ধূমকেতু :
লন্ডনভিত্তিক দ্য ইকোনমিস্ট সাময়িকীতে অনলাইনে গত ২৫ মে বাংলাদেশ সম্পর্কে দু'টি প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়েছে। মার্কিন পররাষ্ট্র দফতরের মানবাধিকার প্রতিবেদন এবং অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনালের প্রতিবেদনে বাংলাদেশ সম্পর্কে বক্তব্য প্রকাশের পর এই দু'টি প্রতিবেদন বহির্বিশ্বে বিশেষ গুরুত্বের সঙ্গে লক্ষ্য করা হবে। প্রভাবশালী আন্তর্জাতিক সাময়িকী হওয়ায় দ্য ইকোনমিস্টের এই প্রতিবেদন দু'টি বাংলাদেশের সাম্প্রতিক রাজনৈতিক পরিস্থিতির আন্তর্জাতিক পর্যবেক্ষণ হিসেবে গণ্য হবে। ‘দ্য প্রাইম মিনিস্টার সেটস দ্য কান্ট্রি অন এ ডেঞ্জারাস পাথ' এবং ‘বাংলাদেশ টক্সিক পলিটিক্স : হ্যালো দিল্লী, ইট ইজ আপ টু ইন্ডিয়া টু ট্রাই টু স্টপ শেখ হাসিনা রুইনিং বাংলাদেশ'- এই শিরোনামের প্রতিবেদন দু'টিতে বাংলাদেশের উত্তপ্ত রাজনৈতিক পরিস্থিতি, সরকারের কঠোর ও অনমনীয় অবস্থান, যুদ্ধাপরাধের বিচার, গুম, রাজনৈতিক হয়রানি এবং সাধারণ মানুষের দুর্ভোগের কথা তুলে ধরে বলা হয়েছে, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বাংলাদেশকে বিপজ্জনক পথে নিয়ে যাচ্ছেন। একই সঙ্গে উদ্ভূত পরিস্থিতি থেকে বাংলাদেশকে রক্ষার জন্য ভারতকে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখার আহবান জানানো হয়েছে। আরও বলা হয়েছে, বিরোধী দলের নেতাদের জেলে পাঠানো হয়েছে, রাজনৈতিক সংঘাতের কারণে গুম আর খুন বেড়েছে। আগামী নির্বাচন কার অধীনে হবে এবং স্বচ্ছ হবে কিনা তা নিয়ে বিবাদ দেখা দিয়েছে। এ অবস্থায় অনেক পর্যবেক্ষক সন্ধিহান হয়ে পড়েছেন, দেশটিতে নির্বাচন হবে কিনা। খাদ্য ও জ্বালানি মূল্য বৃদ্ধি, ব্যাপক লোডশেডিং, নতুন রাস্তা নির্মাণের প্রতিশ্রুতি পূরণ না হওয়ায় রাজপথে বিক্ষোভ হচ্ছে।
ইকোনমিস্টের প্রতিবেদন দু'টিতে যা রয়েছে, তা বাংলাদেশের ভাব-মর্যাদার জন্য ক্ষতিকর, এতে সন্দেহ নেই। মার্কিন পররাষ্ট্র দফতরের ২০১১ সালের বিশ্ব মানবাধিকার রিপোর্ট এবং অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনালের ২০১২ সালের রিপোর্ট বাংলাদেশের অবনতিশীল পরিস্থিতির চিত্র তুলে ধরেছে। রাজনৈতিক, সামাজিক ও অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে মানবাধিকার লংঘন ও আইনের শাসন নষ্ট হওয়া, সংবাদপত্র ও মত প্রকাশের স্বাধীনতা সীমিত হওয়া, ব্যাপক মাত্রায় দুর্নীতি ইত্যাদির কথা তুলে ধরা হয়েছে। অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনালের রিপোর্টে বারবার প্রতিশ্রুতি দেয়া সত্ত্বেও বিচার বহির্ভূত হত্যাকান্ড বন্ধে ব্যর্থতার কথা বলা হয়েছে। অর্থাৎ রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতা ও সংকট, আইন-শৃক্মখলা পরিস্থিতির অবনতি, সুবিচার প্রাপ্তির সংকুচিত সুযোগ অর্থাৎ সার্বিক অবনতিশীল পরিস্থিতির কথা উঠে এসেছে। এই তিনটি রিপোর্ট বাংলাদেশের যে নেতিবাচক ভাব-মর্যাদার ইঙ্গিত দিচ্ছে, তা বিশেষভাবে প্রণিধানের বিষয়। আজকের যুগে আন্তর্জাতিক অঙ্গনে কোনো দেশের ভাব-মর্যাদার বিষয়টি এড়িয়ে যাওয়ার মত নয়। শুধু রাজনৈতিক প্রেক্ষিতে নয়, অর্থনৈতিক প্রেক্ষিতেও এক্ষেত্রে বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ। দাতা দেশ ও সংস্থাগুলোর উদ্বেগের কথাও ওই রিপোর্টে উল্লেখিত হয়েছে। একথা বলার কোনো উপায় এখনকার বিশ্বে নেই বলেই আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে কোনো দেশের ভাব-মর্যাদা একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। ইকোনমিস্টের রিপোর্টে যে ধারণা ফুটে উঠেছে, তা বাংলাদেশ সম্পর্কে নেতিবাচক চিত্রই তুলে ধরেছে।
প্রতিবেদনে বলা হয়, নির্বাচনের ১৮ মাস বাকি থাকতেই রাজপথে বিক্ষোভ দেখা যাচ্ছে। বিরোধী নেতাদের কারাগারে পাঠানো হচ্ছে, তাদের গুম ও খুনের জন্য ক্ষমতার পুরনো প্রতিদ্বনিদ্বতাকে ব্যাপকভাবে দায়ী করা হচ্ছে। পরবর্তী নির্বাচন কার তত্ত্বাবধানে হবে এবং তা আসলেই নিরপেক্ষ হবে কি না, তা নিয়ে পরস্পর বিরোধী অবস্থান দেখা যাচ্ছে। এটা ইতোমধ্যে এত তীব্র হয়ে উঠেছে যে, অনেক পর্যবেক্ষক প্রতিদ্বনিদ্বতামূলক কোনো নির্বাচন আদৌ হবে কি না, তা নিয়ে সংশয় প্রকাশ করেছেন। বাংলাদেশীরা ইতোমধ্যে খাদ্য ও জ্বালানির মূল্য, মারাত্মক লোডশেডিং এবং নতুন নতুন সড়ক নির্মাণের প্রতিশ্রুতি ভঙ্গে ক্ষুব্ধ হয়ে উঠেছেন।
প্রতিবেদনে বলা হয়, মাসখানেক আগে এক তরুণ রাজনীতিবিদকে অপহরণ করা হয়, খুব সম্ভবত তাকে খুন করা হয়েছে। এর আগে অন্য দু'জনকে হত্যা করা হয়। গত মাসে কয়েকজন সংসদ সদস্যসহ ৩৩ জন বিরোধী নেতাকে কারাগারে ঢোকানো হয়। খালেদা জিয়ার দাবি, বিএনপির তিন হাজার নেতাকে গ্রেফতার করা হয়েছে। আতঙ্ক সৃষ্টির জন্য এটা করা হয়েছে। সম্প্রতি বাংলাদেশে বেশ কয়েকটি রহস্যজনক হত্যাকান্ড ঘটেছে। এক সৌদি কূটনীতিক গুলীতে নিহত হয়েছেন, এক ট্রেড ইউনিয়ন কর্মী নির্যাতিত ও খুন হয়েছেন, দুর্নীতির অনুসন্ধান করার পর এক সাংবাদিক দম্পতিকে হত্যা করা হয়েছে। সেনাবাহিনীর ওপর সরকারের নিয়ন্ত্রণ কঠোর করতে জানুয়ারিতে ক্যুর গুজব ছড়ানো হয়। বাংলাদেশের অন্যতম সুপরিচিত ব্যক্তিত্ব, গ্রামীণ ব্যাংকের ড. মুহাম্মদ ইউনূসকে হেনস্তা করা হয়েছে। মতিভ্রমের শিকার শেখ হাসিনা তাকে রাজনৈতিক হুমকি মনে করেন। মন্ত্রীরা তার সমালোচনা করছেন আর সরকার তার ব্যাংকের কার্যক্রম পর্যালোচনার জন্য আরেক দফা কমিশন গঠন করেছে। আর কমিশন গঠন নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন ড. ইউনূস। বস্তুত সরকার গ্রামীণ ব্যাংককে কব্জা করতে চাচ্ছে।
প্রতিবেদনে বলা হয়, বাংলাদেশের বিচার বিভাগকে অতিমাত্রায় রাজনীতিকরণ করা হয়েছে। ফলে বিরোধীদের ন্যায়বিচার পাওয়ার পথ সংকুচিত হয়েছে। মতপ্রকাশের স্বাধীনতাকে সীমিত করা হয়েছে। সাংবাদিকরা বাধ্য হচ্ছেন সেলফ-সেন্সরশিপের। তারা সরকারি বাহিনীর নির্যাতনের শিকার হচ্ছেন। গুম, নিরাপত্তা হেফাযতে মৃত্যু, খেয়াল-খুশি মতো গ্রেফতার ও আটক রাখার অবাধ স্বাধীনতা ভোগ করছে সরকারি নিরাপত্তা বাহিনী।
২০০৪ সালে র্যাব গঠনের পর এ পর্যন্ত তারা ৭০০ জনকে হত্যা করেছে। এ প্রসঙ্গে তারা কলেজ ছাত্র লিমন এবং দৈনিক আমার দেশ সম্পাদক মাহমুদুর রহমানের ওপর র্যাব-এর নির্মম নির্যাতনের বর্ণনা দিয়েছে। তারা ব্যাপক মাত্রায় দুর্নীতির ভয়াবহতা তুলে ধরেছে। যুদ্ধাপরাধ নিয়ে গঠিত আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের মান নিয়ে সমালোচনা করেছে। তারা বলেছে, এটি আন্তর্জাতিক মানদন্ডের শর্ত পূরণ করেনি। তারা দুঃখ করে বলেছে, ট্রাইব্যুনাল এখনো যুদ্ধাপরাধ, মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধ, গণহত্যার মত বিষয়গুলোর সংজ্ঞা আন্তর্জাতিক মানদন্ড অনুযায়ী নির্ধারণ করেনি। বাংলাদেশের আন্তর্জাতিক অপরাধ দমন ট্রাইব্যুনালে আন্তর্জাতিক মান অর্জন করতে হলে ক্ষতিগ্রস্তদের পাশাপাশি যাদের বিচার করা হচ্ছে, তাদের মানবাধিকার ও ন্যায়বিচারের বিষয়টিও বিবেচনায় রাখতে হবে। সরকারের দায়িত্বপ্রাপ্ত মন্ত্রী এমনকি ক্ষমতার শীর্ষে অবস্থানকারীরা দাবি করছে, দেশের মানবাধিকার পরিস্থিতি স্বাভাবিক। তারা গায়ের জোরে এটা মানতে মানুষকে বাধ্য করছে। এখন বাইরের মানবাধিকার প্রতিষ্ঠানগুলো সরকারের চাপিয়ে দেয়া মিথ্যাকে ভুল প্রতিপন্ন করছে। সরকারের উচিত আর সামনে না বাড়া। গুম, নিখোঁজ, সন্ত্রাস, দুর্নীতি ও বিচারহীনতার সংস্কৃতি থেকে বেরিয়ে আসা। এরপরেও যদি একগুঁয়েমি করে সরকার মানুষের মানবাধিকার পদদলিত করা অব্যাহত রাখে তার পরিণতি শুভ হওয়ার নয়।
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন