার করছে।সরকারের দায়িত্বহীনতা সম্পর্কে আরজিতে বলা হয়েছে, সরকারের দায়িত্ব হচ্ছে জনগণের জীবন ও সম্পদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করা। শেখ হাসিনার সরকার ঠিক তার উল্টো কাজ করছে। সরকার দলীয় ক্যাডাররা অস্ত্র হাতে প্রকাশ্যে বিরোধীদলের সমর্থক নাটোরের পৌর চেয়ারম্যানকে হত্যা করেছে, যা টেলিভিশনে সম্প্রচার করা হয়েছে। হত্যাকারীরা সরকার দলীয় হওয়ায় তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া হয়নি। গত তিন বছরে ক্রসফায়ারের নামে বিরোধী দলীয় নেতা-কর্মীদের হত্যা করা হয়েছে।আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালতের মামলা নং ওটিপি-সিআর-২৩/১২। আরজি গ্রহণ করে অভিযোগ উত্থাপনকারীদের উদ্দেশ্য করে আদালদের তথ্য প্রমাণ ইউনিটের প্রধান এমপি ডিলন স্বাক্ষরিত এক চিঠিতে বলা হয়েছে, ‘আপনাদের উত্থাপিত আরজি গ্রহণ এবং রেজিস্ট্রি শাখায় অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালতের বিধিমালার আলোকে বিষয়টি বিবেচনা করা হবে। এক্ষেত্রে পরবর্তী সিদ্ধান্ত আপনাকে আনুষ্ঠানিকভাবে জানানো হবে'।বাংলাদেশ মানবাধিকার কমিশনের চেয়ারম্যান ড. মিজানুর রহমানের ভাষায়, এগুলো হচ্ছে নতুনরূপে ক্রসফায়ার। তিনি বিভিন্ন সভা ও সেমিনারে দাবি করেছেন-‘আইন-শৃক্মখলা বাহিনীর পরিচয়ে ধরে নেয়ার পর খোঁজ পাওয়া যাচ্ছে না এরকম অভিযোগ বাংলাদেশ মানবাধিকার কমিশনেও আসছে।' ইউনিফর্ম বা নির্ধারিত পোশাক ছাড়া আইন-শৃক্মখলা বাহিনী যাতে গ্রেফতার অভিযানে না যায় এ জন্য তিনি সরকারের প্রতিও দাবি জানিয়েছেন। (সূত্রঃ দৈনিক আমার দেশ ১ জানুয়ারি ২০১২)২৪ নবেম্বর ২০০৮ রাজধানীর লালমাটিয়ায় বোনের বাসা থেকে সাদা পোশাকের একদল লোক আওয়ামী যুবলীগের সাবেক কেন্দ্রীয় নেতা লিয়াকত হোসেনকে তুলে নিয়ে যায়। লিয়াকতের পরিবার এখনও তার সন্ধান পাননি। তারা স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় ও পুলিশের মহাপরিদর্শকের কাছে আবেদন করে এবং র্যাব ও পুলিশের কাছে ধরণা দিয়েও কিছু জানতে পারেননি। লিয়াকতের স্ত্রী সংবাদ সম্মেলন করে অভিযোগ করে বলেছিলেন, তার স্বামীকে আইন-শৃক্মখলা রক্ষাকারী বাহিনী আটক করেছে। র্যাব, পুলিশ বা সরকারি কোনো কর্তৃপক্ষই লিয়াকতকে আটক করার কথা স্বীকার করেনি। এ ব্যাপারে লিয়াকতের পরিবারের সদস্যরা আদালতে গিয়েও সরকারের কাছ থেকে কোনো উত্তর পায়নি।২০ জুলাই ২০০৯ তারিক হোসেন নামে এক এনজিও কর্মীকে পুরান ঢাকার লালবাগ থেকে আটক করে র্যাব। তার বোন নাসরিন হোসেন ২২ জুলাই মতিঝিল থানায় একটি জিডি করেন। তাতে বলা হয়, তার ভাই চট্টগ্রাম থেকে ঢাকায় বোনের বাসায় আসার পথে ২০ জুলাই থেকে নিখোঁজ রয়েছে। তারিকের স্ত্রী শারমিনের অভিযোগ, র্যাব তার স্বামীকে গ্রেফতার করে খুলনায় নিয়ে গেছে। কিন্তু এরপর তার আর কোন খোঁজ পাওয়া যায়নি।২২ জুলাই ২০০৯ সিরাজগঞ্জের বেলকুচি উপজেলার পুকুরিয়া বেড়ার বাজার থেকে তুষার ইসলাম ওরফে টিটুকে র্যাব সদস্যরা আটক করে বলে আত্মীয়স্বজন অভিযোগ করেছেন। এখন পর্যন্ত তুষারের কোন খোঁজ পাওয়া যায়নি। তুষারের পরিবারের আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে মানবাধিকার সংস্থা ‘অধিকার' এ ঘটনার তদন্ত করে। অধিকারের তদন্তে বলা হয়, র্যাব-৩ সদস্যরা তুষারকে আটক করার পর নিখোঁজ রয়েছেন বলে প্রমাণ মিলেছে।২৬ আগস্ট ২০০৯ কদমতলীর এক ড্রাইভার দেলোয়ার হোসেন শিকদারকে ধোলাইপাড়ের অজ্ঞাত এক ব্যক্তি ডেকে নিয়ে যায়। এরপর থেকে সে নিখোঁজ।২৭ এপ্রিল ২০১০ মিজানুর রহমান সুমন নামের একজন ব্যবসায়ীকে সাদা পোশাকধারী র্যাব সদস্যরা গাইবান্ধার মহিমাগঞ্জ থেকে গ্রেফতার করে ঢাকায় নিয়ে আসে। এরপর থেকে তিনি নিখোঁজ রয়েছেন।২৫ জুন ২০১০ রাজধানীর ইন্দিরা রোডের এক আত্মীয়ের বাসা থেকে প্রাইভেট কারে ধানমন্ডি যাওয়ার সময় সাদা পোশাকধারী ব্যক্তিদের হাতে আটক হন বিএনপির জাতীয় নির্বাহী কমিটির সদস্য ও ৫৬ নম্বর ওয়ার্ড কমিশনার চৌধুরী আলম। গাড়ি থামিয়ে তাকে সাদা পোশাকধারীরা আটক করে নিয়ে যায় বলে পরিবারের পক্ষ থেকে অভিযোগ করা হয়েছে। চৌধুরী আলমকে আইন-শৃক্মখলা বাহিনীর পরিচয়ে আটক করার পর আদালতে রিট করায় তাকে খুঁজে বের করতে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী, স্বরাষ্ট্র সচিব ও পুলিশের আইজিকে নির্দেশ দিলেও এখন পর্যন্ত তাদের কাছ থেকে কোন সাড়া পাওয়া যায়নি। অন্যদিকে মামলাটি সিআইডি পুলিশ তদন্ত করলেও পরিবারের কারও সঙ্গে কথা বলেননি তদন্ত কর্মকর্তারা।১৫ ফেব্রুয়ারি ২০১১ রাজধানীর ৬২০ উত্তর শাহজাহানপুর থেকে সাদা পোশাকের ও পোশাকধারী র্যাব সদস্যরা মুদি দোকান কর্মচারী রফিকুল ইসলামকে ধরে নিয়ে যাওয়ার পর থেকে তার আর কোনো খোঁজ পাওয়া যাচ্ছে না। রফিকুলকে ধরে নিয়ে যাওয়ার পর তার পরিবার র্যাব-৩, স্থানীয় থানাসহ বিভিন্ন জায়গায় খোঁজ নিয়েছেন কিন্তু তাকে কোথাও পাওয়া যায়নি। ঘটনার দিন বিকেলে র্যাবের পোশাকধারী এবং সাদা পোশাকে ১৫/২০ জন লোক দোকান থেকে রফিকুলকে আটক করে নিয়ে যায়। কী অপরাধে তাকে আটক করা হয়েছে এ ব্যাপারে তারা কিছুই জানায়নি। দিন দুপুরে রফিকুলকে আটক করে নেয়ার এ দৃশ্য আশপাশের অন্যান্য দোকানদার, পথচারী ও সাধারণ মানুষ প্রত্যক্ষ করেছে।২২ ফেব্রয়ারি ২০১১ স্টামফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র তৌফিক আহমেদ হাসান হিযবুত তাহরীরের পোস্টারসহ অন্য দু'জনের সঙ্গে ধরা পড়ে। এ ব্যাপারে পুলিশের দায়েরকৃত মামলায় ১৩ মে সে জামিন পায়। হাসানের বাবা এডভোকেট মোহাম্মদ খবির উদ্দিন অভিযোগ করেন, পুলিশ ও কারারক্ষীদের সূত্রে তিনি জানতে পারেন, তার ছেলেকে জেল গেট থেকে জামিনে বের হয়ে আসার পর পরই সাদা পোশাকে র্যাব অপহরণ করেছে। এ ঘটনায় কারা কর্তৃপক্ষ ও র্যাব ১০-এর ডিএডির বিরুদ্ধে আদালতে মামলা দায়ের করেছেন খবির উদ্দিন। খবির উদ্দিন বলেন, আদালত মামলাটি বিচার বিভাগীয় তদন্তের নির্দেশ দেন।৮ এপ্রিল ২০১১ সূত্রাপুরের লালকুঠি ফরাশগঞ্জ ক্লাব কমিউনিটি সেন্টারে অনুষ্ঠিত বড় ভাই ইয়াদ আহম্মেদ দিপুর বৌ-ভাতের অনুষ্ঠানে সদরঘাট এলাকার ব্যবসায়ী তারিক উদ্দীন আহমেদ রানা উপস্থিত ছিল। বিকাল ৪টার দিকে কমিউনিটি সেন্টারের সামনে রানা এসে দাঁড়ালে ৬/৭ জন সাদা পোশাকের অস্ত্রধারী তাকে টেনে একটা মাইক্রোবাসে তোলে। ওই সময় স্থানীয় লোকজন অজ্ঞাত অস্ত্রধারীদের পরিচয় জানতে চাইলে তারা নিজেদের র্যাবের লোক বলে দাবি করে। পরবর্তীকালে র্যাব-১০ এর কার্যালয়সহ বিভিন্ন স্থানে খোঁজ নিয়ে তার কোনো সন্ধান পাওয়া যায়নি।১৭ এপ্রিল ২০১১ বাড্ডা কুড়িল এলাকা থেকে র্যাব পরিচয়ে অজ্ঞাত কিছু লোক ঝালকাঠি জেলার রাজাপুর উপজেলার মিজানুর রহমান মিজান, নাজমুল হক মুরাদ ও ফোরকানকে অপহরণ করে নিয়ে যায়। পরে মোহাম্মদপুরের ঢাকা উদ্যানের পেছনে তুরাগ নদীর বালুতে তিনজনের লাশ উদ্ধার করে পুলিশ। কিছুদিন পর ফোরকান রহস্যজনকভাবে ফিরে আসে। পরে সে র্যাবের হাতে আটক হওয়ার বর্ণনা দেয়। কিন্তু কিছুদিন পর সে গ্রামের বাড়ি রাজাপুরে ফিরে গেলে সেখান থেকে আবার নিখোঁজ হয় এবং এখনও তার সন্ধান মেলেনি।১৪ জুলাই ২০১১ গোলাম মর্তুজা নামের একজন ছাত্র সংগঠককে ডিবি পুলিশ পরিচয়ে সাদা পোশাকধারী ৬/৭ ব্যক্তি ধানমন্ডির রবীন্দ্র সরোবর থেকে হাতকড়া লাগিয়ে নিয়ে যায় বলে তার পরিবার অভিযোগ করেছে। গোলাম মর্তুজার আত্মীয়-স্বজনরা সিআইডি, র্যাব এবং ধানমন্ডি থানায় যোগাযোগ করেও তার কোনো সন্ধান পায়নি।২৯ সেপ্টেম্বর ২০১১ ছেলেকে স্কুল ভ্যানে তুলে দিয়েই নিখোঁজ হন ছাত্র ইউনিয়নের নেতা কে এম শামী আক্তার। এখনও সন্ধান মেলেনি তার। বাসার জন্য কিছু কেনাকাটার উদ্দেশ্যে দোকানের দিকে যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে ৭-৮ জন লোক জোর করে গাড়িতে তুলে নিয়ে যায়। তার সন্ধানের দাবিতে পরিবারের পক্ষ থেকে সংবাদ সম্মেলন ও সংগঠনের পক্ষ থেকে মানববন্ধন কর্মসূচি পালন করা হয়েছে।১৯ অক্টোবর ২০১১ রাত ২টায় সাভারের কাতলাপুর পালপাড়ায় নিজ বাসার তিনটি তালা ভেঙে তুলে নিয়ে যাওয়া হয় ৪১ নম্বর ওয়ার্ড আওয়ামী লীগ সভাপতি হাজী নূর মোহাম্মদকে। রাতে একটি প্রাডো, একটি পাজেরো গাড়ি দিয়ে সাদা পোশাকে কয়েকজন লোক আসে। সেখানে পালপাড়া কাতলাপুরের ১-৩ নম্বর বাসায় ঘুমিয়ে ছিলেন তিনি। ওই লোকগুলো প্রশাসনের লোক পরিচয় দিয়ে অজ্ঞাত পরিচয়ধারী লোকগুলো গাড়িতে করে তুলে নিয়ে যান। এ ব্যাপারে তার মেয়ে সম্পার স্বামী আব্দুল মান্নান শ্বশুরের নিখোঁজ রহস্যের জট খুলতে আটঘাঁট বেধে মাঠে নেমেছিলেন। শ্বশুরকে উদ্ধার করতে গিয়ে হাওয়া হয়ে গেলেন জামাতা আব্দুল মান্নান ও তার বন্ধু ইকবাল।৮ নবেম্বর ২০১১ চট্টগ্রামের বোয়ালখালী থানা বিএনপির সভাপতি ও করলডেঙ্গা ইউনিয়নের চেয়ারম্যান নজরুল ইসলামকে র্যাব সদস্যরা গাজীপুর থেকে তুলে নিয়ে যায় বলে তার পরিবার অভিযোগ করেছে। গাজীপুর-জয়দেবপুর বাইপাস রোডের চৌরাস্তা এলাকা থেকে সাদা পোশাকধারী ৪/৫ জন লোক আইন-শৃক্মখলা রক্ষাকারী বাহিনীর পরিচয় দিয়ে তার গাড়ি থেকে জোর করে তাকে অন্য একটি গাড়িতে তুলে নেন। কিন্তু তুলে নিয়ে যাওয়ার বিষয়টিকে অস্বীকার করছে র্যাব।২৯ নবেম্বর ২০১১ কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে ঢাকা সিটি কর্পোরেশন বিভক্তির প্রতিবাদ সমাবেশে গিয়েছিলেন সিটি কর্পোরেশনের কর্মচারী ও সূত্রাপুর থানা স্বেচ্ছাসেবক দলের যুগ্ম আহবায়ক মো. মাসুদ। এখন পর্যন্ত তিনি আর বাসায় ফিরে আসেননি। সমাবেশ থেকেই উধাও হয়ে যান মাসুদ।দেশের বিভিন্ন স্থানে হত্যা, বিশেষ করে একের পর এক গুপ্তহত্যার ঘটনা ঘটলেও পুলিশ এর ক্লু উদ্ধার করতে পারছে না। ভুক্তভোগীদের অভিযোগ, অনেক গুপ্তহত্যার খবর আইন প্রয়োগকারী সংস্থার গোচরে রয়েছে; কিন্তু তারপরও তারা এ বিষয়ে কোনো তৎপরতা চালাচ্ছে না। গুপ্ত হত্যার শিকার হতভাগ্য ব্যক্তিদের মামলাগুলোর তদন্ত নিয়ে সবচেয়ে বিপজ্জনক অবস্থায় আছে পুলিশ। অধিকাংশ মামলার তদন্ত করছে স্থানীয় থানা পুলিশ। বিচ্ছিন্নভাবে দু'একটি মামলার তদন্তভার দেয়া হয়েছে সিআইডি অথবা অন্য কোন সংস্থার হাতে। থানা পুলিশ এসব মামলার তদন্ত করতে গিয়ে অপরাধের ধরন, অপরাধের উৎস, পারিপার্শ্বিক পরিস্থিতি, হত্যার শিকার, মোবাইল কল লিস্ট ইত্যাদি পর্যালোচনা করছে। অনুসন্ধানে জানতে পারছে, এগুলো নিছক কোনো সাধারণ হত্যাকান্ড নয়; পরিকল্পিতভাবেই ক্রসফায়ারের মতো হত্যাকান্ডগুলো ঘটানো হয়েছে। এসব তথ্য জানার পর তদন্ত সংস্থা বা তদন্ত কর্মকর্তা মামলার তদন্ত কাজ সামনে এগিয়ে নিতে পারছেন না। তদন্ত কর্মকর্তা এসব বিষয় নিয়ে ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের সাথে আলোচনা করেও পরবর্তী করণীয় কি তা জানতে চাচ্ছেন। কিন্তু ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা এ বিষয়ে কোনো দিক নির্দেশনা দিতে পারছেন না। এসব মামলার ভবিষ্যৎ কি হবে তা নিয়ে শঙ্কায় রয়েছেন তদন্ত কর্মকর্তারা। আইনের বাধ্যবাধকতা থাকায় হত্যা মামলায় চার্জশিট অথবা ফাইনাল রিপোর্ট দিতে হয়। আলোচিত এসব মামলায় চার্জশিট দিতে হলে হত্যাকান্ডে জড়িত ব্যক্তিদের সনাক্ত করে তাদের নাম-পরিচয় উল্লেখ করতে হবে। ফাইনাল রিপোর্ট দিতে গেলেও দেখা দিচ্ছে বড় ধরনের জটিলতা। আলোচিত এসব মামলায় ফাইনাল রিপোর্ট দিতে চাইলে তদন্ত প্রতিবেদনে উল্লেখ করতে হবে, ‘এসব মামলায় কোনো আসামীকে চিহ্নিত করা যায়নি'।অনেক ক্ষেত্রেই প্রাপ্ত তথ্য প্রমাণে সন্দেহভাজনদের চিহ্নিত করা সম্ভব; কিন্তু বাস্তবতা হলো তাদের বিরুদ্ধে চার্জশিট দেয়া সম্ভব নয়। এরপরও নানামুখী চাপে এসব হত্যা মামলায় ফাইনাল রিপোর্ট দিলেও ভবিষ্যতের কথা চিন্তা করে তদন্ত কর্মকর্তারা শঙ্কিত। কারণ বাদীপক্ষ যদি এসব মামলার তদন্তের গ্রহণযোগ্যতার প্রশ্ন তুলে আদালতে শরণাপন্ন হন, তাহলে নিশ্চিতভাবেই তদন্ত কর্মকর্তার গাফিলতির প্রমাণ পাওয়া যাবে। সেক্ষেত্রে ভবিষ্যতে তদন্ত কর্মকর্তাদের ভাগ্যে কি হবে তা চিন্তা করে এসব তদন্ত কর্মকর্তা এখন উদ্বিগ্ন। সংবাদপত্রে প্রকাশিত তথ্যে জানা গেছে-২৮ জানুয়ারি ২০০৯ লালবাগে ডিশ ব্যবসায়ী আজগরের ১৫ টুকরো লাশ উদ্ধার করা হয়।২৭ আগস্ট ২০০৯ কমলাপুর রেললাইনের ওপর থেকে অজ্ঞাত এক মহিলা (৩৫) ও ছয় বছরের একটি শিশুর লাশ উদ্ধার করে পুলিশ। ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল মর্গে ময়না তদন্তের পর ফরেনসিক বিশেষজ্ঞরা নিশ্চিত হয়েছে লাশের পরিচয় গুম করতে তাদের রেললাইনের ওপর ফেলে রাখে দুর্বৃত্তরা। মাকে গলাকেটে এবং শিশুকে কুপিয়ে হত্যা করার আলামত পাওয়া গেছে।২৮ আগস্ট উত্তরখান থানার ময়নারটেক এলাকা থেকে মস্তকবিহীন লাশ উদ্ধার করে পুলিশ। তার মাথা এখনও উদ্ধার করা সম্ভব হয়নি। ৬ ডিসেম্বর ২০০৯ রাজধানীর দক্ষিণখানের কোর্টবাড়ি এলাকায় বন্যা আক্তার নামে এক কিশোরীকে গলাকেটে হত্যা করা হয়। বাড্ডায় ট্রাভেল ব্যাগের ভেতর থেকে যুবতীর দেহ উদ্ধার করে পুলিশ। তার দেহের সঙ্গে মাথা ও দু'পা ছিল না বলে পুলিশ জানায়। আব্দুল কাদেরের মেয়ে বন্যা আক্তার (১১) স্থানীয় প্রাইমারি স্কুলের তৃতীয় শ্রেণীর ছাত্রী সে। ৫ ডিসেম্বর সন্ধ্যায় বাসা থেকে বেরিয়ে বন্যা নিখোঁজ হয়। পুলিশের ধারণা, তাকে পাশবিক নির্যাতনের পর হত্যা করা হয়েছে।৭ ডিসেম্বর ২০০৯ বাড্ডার খিলবাড়ীরটেক ইসলামিয়া স্কুল রোডের ডোবা থেকে অজ্ঞাত যুবতীর (৩০) দেহ উদ্ধার করে পুলিশ। ব্লাউজ ও প্রিন্টের শাড়ি জড়ানো দেহটি ট্রাভেল ব্যাগের ভেতর ছিল। তার মাথা ও দু'পা দেহের সঙ্গে ছিল না বলে পুলিশ জানান। এলাকাবাসী পঁচা দুর্গন্ধ পেয়ে পুলিশকে খবর দেয়। পুলিশ ডোবায় ভাসতে থাকা ট্রাভেল ব্যাগ তুলে আনে। ব্যাগটি খুলে দেখা যায় বেশ কিছু গরুর গোশতের নিচে যুবতীর দেহ। দেহে পচন ধরে দুর্গন্ধ ছড়াচ্ছিল। পুলিশের ধারণা, ট্রাভেল ব্যাগে মহিলার খন্ডিত দেহকে আড়াল করতেই উপরে গরুর গোশত ছড়িয়ে রাখা হয়।২৬ এপ্রিল ২০১০ মোহাম্মদপুর থানাধীন তুরাগ নদীর পারে যুবদল নেতা ও ঠিকাদার মিজানুর রহমান মজুমদার, মিনাজের বন্ধু নাজমুল হক মুরাদ, তার সহযোগী ফোরকানের লাশ উদ্ধার করা হয়। বেরিবাঁধে বালুচাপা অবস্থায় পাওয়া যায় তাদের লাশ। এর আগে ১৭ এপ্রিল র্যাব পরিচয়ে সাদা পোশাকের ৭/৮ জন লোক কুড়িল বিশ্বরোড থেকে তাদের ধরে নিয়ে যায়। এরপর তারা নিখোঁজ ছিল। পরে লাশ পাওয়া যায় তুরাগের পাড়ে।২৬ এপ্রিল ২০১০ পল্লবীতে শহীদুল্লাহ নামে এক ব্যবসায়ীর লাশ উদ্ধার হয়। আমিন বাজারে ব্রিজের কাছ থেকে র্যাব-৪ লেখা একটি গাড়ি শহীদুল্লাহকে তুলে নিয়ে যায়। এরপর থেকে নিখোঁজ ছিল শহীদুল্লাহ। পরে তার লাশ পাওয়া যায় বেড়িবাঁধে।৩১ জুলাই ২০১১ রাজধানীর দয়াগঞ্জ বাজার মোড়ে স্থানীয় তরুণ জুয়েল গিয়েছিল চিনি, চা-পাতা কিনতে। আর রাজীব বের হয়েছিল নাশতা করতে। এখান থেকে তাদের ধরে নিয়ে যায় আইনশৃক্মখলা রক্ষাকারী বাহিনীর নামে সাদা পোশাকের একটি দল। তাদের সঙ্গে গ্রেফতার হয় আরেক তরুণ ওয়ার্কশপ কর্মী মিজানুর রহমান। ঘটনাটি ঘটে যাওয়ার ৫ দিন পর ৫ আগস্ট এই তিনজনের মধ্যে দু'জনের লাশ পাওয়া যায় গাজীপুরের পূবাইল রাস্তার ঢালে। ঢাকা-মাওয়া সড়কের পাশ থেকে পাওয়া যায় আরেক তরুণের লাশ।রাষ্ট্রের যেসব নাগরিক নিখোঁজ বা গুম হয়েছেন অথবা গুপ্তহত্যার শিকার হয়েছেন, এসব ঘটনার সঙ্গে কারা জড়িত, তা খুঁজে বের করার দায়িত্ব সরকারের। এদের কয়েকজনের লাশ পরে পাওয়া গেছে। যার মধ্যে বিরোধী দল সমর্থিত ছাত্র সংগঠন ছাত্রদল ও বিএনপির নেতাকর্মী রয়েছেন। এ ঘটনার সঙ্গে আইনশৃক্মখলা বাহিনী জড়িত থাকার বিষয়টি সরকারও অস্বীকার করতে পারে না।লেখক পরিচিতি ঃ সদস্য সচিব, শামসুর রহমান ফাউন্ডেশন, সিলেট।
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন