॥ মুহাম্মদ মিযানুর রহমান জামীল ॥
ভারতের পররাষ্ট্রনীতির বিরুদ্ধে গোটা দণি এশিয়ায় বিরাজ করছে ভারতবিরোধিতা। তবে ভারত এই বিরোধিতাকে সঙ্কীর্ণ ধর্মীয় সাম্প্রদায়িক রাজনীতি বলে উড়িয়ে দিচ্ছে। বলা যায়, ভারত বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামে সমর্থন দিয়েছিল এবং বাংলাদেশের মিত্রের ভূমিকা পালন করেছিল। কিন্তু স্বাধীনতার পর ভারত একের পর এক তার আগ্রাসী চরিত্র উন্মোচন করে এবং সর্বশেষ তা ফারাক্কার পানি প্রত্যাহারের মধ্য দিয়ে।
ভারতের এবারের আগ্রাসন টিপাইমুখ বাঁধ। পানির ওপর ভারতের একচেটিয়া নিয়ন্ত্রণ বজায় রাখাই এর উদ্দেশ্য। অথচ এর কারণে বাংলাদেশের যে সর্বনাশ হবে, ভারত তা একবারো ভেবে দেখেনি। এ বাঁধের ফলে বাংলাদেশের তির পরিসংখ্যান দেখলে আঁতকে উঠতে হয়।
ইনস্টিটিউট অব ওয়াটার মডেলিং ২০০৫ সালে একটি গবেষণায় উজানে বাঁধ নির্মাণে বাংলাদেশে কী পরিমাণ তি হবে, তার বিস্তারিত হিসাব প্রকাশ করে। এর মধ্যে রয়েছেÑ প্লাবনভূমির প্লাবনের ধরন ও পরিমাণ এবং ঋতু বদলে যাবে। সুরমা ও কুশিয়ারার প্রাকৃতিক পানিপ্রবাহ শুষ্ক করায় সিলেট ও মৌলভীবাজারেই যথাক্রমে ৩০ হাজার ১২৩ হেক্টর এবং ৫২০ হেক্টর প্লাবনভূমি কমে যাবে। বর্ষায় জলমগ্ন হবে না সুরমা ও কুশিয়ারা নদীর উজানের ৭১ শতাংশ এলাকা। কুশিয়ারা নদীর প্রায় ৬৫ কিলোমিটার এলাকা নদীটির ডান পাশের প্লাবনভূমি থেকে বিচ্ছিন্ন হবে। কুশিয়ারা বাম তীরের বরদাল হাওর শুকনো মওসুমে পুরোপুরি শুকিয়ে যাবে। কাইয়ার দীঘির হাওর দুই হাজার ৯৭৯ হেক্টর জলাভূমি হারাবে। ফলে সুরমা-কুশিয়ারা-মেঘনা অববাহিকার বিস্তীর্ণ অঞ্চলজুড়ে জলবায়ু, বাস্তুসংস্থান ও জীবন-জীবিকার ব্যাপক তি হবে।
আন্তর্জাতিক ও বাংলাদেশের বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ভারতের টিপাইমুখ বাঁধ বাংলাদেশের এই নদী অববাহিকার জনপদে সর্বনাশ ডেকে আনবে। বর্ষা শুরুর আগে নদীতে যে তলানি প্রবাহ থাকে, টিপাইমুখ বাঁধ তা আসতে দেবে না। এ ছাড়া বর্ষার শুরুতেও বৃষ্টির পানি আটকে রাখবে। ফলে বর্ষার শুরুতে সুরমা ও কুশিয়ারায় প্রায় এক মাস দেরিতে পানি আসবে। ফলে নদী দু’টি শুকিয়ে থাকবে। তবে পুরো বর্ষায় ঠিকই নদী পূর্ণ থাকবে। এরপর বর্ষা শেষ হলে জলাধারে ধরে রাখা পানি আস্তে আস্তে ছাড়বে। আগে যেখানে নভেম্বরের দিকে নদীর পানি শুকিয়ে যেত, এখন তা জানুয়ারিতে হবে। ফলে হাওরাঞ্চলে এক ফসলি জমিগুলোতে ধান চাষ করা যাবে না। মওসুমে এক হাজার কোটি টাকার বোরো ধানের আবাদ হবে না এবং জনজীবন, মৎস্যসম্পদ, কৃষিÑ সব কিছুই বিপর্যয়ে পড়বে।
বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, একটি ভূমিকম্পপ্রবণ এলাকায় বাঁধের জলাধার ভূমিকম্পকে উসকে দেয়। যদি ভূমিকম্পে বাঁধ ভেঙে যায়, তাহলে তা ভাটির দেশ বাংলাদেশের জন্য ভয়াবহ সর্বনাশ বয়ে আনবে বলে বিশেষজ্ঞরা মনে করেন। ভারতে টিপাইমুখ বাঁধের বিরুদ্ধে তীব্র আন্দোলন হচ্ছে। এই বাঁধের মূল বিষয় সামরিক। বাঁধ থেকে উৎপাদিত বিদ্যুৎ সেখানকার সামরিক আগ্রাসনকে আরো বেশি গতি দেবে। আসামে চলছে বিচ্ছিন্নতাবাদী আন্দোলন। সেই সাথে আসামবাসী এই বাঁধের বিরুদ্ধে তীব্র গণ-আন্দোলনও জারি রেখেছে। প্রয়োজন সীমান্তের গণ্ডি পেরিয়ে দুই দেশের জনগণের সংগ্রামে মিলন ঘটানো। একই সাথে আওয়াজ তোলা দরকারÑ অভিন্ন নদীর অভিন্ন বণ্টন চাই।
দেশের সীমানা যেমন কাঁটাতার-পাসপোর্ট দিয়ে পার্থক্য করা যায়, নদীকে তেমনভাবে বিভাজ্য করা যায় না। যদি উভয় দেশের মানুষ এই আওয়াজ তোলে, তাহলে মতায় যারা থাকেন, তাদের অবশ্যই নড়েচড়ে বসতে হবে। নতজানু চিন্তা ঝেড়ে ফেলে অস্তিত্বের জন্য বাংলাদেশকে জাগতে হবে। রুখতেই হবে সর্বনাশা টিপাইমুখ বাঁধ।
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন