মঙ্গলবার, ১২ জুন, ২০১২

যাদের করেছ অপমান



ম ন জু র আ হ ম দ
জাতীয় সংসদে দাঁড়িয়ে লাগামহীনভাবে যা ইচ্ছা তাই কি বলা যায়? কোনো ব্যক্তি সম্পর্কে, তিনি খ্যাতিমান হোন বা অখ্যাত কেউ, অবমাননাকর কিছু কি বলা যায়? কারও কোনো বক্তব্যে সংসদের কোনো সদস্য অথবা একাধিক সদস্য কিংবা পুরো সংসদও যদি সংক্ষুব্ধ হয়, তবে তার বিহিত করার সংসদীয় নিজস্ব পদ্ধতি তো নির্দিষ্ট করাই আছে। এ বিষয়ে সংসদীয় কমিটি আছে এবং সে কমিটিতে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিকে তলবের নিয়মও আছে। সে নিয়ম পালনের আগেই সংসদে বক্তব্য দিতে দাঁড়িয়ে কাউকে অপদস্থ করা সংসদের প্রচলিত রীতি অনুযায়ী সমীচীন নয়। সংসদে যাদের জবাব দেয়ার সুযোগ নেই, সংসদের ফ্লোরে যারা আত্মপক্ষ সমর্থন করতে পারেন না, তারা যাতে সংসদে অহেতুক সমালোচিত না হন সে লক্ষ্যেই আইন প্রণেতাদের এই সতর্কতা।
কিন্তু আমাদের মাননীয় সংসদ সদস্যরা তো এই সতর্কতাকে বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখাচ্ছেন। এ সম্পর্কিত সংসদীয় বিধি-বিধানকে তো তারা আমলে নিচ্ছেন না। তারা সংসদের সদস্য, শাসন ক্ষমতার সর্বোচ্চ সংস্থায় তারা জনগণের ভোটে নির্বাচিত—এই দাপটেই তারা বা তাদের কেউ কেউ বেপরোয়া মনোভাবের প্রকাশ ঘটিয়ে চলেছেন। তারা কারও মান-সম্মানের তোয়াক্কা করেন না। যার বিরুদ্ধে তারা বলেন, যার ওপর তারা কুপিত হন, তিনি যত সম্মানীয় হোন না কেন, জাতীয় বা আন্তর্জাতিকভাবে তিনি দেশের যত গর্বের মানুষই হোন কেন, তাকে হেনস্থা করতে এই সংসদের সদস্য এবং সরকারের কর্তাব্যক্তিরা সামান্যতম বিচলিত হচ্ছেন না। একের পর এক তারা অসম্মানিত করে চলেছেন দেশের নমস্য ব্যক্তিদের। অত্যন্ত নিম্নমানের আক্রমণাত্মক ভাষায়, অত্যন্ত অমার্জিত ও স্থূলভাবে তারা সংসদে ও সংসদের বাইরে বক্তব্য দিচ্ছেন তাদের বিরুদ্ধে।
এবার সংসদে এদের আক্রমণের শিকার হয়েছেন ‘আলোকিত মানুষ গড়ার কারিগর’ সর্বজনশ্রদ্ধেয় শিক্ষাবিদ অধ্যাপক আবদুল্লাহ আবু সায়ীদ। কী তার অপরাধ? না, কোনো অপরাধ তার প্রমাণিত হয়নি। কোনো অপরাধ না করেই তিনি সংসদে হেনস্থা হয়েছেন। অধ্যাপক সায়ীদ নাকি ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনালের সেমিনারে দেয়া বক্তব্যে সংসদ সদস্যদের চোর-ডাকাত বলে অভিহিত করেছেন। সংসদের সবেধননীলমণি স্বতন্ত্র সদস্য ফজলুল আজিম বিষয়টি উত্থাপন করেন। আর এ প্রসঙ্গে অধ্যাপক সায়ীদের বিরুদ্ধে ব্যক্তিগত আক্রমণ চালিয়ে বক্তব্য দেন প্রবীণ সদস্য সাবেক মন্ত্রী শেখ ফজলুল করিম সেলিম। বিস্ময়ের ব্যাপার, স্পিকার ও ডেপুটি স্পিকারের অনুপস্থিতিতে সেই মুহূর্তে অধিবেশনের সভাপতি অধ্যাপক আলী আশরাফ নিজেও অধ্যাপক আবদুল্লাহ আবু সায়ীদের বিরুদ্ধে বিভিন্ন কূট মন্তব্য করেন। তিনি অধ্যাপক সায়ীদকে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তিদান এবং সংসদে দাঁড়িয়ে দেশের ১৬ কোটি মানুষের কাছে তার নিঃশর্ত ক্ষমা প্রার্থনার পক্ষে অভিমত ব্যক্ত করেন। তিনি বলেন, তাকে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দেয়া না হলে গণতন্ত্রের আকাশে কালো মেঘ দেখা দেবে। এমন বক্তব্য সংবিধানের লঙ্ঘন এবং গণতন্ত্রকে পদদলিত করার প্রয়াস বলেও তিনি উল্লেখ করেন।
অধ্যাপক আলী আশরাফকেও ছাপিয়ে গেছেন শেখ ফজলুল করিম সেলিম। বলা যায়, ব্যক্তিগত আক্রমণের এক নির্দশন স্থাপন করেছেন তিনি। তিনি অধ্যাপক সায়ীদের টাকার উত্স, তার এত গাড়ি-বাড়ির উত্স ইত্যাদি সন্ধানের দাবি জানান। তিনি ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনালের সমালোচনা করে বলেছেন, এসব এনজিও বিদেশ থেকে টাকা এনে সার্টিফিকেট দেয়ার দোকান খুলেছে। এদের টাকার উত্স সম্পর্কে খোঁজ নিতে তিনি অর্থমন্ত্রীর প্রতি আহ্বান জানান। অধ্যাপক সায়ীদকে কটাক্ষ করে তিনি বলেন, সংসদের ওপর আঘাত আনা এসব বুদ্ধিজীবী কিছু কিছু সময় জাতির বিবেক হয়ে যান। কিন্তু জাতির দুর্যোগের সময় তাদের টিকিটিও খুঁজে পাওয়া যায় না। দেশে যখন গণতান্ত্রিক সরকার থাকে, জনগণের সরকার থাকে, তখন এসব বুদ্ধিজীবীর মাথা খারাপ হয়ে যায়। কিন্তু যদি সামরিক সরকার আসে, অগণতান্ত্রিক অবৈধ সরকার আসে তাহলে তারা পদ পান, সুবিধা পান, টাকার মালিক হন। এত বলার পরও ক্ষান্ত দেননি জনাব সেলিম। অধ্যাপক সায়ীদের পেশাগত সাফল্যকে ব্যঙ্গ করে বলেছেন, এসব অধ্যাপকের কাছ থেকে ছাত্ররা কী শিক্ষা লাভ করতে পারে তা বলে দেয়ার প্রয়োজন হয় না।
সংসদে উত্থাপিত এসব অভিযোগের জবাব দিতে বিলম্ব করেননি অধ্যাপক সায়ীদ। ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল আয়োজিত এক সংবাদ সম্মেলনে তিনি সব অভিযোগ অস্বীকার করে বলেছেন, সংসদ সদস্যদের তিনি চোর-ডাকাত বলেননি। তিনি দুর্নীতি নিয়ে যা বলেছেন তা বিশেষ কারও বিরুদ্ধে নয়, এটি ছিল একটি সাধারণ আলোচনা। তিনি সেমিনারে দেয়া তার বক্তৃতার ধারণকৃত অডিও টেপ সাংবাদিকদের দেন। তিনি বলেন, তার কোনো গাড়ি নেই, বাড়ি নেই। তিনি একটি অ্যাপার্টমেন্টে ভাড়া থাকেন। এই ভাড়া পরিশোধের আর্থিক সঙ্গতিও তার নেই। ম্যাগাসাইসাই পুরস্কারের টাকাটাই তার ভরসা। তিনি আক্ষেপ করে বলেন, কোনো পত্রিকায় প্রকাশিত ভুল খবর যাচাই-বাছাই না করেই সংসদে তার সম্পর্কে এ ধরনের বিরূপ আলোচনা করা হয়েছে।
তার এই জবাবের প্রতিক্রিয়া সংসদে কী হয়েছে জানা যায়নি। অধ্যাপক সায়ীদকে কদর্যভাবে আক্রমণকারী শেখ সেলিম কিংবা আলী আশরাফ, ফজলুল আজিম, জাতীয় পার্টির মুজিবুর রহমান চুন্নু, যিনি আবদুল্লাহ আবু সায়ীদকে উদ্দেশ করে বলেছিলেন, ‘যিনি দেশের জন্য কিছু করতে পারেন না, দেশের মানুষের দায়িত্ব নিতে পারেন না, তিনি এ ধরনের মন্তব্য করতে পারেন না’—তারা কি তাদের বক্তব্য প্রত্যাহার করেছেন? সর্বজনশ্রদ্ধেয়, ম্যাগাসাইসাই পুরস্কারে ভূষিত বাংলাদেশের আরেক গর্ব অধ্যাপক সায়ীদকে এমন নির্লজ্জভাবে অবমাননার জন্য তার কাছে তারা কি ক্ষমা প্রার্থনা করেছেন?
তবে নিশ্চয় ধন্যবাদার্হ ডেপুটি স্পিকার কর্নেল (অব.) শওকত আলী। তিনি সংসদে অধ্যাপক সায়ীদকে নিয়ে এ ধরনের আলোচনায় দ্বিমত পোষণ করে তার ব্যক্তিগত অভিমত ব্যক্ত করে বলেছেন, অধ্যাপক সায়ীদ তার শ্রদ্ধেয়। তার মতো সম্মানীয় ব্যক্তিকে নিয়ে সংসদে এ ধরনের আলোচনা সমীচীন হয়নি।
সমীচীন হয়নি, কিন্তু আলোচনার নামে তাকে যে উদ্দেশ্যমূলক ও দুঃখজনকভাবে অবমাননা করা হয়েছে তা বিহিতে কি কোনো উদ্যোগ নেয়া হয়েছে? সংসদের পক্ষ থেকে এমন একটি উদ্যোগ গ্রহণ কি বাঞ্ছনীয় নয়?
আসলেই দেশ যেন এখন এক শ্রদ্ধাবোধের দুর্ভিক্ষের মধ্যে কালাতিপাত করছে। উদ্দেশ্যমূলকভাবে এখন একে অন্যের প্রতি অশ্রদ্ধার প্রকাশ ঘটাচ্ছে, তাকে অবমাননা করছে, অপদস্থ করছে। বলতে দ্বিধা নেই, এ প্রবণতা ক্ষমতাসীনদের মধ্যে বড় প্রকট হয়ে দেখা দিয়েছে। ক্ষমতার জোরে তারা এখন আর কাউকেই পরোয়া করছে না। ব্যক্তিগত এবং প্রাতিষ্ঠানিকভাবে তারা আক্রমণ চালাচ্ছে তাদের ওপর, যাদের তারা সামান্যতমও তাদের স্বার্থবিরোধী মনে করছে। খোদ প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা থেকে শুরু করে ক্ষমতাসীন দল আওয়ামী লীগের নিম্ন পর্যায়ের ব্যক্তিরাও উদ্দেশ্যপ্রণোদিতভাবে মুখিয়ে উঠছেন কাউকে অবমাননা-অমর্যাদা করতে। ড. ইউনূসের বিরুদ্ধে তো সরকার এবং সরকারি দল রীতিমত জেহাদে নেমেছে তিনি নোবেল পেয়ে দেশের মুখ উজ্জ্বল করার পর থেকেই। তাদের এমন পর্যায়ের এমন সব ব্যক্তিরাও ড. ইউনূস সম্পর্কে কূট বাক্য উচ্চারণ করছে যা শুনে আত্মগ্লানিতে অধোবদন হয়ে যেতে হয়। এসব ব্যক্তির ন্যূনতম যোগ্যতা নেই ড. ইউনূসের প্রতিষ্ঠার কাছাকাছি যাওয়ার, তার সাফল্য মূল্যায়নের। অথচ তোতা পাখির মতো তারা আউড়ে চলেছে ইউনূসবিরোধী বচন। এমন অবস্থায় প্রশ্ন করতে ইচ্ছে হয়, এ কোন সংস্কৃতির প্রচলন ঘটানো হচ্ছে আমাদের সামাজিক মূল্যবোধে? ক্ষমতার জোরে দেশের কৃতী ব্যক্তিদের মান-মর্যাদা ভূলুণ্ঠিত করার সংস্কৃতি তো আমাদের সমাজে কখনও ছিল না।
পত্রিকায় দেখলাম সংসদ উপনেতা সৈয়দা সাজেদা চৌধুরী তার সাতাত্তরতম জন্মদিনের অনুষ্ঠানে কেক কাটার পর সাংবাদিকদের সঙ্গে আলাপচারিতায় ড. ইউনূস প্রসঙ্গে বলেছেন, ‘ইউনূসরা ক্ষণস্থায়ী। এরা কিছুদিনের জন্য আসে, আবার চলে যায়। ইউনূসও একদিন হারিয়ে যাবে।’ কথাটা কি ঠিক বলেছেন সম্মানীয় উপনেতা? ড. ইউনূসকে তুচ্ছ করার জন্য এমন অবাস্তব কথা বলতে হবে তার মতো উচ্চ পদমর্যাদার কোনো ব্যক্তিকে? কোনো নোবেল বিজয়ী কি তার দেশ ও জাতির ইতিহাস থেকে কখনও হারিয়ে গেছেন? নোবেল বিজয়ীরা তো পুরস্কারটি পেয়ে বিখ্যাত হন না। তারা আগেই বিখ্যাত হন তাদের কীর্তির জন্য। নোবেল একটি পুরস্কার। এ পরস্কার পেতে হলে উল্লেখযোগ্য অবদান রাখতে হয়, গুরুত্বপূর্ণ কীর্তির অধিকারী হতে হয়। বড় বড় বিজ্ঞানীরা নোবেল পেয়েছেন তাদের আবিষ্কারের জন্য, রবীন্দ্রনাথ পেয়েছেন তার সাহিত্য কীর্তির জন্য, অমর্ত্য সেন, ড. ইউনূস, ড. ভিসি রমন সবাই পেয়েছেন তাদের অবদানের জন্য। এরা কেউ হারিয়ে যাবার নন, কেউ হারিয়ে যাবেন না। বরঞ্চ হারিয়ে যাবেন সাজেদা চৌধুরীদের মতো ক্ষণস্থায়ী মন্ত্রী-উপনেতারা। বাংলাদেশে এ পর্যন্ত কত অসংখ্য মন্ত্রীর আসা-যাওয়া আমরা দেখেছি। কোথায় তারা আজ? কেউ কি তাদের মনে রেখেছে? তারাই কি সবাই হারিয়ে যায়নি? হারিয়ে সাজেদা চৌধুরীই একদিন যাবেন, ড. ইউনূস নন।
পররাষ্ট্রমন্ত্রী, সরকারের এক পাতি মন্ত্রী আমাদের সমাজের আর এক সম্মানীয় বিশিষ্টজন ব্যারিস্টার রফিক উল হক সম্পর্কে অবমাননাকর কিছু মন্তব্য করেছিলেন বলে পত্রিকায় পড়েছিলাম। মনে হয় দেশে যেন এক হিড়িক পড়ে গেছে মর্যাদাবান ব্যক্তিদের অসম্মানিত-অবমাননা করার। যারা এমন করছেন তারা নিশ্চয় এ বোধ থেকে বিচ্যুত নন যে, যে জাতি নিজেদের প্রতি শ্রদ্ধাশীল নয়, যারা নিজেদের সম্মান জানাতে পারেন না সে জাতি কখনোই নিজের পায়ে দাঁড়াতে পারে না, ওপরে উঠতে পারে না। সে জাতি, সে দেশ বড় দুর্ভাগা।
বাংলাদেশের আজকের বিরাজিত পরিস্থিতিতে কবিগুরুর কথাগুলো বারবার ফিরে ফিরে আসে। বারবার চিত্কার করে বলতে ইচ্ছে করে—‘হে মোর দুর্ভাগা দেশ, যাদেরে করেছ অপমান, অপমানে হতে হবে তাহাদের সবার সমান।’
ফুটনোট : লেখাটা পত্রিকায় পাঠিয়ে দেয়ার পর খবরে দেখলাম অধ্যাপক সায়ীদকে অবমাননার ঘটনায় স্পিকার অ্যাডভোকেট আবদুল হামিদ সংসদের পক্ষ থেকে দুঃখ প্রকাশ করেছেন এবং অধ্যাপক সায়ীদ সম্পর্কে সংসদে দেয়া অসংসদীয় বক্তব্যগুলো এক্সপাঞ্জ করেছেন।
লেখক : যুক্তরাষ্ট্র প্রবাসী প্রবীণ সাংবাদিক

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন