মঙ্গলবার, ১২ জুন, ২০১২

তত্ত্বাবধায়ক সরকার কতকাল দরকার?



মো. গো লা ম হো সে ন
’৮৮ নির্বাচনকে সামনে রেখে এরশাদবিরোধী আন্দোলন যখন তুঙ্গে, তখন এক সংবাদ সম্মেলনে প্রেসিডেন্ট এরশাদ অনুষ্ঠিতব্য নির্বাচন অবাধ ও নিরপেক্ষ হওয়ার নিশ্চয়তা ব্যক্ত করলে জনৈক সাংবাদিক জানতে চাইলেন, আসন্ন নির্বাচনটিও ’৮৬-র মতো অবাধ ও নিরপেক্ষ হবে কিনা? প্রশ্নের কোনো জবাব না দিয়ে এরশাদ পাল্টা প্রশ্ন করলেন, ‘আপনি কোন পত্রিকার সাংবাদিক? জবাব—‘বিবিসি’। এরশাদ—‘ও, বিরোধী ব্রডকাস্টিং কর্পোরেশন, তাই না।’ ক্ষুদ্র সংলাপ। কিন্তু তাত্পর্য গভীর। সাংবিধানিকভাবে বাংলাদেশ একটি গণতান্ত্রিক দেশ। তবে আমাদের গণতন্ত্রের আলাদা কিছু মাত্রা আছে। এখানে শূন্য জনপ্রিয়তা নিয়েও ক্ষমতায় থেকে নির্বাচন করে কেউ কোনোদিন পরাজিত হয়নি। আবার তত্ত্বাবধায়ক ব্যবস্থায় কেউ পরপর দু’বার ক্ষমতায় আসতে পারেনি। তাই ক্ষমতাসীনদের কাছে সব সময়ই ‘তত্ত্বাবধায়ক’ শব্দটি আতঙ্ক ও হতাশার কারণ। আমাদের আরও কতিপয় বৈশিষ্ট্য হলো এই যে, আমরা এক সময় নিরপেক্ষ নির্বাচনের স্বার্থে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের জন্য জীবনপণ আন্দোলন করি, আবার ক্ষমতায় থাকলে ভোল পাল্টিয়ে গণতন্ত্রের ভিত মজবুত করার পবিত্র নিয়তে (?) তাকে অবৈধ কুলাঙ্গার বলে প্রত্যাখ্যান করি। গণতন্ত্রের জন্য আমরা প্রতারণা করতে পারি, মিথ্যে শপথও করতে পারি। এমনকি প্রয়োজনে গুম বা খুনও। আমরা গণতন্ত্রের জন্য, গণতন্ত্রীদের দ্বারা, গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ায় পবিত্র সংসদে বসেই গণতন্ত্র দাফনের ব্যবস্থা করতে পারি। আমরা গণতন্ত্রের জন্য কখনও বলি হই, কখনও গণতন্ত্রেরে দেই বলি। কবির ভাষায়—‘দেবতারে প্রিয় করি—প্রিয়েরে দেবতা।’
এটা সবারই জানা, জামায়াত ও আওয়ামী লীগের যৌথ আন্দোলনের ফসল এই তত্ত্বাবধায়ক ব্যবস্থা। এক সময় ক্রেডিট নেয়ার জন্য আওয়ামী লীগ একে তাদের ‘ব্রেনচাইল্ড’ বলেই দাবি করত। জাতিকে একটি অবাধ ও নিরপেক্ষ নির্বাচন উপহার দেয়ার পবিত্র নিয়তে তারা এখন তত্ত্বাবধায়ক ব্যবস্থার মূলোত্পাটন চাইছেন—এমনটি দেশের কোনো পাগল বা শিশুও বিশ্বাস করে কি? সেদিন সংসদে দাঁড়িয়ে প্রধানমন্ত্রী বলেছিলেন, ‘জনগণের ক্ষমতা জনগণের কাছেই থাকবে। সংসদে আমাদের দুই-তৃতীয়াংশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা আছে। আমরা এখন সংবিধান সংশোধনী বিল পাস করে নিলেও বিরোধী দল কোনো ন্যায্য কথা বললে, পরামর্শ দিলে পরে তা পরিবর্তন করতে পারব।’ দিলটা যখন এতই নির্মল, তখন পুরো জাতির আপত্তি ও প্রতিবাদের মুখে সর্বোচ্চ আদালতের পূর্ণাঙ্গ রায় প্রকাশের আগেই তড়িঘড়ি এই বিল পাসে তাদের বাধ্য করেছিল কে? অথচ এর মাত্র কয়েক দিন আগে ০৭-৬-১১ তারিখে তিনিই বলেছিলেন, ‘তত্ত্বাবধায়ক সরকারকে আরও উন্নত করতে চাই।’ আবার ১২-০৭-১১ তারই মন্তব্য—‘এখন আর তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রয়োজন কী?’ খালেদা জিয়ার দুই ছেলের ওপর নির্যাতনের প্রসঙ্গ টেনে প্রধানমন্ত্রী বলেছিলেন, ‘তত্ত্বাবধায়ক সরকারের এত নির্যাতন তিনি ভুলে গেলেন কীভাবে।’ ‘শিশু আর পাগল ছাড়া কেউ নিরপেক্ষ হতে পারে না’—খালেদা জিয়ার এই উক্তি বহুবার তার মুখে উচ্চারিত হতেও দেখা গেছে। অন্যদিকে আশরাফ সাহেবের মন্তব্য, ‘আদালতের রায় অসম্পূর্ণ।’ কারও কারও মতে সঙ্গতিহীন ও স্ববিরোধী। খাসা কথাটা বলেছেন সুরঞ্জিত বাবু, ‘রায়ের পর যে ব্যবস্থাটি নাই হয়ে গেছে, সেটি আমরা আর ফিরিয়ে আনতে পারব না।’ এসব উক্তি থেকে প্রতীয়মান হয় যে, এক সময় অপত্য স্নেহে লালিত ‘ব্রেন চাইল্ড’টি এখন কুলাঙ্গার হিসেবে বিবেচিত হওয়ার পেছনে তাদের মোটামুটি তিনটি গুরুতর অভিযোগ রয়েছে। তাহল—১. দেশের সর্বোচ্চ আদালত কর্তৃক তার জন্ম অবৈধ বলে স্থিরকৃত হয়েছে, ২. এক সময় খালেদা জিয়াও বলেছেন ‘শিশু আর পাগল ছাড়া কেউ নিরপেক্ষ হতে পারে না’ এবং ৩. ফখরুদ্দীনের সরকার খালেদার দুই ছেলের ওপর পাশবিক নির্যাতন করেছে। অবশ্য আরও একটা অব্যক্ত কারণ আছে, মূল কারণ হলেও তা তারা বলেন না। তা হলো ব্রেন চাইল্ডটা এমন নিমকহারাম যে, নির্বাচনে জেতার ব্যাপারে কোনো নিশ্চয়তাই দেয় না।
তত্ত্বাবধায়ক সরকারের বিপক্ষে আপাতত এসব ভোঁতা যুক্তি নিয়েই সরকার বাজিমাত্ করতে চাইছে। হ্যাঁ, খালেদা জিয়াও এক সময় বলেছিলেন, ‘শিশু আর পাগল ছাড়া কেউ নিরপেক্ষ হতে পারে না’ কিন্তু ’৯৬-তে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠার মধ্য দিয়ে প্রকারান্তরে তার বক্তব্য প্রত্যাহারই হয়েছে বলা চলে। অথচ যিনি তখন তত্ত্বাবধায়ক সরকারকে নিজের ‘ব্রেন চাইল্ড’ বলে পরিচয় দিতেন, তিনি এখন জাতির আপত্তি আর আদালতের পরামর্শ উপেক্ষা করেই তার প্রাণ সংহারে উদ্যত!
প্রধানমন্ত্রীর আন্দোলনের ফসল ফখর-মইন সরকার খালেদা জিয়ার দুই ছেলেকে মেরেছে খুব। তাই দরদি মাসির মতোই তিনি আর ‘তত্ত্বাবধায়ক সরকার চান না’—এমন হাস্যকর যুক্তিও এখন প্রধানমন্ত্রীর হাতিয়ার। ফখর-মইন সরকার যে সাংবিধানিক সরকার ছিল না, তা প্রধানমন্ত্রীর উক্তিতেই স্বীকৃত। ‘আন্দোলনের ফসল’ সেই অসাংবিধানিক সরকারের অভিষেকেও তিনি গিয়েছিলেন ঘটা করেই। আগাম প্রতিশ্রুতিও দিয়েছিলেন তাদের যাবতীয় পাপ মোচনের, যা প্রকৃত অর্থে নির্বাচনে জিতিয়ে দেয়ার লক্ষ্যে ঘুষ প্রদানেরই শামিল। নির্বাচনে অবিশ্বাস্য রকম বিজয়ও পেয়েছেন তিনি। অবশ্য প্রতিশ্রুতি ভঙ্গ করেননি তিনিও। ওদের সব পাপ মোচন করে নিরাপদে দেশত্যাগের ব্যবস্থা করে দিয়েছেন দলের নির্যাতিত নেতাদের প্রতিবাদের মুখেও। বরং প্রতিবাদী সেসব নেতাকে নির্মম কটাক্ষ করে বলা হয়েছিল, ‘কার উসিলায় শিরনি খাইলা, ফকির চিনলা না’। হুশিয়ার করে দেয়া হয়েছিল এ বিষয়ে বিএনপির ভাষায় কথা না বলার জন্য। সুতরাং তারেক বা আরাফাতের ওপর নির্যাতনের অভিযোগ উত্থাপন করে প্রধানমন্ত্রী প্রকারান্তরে নিজের বিরুদ্ধেই অভিযোগ উত্থাপন করছেন না তো?
