মঙ্গলবার, ১২ জুন, ২০১২

‘আন্দোলনে মুখর সারা দেশ হরতাল, রোডমার্চ, মহাসমাবেশ’



মনিরুজ্জামান মনির
আমাদের দেশে বর্তমান রাজনৈতিক পরিস্থিতি সঙ্কটাপন্ন, সাংঘর্ষিক। তবে এই সঙ্কট এবং সংঘর্ষের নেপথ্য নায়ক হলো বর্তমান সরকার এবং সরকারি দল আওয়ামী লীগ। আমরা সাধারণত জানি ক্ষমতার আসনে বসা সরকার ও সরকারি দলের কর্মকাণ্ডের সত্য-মিথ্যা সমালোচনা বিরোধী দলই করে থাকে। কিন্তু এবার হয়েছে উল্টো। নির্বাচনী ইশতেহারে বর্ণিত অঙ্গীকারসমূহ একে একে বাস্তবায়নে মনোযোগ না দিয়ে, জনগণের ম্যান্ডেটের প্রতি শ্রদ্ধা না দেখিয়ে বিরোধী দল বিএনপির অতীতে দেশ পরিচালনার ব্যর্থতার তীব্র সমালোচনা শুরু করল বর্তমান সরকার। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী, মন্ত্রিবর্গ এবং দলীয় নেতৃবৃন্দ প্রায় প্রতিদিন দেশে-বিদেশে বক্তৃতা-বিবৃতিতে অশ্রাব্য ভাষায় (গণতন্ত্রের ভাষায় নয়) বিশেষত বেগম খালেদা জিয়া এবং তার পরিবারের সদস্যদের ‘দুর্নীতিবাজ’ ‘লুটেরা’ ‘দেশের অর্থ বিদেশে পাচারকারী’ বলে অভিযুক্ত করলেন। বিগত ০১/১১ সেনা সমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অবৈধ শাসনকালে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী এবং বিরোধীদলীয় নেত্রী দু’জনকেই কল্পিত দুর্নীতিতে অভিযুক্ত করে বিশেষ কারাগারে হাজতবাসে রাখা হয়। বেগম জিয়ার দুই সন্তান তারেক রহমান ও কোকো রহমানকে বিনা ওয়ারেন্টে অ্যারেস্ট করে পৈশাচিক নির্যাতন করা হয়। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী তার নির্বাহী ক্ষমতা বলে বিগত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের শাসনকালে তার নিজের এবং দলের নেতৃবৃন্দের বিরুদ্ধে করা মামলাগুলো তুলে নিলেন। কিন্তু বেগম জিয়া এবং তার পরিবার ও দলীয় নেতৃবৃন্দের বিরুদ্ধে করা একটি মামলাও তুলে নিলেন না। বরং নতুন নতুন কল্পিত অভিযোগ সংযোজন করে তাদের বিরুদ্ধে মামলা দেয়া হলো। এখানে একটি কথা সরল অংকের সহজ ফলাফলের মতো বলা যায়, বিগত তত্ত্বাবধায়ক সরকার অবৈধ-অগণতান্ত্রিক হলে এবং তাদের বিরুদ্ধে করা মামলাগুলো অসাড়, অবৈধ বলে বিবেচ্য হবে আর বেগম জিয়ার পরিবারসহ অন্যান্য নেতৃবৃন্দের বিরুদ্ধে করা মামলাগুলো অবৈধ বলে বিবেচিত হবে না, তা কি মেনে নেয়া যায়? আসলে বেগম জিয়া এবং বিএনপিকে বাধ্য করা হচ্ছে এই সরকারের বিরুদ্ধে তীব্র আন্দোলনে সোচ্চার হতে। স্বাধীনতার ৪০ বছর পর বর্তমান সরকার বিএনপির প্রতিষ্ঠাতা এ দেশের সবচেয়ে জনপ্রিয় সাবেক রাষ্ট্রপতি শহীদ জিয়াউর রহমানকে নতুন করে অবমূল্যায়ন শুরু করল। এমনকি সংবিধান সংশোধন করে ‘স্বাধীনতার ঘোষক জিয়া’ এই অংশটুকু বাতিল করা হলো। রাজনৈতিক প্রতিহিংসায় ইতিহাস কি পাল্টানো যায়? ইতিহাস কি মহামান্য আদালতের রায় নিয়ে লেখা হয়, না অধিকাংশ জনগোষ্ঠীর সাক্ষ্য গ্রহণ থেকে ইতিহাসের উপাদান গ্রহণ করা হয়? জনগণের ম্যান্ডেট নিয়ে ক্ষমতায় বসে দেশের জনগণকে সুখ-স্বাচ্ছন্দ্য দেয়ার পরিবর্তে দেয়া হলো কষ্ট, দুর্ভোগ। সাধারণ মানুষের নিরাপত্তাহীন জীবন-যাপন দুর্বিষহ যন্ত্রণার শামিল হয়ে উঠল। নির্বাচনী ইশতেহারে বর্ণিত একটি ওয়াদাও তারা রাখতে পারল না। ক্ষমতা গ্রহণের পরপরই বাজারে লাগল আগুন। দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি আর নিম্নে ধাবিত হলো না। মধ্যবিত্ত মানুষের সংসার হলো অচল। শেয়ারবাজারে লাখ লাখ মানুষ হলো সর্বহারা। আওয়ামী লীগ, ছাত্র লীগের টেন্ডারবাজিতে সরকারি উন্নয়ন ও ব্যবসায় এলো স্থবিরতা। সন্ত্রাস-চাঁদাবাজিতে শান্তিপ্রিয় মানুষ হলো দিশেহারা। গ্যাস, পানি, বিদ্যুিবহীন মানুষের কষ্ট পৌঁছল সর্বোচ্চ সীমায়। সরকার মানুষের ঘরে-বাইরে জনপদে কোনো স্থানে জীবনের নিরাপত্তা দিতে পারল না। আসলে এখানে চলছে অস্বাভাবিক মৃত্যুর হিড়িক। ছোটরা মরছে, বড়রা মরছে, সাংবাদিক মরছে, শিল্পকর্মী মরছে, বুদ্ধিজীবী মরছে, ছাত্র মরছে, ব্যবসায়ী মরছে, গৃহিণী মরছে, সাধারণ মানুষ মরছে। প্রতিবেশী দেশ ভারত, সীমান্তে নিরীহ মানুষদের প্রতিদিন মারছে। তিস্তা নদীর পানি হিস্যা দিচ্ছে না। সিলেটের সুরমা, কুশিয়ারা, সারি নদীর উজানে টিপাইমুখ বাঁধ দিয়ে আমাদের উর্বরা জমিকে মরুভূমিতে রূপান্তর করার কর্মসূচি বাস্তবায়নের কাজ শুরু করল। তা সত্ত্বেও আওয়ামী লীগ সরকার আমাদের বুকের জমিনের উপর দিয়ে ভারতীয় ভারি যানবাহন অবাধে চলাচলের জন্য করিডোরের নামে দিয়েছে ট্রানজিট। বিরোধী দলীয় নেত্রী এসবের প্রতিবাদ করলেন। নির্যাতিত-নিপীড়িত মানুষের পাশে দাঁড়ালেন। জনগণকে সঙ্গে নিয়ে আন্দোলনের ডাক দিলেন। জনগণের দুর্ভোগ ও দেশের অর্থনীতির কথা চিন্তা করে খুব সংক্ষিপ্ত হরতাল দিলেন। এখানে উল্লেখ প্রয়োজন বিরোধী দলীয় নেত্রী এ পর্যন্ত হরতাল দিয়েছেন ১৩ দিন আর বিরোধী দলে থাকাকালীন আওয়ামী লীগ প্রধান হরতাল দিয়েছেন ১৭০ দিন। আওয়ামী লীগ সরকার তাদের গোধূলিলগ্নে গণবিস্ফোরণ থেকে বুঝতে পারল, আগামী নির্বাচনে সোনার তরীর নিশ্চিত ভরাডুবি। তাই সংবিধান থেকে নির্বাচনী প্রক্রিয়া নিরপেক্ষ সরকারের অধীনে হওয়ার বিধানটুকু বাতিল করে দিল। বিএনপি প্রতিবাদ জানাল। বিএনপি চায় নির্দলীয় নিরপেক্ষ সরকারের অধীনে আগামী নির্বাচন। এই আন্দোলনের লক্ষ্যে তাই বেগম জিয়া করলেন ‘রোড মার্চ’—বিভাগীয় শহর সিলেট, রাজশাহী, খুলনা, চট্টগ্রামে। তার দলীয় নেতৃবৃন্দ-সমর্থকদের নিয়ে গাড়ি মিছিল করে সেসব এলাকার মানুষদের করলেন সংগঠিত। এতে তৃণমূল পর্যায়ে বিএনপি নেতা-সমর্থক হলো উজ্জীবিত; আর এ সরকারের প্রতি প্রতিবাদে মুখর। সরকার নির্যাতন-নিপীড়ন করে বিরোধী দলের আন্দোলন দমন করতে চাইল। অবিশ্বাস্য মামলা দিয়ে আঠার দলীয় জোটের শীর্ষ নেতাদের করল কারাগারে নিক্ষেপ। বিএনপির সাংগঠনিক সম্পাদক এম. ইলিয়াস আলীকে গুম সরকার করেছে, এই অভিযোগ আনলো বিএনপি। তবুও আন্দোলন দমল না। বরং আরও চাঙ্গা হলো। বিএনপি নেত্রী বেগম জিয়া ঢাকাতে মহাসমাবেশ করেছেন দু’বার, সরকারের সব ধরনের বাধা তুচ্ছ করে রাজধানীতে জেগেছিল গণজোয়ার। এখানে সারা বাংলাদেশের মানুষ এসে এই সরকারের প্রতি অনাস্থা এবং সমর্থন প্রত্যাহার করার কথা জানিয়ে গেল। সাধারণ মানুষদের প্রত্যাশা—সরকার বিরোধী দলের গণতান্ত্রিক দাবি ‘নির্দলীয় নিরপেক্ষ সরকারের অধীনে আগামী নির্বাচন অনুষ্ঠান’ মেনে নেবে এবং গুম হওয়া এম. ইলিয়াস আলীকে জীবন্ত ফিরিয়ে দেবে। দেশ ও জাতিকে অনিবার্য সঙ্কট এবং সংঘর্ষ থেকে পরিত্রাণ দেবে।
monirlyric@gmail.com

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন