॥ আলফাজ আনাম ॥
বিরোধী দলের রাজনৈতিক কর্মসূচি ভণ্ডুল করার জন্য বাংলাদেশের ক্ষমতাসীন দলের উদ্ভাবনী শক্তি বিশ্বের রাজনৈতিক দলগুলোকে তাক লাগিয়ে দেয়ার মতো। বিরোধী দল যেন সমাবেশ করতে না পারে সে জন্য সারা দেশে পরিবহন ব্যবস্থা বন্ধ করে দেয়ার বুদ্ধি স্বৈরশাসক এরশাদ এমনকি পাকিস্তানি সেনাশাসক আইয়ুব-ইয়াহিয়ার মাথায়ও আসেনি। মুক্তিযুদ্ধের সময় ঢাকার সাথে সারা দেশের যোগাযোগ ব্যবস্থা বন্ধ হয়ে যায়নি। বিরোধী দলের সমাবেশ ঠেকাতে এটাই এখন ক্ষমতাসীন দলের প্রধান রাজনৈতিক কৌশল হয়ে দাঁড়িয়েছে। গত ১২ মার্চে বিএনপির নেতৃত্বাধীন জোটের মহাসমাবেশের আগে তিন দিন সারা দেশ থেকে ঢাকাকে বিচ্ছিন্ন করে ফেলা হয়েছিল। এবারো বিএনপির নেতৃত্বাধীন জোটের মহাসমাবেশের আগে লঞ্চ ও বাস যোগাযোগ বন্ধ করে দেয়া হয়। শুধু তাই নয়, রাজধানীর নগর পরিবহন ব্যবস্থা ছিল বন্ধ। বিভিন্ন এলাকা থেকে বিরোধী দলের নেতাকর্মীদের সমাবেশে আসা ঠেকাতে রাজধানীর ভেতরেও বাস চলাচল বন্ধ করে দেয়া হয়।
ক্ষমতাসীন দলের ডাকা অঘোষিত এই হরতালে সাধারণ মানুষের দুর্ভোগের মাত্রা ছিল অনেক বেশি। বিরোধী দল হরতাল ডাকে পূর্ব ঘোষণা দিয়ে। মানুষ জানে কবে হরতাল হবে। সেভাবেই প্রস্তুতি নেয়। কিন্তু বিরোধী দলের সমাবেশ সামনে রেখে সরকারি দলের ডাকা হরতালের ব্যাপারে মানুষের কোনো প্রস্তুতি ছিল না। রাস্তায় বের হওয়ার পর কোনো যানবাহন না পেয়ে ঘণ্টার পর ঘণ্টা রাস্তায় দাঁড়িয়ে থাকতে হয়েছে। প্রচণ্ড গরমে যানবাহন না পেয়ে মানুষের এই যন্ত্রণা শেষ পর্যন্ত ক্ষোভ আরো বাড়িয়ে দিয়েছে। বিমানবন্দরে সামনে সকালে যানবাহন না পেয়ে ক্ষুব্ধ মানুষ রাস্তা অবরোধ করে বসে থাকে। লঞ্চ চলাচল বন্ধ থাকায় কেরানীগঞ্জসহ ঢাকার আশপাশের এলাকায় যারা নৌকায় সদরঘাটে আসার চেষ্টা করেছেন সদরঘাটে তাদের বেদম পিটুনি দিয়েছে শ্রমিক লীগ। দেশের উত্তরাঞ্চল থেকে যেসব বাস ঢাকায় ঢোকার অপেক্ষায় ছিল সেগুলো আটকে দেয়া হয় সাভার এলাকায়। অনেক নারী ও শিশুকে ব্যাগ হাতে নিয়ে বসে থাকতে হয়। পূর্ব ঘোষণা ছাড়াই ক্ষমতাসীন দলের হরতাল ছিল প্রকৃত অর্থেই জনগণের বিরুদ্ধে হরতাল।
অনেক রাজনৈতিক বিশ্লেষক মনে করেন, আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় গেলেও বিরোধী দলের আচরণ ছাড়তে পারে না। আওয়ামী লীগের এই ভূমিকা এবারই প্রথম নয়, বাংলাদেশের স্বাধীনতার পর ১৯৭৩ সালের ২৯ জানুয়ারি সারা দেশে সকাল-সন্ধ্যা হরতাল পালন করে আওয়ামী লীগ। তখন রাষ্ট্রক্ষমতায় অধিষ্ঠিত ছিলেন শেখ মুজিবুর রহমান। হরতালের ডাক দেয়ার কারণ হিসেবে বলা হয়, বঙ্গবন্ধুর প্রতি অশালীন উক্তি, গুপ্তহত্যার প্রতিবাদ ও নির্বাচন বানচালের ষড়যন্ত্রের