উল্লেখ্য, প্রধান বিচারপতি এবিএম খায়রুল হকের সিদ্ধান্তক্রমে ৩ : ৩ বিভক্ত রায়ে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের পক্ষে হাইকোর্টের রায়টি বাতিল হয়। তবে ‘উপকারী’ বিবেচনায় আগামী দুই মেয়াদে তা বহাল রাখার পরামর্শ দিয়ে আদালত শ্যাম ও কুল দুটোই রক্ষা করতে চেয়েছেন বলে মনে হয়। ‘বিচার মানি, তালগাছটা আমার’ মানসিকতার পরিচয় দিয়ে আদালতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল সরকার আদালতের পরামর্শ মানতে একেবারেই নারাজ। কারণ ‘ওটা রায়ের অংশ নয়।’ তাদের এটাও দাবি যে, কয়েকটি উপনির্বাচন ও পৌর নির্বাচনে প্রমাণিত যে তাদের অধীনে নিরপেক্ষ সংসদ নির্যাচনও সম্ভব। তাই যদি হবে তবে কোন ইলেকশন ইঞ্জিনিয়ারিংয়ের অপরিহার্য প্রয়োজনে চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশন নির্বাচনের ফলাফল হঠাত্ করে ৭-৮ ঘণ্টার জন্য বন্ধ করে রাখা হয়েছিল? দেশের একজন ভোটারও কি বিশ্বাস করেন যে, ভোটের ব্যবধান এক লাখ না হয়ে দুই এক হাজার হলেও বিএনপির প্রার্থীই জয়যুক্ত হতেন? ভোলা, হবিগঞ্জ আর বি-বাড়ীয়া উপনির্বাচনে কী দেখা গেল? যেখানে ভোট ডাকাতি আর কেন্দ্র দখলের ঘটনা ঘটেনি, সেখানে পাস করেছে বিএনপি। ‘স্বাধীন ও নিরপেক্ষ’ নির্বাচন কমিশন থেকে ঘোষণা দেয়া হলো, ব্যালট কুড়িয়ে পাওয়ার অভিযোগ যে তুলবে তাকেই গ্রেফতার করা হবে। চট্টগ্রামের ফলাফলে আতঙ্কিত সরকার ঢাকাকে দু’ভাগ করেও নির্বাচন নিয়ে শঙ্কিত ও বিব্রত! এরপরও সরকারের ওপর একটা জাতীয় নির্বাচনের দায়িত্ব অর্পণ কি বানরের হাতে পিঠা ভাগের দায়িত্ব অর্পণের মতোই হাস্যকর বোধ হয় না? আবার এরই মধ্যে তারাই বার বার ঘোষণা দিচ্ছেন ’২১ অবধি ক্ষমতায় থাকার।
‘হাত-পা বাঁধা’ আদালতের এই রায় সরকারের দারুণ পছন্দ হয়েছে বলেই মনে হয়। আদালতেরই স্বীকৃতি—ব্যবস্থাটা ‘উপকারী’। সুতরাং এটা রহিতকরণ জাতীয় ক্ষতি। কাজেই উপকারী একটা ব্যবস্থাকে সাংবিধানিকভাবে আরও সুসংহতকরণে প্রয়োজনীয় পরামর্শ ও দিকনির্দেশনা দিয়ে ‘উপকারী’ বিষয়টিকে তিরোহিত করার ব্যবস্থা করে জাতিকে বিভ্রান্তি ও সংঘাতের মুখোমুখি দাঁড় করিয়ে দেয়া হলো কার স্বার্থে, এই জিজ্ঞাসার জবাব হয়তো এখনও কালের গর্ভে। এটা কি পদার্থবিজ্ঞান বা অংক শাস্ত্রের মতো কোনো বিষয় যে আদালত হিসেব করে নিশ্চিত হয়েছেন, দুই মেয়াদের পর তত্ত্বাবধায়ক ব্যবস্থার আর কোনো প্রয়োজন থাকবে না?
আমাদের সংবিধানকে সাংবিধানিকভাবে জনগণের অভিপ্রায়ের অভিব্যক্তিরূপেই মূল্যায়ন করা হয়েছে। শতভাগ মানুষের অভিপ্রায়েরর অভিব্যক্তিস্বরূপ যে বিষয়টি সংবিধানে সংযুক্ত হয়েছে এবং উপকারী বলেও আদালত কর্তৃক স্বীকৃত হয়েছে, তাতে শব্দচয়ন বা বাক্য গঠনজনিত দুর্বলতা থাকলে তা নিরসনে পরামর্শ ও দিকনির্দেশনা দেয়া যেতে পারে; কিন্তু গণ‘অভিব্যক্তি’ অসাংবিধানিক বা বেআইনি বিবেচিত হতে পারে কীভাবে? ’৯০ বা ’৯৬-এর মতোই সরকার তথা আওয়ামী লীগ ছাড়া পুরো জাতি আজ তত্ত্বাবধায়ক সরকারের পক্ষে। গণঅভিপ্রায়ের প্রতি শ্রদ্ধা দেখিয়ে সরকার যদি ‘তত্ত্বাবধায়ক সরকার’ পুনঃপ্রতিষ্ঠায় সংসদে নতুন করে বিল উত্থাপন ও পাস করে যথাযথভাবে, তাহলে তাও কি অসাংবিধানিক ও বেআইনি হবে? অবশ্যই নয়। তাহলে একই কাজ ’৯৬-এর সংসদ করল বলে অবৈধ হবে কেন?
বিচারপতি খায়রুল হকের খ্যাতি শুধু হাত-পা বাঁধা অবস্থায় বিচার কার্য সম্পাদনের জন্যই নয়, কান পাতলেই শোনা যায় নানা কথা। ত্রাণ তহবিলের টাকায় ছেলের বিয়ে, নিষিদ্ধ বাঘের চামড়া, সোনার হরিণ, সোনার নৌকাও নাকি উপহার জুটত তার। সম্পাদক মাহমুদুর রহমানের আদালত অবমাননা মামলার শুনানিতে তিনি একটি মূল্যবান কথা বলেছিলেন—‘জনগণের আস্থাই হচ্ছে বিচার বিভাগের শক্তি। বিচার বিভাগের ওপর জনগণের আস্থা নষ্ট হয়ে গেলে পৃথিবীর সব অর্জনই শেষ হয়ে যাবে।’ আমরা মনে করি, গণঅভিপ্রায়ের যথার্থ মূল্যায়ন এবং ইনসাফের প্রতি আপসহীনতা এই আস্থা অর্জন ও রক্ষার প্রধান নিয়ামক। বস্তুত সুস্থ মন ও মানসসম্পন্ন প্রতিটি মানুষই এক-একটি আদালত। আর প্রতিটি রায় জনতার আদালতে উপস্থাপিত হয়ে যায় আপনা থেকেই, শুধু দেশে নয়—দেশের বাইরেও। ‘বাংলাদেশের আদালত সরকারের মুখের দিকে তাকিয়ে রায় প্রদান করে’—এমন মন্তব্য এখন উচ্চারিত হয় বিদেশি মিডিয়ায়ও। আসলে কি তাই? তা হলে জাতি হিসেবে আর আমাদের থাকল কী?
তারপরও কথা থাকে। তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থাটা কত কাল দরকার? উত্তর অতি সহজ। যতদিন না আমাদের পারস্পরিক আস্থা ও মর্যাদাজ্ঞান এই পর্যায়ে না আসবে যে, বিরোধী দল বলবে ‘ঝামেলা করে লাভ কী, তত্ত্বাবধায়ক সরকার আর নেই দরকার’; আর ক্ষমতাসীন সরকারের মুখে শুনতে পাব বিপরীত উচ্চারণ ‘এই আমানত আমরা নিতে চাই না, স্বচ্ছতা ও নিরপেক্ষতার স্বার্থে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনেই নির্বাচন হোক।’ সেই সোনার মানুষ এই মাটিতে জন্মাবে কবে, আল্লাহই ভালো জানেন। তবে সে পর্যন্ত ধৈর্য ধরে তত্ত্বাবধায়ক ব্যবস্থাটাকেই টিকিয়ে রাখতে হবে। আর এক্ষেত্রে জিম্মাদারিটা সরকারেরই।

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন