রবিবার, ৬ মে, ২০১২

রবীন্দ্রনাথকে নিয়ে রাজনীতি রবীন্দ্রনাথের রাজনীতি


 সাজজাদ হোসাইন খান
কবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর রাজনীতিক ছিলেন না, তবে রাজনীতি মনস্কোতো ছিলেন বটেই। এই মনস্কোতার খবর জানা যায় তাঁর লেখা, আচার আয়োজনে। রবীন্দ্রনাথের সমগ্র জীবন অতিবাহিত হয়েছে পরাধীন ভারতে। ইংরেজ শাসনে রাজনীতি যখন নানা বাঁকে মুচড় খাচ্ছিল ঠিক সেই সময়টায় রবীন্দ্রনাথের উত্থান। সাহিত্য গগনে প্রখর সূর্যের মতোই তার উত্তাপ। এই উত্তাপের উষ্ণতা কেবল দেশেই নয় বিদেশেও ছড়িয়ে পড়েছিল। যে কারণে কবি রবীন্দ্রনাথ একটি প্রতিষ্ঠানে রূপ পরিগ্রহ করেছিল। তাঁর গ্রহণযোগ্যতা তখন সর্বব্যাপী। সক্রিয় রাজনীতির সাথে তিনি নিজকে সম্পৃক্ত করেননি। তবে তিনি তার রাজনৈতিক মত ও পথকে প্রকাশ করেছেন অবলীলায়। ইংরেজের প্রতি তাঁর ছিল বিশেষ অনুরাগ। যখন ইংরেজ দুঃশাসনের বিপক্ষে সমগ্র ভূ-ভারত উন্মাতাল। ইউরোপীয় সভ্যতার প্রতি তিনি ছিলেন সপ্রশংস। যদিও তাদের অসভ্যতা-অনাচার কথিত সভ্যতাকে অতিক্রম করেছিল। প্রায় বিশ্বব্যাপী তাদের অসভ্যতা এবং স্বৈরমনোভঙ্গি স্পর্শ করেছিল। কিন্তু রবীন্দ্রনাথ এ ব্যাপারে ছিলেন শীতল। ইংরেজের দমন-পীড়ন তাকে ব্যথিত করেনি। তিনি তাদের এই অশোভন আচরণকে বরং প্রশ্রয় দিয়েছেন। রবীন্দ্র জীবনের সমগ্র কর্মকান্ড অনুসন্ধানে এমন তথ্যই উন্মোচিত হয়। শরৎচন্দ্রের উপন্যাস ‘পথের দাবি' ইংরেজ শাসক বাজেয়াপ্ত করেছিল। তখন রবীন্দ্রনাথের সহযোগিতা প্রত্যাশা করে শরৎচন্দ্র একখানা পত্র লিখেছিলেন। পত্র জবাবে রবীন্দ্রনাথ লিখলেন-
‘কল্যাণীয়ষু,
তোমার পথের দাবি পড়া শেষ করেছি। বইখানি উত্তেজনক। অর্থাৎ ইংরেজদের শাসনের বিরুদ্ধে পাঠকের মনকে অপ্রসন্ন করে তোলে।... ইংরেজ রাজ ক্ষমা করবেন এই জোরের উপরই ইংরেজ রাজাকে আমরা নিন্দা করি এটাতে পৌরষ নেই। আমি নানা দেশ ঘুরে এলুম। আমার যে অভিজ্ঞতা হয়েছে তাতে এই দেখলেম একমাত্র ইংরেজ গবর্নমেন্ট ছাড়া স্বদেশী বা বিদেশী প্রজার বাক্যে বা ব্যবহারে বিরুদ্ধতা আর কোন গবর্নমেন্ট এতটা ধৈর্যের সঙ্গে সহ্য করে না।' (অরবিন্দ পোদ্দার রবীন্দ্রনাথ রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব, উচ্চারণ কোলকাতা, পৃ: ৩২৪) যখন ভারতের বিবেকসম্পন্ন মানবকুল ইংরেজ বিতাড়নে নানান কৌশল আবিষ্কারে ব্যস্ত তখন কবি রবীন্দ্রনাথের এহেন উচ্চারণ।
ইদানীং কেউ কেউ কবির রাজনৈতিক মতামত নিয়ে ঢাউস প্রবন্ধ নিবন্ধের ফর্দ তৈরি করেন। ইনিয়ে-বিনিয়ে বাক্যের নানা ঘুরপ্যাঁচে পাঠকের দৃষ্টিকে একটা স্বস্তিকর উপত্যকায় এনে দাঁড় করানোর কোশেক করেন। কবি যা নন অতিকথনের মাধ্যমে তাকে তা দেখানোর চেষ্টা করেন। এতে পাঠক বিভ্রান্ত হন। বিশেষ করে বর্তমান প্রজন্ম ইংরেজের দুঃশাসনের ব্যাপারে রবীন্দ্রনাথ বরাবরই ছিলেন বাকরুদ্ধ। দুঃশাসকের শিরোমনি পঞ্চম জর্জকে তিনি সম্বোধন করেছিলেন ‘‘ভারতের ভাগ্যবিধাতা রূপে। এই যখন চিত্র, তখন তাকে নিয়ে কতটা পথ হাটা যায়। ভারতবাসীর ইংরেজ বিতাড়নের বিষয়ে প্রস্তুতিপর্বের সমাপ্তির প্রান্তসীমায় এসে পড়েছে। এখানে সেখানে যুদ্ধ। সিপাহী বিপ্লবের রেশ প্রবাহিত হচ্ছে দেশময়। রাজনীতিতে মতপার্থক্য থাকবে। সব মানুষ একমত পোষণ করবে এমনটা কখনো হয় না। এই দিক বিবেচনা করলে রবীন্দ্রনাথ তার মতামতকে স্পষ্টভাবেই প্রকাশ করেছেন। হয়তো তার এই মত ভারতের স্বাধীনতা আন্দোলনের প্রেক্ষাপটে ইতিবাচক ছিল না। বিশ্লেষকদের ধারণা কবির নেতিবাচক দিকটিই প্রবল ছিল। কিন্তু দুঃখজনক হল অতিভক্ত বা রবীন্দ্রনাথকে নিয়ে যারা রাজনীতি করেন তারা কবির রাজনৈতিক মতামত নিয়ে ধুয়াকার সৃষ্টি করেন। রবীন্দ্রনাথের মতের বদলে নিজের মতকে প্রতিষ্ঠা করতেই যেন বেশি ব্যস্ত হয়ে পড়েন। তাতে তারা রবীন্দ্রনাথের যেমন সর্বনাশ করেন সর্বনাশ করেন ইতিহাসের সত্যকেও। বঙ্গভঙ্গের প্রাক্কালে কার কি ভূমিকা ছিল তা স্পষ্ট। এরপরও কেউ কেউ নতুন ইতিহাস রচনা করে যাচ্ছেন মনের সুখে। কে না জানে বঙ্গভঙ্গ ছিল পূর্ববাংলার কৃষককূলের ভাগ্যসুপ্রসন্ন  করার একটি আয়োজন। এই আয়োজন ভন্ডুল করে দিয়েছিল প্রতিবেশী সমাজ বঙ্গভঙ্গ রদ আন্দোলনের মাধ্যমে। তখন রবীন্দ্রনাথ ছিলেন তাদের পক্ষে। তিনি তখন বাউল গগনের একটি গানের সুরকে আশ্রয় করে আমার সোনার বাংলা গানটি রচনা করেছিলেন। যা এখন বাংলাদেশের জাতীয় সঙ্গীত। এই সত্যকে নিয়েও কেউ কেউ বিভ্রান্ত ছড়াতে চান। ইতিহাস বিকৃতি করেন। অবাক ব্যাপার হলো ভারত বিভক্তির সময় এই সমাজটিই আবার যুক্তবাংলার বিপক্ষে অবস্থান নেয়। সোহরাওয়ার্দী এবং আবুল হাশেমরা তখন বৃহৎ বঙ্গের পক্ষে লড়াই করছিলেন। এসব সত্য বর্তমানে ছাইচাপা দেবার চেষ্টা হচ্ছে। নতুন প্রজন্ম জানতে পারছে না সত্য ইতিহাস। আফসোসের বিষয় হলো তারাও জানতে চাচ্ছে না সে সব ইতিহাসের খবরাখবর। মিথ্যা ইতিহাসকেই সঠিক বিবেচনায় মনোপিড়ায় ভুগছে।
বাংলা সাহিত্যের এক বিশাল মহীরুহ রবীন্দ্রনাথ। তিনি বাংলাভাষা এবং সাহিত্যকে সমৃদ্ধ করেছেন। বিদেশ-বিভুইয়ে বাংলাভাষা সাহিত্যের বিস্তার ঘটিয়েছেন, পরিচিত করেছেন। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ভারতের জাতীয় কবি। তাতে কী! বাংলাদেশের মানুষও তাকে মান্য করে শ্রদ্ধা করে, পাঠ করে হৃদয় দিয়ে। তার সঙ্গীতে আবেশিত হয় রবীন্দ্রনাথের প্রতি ভক্তি-শ্রদ্ধার এতটুকু কমতি নেই এখানে। তার জন্ম দিবস মৃত্যু দিবস পালন হচ্ছে দীর্ঘদিন থেকে স্বস্তির সাথে, তৃপ্তির সাথে। তাকে বাংলাদেশের মানুষ স্মরণ করবে বার বার। কারণ তিনি বাংলাভাষার একজন বড় লেখক, প্রিয় লেখক। তাছাড়া তিনি বাংলাদেশে অবস্থান করেছেন শিলাইদহে-পতিসরে। যদিও তার অতিভক্তজন প্রচার করেন রবীন্দ্রনাথ এই ভাটি মুল্লুকের জনগণকে ভালবেসে জনপদের প্রকৃতিকে ভালবেসে এখানে দিনযাপন করেছেন। আসলে এমন উচ্চারণে তেমন কোন সত্য নেই। তিনি বাংলাদেশে থেকেছেন বাধ্য হয়ে। তার জমিদারি তদারকির খাতিরে। রুজি-রোজগারের প্রত্যাশায়। তবে আনন্দের খবর হলো, এই সময় কালটিতে রবীন্দ্রনাথ বাংলা ভাষাভাষীদের জন্য মহামূল্যবান কিছুর ছলা তৈরি করেছিলেন। যা বাংলা সাহিত্যের এক অমূল্য সম্পদ।
১৫১তম জন্মদিন পালিত হচ্ছে এই বিশ্ববরেণ্য কবির। ইদানীং আবার রেওয়াজ চালু হয়েছে এক সাথে পালিত হয় বাংলাদেশ এবং ভারতে। বাংলাদেশের জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলামের জন্ম-মৃত্যু দিবসও উদযাপিত হবে একই কায়দায়। তবে এই রেওয়াজের পশ্চাতে কতটা রাজনীতি আর কতটা শোভন চিন্তা জড়িত তা এখনও আবিষ্কৃত হয়নি। হয়তো আগামীতে বিষয়টা খোলাসা হবে। সম্প্রতি রবীন্দ্র সাহিত্য চর্চার পরিবর্তে রবীন্দ্রকে নিয়ে রাজনীতি এখন তুঙ্গে। এদেশের অাঁতেলরা এ ব্যাপারে অগ্রহণীর ভূমিকায়। লেখায়, বক্তৃতা-ভাষণে এই রাজনীতির ঝাঁজ তারা ছড়িয়ে যাচ্ছেন। বাংলা-বাঙালি বলতেই তারা রবীন্দ্রনাথকে উপস্থাপন করেন। বাঙালি সংস্কৃতির ধারক নাকি রবীন্দ্রনাথ। ভাষা আন্দোলনে তিনি বাংলা সনের পুরো ভাগে তিনি, বাঙালির যে কোন দেশজ উৎসবে রবীন্দ্রনাথকে উপস্থিত করা যেন বর্তমানে একটা ফ্যাশনে রূপ নিয়েছে। বাংলা সনের শুরুতে চ্যানেল, পত্র-পত্রিকায় রীতিমত রবীন্দ্র-বন্দনা শুরু হয়। তখন মনে হয় যেন কানু ছাড়া গীত নাই। আজকাল ফ্যাশন হাউজগুলোও এই অতিতোষণে নিজেদের শামিল করছে। ‘এসো হে বৈশাখ' লেখা শার্ট-গেঞ্জি, কামিজ বাজারে ছেড়ে। বৈশাখের দৃপ্ত ভঙ্গিকে ধারণ করে কবি নজরুলের এমন সব বিখ্যাত বিখ্যাত গান থাকলেও তা থাকে প্রচন্ডভাবে উপেক্ষিত। রাজনীতির খেলাটা এখানেই। বাঙালির সব বিষয়ে একমাত্র রবীন্দ্রনাথকেই ধারণ করতে হবে, অনুসরণ করতে হবে এমনতো কোন দিব্যি নেই। কারণ বাঙালিরও রকমফের আছে, তাদের চিন্তা-চেতনায় বৈপরীত্য আছে। যে জন্যে রবীন্দ্রনাথ সব বাঙালির জীবন যাপনকে ধারণ করে না। তাই সব বাঙালির সংস্কৃতি ইতিহাসও রবীন্দ্রনাথে সমর্পিত নয়।
এত কিছুর পরও রবীন্দ্রনাথকে প্রিয়ের তালিকা থেকে তফাতে রাখা যাবে না। কারণ তিনি বাংলা ভাষা-সাহিত্য সমৃদ্ধ করেছেন। বিশ্ব সাহিত্য আসরে স্থান করে দিয়েছেন। তাই তাকে নিয়ে রাজনীতি না করে তার সাহিত্য পাঠে মনোযোগী হওয়া অধিক উপকারের। রাজনীতি এবং সাহিত্য দুটি অনেক সময় এক নাও হতে পারে। যে জন্যে রবীন্দ্রনাথের রাজনৈতিক মনোভঙ্গিকে স্পষ্ট করতে গেলে সত্যকে উপস্থাপন করাই শ্রেয়। প্রকাশে ধুয়াশা জড়িয়ে থাকলে রবীন্দ্রনাথ যেমন ভুলের চুরাবালিতে আটকে থাকবেন, পাঠকগণও সঠিক তথ্য জানা থেকে বঞ্চিত হবেন। রবীন্দ্রনাথ নিয়ে রাজনীতি বা রবীন্দ্রনাথের রাজনীতি ব্যাপারে যতটা বিভ্রান্তির বাইরে থাকা যায় ততটাই মঙ্গল।

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন