॥ বদরুদ্দীন আহমদ ॥
দুর্নীতির রাহুগ্রাস থেকে আমরা মুক্তি চাই। দুর্নীতি আমাদের সমাজজীবনের একটি অভিশাপ। বিচার বিভাগের দুর্নীতির কথা বললে আদালত অবমাননার দায়ে অভিযুক্ত হওয়ার আশঙ্কা থাকে। তবে বিচার বিভাগের নিম্নস্তরের দুর্নীতির কথা সর্বজনবিদিত। অনেককেই বলতে শোনা যায়, সেখানে নাকি রায় বেচাকেনা হয়। কেউ কেউ বলেন, পেশকার, সেরেস্তাদার, পিয়ন দুর্নীতিপরায়ণ। তাদের অনেকেরই ঢাকায় বাড়ি আছে। যেটা গ্রহণ করে তা হলো ‘বকশিশ’ নামের ঘুষ।
বিচার বিভাগের উচ্চপর্যায়ে দলীয়ভাবে বিচারক নিয়োগ দেয়ার অভিযোগ উঠেছে। তাদের যোগ্যতা ও স্বচ্ছতার যাচাই না করেই নিয়োগ দেয়ার সম্ভাবনা থেকে যায়। এজলাসে মুখ চেনাচেনির ব্যাপার রয়েছে। কারণ একই ধরনের মামলায় এক অ্যাডভোকেট রিলিফ পাচ্ছেন, অন্যজন পাচ্ছেন না। এখানে পরিচয়ের কাছে স্বচ্ছতা মিলিয়ে যায়।
হাইকোর্ট ডিভিশনে নিয়োগপ্রাপ্তদের অতীত পর্যালোচনা করতে হবে। দলীয়ভাবে নিয়োগ বন্ধ করতে হবে। প্রধান বিচারপতির সুপারিশের প্রাধান্য দিতে হবে। এই নিয়োগের ব্যাপারে দেশের প্রধান নির্বাহীর হস্তক্ষেপ করা চলবে না। দেশ আজ রসাতলে গেলেও সুপ্রিম কোর্টের বিচারপতিদের কিছুটা স্বচ্ছতা আছে। সরকারের প্রধান নির্বাহীকে ভয় না করে নির্ভীকভাবে রায় দেয়া হলে দেশ এখনো রক্ষা পেতে পারে।
গণপূর্ত, সড়ক ও জনপথ বিভাগের দুর্নীতির কথা সবারই জানা। এখানে প্রজেক্টের ব্যয় নির্ধারণের সময় থেকেই দুর্নীতি শুরু হয়। অনেক ক্ষেত্রে ব্যয় বাড়িয়ে হিসাব করা হয়। এখানে নির্বাহী প্রকৌশলী থেকে শুরু করে তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী, এমনকি অনেক ক্ষেত্রে প্রধান প্রকৌশলীর সম্পৃক্ততা থাকে।
কাজ শুরু হওয়ার পর অতিরিক্ত হিসাবের বিপরীতে সেকশন অফিসারকে টাকা দিতে হয়। গাছপালা না থাকলেও গাছপালা কাটার বিলও অর্থের বিনিময়ে ঠিকাদাররা পেয়ে যান। এখন ঠিকাদারেরা সিন্ডিকেট করে টেন্ডার দিয়ে থাকেন। তিন গুণ, চার গুণ বেশি রেটে কাজ পেয়ে থাকেন ভাগ্যবানেরা। এরপর ঠিকাদারেরা নিজেদের মধ্যে কাজ ভাগাভাগি করে নেন। বিল পাওয়ার সাথে সাথে বিলের ওপর পার্সেন্টেজ দিতে হয় এসও, নির্বাহী প্রকৌশলী, অনেক ক্ষেত্রে প্রধান প্রকৌশলীকে।
বড় কাজ হলে প্রধান প্রকৌশলীও পার্সেন্টেজ পেয়ে থাকেন। এই পার্সেন্টেজের ব্যাপারটা ব্রিটিশ আমল থেকেই চলে আসছে। ফলে ১০ কোটি টাকার কাজ ২০ কোটি টাকায় সম্পন্ন করতে হয় কখনো কখনো।
এসি ল্যান্ড দুর্নীতির পরিমাণ কম নয়। সম্পত্তির নতুন রেকর্ড বা রেকর্ড সংশোধন করা ইত্যাদির জন্য প্রচুর অর্থ ব্যয় করতে হয়। ভুক্তভোগী কোনো লোক যদি আদালতের দ্বারস্থ হন, সেখানে ব্যাপারটা বিলম্বিত হয়। অনেক সময়ে অর্থ খরচ করেও সঠিক সিদ্ধান্ত নিশ্চিত করা যায় না। শেষ পর্যন্ত এসি ল্যান্ডের অফিসেই প্রচুর অর্থের বিনিময়ে নিষ্পত্তি করতে হয়।
কাস্টমসের ব্যাপারটা খুবই চমকপ্রদ। কোনো পার্টির বিদেশ থেকে বহু কোটি টাকার অবৈধ মাল এলো, কিন্তু কাস্টমস সে মাল ধরে ফেলে। এরপর পার্টির সাথে কাস্টমস অফিসারদের দরকষাকষি চলতে থাকে। কাস্টমস বলে, যদি এত টাকা না দেন, তাহলে সব মাল বাজেয়াপ্ত করব। পার্টি উপায়ান্তর না দেখে অর্থের বিনিময়ে সুরাহা করতে বাধ্য হয়। এভাবে অবৈধ মালামাল দেশের অভ্যন্তরে প্রবেশ করে, যা অর্থনীতি ও সমাজের জন্য অত্যন্ত ক্ষতিকর। দুর্নীতির বড় ধরনের আখড়া এই কাস্টমস।
ইনকাম ট্যাক্স থেকে সরকার সবচেয়ে বেশি রাজস্ব পেয়ে থাকে। এখানে কোনো করদাতা সঠিক রিটার্ন দাখিল করলেও অফিসারের খপ্পর থেকে বেরিয়ে আসতে পারে না। প্রত্যেক সার্কেলের জন্য সরকার থেকে ট্যাক্স নির্ধারণ করে দেয়া হয়। অফিসারের কাছে যখন ফাইল পেশ করা হয়, তখন সংশ্লিষ্ট করদাতাকে বলেন, আগের বছরের করই রেখে দিচ্ছি, আমাকে এত টাকা দিতে হবে।’ তখন টাকা না দিয়ে উপায় থাকে না। করদাতাকে অর্থের বিনিময়ে সুরাহা করতে হয়। আয়করকে ব্যবসায়ীরা ভয় পান। তাদের দুর্নীতি ধরা কঠিন। সরকার এ ব্যাপারে হস্তক্ষেপের প্রয়োজনীয়তা বোধ করে না। অফিসার ঘুষ নিক বা না নিক, সরকারের যেন কিছু আসে-যায় না। অনেক ক্ষেত্রে সংশ্লিষ্ট অফিসার ব্লাকমেইল করে মোটা অঙ্কের টাকা আদায় করে থাকেন।
আমার নিজের একটা কেসের ব্যাপারে ইনকাম ট্যাক্স অফিসে যাতায়াত ছিল। তখন জানতে পারলাম, ওই অফিসার (ডিউটি কমিশনার, ট্যাক্স) ঘুষ খান না বা অবৈধভাবে কোনো করদাতার কাছ থেকে টাকা আদায় করেন না। তাকে পরীক্ষা করার জন্য একদিন অফিসারের সাথে দেখা করি। আমি যখন তার রুমে ঢুকি, তিনি আমাকে দেখেই বললেন, আপনার তো আমার সার্কেলে কোর্ট কেস, তবে কেন এসেছেন?
বললাম, আপনার সাথে আমার কিছু কথা ছিল। তিনি বললেন, আমি হাতের কাজ সেরে নিই, আপনি বসুন। তিনি নিজের কাজ সেরে প্রায় আধঘণ্টা পর আমার দিকে মুখ তুলে তাকালেন। বললেন, কী বলতে চান, বলুন।
Ñআমি জেনেছি, আপনার মতো একজন সৎ ও নির্লোভ অফিসার গোটা ডিপার্টমেন্টে নেই। তিনি রুষ্ট হয়ে বললেন, ভণিতা রেখে বলুন কী বলতে চান আপনি?
‘Ñস্যার, আপনি মাত্র এক হাজার ৬০০ টাকা বেতন পান। আপনার স্ত্রী, দুই সন্তান রয়েছে, অফিসার হিসেবে আপনাকে স্ট্যান্ডার্ড বজায় রেখে চলতে হয়। এই সামান্য টাকায় আপনার চলে কেমন করে?’ এ ঘটনা কিন্তু পাকিস্তান আমলের।
Ñদেখুন, এ হলো মানসিকতার ব্যাপার। তিনি বললেন, ‘ঘর ভাড়া দিই ২০০ টাকা ও খাওয়া খরচ বাবদ খরচ হয় ৩০০ টাকা। অন্যান্য নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসপত্রের পেছনে খরচ হয় ২৫০ টাকার মতো। এর মধ্যে বিয়েশাদি, জন্মদিনের খরচ রয়েছে। জামাকাপড় আমার স্ত্রীই ইস্ত্রি করে দেয়। বাড়িতে কাজের বুয়া নেই। আমার বেতন থেকে খরচ হয় ৯৫০ টাকা। বাকি টাকা সঞ্চয় করি। পরিবারসহ ভালোই আছি। লোভ মানুষকে সর্বনাশের পথে ঠেলে দেয়। আমার এক প্রতিবেশী ছিল। পুলিশের এসআই। অত্যন্ত সৎ লোক ছিল। স্ত্রী বিভিন্ন জিনিসের বায়না ধরত। স্ত্রীর সন্তুষ্টির জন্য সে অবৈধভাবে টাকা উপার্জন শুরু করল।
কিছু দিন আগে এক ভদ্রলোক এজাহার করার জন্য থানায় তার কাছে এসেছিল। এজাহার লিপিবদ্ধ করতে সে ৫০০ টাকা দাবি করল। ভদ্রলোক টাকাটা তার হাতে তুলে দিতেই সিআইডির দু’জন লোক রুমে ঢুকে সেই এসআইকে হাতেনাতে ধরে ফেলে। বর্তমানে সে জেলহাজতে। লোভী যারা, তাদের পরিণাম এ রকমই হয়ে থাকে।
যা হোক, ফরেন টেন্ডার হলে পাকিস্তান আমলে সচিব পর্যায়ে এর সুরাহা হয়ে যেত। একেকটা টেন্ডার শত শত কোটি টাকার। কিন্তু বর্তমানে সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ের মন্ত্রীরা নিজেই এসব ডিল করেন।
মন্ত্রী অফিসের চেয়ারে বসেই পিএকে বলেন, ‘ফরেন টেন্ডার ফাইল কোথায়? সচিবকে আমার কাছে পেশ করতে বলুন।’ চীন থেকে কয়লা কিনবে বাংলাদেশ। দু’টি কোটেশন পাওয়া গেল। একটি কয়লা, অন্যটি কয়লার ডাস্ট। দামের অনেক তফাত। কয়লার দাম যদি হয় ৫০ কোটি টাকা, কয়লার ডাস্টের দাম হয় ৫০ লাখ টাকা। মন্ত্রী শেষ পর্যন্ত ডাস্ট কেনর আদেশ দিলেন। কয়লার মূল্যে ডাস্ট কেনা হলো। গোটা টাকাটার অপচয় হলো। কিন্তু মন্ত্রীর পকেট হলো ভারী। প্রত্যেকটি মন্ত্রণালয়ে বিদেশী মালামালের শিডিউল তৈরি হয়েই থাকে। আমাদের কাছে এটা বোধগম্য নয়। যাদের বাড়ি-গাড়ি সবই আছে, বাড়ি ভাড়াই পেয়ে থাকে লক্ষাধিক টাকা, তবু কেন তাদের অর্থের খায়েশ মেটে না? অথচ প্রতিটি মানুষের প্রয়োজন মাত্র সাড়ে তিন হাত জায়গা।
বলতেই হয়, রাজনীতিতে ছেলে, ভাই, ভাগ্নে প্রমুখকে সম্পৃক্ত করার পরিণতি কোনো দিন ভালো হয় না। সে কথা শেখ হাসিনাও জানেন, খালেদা জিয়াও জানেন। সরকারপ্রধান তার ন্যায়নীতি ও আদর্শ নিয়ে দেশকে দুর্নীতিমুক্ত করতে পারেন।
লেখক : আইনজীবী, বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্ট
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন