বৃহস্পতিবার, ৩১ মে, ২০১২

পুঁজিবাদী-সাম্রাজ্যবাদী বিশ্বায়নের নগ্নরূপ

কনক জ্যোতি

বিগত দুই দশকের পৃথিবীতে নিজের একক মদমত্ত শক্তিতে  পুঁজিবাদ প্রচন্ড আগ্রাসী থাবায় সবকিছু তছনছ করে দিচ্ছে। পৃথিবী এবং এর  মানব সমাজকে ভাসিয়ে দিচ্ছে যুদ্ধ, রক্ত, মৃত্যু, ক্ষুধা, দারিদ্র্য ও নিপীড়নের বিভীষিকায়। পুঁজিবাদের রাজনৈতিক প্রতাপ সাম্রাজ্যবাদরূপী ভয়াল অক্টোপাসের বর্বরতায় গ্রাস করেছে মানব সভ্যতাকে। পুঁজিবাদ-সাম্রাজ্যবাদের একচ্ছত্র দাপটের নৃশংস ধারার নাম দেয়া হয়েছে ‘বিশ্বায়নের যুগ', যেখানে তাবৎ পৃথিবী বন্দি পশ্চিমা সভ্যতার অসভ্য আর্থ-সামাজিক-রাজনৈতিক-সাংস্কৃতিক-মনোদার্শনিক বলয়ে।
সমাজতন্ত্রের পতিত-পচা লাশের ওপর দাঁড়িয়ে বিগত নববই দশকে পুঁজিবাদ-সাম্রাজ্যবাদের সর্বাত্মক নবউত্থান সংঘটিত হয়। সে সময় মানবিকতা ও সাম্যের সুমহান আদর্শে বিশ্বের দেশে দেশে মানবমুক্তির মহামন্ত্ররূপে ইসলামের পুনর্জাগরণ ঘটে। সামগ্রিক জীবনব্যবস্থা হিসেবে ইসলামের সম্ভাবনাকে ঠেকাতে তখন পশ্চিমের পন্ডিতকুল এবং বিশ্বের দেশে দেশে তাদের লোকাল এজেন্টগণ ইসলামের বিরুদ্ধে তথাকথিত মৌলবাদ, জঙ্গীবাদ, ধর্মান্ধতা ও সাম্প্রদায়িকতার লেভেল লাগিয়ে ইসলামমুখী জনমতকে বিভ্রান্ত করতে সচেষ্ট হয়। তখন সেইসব জ্ঞানপাপী তারস্বরে চিৎকার করতে থাকে পুঁজিবাদের পক্ষে। বলতে থাকে, পুঁজিবাদ হলো উদার, গণতান্ত্রিক, ব্যক্তিস্বাধীনতাপন্থী ইত্যাদি ইত্যাদি। মাত্র দুই দশকেই পুঁজিবাদের দানবীয় শরীর থেকে দুর্গন্ধ বের হওয়া শুরু করেছে। আশঙ্কা করা হচ্ছে, পুঁজিবাদও অচিরেই ইতিহাসের অাঁস্তাকুড়ে গিয়ে সমাজতন্ত্রের পতিত-পচা লাশের পাশে ঠাঁই নেবে।
ইউরো-আমেরিকার একশ্রেণীর পন্ডিত গত দুই দশকে বিশ্বব্যাপী প্রচার চালিয়েছিলেন যে, সাম্প্রতিক সময়ের পুঁজিবাদের চেহারাটা হলো ‘মানবিক' (!)। কিন্তু তাদের সেই চড়া সুরের গান গত শতকে পুঁজিবাদ নিজেই বাতিল করে দেয় নিজ কুকর্ম দিয়ে, নিজ নির্মমতা দিয়ে, সারা দুনিয়ায় লাখ লাখ মানুষকে বেকার বানিয়ে, কোটি কোটি মানুষকে অনাহারে রেখে এবং সংখ্যাতীত নারী ও পুরুষকে যুদ্ধ, হত্যা, রক্ত, মৃত্যুর বিভীষিকার মধ্যে ফেলে দিয়ে।
বিশ্ব খাদ্য ও কৃষি সংস্থা-এর ‘ক্ষুধা' সংক্রান্ত ২০০৯ সালের বার্ষিক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, সাম্প্রতিক সময়ে সারা বিশ্বে একশত কোটির বেশি মানুষ খিধে পেটে ঘুমিয়েছেন। খাদ্য ও আর্থিক সঙ্কট বিশ্বব্যাপী ক্ষুধার্ত মানুষের সংখ্যা ঐতিহাসিক পর্যায়ে বাড়িয়ে তুলেছে। এই অনাহারী মানুষদের অধিকাংশেরই বাস গরিব দেশগুলোতে। এশিয়া-প্রশান্ত মহাসাগরীয় এলাকায় ৬৪ কোটি ২০ লাখ, আফ্রিকার সাহারা সন্নিহিত এলাকায় ২৬ কোটি ৫০ লাখ, লাতিন আমেরিকা ও ক্যারিবীয় অঞ্চলে ৫ কোটি ৩০ লাখ, নিকট-প্রাচ্য ও উত্তর আফ্রিকায় ৪ কোটি ২০ লাখ। সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ তথ্য হলো পৃথিবীর সবচেয়ে ধনী দেশ হিসেবে পরিচিত দেশটিতে দীর্ঘকাল ধরে থাকা অনাহারী মানুষের সংখ্যা ছিল দেড় কোটি। 
আদি-অন্তহীন বিপুল-বিশাল বৈশ্বিক ক্ষুধার্ত মানুষের ওপর পুঁজিবাদ যখন একের পর এক আক্রমণ শাণাচ্ছে, বিশ্বায়ন তখন পুঁজিবাদের একান্ত সহযোগীর মতো দাঁড়িয়েছিল। অথচ একশ্রেণির পশ্চিমা পন্ডিত এহেন বিশ্বায়নের মাঝেই দেখেছিলেন ‘মানুষের বেঁচে থাকার জীয়নকাঠি'! আজকাল অবশ্য এ পন্ডিতরা এ বিষয়ে আর মুখ খোলেন না। ‘মানবিক' পুঁজিবাদের মতোই ‘মহান' বিশ্বায়ন এ পন্ডিতদের হাস্যকর-দালালির চেহারাটি সারা বিশ্বের সামনে নগ্নভাবে দেখিয়ে দিয়েছে।
বিশ্ব খাদ্য ও কৃষি সংস্থার মহাপরিচালক বিগত নববই'র দশকেই বলেছিলেন, ‘‘ক্ষুধাকে হটিয়ে দেয়ার অর্থনৈতিক ও কারিগরি উপায় আমাদের আছে। যা নেই, সেটা হচ্ছে, ক্ষুধা চিরতরে দূর করার রাজনৈতিক ইচ্ছা।’’ অনেক আগে, ১৯৭৪ সালে, তৎকালীন মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. হেনরি কিসিঞ্জারও প্রায় একই রকমের একটি কথা বলেছিলেন, যা ছিল কিসিঞ্জারের মুখ দিয়ে বের হওয়া স্বল্পসংখ্যক সত্য-কথার একটি: ‘‘ক্ষুধা অবসানের সামর্থ্য বিশ্বের রয়েছে। তা করায় ব্যর্থতা অক্ষমতার প্রতিফলন নয়, রাজনৈতিক ইচ্ছার অভাবেরই প্রতিফলন।’’
পুঁজিবাদ কখনওই লাভ ও ব্যবসায়িক স্বার্থবিহীন এমন কোনও রাজনৈতিক সদিচ্ছা প্রকাশ করে না। খাদ্যদ্রব্যের ব্যবসা ও মুনাফার জন্যেই পুঁজিবাদ বিশ্বে খাদ্যের প্রাকৃতিক বা কৃত্রিম সঙ্কট চায়; ক্ষুধার্ত মানুষের বিপন্ন মুখ দেখতে চায়। ফলে গত দশক ক্ষুধা অবসানে পুঁজিবাদী বিশ্ব ব্যবস্থার রাজনৈতিক ইচ্ছার অভাব প্রকটভাবে দেখা গেছে। পৃথিবীর নানা জায়গায় গরীবদের আয়ের অধিকাংশটুকুই খরচ করতে হয়েছে খাবার কেনায়। দশকটির শেষ ভাগে অন্যতম ঘটনা ছিল বিভিন্ন দেশে খাদ্য-দাঙ্গা। বিশ্ব খাদ্য সংস্থার হিসাব অনুযায়ী ২০০৮ সালে ৩৭টি দেশে খাদ্যের জন্যে দাঙ্গা হয়। হাইতির অনেক মানুষকে শুকনো বা ভিজা কাদা খেয়ে ক্ষুধা মেটাতে হয়। একই সময়কালে বিশ্বের দেশে দেশে খাদ্যদ্রব্যের দাম এত বেড়ে যায় যে, প্রায় সব দেশের সরকার বিচলিত ও শঙ্কিত হয়ে পড়ে স্থিতিনাশের আশঙ্কায়।
পুঁজিবাদের শোষণের কারণে গরীব আর দেউলিয়া মানুষ কেবল দক্ষিণ গোলার্ধের বৈশিষ্ট্য হয়ে থাকেনি; পুঁজিশাসিত বিশ্ব ব্যবস্থার কেন্দ্রস্থ দেশগুলোতেও অবস্থান করেছিল এবং এখনও করছে। যুক্তরাষ্ট্রের পশ্চিম ভার্জিনিয়ায় ফুড স্ট্যাম্পের ওপর নির্ভরশীল মানুষের সংখ্যা ছিল সেখানকার মোট জনসংখ্যার ১৬ শতাংশের বেশি। সবচেয়ে বেশি ছিল সে দেশের রাজধানী ওয়াশিংটন ডিসিতে, ২০০৯ সালের জানুয়ারি মাসে ১৭.১ শতাংশ। এর এক বছর আগে এ হার ছিল ১৫.১ শতাংশ। মিসিসিপি (২০০৮ সালের জানুয়ারিতে ১৫.০ এবং ২০০৯ সালের জানুয়ারিতে ১৬.৬ শতাংশ), মিসৌরি একই সময়কালে যথাক্রমে ১৪.৮ এবং ১৬.৮, টেনেসি ১৪.৫ এবং ১৬.৬ শতাংশ। ইডাহোতে ফুড স্ট্যাম্পের ওপর নির্ভরশীল মানুষের সংখ্যা এক বছরে বেড়ে যায় ৩২ শতাংশ, নেভাডা, উটা ও ফ্লোরিডায় তা বৃদ্ধি পায় প্রায় ২৯ শতাংশ। এ পরিসংখ্যান জানিয়েছে যুক্তরাষ্ট্র কৃষি মন্ত্রণালয়ের খাদ্য ও পুষ্টি সার্ভিস। উল্লেখ করা দরকার যে, যুক্তরাষ্ট্রে দারিদ্র্য পরিমাপের একটি নির্ভরযোগ্য পন্থা হচ্ছে ফুড স্ট্যাম্পের ওপর নির্ভরশীল মানুষের সংখ্যা। গত দুই দশকেই যুক্তরাষ্ট্রে ‘ফুড ইনসিকিওর' বা ‘খাদ্যের দিক থেকে নিরাপত্তাহীন' এবং ‘ভেরি লো ফুড ইনসিকিওর' বা ‘খাদ্যের দিক থেকে খুবই নিরাপত্তাহীন' নামে দু'দল অতি দরিদ্র মানুষের অস্তিত্ব আর অস্বীকার করে রাখা সম্ভব হয়নি। পুঁজিবাদের সেই স্বর্গে বেঁচে থাকার জন্য দরকার এমন পরিমাণ ক্যালোরি কেনার মত অর্থ বা ঋণ এই মানুষদের ছিল না। সে দেশে গত দুই দশকের শেষ বড় দিনের উৎসবগুলোতে লঙ্গরখানায় দেখা গেছে হাজার হাজার নিরন্ন মানুষের লম্বা লাইন। কেবল টেক্সাসে ফুড স্ট্যাম্পের ওপর নির্ভর করা মানুষের সংখ্যা ছিল ৩০ লাখ। সারা যুক্তরাষ্ট্রে ফুড স্ট্যাম্প পেয়েছে প্রায় তিন কোটি ২০ লাখ আমেরিকানবাসী। অনুমান করা হয় যে, যুক্তরাষ্ট্রে আরও অন্তত এক কোটি মানুষ ফুড স্ট্যাম্প পায় না, যদিও তা তাদের দরকার। নিয়ম অনুযায়ী ফুড স্ট্যাম্পে একজন ব্যক্তি সর্বাধিক পান সপ্তাহে প্রায় ৫০ ডলার; সে হিসাবে প্রতি বেলা খাবারের জন্য সে মানুষটির কপালে বরাদ্দ হচ্ছে মাত্র দু ডলারের কিছু বেশি। আমেরিকার বাজারে দু ডলার খুবই তুচ্ছ অঙ্ক। পুঁজিবাদের মোড়ল তার নাগরিকদের এটাও দিতে পারছে না।
ধনী দেশের বিপরীতে গরীব দেশগুলোতে অবস্থা কেমন ছিল বিশ্বায়নের যুগে পুঁজিবাদের সর্বগ্রাসী এই পরিস্থিতিতে? যুদ্ধ, খরা, মহামারী ও সাম্রাজ্যবাদ-পুঁজিবাদ সৃষ্ট নানা দুর্যোগের কবলে নিপতিত হয়ে দারিদ্র্য ও অনাহারের বিশ্বায়িত মানব-মুখমন্ডল বিশ্বের সর্বত্র দেখা গেছে। এমনকি, পুঁজিবাদ-সাম্রাজ্যবাদের প্রধান দোসর যুক্তরাজ্যও রেহাই পায়নি। যুক্তরাজ্যের মানুষের মধ্যে  অসচ্ছল হওয়ার হার ২০০৯ সালে বৃদ্ধি পায় ২৮.২ শতাংশ। পরিসংখ্যান এটাও জানিয়েছে যে, প্রতি বছরই ব্রিটেন-যুক্তরাজ্যে প্রতি ৬০ জনে একজন অসচ্ছল হয়ে পড়ে। ব্রিটিশ কোম্পানিগুলোতে দেউলিয়াত্বের লাল বাতি জ্বলার হার ছিল ৫০ শতাংশ।
পুঁজি যখন মন্দ অবস্থার মুখোমুখি হয়, তখন শ্রমের ওপরেও চাপ পড়ে। বিগত দুই দশকে এবং বর্তমানেও সেটাই দেখা যাচ্ছে। আর এটাই হচ্ছে পুঁজিবাদের ত্রুটি ও অক্ষমতার নানামুখী প্রকাশ। আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থার (আইএলও) ‘গ্লোবাল এমপ্লয়মেন্ট ট্রেন্ডস টু ২০০৯' শীর্ষক প্রতিবেদনের তথ্য অনুসারে ২০০৯ সালে বিশ্বে পাঁচ কোটিরও বেশি মানুষ কর্মহীন-বেকার হয়েছে। সারা দুনিয়ায় তালিকাভুক্ত বেকারের সংখ্যা আইএলও-এর মতে ২৫ কোটি। পুঁজিবাদের মহাসঙ্কটের কারণে আরও ২০ কোটি মজুর চরম দারিদ্রে্যর মধ্যে চলে যাবে এবং এর ফলে ২০১০ সালটি থেকে বিশ্বে ‘শ্রমজীবী গরিবের' সংখ্যা দাঁড়াবে ১৫০ কোটি। এ সংখ্যা বিশ্বের সমগ্র শ্রমজীবী মানুষের মোট সংখ্যার অর্ধেক। ‘দ্য কস্ট অব কোআরশন' নামের আরেকটি গবেষণা প্রতিবেদনে আইএলও জানিয়েছে যে, বর্তমান বিশ্বায়নের যুগে পুঁজিবাদী অর্থ ও সমাজ ব্যবস্থায় সাম্রাজ্যবাদী প্রক্রিয়ায় ‘বলপূর্বক মেহনত আদায়ের মাধ্যমে দুনিয়ার মজুরদের কাছ থেকে বছরে শোষণ করে নেওয়া হচ্ছে ২০ বিলিয়ন বা দুই হাজার কোটি ডলার'।
বিশ্বায়নের যুগে পুঁজিবাদী অর্থ ও সমাজ ব্যবস্থায় সাম্রাজ্যবাদী প্রক্রিয়ার মধ্যে আরও অনেক বীভৎস ক্ষত লক্ষ্য করা যাচ্ছে। বর্তমান মহা আর্থিক সঙ্কটের ফলে পৃথিবী জুড়ে মানুষ পাচার বেড়ে যাওয়ার আশঙ্কা ব্যক্ত করেছে বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সংস্থা। ওইসিডি-এর হিসাব অনুসারে দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় বেকারত্বের ৭০ শতাংশ অনানুষ্ঠানিক খাতভুক্ত। আইএলও-এর তথ্য অনুসারে বিশ্বে বলপূর্বক মেহনত করানোর ৭৭ শতাংশই ঘটে এই অঞ্চলে। পূর্ব ইউরোপে শ্রম-শোষণের শিকার মানুষের সংখ্যাও বেড়েছে। বেলারুশে ৮০ হাজার মানুষ ‘নিখোঁজ' বলে তথ্য প্রকাশিত হয়েছে। অনুমান করা হচ্ছে, এরা কাজ করার জন্য রাশিয়াসহ বিভিন্ন পার্শ্ববর্তী দেশে গেছে; কিন্তু অস্তিত্ব রক্ষার জন্য নানা স্থানে, এমনকি জেল-হাজতে ঠাঁই পেয়েছে। এদের আর কোনও স্থায়ী বা নির্দিষ্ট ঠিকানাও পাওয়া যাচ্ছে না। ইউরোপের সবচেয়ে গরিব দেশ হিসাবে পরিচিত মলদোভার এক-চতুর্থাংশ মানুষ দেশান্তরী হতে বাধ্য হয়েছে। এরা জীবিকার তাগিদে অনিশ্চিত গন্তব্যে হারিয়ে গেছে।
খোদ জাতিসংঘের কর্তারাও স্বীকার করেছেন যে, সস্তা পণ্য আর সেবার চাহিদা বিশ্বব্যাপী আধুনিক দাস ব্যবস্থার সৃষ্টি করেছে। উল্লেখ করা দরকার যে, আধুনিক কালের (বিশ্বায়নের পুঁজিবাদী-সাম্রাজ্যবাদী কালের) এ দাস ব্যবস্থা হচ্ছে বলপূর্বক মজুর খাটানো। জাতিসংঘের কর্তাদের আশঙ্কা যে, আর্থিত সঙ্কটের প্রতিক্রিয়ায় আরও শিল্প ও ব্যবসা প্রতিষ্ঠান কর ফাঁকি দেয়াসহ নানা বেআইনি তৎপরতার চেষ্টা চালাবে; নিজ প্রতিষ্ঠানে মজুরদের সঠিক তথ্য দেবে না; এদের বেতন ও চাকরির কোনও নিয়ম মানা হবে না। এ উদ্দেশ্যে এ সব শিল্প ও ব্যবসা প্রতিষ্ঠানকে অনেক কাজ-কারবার করতে হবে অতি গোপনে বা অনৈতিক-অবৈধ পথে। আর্থিক সঙ্কটের মুখে থাকা অনেক নামকরা বহুজাতিক কোম্পানি পর্যন্ত বলপ্রয়োগ, সস্তা মজুরি, শিশু শ্রম, নারী শ্রম লুণ্ঠনসহ নানাবিধ অপকর্মে লিপ্ত হচ্ছে। আর এগুলোই হচ্ছে পুঁজিবাদী-সাম্রাজ্যবাদী বিশ্বায়নের ‘উপহার'।
ইত্যাকার কারণে পৃথিবীতে যে কোনও সময়ের চেয়ে গত দুই দশকে এবং বর্তমান সময়ে শ্রমিক অসন্তোষ তীব্রতর হয়। শ্রমিক-মজুরদের প্রতিবাদ-বিক্ষোভ বৃদ্ধি পাওয়া শোষণের তীব্রতার বিরুদ্ধে প্রতিক্রিয়ারূপে চিহ্নিত করা যায়। অনেক জায়গায় মালিকরা মজুরদের পাওনা পারিশ্রমিক দেয়নি; অনেক জায়গায় মজুরদের বাধ্য করা হয়েছে সম্মত কর্মশর্তাবলীর চেয়ে খারাপ অবস্থায় কাজ করতে। ইউরোপের কোনও কোনও দেশে চীনা মজুররা প্রবল শোষণের মধ্যে পড়েছেন। বিদেশী মজুরদের মজুরি না দেয়া সংক্রান্ত অভিযোগ কোনও কোনও দেশে ১১১ শতাংশ বৃদ্ধি পায়। চীনের শ্রম অবস্থার কারণে প্রায় দুই কোটি শ্রমিক কাজ ছেড়ে স্ব স্ব গ্রামে ফিরে যেতে বাধ্য হয়। ফিলিপাইনে কাজ হারিয়েছে ১৮ লাখ মানুষ (২০০৯ সালে)। যুক্তরাষ্ট্র, জিব্রাল্টার, মিসর, ফ্রান্স, মেক্সিকো, চিলি, রাশিয়া, ভারত, গ্রীস, বাংলাদেশ এবং আরও অনেক দেশে মজুরদের বিভিন্ন ধরনের আন্দোলন ঘটে গত দশকে। যুক্তরাষ্ট্রে মজুররা কারখানা দখল করে নেয়। সেই মজুরদের প্রতি খোলা সমর্থন জানায় সমাজের সর্বস্থরের মানুষ। বিক্ষোভ কোথাও কোথাও দাঙ্গায় রূপ নেয়। এ সব দাঙ্গা ছিল পুঁজির যাত্রাপথ নিশ্চিত করতে নানা চেষ্টার বিরুদ্ধে জনমানুষের সুস্পষ্ট বিরোধিতার প্রকাশ।
পুঁজিবাদ-সাম্রাজ্যবাদের আরেকটি বিশ্বব্যাপ্ত নগ্নরূপ দেখা যাচ্ছে নানা ধরনের একতরফা হামলা, চাপিয়ে দেওয়া যুদ্ধ, আগ্রাসনের রক্তাক্ত ধারা ও সামরিক-সশস্ত্র রণ-হুঙ্কার ইত্যাদি বর্বর আচরণের মাধ্যমে। চলছে বিশ্বের প্রাকৃতিক সম্পদ ও ভূ-রাজনীতিগত দিক থেকে গুরুত্বপূর্ণ এলাকাগুলোতে দখলদারিত্ব, সামরিক তৎপরতা ও সামরিক ঘাঁটি বিস্তারের অব্যাহত ধারায়। বিশ্বব্যাপী সন্ত্রাসী বোমা হামলা, আফগানিস্তান ও ইরাকে আক্রমণ, পাকিস্তানে যুদ্ধের বিস্তৃতি, শ্রীলঙ্কায় সংঘাত, আফ্রিকার দেশে দেশে বিশৃক্মখলা সৃষ্টি, নানা দেশে সরকার উৎখাতের মাধ্যমে দালাল ও তাবেদারদের ক্ষমতায় বসানো, দক্ষিণ ওসেটিয়া যুদ্ধ, চেচনিয়ায় সামরিক অভিযান, দারফুরে হত্যাযজ্ঞ, কঙ্গোয় যুদ্ধ ইত্যাদি ঘটনার মাধ্যমে পুঁজিবাদ-সাম্রাজ্যবাদ বিশ্বের শান্তি বিনষ্ট করে চলেছে। পুঁজিবাদ-সাম্রাজ্যবাদ তথা পশ্চিমা ইউরো-আমেরিকান গোষ্ঠীর লাঠিয়াল বাহিনী নামে কুখ্যাত ন্যাটোর বিস্তৃতি আরও বৃদ্ধি করার মাধ্যমে সঙ্কট ও উত্তেজনাকেও বাড়িয়ে তোলা হয়। সোমালিয়ার উপকূলে নাটকীয় ও রহস্যজনকভাবে উত্থান ঘটানো হয় জলদস্যুদের। পৃথিবীর বিভিন্ন ক্ষুদ্র রাষ্ট্রকে ব্যর্থ বা আধা-ব্যর্থ রাষ্ট্রে পর্যবসিত করা হয় নানা হস্তক্ষেপ ও ইন্ধনের মাধ্যমে। বিভিন্ন সম্পদে সমৃদ্ধ রাষ্ট্রগুলোকে ব্যর্থ বা অর্ধ-ব্যর্থ লেবেল দিয়ে সেগুলোকে দুর্বল করা হয় এবং সেখানে বহুজাতিক কোম্পানিগুলোর হস্তক্ষেপের পথ উন্মুক্ত করে দেয়া হয়। সামগ্রিকভাবে আন্তর্জাতিক লুটপাটের একটি অবাধ চারণভূমিতে পরিণত করা হয়েছে পৃথিবীকে।
ইউরো-আমেরিকার পুঁজিবাদ-সাম্রাজ্যবাদী চক্রের কুকাজ সম্পর্কে আরও স্পষ্ট ধারণা পাওয়া যাবে অস্ত্র প্রতিযোগিতা ও অস্ত্র উৎপাদনের হিড়িক দেখে। বিশ্ব শান্তিপূর্ণ ও স্বাভাবিকভাবে চললে এতো অস্ত্রের প্রয়োজন হতো না। অস্ত্রের বিস্তার প্রমাণ করছে যে, পুঁজিবাদ-সাম্রাজ্যবাদ পৃথিবীর মানব সভ্যতার বিরুদ্ধে একটি গোপন ও অঘোষিত যুদ্ধে লিপ্ত রয়েছে। পুরো পরিসংখ্যান জানা না গেলেও বিশ্বের একশটি বড় অস্ত্র উৎপাদন কোম্পানির অস্ত্র বিক্রির পরিমাণ ২০০৬ সালে ছিল ৩১৫ বিলিয়ন মার্কিন ডলার। এর মধ্যে ৬৩ শতাংশ ছিল ৪১টি মার্কিন কোম্পানির, পশ্চিম ইউরোপের ৩৪টি কোম্পানির ছিল ২৯ শতাংশ। রুশ অস্ত্র তৈরি কোম্পানিগুলোরও বিপুল বৃদ্ধি ঘটে। উত্তর আমেরিকা ও পশ্চিম ইউরোপীয় অস্ত্র শিল্পে ২০০৭ সালে একীভূত হওয়া ও কিনে নেয়ার ৫০টি তাৎপর্যপূর্ণ ঘটনা ঘটে। এগুলোর মধ্যে তিনটি ছিল ইউরোপে আন্তঃসীমান্ত ও ১৬টি ছিল আন্তঃআটল্যান্টিক। আন্তঃআটল্যান্টিক একীভূত হওয়া ও কিনে নেয়ার প্রায় সবক'টি ঘটনাই ছিল ব্রিটিশ ও আমেরিকান কোম্পানিগুলোর মধ্যে। আরও সংহত আন্তঃইউরোপীয় ইউনিয়নভিত্তিক অস্ত্র শিল্প ও বাজার গড়ে তোলার জন্য অব্যাহত রাজনৈতিক ও কৌশলগত উদ্যোগ অব্যাহত ছিল এবং সেটা এখনও রয়েছে। এ লক্ষ্যে ইউরোপীয় প্রতিরক্ষা সংস্থা সামরিক-রণনীতিগত দু'টি দলিলের ব্যাপারে একমতও হয়েছে। একটি হচ্ছে, ইউরোপীয় প্রতিরক্ষা কারিগরি ও শিল্প ভিত্তি সংক্রান্ত। অপরটি, সামরিক গবেষণা ও প্রযুক্তি কর্মনীতি সংক্রান্ত। এরই ধারাবাহিকতায় ১৯৯৯ থেকে ২০০৮, এই সময়কালে বিশ্ব সামরিক ব্যয় ৪৫ শতাংশ বৃদ্ধি পায়। সামরিক ব্যয়ের দিক থেকে সাম্প্রতিক সময়ে শীর্ষস্থানীয় ১০টি দেশ হচ্ছে যুক্তরাষ্ট্র, চীন, ফ্রান্স, যুক্তরাজ্য, রাশিয়া, জার্মানী, জাপান, ইতালি, সৌদি আরব ও ভারত। স্টকহোমভিত্তিক ‘ইন্টারন্যাশনাল পিস রিসার্চ ইন্সটিটিউট'-এর গবেষণা তথ্যে জানা যায় যে, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সামরিক ব্যয় দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পরে প্রকৃত অর্থে সর্বোচ্চ স্তরে পৌঁছিয়েছে। এর আরেকটি প্রমাণ হলো, ব্যাপকভাবে সংঘাত-গৃহযুদ্ধ, দাঙ্গা-হাঙ্গামা যুদ্ধের প্রকোপ। পরিসংখ্যান জানাচ্ছে যে, ২০০৭ সালে বিশ্বের ১৩টি স্থানে ১৪টি বড় ধরনের সশস্ত্র সংঘর্ষ ঘটে। ২০০৮ সালে এসে এর সংখ্যা দাঁড়ায় ২৬টিতে। এর ফলে মানবাধিকার ও শান্তি ইতিহাসে সবচেয়ে চরম বিপদের মধ্যে পড়েছে।
পুঁজিবাদ-সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে সাধারণ মানুষ তাদের জীবনকে সুখী, শান্তিপূর্ণ, স্থিতিশীল ও সমৃদ্ধ করার জন্য সম্পদ বণ্টন ও ভোগ ব্যবস্থা থেকে বৈষম্য দূর করতে সমাজের আমূল পরিবর্তনের প্রয়াস চালায়। বিশ্বের নানা প্রান্তে এ কারণেই মানবমুক্তির মহামন্ত্ররূপে ইসলামের দ্রুত বিকাশ ঘটতে থাকে। যুদ্ধ বা বলপ্রয়োগে পুঁজিবাদী-সাম্রাজ্যবাদী চক্র মানুষের এই বিশ্বাস ও আস্থার জায়গাটিকে দখল করতে পারেনি। ফলে চলে অন্য খেলা। দেখা যায়, সাধারণ মানুষের পরিবর্তনমুখী বা ইসলামপ্রিয় প্রয়াসকে সরিয়ে চলতি ব্যবস্থার মধ্যেই আটকে রেখে বিদ্যমান পুঁজিবাদী-সাম্রাজ্যবাদী অবস্থাটি টিকিয়ে রাখার জন্য প্রয়োগ করা হয় এনজিও-পন্থা। বৈষম্যের মূল কারণ দূর করার পথে নেয় না এ পন্থা। এ পন্থার অন্যতম পরীক্ষাগার আফ্রিকার দেশগুলো, বাংলাদেশ, নেপাল। কিন্তু সকল দেশেই এনজিও-পন্থা পুঁজিবাদ-সাম্রাজ্যবাদের গুচ্ছ-গুচ্ছ দালাল ও বশংবদ তৈরি করে এই বিশ্ব শোষকদের সাহায্য করা ছাড়া আর কিছুই করতে পারেনি। প্রমাণ হয় যে, সমাজের মধ্যকার শোষণ ও অব্যবস্থা এনজিওগুলো নিরসন করতে পারেনি। বরং শোষণ ও অবস্থার দুষ্টচক্রে মানুষকে বিভ্রান্ত করতে পারে। পাশাপাশি মানুষের মধ্যকার দেশপ্রেমিক-বিশ্বাসী-সংগ্রামশীলতাকেও ধ্বংস করে দিচ্ছে পুঁজিবাদী বিশ্বের মদদপ্রাপ্ত এনজিওগুলো।
পুঁজিবাদী-সাম্রাজ্যবাদী পশ্চিমা বিশ্ব চলমান বিশ্বায়নের যে সংজ্ঞা ও সীমা নির্ধারিত করেছে, বিগত দুই দশকে পৃথিবীতে জ্বালিয়ে দিয়েছে নরকের অগ্নিকুন্ড। চলছে দুটি যুদ্ধের আগুন; সময়ের মাপকাঠিতে এই দুই যুদ্ধের আগুন, ইরাক ও আফগানিস্তান, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ থেকে দীর্ঘতর। লাখ লাখ মানুষ, যারা ঘটনাচক্রে নয়, সুনির্দিষ্ট আক্রমণের কারণে মারা যাচ্ছে, তাদের পরিচয় হলো মুসলমান। লেবানন ও মধ্যপ্রাচ্যের রক্ত আর মৃত্যু দিনে দিনে ক্লান্ত হয়ে যাওয়ায় এবং প্রতিরোধের মুখে গণঅভ্যুত্থানের দিকে চলে যাওয়ায়, পশ্চিমা বন্দুক-বোমা-আক্রমণের দিক বদল হয়েছে এক মুসলিম জনপদ থেকে আরেক মুসলিম অঞ্চলে। পুঁজিবাদ-সাম্রাজ্যবাদ পৃথিবী ও এর মানুষকে শোষণ ও নির্যাতন করছে---এটা খুবই সত্য কথা। কিন্তু এর চেয়ে নির্মম সত্য হলো শোষণ, নির্যাতন, আক্রমণ হচ্ছে কেবল মুসলিম অঞ্চলেই। সমাজতন্ত্রের লাশের ওপর একচ্ছত্রভাবে দাঁড়িয়ে বসনিয়ার মুসলমানদের নিধনের মাধ্যমে যার সূচনা ঘটেছিল, সেটা এখন ইরাক ও আরব বিশ্বের তেল, আফগানিস্তান থেকে মধ্য এশিয়া পর্যন্ত দেশসমূহের জ্বালানি, প্রাকৃতিক সম্পদ ও ভূ-কৌশলগত অঞ্চলের অধিকার হরণের ক্ষেত্রে পর্যন্ত বিস্তার লাভ করেছে। পুঁজিবাদী-সাম্রাজ্যবাদী পৃথিবীর মানচিত্রের জ্বলন্ত ও রক্তাক্ত অংশটুকুর আজকের পরিচয় হলো মুসলিম জগত।
বিশ্বায়নের পুঁজিবাদী-সাম্রাজ্যবাদী বিশ্বায়নের পৃথিবীর মানুষ দেখতে পাচ্ছে শত-শত কোটি মানুষ কান্না ও রক্তে ভেসে যাচ্ছে। ভেসে যাচ্ছে তাদের জীবন, সম্পদ, সংগ্রাম, ভূখন্ড, এমনকি, পায়ের তলার মাটিটুকুও। ভেসে যাচ্ছে তাদের পরিচয়, অস্তিত্ব, বিশ্বাস আর অধিকার। এই আক্রান্ত মানুষের মৌলিক পরিচয়, তারা মুসলমান। তাদের রক্তে ভেজা পুঁজিবাদ-সাম্রাজ্যবাদ আরও আরও মুনাফা ও লুটপাটের জন্য পাগলা ঘোড়ার মতো দাপিয়ে বেড়াচ্ছে তাবৎ বিশ্ব---যার হাত থেকে শান্তিকামী কোনও মানুষেরই রেহাই পাওয়ার সুযোগ নেই। মানুষের স্বপ্ন, সংসার, দেশ, জনপদ তছনছ করতে করতে এই উন্মাদ পুঁজিবাদ-সাম্রাজ্যবাদ পুরো মানব বংশকেই শোষণ ও দারিদ্রে্যর অন্ধ গহবরে ঠেলে দিচ্ছে। যুদ্ধ, উত্তেজনা, দাঙ্গা আর তাবেদার গোষ্ঠীর মাধ্যমে পৃথিবীতে সৃষ্টি করা হয়েছে ইতিহাসের সবচেয়ে বড় ও বীভৎস বিশৃক্মখলা। পুরো মানব সভ্যতাকেই বিষাক্ত শ্বাপদের ছোবলে ছোবলে আক্রান্ত করছে এবং গণমানুষের মুক্তি ও পুনরুত্থানের যে কোনও উদ্যোগকেই নস্যাৎ করছে পুঁজিবাদী সাম্রাজ্যবাদী ইউরো-আমেরিকান চক্র। বানোয়াট পন্ডিতদের মধুর কথায় যে পুঁজিকে বলা হয়েছিল ‘মানবিক', সেই পুঁজি আসলে কতোটা শোষক, কতোটা নিপীড়ক, কতোটা নৃশংস ইতিহাস সেটা আবারও দেখতে পাচ্ছে। যেভাবে সমাজতান্ত্রিক সামাজিক-সম্প্রসারণবাদের আড়ালে মানুষকে মিথ্যা সাম্যের-স্বর্গরাজ্যের প্রলোভন দিয়েছিল সাবেক সোভিয়েট ইউনিয়নের নেতৃত্বাধীন সমাজতান্ত্রিক মতাদর্শ; তেমনিভাবে পুঁজিবাদের রঙিন-মোহময় জগতের ভোগ ও যথেচ্ছাচারের দিকে পৃথিবীর মানুষকে এখন টানছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্বাধীন ইউরো-আমেরিকান পুঁজিবাদী-সাম্রাজ্যবাদী মতাদর্শ। কিন্তু শোষণ-নিপীড়নের ছদ্মাবরণে কোনও অমানবিক দর্শন ও আদর্শই পৃথিবীতে টিকে থাকতে পারে না---তাসের ঘরের মতো ভেঙে পড়ে। ভেঙে পড়ে নমরূদের প্রাসাদের মতো। ৭০ বছরেই ভেঙে পড়েছিল সমাজতান্ত্রিক শোষণ ও নিপীড়ন। পুঁজিবাদী-সাম্রাজ্যবাদের যে বীভৎস-অমানবিক নগ্নরূপ দেখা যাচ্ছে, তাতে এহেন সভ্যতাবিনাশী আদর্শের ৭০ বছরও টিকে থাকার ক্ষমতা নেই। জাগ্রত মানুষের মুক্তির পদতলে অচিরেই কবর রচিত হবে মানবধ্বংসী পুঁজিবাদী-সাম্রাজ্যবাদী বিশ্বায়নের স্বপ্নসাধ।

কাকিসটোক্র্যাসির রাজত্ব


॥ আলমগীর মহিউদ্দিন ॥

Where people fear the government you have tyranny. Where government fears the people you have liberty- John Basil Barnhill (1914)
Government is not reason, it is not eloquent; it is force. Like fire, it is a dangerous servant and a fearful master- George Washington.
এ উদ্ধৃতি দু’টি নিয়ে আলোচনার আগে একটি ক্ষীণ সম্পর্কিত বিষয় লক্ষ করা যেতে পারে। কারণ, শিরোনামের সাথে এর যোগসূত্র রয়েছে। বিষয়টি হলো ভারতের সাবেক সুপ্রিম কোর্টের বিচারক ও বর্তমানে ভারতীয় প্রেস কাউন্সিলের চেয়ারম্যান জাস্টিস মারকান্ডে কাটজুর বক্তব্য। তার পুরনো বক্তব্যগুলোর মতোই ভারতীয় পত্রপত্রিকা ও বোদ্ধা জনগণের মধ্যে এবারের বক্তব্যটিও ঝড় তুলেছে। জাস্টিস কাটজু ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস পত্রিকার এক নিবন্ধে বলেছেন, ‘ভারতের ৯০ শতাংশ মানুষ মানসিকভাবে পিছিয়ে আছে।’ তিনি তাদের ‘বোকা-গাধা (idiot, fools) বলেছেন। তিনি বলেছেন তাদের মানসিকতা ‘যুক্তিসঙ্গত ও বাস্তবসম্মত’ না হওয়ায় তাদের মন ‘বর্ণপ্রথা, সাম্প্রদায়িকতা ও কুসংস্কার’ (Casteism, Communalism and Superstition) আচ্ছন্ন করে রাখে। ফলে ুদ্র স্বার্থবাদী এবং ক্ষমতালোভীরা তাদের সহজেই ব্যবহার ও পরিচালিত করতে পারে। তার মতে, ভারত এ জন্য ক্রমেই পেছনে পড়ে যাচ্ছে এবং তিনি শঙ্কা প্রকাশ করেছেন, একসময় ভারতের অস্তিত্বেই হয়তো হাত পড়বে। তিনি এ স্বার্থবাদীদের অযোগ্য এবং অপরাধীর সাথে তুলনা করেছেন। কয়েক দশক ধরে এমন মানুষেরা প্রায়ই গদি দখল করছে। এমন শাসকদের কারণে ভারতে সামাজিক বিপর্যয় ঘটতে যাচ্ছে। তাদের নিয়ে তিনি মজার উদাহরণও টেনেছেন। ‘শতকরা ৯০ ভাগ ভারতীয় জ্যোতিষশাস্ত্র দিয়ে ভাগ্য গণনায় বিশ্বাসী।’ তিনি জ্যোতিষীদের ‘ধাপ্পাবাজ ও কুসংস্কারাচ্ছন্ন’ (humbug and superstitious) বলে অভিহিত করে প্রশ্ন করেছেন, গ্রহগুলো কেমন করে জীবনকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারে? তিনি দেখিয়েছেন, যে টিভি যত জ্যোতিষচর্চা করে, তার টিআরপি (দর্শকপ্রীতি) তত বেশি।
ক্রিকেটের কথা উল্লেখ করে বলেছেন, এখন এটাকে সংবাদমাধ্যম ও ব্যবসায়ীরা ধর্মের পর্যায়ে নিয়ে গেছে। আফিমের নেশায় যেন জনগণকে বুঁদ করে ফেলেছে। অথচ ৮০ শতাংশ লোকের সমস্যা হলো দারিদ্র্য, চাকরি, খাদ্য, পণ্যের দাম বেড়ে যাওয়া, স্বাস্থ্যসেবা, শিক্ষা ও বাসস্থান। এ নিয়ে এরা মাথা ঘামাচ্ছে না।
আবার আন্না হাজারের বিষয় নিয়ে সংবাদমাধ্যমে এবং রাজনৈতিক অঙ্গনের মাতামাতিকে তিনি ম্যাকবেথের সেই বিখ্যাত উক্তির উদ্ধৃতি দিয়ে বলেছেন, ‘এগুলো মাত্র বাগাড়ম্বর। আসলে দুর্নীতির গায়ে কোনো স্পর্শ লাগেনি।’ (a tale/told by an idiot, full of sound and fury/signifying nothing) জাস্টিস কাটজু তার স্পষ্ট বক্তব্য দিয়ে মাঝে মাঝে ঝড় তোলেন। বিশেষ করে ভারতীয় সাংবাদিকদের ‘মেধাহীন লেজুড়বৃত্তিকে’ তীব্র কশাঘাত করে মন্তব্য করেছেন, তাদের বেশির ভাগই ‘নিম্নমানের বুদ্ধিজীবী’। তিনি বলেছেন, ক্ষমতায় অপরাধী এবং অযোগ্যদের বিশাল উপস্থিতি সমাজের সর্বস্তরে তার প্রভাব পড়ছে।
তবে জাস্টিস কাটজুকে সমর্থন না করেও বিশালসংখ্যক ব্লগার একটি মূূলসুরকে নিয়ে আলোচনা করেছে। তারা বলেছে, বেশ কয়েক দশক ধরে ‘অযোগ্য ও অপরাধীরা’ জনগণকে বোকা বানিয়ে ক্ষমতায় গিয়ে তাদের চিরাচরিত তাণ্ডবলীলা চালাচ্ছে। তাদের প্রচারণা ও নিষ্পেষণের যাঁতাকলে জনগণকে এতই ব্যস্ত রাখা হচ্ছে যে, তারা তাদের সাধারণ চিন্তার অধিকারটুকু হারিয়ে ফেলছে। তারা গতকাল বা আগামীকালের ভাবনার মাঝে ফাঁকটুকু পাচ্ছে না আজকের জীবনে।
আসলে এ অবস্থা এখন তীব্র হলেও এর অবস্থান খুব পুরনো। আর তাই কয়েক শতাব্দী আগেও এমন অবস্থার বর্ণনা মেলে। এমন সরকারকে বলা হয় কাকিসটোক্র্যাসি। এমন সরকারগুলোর দাপট ও তাণ্ডবতা তীব্রতা লাভ করে তত, যত তাদের ব্যর্থতার বোঝা। এখন এ বিষয় নিয়ে বিকল্প সংবাদমাধ্যম এবং বোদ্ধা প্রতিবাদী রাজনৈতিক অঙ্গনে এর বিশাল আলোচনা চলছে। এ বিষয় নিয়ে আলোচকেরা এ ধারণা প্রতিষ্ঠা করতে সক্ষম হয়েছেন যে, প্রথম বিশ্বের নেতৃত্বে সারা বিশ্বে বিশেষ করে তৃতীয় বিশ্বে এখন কাকিসটোক্র্যাসির রাজত্ব চলছে। এবং জনগণকে অবধারিতভাবে এর ফল ভোগ করতে হচ্ছে। এমন অভাবিত ঘটনা প্রতিদিন ঘটছে যে, মানুষের অনুভূতি হারিয়ে যাচ্ছে।
প্রশ্ন উঠবে, বিশেষ করে বাংলা ভাষাভাষীদের কাছে কাকিসটোক্র্যাসি কী? উইকিপিডিয়ার সংজ্ঞা অনুসারে এটা ‘অযোগ্য, দুর্নীতিবাজ ও অপরাধীদের’ সরকার। এটা গ্রিক শব্দ ‘কাকোস’ অর্থাৎ খারাপ (bad) থেকে এসেছে। কাকোসের বহুবচন কাকিসটোস অর্থাৎ ‘অত্যন্ত খারাপ’ (worst)।
এমন সরকারের সংজ্ঞা আগে থাকলেও ১৮২৯ সালে ‘মিসফরচুন অব এলফিন’ উপন্যাসে থোমাস লাভ পিকক প্রথম লিখিতভাবে শব্দটি ব্যবহার করেন। এরপর ১৮৭৬ সালে ব্যঙ্গাত্মক লেখক জেমস রাসেল লোয়েল তখনকার অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে এক চিঠিতে প্রশ্ন করেছিলেন, আমাদের সরকারটি জনগণের (Is our government of the people, by the people, for the people or a Kakistocracy rather, for the benefit of Knaves at the cost of fools?) নাকি শয়তানের (Knave) স্বার্থে, যারা বোকা জনগণকে জিম্মি করেছে (at the cost of fools)। মার্কিন নিবাসী অতনু দে ভারতের কথা লিখতে গিয়ে বলেছেন, যখন সবচেয়ে দুর্নীতিবাজ ও নৈতিকতাহীনদের (most corrupt and least principled) কাকিসটোক্র্যাসির সরকারের বলা হয়, তখন ভারতের উদাহরণটি আসে সর্বাগ্রে। অথচ ভারত বিশ্বের মধ্যে অন্যতম গণতান্ত্রিক দেশ বলে পরিচিত।
উইকিপিডিয়ার মতে, নানা সময়ে ৩২ ধরনের সরকার চালু ছিল, যদিও সাধারণ মানুষ গুটিকয়েক ধরনের কথা বলে থাকে। যেমন গণতন্ত্র। অথচ এপিসটেমোক্র্যাসি, জেনিওক্র্যাসি, লোগোক্র্যাসি, কেপ্টোক্র্যাসি, ক্রিটোক্র্যাসি, থিওডেমোক্র্যাসি, টিমোক্র্যাসি প্রভৃতি সরকার ছিল এবং এখনো চালু আছে ডেমোক্র্যাসির মধ্য দিয়ে। মজার কথা হলো, সরকারের এই নামগুলো বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই এসেছে গ্রিক থেকে, যেখানে প্রথম সরকারের প্রচলন হয়। ডেমোক্র্যাসির জন্মও এখানে। আজ সেই গ্রিস প্রথম বিশ্বে সবচেয়ে রুগ্ণ গণতন্ত্র।
যাই হোক, কয়েক ধরনের সরকার এখন ডেমোক্র্যাসির পৃষ্ঠপোষকতায় কর্মকাণ্ড চালাচ্ছে। যা চলছে তা হলো প্লুটোক্র্যাসি ধনীদের সরকার; টেকনোক্র্যাসি; থিওডেমোক্র্যাসি যা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে প্রচলিত; ক্রিটোক্র্যাসি বিচারকদের দিয়ে পরিচালিত সরকার। এ সরকার চালিত হয় ক্রিটারকি দিয়ে, যেখানে আদালত স্বপ্রণোদিত হয়ে সরকারি কর্মকাণ্ডের জন্য যে রায় দেন; অলিগার্কি সম্ভ্রান্ত ব্যক্তিদের সরকার; অটোক্র্যাসি এবং অ্যানারকি আইন অমান্যকারী সরকার।
খুবই লক্ষণীয় বিষয় হলো, প্রথম বিশ্বসহ দুনিয়াব্যাপী অধুনা ক্রিটারকি চলছে। বিচারকেরা তাদের ক্রিটারকি রায় দিয়ে সরকার পরিচালনা অথবা প্রভাবান্বিত করার কাজে ব্যস্ত। অবশ্য অনেক ক্ষেত্রে কাকিসটোক্র্যাসির নেতারা এমন বিচারক নিয়োগ দেয়, যাতে তারা তাদের অ্যাজেন্ডা বাস্তবায়ন করে। এ জন্য বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই এমন বিচারকেরা দলের সাবেক ক্যাডার বা দলীয় হন। তাদের রায় জনগণকে হতাশ করলেও বোদ্ধা ব্যক্তিরা সহজেই বুঝতে পারেন। এরা সমাজের সোচ্চার প্রতিবাদীদের শক্তি ও বিচারালয়ের অ™ভুত সমন্বয় ঘটিয়ে স্তব্ধ করার প্রয়াস পান। যেমন সংবাদমাধ্যম ও রাজনৈতিক কর্মীদের ওপর হামলা এবং অভূতপূর্ব আদালত নির্দেশনা, যা বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই নাগরিক অধিকার হরণ করে।
তবে এসবের মূলে কাজ করে ফ্যাসিবাদ যা অবশেষে পুলিশি রাষ্ট্রে পরিণত করে। কাকিসটোক্র্যাসির শাসকেরা তাদের অযোগ্যতা, দুর্নীতি ও অপরাধকে আড়াল করতে সরকারের সব অঙ্গকে অনৈতিক পন্থায় ব্যবহার করে। এখন এ যুক্তি সর্বগ্রাহ্য যে, সব সরকারই পরিণতিতে কাকিসটোক্র্যাসিতে পর্যবসিত হয়; আবার এটাও বলা হয়, সব সরকারই এ অবস্থা থেকে শুরু করে। পরে তারা ভালো বা খারাপ হয়। সেকুলারিজম প্রবক্তা বিখ্যাত লেখক লরেন্স ডাবলু ব্রিট বলেছেন, এরা সবাই অন্তত ১৪টি পন্থা কম-বেশি ব্যবহার করে ক্ষমতায় যেতে এবং টিকে থাকতে। এগুলো হলো : ০১. আকর্ষণীয় স্লোগান, দেশের পতাকা এবং বিশেষ ধরনের পোশাক পরে তাদের নির্ধারিত জাতীয়তাবাদ তীব্রভাবে প্রচার করে প্রতিবাদীদের স্তব্ধ বা নির্মূল করা; ০২. মানবাধিকারকে নিন্দা করা বা এমন আলোচনাকে প্রতিরোধের চেষ্টা। কারণ, এরা নিজেরাই মানবতাবিরোধী কর্মকাণ্ডে সর্বদা নিয়োজিত থাকে; ০৩. প্রতিবাদ ও প্রতিবাদীকে এক নম্বর শত্রু হিসেবে চিহ্নিত করে তাদের বিরুদ্ধে প্রচণ্ড প্রচারণা শুরু করা এবং নিজেদের অন্যায়-ব্যর্থতাকে তাদের ওপর চাপিয়ে দেয়া; ০৪. সরকারের সব সশস্ত্র বাহিনীকে নিজেদের রাজনৈতিক মতবাদের আদর্শধারী করা এবং তার জন্য চাকরিচ্যুত, বিচার ইত্যাদি ব্যবস্থা গ্রহণের ভয় দেখানো বা নেয়া হয়; ০৫. যৌনতাকে প্রগতিবাদের অঙ্গ হিসেবে উৎসাহিত করে যুব সম্প্রদায়কে অনৈতিকতার দিকে ঠেলে দিয়ে নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা এবং নারীদের দ্বিতীয় শ্রেণীর নাগরিকে পরিণত করে ভোগের সামগ্রী হিসেবে অভিহিত করা; ০৬. সংবাদমাধ্যমকে সম্পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ করা, প্রয়োজনে বন্ধ করে দেয়া, যাতে জনগণ তাদের অপকর্ম সম্পর্কে কোনো খবর না পায়; ০৭. জাতীয় প্রতিরক্ষা বিষয় নিয়ে প্রচণ্ড মাতামাতি করা এবং এর মাধ্যমে প্রতিবাদী এবং বিরোধী দলকে সম্পূর্ণ নাস্তানাবুদ বা নির্মূল করা; ০৮. শাসকগোষ্ঠী ও ধর্মীয় নেতাদের সমন্বয় সাধন। যেসব ধর্মীয় নেতা এ সমন্বয় কর্মকাণ্ডের বিরোধিতা করবে, তাদের জেলজুলুম ইত্যাদির মাধ্যমে নিয়ন্ত্রণ বা নির্মূল করা; ০৯. করপোরেট শক্তিকে সাহায্য করা; ১০. শ্রমজীবীদের নিয়ন্ত্রণ করা এবং তাদের সব সংগঠনকে সরকারের নিয়ন্ত্রণে আনা অথবা নির্মূল করা; ১১. সুশীলসমাজ ও বুদ্ধিজীবীদের নিয়ন্ত্রণের লক্ষ্যে ভীতির রাজ্য স্থাপন করা। এ কাজে শিক্ষাব্যবস্থা এবং শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোকে নিবিড় পর্যবেক্ষণে রাখা এবং নিয়ন্ত্রণ করা; ১২. অপরাধ নিয়ে প্রবল প্রচার চালিয়ে নিজেদের অপরাধকে লুকিয়ে রাখা এবং বিচারব্যবস্থাকে রাজনৈতিক কর্মী হিসেবে ব্যবহার করা; ১৩. দুর্নীতি নিয়ে প্রচণ্ড আলোচনা ও কর্মকাণ্ডে প্রতিবাদী ও বিরোধীদের শায়েস্তা করা; ১৪. নির্বাচনকে সম্পূর্ণ নিয়ন্ত্রণের লক্ষ্যে পুলিশ-প্রশাসন-বিচারকে এক সূত্রে গেঁথে ফেলা।
এ পদ্ধতিগুলো তৃতীয় বিশ্বের কাকিসটোক্র্যাসির অনুসারীরা গণতন্ত্রের নামে নিবিড়ভাবে অনুসরণ করছে। এমনকি প্রথম বিশ্বেও এর ব্যবহার লক্ষ করা যায়। তাই রেডিও আমেরিকার অনুসন্ধানী রিপোর্টার টিম কেলি সম্প্রতি দ্য পুলিশ স্টেট ইজ হেয়ার নিবন্ধে লিখেছেন, ‘যারা ভাবছেন সুদিন সামনে এবং বিপ্লব এলো বলে, তারা জানেন না রাতের আঁধারে গান গাইতে গাইতে তা চলে গেছে।’ তিনি অবশ্য মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের কথা বলেছেন।
তবে কেলি যে কর্মকাণ্ডগুলোর কথা উল্লেখ করেছেন, তা বিশ্বব্যাপী তথাকথিত গণতান্ত্রিক শক্তিগুলো নিবিড়ভাবে ব্যবহার করছে। যেমন নিবর্তনমূলক আইন, বিরোধীদের বিচারবহির্ভূত শাস্তি এবং নির্মূলকরণ, বিনা চার্জে জেলে প্রেরণ। এমনকি রাষ্ট্রের আইন সাধারণ মানুষের সহায়তায় আসছে না। বরং, সাবেক মার্কিন অর্থসচিব পল ক্রেইগ রবার্টসের মতে, এখন আইন জনগণের রক্ষক নয়, এটা এখন সরকারের হাতের একটি অস্ত্র, যা দিয়ে জনগণকে শায়েস্তা করা যায়।
টিম কেলির একটি মন্তব্য যেন বাংলাদেশের মতো দেশগুলোর জন্য করা হয়েছে। ‘দেশের বিচারালয়গুলো যেন পুলিশ স্টেট না ঠেকিয়ে বরং এর বাস্তবায়নের জন্য কাজ করে যাচ্ছে।’ ('The nation’s courts, rather than checking the police states, relentless expansion, have become its enabler.') কেলি বলছেন, সঙ্গত কারণেই জনগণ এখন সরকারকে ভয় পাচ্ছে। বিচার পাচ্ছে না। সেটা আর এখন আলোচ্য বিষয় নয়। কারণ কাকিসটোক্র্যাসি কায়েম হয়ে গেছে, যেখানে ‘অযোগ্য-দুর্নীতিবাজ-অপরাধীরা’ পুলিশি রাষ্ট্র কায়েম করে নিজের ক্ষমতা ও স্বার্থ রক্ষা করছে। অন্য কথায়, এখন কাকিসটোক্র্যাসির রাজত্ব।
তাই জন বার্নহিলের মন্তব্য স্মরণ না করে পারা যায় না। যখন জনগণকে ভয় করতে হয় সরকারকে তখন বুঝতে হবে প্রজাপীড়নের শাসন তথা টাইরেনি কায়েম হয়েছে। সরকার জনগণের তোয়াক্কা করলে, জনগণ মুক্তি ও স্বাধীনতা ভোগ করত। বিখ্যাত Born under a bad sky-এর লেখক জেফরি সেন্ট কেয়ার আধুনিককালের সরকারও মুসলমানদের সংবাদমাধ্যমের নিয়ন্ত্রণের কৌশলী পদ্ধতিগুলো বর্ণনা করে জন লিলবার্নকে স্মরণ করেছেন। ১৬৩৪ খ্রিষ্টাব্দে চার্লস-১ এর এবং চার্চের অনধিকার চর্চার বিরুদ্ধে এক লেখার কারণে তাকে মৃত্যুদণ্ড দেয়া হয়। তবে ওলিভার ক্রমওয়েল এবং পার্লামেন্ট সদস্যদের প্রতিবাদে তাকে মুক্ত করা হয়। লিলবার্ন সারাজীবন বক্তব্যের স্বাধীনতার জন্য যুদ্ধ করেছেন। এমনকি মহাকবি মিলটন তার কর্মে উদ্বুদ্ধ হয়ে বক্তব্যের স্বাধীনতার সপক্ষে বিখ্যাত অ্যারিয়োগেজেটিকা ৪০০ বছর আগে রচনা করেন। লিলবার্ন গোপন বিচার ও পক্ষপাতিত্বের বিচারের বিরুদ্ধে আন্দোলন করে সর্বপ্রথম এটা সর্বগ্রাহ্য করেন যে, রাষ্ট্রের সবাই সমান এবং সবার বলার অধিকার আছে। আদালতকে এ বিষয়টি প্রাধান্য দিতে হবে। সেন্ট জেফরি প্রশ্ন করেছেন সাম্প্রতিক এক নিবন্ধে, ‘এখন লিলবার্ন (বেঁচে থাকলে) কী করতেন? (Intolerable opinions in an age of secret tribunals)। জেফরি বলেছেন, লিলবার্ন কখনোই হার মানতেন না।
আর সত্য কথাই বলেছেন জর্জ ওয়াশিংটন, ‘সরকার আগুনের মতো, যা চাকর হিসেবে বিপজ্জনক এবং প্রভু হিসেবে ভয়ঙ্কর।’
মজার কথা হলো, রাজনীতিবিদেরা হলেন সেই দল, যারা সমস্যা সৃষ্টি করেন, তার প্রতিবিধানের জন্য জনগণের কাছে যান এর সমাধানের জন্য। সমাধান? তাদের ক্ষমতায় বসাতে হবে। রাজনীতির এটা একটি অমোঘ বিধান যেÑ সঙ্ঘাত, মিথ্যা ও অনাচার ছাড়া রাষ্ট্রাচার প্রায় অসম্ভব। আর এই মিথ্যা-সঙ্ঘাত-দুর্নীতিকে প্রতিহত করার সংগ্রামও চলমান।

২০১২-১৩ অর্থবছরের বাজেটে বিবেচ্য


॥ হারুন-আর-রশিদ ॥

আসন্ন বাজেটই হবে বর্তমান সরকারের রাজনৈতিক প্রতিশ্রুতি বাস্তবায়নের সর্বশেষ সুযোগ। চলমান অর্থনীতির সব জটিল প্রতিবন্ধকতা মোকাবেলার সবধরনের প্রস্তুতি থাকছে এই বাজেটে। অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত স্পষ্ট করেই এ কথা কয়েকবার বলেছেন বিভিন্ন সংবাদ সম্মেলনে।
বর্তমান সময়ে মূল্যস্ফীতি দুই অঙ্কের ঘরে রয়েছে। অর্থাৎ ১০ শতাংশের ওপরে। আগামী অর্থবছরে তা কমিয়ে ৯ শতাংশের নিচে রাখা হবে এবং চারটি খাতকে বিশেষ করে বিদ্যুৎ, জ্বালানি, কৃষি, মানবসম্পদকে বাজেটে সর্বোচ্চ বিবেচনায় রাখা হবে। অবশ্য এ খাতগুলোতে চ্যালেঞ্জ রয়েছে।
দেশে বর্তমানে সব ধরনের খাদ্যপণ্যের দাম অস্বাভাবিক হারে বেড়েছে। চাহিদার তুলনায় খাদ্যপণ্যের সরবরাহ কম হওয়ায় দাম বাড়ছে অস্বাভাবিক হারে। সেহেতু মূল্যস্ফীতি এক অঙ্কে ধরে রাখা সরকারের জন্য বড় চ্যালেঞ্জ হিসেবে দেখা দেবে আগামী বাজেটে। বিনিয়োগের পূর্বশর্ত হচ্ছে নিরবচ্ছিন্ন বিদ্যুৎ ও জ্বালানি সরবরাহ। শিল্পের জ্বালানি নিশ্চয়তা না থাকায় বড় ধরনের বিনিয়োগের সব প্রচেষ্টা বিগত তিন বছরে ভেস্তে গেছে। শিল্পে বিনিয়োগ না থাকায় শিল্পে কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি হয়নি। ফলে সরকারের পূর্বঘোষণা মতে প্রতি ঘরে একজনকে কর্মসংস্থানের সুযোগ Ñ সেটাও বাস্তবায়ন সম্ভব হয়নি। এসব কারণে প্রতি বছরই শিক্ষিত বেকারের সংখ্যা দেশে জ্যামিতিক হারে বাড়ছে। বিদ্যুৎ ও জ্বালানি সরবরাহ অপ্রতুল হওয়ায় বিনিয়োগে মন্থর গতি স্পষ্টতর হয়ে উঠছে। ফলে সরকারের নির্বাচনী প্রতিশ্রুতি ৮০ শতাংশই অপূরণ থেকে গেছে। বিনিয়োগ কচ্ছপ গতিতে আগালে শিল্প সম্প্রসারণ সম্ভব হবে না ফলে বেকারত্বের হার বৃদ্ধি পাবে।
মহাজোট সরকারের নির্বাচনী ইশতেহারে সবচেয়ে বড় প্রতিশ্রুতি ছিল বিদ্যুৎ সমস্যার সমাধান। সরকার বলছে গেল তিন বছরে তিন হাজার মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদন বেড়েছে কিন্তু বাস্তবে তার কোনো প্রমাণ দেখছি না। ভয়াবহ লোডশেডিং বর্তমানে ২০০৯ সালের চেয়েও বেড়েছে। ফলে শিল্পপ্রতিষ্ঠানে উৎপাদন বিগত দুই বছরের চেয়ে কমেছে। নতুন কোনো শিল্পপ্রতিষ্ঠান গড়ে ওঠেনি শুধু বিদ্যুৎ সঙ্কটের কারণে। বিদ্যুৎ ও গ্যাস সঙ্কট সমাধান না হলে বাংলাদেশকে শিল্পপণ্যের ক্ষেত্রে আমদানিনির্ভর বাজেটে পরিণত হতে হবে। দেশের চলমান অর্থনীতিতে সরকারের ব্যাংকঋণের ওপর নির্ভরতা উদ্বেগজনক হারে বাড়ছে। চলতি অর্থবছরে বৈদেশিক সহায়তা হ্রাস পাওয়ায় সরকার ব্যাংকঋণ প্রথম ১০ মাসে (২০১১-১২ জুলাই-এপ্রিল) মোট ১৬ হাজার ৬৬৮ কোটি ৫৩ লাখ টাকা ঋণ গ্রহণ করেছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের সর্বশেষ তথ্য অনুযায়ী এই বিবরণী পাওয়া যায়। সরকারের বিগত তিনটি বাজাটের মধ্যে চলতি অর্থবছরেই ব্যাংক থেকে ঋণ গ্রহণ সর্বোচ্চপর্যায় পৌঁছায়।
ব্যাংক থেকে ঋণ নিয়ে ব্যাপক সমালোচনার প্রেক্ষাপটে ২০১২-১৩ অর্থবছরে তা কমানোর সুপারিশ করেছে গবেষণা প্রতিষ্ঠান সিপিডি।
চলতি অর্থবছরে (২০১১-১২) রেমিট্যান্স বাড়েনি। গত জানুয়ারি থেকে এপ্রিল চার মাসে প্রবাসীদের পাঠানো বৈদেশিক মুদ্রার পরিমাণ তুলনামূলক বিগত অর্থবছরের চার মাসের চেয়ে অনেক কম ছিল। বাংলাদেশ ব্যাংকের পরিসংখ্যানে যে তথ্য দেয়া হয়েছে তাতে দেখা যায়, গত জানুয়ারি মাসে বিদেশী শ্রমবাজার থেকে বৈদেশিক মুদ্রা এসেছে ১২২ কোটি ১৪ লাখ ডলার, কিন্তু ফেব্রুয়ারিতে তা কমে দাঁড়ায় ১১৩ কোটি ৩০ লাখ ডলারে, মার্চে তা আরো কমে দাঁড়ায় ১১০ কোটি ৯১ লাখ ডলারে। এপ্রিলে এসে দাঁড়িয়েছে ১০৮ কোটি ২২ লাখ ডলারে। চলতি অর্থবছরে প্রতি মাসে গড় হিসাবে দুই হাজার ৪০০ কোটি টাকা ভর্তুকি দিতে হয়েছে। এই অর্থ তুলতে সরকার পাঁচবার জ্বালানি তেল ও বিদ্যুতের দাম বাড়িয়েছে। এতে জনদুর্ভোগ যেমন বেড়েছে, তেমনি বেড়েছে মূল্যস্ফীতির হার। সরকারের ব্যাংকঋণ গ্রহণের সীমা চলতি অর্থবছরে সাড়ে চার মাসেই অতিক্রম করেছে। বর্তমান সরকারের বিগত ১১ মাসে মাত্রাতিরিক্ত ঋণগ্রহণ সামগ্রিক অর্থনীতিতে চাপ সৃষ্টি করেছে। দুর্বল হয়েছে দেশের সামগ্রিক অর্থব্যবস্থা। খাদ্য ও খাদ্যবহির্ভূত পণ্যের দাম বাড়ালে মূল্যস্ফীতি বাড়াতে সহায়ক ভূমিকা পালন করবে এতে জাতীয় উৎপাদন প্রবৃদ্ধি কমবে। এসব কথা বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদসহ জাতীয় ও আন্তর্জাতিক সংস্থার। সুতরাং আগামী অর্থবছরে শতকরা ৭ ভাগ প্রবৃদ্ধি অর্জন নিয়ে সংশয় থেকেই যাচ্ছে।
বিগত এক দশকের মধ্যে সর্বোচ্চ মূল্যস্ফীতি (১৩ দশমিক ৯৬) ছিল জানুয়ারি ২০১২ সালে। ২০১২ এপ্রিলে এসে এর মূল্যস্ফীতি কমে দাঁড়িয়েছে ১০ দশমিক ৭৭। আগামী বাজেটে সরকার কিভাবে এক অঙ্কে মূল্যস্ফীতি ধরে রাখবে সেটাও প্রশ্ন হয়ে থেকে যাচ্ছে। এসব বিষয় নিয়ে সরকারের অর্থমন্ত্রীর কাছ থেকে বাজেটে দিকনির্দেশনামূলক বক্তব্য জাতি প্রত্যাশা করে। অর্থাৎ মূল্যস্ফীতির লাগাম টেনে ধরার পাশাপাশি ৭ ভাগের ওপর প্রবৃদ্ধি অর্জন করতে চাইলে জ্বালানি তেল, বিদ্যুৎ, গ্যাস এসবের উৎপাদন বাড়ানোসহ এর মূল্যও সহনীয় পর্যায়ে ধরে রাখার ব্যবস্থা থাকতে হবে বাজেটে। শিল্পে বিনিয়োগ বাড়াতে হলে সরকারকে এই পদক্ষেপ অবশ্যই নিতে হবে।
মহাজোটের উন্নয়ন রূপরেখার মূল লক্ষ্য ২০২১ সালের মধ্যে বাংলাদেশকে মধ্যম আয়ের দেশ, বার্ষিক মাথাপিছু গড় আয় চার হাজার ইউএস ডলার এবং জিডিপি প্রবৃদ্ধির লক্ষ্যমাত্রা অর্জন ১০ শতাংশ। উন্নয়নের রূপরেখা দীর্ঘমেয়াদি প্রেক্ষিত পরিকল্পনা ২০১০-২১ ১০ মে বৃহস্পতিবার জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদের (এনইসি) বৈঠকে এটি অনুমোদন হয়েছে। কিন্তু এই রূপরেখার কাজ শুরু হয়েছে ২০১০ সাল থেকে। ২০২১ সালের মধ্যে বাস্তবায়নের এই রূপকল্পে থাকছে দারিদ্র্য দূরীকরণ, কর্মসংস্থান, আয় বণ্টন আঞ্চলিক ও আন্তর্জাতিক বাণিজ্য, বিদ্যুৎ ও জ্বালানি শিক্ষা, স্বাস্থ্য ও পুষ্টি, পরিবার পরিকল্পনা, ুদ্র ও মাঝারি শিল্প, দুর্নীতি দমন ও জনপ্রশাসন উন্নয়ন, খাদ্য নিরাপত্তা, যোগাযোগ, নগরায়ন, জলবায়ু পরিবর্তন ও দুর্যোগ মোকাবেলার ব্যবস্থাপনাসহ ডিজিটাল বাংলাদেশ গড়ে তোলার এক মহাপরিকল্পনা। এ জন্যই ২০১২-১৩ অর্থবছরের বাজেটটি সেই আঙ্গিকেই সরকারকে ঢেলে সাজাতে হবে। সুতরাং বর্তমান বাজেট সরকারের জন্য একটি চ্যালেঞ্জিং বাজেট।
এ দিকে এশীয় দেশগুলোর মধ্যে আন্তঃলেনদেনের দায় পরিশোধ করতে হয়েছে (৯.৫.১২) ৭৩ কোটি ২০ লাখ ডলার। ফলে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ ৯৫৯ কোটি ডলারে নেমে এসেছে (সূত্র : জাতীয় দৈনিক ১০.৫.১২)। সুতরাং বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ বাড়াতে হলে রফতানি বাণিজ্যের ওপর জোর দিতে হবে সবচেয়ে বেশি। পাশাপাশি বৈদেশিক শ্রমবাজার সম্প্রসারিত করে রেমিট্যান্স বাড়ানোর কাজটিও করতে হবে আগামী অর্থবছরের মধ্যে। হারিয়ে যাওয়া শ্রমবাজার মধ্যপ্রাচ্যকে আবার ফিরিয়ে আনতে হবে। ২০১১-১২ অর্থবছরে এডিপি নির্ধারণ করেছিল ৪১ হাজার কোটি টাকা। কিন্তু দেখা গেছে বিগত ১০ মাসে মাত্র ৪৫ শতাংশ এডিপির কাজ বাস্তবায়ন সম্ভব হয়েছে। ২০১১ সালের রূপকল্পের ভিশন বাস্তবায়ন কিভাবে সম্ভব হবে যদি বিদেশী অর্থায়নের টাকা শতভাগ বাস্তবায়ন সম্ভব না হয়। বাজেটে এসব বিষয়ে দিকনির্দেশনা থাকতে হবে। এডিবির নির্বাহী কর্মকর্তারা আশঙ্কা প্রকাশ করেছেন, আগামী অর্থবছরে অর্থনীতি আরো খারাপ হবে। মূল্যস্ফীতি সিঙ্গেল ডিজিটে নামবে না। চলতি বছরের প্রবৃদ্ধি হবে ৬ দশমিক ২ শতাংশ এবং আগামী অর্থবছরেও প্রবৃদ্ধি অর্জন এর বেশি হবে না বলে তারা মত প্রকাশ করেছেন। (সূত্র জাতীয় দৈনিক-১২.৪.১২)।
দেশে শতাধিকের মতো এমএলএম কোম্পানি সরকারের বৈধতা নিয়ে ব্যবসায় করে থাকলেও নীতিনির্ধারণী কোনো আইন নেই। দ্রুত এ ব্যাপারে আইন প্রণয়ন করতে হবে। জলবায়ু বিশেষজ্ঞরা বলেছেন বাংলাদেশে যেভাবে বন উজাড়, ভারতের অপরিকল্পিত বাঁধ নির্মাণ এক তরফাভাবে পানি নিয়ন্ত্রণ করা থেকে বাংলাদেশের দুই কোটি লোক কাইমেট রিফিউজিতে পরিণত হবে। এসব আন্তর্জাতিক ব্যাপারে দেশের নির্বাহী প্রধানকে সিদ্ধান্ত নিতে হবে যাতে বাংলাদেশের অর্থনীতির ক্ষতি না হয় জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে। মানবসৃষ্ট এই প্রাকৃতিক বিপর্যয় বিষয়টিও বাজেটে আলোকপাত করতে হবে যা বিষয়টি সুরাহা করা সম্ভব হয় আন্তঃমহাদেশীয় সুসম্পর্কের মাধ্যমে এবং কাজটি অর্থনীতির জন্য অত্যন্ত জরুরি বলে বিবেচনা করতে হবে। অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির লক্ষ্যমাত্রাকে হুমকির মুখে নিক্ষেপ করেছে এমন পাঁচটি কারণ চিহ্নিত করেছেন বাংলাদেশ মেট্রোপলিটান বণিক সমিতি। কারণগুলো হলো ব্যালান্স অব পেমেন্টের ওপর অত্যধিক চাপ, ব্যাংক থেকে সরকারের অত্যধিক ঋণ নেয়া, বিনিয়োগে স্থবিরতা, ঊর্ধ্বমুখী মূল্যস্ফীতি এবং রাজনৈতিক অস্থিরতা। এ পাঁচটি যুগপৎ কারণের জন্য অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির হার নির্ধারিত শতাংশের পরিবর্তে ৬ দশমিক ২ শতাংশে নেমে আসবে বলে এশীয় উন্নয়ন ব্যাংক আশঙ্কা প্রকাশ করেছে। আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল (আইএমএফ) আশঙ্কা করেছে যে চলতি অর্থবছরে প্রবৃদ্ধির হার ৭ শতাংশের পরিবর্তে ৫ দশমিক ৫ শতাংশ হবে। রফতানি খাতেও পরিস্থিতির অবনতি ঘটেছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের পরিসংখ্যান অনুযায়ী গত অর্থবছরের (২০১০-১১) জুলাই-মার্চ, এই ৯ মাসে বাণিজ্য ছিল ৫৮২ কোটি মার্কিন ডলার। চলতি অর্থবছরে (২০১১-১২) জুলাই-মার্চ সেই বাণিজ্য ঘাটতি বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৬৫৮ কোটি ডলারে। অর্থাৎ চলতি বছরের ৯ মাসে বিগত অর্থবছরের ৯ মাসের তুলনায় বাণিজ্য ঘাটতি বেড়েছে ৭৬ কোটি মার্কিন ডলার। বিদ্যুৎ পরিস্থিতির মারাত্মক অবনতি ঘটেছে। মেট্রোপলিটন চেম্বারের আলোচ্য তথ্য মোতাবেক বিদ্যুতের বর্তমান চাহিদা হলো ৬২ হাজার মেগাওয়াট। সেখানে উৎপাদন হচ্ছে চার হাজার ৫০০ থেকে পাঁচ হাজার মেগাওয়াট। প্রতি মাসে ৭০ হাজার গ্রাহক সৃষ্টি হচ্ছে। সেই হিসাবে ঘাটতি হচ্ছে এক থেকে দেড় হাজার মেগাওয়াট। সম্প্রতি ইউরোপীয় ইউনিয়নের আটজন রাষ্ট্রদূত বাংলাদেশে এসে একটি সংবাদ সম্মেলনে স্পষ্ট ভাষায় বলেছেনÑ বিদেশে বাংলাদেশের ভাবমূর্তি ভালো নয়। সে কারণে ইউরোপীয় বিনিয়োগকারীরা বিনিয়োগের জন্য বাংলাদেশে আসছে না। একই কথা বলেছেন মার্কিন রাষ্ট্রদূত ড্যান মজিনা। ইউরোপ ইউনিয়ন এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের রাষ্ট্রদূতেরা বাংলাদেশের ইমেজ সঙ্কট দূর করা এবং বিদেশে বিনিয়োগ আকৃষ্ট করার জন্য সুস্থ রাজনৈতিক পরিবেশ বজায় রাখার ওপর অধিক গুরুত্ব আরোপ করেছেন। এই জন্য তারা শিগগিরই প্রধান রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে সমঝোতা ও সংলাপ শুরু করার তাগিদ দিয়েছেন। এ কথাটি বিদেশী মেহমানরাই নন খোদ আওয়ামী লীগের একজন মন্ত্রী সম্প্রতি বলেছেনÑ দেশে ওয়ান ইলেভেনের পদধ্বনি শোনা যাচ্ছে। রাজনীতি সঙ্ঘাতের পথে অগ্রসর হচ্ছে। এটা কারো জন্য মঙ্গল বয়ে আনবে না। এফবিবিসিআই অর্থমন্ত্রীকে সঙ্ঘাতময় পরিস্থিতি এড়াতে উদ্যোগ নিতে বলেছেন। দুর্ভাগ্য জাতির দেশী বিদেশী সৎ পরামর্শ কর্ণপাত না করে রাজনীতিকে ইচ্ছা করেই মারাত্মক সঙ্ঘাতের পথে ঠেলে দেয়া হচ্ছে। এই সঙ্ঘাতের কারণে অতীতের সঙ্ঘাতের মতোই দেশে যে অর্থনৈতিক ক্ষতি হবে ভালো বাজেট পেশ করলেও তা দেশের অর্থনীতির জন্য শুভ বার্তা বয়ে আনবে না। ৪২ বছরের মতোই শুধু আমরা পেছাতেই থাকব সামনের দিনগুলোতেও। দেশের অর্থনীতির এই ক্ষতির জন্য বর্তমান প্রজন্ম রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দকেই দায়ী করবে এবং এটাই স্বাভাবিকÑ কারণ দেশ পরিচালনা করছেন রাজনীতিকেরাই।
লেখক : গ্রন্থকার, গবেষক ও কলামিস্ট

এক অনিশ্চিত পথে চলেছে স্বদেশ!

মুহাম্মদ জাহাঙ্গীর | তারিখ: ০১-০৬-২০১২
বাংলাদেশের রাজনৈতিক পরিস্থিতি ক্রমশ জটিল হয়ে উঠেছে। একদিকে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দাবি অপরদিকে তত্ত্বাবধায়ক সরকারকে অস্বীকার—এই পরস্পরবিরোধী অবস্থানে দেশের রাজনৈতিক পরিস্থিতি সংঘাতের দিকেই এগোচ্ছে। এই পটভূমিতে দেশের অন্যান্য দল, নাগরিক সমাজ, মিডিয়া ও বিভিন্ন সামাজিক সংগঠন এমনকি বিদেশি বন্ধুরাও দুই দলকে সংলাপে বসে এই জটিলতা অবসানে একটা সমঝোতায় পৌঁছানোর জন্য আহ্বান জানিয়েছেন। কিন্তু সরকার এ ব্যাপারে এখনো ইতিবাচক কোনো সাড়া দেয়নি। সামনে আরও হরতালের কর্মসূচি, বিএনপির ভাষায়, আরও কঠোর কর্মসূচি আসতে পারে বলে ঘোষণা দেওয়া হয়েছে।
এ রকম অবস্থায় দেশের পরিস্থিতি ক্রমশ অনিশ্চিত হয়ে উঠেছে। যাঁরা দেশের রাজনীতি বিশ্লেষণ করেন তাঁরাও প্রায় সবাই দেশের ভবিষ্যৎ রাজনীতি সম্পর্কে কোনো আশাবাদী মন্তব্য করতে পারছেন না। সমঝোতা না হলে দেশে একটা বড় রকমের সংঘাত হতে পারে বলে অনেকে আশঙ্কা করছেন।
অথচ এই সংঘাত এড়ানোর একটা বড় উপায় ছিল সংলাপ। দীর্ঘমেয়াদি সংলাপের মাধ্যমে উভয় পক্ষ কিছুটা ছাড় দিলে সমঝোতার একটা পথ পাওয়া যেতে পারে। আর দুই বড় দলের মধ্যে সমঝোতা হলে তার ভিত্তিতে সংবিধান সংশোধন করা কয়েক মিনিটের ব্যাপার মাত্র।
কিন্তু সেই বহুল প্রত্যাশিত সংলাপের ব্যাপারে প্রধানমন্ত্রী বা তাঁর দলকে এখনো প্রচণ্ডভাবে অনাগ্রহী বলেই মনে হয়। গণতন্ত্রে বা সংসদীয় গণতন্ত্রে প্রধানমন্ত্রী ও বিরোধী দলের নেতাকে যে নানা সংকটে ও ইস্যুতে প্রায়ই আলোচনায় বসতে হয় তা আমাদের প্রধানমন্ত্রীর অজানা থাকার কথা নয়। তবুও প্রধানমন্ত্রী আলোচনা বা সংলাপকে উপেক্ষা করতে পারছেন। বলা হয়, বাংলাদেশে সংসদীয় পদ্ধতির সরকার রয়েছে। এটা কাগুজে কথা। বাস্তবে বাংলাদেশে যেভাবে সংসদ ও মন্ত্রিসভা কাজ করছে তা ‘রাষ্ট্রপতি পদ্ধতি’র একটি নিকৃষ্ট সংস্করণ। এ ব্যাপারে প্রধান বিরোধী দলও কম দায়ী নয়।
কোনো সরকারে একনায়কত্ব প্রতিষ্ঠিত হলে সেই সরকারের কাছ থেকে দায়িত্বশীলতা আশা করা বৃথা। বাংলাদেশে আমরা এখন প্রায় সে রকম পরিস্থিতির সম্মুখীন হয়েছি।
একটা কথা আমার প্রায়ই মনে জাগে। যদি শেষ পর্যন্ত আওয়ামী লীগ আগামী নির্বাচনে সরকার গঠন করার মতো সিট না পায়, তাহলে শেখ হাসিনা কাকে বা কাদের দায়ী করবেন? মন্ত্রিসভাকে? সাংসদদের? আমলাদের? কাউকেই দায়ী করার কোনো সুযোগ নেই। কারণ সবাই দেখতে পেয়েছেন, মহাজোট সরকার কেবল একজনের নির্দেশেই পরিচালিত হয়েছে। এই অদক্ষ মন্ত্রিসভা (কচিকাঁচার মন্ত্রিসভা—আবদুল গাফ্ফার চৌধুরী) তিনিই গঠন করেছেন। দক্ষ ও অভিজ্ঞ আওয়ামী লীগ নেতাদের তিনিই দূরে সরিয়ে রেখেছেন। মন্ত্রী ও উপদেষ্টাদের মধ্যে তিনিই দ্বন্দ্ব লাগিয়ে রেখেছেন। ছোট-বড় সব সিদ্ধান্ত নেওয়ার প্রক্রিয়ায় প্রধানমন্ত্রীর দপ্তরকে অতিরিক্ত ক্ষমতা দিয়ে তিনি কার্যত মন্ত্রণালয়কে অকার্যকর করে রেখেছেন। মাধ্যমিক পরীক্ষার রেজাল্টও বেচারা শিক্ষামন্ত্রী ঘোষণা করতে পারেন না!
এসব দৃশ্য বা ঘটনাপ্রবাহ সচেতন মানুষ দেখেছে। এগুলো বিএনপির অপপ্রচার নয়। টিভিতে দেখা ও পত্রিকায় পড়া ঘটনা। কাজেই নির্বাচনে পরাজিত হলে প্রধানমন্ত্রী কাকে দায়ী করবেন তা দেখার জন্য আমার খুব কৌতূহল। অবশ্য পরাজিত হবেন এমন কোনো কথা নেই। বিপুল ভোটে আওয়ামী লীগ আবার জয়ী হতে পারে। দেশের মানুষ যদি এ রকম ‘শাসন’ পছন্দ করে তাহলে তারা আওয়ামী লীগকে ভোট দিতেই পারে। জনগণের ইচ্ছাকে দমিয়ে রাখার শক্তি কারও নেই।
অনেকে মনে করেন, দেশের বিশিষ্ট ব্যক্তিরা চাপ সৃষ্টি করলেই প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সংলাপে বসতে বাধ্য হবেন। এখানে একটা কথা স্পষ্ট করা দরকার। সংলাপে বসতে দুই দলের কারও তেমন আপত্তি নেই। শুধু একটি শর্ত তাঁদের রয়েছে। প্রধানমন্ত্রীর শর্ত: সংলাপে ‘তত্ত্বাবধায়ক সরকার ইস্যু’ আলোচ্য বিষয় হতে পারবে না। কারণ, এটা মৃত বিষয়। এই ইস্যু সংবিধান থেকেই বাদ দেওয়া হয়েছে।
বেগম খালেদা জিয়ার শর্ত: সরকার যদি তত্ত্বাবধায়ক সরকার ইস্যুটি মেনে নেয় তাহলে তাঁরা সংলাপে বসতে রাজি।
সেই পুরোনো প্রবাদটির কথা পাঠকের মনে পড়তে পারে। ‘সালিস মানি, কিন্তু তালগাছটি আমার।’
এ রকম অবস্থায় কারা প্রধানমন্ত্রী ও বিরোধী দলের নেত্রীকে প্রভাবিত করতে পারবেন?
অনেকে মনে করেন, বিভিন্ন পেশার নেতৃস্থানীয় মানুষেরা সংঘবদ্ধ হয়ে প্রধানমন্ত্রীর ওপর চাপ সৃষ্টি করলে প্রধানমন্ত্রী বিতর্কিত সব বিষয় নিয়ে সংলাপে বসতে আগ্রহী হবেন।
বাংলাদেশের বর্তমান রাজনৈতিক ও সামাজিক পরিস্থিতি সম্পর্কে যাঁদের পরিষ্কার ধারণা নেই তাঁরা এ রকম প্রস্তাব দিতে পারেন। তবে বাস্তবতা খুব ভিন্ন চিত্র।
বাংলাদেশের বিভিন্ন পেশার নেতারা দলীয় পরিচয়ে বিভক্ত। প্রায় সব পেশার নেতারাই দুই প্রধান দল বা তাঁদের দলের সরকারের কাছ থেকে নানা অনুগ্রহ নিয়ে থাকেন। তাঁরা দলের সেবাদাস। দলের নেত্রী বা প্রধানমন্ত্রীর মন জুগিয়ে কথা বলাই তাঁদের প্রধান কাজ। প্রত্যক্ষ রাজনীতি না করলেও তাঁদের আচরণ ও কথাবার্তা দলের ক্যাডারদের মতোই। তাঁরা শেখ হাসিনা বা খালেদা জিয়ার ওপর চাপ সৃষ্টি করার মতো নৈতিক জোর রাখেন না। তাঁরা সরকার বা দল থেকে নানা সুবিধা আদায়ে ব্যস্ত। শেখ হাসিনা বা খালেদা জিয়া পছন্দ করবেন না, এমন কোনো কথা তাঁরা কখনো বলবেন কি না আমার সন্দেহ হয়। কাজেই পেশাজীবী নেতাদের দ্বারা এই সংকটে কোনো ইতিবাচক ভূমিকা আশা করা যায় না।
এই সংকট নিরসনে নেতৃত্বস্থানীয় ও সম্মানিত বুদ্ধিজীবীদের কাছেও অনেকের প্রত্যাশা রয়েছে। কিন্তু বাংলাদেশে দলনিরপেক্ষ সৎ বুদ্ধিজীবী (নেতৃত্বস্থানীয়) নেই বললেই চলে। সুযোগ পেলে তাঁরা নেত্রীর যেভাবে বন্দনা করেন, তা যেকোনো রুচিশীল মানুষকে পীড়িত করবে। তাঁদের বন্দনার ভাষা যাঁরা নিজের কানে শোনেননি তাঁরা বিশ্বাসও করতে পারবেন না।
নিঃসন্দেহে তাঁরা খ্যাতনামা বুদ্ধিজীবী, শিল্পী, সাহিত্যিক। দেশের জন্য তাঁদের অবদান অসামান্য। কিন্তু তাঁরা পোষমানা দলীয় বুদ্ধিজীবী! পশ্চিমবঙ্গের প্রখ্যাত সাহিত্যিক (প্রয়াত) অন্নদা শঙ্কর রায়ের মতো বিবেকবান, নির্লোভ ও সাহসী বুদ্ধিজীবী বাংলাদেশে নেই বললেই চলে। যে দু-একজনের কথা অনেকের মনে পড়বে তাঁরা দেশের চলমান রাজনৈতিক সংকট সম্পর্কে প্রায় কখনো কোনো কথাই বলেন না। এ ধরনের নীরব বুদ্ধিজীবীদের কাছ থেকে কোনো গঠনমূলক ও ইতিবাচক ভূমিকা আশা করা বৃথা।
একজন প্রখ্যাত কলামিস্ট বাংলাদেশের দুজন ‘বিশিষ্ট নাগরিকের’ কাছে আশা করেছেন, তাঁরা যেন তাঁদের প্রভাব ও প্রতিপত্তি কাজে লাগিয়ে দেশের বৃহত্তর স্বার্থে দুই নেত্রীকে সংলাপে বসাতে চাপ দেন।
এই দুজন বিশিষ্ট নাগরিকের অন্তত একজন চলমান রাজনীতি নিয়ে কোনো কথা না বলেই সরকারের কাছে যেভাবে অপদস্থ ও অপমানিত হয়েছেন এবং হচ্ছেন তাতে মনে হয় না দেশের রাজনীতি নিয়ে কথা বলা বা কোনো ভূমিকা রাখা তাঁর জন্য উপযুক্ত কাজ হবে। রাজনীতি নিয়ে কথা বললে তিনি আরও অপদস্থ হতে পারেন বলে আশঙ্কা হয়। অতএব, দেশের সমস্যা রাজনীতিবিদদেরই সামলাতে হবে। এই দুই বিশিষ্ট নাগরিকের কাছ থেকে কোনো রাজনৈতিক ভূমিকা আশা না করাই শ্রেয়। আরও একটি কথা মনে রাখা দরকার। যে দুজন বিশিষ্ট নাগরিকের কথা বলা হচ্ছে, তাঁদের প্রতি শেখ হাসিনা বা বর্তমান সরকারের কোনো আস্থা বা শ্রদ্ধা নেই। এ কারণেও রাজনৈতিক অঙ্গনে তাঁদের কোনো ভূমিকা পালনের সুযোগ নেই।
ভূমিকা পালন করতে পারে মিডিয়া। প্রিন্ট ও ইলেকট্রনিক মিডিয়া। যদি মিডিয়ার মালিকেরা ঐক্যবদ্ধ হতে পারেন। যদি তাঁরা একমত হন যে সংলাপ ও সংলাপের মাধ্যমে নির্বাচনকালীন সরকারপদ্ধতি সম্পর্কে দুই দলকে একটা সমঝোতায় আসতেই হবে। সংবাদপত্র যদি সংলাপ ও সমঝোতার পক্ষে পরিকল্পিতভাবে প্রতিদিন লেখা প্রকাশ করে, টিভিতে নানা অনুষ্ঠান প্রচার হয়, তার একটা প্রভাব দুই দলের ওপরই পড়তে পারে। এ ছাড়া সংলাপের বিপক্ষে বা কোনো একটা বিতর্কিত বক্তব্য দুই দলের নেতারা যখন বক্তব্যে বলবেন তা খুব দায়সারাভাবে প্রচার করেও নেতাদের নিরুৎসাহিত করা যায়।
বাংলাদেশে সরকার ও জাতীয় সংসদের পর মিডিয়াই সবচেয়ে শক্তিশালী প্রতিষ্ঠান। এখনো আমাদের মিডিয়া অনেকটা স্বাধীন। মিডিয়ার একটা বড় অংশ যদি দেশের এই ক্রান্তিলগ্নে ঐক্যবদ্ধ হয়ে একটা ইতিবাচক ভূমিকা পালন করতে পারে তাহলে বর্তমান সংকট দূর করার লক্ষ্যে কিছুটা অগ্রগতি হতে পারে।
বাংলাদেশের রাজনীতি অত্যন্ত নিম্নমানের। গ্রাম্য রাজনীতিও বলা যায়। যাঁরা এখানে রাজনীতি করেন, বর্তমান সমস্যা তাঁদেরই সৃষ্টি। তাঁদেরই এই সমস্যার সমাধান করতে হবে। সম্মানিত, বিদগ্ধ, রুচিবান, মননশীল ব্যক্তিদের এই নোংরা রাজনীতিতে না জড়ানোই ভালো হবে। আমার ধারণা, এই গ্রাম্য ও দুর্বৃত্তায়নের রাজনীতিতে তাঁরা তেমন কিছু করতেও পারবেন না। কারণ শিক্ষিত ও সম্মানিত ব্যক্তিদের প্রতি এই অপরাজনীতির নেতাদের অনাস্থা ও অশ্রদ্ধা রয়েছে।
অনেকে প্রশ্ন করতে পারেন, তাহলে দেশের জন্য তাঁদের কি কিছু করণীয় নেই? দায়িত্ব নেই?
নিশ্চয় আছে। তবে সেই দায়িত্ব পালনের সুযোগ ও পরিবেশ থাকতে হবে। বাংলাদেশে এখন সেই সুযোগ নেই। অপরাজনীতি সবকিছু দখল করে ফেলেছে। এখানে সুবচনেরও স্থান নেই। বাংলাদেশ দল ও দলকানাদের স্বর্গরাজ্যে পরিণত হয়েছে। দলের সঙ্গে যাঁরা কণ্ঠ মেলাতে পারবেন না তাঁদের কোনো মূল্য নেই এ দেশে।
তাহলে সংলাপের কী হবে? সংলাপের কী হবে তা দুই দল ও দুই নেত্রীই ভালো জানেন। তাঁদের সুমতি হলে সংলাপ হবে। সমঝোতা হবে। সুমতি না হলে দেশে সংঘাত হবে। অনেক মানুষ মারা যাবে। সম্পত্তির ক্ষতি হবে। মানুষের মূল্যবান সময় নষ্ট হবে। আর আমরা সাধারণ মানুষ তা চোখ মেলে দেখতে থাকব। কারণ আমরা অসহায়। আমরা দুই দলের কাছে জিম্মি। আমরা অসংগঠিত। এই জিম্মিদশা থেকে আমাদের কে মুক্তি দেবেন কে জানে। হয়তো শুধু সৃষ্টিকর্তাই জানেন।
মুহাম্মদ জাহাঙ্গীর: মিডিয়া ও উন্নয়নকর্মী।

তত্ত্বাবধায়ক নাকি অন্তর্বর্তীকালীন?

ড. মুহাম্মদ ইয়াহ্ইয়া আখতার
কেমন সরকারের অধীনে আসন্ন দশম সংসদ নির্বাচন হবে সে আলোচনাই এখন টক অব দ্য কান্ট্রি। এতদিন তত্ত্বাবধায়ক নাকি দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচন হবে, সে বলয়েই এ সংক্রান্ত আলোচনা আবর্তিত হ”িছল। এ দুই রকমের সরকারের সঙ্গে সাধারণ মানুষের পরিচয় ছিল। দলীয় সরকারের অধীনে দেশ পরিচালিত হওয়ায় এ সরকারের সঙ্গে সবার পরিচয় থাকে। নব্বইয়ের দশকের পর থেকে ২০ বছরে জাতীয় সংসদ নির্বাচন তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে অনুষ্ঠিত হওয়ায় এ ব্যব¯’াটিও সাধারণ মানুষের কাছে পরিচিত হয়ে ওঠে। কারণ সামরিক শাসনবিরোধী আন্দোলনের পর বিচারপতি সাহাবুদ্দীন আহমদের সর্বসম্মত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে অনুষ্ঠিত পঞ্চম সংসদ নির্বাচনের পর তত্ত্বাবধায়ক সরকারের ওপর সাধারণ মানুষের কিছুটা আ¯’া গড়ে ওঠে। পরবর্তী সময়ে ১৯৯৬ সালে বিএনপি সরকার অসাংবিধানিকভাবে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচন দিতে না চাওয়ায় আওয়ামী লীগ জামায়াতসহ আরও কিছু দল নিয়ে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের জন্য জোরালো আন্দোলন করে। এ আন্দোলনের একপর্যায়ে সাংবিধানিকতা বজায় রাখার স্বার্থে বিএনপি সরকার ষষ্ঠ সংসদ নির্বাচন করে সে স্বল্পায়ুর সংসদে সংবিধানের ত্রয়োদশ সংশোধনী পাস করে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যব¯’ার অধীনে সংসদ নির্বাচনের বিধানকে সাংবিধানিক ভিত্তি দিলে তখন থেকে সাংবিধানিক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে সপ্তম ও অষ্টম সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। তবে নবম সংসদ নির্বাচন আবার তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে হয়নি। এ অভিনব প্রকৃতির জর“রি সরকারটির জš§ হয় কিছু মের“দণ্ড-দুর্বল রাজনীতিক, কয়েকজন উ”চাভিলাষী সেনা কর্মকর্তা এবং জেনেভা কনভেনশন লঙ্ঘনকারী কতিপয় বিদেশী কূটনীতিকের সম্মিলিত ষড়যন্ত্রের মধ্য দিয়ে। এ সরকারকে সাংবিধানিক বিধি, আয়ুষ্কাল এবং কর্মকাণ্ডের পরিমাপকে তত্ত্বাবধায়ক সরকার বলা যায় না। তবে রাজনীতির ব্যাকরণ ভেঙে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী থেকে শুর“ করে মহাজোট সরকারের অনেক নেতা-মন্ত্রীই এখন ফখর“দ্দীন সরকারের অমানবিক অপকর্মগুলোকে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের ঘাড়ে চাপানোর জন্য ওই সরকারকে তত্ত্বাবধায়ক সরকার বলে অভিহিত করছেন।
যা হোক গত ২০-২২ বছরে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে জাতীয় সংসদ নির্বাচন হওয়ায় এ স্বল্পায়ুর সরকারটি সাধারণ মানুষের কাছে পরিচিতি লাভ করে। তবে রাজনীতিকদের উচিত ছিল সাংবিধানিক ভিত্তি পাওয়ার পর তত্ত্বাবধায়ক সরকারের কার্যক্রম ও গতিবিধি লক্ষ্য করে এর যেসব দুর্বলতা পরিলক্ষিত হ”িছল সেগুলো দূর করতে এ ব্যব¯’ার প্রয়োজনীয় সংস্কার করা। এ লক্ষ্যে কাজ করলে তারা যেসব কাজ করতে পারতেন তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য হ”েছ :
ক. তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান উপদেষ্টা হওয়ার ক্ষেত্রে যেহেতু সুপ্রিমকোর্টের সর্বশেষ অবসরপ্রাপ্ত বিচারপতি প্রথমে সুযোগ পাওয়ার কথা এবং যেহেতু ওই অব¯’ানে কোন বিচারপতি থাকবেন সে বিষয়টি নিয়ে ক্ষমতাসীনদের রাজনৈতিক অংক কষাকষির কারণে বিচারাঙ্গনে রাজনৈতিক দূষণ ছড়িয়ে পড়ে। শুর“ হয় বিচারপতিদের পদোন্নতির রাজনীতি, সে কারণে এরা এ পদে যাতে বিচারপতিদের সঙ্গে সর্বজনশ্রদ্ধেয় অবসরপ্রাপ্ত আমলা, সম্মানিত বরেণ্য শিক্ষাবিদ, খ্যাতিমান সুশীল সমাজের সদস্যদেরও গণ্য করার ব্যব¯’া নিতে পারতেন;
খ. এ অ¯’ায়ী সরকার কতদিন ক্ষমতায় থাকতে পারবে সে ব্যাপারে আরও সুনির্দিষ্ট ও সুস্পষ্ট বিধান করতে পারতেন;
গ. তত্ত্বাবধায়ক সরকারের মাননীয় প্রধান উপদেষ্টারা ১০ জন উপদেষ্টা নিয়োগের ব্যাপারে রাজনৈতিক দলগুলোর কাছ থেকে তালিকা গ্রহণ করায় রাজনৈতিক দলের নেতারা ওপরে নিরপেক্ষ পরিচয়ধারী কিš‘ ভেতরে নিজ আদর্শে বিশ্বাসী বর্ণচোরা ব্যক্তিত্বদের তালিকাভুক্ত করার সুযোগ যাতে না পান সেজন্য দলগুলোর কাছ থেকে তালিকা না নেয়ার বিধান চালু করতে পারতেন;
ঘ. এ সরকার দৈনন্দিন র“টিন কাজ ছাড়া যাতে সাহাবুদ্দীন সরকারের শিক্ষা সংস্কার কমিটি বা হাবিবুর রহমান সরকারের মতো নবম বা দশম শ্রেণীতে ধর্ম বিষয়ে পড়ানো হবে কিনা সে বিষয়ে জড়িত হয়ে এখতিয়ারবহির্ভূত দায়িত্ব পালন না করে, সে ব্যাপারে ব্যব¯’া গ্রহণ করতে পারতেন; এবং
ঙ. তিন মাস একটি মুক্ত ও অবাধ নির্বাচন অনুষ্ঠানের জন্য কম সময় মনে হলে এ সময় সামান্য বৃদ্ধি করার ব্যাপারেও সিদ্ধান্ত গ্রহণ করতে পারতেন।
কিš‘ দুঃখের বিষয় ১৯৯৬ সালে ত্রয়োদশ সংশোধনী পাস হওয়ার পর সাংবিধানিক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচন শুর“ হলে এ ব্যব¯’ার নানা ত্র“টি-বিচ্যুতি লক্ষ্য করা গেলেও রাজনৈতিক নেতৃত্ব এ সরকার ব্যব¯’ার কোন সংস্কারের উদ্যোগ গ্রহণ করেনি।
তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে তিনটি নির্বাচন হওয়ার পর আওয়ামী লীগের নির্বাচনী ইশতেহারে না থাকা সত্ত্বেও হঠাৎ করে উ”চ আদালতের একটি রায়ের সংক্ষিপ্ত আদেশের একাংশের ওপর ভিত্তি করে সংবিধান বিশেষজ্ঞ, সুশীল সমাজ, অ্যামিকাস কিউরি এবং সর্বোপরি সাধারণ মানুষের পরামর্শ উপেক্ষা করে এ সরকার তড়িঘড়ি সংবিধানের পঞ্চদশ সংশোধনী পাস করে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যব¯’া বাতিল করে। যেসব সমস্যার কারণে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যব¯’া প্রবর্তন করা হয়েছিল, ওই সমস্যাগুলো সমাধান না করে, নির্বাচন কমিশন শক্তিশালী না করে এ ব্যব¯’া বাতিল করে দেয়ায় দলীয় ব্যব¯’ার অধীনে সংসদ নির্বাচনের ব্যব¯’া করা হয়। এর ফলে বিরোধী দল এবং নাগরিক সমাজ মনে করে, মন্ত্রী ও এমপিরা নিজ পদে থাকা অব¯’ায় দলীয় সরকারের অধীনে অবাধ নির্বাচন হওয়ার মতো পরিবেশ দেশে এখনও তৈরি হয়নি। ফলে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচন অনুষ্ঠানের দাবি নিয়ে আন্দোলন গড়ে উঠেছে এবং ওই আন্দোলন হরতাল, রোডমার্চ, সমাবেশ-মহাসমাবেশ, মানববন্ধন প্রভৃতির মধ্য দিয়ে চলমান রয়েছে, আর এরই ধারাবাহিকতায় প্রধান বিরোধী দল তাদের দাবি মেনে নিতে সরকারকে ১০ জুন পর্যন্ত সময় বেঁধে দিয়েছে। এ সময়ের মধ্যে সরকার দাবি না মানলে বিএনপির নেতৃত্বাধীন ১৮ দলীয় জোট কঠোর আন্দোলন কর্মসূচি ঘোষণা করার হুমকি দিয়েছে। এ অব¯’ায় কোন সংলাপ না হওয়ায় এবং সরকারি দল ও প্রধান বিরোধী দল পরস্পরবিরোধী অব¯’ান গ্রহণ করায় দেশে রাজনৈতিক সহিংসতা ও সংঘাতের আশংকা দেখা দিয়েছে।
বর্তমান রাজনৈতিক পরি¯ি’তির সঙ্গে ১৯৯৬ সালের তত্ত্বাবধায়ক সরকার আন্দোলনের সময়কার পরি¯ি’তির অনেকটা সাদৃশ্য রয়েছে। ওই সময় সরকার কিছুতেই তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচন দিতে চায়নি, কিš‘ আওয়ামী লীগ-জামায়াতের কঠোর আন্দোলনের চাপে অনেক দেরি করে হলেও একপর্যায়ে আরেকটি নির্বাচন করে সংবিধানের সংশোধনীর মধ্য দিয়ে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচনের দাবি মেনে নিতে বাধ্য হয়। এখনও কি পরি¯ি’তি সে রকম? এখনও সরকার কিছুতেই তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচন দিতে চাইছে না, আর বিরোধী দল সাফ জানিয়ে দিয়েছে, দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচন হলে সে নির্বাচনে তারা অংশগ্রহণ করবে না। বিরোধী দলগুলো তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচনের দাবিতে আন্দোলন করে যা”েছ এবং সে আন্দোলনের অংশ হিসেবে যুগপৎ নাগরিক সমাজ ও আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়কে মুক্ত ও অবাধ সংসদ নির্বাচনের স্বার্থে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের গুর“ত্ব অনুধাবন করাতে সমর্থ হয়েছে। এ কারণে ১০ জুনের আলটিমেটাম শেষে হয়তো বিরোধী দল আরও কঠোর আন্দোলন কর্মসূচির দিকে এগিয়ে যাবে। তবে সরকারও পরি¯ি’তি পর্যালোচনা করে বুঝতে পেরেছে যে, পুলিশের পিটুনি আর মামলা দিয়ে বিরোধীদলীয় নেতাকর্মীদের নির্দলীয় সরকারের আন্দোলন থেকে হয়তো ফেরানো যাবে না। বিরোধী দলের আলটিমেটাম নিকটবর্তী হওয়ায় সরকারের বক্তব্যে ইদানীং কিছুটা হলেও নমনীয়তা লক্ষ্য করা যা”েছ।
সরকারি দলের নেতারা প্রথমে বলেছিলেন, আদালত তত্ত্বাবধায়ক সরকার বাতিল করে দিয়েছেন, কাজেই এ ব্যাপারে আমাদের কিছুই করণীয় নেই। অন্যান্য গণতান্ত্রিক দেশে যেভাবে নির্বাচন হয়, আমাদের দেশেও তেমনিভাবেই অর্থাৎ দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচন হবে। মাননীয় প্রধানমন্ত্রীও সুকৌশলে অ-তত্ত্বাবধায়ক, অসাংবিধানিক ফখর“দ্দীন-মইনউদ্দিন জর“রি সরকারের কুকর্মের দায় তত্ত্বাবধায়ক সরকারের ওপর চাপিয়ে এ সরকারকে ‘দানব’ বলে অভিহিত করে এর সমালোচনা অব্যাহত রেখেছিলেন। কিš‘ সরকারি দল থেকে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের যতই সমালোচনা করা হোক না কেন, সাধারণ মানুষ দলীয় সরকারের চেয়ে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচন চায়। তারা মনে করে, দলীয় সরকারের অধীনে অবাধ নির্বাচন করার মতো পরিবেশ এখনও এ দেশে তৈরি হয়নি। এ কারণে বিরোধী দল থেকে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচন দাবি করে যে আন্দোলন করা হ”েছ সে আন্দোলন নাগরিক সমাজের সমর্থন পা”েছ। বিষয়টি বুঝতে পেরে বিরোধীদলীয় আলটিমেটাম শেষ হওয়ার প্রাক্কালে সরকারদলীয় নেতারা কিছুটা নমনীয় সুরে কথা বলছেন। দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচনের অনড় অব¯’ান থেকে সরে এসে এখন তারা অন্তর্বর্তীকালীন সরকার নিয়ে সংলাপ করতে চাইছেন।
এ বিষয়ে ২৭ মে ১৪ দলীয় বৈঠকের পর আওয়ামী লীগ সাধারণ সম্পাদক বলেন, ‘অন্তর্বর্তীকালীন সরকার ব্যব¯’ার রূপরেখা নিয়ে আলোচনার পথ সব সময় খোলা রয়েছে, তবে তত্ত্বাবধায়ক ব্যব¯’া নিয়ে নয়।’ সরকারদলীয় সাধারণ সম্পাদকের এ বক্তব্যে যেমন সমঝোতার সুর ধ্বনিত হয়; তেমনি আবার যখন তিনি বলেন, ‘অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের রূপরেখা যে এখনই চূড়ান্ত করতে হবে তা আমি মনে করি না। এ নিয়ে আলোচনার যথেষ্ট সময় রয়েছে’, তখন মনে হয় তার এ বক্তব্য সহিংসতা ও সংঘাতকে প্রশ্রয় দি”েছ। কারণ, যে ইস্যু নিয়ে মাসের পর মাস আন্দোলন চলছে, দেয়া হ”েছ হরতাল, রোডমার্চ, মহাসমাবেশ, আলটিমেটাম ও পরবর্তী সময়ে আসছে আরও কঠোর কর্মসূচি, সে ইস্যুটি যদি দ্র“ত সমাধান করা যায় তাহলে এটাই কি সবার জন্য ভালো নয়? সরকারি দল চাইছে বিরোধী দলকে চাপে রেখে তাদের দিয়ে এ বিষয়ে প্রস্তাব উত্থাপন করাতে। কারণ, বিরোধী দল কোন প্রস্তাব উত্থাপন করার পর সরকারি দলের পক্ষে তা নাকচ করা বা তাকে ভিন্ন রূপ দিয়ে পাস করানোর মতো সংসদীয় শক্তি রয়েছে। বিরোধী দলও সহজে সরকারি দলের ফাঁদে পা দিতে চাইছে না। তারা বলছে, সমস্যাটি সরকারি দল তৈরি করেছে, কাজেই এর সমাধান-উদ্যোগও সরকারি দলকেই নিতে হবে। কারণ এ উদ্যোগকে সাংবিধানিক ভিত্তি দেয়ার শক্তি একমাত্র সরকারি দলেরই রয়েছে।
সরকারি দল ‘অন্তর্বর্তীকালীন সরকার’ বলে আলোচনা করতে চাইলে সমস্যার সমাধান হবে না এবং এ ব্যাপারে বিরোধী দলও আকৃষ্ট হবে না। তাদের ঝেড়ে কাশতে হবে। এ সম্ভাব্য আলোচনার আগে একটি মাত্র বিষয় তাদের পরিষ্কার করতে হবে, আর তা হল তাদের উল্লিখিত অন্তর্বর্তীকালীন সরকারদলীয় নাকি নির্দলীয় হবে। যদি সরকার এ অন্তর্বর্তীকালীন সরকারকে নির্দলীয় চরিত্র প্রদানে রাজি হয়, তাহলে আর এ বিষয়ে সংলাপে বিরোধী দলের রাজি না হওয়ার কোন কারণ থাকবে না। আর এ নিয়ে সংলাপ করতে পারলে সরকারি ও বিরোধী দল মিলে এ সরকারের বাকি বৈশিষ্ট্য কেমন হবে সে বিষয়গুলো ঠিক করে নিতে পারবে। এর মধ্যে যে বিষয়গুলো প্রাধান্য পাবে তা হ”েছ এ সরকারের সদস্যদের নির্বাচিত হতে হবে নাকি নির্বাচিত না হলেও চলবে; এর প্রধান উপদেষ্টা কে কী প্রক্রিয়ায় মনোনীত হবেন; এর সদস্য সংখ্যা কত হবে; তারা কিভাবে মনোনীত হবেন; এর আয়ুষ্কাল ও কর্মপরিধি কেমন হবে; সরকারের মন্ত্রী-নেতারা এতে জড়িত থাকবেন কিনা প্রভৃতি। সময় থাকলেও এ আলোচনা যত দ্র“ত হবে, দেশ ও জাতির জন্য ততই মঙ্গল। কারণ বিষয়টি ফয়সালা না হওয়া পর্যন্ত বিরোধী দল আন্দোলন কর্মসূচি দিয়েই যাবে, আর আন্দোলন কর্মসূচি মানেই পুলিশের পিটুনি, ভ্রাম্যমাণ আদালতের মামলা, গ্রেফতার এবং এসবের মধ্য দিয়ে সরকারি ও বিরোধী দলের মধ্যে দূরত্ব বৃদ্ধি। সাধারণ মানুষ সরকারি ও বিরোধী দলের মধ্যে দূরত্ব দেখতে চায় না, তারা চায় উভয় দল সমঝোতার ভিত্তিতে উদ্ভূত সমস্যার সমাধান কর“ক। এ সমঝোতা প্রক্রিয়ায় যে দল যত গঠনমূলক ভূমিকা পালন করতে পারবে, নাগরিক সমাজে সে দলের তত বেশি জনপ্রিয়তা বৃদ্ধি পাবে। আর মুক্ত ও অবাধ নির্বাচন হলে এই জনপ্রিয়তাকে পুঁজি করে সে দল নির্বাচনে ততই এগিয়ে যেতে পারবে। সরকারের নাম কী হবে, তাতে কিছুই এসে যায় না। সম্ভাব্য সরকারের নাম যদি তত্ত্বাবধায়ক সরকার না হয়ে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার হয় তাতে কেউই কোন আপত্তি করবেন বলে মনে হয় না, যদি ওই সরকার নির্দলীয় চরিত্র নিয়ে সম্পূর্ণ রাজনৈতিক প্রভাবমুক্ত হয়ে সংসদ নির্বাচন পরিচালনায় নির্বাচন কমিশনের সঙ্গে নিরপেক্ষভাবে কাজ করতে পারে।
ড. মুহাম্মদ ইয়াহ্ইয়া আখতার : অধ্যাপক, রাজনীতিবিজ্ঞান বিভাগ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়
ধশযঃবৎসু@মসধরষ.পড়স

কেন এই বাক্যদূষণ!

মোঃ শরীফুল ইসলাম খান
উ”চ মাধ্যমিকে বাংলা পাঠ্যবইয়ের বিলাসী গল্পের একটি লাইন প্রায়ই মনে পড়ে। জীবনের ধূসর লগ্নে তা হুবহু মনে করতে পারি কিনা জানি না। যতদূর মনে পড়ে শরৎচন্দ্র বলেছিলেন, ‘২৬ বছর সংসার জীবনযাপন করিয়াও একে অন্যকে চিনিতে পারে নাই।’ বহু বছর পর একটি জাতীয় দৈনিকে পরিবেশিত সংবাদ থেকে জানতে পারি, ‘৯২ বছর বয়স্কা জনৈকা বৃদ্ধা (দেশ ও নাম মনে নেই) ৭৪ বছর সংসার জীবনযাপন করার পর তার প্রথম স্বামীকে ছেড়ে প্রেমিকের সঙ্গে নতুন করে সংসার জীবনে আবদ্ধ হন।’ ৭৪ বছর সংসার অতিবাহিত করে তিনি বুঝতে পারেন তার সাবেক স্বামী তার জন্য সঠিক ব্যক্তি ছিল না। সেই কারণে তার একাকিত্ব মোচনে তাকে ৭৪ বছর পর অন্য কাউকে বেছে নিতে হল। উপরের গল্প ও সংবাদের উদ্ধৃতি সংসার জীবনকে ঘিরে কোন দোদুল্যমানতা তৈরির জন্য নয়। কবি, সাহিত্যিক, মনোবিজ্ঞানী আজও যে জায়গাটিতে অহরহ অনুসন্ধান করে বেড়া”েছন, তা হ”েছ মানুষের মন। এ মন কখন কী চায় তা আজও রহস্যের বেড়াজালে রয়ে গেছে। আর তাই তাকে পুরোপুরি বোঝার জন্য কাজ করে যা”েছ বিজ্ঞান। শুনতে পাই ভবিষ্যতে এমন যন্ত্র আবিষ্কার হবেÑ যা মানুষের ভেতরকার চিন্তা-চেতনাকে প্রকাশ করবে। তার আগ পর্যন্ত মানুষের ই”ছা, অনি”ছা, ক্রোধ, ভালোবাসা এগুলোর বহিঃপ্রকাশের সর্বোত্তম মাধ্যম ও বাহন হ”েছÑ ভাষা; আর সেই ভাষার যথাযথ প্রয়োগের জন্য বাক্য চয়ন অত্যন্ত গুর“ত্বপূর্ণ। একজন মানুষের ধ্যান-ধারণা, চিন্তা-চেতনা, তার ভেতরের যে আমি তার বহুল অংশ পরিস্ফুটিত হয়ে আসে তার বাক্য দিয়ে। আমরা একজন মানুষ কতটা মার্জিত ও র“চিবোধসম্পন্ন, তিনি কী করতে চান, কী করতে পারবেন তার অধিকাংশই নির্ণয় করি তার কথাবার্তার ধরন ও বাক্য প্রয়োগের মাধ্যমে। বাক্যের গুর“ত্ব অন্য আরেকটি কারণে। এ বিশ্ব সংসারের অনেক কিছুই ভুল ছিল বলে পরিবর্তন ও পরিবর্ধনের আওতায় আনা যায়। পরিবেশ দূষণের মারাÍক প্রতিক্রিয়াকেও সম্মিলিত প্রচেষ্টায় ঠেকানো যায়। কিš‘ বাক্য একবার মুখ থেকে বের হয়ে গেলে তা বাতাসে মিলিয়ে যায়, কোন চেষ্টাতেই নির্গত বাক্য ফিরিয়ে এনে তাকে নতুন করে সাজানো বা সংশোধন করা যায় না। বিজ্ঞান এখনও তা পারেনি। অশালীন বাক্য প্রয়োগ করে পরে হয়তো দুঃখ প্রকাশ করা যায়, সংসদে এক্সপাঞ্জ করা যায়, কিš‘ হারিয়ে যায় ব্যক্তির ব্যক্তিত্ব ও মর্যাদা। যদিও ব্যক্তি ধারণা করে, আমরা এগুলো এক সময় ভুলে যাই, আবার তাদের মর্যাদার আসনে প্রতিষ্ঠিত করি। আসলে আমরা তা ভুলি না। অন্য কোন উপায়ান্তর না দেখে বা কখনও তাঁবেদারির মজ্জাগত কারণে আমরা ভুলে যাওয়ার বা মর্যাদা দেয়ার ভান করি মাত্র।
আমাদের সামাজিক বলয়ের বেশির ভাগ লোকই অপ্রাপ্তির মহাফোকরে দিন দিন কথাবার্তা, চালচলনে বেপরোয়া হয়ে পড়ছি। সমবেদনা, সংবেদনশীলতা, সহ্য ক্ষমতা এগুলো আমাদের একেবারেই নেই বরং অশোভন আচরণ এখন আমাদের মার্কা হয়ে দাঁড়িয়েছে। আমাদের দেশে এখন আর এহেন ক্ষেত্র নেই, যেখানে বিভক্তি নেই আর এ বিভক্ত বলয়ে ভাগাভাগি হয়ে নিজেরা অশালীন, অসভ্য উক্তিতে দূরত্ব তৈরি করছি একে অন্যের সঙ্গে। একটু নজর দিলে দেখব রাস্তায় কর্তব্যরত পুলিশ, সার্জেন্ট, ট্রাফিক, হাসপাতালে আয়া, নার্স, ডাক্তার, সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারী, করপোরেটের ব্যক্তিরা, শিক্ষক, রাজনীতিবিদ এবং সামাজিক বলয়ের অন্যরা বেশির ভাগ ক্ষেত্রে রাগ দমন করি অসভ্য, নোংরা ও কুর“চিপূর্ণ বাক্য প্রয়োগের মাধ্যমে, যা আমাদের সমাজের সব স্তরকে করে ফেলছে র“চিহীন। অসহিষ্ণু হয়ে উঠছে সারা জাতি, কেউ কাউকে মানছি না, বিশ্বাস করছি না। সেই ধারায় ভেঙে যা”েছ নদী ভাঙনের মতো সমাজের সব কূল। পরিশীলিত জাতি হিসেবে আমাদের তৈরি হওয়ার পথ করে ফেলছি কষ্টসাধ্য, সভ্যতার অগ্রগতি থেকে রয়ে যা”িছ দূরেÑ বহু দূরে। বিধ্বস্ততায় হিতাহিত জ্ঞান লোপ পেয়ে নামছি ধ্বংসযজ্ঞে। যে কোন ইস্যুতেই ভাঙছি নিজেদের গাড়ি নিজেরা। নিজেরা পোড়া”িছ নিজেদের, যখন বোধোদয় ঘটবে তখন নিঃশেষ হয়ে যাবে হয়তো অনেক কিছু। তাই আর দেরি না করে রাজনীতিকদেরই ফিরিয়ে আনতে হবে পুরো জাতিকে সু¯’তায়।
আমরা জানি, যে কোন পরিবর্তন, পরিবর্ধন, সচেতনতা, প্রণোদনা, আইন-কানুন এগুলো সাধারণ জনগণের আওতাভুক্ত নয়। সরকার একমাত্র যন্ত্র, যে এগুলো প্রয়োগ করে জনগণের সুষ্ঠু জীবন ধারণের নিশ্চয়তা প্রদান করতে পারে। সরকার ও সরকারি দলকে নিজেদের কথাবার্তায়, আচার-আচরণে লাগাম ধরে রাখতে হবে। সরকারকে এ লাগাম ধরে রাখায় সর্বাধিক সহায়তা করার নৈতিক দায়িত্ব বিরোধী দলের।
রাজনীতিতেই যদি চলতে থাকে অশোভন কথার ফুলঝুরি, চলে দ্বৈত-বাক্য সংঘাত, তাহলে দেশের আর অন্য কোন কাঠামোতে শোভন কিছু প্রত্যাশা করার কোন সুযোগই নেই। সুন্দর গোছানো বাক্য দিয়ে অনেক নেতিবাচক বিষয়কেও ইতিবাচক বোধে আনা যায়। নির্দিষ্ট ইস্যুতে বাকবিতণ্ডা চলতে পারে কিš‘ খারাপ বাক্য অনেক ইতিবাচক বিষয়কেও প্রশ্নবোধক করে তোলে এবং অযথা দ্বন্দ্ব তৈরি করে। রাজনীতিতে বাক্যের অশালীনতার প্রকোপ বাড়ার অন্যতম যে কারণÑ আমাদের দেশের বর্তমান রাজনীতিতে প্রত্যাশিত ভালো মানুষ এখন আর সম্পৃক্ততা রাখতে চান না। এখন রাজনীতিতে যারা সম্পৃক্ত ও সো”চার তাদের বেশির ভাগই সামাজিক বলয়ে অপ্রত্যাশিত পরিচিতিতে বেড়ে ওঠা। আরেক শ্রেণী রয়েছেন যারা রাজনীতি ভালো বোঝেন, রাজনীতিবিদ হিসেবে প্রথিতযশা কিš‘ তাদের বাক্য এক, কর্ম আরেক। বাক্য দিয়ে দেশ ও জাতির স্বপ্ন বুনেন আর ক্ষমতাপুষ্ট হয়ে কর্ম দিয়ে অকাতরে করেন জনতার স্বপ্ন চুরি। নিজেরাও করেন, নিজের অস্তিত্বের স্বার্থে অন্যকে দিয়েও করান। রাজনীতির এ হীন ও অপসংস্কৃতির কারণে সাধারণত সুধীজন ও সুশীল মানসিকতার বেশির ভাগই রাজনীতির বাইরে মানসম্মান নিয়ে বেঁচে থাকাকেই প্রাধান্য দিয়ে থাকেন। রাজনীতি, অর্থনীতি বা সমাজ পরিবর্তনে বরেণ্য ব্যক্তিদের কোণঠাসা অব¯’া অবলোকন করা ছাড়া অন্য কোন অব¯’ান নেয়ার সাহস ও মানসিকতা দিন দিন ফুরিয়ে যা”েছ আমাদের। সেই ফোকরে রাজনীতি চলে যা”েছ নোংরামির সর্বশেষ পর্যায়ে। হজম করার সবচেয়ে দুঃখজনক পরিণতির যে নজিরটি এরই মধ্যে ¯’াপন করে ফেলেছি আমরা তা হ”েছ, ড. ইউনূসের মতো একজন বিশ্ব বরেণ্য এবং দেশের একমাত্র নোবেল বিজয়ীকে রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত হয়ে বাক্যবাণে মানসিক নিপীড়ন করা।
প্রায়ই আমাদের সংসদে সংসদ সদস্যদের মধ্যে যে অযাচিত বাক্যাবলী ব্যবহƒত হয় সেটা অনভিপ্রেত। সংসদে সংসদ সদস্যদের মধ্যে অনভিপ্রেত ঘটনা তৈরির নজির সারাবিশ্বে নতুন কিছু নয়। কিছুদিন আগেও (৩০ মার্চ ২০১২) তুরস্কের পার্লামেন্টে সংসদ সদস্যরা স্কুল সংস্কার আইন পাস করা নিয়ে হাতাহাতি করেছেন। আমাদের সংসদে বেশির ভাগ অশ্রাব্য কথাবার্তা ব্যক্তিকে কেন্দ্র করে। ব্যক্তির প্রতি ব্যক্তির বিদ্বেষের মাত্রা যে বর্বরতার দিকে দেশ ও জাতিকে ঠেলে দি”েছ তার ফলাফল সারাজাতি ভোগ করছে। সেদিনও সামান্য পায়ে পাড়া দেয়ার ঘটনাকে কেন্দ্র করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ও ঢাকা কলেজের ছাত্ররা যে ধ্বংসযজ্ঞ চালিয়েছে তার ভোগান্তির শিকার হয়েছে সাধারণেরা। কথা কাটাকাটি, অশ্রাব্য গালাগালি মানুষের মধ্যে জানোয়ারের উš§াদনা এনে দেয় আর সেই উš§াদনায় সভ্যতা বিকলাঙ্গ হয়ে পড়ে। সোজা হয়ে তা দাঁড়াতে পারে না।
সাধারণেরা সাধারণ। এদের সোজা পথে আনা খুব কঠিন কিছু নয়। এ দেশে এখনও ভালো মানুষের সংখ্যাই বেশি। প্রয়োজনে কড়া কিছু আইন তৈরি করে এবং সর্বতোভাবে তা প্রয়োগ করে জনগণকে উন্নয়নের ধারায় নিয়ে আসা যাবে। রাজনীতিবিদরা দেশের মূল চালিকাশক্তি। প্রাপ্তি-অপ্রাপ্তির সব হিসাব-নিকাশে এরা রাজ-রাজা। তাই সর্বাগ্রে রাজনীতিবিদদেরই বাক্য সংযম প্রয়োজন। বাক্য দূষণের ধ্বংস ভীষণ, তা উপলব্ধি করতে না পারলে হিন্দি ছবির অশ্লীল দৃশ্য থেকে বা”চাদের দৃষ্টি এড়ানোর জন্য আমরা যেমন টিভি চ্যানেল পরিবর্তন করে ফেলি, তেমনিভাবে রাজনীতিবিদদের কাছ থেকে মুখ ফিরিয়ে নিতে পারে আমাদের বর্তমান ও ভবিষ্যৎ প্রজš§।
মোঃ শরীফুল ইসলাম খান : ব্যাংকার
ংযধৎরভশযধহ৬৪@মসধরষ.পড়স

খুনের অংশীদারিত্ব নিয়ে প্রশ্ন!

মুহাম্মদ ইসমাইল হোসেন
দেশে এখন কে কোথায় কিভাবে খুন হ”েছন বা হবেন, তার হিসাব রাখাই মুশকিল হয়ে পড়েছে! এসব খুনের ক্ষেত্রে সবচেয়ে এগিয়ে আছে বাস, মিনিবাস, ট্রাকচালকরা। কখন কোন পরিবহন শ্রমিক কার গায়ের ওপর কিভাবে গাড়ি চাপিয়ে দেবেন, দেশজুড়ে তারই যেন প্রতিযোগিতা চলছে। গত শুক্রবার সকাল ৭টায় গুলশান থেকে উত্তরা আসতে এয়ারপোর্ট রোডে রিজেন্সি হোটেলের সামনে দেখলাম ১০-১২টি বাস-মিনিবাস তালগোল পাকিয়ে সম্পূর্ণ রাস্তা ব্লক করে রেখেছে। ছুটির দিনে সকালে রাস্তা মোটামুটি ফাঁকা থাকায় একটু স্পিডে চলা আমার গাড়িটিকে হঠাৎ ব্রেক কষে পরি¯ি’তি সামাল দিতে হল। কিš‘ বাস-মিনিবাসগুলো আড়াআড়ি করে রাখায় আমার ছোট্ট গাড়িটি বের করে এগিয়ে চলার একটু জায়গাও খুঁজে পাওয়া গেল না। ১৬ থেকে ১৮ বছরের একেকজন ড্রাইভারের প্রায় প্রত্যেকেই মুখে সিগারেট গুঁজে রাস্তাটাকে একান্তই নিজের করে নিয়েছেন এবং তাদের হেলপাররা ডাকাডাকি, হাঁকাহাঁকির প্রতিযোগিতা করে যাত্রী উঠা”েছন। এভাবে কিছুক্ষণ পর একটি গাড়ি সরে গেলে কোনমতে আমরা বেরিয়ে এলাম। এই হল এয়ারপোর্ট রোডের মতো একটি গুর“ত্বপূর্ণ রাস্তার অব¯’া! এভাবে রাস্তা ব্লক করে দেশজুড়েই এসব প্রাপ্ত-অপ্রাপ্তবয়স্ক হাজার হাজার ড্রাইভার দিনরাত যে রাস্তাঘাটে অনাচার, অত্যাচার এবং দুর্ঘটনা ঘটিয়ে চলেছে, তা বলাই বাহুল্য। তাদের একেকজনের শারীরিক ভাষা, মুখের ভাষা এমনই ভয়ংকর যে, তা দেখলে বা শুনলে মানুষ দূরের কথা, ভূত পর্যন্ত পালায়। রাস্তার মাঝখানে গাড়ি থামিয়ে যাত্রী উঠানো-নামানো, ভয়ংকর গতিতে গাড়ি চালানো, মোড় ঘোরানো, ওভারটেকিং করা তাদের নিত্যদিনের খেলা। আর এসব ড্রাইভার-হেলপারের গুর“ হলেন আমাদের বর্তমান নৌপরিবহনমন্ত্রী শাজাহান খান। শাজাহান খান ছাড়াও সরকারি দল, বিরোধী দলে আরও অনেক ব্যক্তি আছেন, যারা ওইসব পরিবহন শ্রমিকের অপকর্মকে পুঁজি করে বড় বড় রাজনৈতিক নেতা হয়ে বসেছেন। ওইসব পরিবহন শ্রমিক খামখেয়ালি করে নৃশংসভাবে রাস্তাঘাটে মানুষ খুন করার সঙ্গে সঙ্গেই তাদের নেতারা খুনি ড্রাইভারদের পক্ষে সাফাই গাওয়া শুর“ করেন এবং গাড়ির দোষ, রাস্তার দোষ ইত্যাদি দোহাই দিয়ে খুনিদের রক্ষায় সর্বশক্তি নিয়োগ করেন। এভাবে থানা পুলিশের সঙ্গে তদবির-দালালি করে যিনি যত বেশি খুনি ড্রাইভারকে রক্ষা করতে পারেন, তিনিই তত বড় পরিবহন শ্রমিক নেতা হয়ে যান। কথা হল, পরিবহন শ্রমিকরা রাস্তায় গাড়ি চালানোর সময় দুর্ঘটনা ঘটতে পারে। কিš‘ তা নিছকই দুর্ঘটনা হওয়া উচিত এবং তা কালেভদ্রেই হতে পারে। কিš‘ এ দেশে যা হ”েছ, তা দুর্ঘটনা না হয়ে নিত্যনৈমিত্তিক খুনই হ”েছ বলা যায়। পরিবহন শ্রমিকরা সুসংগঠিত সংগঠনের সুযোগ এবং তাদের নেতাদের একতরফা আশীর্বাদ নিয়ে দিনরাত রাস্তাঘাটে অনিয়ম, বিশৃংখলা এবং গায়ের জোর প্রদর্শনের মাধ্যমে দুর্ঘটনার নামে একেকটি খুনের ঘটনা ঘটিয়ে গোঁফের নিচে মুচকি হাসি দি”েছন। কারণ দেশের প্রচলিত আইনে তারা ধরাছোঁয়ার ঊর্ধ্বে থাকায় এবং শ্রমিক নামধারী হাজার হাজার উ”ছৃংখল কিশোর-যুবকের সংগঠনসহ প্রতিটি সরকারেরই উ”চপদে তাদের নেতা থাকায়, তারা কোনরূপ নিয়ম-নীতি, নৈতিকতার তোয়াক্কা না করে অনায়াসে অপকর্ম অব্যাহত রেখেছেন। এসব শ্রমিক সংগঠন এবং তাদের নেতারা আবার চাঁদা আদায়ের মাধ্যমে আর্থিকভাবে এতটাই শক্তিশালী যে, টাকার জোরেও তারা অনেক কিছু করে ফেলেন। আবার রাজনীতিতেও তাদের ভীষণ কদর! মনে পড়ে, এরশাদ সরকারের আমলে এসব উ”ছৃংখল ড্রাইভার, যারা রাস্তাঘাটে দুর্ঘটনার নামে মানুষ হত্যা করে, তাদের বির“দ্ধে উপযুক্ত শাস্তির বিধানসংবলিত আইন করতে গেলে আওয়ামী লীগ-বিএনপি দুই দলই সে আইন প্রণয়নের বিরোধিতা করে রাস্তায় নেমেছিল। ফলে আজ পর্যন্ত কোন সরকারের পক্ষেই খুনি ড্রাইভারদের বির“দ্ধে উপযুক্ত আইন করা সম্ভব হয়নি। কারণ বর্তমান সরকারে যেমন শাজাহান খান আছেন, তেমনি সব সরকারের আমলেই অমন দু-চারজন থেকেই থাকেন। আর এসব পরিবহন শ্রমিক নেতা রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা দখল এবং পরিচালনার ক্ষেত্রে এতটাই অপরিহার্য যে, কোন সরকারই তাদের বাদ দিয়ে নিজেদের অস্তিত্ব কল্পনা করতে পারে না। নির্বাচনের সময় এমপি পদে মনোনয়ন থেকে শুর“ করে দেশ পরিচালনার ক্ষেত্রে পেশাদার মাস্তানদের প্রাধান্যের কারণেই দেশে আজ কে কোথায় কিভাবে খুন হবেন, তার প্রতিযোগিতা চলছে। এসব অপশক্তি ব্যবহারে সরকারি দল, বিরোধী দল উভয়েই সমভাবে পারদর্শী। এ পারদর্শিতায় যে দল বেশি এগিয়ে থাকে, তাদেরই জয়জয়কার হয় এবং সে জয়ের তিলক মাথায় নিয়েই একেকটি দল সরকার গঠন করে। আর সেই সরকারের প্রধানমন্ত্রী পর্যন্ত জানেন যে, এসব অপশক্তির অত্যাচারে দেশের মানুষ অতিষ্ঠ। বর্তমানে দেশের প্রতিটি পরিবারই এই ভেবে শংকিত যে, তাদের কেউ রাস্তায় বের হলেই সড়ক দুর্ঘটনা নামক খুনের শিকার হবেন! কিছুদিন আগে স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী পাবনা যাওয়ার পথে একটি বাসের সঙ্গে তার গাড়ির সংঘর্ষ হয়। সঙ্গে থাকা পাইলট কারের পুলিশ সে বাস ড্রাইভারকে আটক করলেও তেমন ক্ষয়ক্ষতি না হওয়ায় প্রতিমন্ত্রী মহোদয়ের নির্দেশে তাকে ছেড়ে দেয়া হয়। আবার মাত্র কয়েক দিন আগে নৌপরিবহনমন্ত্রী নিজ জেলায় গিয়ে একইভাবে বাসের সঙ্গে নিজ গাড়ির দুর্ঘটনার শিকার হন এবং তিনি সামান্য আহত হলেও তার সঙ্গী অপরজন গুর“তর আহত হন। এ অব¯’ায় সাধারণ নাগরিক যারা ছোটখাটো গাড়িতে, হেঁটে বা রিকশা ইত্যাদিতে পথ চলেন, তাদের অব¯’া কী, তা সহজেই অনুমেয়। তারা যে দিনরাত দুর্ঘটনার নামে খুনের শিকার হ”েছন, এখন আর তা বলার অপেক্ষা রাখে না। কারণ যেসব ড্রাইভার মন্ত্রী, প্রতিমন্ত্রীর গাড়িতেও আঘাত হানতে কসুর করেন না, তারা যে সাধারণ মানুষকে যমদূতের মতো রাস্তায় পিষ্ট করে হত্যা করবেন, নিত্যদিনের ঘটনায় সে কথাই তারা প্রমাণ করছেন। উপসংহারে তাই নৌপরিবহনমন্ত্রী তথা ড্রাইভার সাহেবদের নেতা মহোদয়কে একটি বিনীত প্রশ্ন করবÑ ‘আপনার সংগঠনের ড্রাইভার সাহেবরা নিত্যদিন দুর্ঘটনার নামে যেসব খুনখারাবি করে চলেছেন, তাতে আপনি অংশীদার হয়ে যা”েছন না তো?’
মুহাম্মদ ইসমাইল হোসেন : মুক্তিযোদ্ধা, কলামিস্ট

বাংলাদেশে সংবাদ মাধ্যমের ওপর সরকারি হামলা


ব দ রু দ্দী ন উ ম র
আজ থেকে ঠিক দু’বছর আগে শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন তথাকথিত মহাজোট সরকারের পুলিশ দৈনিক আমার দেশ পত্রিকা অফিসে হামলা চালিয়ে পত্রিকাটির সম্পাদক মাহমুদুর রহমানকে গ্রেফতার করেছিল এবং পত্রিকার প্রেসে তালা ঝুলিয়ে দিয়েছিল। আওয়ামী লীগ স্বাধীন বাংলাদেশে ক্ষমতাসীন হওয়ার পর থেকে দেখিয়ে দিয়েছে জনগণের ওপর নির্যাতন, অপহরণ, গুম খুন, সংবাদপত্রের ওপর হামলায় তারা কতখানি পারদর্শী। কাজেই এসব ক্ষেত্রে তাদের অভিজ্ঞতা এবং কৌশলগত দক্ষতা অন্য যে কোনো দলের থেকেই বেশি। যদিও শাসক শ্রেণীর অন্য দলও ক্ষমতায় থাকার সময় একই ধরনের কর্মকাণ্ড চালিয়ে যেতে চেষ্টার ত্রুটি রাখে না।
১৯৭৪ সালের ২৮ ফেব্রুয়ারি শেখ মুজিব বাংলাদেশে জরুরি অবস্থা জারি করে জনগণের ওপর নির্যাতনের যে স্টিমরোলার চালিয়েছিলেন, সেটা তার শাসনকে কলঙ্কিত করেছিল এবং সেটাই তার উত্খাতের প্রধান কারণ ছিল। শেখ মুজিব সংবাদপত্রের কণ্ঠরোধ যেভাবে করেছিলেন তার তুলনা একমাত্র প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খানের ১৯৭১ সালের নয় মাসের শাসন ছাড়া পাকিস্তান আমলে এবং আজ পর্যন্ত যত সরকার এসেছে তার কোনোটির আমলেই পাওয়া যাবে না। স্বাধীনতার লড়াইয়ের পর জনগণকে এভাবে যে ‘স্বাধীনতা’ শেখ মুজিবের নেতৃত্বাধীন আওয়ামী লীগ দান করেছিল, ঐতিহাসিক রেকর্ড থেকে সেটা মুছে ফেলা কারও পক্ষে সম্ভব নয়। দুষ্ট প্রকৃতির মতলববাজ লোক ছাড়া এ চিন্তা করাও কারও পক্ষে সম্ভব নয়।
১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ ইয়াহিয়ার সামরিক বাহিনী আমাদের জনগণের ওপর ব্যাপক ও নিষ্ঠুর আক্রমণ পরিচালনা শুরু করার সময় শেখ মুজিব নিজে বাড়িতে বসে থেকে পাকিস্তানি সামরিক বাহিনীর কাছে আত্মসমর্পণ করেছিলেন। স্বাধীনতা সংগ্রামে নেতৃত্ব দেয়ার কোনো ক্ষমতা তখন তার ছিল না। রাজনৈতিক দল হিসেবে সেই আক্রমণ প্রতিরোধের কোনো লাইনই আওয়ামী লীগের ছিল না। তারা শেখ মুজিবকে ধরে নিয়ে পাকিস্তানে চালান দিয়েছিল। দেশের লাখ লাখ মানুষ জীবন দান থেকে নিয়ে হাজার রকম নির্যাতনের শিকার হতে থাকার সময় তার নিরাপদ জীবনের দায়িত্ব নিয়েছিল পাকিস্তান সরকার। শুধু তাই নয়, ঢাকায় তার স্ত্রী ও বর্তমান প্রধানমন্ত্রীসহ পুত্র-কন্যাদের ভরণপোষণ ও নিরাপত্তার দায়িত্বও নিয়েছিল ইয়াহিয়ার সামরিক সরকার। অন্যদিকে ২৫ মার্চের পর স্বাধীনতার আওয়াজ তুলে আওয়ামী লীগের সর্বস্তরের নেতানেত্রীরা দেশের জনগণকে পাকিস্তানিদের বর্বরোচিত আক্রমণের মুখে ফেলে দেশ ছেড়ে প্রাণভয়ে যথাসাধ্য দ্রুততার সঙ্গে ভারতে পলায়ন করেছিলেন। ওই কাপুরুষতা ও দেশের জনগণের প্রতি কলঙ্কজনক আচরণের জন্য তাদের যে ব্যাখ্যা থাকা দরকার ছিল, সে ব্যাখ্যা তারা আজ পর্যন্ত কোনোদিন দেয়নি। দেশের মাটিতে দাঁড়িয়ে লড়াই না করে আওয়ামী লীগ নেতৃত্ব নিজেরা ভারতে নিরাপদ অবস্থানে থেকে বাংলাদেশ স্বাধীন করার দায়িত্ব অর্পণ করেছিলেন ভারতীয় সরকারের কাছে! ভারত সরকার দক্ষতার সঙ্গে সে দায়িত্ব পালন করেছিল!! এই যাদের অবস্থা ছিল, তারা ১৯৭১ সালের মার্চ মাসে দেশ স্বাধীন করতে চেয়েছিল, তার পরিকল্পনা করেছিল ও তার জন্য ডাক দিয়েছিল—এর থেকে হাস্যকর কথা আর কী হতে পারে? কিন্তু যা হাস্যকর তারই পতাকা আজ বাংলাদেশে উড়ছে। অন্যদিকে দেশের হাজার হাজার তরুণ ও যুবক দেশ স্বাধীন করার জন্য এগিয়ে এসেছিল। তারা আওয়ামী লীগের বা তার কোনো অঙ্গ সংগঠনের সদস্য ছিল না। দেশপ্রেমে উদ্বুদ্ধ হয়েই তারা বাংলাদেশের ভেতরে এবং ভারত থেকে বাংলাদেশের মধ্যে এসে পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর সঙ্গে লড়াই করেছিল। অগণিত সংখ্যক এই যোদ্ধা অকাতরে নিজেদের জীবন দিয়েছিলেন। কিন্তু যারা এভাবে জীবন দিয়েছিলেন তারা কোনো স্বীকৃতি পাননি, তাদের পরিবার এবং যারা এই যুদ্ধে নানাভাবে শরিক ও ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিলেন তারা ১৯৭১-এর ১৬ ডিসেম্বরের পর কিছুই পাননি। যারা কলকাতায় বসে ছিল এবং যারা দেরাদুনে ভারতীয় জেনারেল ওভান্দের তদারকিতে ভারতীয় এজেন্ট হিসেবে ট্রেনিং লাভ করেছিল তারাই দেশে ফিরে মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে নিজেদের ঢেঁড়ি পিটিয়ে মাখন-রুটির ব্যবস্থা করেছিল। লুটপাট করে দেশকে ছারখার করেছিল। শেখ মুজিব পাকিস্তানিদের হেফাজত থেকে ঢাকায় এসে স্বাধীন বাংলাদেশের জনগণের দণ্ডমুণ্ডের কর্তা হয়েছিলেন। কিন্তু এমনভাবে তারা স্বাধীন বাংলাদেশে নিজেদের শাসন পরিচালনা করেছিলেন যাতে মাত্র সাড়ে তিন বছরের মাথায় প্রায় সমস্ত পরিবারসহ শেখ মুজিব নিজে নিষ্ঠুরভাবে নিহত হয়েছিলেন এবং আওয়ামী লীগ সরকারই শুধু নয়, সংগঠনও এমনভাবে বিলুপ্ত হয়েছিল যাতে মুজিব হত্যা ও নিজেদের সরকার উত্খাতের বিরুদ্ধে সামান্যতম কোনো প্রতিবাদ ও প্রতিরোধই তাদের পক্ষে সম্ভব হয়নি। চরম প্রতিক্রিয়াশীল একটি সামরিক চক্র মার্কিন গোয়েন্দা সংস্থা সিআইএ’র সহযোগিতায় শেখ মুজিব এবং আওয়ামী লীগকে এভাবে হত্যা ও নিশ্চিহ্ন করলেও এর মূল দায়িত্ব সেই সামরিক চক্রের ঘাড়ে চড়িয়ে দেয়া একেবারেই সঠিক হচ্ছে না। সেটা কোনো যোগ্য ঐতিহাসিকেরই কাজ নয়। এজন্য আওয়ামী লীগকে নিজের দায় অবশ্যই স্বীকার করতে হবে।
কিন্তু সে দায় স্বীকার করার মতো নৈতিক ও রাজনৈতিক সততা তাদের না থাকায় বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রাম এবং ১৯৭১ সালে স্বাধীনতা যুদ্ধের ইতিহাসকে তারা ১৯৭২ সাল থেকেই বিকৃত করতে থাকে। ইতিহাস রচনার ক্ষেত্রে তাদের এই ভূমিকার জন্য বাংলাদেশের স্বাধীনতার ইতিহাস বিকৃতকরণের যত রকম চেষ্টা হয়েছে, তার পথিকৃতের গৌরব আওয়ামী লীগেরই প্রাপ্য।
বাংলাদেশে আজ সমগ্র জনগণ ও সেই সঙ্গে সংবাদপত্র ও বৈদ্যুতিক সংবাদ মাধ্যমের ওপর যেভাবে সরকারি আক্রমণ চলছে, একে এর ঐতিহাসিক পরিপ্রেক্ষিতে উপস্থিত করার উদ্দেশ্যে ওপরের এত সব কথা বলার প্রয়োজন হলো। শুধু আওয়ামী লীগই এসব করছে, তার জন্যই এর প্রয়োজন নয়। আওয়ামী লীগ ছাড়া ১৯৭৫ সালের পর প্রত্যেকটি সরকারই পরিস্থিতি অনুযায়ী একই কাজ করেছে। এ বিষয়টি ভুলে গিয়ে শুধু আওয়ামী লীগের সমালোচনার মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকলে তার কোনো গণতান্ত্রিক তাত্পর্য থাকবে না। কিন্তু এ সত্ত্বেও যা বলা দরকার তা হলো, ১৯৭২-৭৫ সালের আওয়ামী বাকশালী শাসন আমলে জনগণের ওপর নির্যাতনের যে ঐতিহ্য শুরু হয়েছিল, সেই ঐতিহ্যের ধারাবাহিকতা রক্ষা করেই অন্যান্য সরকার অভিন্ন শাসক শ্রেণীর পক্ষে একইভাবে একই কাজ করেছে। কাজেই সংবাদপত্র এবং বৈদ্যুতিক সংবাদ মাধ্যমের ওপর আক্রমণ শুধু আওয়ামী লীগেরই কাজ নয়। বিএনপি, জাতীয় পার্টি কেউই এদিক দিয়ে নিজেদের সরকারের আমলে হাত গুটিয়ে বসে ছিল না।
দুই বছর আগে দৈনিক আমার দেশ-এর ওপর বর্তমান আওয়ামী লীগ সরকারের আক্রমণ প্রসঙ্গে ফিরে এসে বলা দরকার যে, এই পত্রিকাটি সরকারবিরোধী রিপোর্ট ও নানা তথ্য প্রকাশ করার জন্য যেভাবে পুলিশ তার ওপর ঝাঁপিয়ে পড়েছিল, এখন সে আক্রমণ আরও ব্যাপক আকারে দেশজুড়ে চলছে। এমনকি যে রিপোর্ট ও তথ্য প্রকাশিত হয়নি কিন্তু প্রকাশের মুখে ছিল, তা বন্ধ করার জন্য সাংবাদিক হত্যাও এখন শুরু হয়েছে! সেই হত্যাকাণ্ডের কোনো প্রকৃত তদন্ত যে আজ পর্যন্ত হচ্ছে না, এর কারণ বোঝার অসুবিধা কোনো সত্ লোকের আছে?
বাংলাদেশে সংবাদপত্র ও সাংবাদিকদের ওপর আক্রমণ এখন প্রায় প্রতিদিন এমনভাবে হচ্ছে যাতে একে এক নিয়মিত ব্যাপার হিসেবে গণ্য করা চলে। মারপিট, অপহরণ, গুম-খুন সবকিছুই যেমন সাধারণ রাজনৈতিক বিরোধীদের ক্ষেত্রে হচ্ছে, তেমনি তা হচ্ছে সাংবাদিকদের ক্ষেত্রেও। অবস্থা এখন এমন দাঁড়িয়েছে যে, এই আক্রমণ শুধু সরকারবিরোধী সাংবাদিকদের মধ্যেই সীমাবদ্ধ নেই। নানা ধরনের বিক্ষোভ সমাবেশের সংবাদ সংগ্রহের জন্য সরকার সমর্থক পত্রিকার সাংবাদিকরাও পুলিশের আক্রমণের শিকার হচ্ছেন।
দৈনিক আমার দেশ সরকারের আক্রমণের বিশেষ লক্ষ্যস্থল এ কারণে যে, এই পত্রিকাটি যথেষ্ট তথ্য সহকারে সরকারের নানা দুষ্কৃতির সংবাদ জনগণকে সরবরাহ করে থাকে। এই পত্রিকাটির বিক্রি এবং প্রচারও যথেষ্ট। কাজেই এর বিরুদ্ধে শুধু পুলিশি আক্রমণ নয়, পরোক্ষভাবে বিজ্ঞাপন বন্ধ করে একে আর্থিকভাবে পঙ্গু করার ব্যবস্থাও সরকার করেছে। এই পরিস্থিতিতে শুধু সরকারি বিজ্ঞাপনই নয়, বেসরকারি বিজ্ঞাপন থেকেও এরা বঞ্চিত হচ্ছেন। কারণ সরকারের এই বিজ্ঞাপননীতি লঙ্ঘন করে বিজ্ঞাপন দিলে বিজ্ঞাপনদাতারা সরকারি রোষ এবং হয়রানির শিকার হওয়ার ভয় করেন। ভয় করারই কথা। সবশেষে এখানে বলা দরকার যে শুধু আমার দেশ পত্রিকাটিই নয়, দেশজুড়ে সংবাদপত্র ও সাংবাদিকদের বিরুদ্ধে এখন যে সরকারি আক্রমণ প্রায় প্রতিদিন নিয়মিতভাবে চলছে, তার বিরুদ্ধে জোরদার সংগ্রাম সাংবাদিকরা করছেন না। তারা যেভাবে সংগ্রাম করছেন সেটা দাঁড়াচ্ছে সংগ্রাম সংগ্রাম খেলার মতো। এজন্য তারা মানববন্ধন, অনশন, ঘরোয়া সভা, দলবাজি ইত্যাদি করলেও এখনও পর্যন্ত তাদের ঢাকা এবং অন্যত্র কোনো বড় সমাবেশ ও মিছিল করতে দেখা যায়নি। মিছিল ছাড়া কোনো আন্দোলন শক্তিশালী হওয়ার নয়। মিছিল হলো রাস্তার লড়াইয়ের এক অপরিহার্য অনুষঙ্গ। অন্যদের কর্মসূচির তথ্য সংগ্রহ করতে গিয়ে তারা মার খাচ্ছেন। কিন্তু নিজেদের কর্মসূচি নিয়ে রাস্তায় নেমে যখন তারা পুলিশের মার খাবেন, তখনই বোঝা যাবে যে সংবাদপত্র কর্মীরা নিজেদের বিরুদ্ধে আক্রমণ প্রতিরোধ ও নিজেদের পেশাগত স্বাধীনতা রক্ষার সংগ্রাম সঠিক পথে ও যথাযথভাবে শুরু করেছেন।
৩০-০৫-২০১২

মঙ্গল-আলোকে আলোকিত হোক জাতি

সৈয়দ আবুল মকসুদ
গণতন্ত্র ও সুশাসনের পথের কাঁটাগুলো অপসারণের দায়িত্ব রাজনৈতিক নেতাদের। পৃথিবীর বহু দেশেই বিভিন্ন সময় গণতন্ত্রের যাত্রাপথে বিচিত্র বাধা ছিল। গণতন্ত্রে নানা মত, নানা পথ থাকবেই। কোনো একটি মত কারও ওপর চাপিয়ে দেওয়া নয়, নানা মতাদর্শের সমন্বয়ের ভেতর দিয়েই গণতন্ত্র বিকশিত হয়। বাংলাদেশের প্রধান দলগুলোর মধ্যে যে মতপার্থক্য রয়েছে তা কমিয়ে আনা মোটেই কোনো কঠিন ব্যাপার নয়। শুধু দরকার রাজনীতিবিদদের সদিচ্ছা ও আন্তরিকতা

অনেক দুঃখের তিমিরের ভেতর দিয়ে বাংলাদেশের অভ্যুদয়। বিশ্ববাসী অনেকের আশঙ্কা ছিল বাংলাদেশ মাথা উঁচু করে টিকে থাকতে পারবে না। কারণ তার ভূমি কম, প্রাকৃতিক সম্পদ সীমিত এবং জনসংখ্যা ঘনবসতিপূর্ণ; কিন্তু তাদের আশঙ্কা বা অনুমান অমূলক প্রমাণিত হয়েছে। পাকিস্তান থেকে সরে এসে স্বাধীন বাংলাদেশ রাজনৈতিক, সামাজিক ও অর্থনৈতিকভাবে যথেষ্টই ভালো অবস্থানে আছে। বাংলাদেশের চেয়ে কয়েক গুণ বড় পাকিস্তানের অবস্থাই আজ শোচনীয়। কিন্তু বাংলাদেশ আরও ভালো থাকতে পারত, যদি এখানে গণতন্ত্র ও সুশাসন অব্যাহত থাকত। বাংলাদেশে গণতন্ত্র ও সুশাসনের পথে শুরুতেই পুঁতে রাখা ছিল কিছু কাঁটা। দিন দিন কাঁটার সংখ্যা বেড়েছে। সেই কাঁটায় ক্ষতবিক্ষত হয়েছে জনগণের পা; কিন্তু সেই কাঁটা থেকে সুবিধা নিয়েছেন একশ্রেণীর জনবিরোধী রাজনীতিক, জনবিচ্ছিন্ন আমলা আর সামরিক শাসক ও তাদের দোসররা।

বাংলাদেশের চলি্লশ বছরের ইতিহাস নির্বাচিত সরকারের স্বৈরশাসন, অসাংবিধানিক সামরিক সরকারের স্বৈরাচার এবং গণতান্ত্রিক সরকারের অনাচারে ভরপুর। সরকারি দল ও বিরোধী দলের অসহযোগিতামূলক ও সংঘাতপূর্ণ অবস্থান বাংলাদেশকে রাজনৈতিকভাবে একটি অন্ধকারময় অবস্থার দিকে ঠেলে দিচ্ছে। আইনের শাসনের অভাবে জনগণের জীবনে নেমে এসেছে প্রায় অসহনীয়
দুর্দশার অবস্থা।
বাংলাদেশ হাজার বছর ধরে হিন্দু, মুসলমান ও বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বীদের সমন্বিত সাংস্কৃতিক দেশ। বাংলাদেশের সমাজ পরমতসহিষ্ণুতার সমাজ। সেখানে সাম্প্রদায়িক রাজনীতির পৃষ্ঠপোষকতায় এক সময় ধর্মান্ধতা ও মৌলবাদ মাথাচাড়া দিয়েছিল। ধর্মান্ধতা ও মৌলবাদিতা হলো অন্ধকারের জিনিস। সেই অন্ধকার দূর করার উদ্যোগ নিয়েছে বাংলাদেশের মানুষ এবং এ ক্ষেত্রে তার সফল না হয়ে উপায় নেই।
অপরাজনীতির ভেতরেও বাংলাদেশের অর্থনীতি এগিয়ে গেছে অস্বাভাবিক দ্রুতগতিতে। এ ক্ষেত্রে সরকারের চেয়ে বেশি কৃতিত্ব বেসরকারি উদ্যোক্তাদের। অনেক বাধার ভেতর দিয়ে ব্যক্তি উদ্যোক্তাদের কাজ করতে হয়। তারপরও আজ দক্ষিণ এশিয়ার বাংলাদেশ এক বিকাশমান অর্থনীতি। রাজনৈতিক অস্থিরতা না থাকলে এবং গণতান্ত্রিক সুশাসন থাকলে আগামী ১০ বছরে বাংলাদেশ এ অঞ্চলের অনেক দেশকে ছাড়িয়ে যাবে, সে সম্ভাবনার কথা বিদেশি বিশেষজ্ঞরাও বলছেন।
বাংলাদেশের অর্থনৈতিক অগ্রগতির পথে যে বাধা তা রাজনৈতিক অস্থিরতার কারণে। প্রধান রাজনৈতিক দলগুলোর নেতাদের মধ্যে পরস্পরের প্রতি আস্থা ও শ্রদ্ধাবোধের মারাত্মক অভাব। অথচ বহুদলীয় সংসদীয় গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার জন্য যা অপরিহার্য। রাজনৈতিক মতপার্থক্য সংসদে আলোচনার মাধ্যমে মীমাংসা না করে তা নিয়ে রাজপথে সংঘাতময় অবস্থার সৃষ্টি করা হয়। তাতে সমস্যা থেকেই যায়, সমাধান হয় না। এ বিষয়টিই আজ বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় সংকট।
গণতন্ত্র ও সুশাসনের পথের কাঁটাগুলো অপসারণের দায়িত্ব রাজনৈতিক নেতাদের। পৃথিবীর বহু দেশেই বিভিন্ন সময় গণতন্ত্রের যাত্রাপথে বিচিত্র বাধা ছিল। গণতন্ত্রে নানা মত, নানা পথ থাকবেই। কোনো একটি মত কারও ওপর চাপিয়ে দেওয়া নয়, নানা মতাদর্শের সমন্বয়ের ভেতর দিয়েই গণতন্ত্র বিকশিত হয়। বাংলাদেশের প্রধান দলগুলোর মধ্যে যে মতপার্থক্য রয়েছে তা কমিয়ে আনা মোটেই কোনো কঠিন ব্যাপার নয়। শুধু দরকার রাজনীতিবিদদের সদিচ্ছা ও আন্তরিকতা।
অতীতের ভুলভ্রান্তিগুলো নিয়ে ঘাঁটাঘাঁটি করে কোনো লাভ হবে না। তাতে শুধু হবে শক্তিক্ষয়। বাড়বে তিক্ততা। গণতান্ত্রিক সুশাসন প্রতিষ্ঠা করে একটি আলোকিত বাংলাদেশ গড়তে হলে সব দলের নেতাদেরই কিছু ছাড় দিতে হবে। ভিন্নমতের সঙ্গে বৈরিতা না করে সহযোগিতার সঙ্গে কাজ করার মনোভাব না থাকলে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠিত হবে না। গণতান্ত্রিক সুশাসন প্রতিষ্ঠিত হলে ধর্মান্ধতার অন্ধকার আপনাআপনি দূর হবে, আর্থসামাজিক ক্ষেত্রের অস্থিরতাও কমে আসবে।
পৃথিবীর যে কোনো গণতান্ত্রিক দেশের মতো বাংলাদেশেও গণমাধ্যম গণতন্ত্রকে প্রাতিষ্ঠানিক রূপ দিতে বড় ভূমিকা রাখছে। সংবাদপত্র ও ইলেকট্রনিক মিডিয়া আজ খুবই বিকশিত। সব দলের মতামতই মুহূর্তের মধ্যে জনগণের কাছে পেঁৗছে যাচ্ছে। তা ছাড়া দলীয় রাজনীতির বাইরে বিভিন্ন নাগরিক সমাজের প্রতিনিধিরাও তাদের চিন্তা-ভাবনার কথা প্রকাশ করছেন। তাতে জনগণের চেতনার মান বাড়ছে। সব মতামত বিবেচনা করে তারা নিজেরা একটি স্বাধীন সিদ্ধান্ত নিতে পারছে। ফলে রাজনীতিকরা মানুষকে দীর্ঘ সময় বোকা বানিয়ে নিজেদের ফায়দা লুটতে পারবে না। জনগণ যখন সিদ্ধান্ত নিতে সক্ষম হয় তখন নেতারা তাদের সঙ্গে প্রতারণা করতে পারে না। বহু সংগ্রাম করে বাংলাদেশের সাংবাদিকরা তাদের স্বাধীনতা অর্জন করেছেন। সে স্বাধীনতা নষ্ট রাজনীতির স্বার্থে নয়, ব্যবহৃত হবে জনগণের স্বার্থে এবং গণতন্ত্র ও আইনের শাসন প্রতিষ্ঠার প্রয়োজনে। এটাই বর্তমান সময়ের বাংলাদেশের দাবি।
স্বাধীনতা অর্জনের আশঙ্কায় মুক্তিযুদ্ধে যে লাখ লাখ মানুষ জীবন দিয়েছেন, হারিয়েছেন সহায়-সম্পদ এবং নারীসহ সাধারণ মানুষ সহ্য করেছেন অকল্পনীয় নির্যাতন, সেসব মানুষের স্বপ্ন ছিল একটি অসাম্প্রদায়িক ধর্মনিরপেক্ষ গণতান্ত্রিক বাংলাদেশ। শাসকশ্রেণী সেই স্বপ্ন পূরণ করতে পারেনি। সংবিধান কাটাছেঁড়ার ফলে আজ পরস্পরবিরোধিতায় পরিপূর্ণ। মূলনীতি হিসেবে মূল সংবিধানের ধর্মনিরপেক্ষতা পুনঃস্থাপিত হয়েছে বটে, কিন্তু রাষ্ট্রধর্ম ইসলামও আছে, বিসমিল্লাহও আছে। তাতে আধুনিক গণতান্ত্রিক সংবিধানের চরিত্রটি থাকল না।
তারপরও সংবিধান জনগণকে যে অধিকার দিয়েছে তাও আজ রক্ষিত হচ্ছে না। ন্যায়বিচার ও আইনের শাসন ছাড়া গণতন্ত্র হয় না। শাসকশ্রেণীর স্বার্থে মানুষের মৌলিক অধিকারকে বিন্দুমাত্র ছাড় দেওয়ার প্রশ্ন আসে না। রাষ্ট্রে আজ কিছু নতুন উপদ্রব দেখা দিয়েছে। দুর্নীতি ছড়িয়ে পড়েছে মহামারীর মতো। উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোর অবস্থা শোচনীয়। প্রশাসনে দক্ষতার অভাব, দলীয়করণ সর্বত্র। এসবই মানুষের সৃষ্টি। সুতরাং তার সমাধান সম্ভব।
পৃথিবীর অনেক দেশই আজ বাংলাদেশের চেয়ে অনেক বেশি জটিল সমস্যায় জর্জরিত। সেদিক থেকে আমাদের অবস্থান অনেক ভালো। কিন্তু প্রত্যাশিত রকম ভালো নয়। ভালো না থাকার পথে যেসব বাধা তা শনাক্ত করার দায়িত্ব যে কোনো সচেতন মানুষের; কিন্তু তার সমাধান করতে পারেন শুধু নেতারাই। সব রকম অন্ধকারমূলক অবস্থাকে হটিয়ে সবার অংশগ্রহণে মঙ্গল-আলোকে আলোকিত একটি সমৃদ্ধ বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠিত হবে_ এ আমাদের প্রত্যাশা।

সৈয়দ আবুল মকসুদ :লেখক ও গবেষক

দু'জনেই বদলাতে পারেন দেশের ভাগ্য

মাসুদা ভাট্টি
এ মুহূর্তে দু'জন নেতা যদি চান তাহলে কতগুলো সমস্যার সমাধান হতে পারে। প্রথমত, বাংলাদেশের জনগণ মুক্ত হতে পারে যে কোনো রাজনৈতিক অস্থিরতা থেকে। গণতান্ত্রিক ভবিষ্যৎ হতে পারে ঝামেলামুক্ত। কোনো অরাজনৈতিক
শক্তির ক্ষমতা দখল থেকে দূরে থাকতে পারে দেশ। নির্বাচন ব্যবস্থা হতে পারে স্থায়ী ও কোনো তৃতীয় পক্ষের খবরদারি ছাড়াই, বিশ্বের অন্য অনেক গণতান্ত্রিক
রাষ্ট্রের মতোই

কোনো আগ্রহী ব্যক্তি যদি গুগল সার্চ ইঞ্জিনে 'বিশ্বের ক্ষমতাধর মহিলা' লিখে খোঁজ করতে বোতামে চাপ দেন তাহলে যেসব তথ্য আসে তা থেকে এটুকু জানতে পারবেন যে, এই ক্ষুদ্র বাংলাদেশে দু'দু'জন নারী রয়েছেন, যারা বিভিন্ন সময়ে বিশ্বের ক্ষমতাধর মহিলাদের তালিকায় স্থান করে নিয়েছেন। একথা আমরা যারা এ দেশে বসবাস করি তারাও ভালোভাবেই জানি যে, এ দু'জন নারী কতটা ক্ষমতাবান। তারা চাইলেই যে দেশের ভাগ্য বদলাতে পারেন সে কথাই আজকের লেখার মূলকথা।

সম্প্রতি বিশ্বখ্যাত টাইম ম্যাগাজিন বিশ্বের নারী রাষ্ট্র প্রধানের মধ্যে শেখ হাসিনাকে সপ্তম ক্ষমতাধর প্রধানমন্ত্রী হিসেবে নির্বাচন করেছে। এ ম্যাগাজিন শেখ হাসিনাকে উল্লেখ করেছে_ 'এ হিস্টরি অব সারভাইভিং' হিসেবে। '৭৫-এর হত্যাকাণ্ড থেকে ২০০৪ সালের একুশে আগস্টের গ্রেনেড হামলা_ এই দীর্ঘ সম্পর্কে শেখ হাসিনাকে পার হতে হয়েছে নানা চড়াই-উতরাই। বাংলাদেশের মতো একটি পুরুষতান্ত্রিক সমাজ ব্যবস্থার দেশে শেখ হাসিনাকে এগোতে হয়েছে অনেক হিসাব কষে, সাবধানতার সঙ্গে। এমনকি অনেক সময় তার নিজ দলের পুরুষ নেতাদের সঙ্গেও তাকে যুঝতে হয়েছে। এ ক্ষেত্রে তিনি যে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের কন্যা, তার এ পরিচয়ও খুব বেশি সাহায্যে আসেনি। তাকে চলতে হয়েছে সম্পূর্ণ একাই। তারপরও তিনি এগিয়ে গেছেন এবং বাংলাদেশের মানুষের কাছ থেকে তিনি লাভ করেছেন অকুণ্ঠ সমর্থন। যে কারণে তিনি দু'দু'বার আওয়ামী লীগকে ক্ষমতায় নিয়ে এসেছেন। দলের ভেতরও প্রতিষ্ঠা করেছেন নিজস্ব আধিপত্য। আর বর্তমানে দুই-তৃতীয়াংশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা নিয়ে শেখ হাসিনার নেতৃত্বে আওয়ামী লীগ সরকার কোনো বড় বাধা ছাড়াই দেশ পরিচালনা করছে। ষড়যন্ত্র যে নেই তা নয়, কিন্তু সেসব ক্ষমতারই অংশ, কোনো ক্ষমতাবলয়ই নিরঙ্কুশ নয়, একথা আমাদের মানতেই হবে। তাছাড়া দেশের সংবিধানও প্রধানমন্ত্রীকে দিয়েছে একচ্ছত্র ক্ষমতা। সুতরাং তিনি যে বিশ্বের ক্ষমতাবান রাষ্ট্রপ্রধানদের তালিকায় স্থান লাভ করবেন, তা বলাইবাহুল্য।
আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে শেখ হাসিনা ও তার দলের রয়েছে বিশেষ প্রভাব। দু'বার ক্ষমতায় এসেই কেবল নয়, শেখ হাসিনা বরাবরই আন্তর্জাতিক রাজনীতিতে আলোচিত নাম। তিনি অর্জন করেছেন বেশকিছু আন্তর্জাতিক পুরস্কারও। ইউনেস্কো শান্তি পুরস্কার যার মধ্যে অন্যতম। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের কন্যা হিসেবেও তার পরিচিতি বিশ্বাঙ্গনে ব্যাপক। সুতরাং আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে শেখ হাসিনার জন্য বাংলাদেশের পক্ষে দাবি-দাওয়া আদায় বেশ সহজ। যদিও আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে একটি বিশেষ মহল তার একরোখা স্বভাবকে মেনে নিতে পারে না এবং তিনি ক্ষমতায় এলে তাদের অপতৎপরতা বৃদ্ধি পেতে দেখা যায়। দেশের ভেতরে ও বাইরে যার এত ক্ষমতা তার পক্ষে যে কোনো সিদ্ধান্ত গ্রহণই অত্যন্ত সহজ, প্রয়োজন কেবল সদিচ্ছার। সম্প্রতি বিশ্বের একটি খ্যাতনামা জরিপকারী সংস্থার মতে, তিনি বিশ্বের অন্যতম জনপ্রিয় প্রধানমন্ত্রীও। ক্ষমতা ও জনপ্রিয়তা যদি এক সঙ্গে কারও ঝুলিতে থাকে তাহলে তার পক্ষে জনগণের জন্য যে কোনো সিদ্ধান্ত গ্রহণই সহজ হয়। সুতরাং শেখ হাসিনার কাছ থেকে জনগণের চাওয়া সীমাহীন। এখন আসছে সময়ে মানুষ তার কাছ থেকে কী পেল, সে হিসাবই করবে।
২০০৫ সালে ফোর্বস ম্যাগাজিন বিশ্বের তথা এশিয়ার ক্ষমতাবান নারীদের তালিকায় স্থান দেয় তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়াকে। খালেদা জিয়া সে সময় সংসদে দুই-তৃতীয়াংশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা লাভকারী জোটের নেতা ও অন্যতম ক্ষমতাবান প্রধানমন্ত্রী। দলের ভেতর তার কথার ওপর কথা নেই। বিএনপির নেতৃত্বভার গ্রহণের পর তার নেতৃত্বকে কখনও কোনো প্রতিদ্বন্দ্বীর মুখোমুখি হতে হয়নি, যেটি শেখ হাসিনাকে পেরিয়ে আসতে হয়েছে। সুতরাং তার আধিপত্য দল ও রাষ্ট্রে তখন একচ্ছত্র। দলের বাইরে খালেদা জিয়ার একটি সমর্থকগোষ্ঠীও রয়েছে। সুতরাং মানুষের আশাও তার কাছে বিশাল। এমনকি তার দল এখন বিরোধী দল হওয়ার পরও তিনি যে কম ক্ষমতাবান এরকম ভাবার কোনো কারণে নেই। সরকারের যে কোনো ভুল-ত্রুটির ফসল ঘরে তুলবে তার দল, সেটাই স্বাভাবিক। এ ছাড়া আন্তর্জাতিক অঙ্গনেও রয়েছে খালেদা জিয়া ও তার দলের বেশ ক'টি স্থায়ী বন্ধু রাষ্ট্র। সেদিক দিয়ে আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে খালেদা জিয়া চাইলেই বাংলাদেশের জন্য বেশ বড় কিছু আনতে পারেন। আগেই বলেছি, দেশের ভেতর খালেদা জিয়ার বিরাট সমর্থকগোষ্ঠী রয়েছে, যাদের কারণে তিনি তিনবার প্রধানমন্ত্রী নির্বাচিত হয়েছেন। সুতরাং তার পক্ষে সিদ্ধান্ত গ্রহণ অত্যন্ত সহজ, যা অন্য অনেক দেশের নেতাদের পক্ষেই অসম্ভব ব্যাপার। এখানেও সেই একই প্রশ্ন_ সদিচ্ছার।
এ মুহূর্তে এই দু'জন নেতা যদি চান তাহলে কতগুলো সমস্যার সমাধান হতে পারে। প্রথমত, বাংলাদেশের জনগণ মুক্ত হতে পারে যে কোনো রাজনৈতিক অস্থিরতা থেকে। গণতান্ত্রিক ভবিষ্যৎ হতে পারে ঝামেলামুক্ত। কোনো অরাজনৈতিক শক্তির ক্ষমতা দখল থেকে দূরে থাকতে পারে দেশ। নির্বাচন ব্যবস্থা হতে পারে স্থায়ী ও কোনো তৃতীয় পক্ষের খবরদারি ছাড়াই, বিশ্বের অন্য অনেক গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রের মতোই। সমস্যামুক্ত হয়ে অর্থনৈতিকভাবে এগিয়ে যেতে পারে দেশ। জননিরাপত্তা ফিরে আসতে পারে, রাজনৈতিক সংঘাতমুক্ত হতে পারে রাজনৈতিক পরিবেশ। সর্বোপরি দেশে বিদেশি বিনিয়োগ পরিবেশ সৃষ্টি হবে। আমরা জানি, বিগত দশকে বাংলাদেশের ভাবমূর্তি নানা ক্ষেত্রে বেশ ঔজ্জ্বল্য লাভ করেছে। হেনরি কিসিঞ্জারের কথিত তলাবিহীন ঝুড়ি '৭৫-এর পর থেকে স্বৈরশাসকের কব্জায় পড়ে এবং বিশ্বে যেসব দেশে গণতন্ত্র নেই সেসব দেশের তালিকায় স্থান পায়। সে সময় বাংলাদেশ কেবল প্রাকৃতিক দুর্যোগ আর রাজনৈতিক হত্যাকাণ্ডের কারণেই সংবাদ শিরোনাম হতো। '৯০ সাল পর্যন্ত এই ধারাবাহিকতা বজায় ছিল। তারপর বাংলাদেশের গণতন্ত্রে উত্তরণ বিশ্বের গণমাধ্যমে নতুনভাবে উপস্থাপিত হয়। তারপর থেকে অবশ্য খুব কমই বাংলাদেশকে নেতিবাচক প্রচারণার শিকার হতে হয়েছে। একমাত্র ব্যতিক্রম এখানে মৌলবাদী শক্তির ক্ষমতা গ্রহণ এবং বাংলাভাই সংক্রান্ত মৌলবাদী শক্তির উত্থানকে উদার গণতান্ত্রিক বিশ্ব কোনোভাবেই ভালোভাবে নেয়নি। কেউ যদি একটু গবেষকের দৃষ্টিতে এই চলি্লশ বছরকালকে বিশ্লেষণ করে দেখেন তাহলে দেখবেন, স্বৈরশাসক ও মৌলবাদ আক্রান্ত আমলে বাংলাদেশে বিদেশি নিয়োগ হয়েছে সবচেয়ে কম। এখানে একথা বলার উদ্দেশ্য হচ্ছে, বাংলাদেশে যখন নিরবচ্ছিন্ন গণতান্ত্রিক শাসন ব্যবস্থা বজায় থাকে তখন বিদেশে বাংলাদেশের ভাবমূর্তি থাকে ইতিবাচক এবং এ সময় বিনিয়োগও বাড়ে অন্য সময়ের তুলনায় বেশি।
বৈশ্বিক অর্থনীতির নিক্তিতে বাংলাদেশ এখন এমন এক জায়গায় অবস্থান করছে যেখান থেকে সামান্য প্রচেষ্টাতেই বাংলাদেশ উঠে আসতে পারে একটি মধ্যম আয়ের দেশের তালিকায়। গত তিন বছর ধরে বিশ্ব যে অর্থনৈতিক মন্দার মুখোমুখি হয়েছে তার আঁচ খুব একটা বাংলাদেশে লাগেনি। জনসংখ্যার এই বিরাট বোঝা সত্ত্বেও বাংলাদেশ অর্থনৈতিকভাবে এগিয়েছে। এর অন্যতম কারণ দেশটিতে মোটামুটি গণতান্ত্রিক পরিবেশ ছিল এবং সবকিছু ছাপিয়ে বাংলাদেশের এগিয়ে যাওয়াই চোখে পড়ার মতো ছিল। এখনও তা অব্যাহত রয়েছে। শেখ হাসিনার নেতৃত্বে মহাজোট সরকার নানা সীমাবদ্ধতা সত্ত্বেও বেশকিছু ক্ষেত্রে উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি অর্জন করেছে। শিক্ষা, কৃষি, টেলি যোগাযোগ, তথ্যপ্রযুক্তি ইত্যাদি ক্ষেত্র এ উল্লেখযোগ্য অগ্রগতির ভেতরে পড়ে। এ অবস্থায় শুধু রাজনৈতিক সিদ্ধান্তে যদি এই দুই ক্ষমতাধর নেতা কোনো ভুল করেন তাহলে তা হবে বাংলাদেশের মানুষের জন্য চরম দুর্ভোগ্যের। দু'জন মানুষের সিদ্ধান্তই যদি কেবল ১৬-১৭ কোটি মানুষের ভাগ্য বদলাতে পারে তাহলে তাদের নিশ্চয়ই উচিত, কোনো দল বা গোষ্ঠী নয়, কোনো ক্ষমতার লোভ নয়, কেবল এই কোটি মানুষের কথা, যারা তাদের কথায় প্রাণ দিতে জানে এবং সে প্রমাণ তারা ইতিমধ্যে দিয়েছে। সুতরাং এ দুই ক্ষমতাবানের কাছে বাংলাদেশের মানুষের চাওয়া কিছু অযৌক্তিক এবং অহেতুক নয়, বরং জনগণের পক্ষে তাদের সিদ্ধান্ত গ্রহণের যথেষ্ট যুক্তি আছে।

মাসুদা ভাট্টি :সম্পাদক, একপক্ষ

masuda.bhatti@gmail.com

বাজার থেকে টাকা গেল কোথায়?

ড. আর এম দে ব না থ
যেখানে যাই সেখানেই প্রশ্ন, টাকা কোথায় গেল? জমি কেনার লোক নেই, ফ্ল্যাট কেনার ক্রেতা কম, ব্যাংকে আমানত রাখার লোকের অভাব, সঞ্চয়পত্র কেনার জন্য সরকারের আবেদন সত্ত্বেও তা কেনার লোক কম, শেয়ারবাজারে টাকা খাটানোর বিনিয়োগকারী নেই, ধার চাইলে ধার পাওয়া যায় না, ধার দিলে তা শোধ হয় না, বাকিতে মাল বিক্রি কম। এ ধরনের শত প্রশ্নে জর্জরিত টাকার বাজার। কী রমরমা ছিল টাকার বাজার! কথায় কথায় বকশিশ মিলত। এখন মিলে কম। এসব প্রশ্নের শেষে মিলিয়ন ডলার প্রশ্ন, টাকা গেল কোথায়? আমি নিজেও বিচলিত এই প্রশ্নে। নানাজন নানা কথা বলে। কার কথা যে ঠিক, কার কথা যে বেঠিক তা বুঝি কম। আমি চাই তথ্য। কেউ দেয়, কেউ দিতে পারে না। যে তথ্য পাই, তা দিয়ে আমার পুরো সš‘ষ্টি আসে না। বিশেষ করে প্রচার গুণের কারণে ও মিডিয়ার কল্যাণে অর্থনীতিবিদ বনে যাওয়া লোকদের এবং তিন মাসের বনের রাজা উপদেষ্টাদের কথায় বিশ্বাস ও আ¯’া রাখা বড়ই কঠিন। তারা পৃথিবীর সব বিষয়ের ওপর জ্ঞান ও বুদ্ধি রাখেন। এসব কারণে তাদের কাছ থেকে আমি আমার প্রশ্নের উত্তর অর্ধেক পাই, অর্ধেক পাই না, কনফিউজ্ড হই। টাকা গেল কোথায়?
টাকা কি কেউ কেউ সিন্দুকে ভরে রেখে দিয়েছে? টাকা কি ১০০০ টাকার নোট করে মানুষ বালিশের তলায় রেখে দিয়েছে? টাকা কি বস্তাভর্তি করে ব্যবসায়ীরা বিদেশ নিয়ে গেছে? হতে পারে এসব। কিš‘ তা হলে ক্যাশ আউটসাইড ব্যাংক (সিওবি) বেশ বাড়ার কথা। এর হিসাব বাংলাদেশ ব্যাংক রাখে। ওইসব তথ্যে দেখা যায়, ২০১১ সালের জুলাইয়ের তুলনায় ২০১২ সালের ফেব্র“য়ারি পর্যন্ত সিওবি তত বেশি বাড়েনি। যেটুকু বেড়েছে, স্বাভাবিক মূল্যস্ফীতির কারণে জিনিসের যে মূল্য বেড়েছে তা মেটানোর জন্যই লাগার কথা। এই সময়ে দুই-সোয়া দুই হাজার কোটি টাকার সিওবি বেড়েছে। অর্থাৎ ৮ মাসে এই বৃদ্ধি। গেল বছরের একই সময়ে তা বেড়েছিল প্রায় ৫ হাজার কোটি টাকা। সেই হিসাবে সিওবি বাড়েনি বলা যায়। তাহলে যে বলা হ”েছ টাকা সিন্দুকে আবদ্ধ, ঘরে তালাবদ্ধ, বালিশের তলায়, মধ্যপ্রাচ্যে বা ভারতীয় মাড়োয়ারির হাতেÑ এসবের ভিত্তি কী? কেউ কেউ বলেন, কুরিয়ার সার্ভিস ওয়ালারা ‘প্যারালাল ব্যাংকিং’ করছে। অর্থাৎ তারা টাকা ধরে রাখছে। তারা তাদের টাকা ব্যাংকে রাখছে না। এটা হলেও তো ‘সিওবি’ বাড়ার কথা। কিš‘ গেল বছরের তুলনায় ‘সিওবি’ এবার তো নিয়ন্ত্রণাধীন। এর কারণও আছে। চেকের ব্যবহার বাড়ছে। অনলাইন ব্যাংকিং চালু হওয়ায় টাকা ব্যাংক থেকে বেরো”েছ না। এক ব্যাংক থেকে আরেক ব্যাংকে, এক ব্রাঞ্চ থেকে আরেক ব্রাঞ্চে যা”েছ মাত্র। এজন্য গভর্নরকে ধন্যবাদ। আরেকটা মজার তথ্য হ”েছ, ব্যাংকের ‘ভোল্টেও’ টাকা হ্রাস পেয়েছে। এই টাকা থাকে কাস্টমারদের টাকা উত্তোলনের চাহিদা মেটানোর জন্য। দেখা যা”েছ, ভোল্টের টাকার পরিমাণ জুলাই-ফেব্র“য়ারি মাসে ৩৭৩ কোটি টাকা হ্রাস পেয়েছে। এতে কি কাস্টমারদের টাকা উত্তোলনে কোন সমস্যা হ”েছ? না, এমন কথা শুনিনি। এমন কোন রিপোর্ট পাওয়া যায়নি যে, ব্যাংক টাকা তুলতে গেলে টাকা দিতে পারছে না। এটাও চেক ব্যবহারের একটা ফল হতে পারে।
তাহলে টাকা গেল কোথায়? বিদেশে ডলার হয়ে পাচার হয়ে গেছে? ডলার রূপান্তরিত করে টাকা পাঠাতে হলে তো টাকার সরবরাহে কোন সমস্যা হবে না। একজন দুই নম্বরে মার্কেটে ডলার বিক্রি করবে, আরেকজন কিনবে। যে কিনবে সে টাকা দেবে আর যে বিক্রি করবে সে পাবে। এতে তো দুই নম্বর বাজারের ডলার দুই নম্বর দিয়েই বিদেশ যাবে। টাকার সরবরাহ ঠিকই থাকবে। অধিকš‘ বাংলাদেশের টাকার বিদেশে কোন বাজার নেই। কিছু বাংলাদেশী টাকা কলকাতা-মুম্বাই ইত্যাদি শহর এবং মধ্যপ্রাচ্যের কিছু শহরে বাংলাদেশীদের লাগে। কিš‘ সেই টাকা মাড়োয়ারিরাই সংগ্রহ করে আবার তারা তা বাংলাদেশেই ফেরত পাঠায়, কারণ এই টাকা এখানেই চলে, অন্যত্র নয়। এই টাকা যদি বেশি পরিমাণের হতো তাহলেও ‘সিওবি’ বাড়ত। দেখা যা”েছ ঘটনা তা নয়।
এ অব¯’ায় প্রশ্নের জবাব এখন পর্যন্ত পাওয়া যা”েছ না। আমরা যে টাকার কথা বলছি তার কয়েকটা রূপ আছে। এক নম্বর, মানুষের হাতে টাকা যাকে বলা হয় ‘ক্যাশ আউটসাইড ব্যাংকস’ (সিওবি)। দুই নম্বর, ব্যাংকের ভোল্টের টাকা যা দিয়ে ব্যাংক দৈনন্দিন চাহিদা মেটায়। একে বলা হয় ‘ক্যাশ ইন টিলস’। তিন নম্বর, তলবি আমানত (ডিমান্ড ডিপোজিট), চার নম্বর, মেয়াদি আমানত (টাইম ডিপোজিট)। আর কিছু টাকা থাকে বাংলাদেশ ব্যাংকের ব্যাংকিং বিভাগে বিভিন্ন ব্যাংকের জমা দেয়া টাকা হিসেবে। টাকা বলতে এসবকেই বোঝায়। টাকার টানাটানি মানেই এসব উপাদানের টানাটানি। টাকার টানাটানি মানেই প্রধানত আমানতের টানাটানি। আমানত বাড়লে টাকা বাড়ে। টাকা বাড়লে আমানত বাড়ে। এখন আমানত বাড়ে না। এর অনেক কারণ থাকতে পারে। এগুলোর বিচার বিশ্লেষণ হতে পারে। অবশ্যই একটা কারণ, মানুষের সঞ্চয় হ্রাস পেয়েছে। আয়ের তুলনায় মানুষের ব্যয় বেড়েছে। আমি সামিট গ্র“প, এস আলম, এসআর পরিবহন, হলমার্ক গ্র“প, ট্রান্সকমের কথা বলছি না। তারা বিধাতার বিশেষ সৃষ্টি। তাদের বিধাতা উপর থেকে পুষ্পবৃষ্টির মাধ্যমে টাকা দেন। কিš‘ সাধারণ মানুষের ব্যয় বেশি, আয় কম। অতএব, মানুষের সঞ্চয় কম। ব¯‘ত সঞ্চয় ¯’বির হয়ে আছে। ২০১০-এর জুলাইয়ের তুলনায় ২০১১ সালের ফেব্র“য়ারিতে ব্যাংক আমানত (সরকারি ও আন্তঃব্যাংক বাদে) বেড়েছিল ১১ দশমিক ৮৫ শতাংশ। সেই তুলনায় চলতি অর্থবছরের একই সময়ে আমানত বেড়েছে মাত্র ৯ দশমিক ২৯ শতাংশ। অসুবিধা হ”েছ আমানত কম বাড়লে কী হবে, ঋণ বাড়ছে মারাÍকভাবে। প্রসঙ্গত বলে নিই, সাধারণ মানুষের সঞ্চয় যে কমছে তার আরেকটা প্রমাণ হ”েছ ডাকঘর আমানত কমে যাওয়া। অর্থবছরের প্রথম আট মাসে ডাকঘর আমানত কমেছে প্রায় ৪০০ কোটি টাকা। ওই যে বলছিলাম ঋণের কথা, দেখা যা”েছ আমানতের তুলনায় ঋণ বাড়ছে বেশি, অনেক বেশি হারে। মুশকিল হ”েছ, ‘প্রাইমারি ডিপোজিট’ (ক্যাশ ডিপোজিট) না বাড়লে ব্যাংক আমানত বা টাকা বাড়াতে পারে না। তারল্য হার যদি ২০ শতাংশ হয় তাহলে ব্যাংক এক টাকার প্রাইমারি ডিপোজিট পেলে ৫ টাকার সেকেন্ডারি ডিপোজিট বাড়াতে পারে। যেহেতু কম সঞ্চয়ের কারণে কম প্রাইমারি ডিপোজিট (ক্যাশ ডিপোজিট) হ”েছ, অতএব সেকেন্ডারি ডিপোজিটও কম হ”েছ। অর্থাৎ আমানতের প্রবৃদ্ধি, টাকার প্রবৃদ্ধি কমছে। ব্যাংক আগের মতো ঋণ দিতে পারছে না।
এবার আসি আরেকটি কথায়। ডিপোজিটের প্রবৃদ্ধির টাকার প্রবৃদ্ধি বা হার কমার আরেকটা কারণ আছে। আর সেটা হ”েছ টাকা পাচার। সাদামাটাভাবে চিন্তা করলে বলা যায়, টাকা পাচার করলে কিছু হয় না। কারণ টাকা যে দেশে যাবে সে দেশে তা চলবে না। আবার স্বদেশে টাকাকে ফেরত আসতে হবে। এটা কোন বাংলাদেশী শ্রমিককে দিয়ে চতুর ব্যবসায়ী/হুন্ডিওয়ালা শ্রমিকের কাছ থেকে ডলারটা নিয়ে নেবে। ওই শ্রমিক টাকা দেশে পাঠাবে। এভাবেও রেমিটেন্স হয়। আমি এই পদ্ধতিতে টাকা পাচারের কথা বলছি না। আমি বলছি ‘আন্ডার ইনভয়েসিং’-এর মাধ্যমে টাকা পাচারের কথা। ধরা যাক, রফতানি পণ্যের দাম ১০০ ডলার। এলসি খোলা হল ৫০ ডলার হিসাবে। বিদেশে ৫০ ডলার পাচার হয়ে গেল। দেশে এলো ৫০ ডলার। এটা টাকায় কনভার্ট করে রফতানিকারকের অ্যাকাউন্টে জমা দেয়া হবে। ধরা যাক, এতে পাওয়া গেল ৫০ পূরণ ৮০ সমান ৪০০০ টাকা। যদি ১০০ ডলার হতো তাহলে হতো ৮০০০ টাকা। অর্থাৎ রফতানিকারকের আমানত বাড়ল অর্থাৎ ব্যাংকের আমানত বাড়ল ৪০০০ টাকা। যদি তার ঋণ থেকে থাকে, তাহলে অবশ্য তা এডজাস্ট হবে। সেই টাকা আবার অন্যকে দেয়া হবে। একে বলে ‘ক্রেডিট ক্রিয়েশন’ মেকানিজম যার মাধ্যমে ব্যাংক আমানত সৃষ্টি করে। যদি আন্ডার ইনভয়েসিং না হতো, তাহলে ৪০০০-এর ¯’লে টাকার হিসাব হতো ৮০০০। অতএব বলা হ”েছ, আন্ডার ইনভয়েসিংয়ের মাধ্যমে টাকা পাচারের ফলে ব্যাংকের আমানতের প্রবৃদ্ধির হারও কমছে।
অতএব করণীয়? করণীয় হ”েছ মানুষের সঞ্চয় বাড়ানো। এর জন্য দরকার কর্মসং¯’ান বৃদ্ধি করা। দরকার মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ করা। করণীয় বিনিয়োগ বৃদ্ধি করা। মানুষের যাতে চাকরি না যায় তার ব্যব¯’া করা। মানুষ যাতে সারা বছর কাজ পায় তার ব্যব¯’া করা। এসব হবে কি?
ড. আর এম দেবনাথ : সাবেক অধ্যাপক, বিআইবিএম
ৎসফবনহধঃয@ুধযড়ড়.পড়স

গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা


নুরুল ইসলাম বিএসসি
সব যুগে মানুষ সমকালীন সময়ে ভিন্ন ভিন্নকালে জীবনযাপন করেছে। অধিকাংশই সময়ের অনেক পেছনে অব¯’ান করেছে। খুব স্বল্পসংখ্যক মানুষই সময়ের সঙ্গে মিল রেখে বসবাস করেছে।
বর্তমানে যে যুগ চলছে, এটাকে ইন্টারনেটের যুগ বলা যায়। বিস্ময়কর এই আবিষ্কার মানুষের জীবনে অনেক পরিবর্তন এনে দিয়েছে। বিশ্বের যে কোন কোনায় পিনপতন হলেই সারাবিশ্বে মুহূর্ত ছড়িয়ে পড়ে। বিশ্বের সব জাতি বিজ্ঞানের এই আবিষ্কারগুলো কাজে লাগিয়ে সাধারণ মানুষের দৈনন্দিন জীনবে সুখ, শান্তি বৃদ্ধি করেছে। ব্যতিক্রম শুধু বাংলাদেশ।
জননেত্রী শেখ হাসিনা ওই বিজ্ঞানের আবিষ্কারগুলোকে কাজে লাগিয়ে সুখ-সমৃদ্ধি বৃদ্ধিতে ডিজিটাল বাংলাদেশ গড়তে যেই মাত্র পদক্ষেপ নিয়েছেন, বিরোধী দল মধ্যযুগীয় কালচার জ্বালাও-পোড়াও, হরতালের দিকে এগিয়ে যা”েছ। আবার এদের সঙ্গে যুক্ত হয়েছে আমিনীরা। শরিয়তি শাসনের নামে এই বিজ্ঞানের যুগে সাধারণ মানুষদের বোকা বানিয়ে রাস্তায় নেমে ভাংচুর করার প্ররোচনা দি”েছন। শরিয়া শাসন কায়েম হওয়া মানে এ দেশকে পাকিস্তান, আফগানিস্তান বানানো। আমিনীরা হয়তো তাই চান।
বিএনপিতে নিশ্চয়ই কিছু প্রগতিবাদী মানুষ আছেন, যারা আধুনিক বিশ্বের সঙ্গে সমান্তরালে চলতে চান। তারা কেন জ্বালাও-পোড়াও সমর্থন করছেন। রাস্তায় বাস, কার, কী দোষ করল? বাস পোড়ানোর অর্থই হল দেশের সম্পদ নষ্ট করা। দেশের সম্পদ নষ্ট করে ক্ষমতায় গিয়ে দেশ চালানো সম্ভব হবে কি?
বিশ্বে যুগে যুগে অনেক পদ্ধতির সরকার এসেছেÑ বাদশাহী, খেলাফতি ইত্যাদি। যখন সময়ের সঙ্গে তাল মিলিয়ে চলতে সক্ষম হয়নি তখন বিকল্প হিসেবে গণতান্ত্রিক ব্যব¯’ার প্রবর্তন হয়েছে। মধ্যপ্রাচ্যের কয়েকটি দেশ ছাড়া এই গণতান্ত্রিক ব্যব¯’া বিশ্বের সব দেশই গ্রহণ করেছে। মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোতেও এখন গণতন্ত্রের জন্য লড়াই চলছে।
হয়তো এমন একটা সময় আসবে যখন গণতান্ত্রিক ব্যব¯’ারও বিকল্প কিছু উদ্ভাবিত হবে। কী হতে পারে এখন অনুমান করা মুশকিল। হয়তো ওই ব্যব¯’ায় শতভাগ মানুষের শাসক দলের প্রতি সমর্থন না থাকলেও আশি, নব্বই ভাগ থাকবে।
বর্তমান গণতান্ত্রিক ব্যব¯’ায় মাইনরিটিরাও দেশ পরিচালনা করতে পারেন। এখানে একটা উদাহরণ দিয়ে আমার কথাটা পরিষ্কার করতে চাই। ধরি, একটা দেশে তিনটি দল আছে। ওই তিনটি দল নির্বাচনে অংশগ্রহণ করার পর দেখা গেল, এক দল পেয়েছে শতকরা ৪৫ ভাগ, আর এক দল পেল শতকরা ৪০ ভাগ, শেষ দলটি পেল শতকরা ১৫ ভাগ। ৪৫ ভাগ যারা পেলেন তারাই দেশ চালান, অথচ ৪০+১৫=৫৫ ভাগের সমর্থন শাসক দল পায়নি। তবুও এটাকেই এখন সর্বোত্তম পš’া ও পদ্ধতি বলে মানুষ গ্রহণ করেছে। সময়ের তাগিদে এর চেয়েও উন্নত কিছু হয়তো একদিন আবিষ্কৃত হবে। এই গণতান্ত্রিক ব্যব¯’ায় কিছু নিয়ম-নীতি আছে, নির্বাচনে অংশগ্রহণ করতে হয়, মানুষের ঘরে ঘরে গিয়ে নিজেদের ভবিষ্যৎ কর্মপš’া বুঝিয়ে দিতে হয়।
পৃথিবীর প্রত্যেক দেশে এমনকি পার্শ্ববর্তী দেশ ভারতেও নির্বাচন কমিশনের অধীনে নির্বাচন হয়, নির্বাচনের সময় সরকার পদত্যাগ করে না। যে দিন সংখ্যাগরিষ্ঠ দল শপথ নেয়, পূর্ববর্তী সরকারের অবসান হয়। আমরা পৃথিবীর বাইরের কোন দেশ নই। আমাদের এখানে নির্বাচিত সরকারের অধীনে নির্বাচন হতে পারবে না কেন? এ পর্যন্ত এই সরকারের অধীনে যতগুলো নির্বাচন হয়েছে, কোথাও কারচুপির কথা, ভোট জালিয়াতির কথা ওঠেনি। তবুও কেন সন্দেহ? গণতান্ত্রিক ব্যব¯’াকে সচল রাখার জন্য আগামী নির্বাচন পর্যন্ত সবাইকে অপেক্ষা করতে হবে এবং নির্বাচনে অংশগ্রহণ করে জনগণের মতামত নিতে হবে। এটাই এখন পর্যন্ত সচল রীতি।
নুর“ল ইসলাম বিএসসি : সংসদ সদস্য ও কলাম লেখক