বিরুদ্ধে সারা দেশে ধর্মঘট আহ্বান করে আওয়ামী লীগ। অদ্ভুত ব্যাপার হলো ১৯৭৩ সালে ক্ষমতায় থেকে আওয়ামী লীগ যেসব কারণে হরতাল ডেকেছিল দেশে এখন সে পরিস্থিতি বিরাজ করছে। রাষ্ট্রপরিচালনার ক্ষেত্রে ক্ষমতাসীন রাজনৈতিক দলের যে দায়িত্বশীল ভূমিকা থাকা প্রয়োজন আওয়ামী লীগের রাজনৈতিক নীতিনির্ধারকদের মধ্যে শুরু থেকেই তার অভাব প্রবলভাবে ফুটে ওঠে। বরং রাজনৈতিক প্রতিপক্ষকে ঘায়েল করার কৌশল নিয়ে তারা বেশি ব্যস্ত থাকে।
মার্চে বিএনপির সমাবেশের তিন দিন আগ থেকে সারা দেশের সাথে ঢাকাকে বিচ্ছিন্ন করা হয়েছিল। কিন্তু বাধা দেয়ার পরও সমাবেশে জন-উপস্থিতি কমেনি। সোমবারের সমাবেশের চিত্র ছিল একই রকম। এবারো পরিবহন ব্যবস্থা বন্ধ করে দিয়ে বিরোধী দলের সমাবেশে জন-উপস্থিতি কমানো যায়নি। নয়া পল্টনে বিরোধী দলের এই সমাবেশে ফকিরাপুল মোড় থেকে কাকরাইল মোড় পর্যন্ত মানুষের উপস্থিতি আগের যেকোনো সমাবেশের চেয়ে কম ছিল না। পূর্ব দিকে দৈনিক বাংলা মোড় এবং পশ্চিমে বিজয়নগর রাস্তাতেও শত শত মানুষের উপস্থিতি ছিল। প্রচণ্ড রোদ আর গরমের কারণে নয়া পল্টন এলাকার অলিগলির মধ্যেও মানুষের উপস্থিতি ছিল চোখে পড়ার মতো। গণসমাবেশে টাঙানো ব্যানারগুলো থেকে প্রমাণ হয় বাস-লঞ্চ চলাচল বন্ধ করার পরও দেশের বিভিন্ন স্থান থেকে জোটের নেতাকর্মীরা সমাবেশে এসেছেন। রাজশাহী, যশোর, খুলনা, বরিশাল, টাঙ্গাইল ও পঞ্চগড় থেকে বিএনপির অনেক নেতাকর্মী আগেই ঢাকায় চলে আসেন। আবার অনেকে ঢাকায় আসার বাস-কোচ না পেয়ে ভেঙে ভেঙে চলে আসেন। সমাবেশ ঠেকানোর জন্য যানবাহন চলাচল বন্ধ না করলে হয়তো লোকসমাগম আরো বেশি হতো। কিন্তু বাধা দেয়ার পরও বড় আকারের এই সমাবেশ জোটের নেতাকর্মীদের আত্মবিশ্বাস যেমন বাড়িয়েছে; অপর দিকে দুর্ভোগের কারণে সরকারের প্রতি সাধারণ মানুষ আরো বিক্ষুব্ধ হয়ে উঠেছে।
একটি রাজনৈতিক দলের শক্তি অর্জন হয় নেতাকর্মীদের ত্যাগ স্বীকারের মধ্য দিয়ে। শৃঙ্খলার মধ্য দিয়ে আসে রাজনৈতিক দলের সাফল্য। বিরোধী দলের সমাবেশ ঘুরে দেখা গেছে, বিরোধী জোটের নেতাকর্মীদের মাঝে হতোদ্যম অবস্থা আর নেই। প্রচণ্ড গরম, যানবাহনের অপ্রতুলতা, ধরপাকড় এড়িয়ে তারা সমাবেশে এসেছেন। বিএনপি ও জামায়াতের প্রথম সারির নেতাদের গ্রেফতারের পরও নেতাকর্মীদের মধ্যে হতাশার কোনো ছাপ ছিল না। বিরোধীদলীয় নেতা সম্ভবত এ কারণেই বলেছেন, গ্রেফতার করে জোটকে দুর্বল করা যাবে নাÑ কর্মীরা নেতা হবেন, সমর্থকেরা কর্মী হবেন।
সমাবেশে কোনো বিশৃঙ্খলা ছিল না। গরমে অনেক জায়গায় নেতাকর্মীদের পানি খাওয়ানোর ব্যবস্থা ছিল। ছিল একাধিক মেডিক্যাল টিম। নানা রঙের ক্যাপ পড়ে একেক এলাকার নেতাকর্মীদের সঙ্ঘবদ্ধভাবে থাকতে দেখা গেছে। স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী আগেই হুমকি দিয়েছিলেন কোনো প্রকার বিশৃঙ্খলা হলে পুলিশ বসে থাকবে না। কিন্তু সমাবেশে কোনো বিশৃঙ্খলা হয়নি। নয়া পল্টন এলাকা ছিল পুলিশের বেষ্টনীতে। গরমে তৃষ্ণার্ত পুলিশ বসেই ছিল। তাদের কোনো টিয়ার গ্যাস বা আগ্নেয়াস্ত্র ব্যবহার করতে হয়নি; বরং পুলিশ আর সমাবেশে যোগদান করা নেতাকর্মীদের একই গ্লাসে পানি খেতেও দেখা গেছে।
লক্ষণীয় বিষয় সমাবেশে তরুণদের উপস্থিতি ছিল অনেক বেশি। বিরোধীদলীয় নেতাও বিষয়টি লক্ষ করেছেন। তিনি তার বক্তব্যে তরুণদের দৃষ্টি আকর্ষণ করেছেন। আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় থাকলে তাদের ভবিষ্যৎ নেই। সামাজিকভাবে তাদের প্রতিষ্ঠিত হওয়ার কোনো সুযোগ থাকবে না। কর্মসংস্থান হবে নাÑ এমন কথা তিনি একাধিকবার বলেছেন। তরুণদের ব্যাপারে বিএনপির ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা হবে আগামী দিনে দলটির রাজনীতির গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। তরুণদের নিয়ে বিএনপির ভবিষ্যৎ ভাবনা জানানো এখন খুবই জরুরি। কিভাবে তাদের কর্মসংস্থান হবে। দক্ষ জনশক্তি হিসেবে গড়ে তুলতে বিএনপির পরিকল্পনাই বা কী তা জানানো দরকার। বিএনপি অতীতমুখী নয়, ভবিষ্যৎমুখী রাজনৈতিক দলÑ এমন কথা নেতারা বলে থাকেন। সেই ভবিষ্যতের চিত্র এখন তরুণদের সামনে তুলে ধরা বেশি প্রয়োজন। মনে রাখতে হবে জিয়াউর রহমানের রাজনীতি তরুণদের বেশি টেনেছিল। প্রবীণ রাজনীতিবিদদের পাশাপাশি দক্ষ পেশাজীবী আর তরুণদের রাষ্ট্রপরিচালনায় সম্পৃক্ত করেছিলেন। বিএনপির রাজনৈতিক সাফল্য এসেছে এই সমন্বয়ের রাজনীতি থেকে।
সমাবেশে জনসমাগম ঠেকাতে ক্ষমতাসীন দল যখন হরতাল পালনে বাধ্য করেছে তখন বিরোধী দল নতুন রাজনৈতিক কর্মসূচিতে হরতাল না থাকায় স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলেছে। অনেকে ধারণা করেছিলেন বিরোধী দলের নেতাদের মুক্তি না দেয়ার কারণে হয়তো অন্তত এক দিনের হরতালের কর্মসূচি আসতে পারে। কিন্তু রমজান ও ঈদের আগে হরতাল নয়, এমন ঘোষণা দিয়ে বিরোধী দল যথার্থই দায়িত্বশীলতার পরিচয় দিয়েছে। সাড়ে তিন বছরে ২০টিরও কম হরতালের এই নজির বর্তমান ক্ষমতাসীনদের ভবিষ্যৎ রাজনৈতিক কৌশল নির্ধারণে বিবেচনায় নিতে হবে। সময় বদলে গেছে। বদলে গেছে তরুণ ও নতুন ভোটারদের মানসিকতা। সঙ্ঘাত ও সংঘর্ষের অতীতমুখী রাজনীতি পরিত্যাগ না করলে ক্ষমতাসীনদের গণবিচ্ছিন্নতা আরো বাড়বে। বাস, লঞ্চ বন্ধ করে সমাবেশ থেকে জনগণকে বিচ্ছিন্ন করা যায়। কিন্তু মানুষের মন তো বিচ্ছিন্ন করা যায় না।
alfazanambd@yahoo.com
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন