শুক্রবার, ৮ জুন, ২০১২

গণতন্ত্রের জন্য অশনি সংকেত



মো.সেলিম আহমেদ ডালিম :
 আমাদের দেশের সংসদ এখন কোথায় গিয়ে ঠেকেছে তা ভাবলে অবাক হতে হয়। সংসদ সদস্যরা এর আগে সংসদে অশালীন ভাষা প্রয়োগ করে তুমুল বিতর্কের জন্ম দিয়েছিলেন। এখন দেশের একজন গুণীজন অধ্যাপক আব্দুল্লাহ আবু সায়ীদকে ঘিরে তুমুল বিতর্ক শুরু করলেন। তারপর শুরু হলো বিচারবিভাগ নিয়ে। যে জায়গাগুলো দেশের মানুষের কাছে উচ্চাসনে রয়েছে সেখানে এরকম কালিমা জনগণ কখনো মেনে নিতে পারবে না। বিচারবিভাগ সাংবিধানিকভাবেই স্বাধীন। এমনিতেই দেশের মানুষ অপরাজনীতির কারণে হিমশিম খাচ্ছে। এখন যদি দেশের গুরুত্বপূর্ণ সংসদ এবং বিচারবিভাগ মুখোমুখি অবস্থান নেয় তাহলে তার পরিণাম দাঁড়াবে ভয়াবহ। আমরা দেশের মানুষ এ অপছায়া থেকে দূরে থাকতে চাই। দেশের মানুষ শান্তিপ্রিয়। তাদের শান্তি নষ্ট করার অধিকার কোন সংসদ সদস্য এবং বিচারবিভাগের নেই।
রাষ্ট্রের প্রধান দু'টি স্তম্ভে প্রকাশ্যে সংঘর্ষের রূপ নেয়াকে দেশ ও গণতন্ত্রের জন্য অশনি সংকেত। অনেকেই এ ঘটনায় ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করেছেন। গণতন্ত্র দেশে আছে কি না তা নিয়েও এখন ভাবতে হবে। দু'টি স্তম্ভের মধ্যে ভাষা চ্যুতির যে স্খলন ঘটেছে তা হওয়ার কথা ছিল না। সাংবিধানিকভাবেই এ ধরনের অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনার দ্রুত সমাধান করা যেখানে সম্ভব কিন্তু জাতি আজ কি দেখল? সংবিধানকে সমুন্নত রাখার মাধ্যমে আইনের শাসন প্রতিষ্ঠিত হয়। এক্ষেত্রে সংসদ হলো সংবিধানের একটি মূল স্তম্ভ। সেখানে ১৬ কোটি মানুষের রক্ষাকবজ রয়েছে এবং সেটাই হওয়ার কথা ছিল মূলমন্ত্র। যে কোন সমস্যা সমাধান হওয়া উচিত সাংবিধানিকভাবেই। সবার সেই বক্তব্যই দেয়া উচিত, যা দু'টি প্রতিষ্ঠানকে শক্তিশালী করবে। নির্বাহী বিভাগ, আদালত এবং পার্লামেন্ট তিনের সমন্বয় হলো সংবিধান। এখন এর দু'টি অঙ্গে যদি এভাবে অহেতুক ঝগড়া লেগে যায়, তাহলে এটা হবে খুবই দুঃখজনক। দেশের মানুষ এ বিষয়গুলো একটি অশনি সংকেত হিসেবে দেখছে। আমাদের দেখতে হবে গণতন্ত্র সত্যিকার অর্থে থাকছে কিনা। গণতন্ত্র মানে শুধু নির্বাচন নয়। গণতন্ত্র মানে হচ্ছে সংবিধানের শাসন। তার মানে হচ্ছে দু'টি অঙ্গই যেন কাজ করে ঠিকমতো। এখানে অহেতুক সংঘর্ষ থাকা রাষ্ট্রের মূল ভীতেই আঘাত করার শামিল। রাষ্ট্রের দু'টি স্তম্ভ ঝগড়া করলে  সাধারণ মানুষের যাওয়ার  কোর জায়গা থাকে না।
বিচারবিভাগ এবং আমাদের সংসদ- প্রজাতন্ত্রের দু'টি বিভাগ। এ দু'টি সার্বভৌম এবং প্রজাতন্ত্রের স্তম্ভ। এ দু'টি সাংঘর্ষিক হোক এটা জনগণের প্রত্যাশা নয়। সংসদ ও বিচার বিভাগের সাম্প্রতিক দ্বনদ্ব প্রত্যাশিত নয় । এমন কিছু বাদানুবাদ উভয় জায়গাতেই ঘটেছে। জনগণও এটাকে প্রত্যাখ্যান করেছে বলে আমরা দেখেছি। এক্ষেত্রে একজন আরেকজনকে আলটিমেটাম দেয়ার সুযোগ নেই। যে জায়গায় যার অবস্থান তাকে সে জায়গায় সমুন্নত থাকতে হবে। সুপ্রিমকোর্টকে বিতর্কের ঊর্ধ্বে রাখতে হবে। আবার সংসদ যাতে নতুন প্রজন্মের জন্য অনুকরণীয় দৃষ্টান্ত স্থাপন করে সে দিকেও লক্ষ্য রাখতে হবে।
এখানকার বিষয়টি একজন বিচারপতির সঙ্গে সম্পৃক্ত। একজন বিচারপতির কর্মকান্ডকে ঢালাওভাবে বিচার বিভাগের কর্মকান্ড হিসেবে গণ্য করা ঠিক নয়। সে জন্য সব কোর্টকে এ ব্যাপারে দায়ী করা যায় না। দ্বিতীয়ত, সংসদ যেহেতু সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিল চেয়েছে, এখন তারা ইচ্ছা করলে সুনির্দিষ্ট অভিযোগসহ প্রধান বিচারপতিকে লিখতে পারেন। এ ধরনের দরখাস্ত করলে প্রধান বিচারপতি পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে প্রয়োজন মনে করলে এটাকে সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিলে প্রেরণ করতে পারেন। এটাই হলো আমাদের সংবিধানের বিধান। যে কোন নাগরিকই যদি কারও আচরণে ক্ষুব্ধ হন, তাহলে তিনি যথাযথ কর্তৃপক্ষের কাছে অভিযোগ করতে পারেন। এ বিষয়ে সংসদ প্রধান বিচারপতির দৃষ্টি আকর্ষণ করেছে। তাই এটা নিয়ে মন্তব্য করা কারো এখতিয়ারে নেই। তবে আমাদের বিচারপতিদের বক্তব্য-আচরণ হতে হবে বিচারিক, ভাষা হতে হবে সাংবিধানিক। যারা বিচার করেন তাদের অবশ্যই বিচারিক মনোভাব নিয়ে বক্তব্য দিতে হবে। আদালত ও সংসদে এমন ভাষা প্রয়োগ করতে হবে যাতে সাধারণ মানুষ অন্য কোন মনোভাব পোষণ না করেন।
সংবিধান মোতাবেক বিচারপতিরা বিচারকার্য পরিচালনা করেন। সংবিধান মোতাবেক কেউ দায়িত্ব পালন না করলে সংবিধানেই বলা আছে তাকে কিভাবে বিচারিক কাজ থেকে বিরত রাখা যায়। সড়ক ও জনপথ বিভাগের জমি ছেড়ে দেয়ার বিষয়ে উচ্চ আদালতের রায় এবং পরবর্তী সময়ে সংসদের স্পিকার এডভোকেট আবদুল হামিদের বক্তব্যকে কেন্দ্র করে রাষ্ট্রের অন্যতম দু'টি স্তম্ভ সংসদ ও বিচারবিভাগ এখন মুখোমুখি অবস্থানে।  উচ্চ আদালতের রায়ের বিষয়টি সংসদে উত্থাপিত হলে ২৯ মে স্পিকার বলেছিলেন, দেশের মানুষের বিচার পেতে বছরের পর বছর লেগে যাবে আর নিজেদের বিষয় হলে বিচার বিভাগ ঝটপট সিদ্ধান্ত দিয়ে দেবেন- এটি ভালো দেখায় না। আদালতের রায়ে ক্ষুব্ধ হলে জনগণ বিচার বিভাগের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াতে পারে। স্পিকারের এ বক্তব্যের পর উচ্চ আদালত বলেছেন, প্রতিষ্ঠান হিসেবে তারা সাংবিধানিক, অন্য কারও দ্বারা তারা নিয়ন্ত্রিত নন। উচ্চ আদালত আরও বলেছেন, স্পিকার উচ্চ আদালতের কার্যক্রমে হস্তক্ষেপ করছেন এবং তার বক্তব্য রাষ্ট্রদ্রোহমূলক। আদালত স্পিকারকে অজ্ঞ বলেও অভিহিত করেছেন। এমনও বলেছেন, স্পিকারের ওই পদে থাকা উচিত নয়। আদালতের এ মন্তব্যের পর ক্ষোভে ফেটে পড়েছেন সংসদ সদস্যরা। তারা সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিল গঠন করে তিনদিনের মধ্যে মন্তব্যকারী বিচারপতি এএইচএম শামসুদ্দিন চৌধুরী মানিকের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়ার দাবি জানিয়েছেন।
বিচারবিভাগ ও জাতীয় সংসদের মধ্যে যে সম্পর্ক বিরাজ করছে এখন তা অনভিপ্রেত।  উচ্চ আদালত ও জাতীয় সংসদ উভয়েই এই রাষ্ট্রের দু'টি অনিবার্য এবং সম্মানজনক প্রতিষ্ঠান। একটা বিতর্ক প্রায় উঠে থাকে, দেশের সার্বভৌম প্রতিষ্ঠান কোনটি। কে কার অধীনে এমন অনাকাঙ্ক্ষিত বিতর্কও হয়ে থাকে। প্রকৃতপক্ষে জনগণই একমাত্র সার্বভৌম ক্ষমতার অধিকারী। রাষ্ট্র পরিচালনার ক্ষেত্রে জনগণের ইচ্ছা-অনিচ্ছাই শেষ কথা। জাতীয় সংসদ একটি নির্দিষ্ট সময়ের জন্য জনগণের ইচ্ছা-অনিচ্ছাকে ধারণ করে বলে সংসদকে সার্বভৌম সংস্থা বলা হয়ে থাকে। জাতীয় সংসদ ও উচ্চ আদালত এ দু'য়ের মধ্যে সম্পর্কটা কেমন হওয়া উচিত সে বিষয়টারও মীমাংসা হওয়া উচিত। আসলে জাতীয় সংসদ এমন কোন আইন প্রণয়ন করতে পারে না, যা সংবিধানের মূল চেতনার সঙ্গে সাংঘর্ষিক। সেক্ষেত্রে উচ্চ আদালত সংবিধানের সঙ্গে সাংঘর্ষিক আইনকে বাতিল করতে পারে। আবার উচ্চ আদালত তার কার্যক্রম পরিচালনা করে থাকে সংসদ কর্তৃক প্রণীত আইনসমূহের আলোকেই। এক কথায় প্রতিটি প্রতিষ্ঠানই কিছু বিধিবিধান দ্বারা আবদ্ধ। ইচ্ছা করলেই কোন প্রতিষ্ঠান যা খুশি তা করতে পারে না। সুতরাং কে কার কাছ থেকে দায়মুক্ত এমন বিতর্ক নিরর্থক। বর্তমানে জাতীয় সংসদের সদস্যরা ও উচ্চ আদালত যে অনাকাঙ্ক্ষিত সম্পর্কে জড়িয়ে পড়েছেন, সেখানে জনগণের কোন ভূমিকা নেই। অথচ তারাই রাষ্ট্রের একমাত্র সার্বভৌম শক্তি। যে কোন প্রতিষ্ঠান-সাংবিধানিক অথবা অসাংবিধানিক-যার যার সম্মান ও মর্যাদা রক্ষার দায়িত্ব সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানেরই। সেদিক থেকে স্পিকার ও উচ্চ আদালতের বক্তব্য কতটা আইনসম্মত হয়েছে তা চিন্তা করলে উভয়পক্ষের বক্তব্যই শোভনীয় হয়নি। বর্তমান অবস্থায় সার্বভৌম ক্ষমতার অধিকারী জনগণ মর্মাহত হয়েছে। আমরা উভয়পক্ষকে সংযত আচরণ করার অনুরোধ জানাই। সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিল গঠন করে বিচারপতি এএইচএম শামসুদ্দিনের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা না নেয়া হলে জাতীয় সংসদ তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণ করবে আর এজন্য প্রয়োজনে বাহাত্তরের মূল সংবিধানে থাকা বিচারপতিদের অভিশংসন (ইমপিচমেন্ট) করার ক্ষমতাসংক্রান্ত ৯৬ অনুচ্ছেদ পুনর্বহাল করা হবে। এ কাজটি করতে সময় লাগবে মাত্র পাঁচ মিনিট। সংসদে বর্তমান সরকারের নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা থাকায় তারা বাহাত্তরের সংবিধানের ৯৬ অনুচ্ছেদ পুনর্বহাল করতে পারবেন বৈকি এবং তা করে আলোচ্য বিচারপতিকে অভিশংসিত করতে পারবেন। আইনের চেয়ে অনেক সময় রাজনৈতিক সংস্কৃতিই বড়, বেশি গুরুত্বপূর্ণ। বর্তমানে বিচার বিভাগ ও জাতীয় সংসদের মধ্যে যে অনাস্থা ও বৈরিতার সম্পর্ক তৈরি হয়েছে তা অতিদ্রুত সমাধান হবে দেশের মানুষ সেটাই প্রত্যাশা করেন।
লেখক: সাংবাদিক ও কলামিস্ট

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন