মঙ্গলবার, ১২ জুন, ২০১২

সরকারের জন্য আরো একটি সুযোগ


॥ আযম মীর ॥

একই ঘটনার পুনরাবৃত্তি হলো। তবে এবার পূর্ব ঘোষণা না দিয়ে, নীরবে। তিন মাস আগে ১২ মার্চ রাজধানী ঢাকায় মহাসমাবেশ হয়েছিল। তখন ছিল চারদলীয় জোট। স্লোগান ছিল ‘চলো চলো ঢাকা চলো’। সেই মহাসমাবেশ বানচাল করতে সরকার হেন পন্থা নেই যা গ্রহণ করেনি। জেলা-উপজেলা এমনকি ইউনিয়ন পর্যায়ে পর্যন্ত বিএনপি-জামায়াতসহ জোটের নেতা-কর্মীদের গ্রেফতার করা হয়। ঢাকায় পাড়া-মহল্লায় চলে গণগ্রেফতার। মহাসমাবেশের তিন দিন আগে ঢাকার সাথে দেশের অন্যান্য স্থানের সব ধরনের যোগাযোগ বন্ধ করে দেয়া হয়। রাজধানীর হোটেলগুলোতে এক সপ্তাহ আগে থেকে তল্লাশি চলতে থাকে। তিন-চার দিন আগে সব হোটেল বন্ধ করে দেয়া হয়। মহাসমাবেশের দিন রমনা, মতিঝিল, পল্টনসহ কয়েকটি এলাকার রেস্টুরেন্ট ও খাবার দোকান বন্ধ করে দেয়া হয়। রীতিমতো অঘোষিত কারফিউ অবস্থা জারি ছিল। বর্ণনাতীত ভোগান্তি এখনো সাধারণ মানুষের মনে জাগরুক। এত কিছু করেও কিন্তু সমাবেশ বানচাল করা যায়নি। টানটান উত্তেজনার মধ্যে ঢাকায় স্মরণকালের অন্যতম বড় সমাবেশ হয়েছিল সে দিন। যে পুলিশ-র‌্যাবকে সমাবেশে লোক সমাগমে বাধা দেয়ার কাজে ব্যবহার করা হয়েছিল, তারা জনতার ঢলে একাকার হয়ে গিয়েছিল। কোনো গোলযোগ দূরে থাক, ছোটখাটো বিশৃঙ্খলাও হয়নি। 
ফকিরাপুল থেকে নাইটিংগেল মোড় পর্যন্ত সমাবেশের সীমানা নির্ধারণ করে দেয়া হয়েছিল। এর বাইরে মাইক লাগানোও নিষিদ্ধ ছিল। সে দিন বিএনপি কার্যালয়ের চতুষ্পার্শ্বে কয়েক বর্গমাইল এলাকা লোকারণ্য হয়েছিল। বক্তৃতা শোনা নয়, যেন সমাবেশে যোগ দেয়াটাই ছিল তাদের জন্য চ্যালেঞ্জ। জনতা সে দিন বিজয়ী হয়েছে। সরকারকে জানিয়ে দিয়েছে, স্বৈরাচার তা যতই নির্মম হোক, এ দেশের মানুষ তার কাছে মাথা নত করে না। ১২ মার্চের সমাবেশ থেকে বিএনপি চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়া হরতাল, অবরোধ কিংবা সরকার পতনের কোনো কর্মসূচি দেননি। তিনি আবারো তিন মাসের আলটিমেটাম দিয়ে ১১ জুন ঢাকায় পুনরায় মহাসমাবেশের ডাক দেন। দাবি একটাইÑ তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে জাতীয় নির্বাচনের ব্যবস্থা পুনর্বহাল করতে হবে। চারদলীয় জোটের সেই শান্তিপূর্ণ সমাবেশ এবং বেগম খালেদা জিয়ার দায়িত্বশীল বক্তব্য দেশের গণমাধ্যমে উচ্ছ্বসিত প্রশংসা পায়। অন্য দিকে সরকারের আচরণের তীব্র নিন্দা করা হয়। দেশের বুদ্ধিজীবীসহ সব সচেতন মহল আশা করেছিল, ১২ মার্চের সফল মহাসমাবেশ সরকারের মধ্যে ভাবান্তর ঘটাবে। বিরোধী দলের সাথে সংলাপ শুরু করবে। তত্ত্বাবধায়ক ব্যবস্থা পুনঃপ্রবর্তনে আলাপ-আলোচনা করা হবে। কিন্তু সরকার সে পথে এগোয়নি। তিন-তিনটি মাস পার হয়ে গেছে। সরকার বিরোধী দলের সাথে আলাপ দূরে থাক, দলীয় ফোরামেও বিরোধী দলের দাবি নিয়ে কোনো আলোচনা করেনি। বরং প্রধানমন্ত্রী ও আওয়ামী লীগ সভানেত্রী শেখ হাসিনা উল্টো তত্ত্বাবধায়ক সরকার দাবি করায় বিরোধীদলীয় নেতাকে ব্যক্তিগতপর্যায়ে আক্রমণ করেছেন। সমালোচনা করেছেন যথেচ্ছ ভাষায়। সর্বশেষ আওয়ামী লীগের জেলা পর্যায়ের নেতাদের সাথে আলোচনাকালে তিনি স্পষ্ট ভাষায় ঘোষণা করেছেন, তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা পুনর্বহাল করা হবে না। আওয়ামী লীগ সরকারের অধীনেই নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে।
দেখতে দেখতে সময় পার হয়ে গেল। পূর্ব ঘোষণা অনুযায়ী ১১ জুন ঘনিয়ে আসার সাথে সাথে সরকারেরও তৎপরতা বাড়তে থাকল। মহাসমাবেশের অনুমতি দিতে টালবাহানা শুরু করল সরকার। প্রচার-প্রচারণায় বাধা দেয়া হলো। ঠিক আগের দিন মহাসমাবেশের মৌখিক অনুমতি দেয়া হলেও ঢাকাসহ সারা দেশে ব্যাপকভাবে গ্রেফতার করা হলো নেতা-কর্মীদের। দলবদ্ধভাবে বাস-ট্রেন-লঞ্চে আসতে দেয়া হয়নি কর্মী-সমর্থকদের। বরিশাল থেকে ঢাকা অভিমুখী লঞ্চসহ সব ধরনের নৌযান চলাচল বন্ধ করে দেয়া হয়। বগুড়াসহ দেশের অন্য কয়েকটি জেলা থেকে ঢাকায় কোনো যাত্রীবাহী বাস-কোচ আসতে দেয়া হয়নি। মহাসমাবেশের দিন সকাল থেকে রাজধানীর সব প্রবেশপথে ব্যারিকেড দিয়ে যানবাহন আটকে দেয়া হয়। সাভার, টঙ্গী, কাঁচপুরে আটকে দেয়া হয় শত শত বাস। সবচেয়ে ন্যক্কারজনক ঘটনা ঘটে খোদ রাজধানীতে। কর্মস্থলে যাওয়ার জন্য সকালে ঘর থেকে বের হয়ে মানুষ চরম ভোগান্তির মধ্যে পড়ে যায়। নগরে চলাচলকারী সব রুটের যানবাহন বন্ধ করে দেয়া হয়। বিুব্ধ মানুষ এয়ারপোর্ট সড়কসহ কয়েকটি স্থানে এর প্রতিবাদে অবরোধ পর্যন্ত করেছে। অনেক স্থানে বাস থামিয়ে যাত্রীদের নেমে যেতে বাধ্য করা হয়। আগের দুই দিন বহু হোটেলে তল্লাশি চালানো হয়। আর ধরপাকড় তো ছিলই। কিন্তু এত কিছু করেও মহাসমাবেশে লোকসমাগম ঠেকানো যায়নি। ১২ মার্চের মতোই সোমবারের মহাসমাবেশ ছিল জনসমুদ্র। কোনো বিশৃঙ্খলাও হয়নি। কিন্তু মানুষের ভোগান্তি ছিল চরমে। গণতান্ত্রিক সরকারের এ আচরণ দেখে স্বৈরাচারও বোধ হয় লজ্জা পাবে।
আমাদের সংবিধানে সব গণতান্ত্রিক অধিকার স্বীকৃত। রয়েছে নির্বাচিত সংসদ, বহুদলীয় গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা। অথচ প্রধান বিরোধী দলসহ যেকোনো দলকে সভা-সমাবেশ করতে হয় সরকারের মর্জিমাফিক। কোনো প্রতিবাদ-আন্দোলন দূরে থাক, শান্তিপূর্ণ সমাবেশ, মিছিল কিংবা মানববন্ধন করতে হলেও পুলিশের অনুমতি প্রয়োজন। এমন পুলিশি গণতন্ত্রের নজির সম্ভবত বাংলাদেশ ছাড়া আর কোথাও নেই। এখনো দুনিয়ার বহু দেশ আছে, যেখানে বহুদলীয় ব্যবস্থা নেই। রাজতন্ত্র বা একনায়কতন্ত্রও আছে বহু দেশে। কিন্তু ওই সব দেশেও সভা-সমাবেশের চর্চা আছে।
আমরা যে গণতান্ত্রিক সমাজ কায়েমের জন্য দীর্ঘ সংগ্রাম করেছি, মুক্তিযুদ্ধ করেছি, সামরিক স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলন করেছি, ক্ষমতাসীনদের কাছে তা তুচ্ছ হয়ে গেছে। গণতন্ত্রের নামে যে শাসন চলছে, তা নিকৃষ্ট স্বৈরশাসনের সাথেই তুলনা করা যায়। সরকার ১১ জুনের মহাসমাবেশকে কেন্দ্র করে যে আচরণ করেছে, তা থেকে স্পষ্টÑ ১২ মার্চ থেকে তারা কোনো শিক্ষাই নেয়নি। চরম স্বেচ্ছাচারের মাধ্যমে দেশ শাসন করার নীতি গ্রহণ করেছে। তারই চূড়ান্ত বহিঃপ্রকাশ ঘটল নতুন করে।
১২ মার্চের পর রাজনৈতিক অঙ্গনে অনেক গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা ঘটেছে। চারদলীয় জোট সম্প্রসারিত হয়ে ১৮ দলীয় জোটে পরিণত হয়েছে। মন্ত্রী হওয়ার ছয় মাসের মধ্যে সুরঞ্জিত সেনের কেলেঙ্কারি ও তার পদত্যাগ এবং পুনর্বহাল। বিএনপি নেতা ইলিয়াস আলীর গুম হওয়াকে কেন্দ্র করে উত্তেজনা, হরতাল। বিরোধী দলের সংসদে যোগদান এবং আবার বর্জন। হরতালের সময় সবিচালয়ে রহস্যজনক ককটেল বিস্ফোরণ এবং প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের সামনে গাড়ি পোড়ানোর ঘটনায় বিরোধী দলের শীর্ষপর্যায়ের নেতাদের বিরুদ্ধে মামলা দায়ের, গ্রেফতার এবং নজিরবিহীন দ্রুততায় চার্জশিট দাখিল। হাইকোর্ট জামিন আদেশ দেয়ার পরও বিএনপি মহাসচিবসহ শীর্ষ নেতাদের জামিন হয়নি। শীর্ষ নেতারা জেলে আটক থাকার পরও ১১ জুনের সমাবেশ সফল হওয়া প্রমাণ করে, সরকারের ওপর জনগণের আস্থায় চিড় নয়, ফাটল ধরেছে। প্রবল বাধা প্রতিবন্ধকতা উপেক্ষা করে মানুষ খালেদা জিয়ার প্রতি তাদের সমর্থন ব্যক্ত করার পরও তিনি কঠোর কোনো কর্মসূচি ঘোষণা করেননি। হরতাল-অবরোধ নয়, সমাবেশ-বিক্ষোভ-স্মারকলিপি প্রদানের মতো শান্তিপূর্ণ কর্মসূচি ঘোষণা করেছেন। আগামী ঈদুল ফিতর পর্যন্ত আবারো সময় দিয়েছেন সরকারকে। তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা পুনর্বহালের জন্য আলোচনার আহ্বান জানিয়েছেন সরকারকে। তার ঘোষণাÑ সরকার দাবি না মানলে হরতাল, অবরোধ ও ধর্মঘটের মতো কঠোর কর্মসূচি দেয়া হবে। বিরোধী দলের মহাসমাবেশ যখন চলছিল, তখন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বক্তৃতা করছিলেন আওয়ামী লীগ সংসদীয় দলের সভায়। তিনি সরকারের মেয়াদ শেষে নির্বাচন অনুষ্ঠানের কথা উল্লেখ করে দলীয় এমপিদের প্রস্তুতি নিতে বলেন। এর আগে মাঠপর্যায়ের নেতাদের সাথে মতবিনিময়কালেও তিনি একই কথা বলেছেন। প্রধানমন্ত্রী দাবি করেছেন, আওয়ামী লীগ সরকারের অধীনে অনুষ্ঠিত সব নির্বাচন সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ হয়েছে। তাই সংসদ নির্বাচনও নিরপেক্ষ হবে। 
এ দেশের মানুষের মনে উপজেলা, পৌরসভা ও ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনের ঘটনাবলি এখনো জ্বলজ্বল করছে। নির্বাচন কমিশনাররা নির্বাচনকালে ত্যক্ত-বিরক্ত হয়ে যেসব মন্তব্য করেছেন, সংবাদপত্রের পাতায় তা লেখা আছে। তাই ঢালাও দলীয়করণ করা প্রশাসন, পুলিশ-র‌্যাবের তত্ত্বাবধানে জাতীয় নির্বাচন নিরপেক্ষ হবে নাÑ এ কথা সবার কাছেই স্পষ্ট। একমাত্র আওয়ামী লীগ নেতারা ছাড়া কেউই মনে করে না, নির্বাচনকালীন তত্ত্বাবধায়ক সরকার ছাড়া নিরপেক্ষ নির্বাচন সম্ভব। দিন যতই যাচ্ছে, এই ইস্যুতে জনমত ততই বাড়ছে। 
এ অবস্থায় সরকারের জন্য আরেকটি সুযোগ এসেছে। সরকার নানামুখী সঙ্কটে জর্জরিত। সাধারণ মানুষের ওপর প্রাণান্তকর করের বোঝা চাপিয়ে এবং ব্যাংকের ঋণের ওপর নির্ভর করে বাজেট দিয়েছে সরকার। বিদায়ী অর্থবছরে মূল্যস্ফীতির চাপে চিঁড়ে চ্যাপটা হওয়া জনগণ এমনিতেই চরম বিুব্ধ। এবারের বাজেট দেখেও শঙ্কা করা হচ্ছে, পরিস্থিতির উন্নতি হওয়ার সম্ভাবনা কম। বরং অবনতিই ঘটবে। কালো টাকা অবাধে সাদা করার যে সুযোগ দেয়া হয়েছে, তাতে ঘুষ-দুর্নীতি, চাঁদাবাজি-টেন্ডারবাজি, কমিশনবাজি নতুন মাত্রা পাবে। এ অবস্থায় যদি রাজনৈতিক অস্থিরতা বাড়ে, তবে পরিস্থিতি কোথায় গিয়ে ঠেকবে তা অনুমান করাও কঠিন। 
জাতীয় সংসদের বাজেট অধিবেশন চলছে। এ অধিবেশন দীর্ঘ হবে। সরকার চাইলে বিরোধী দলকে ফিরিয়ে এনে সংসদকে কার্যকর ও প্রাণবন্ত করে তুলতে পারে। এ জন্য ইতিবাচক উদ্যোগ নিতে হবে। বিরোধীদলীয় নেতাদের মুক্তি এবং মামলা-হয়রানি থেকে মুক্ত করে গণতান্ত্রিক অধিকারের প্রকৃত চর্চা করতে হবে। তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা পুনর্বহালের বিষয়ে বিরোধী দলের সাথে অবিলম্বে আলোচনা করতে হবে। ক্ষমতার পালাবদলের স্বাভাবিক প্রক্রিয়া মেনে নেয়ার মানসিকতা না থাকলে আর যাই হোক গণতন্ত্র হয় না। সরকার কি সে পথে পা বাড়াবে? 
azammir2003@yahoo.com

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন