ফকির আশরাফ
মাননীয় প্রধানমন্ত্রী, আপনার একজন মন্ত্রী কিছুদিন আগে এক সেমিনারে বলেছিলেন_ 'বাঘে ধরলে ছাড়ে, হাসিনা ধরলে ছাড়ে না।' কেন তিনি এমন কথা বলেছিলেন, তার প্রেক্ষাপটও মনে আছে আমার। খালেদা জিয়ার প্রতি হুমকি প্রদর্শনের লক্ষ্যেই এমন একটি অবাঞ্ছিত বাক্যের অবতারণা করেছিলেন তিনি। এ বাক্যটি দ্বারা তিনি কি তার নেত্রীর প্রশস্তি গাইলেন, নাকি ভিন্ন কোনো ইঙ্গিত দিলেন_ তার ব্যাখ্যা কখনোই দেননি তিনি জনসম্মুখে। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী, আপনার মন্ত্রী ঠিক কথা বলেননি। আপনি বঙ্গবন্ধুর কন্যা। আপনার পিতা ছিলেন সিংহ হৃদয়ের মানুষ। ক্ষমাই ছিল যার চরিত্রের প্রধান বৈশিষ্ট্য। তার রাজনৈতিক জীবনের বড় শত্রু খান এ সবুর খানের জন্য তিনি নিজের বাড়ি থেকে খাবার পাঠিয়েছিলেন জেলখানায়। সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরীর বাবা ফজলুল কাদের চৌধুরীকে কারাগারে দেখতে গিয়েছিলেন আপনার বাবা। বঙ্গবন্ধুর এক ঘনিষ্ঠ (!) রাজনৈতিক সহকর্মী ঠাট্টা করে একদিন বলেছিলেন, 'বঙ্গবন্ধু, তোমার পা দুটি কেটে ফেলা উচিত।' বঙ্গবন্ধু সিংহের মতো গর্জে উঠে বলেছিলেন, কেন? প্রত্যুত্তরে সহকর্মী বললেন_ 'তোমার পা ধরতে পারলেই সাত খুন মাফ।' সেই সহকর্মীর নাম আমি এখানে উচ্চারণ করতে চাই না। কেননা, তিনি বাংলাদেশের মাটিতে একজন ঘৃণিত ব্যক্তি। আজ আপনি (শেখ হাসিনা) প্রধানমন্ত্রী, পিতা যার দয়ার সাগর_ সেই মহান হৃদয়ের আত্দজা হয়ে আর যাই হোন, হিংস্র হতে পারেন না আপনি। কারণ সিংহ শাবক সিংহ-ই হয়, শৃগাল হয় না কখনো।
মাননীয় প্রধানমন্ত্রী, আমি কিছু কথা বলব যেগুলোকে কেউ কেউ ভাবতে পারে, আমি উপদেশ দিচ্ছি আপনাকে। মাননীয় প্রধানমন্ত্রীকে উপদেশ দেওয়ার মতো বেয়াদব আমি নই। এমনকি ধৃষ্টতা দেখানোর মতো সাহসও নেই আমার। আপনার শাসনামলে আমি স্বচক্ষে যা প্রত্যক্ষ করেছি, স্বকানে যা শ্রবণ করেছি, হৃদয় ও মস্তিষ্ক দিয়ে যা উপলব্ধি করেছি, তারই ভিত্তিতে সৃষ্ট অনুভূতি বর্ণনা করার চেষ্টা করব স্বল্পপরিসরে।
কিছুদিন আগে নিত্যদিনের মতো যানজটে আটকা পড়ে প্রায় আধা ঘণ্টা ঠায় বসেছিলাম রাজধানীতে নৌবাহিনীর সদর দফতরের সামনে ভিআইপি সড়কে। আমার গাড়ির সামনে একটি যাত্রীবাহী বাস দণ্ডায়মান। বাসের পেছনে স্পষ্টাক্ষরে লেখা_ 'পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ আদালত মানুষের বিবেক।' কথাটি কার তা আমার জানা নেই। কোন কবি, কোন সাহিত্যিক, কোন দার্শনিক, কোন পণ্ডিত কিংবা কোন মহামানব কথাটি বলেছেন তাও জানি না। তবে বাক্যটি দারুণ পছন্দ হলো আমার। প্রসঙ্গক্রমে মনে পড়ল আরেকদিনের কথা। পুরনো শহরে একটি জরাজীর্ণ বাড়ির দেয়ালে লাল রং দিয়ে উৎকীর্ণ 'প্রাচীর গাত্রে যদি থাকে উপদেশ লিখন, সাদরে তুমি তারে করিও গ্রহণ।' আমার কথাগুলোও জরাজীর্ণ দেয়ালের গায়ে লিখিত সৎকথন ভেবে গ্রহণ করলে বাধিত হব।
মাননীয় প্রধানমন্ত্রী, যে কথাগুলো আজ আমাকে বলতে হচ্ছে পত্রিকার পৃষ্ঠায়, সে কথাগুলো পার্লামেন্টে দাঁড়িয়ে বলার সুযোগ সৃষ্টি হয়েছিল আমার। হুসেইন মুহম্মদ এরশাদের সুপারিশে বিগত নির্বাচনে আপনি আমাকে দিয়েছিলেন নমিনেশন। একটি ক্রেডিট কার্ডের ১২ হাজার পাঁচশ টাকা সার্ভিস চার্জ বকেয়া থাকার অজুহাতে বাতিল হলো আমার মনোনয়নপত্র। মহামান্য হাইকোর্টের অনুমতি পেয়ে নির্বাচনের ১১ দিন আগে যখন নামলাম মাঠে তখন দেখলাম আপনার গ্রিন সিগন্যাল পেয়ে আমার আসনে মাঠ দখল করে ফেলেছেন মহাজোটের বিকল্প প্রার্থী স্থানীয় আওয়ামী লীগ নেতা আশরাফ আলী খান খসরু। আমার অপরাধ! মোকদ্দমায় পড়ে বিলম্বে নাকি মাঠে নেমেছি আমি। তাই আপনার দোহাই দিয়ে নির্বাচন থেকে সরে দাঁড়ানোর জন্য আমাকে অনুরোধ জানালেন আমার অতি শ্রদ্ধাভাজন ড. এইচ টি ইমাম। তার স্নেহমাখা অনুরোধে এবং আমার নেতা এরশাদের অনিচ্ছাকৃত সম্মতিতে এক দিন আগে নির্বাচন থেকে আমি সরে দাঁড়ালাম। হাইকোর্ট থেকে মুক্তি পেয়ে ময়মনসিংহের আওয়ামী লীগ নেতা অধ্যক্ষ মতিয়র রহমান মাত্র সাত দিন আগে নামেন নির্বাচনে। আর চাঁদপুরের ডক্টর মহীউদ্দীন খান আলমগীর সুপ্রিমকোর্টের স্থগিতাদেশ পেয়ে নির্বাচনী মাঠে অবতীর্ণ হন মাত্র পাঁচ দিন আগে। উলি্লখিত দুজন আওয়ামী লীগ নেতার ক্ষেত্রে বিলম্ব হয়নি_ হলো শুধু আমার ক্ষেত্রে? শুধু তাই নয়, সাবেক রাষ্ট্রপতি এরশাদের প্রস্তাবিত তালিকায় ৬০ জনের মধ্যে মাত্র ৪৮ জনকে মনোনয়ন দিতে সম্মতি দিয়েছিলেন আপনি। তার মধ্যে আপনার সম্মতিপ্রাপ্ত ১৭ জন জাপা প্রার্থীর বিপরীতে দাঁড়িয়ে রইলেন আপনার দলীয় প্রার্থী। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী, আপনার কাছে আমার প্রশ্ন_ যদি জাতীয় পার্টির ১৭ জন ফেল না করত বিগত নির্বাচনে তাহলে পার্লামেন্টে বিরোধী দলের আসনে বসত কে? জাতীয় রাজনীতির চিত্র কি ভিন্নতর হতো না? আপনার মাথার ঘাম পায়ের পাতা পর্যন্ত কি এমন করে ঝরত? মাননীয় প্রধানমন্ত্রী, আপনার কাছে আমি অতি ক্ষুদ্র মানুষ। তবুও সাহস করে বলতে চাই_ একজন পলিটিশিয়ানকে স্টেটসম্যান হতে হলে তাকে পরিধান করতে হয় বাইফোকাল চশমা, কাছেরটা যেমন দেখবে, দূরেরটাও দেখতে হবে তাকে।
মাননীয় প্রধানমন্ত্রী, আপনি দয়া করে চোখ খুলে দেখুন, কান খাড়া করে শুনুন, কী হচ্ছে, কী ঘটছে দেশে। আপনার চারপাশে যারা আছেন তারা হয়তো বলছেন_ সব ঠিক আছে। বাহবা। গোয়েন্দা রিপোর্ট কী বলছে? হয়তো ভালো বলছে, নয়তো খারাপ। তবে শোনা যায়, সঠিক গোয়েন্দা রিপোর্টের অভাবে অনেক দেশে সরকার বিভ্রান্ত হয়_ কোনো কোনো দেশে পতন হয় সরকারের। গোয়েন্দা প্রতিবেদন গোপনীয় বিষয়। তাই আমাদের গোয়েন্দা রিপোর্টে কী থাকে তা আমার জানা নেই। রিপোর্টে যাই থাকুক বাস্তবতা হচ্ছে_ দেশ আজ ভয়াবহ সংকটের সম্মুখীন। মানুষের নিত্যদিনের সমস্যা হলো_ গ্যাসের অপ্রতুলতা, অসহনীয় লোডশেডিং, পানির নিদারুণ সংকট, রাজধানীর রাস্তায় তীব্র যানজট, আধা ঘণ্টার রাস্তা লেগে যায় দুই ঘণ্টা। কৃষকের গোলাভরা ধান। কিন্তু কণ্ঠে হাহাকার। ধানের মণপ্রতি উৎপাদন খরচ ছয়শ টাকা। তারা বিক্রি করে সাড়ে চারশ থেকে পাঁচশ টাকায়। সরকারি মূল্য ৭২০ টাকার ধারেকাছেও নেই কৃষক বন্ধুরা। এক মণ ধান বিক্রি করে একটি আটপৌরে শাড়ি কেনাও সম্ভব হয় না কৃষকের পক্ষে। বাজারে আগুন। নিত্যপণ্যের মূল্য আকাশচুম্বী। কৃষক-শ্রমিক এবং চাকরিজীবীদের জীবনে নাভিশ্বাস। এবার আসুন জীবনের নিরাপত্তার প্রশ্নে। এইচএম এরশাদ বলেছেন_ 'ঘরে থাকলে খুন, বাইরে গেলে গুম।' একটি বাক্য দ্বারাই তিনি বুঝিয়ে দিয়েছেন দেশের আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি। তিন মাস হতে চলল খোঁজ মেলেনি গুম হওয়া দেশব্যাপী পরিচিত রাজনৈতিক নেতা ইলিয়াস আলীর। শ্রমিক নেতা আমিনুল হত্যার কূলকিনারা করতে পারেনি আমাদের পুলিশ। আমেরিকা এবং ইউরোপে তৈরি পোশাক রপ্তানি বাজারে এর ভয়াবহ পরিণাম কী হতে পারে তার একটি পূর্বাভাস সম্প্রতি দিয়েছেন মার্কিন রাষ্ট্রদূত ড্যান মোজেনা। সাংবাদিক দম্পতি সাগর-রুনির হত্যাকারীদের ৪৮ ঘণ্টার মধ্যে গ্রেফতার করা হবে বলে সদম্ভে ঘোষণা দিয়েছিলেন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী সাহারা খাতুন। তার পর আপনার ওপর দায়িত্ব ছেড়ে দিয়ে সুচবিদ্ধ বেলুনের মতো চুপসে গেলেন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী। পুলিশ তাদের ব্যর্থতা স্বীকার করেছে উচ্চ আদালতে। একইরকম ব্যর্থতা পুলিশ প্রদর্শন করেছে সৌদি কূটনীতিক হত্যাকাণ্ডের ব্যাপারে। এরও কি মারাত্দক পরিণাম হতে পারে তা কূটনীতিবিশারদদের কাছে সহজেই বোধগম্য। তার ওপর রয়েছে বাংলাদেশের সঙ্গে ভারতের অবন্ধুসুলভ আচরণ। তিস্তা চুক্তির ভবিষ্যৎ অনিশ্চিত। উত্তরবঙ্গ মরুভূমি হওয়ার আশঙ্কা। সুমধুর ভাষায় বাঁধ তৈরি না করার ব্যাপারে ভারতের শত আশ্বাস সত্ত্বেও টিপাইমুখ বাঁধ নির্মাণের সব পরিকল্পনা সমাপ্তপ্রায়। শুধু ড. ইউনূস প্রসঙ্গটি নিয়ে ক্রমাবনতির দিকে যাচ্ছে বাংলা-মার্কিন সম্পর্ক। এটা যে শুভ লক্ষণ নয় তা বলাই বাহুল্য।
মাননীয় প্রধানমন্ত্রী, উপরে যেসব কথা বলা হলো এগুলো দেশের সামগ্রিক চিত্রের খণ্ডাংশ মাত্র। আপনি হয়তো বলতে পারেন, 'সুজন গুণ খোঁজে, দোষ খোঁজে পামর'_ তুমি তো পামরের মতো আমার দোষগুলোই দেখলে, গুণের লেশমাত্রও কি চোখে পড়েনি তোমার! খালেদা জিয়া সম্পর্কে একটি কথাও বললে না তুমি। তিনি কি সর্ব গুণের আধার? মাননীয় প্রধানমন্ত্রী, আপনি ক্ষমতায়। জনগণের কল্যাণের প্রতিশ্রুতি দিয়েই ক্ষমতায় বসেছেন। ভালো কিছু করবেন এটিই স্বাভাবিক। তার ফলাফল পাবেন পরবর্তী নির্বাচনে। কিন্তু প্রতিশ্রুতির পরিপন্থী যা হবে সেটিই দুঃসংবাদ, সেটিই সমালোচনার বিষয়। তাতে সতর্ক হবেন আপনি, উপকৃত হবে জনগণ। আর বিরোধীদলীয় নেতার কথা বলছেন! তিনি পাঁচ বছরের শাসনামলে যা করেছেন তার প্রতিদান পেয়েছেন বিগত নির্বাচনে। আশা করি, জবাব পেয়েছেন মাননীয় প্রধানমন্ত্রী।
বঙ্গবন্ধু নন্দিনী, অনেক আশা বুকে নিয়ে হৃদয় উজাড় করে এ দেশের মানুষ ভোট দিয়েছিল আপনাকে। তিন-চতুর্থাংশ আসন উপহার দিয়ে পার্লামেন্টে অনেক ভারী করে দিয়েছে আপনার পাল্লা। ফলে আপনার যা খুশি তাই সিদ্ধান্ত নিতে পারেন পার্লামেন্টে। সংসদীয় পার্লামেন্টের জগতে আপনার মতো ভাগ্যবান নেতা খুব কম জন্মেছে পৃথিবীতে। আর সেই সুবাদে আপনিও একটি অপরিণামদর্শী সিদ্ধান্ত নিয়েছেন সংসদে। বলতে গেলে যে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের জননী আপনি, সেই সন্তানকে গলাটিপে হত্যা করলেন স্বহস্তে! মাননীয় প্রধানমন্ত্রী, তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থার ঘোরতর বিরোধী একটি মানুষ আমি। ২০০৪ সালের ২৩ সেপ্টেম্বরের কথা। দৈনিক আমার দেশ পত্রিকা ভূমিষ্ঠ হলো পৃথিবীতে। কর্তৃপক্ষের আগ্রহে আমার একটি বক্ষ্যমাণ নিবন্ধ ছাপা হলো উদ্বোধনী সংখ্যায়। শিরোনাম_ 'রাজনীতি : বাংলাদেশ প্রেক্ষিত'। নিবন্ধের একটি অনুচ্ছেদে বলেছি_ তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা হলো রাজনীতিবিদদের ব্যর্থতার কলঙ্ক তিলক। কলঙ্কের এ চিহ্ন মুছে ফেলতে হবে আমাদের পবিত্র সংবিধান থেকে। আজকে সেই 'আমি' বাধ্য হয়ে বিপরীত কথা বলছি পরিবর্তিত প্রেক্ষাপটে। সরকার এবং বিরোধী পক্ষের অবস্থান বিপরীতমুখী। দুই পক্ষই অনড়, অটল এবং যুদ্ধংদেহী। ক্রমশ উত্তপ্ত হচ্ছে সংঘাতময় পরিস্থিতি। ওয়ান-ইলেভেনের আগে যে অবস্থা বিরাজমান তার চেয়েও অবনতির দিকে ধাবমান বর্তমান সংকট। কোন ধরনের সরকারব্যবস্থার অধীনে হবে আগামী নির্বাচন? এ প্রশ্নের উত্তর মিলছে না আজ অবধি। সরকার বলেছে, বর্তমান নির্বাচিত আওয়ামী লীগের নেতৃত্বাধীন মহাজোট সরকারের অধীনেই হবে আগামী নির্বাচন। আর বিএনপির নেতৃত্বাধীন ১৮ দলীয় জোট বলছে, কোনো অবস্থাতেই দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচনে যাবে না বিরোধী দল। সরকার ইতোমধ্যে পার্লামেন্টে ব্রুট মেজরিটিবলে তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা মুছে ফেলেছে সংবিধান থেকে। সরকারের বক্তব্য, সুপ্রিমকোর্টের আদেশ অনুসারেই তারা সংশোধন করে ফেলেছে সংবিধান। আমার বক্তব্য হলো_ তত্ত্বাবধায়ক সরকার প্রশ্নে সুপ্রিমকোর্টের আদেশে আছে দুটি অংশ। প্রথমটিতে বলা হয়েছে_ তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা সংবিধান পরিপন্থী, তাই বর্জনীয়। দ্বিতীয় অংশে আছে_ বর্তমান রাজনৈতিক প্রেক্ষাপট বিবেচনায় আরও দুই টার্ম রাখা যেতে পারে তত্ত্বাবধায়ক সরকারপদ্ধতি। সুপ্রিমকোর্টের আদেশই যদি পালন করতে হয় তাহলে প্রথমটি পালন করবেন হুবহু, দ্বিতীয়টি নয় কেন? উত্তর সহজবোধ্য। বিশ্লেষণের অপেক্ষা রাখে না মাননীয় প্রধানমন্ত্রী।
বঙ্গবন্ধু তনয়া, আপনার সদয় জ্ঞাতার্থে বলছি, তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা প্রশ্নে আলোচ্য ঐতিহাসিক রায়টি দিয়েছেন সুপ্রিমকোর্টের সদ্য বিদায়ী প্রধান বিচারপতি এবিএম খায়রুল হক। তার একটি সাক্ষাৎকার বাংলাভিশনে প্রচারিত হয়েছে গত ৪ জুন। সাক্ষাৎকারটি গ্রহণ করেছেন বিশিষ্ট তরুণ সাংবাদিক বাংলাভিশনের স্পেশাল করেসপন্ডেন্ট বদরুল আলম নাবির। সাক্ষাৎকারে বিচারপতি খায়রুল হক দ্ব্যার্থহীন কণ্ঠে বলেছেন, তত্ত্বাবধায়ক সরকার সংবিধানের পরিপন্থী হওয়ায় তা পরিত্যাজ্য। তবে বিরাজমান রাজনৈতিক সংকট নিরসনের লক্ষ্যে আরও দুই টার্ম বহাল রাখতে হবে তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী, বিচারপতি খায়রুল হক বিগত ২৯ মার্চ স্বাক্ষর করে ছেড়ে দিয়েছেন ঐতিহাসিক রায়। আজ পর্যন্ত রায়ের কপি এলো না জনসম্মুখে। বিষয়টি কি প্রশ্নবোধক নয়?
মাননীয় প্রধানমন্ত্রী, প্রসঙ্গক্রমে এখানে উল্লেখ করতে চাই একটি ঐতিহাসিক ঘটনা। দ্বিতীয় মহাযুদ্ধে মিত্রশক্তির তিন মহানায়ক চার্চিল, রুজভেল্ট এবং স্টালিন। যুদ্ধ কৌশলের পারদর্শিতা, অসাধারণ মেধা এবং অতুলনীয় নেতৃত্বের কারণে ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী স্যার উইনস্টন চার্চিলের নামটি উচ্চারিত হয় সর্বাগ্রে। যুদ্ধ শেষ। অক্ষশক্তি পরাজিত। সারা বিশ্বে মহাবীরের সম্মানে ভূষিত হলেন চার্চিল। যুদ্ধবিধ্বস্ত ব্রিটেনকে জাতির ঐক্যবদ্ধ শক্তি দিয়ে পুনর্গঠনের লক্ষ্যে একটি জাতীয় সরকার গঠনের ইচ্ছা প্রকাশ করলেন তিনি। তার প্রস্তাবে রাজি হলো না বিরোধীপক্ষ শ্রমিক দল। জাতীয় সরকার গঠিত হলে রক্ষণশীল সরকারি দলের নেতা হিসেবে হয়তো তিনিই হতেন সরকারপ্রধান। এমনটিই প্রত্যাশা করেছিল তার দল। অন্যান্য দল সম্মতি দিয়েছিল চার্চিলের প্রস্তাবে। কিন্তু যেহেতু সম্মত হলো না বিরোধী পক্ষ, তাই চার্চিল বিনা দ্বিধায় প্রত্যাহার করে নিলেন জাতির জন্য মঙ্গলকামী তার শুভ প্রস্তাব। এরপর হলো নির্বাচন। চার্চিল পার্লামেন্টে এলেও সরকার গঠন করতে পারেনি তার কনজারভেটিভ পার্টি। ১৯৪১ থেকে ১৯৪৫ সাল পর্যন্ত যুদ্ধের পুরো সময় তিনি ছিলেন প্রধানমন্ত্রী। আবার ১৯৫১ সালে তিনি দ্বিতীয়বারের মতো প্রধানমন্ত্রী হলেন ব্রিটেনের। ব্রিটেনবাসী চার্চিলের তীব্র অভাব অনুভব করেছে পাঁচ বছর। তাই তার দলকে ভোট দিয়ে আবার '৫১ সালে স্যার চার্চিলকে প্রধানমন্ত্রী হিসেবে দেখে অপূর্ণ সাধ পূরণ করল ব্রিটেনবাসী। ১৯৫৩ সালে চার্চিল পেলেন সাহিত্যে নোবেল পুরস্কার। পাঁচ বছর প্রধানমন্ত্রিত্বের বাইরে থাকাকালীন তিনি রচনা করেছেন দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের ছয় খণ্ড ইতিহাস। এ ছাড়াও তার রয়েছে অনেক উপন্যাস, ছোট গল্প এবং প্রবন্ধ পুস্তক। তিনিই পৃথিবীর একমাত্র রাজনীতিবিদ যিনি সাহিত্যে পেয়েছেন নোবেল পুরস্কার।
মাননীয় প্রধানমন্ত্রী, পলিটিশিয়ান হিসেবে সাধারণত কেউ আখ্যায়িত করে না স্যার উইনস্টন চার্চিলকে। তিনি ছিলেন সব সংকীর্ণতার ঊধের্্ব। তাই তিনি শত্রু-মিত্র সবার কাছে হয়ে উঠেন স্টেটসম্যান। পৃথিবীর ইতিহাসে আমরা স্টেটসম্যান হিসেবে দেখেছি মহাত্দা মোহনদাস করমচাঁদ গান্ধীকে, দেখেছি জওয়াহেরলাল নেহেরু এবং ইন্দিরা গান্ধীকে। দেখেছি আব্রাহাম লিংকন, জর্জ ওয়াশিংটনকে। আরও দেখেছি নেলসন ম্যান্ডেলা, মাহাথির মোহাম্মদকে। সর্বশেষ আমরা দেখেছি আপনার বাবা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে। আপনি তো তারই সুযোগ্য কন্যা। পৃথিবীতে অনেক বড় বাবার সন্তান পিতার চেয়ে হয়েছে খ্যাতিমান। সম্রাট শাহজাহানের চেয়ে খ্যাতি পেয়েছেন তার পুত্র আওরঙ্গজেব, হুমায়ুনের চেয়ে আকবর। ষোড়শ শতাব্দীতে ইংল্যান্ডের দোর্দণ্ড প্রতাপশালী রাজা অষ্টম হেনরীর চেয়ে খ্যাতির শীর্ষে উঠেছেন তার কন্যা রানী এলিজাবেথ। পঁয়তালি্লশ বছর একনাগাড়ে ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের অধীশ্বরী ছিলেন চিরকুমারী রানী এলিজাবেথ। শুধু রাজ সিংহাসনে উপবিষ্ট থাকার কারণেই খ্যাতিমান হননি তারা। রাজশক্তি প্রয়োগ করে বাড়িয়েছেন রাজ্য সীমানা। আর সাম্রাজ্যের অখণ্ডতা ধরে রাখার জন্য হৃদয় দিয়ে জয় করেছেন প্রজাসাধারণের হৃদয়। শক্তি দিয়ে বিজয় অর্জন করলে তা হয় ক্ষণস্থায়ী। হৃদয় দিয়ে যে জয় তা হয় দীর্ঘস্থায়ী। হিংসা-বিদ্বেষ কিংবা ষড়যন্ত্র কোনোদিন, কোনো কালে বয়ে আনতে পারে না মানব কল্যাণ। প্রতিহিংসা ডেকে আনে প্রতিহিংসা, ষড়যন্ত্র সৃষ্টি করে ষড়যন্ত্র, ভালোবাসা জন্ম দেয় ভালোবাসা।
মাননীয় প্রধানমন্ত্রী, 'অনুরাগ বা বিরাগের বশবর্তী না হইয়া সকলের প্রতি আইন অনুযায়ী যথাবিহীত আচরণ করিব'_ প্রধানমন্ত্রিত্ব গ্রহণকালে উচ্চারিত এই শপথবাক্য জাতির চলমান সংকটকালে অক্ষরে অক্ষরে আপনি দয়া করে পালন করবেন এবং বিরোধী দলকে সঙ্গে নিয়ে একটি গ্রহণযোগ্য ফর্মুলায় আগামী নির্বাচন অনুষ্ঠানের দ্রুত প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করবেন_ আপনার কাছে আমার এটি বিনয়াবনত প্রত্যাশা। তাহলে আপনার বাবার মতো আপনিও স্টেটসম্যান হিসেবে ওঠে যাবেন খ্যাতির এভারেস্ট চূড়ায়। আর এমনটি যদি আপনি করতে ব্যর্থ হন তাহলে দেশের পথচলা আবার শুরু হতে পারে অসাংবিধানিক পথে।
লেখক : কথাসাহিত্যিক ও রাজনীতিবিদ।
মাননীয় প্রধানমন্ত্রী, আমি কিছু কথা বলব যেগুলোকে কেউ কেউ ভাবতে পারে, আমি উপদেশ দিচ্ছি আপনাকে। মাননীয় প্রধানমন্ত্রীকে উপদেশ দেওয়ার মতো বেয়াদব আমি নই। এমনকি ধৃষ্টতা দেখানোর মতো সাহসও নেই আমার। আপনার শাসনামলে আমি স্বচক্ষে যা প্রত্যক্ষ করেছি, স্বকানে যা শ্রবণ করেছি, হৃদয় ও মস্তিষ্ক দিয়ে যা উপলব্ধি করেছি, তারই ভিত্তিতে সৃষ্ট অনুভূতি বর্ণনা করার চেষ্টা করব স্বল্পপরিসরে।
কিছুদিন আগে নিত্যদিনের মতো যানজটে আটকা পড়ে প্রায় আধা ঘণ্টা ঠায় বসেছিলাম রাজধানীতে নৌবাহিনীর সদর দফতরের সামনে ভিআইপি সড়কে। আমার গাড়ির সামনে একটি যাত্রীবাহী বাস দণ্ডায়মান। বাসের পেছনে স্পষ্টাক্ষরে লেখা_ 'পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ আদালত মানুষের বিবেক।' কথাটি কার তা আমার জানা নেই। কোন কবি, কোন সাহিত্যিক, কোন দার্শনিক, কোন পণ্ডিত কিংবা কোন মহামানব কথাটি বলেছেন তাও জানি না। তবে বাক্যটি দারুণ পছন্দ হলো আমার। প্রসঙ্গক্রমে মনে পড়ল আরেকদিনের কথা। পুরনো শহরে একটি জরাজীর্ণ বাড়ির দেয়ালে লাল রং দিয়ে উৎকীর্ণ 'প্রাচীর গাত্রে যদি থাকে উপদেশ লিখন, সাদরে তুমি তারে করিও গ্রহণ।' আমার কথাগুলোও জরাজীর্ণ দেয়ালের গায়ে লিখিত সৎকথন ভেবে গ্রহণ করলে বাধিত হব।
মাননীয় প্রধানমন্ত্রী, যে কথাগুলো আজ আমাকে বলতে হচ্ছে পত্রিকার পৃষ্ঠায়, সে কথাগুলো পার্লামেন্টে দাঁড়িয়ে বলার সুযোগ সৃষ্টি হয়েছিল আমার। হুসেইন মুহম্মদ এরশাদের সুপারিশে বিগত নির্বাচনে আপনি আমাকে দিয়েছিলেন নমিনেশন। একটি ক্রেডিট কার্ডের ১২ হাজার পাঁচশ টাকা সার্ভিস চার্জ বকেয়া থাকার অজুহাতে বাতিল হলো আমার মনোনয়নপত্র। মহামান্য হাইকোর্টের অনুমতি পেয়ে নির্বাচনের ১১ দিন আগে যখন নামলাম মাঠে তখন দেখলাম আপনার গ্রিন সিগন্যাল পেয়ে আমার আসনে মাঠ দখল করে ফেলেছেন মহাজোটের বিকল্প প্রার্থী স্থানীয় আওয়ামী লীগ নেতা আশরাফ আলী খান খসরু। আমার অপরাধ! মোকদ্দমায় পড়ে বিলম্বে নাকি মাঠে নেমেছি আমি। তাই আপনার দোহাই দিয়ে নির্বাচন থেকে সরে দাঁড়ানোর জন্য আমাকে অনুরোধ জানালেন আমার অতি শ্রদ্ধাভাজন ড. এইচ টি ইমাম। তার স্নেহমাখা অনুরোধে এবং আমার নেতা এরশাদের অনিচ্ছাকৃত সম্মতিতে এক দিন আগে নির্বাচন থেকে আমি সরে দাঁড়ালাম। হাইকোর্ট থেকে মুক্তি পেয়ে ময়মনসিংহের আওয়ামী লীগ নেতা অধ্যক্ষ মতিয়র রহমান মাত্র সাত দিন আগে নামেন নির্বাচনে। আর চাঁদপুরের ডক্টর মহীউদ্দীন খান আলমগীর সুপ্রিমকোর্টের স্থগিতাদেশ পেয়ে নির্বাচনী মাঠে অবতীর্ণ হন মাত্র পাঁচ দিন আগে। উলি্লখিত দুজন আওয়ামী লীগ নেতার ক্ষেত্রে বিলম্ব হয়নি_ হলো শুধু আমার ক্ষেত্রে? শুধু তাই নয়, সাবেক রাষ্ট্রপতি এরশাদের প্রস্তাবিত তালিকায় ৬০ জনের মধ্যে মাত্র ৪৮ জনকে মনোনয়ন দিতে সম্মতি দিয়েছিলেন আপনি। তার মধ্যে আপনার সম্মতিপ্রাপ্ত ১৭ জন জাপা প্রার্থীর বিপরীতে দাঁড়িয়ে রইলেন আপনার দলীয় প্রার্থী। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী, আপনার কাছে আমার প্রশ্ন_ যদি জাতীয় পার্টির ১৭ জন ফেল না করত বিগত নির্বাচনে তাহলে পার্লামেন্টে বিরোধী দলের আসনে বসত কে? জাতীয় রাজনীতির চিত্র কি ভিন্নতর হতো না? আপনার মাথার ঘাম পায়ের পাতা পর্যন্ত কি এমন করে ঝরত? মাননীয় প্রধানমন্ত্রী, আপনার কাছে আমি অতি ক্ষুদ্র মানুষ। তবুও সাহস করে বলতে চাই_ একজন পলিটিশিয়ানকে স্টেটসম্যান হতে হলে তাকে পরিধান করতে হয় বাইফোকাল চশমা, কাছেরটা যেমন দেখবে, দূরেরটাও দেখতে হবে তাকে।
মাননীয় প্রধানমন্ত্রী, আপনি দয়া করে চোখ খুলে দেখুন, কান খাড়া করে শুনুন, কী হচ্ছে, কী ঘটছে দেশে। আপনার চারপাশে যারা আছেন তারা হয়তো বলছেন_ সব ঠিক আছে। বাহবা। গোয়েন্দা রিপোর্ট কী বলছে? হয়তো ভালো বলছে, নয়তো খারাপ। তবে শোনা যায়, সঠিক গোয়েন্দা রিপোর্টের অভাবে অনেক দেশে সরকার বিভ্রান্ত হয়_ কোনো কোনো দেশে পতন হয় সরকারের। গোয়েন্দা প্রতিবেদন গোপনীয় বিষয়। তাই আমাদের গোয়েন্দা রিপোর্টে কী থাকে তা আমার জানা নেই। রিপোর্টে যাই থাকুক বাস্তবতা হচ্ছে_ দেশ আজ ভয়াবহ সংকটের সম্মুখীন। মানুষের নিত্যদিনের সমস্যা হলো_ গ্যাসের অপ্রতুলতা, অসহনীয় লোডশেডিং, পানির নিদারুণ সংকট, রাজধানীর রাস্তায় তীব্র যানজট, আধা ঘণ্টার রাস্তা লেগে যায় দুই ঘণ্টা। কৃষকের গোলাভরা ধান। কিন্তু কণ্ঠে হাহাকার। ধানের মণপ্রতি উৎপাদন খরচ ছয়শ টাকা। তারা বিক্রি করে সাড়ে চারশ থেকে পাঁচশ টাকায়। সরকারি মূল্য ৭২০ টাকার ধারেকাছেও নেই কৃষক বন্ধুরা। এক মণ ধান বিক্রি করে একটি আটপৌরে শাড়ি কেনাও সম্ভব হয় না কৃষকের পক্ষে। বাজারে আগুন। নিত্যপণ্যের মূল্য আকাশচুম্বী। কৃষক-শ্রমিক এবং চাকরিজীবীদের জীবনে নাভিশ্বাস। এবার আসুন জীবনের নিরাপত্তার প্রশ্নে। এইচএম এরশাদ বলেছেন_ 'ঘরে থাকলে খুন, বাইরে গেলে গুম।' একটি বাক্য দ্বারাই তিনি বুঝিয়ে দিয়েছেন দেশের আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি। তিন মাস হতে চলল খোঁজ মেলেনি গুম হওয়া দেশব্যাপী পরিচিত রাজনৈতিক নেতা ইলিয়াস আলীর। শ্রমিক নেতা আমিনুল হত্যার কূলকিনারা করতে পারেনি আমাদের পুলিশ। আমেরিকা এবং ইউরোপে তৈরি পোশাক রপ্তানি বাজারে এর ভয়াবহ পরিণাম কী হতে পারে তার একটি পূর্বাভাস সম্প্রতি দিয়েছেন মার্কিন রাষ্ট্রদূত ড্যান মোজেনা। সাংবাদিক দম্পতি সাগর-রুনির হত্যাকারীদের ৪৮ ঘণ্টার মধ্যে গ্রেফতার করা হবে বলে সদম্ভে ঘোষণা দিয়েছিলেন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী সাহারা খাতুন। তার পর আপনার ওপর দায়িত্ব ছেড়ে দিয়ে সুচবিদ্ধ বেলুনের মতো চুপসে গেলেন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী। পুলিশ তাদের ব্যর্থতা স্বীকার করেছে উচ্চ আদালতে। একইরকম ব্যর্থতা পুলিশ প্রদর্শন করেছে সৌদি কূটনীতিক হত্যাকাণ্ডের ব্যাপারে। এরও কি মারাত্দক পরিণাম হতে পারে তা কূটনীতিবিশারদদের কাছে সহজেই বোধগম্য। তার ওপর রয়েছে বাংলাদেশের সঙ্গে ভারতের অবন্ধুসুলভ আচরণ। তিস্তা চুক্তির ভবিষ্যৎ অনিশ্চিত। উত্তরবঙ্গ মরুভূমি হওয়ার আশঙ্কা। সুমধুর ভাষায় বাঁধ তৈরি না করার ব্যাপারে ভারতের শত আশ্বাস সত্ত্বেও টিপাইমুখ বাঁধ নির্মাণের সব পরিকল্পনা সমাপ্তপ্রায়। শুধু ড. ইউনূস প্রসঙ্গটি নিয়ে ক্রমাবনতির দিকে যাচ্ছে বাংলা-মার্কিন সম্পর্ক। এটা যে শুভ লক্ষণ নয় তা বলাই বাহুল্য।
মাননীয় প্রধানমন্ত্রী, উপরে যেসব কথা বলা হলো এগুলো দেশের সামগ্রিক চিত্রের খণ্ডাংশ মাত্র। আপনি হয়তো বলতে পারেন, 'সুজন গুণ খোঁজে, দোষ খোঁজে পামর'_ তুমি তো পামরের মতো আমার দোষগুলোই দেখলে, গুণের লেশমাত্রও কি চোখে পড়েনি তোমার! খালেদা জিয়া সম্পর্কে একটি কথাও বললে না তুমি। তিনি কি সর্ব গুণের আধার? মাননীয় প্রধানমন্ত্রী, আপনি ক্ষমতায়। জনগণের কল্যাণের প্রতিশ্রুতি দিয়েই ক্ষমতায় বসেছেন। ভালো কিছু করবেন এটিই স্বাভাবিক। তার ফলাফল পাবেন পরবর্তী নির্বাচনে। কিন্তু প্রতিশ্রুতির পরিপন্থী যা হবে সেটিই দুঃসংবাদ, সেটিই সমালোচনার বিষয়। তাতে সতর্ক হবেন আপনি, উপকৃত হবে জনগণ। আর বিরোধীদলীয় নেতার কথা বলছেন! তিনি পাঁচ বছরের শাসনামলে যা করেছেন তার প্রতিদান পেয়েছেন বিগত নির্বাচনে। আশা করি, জবাব পেয়েছেন মাননীয় প্রধানমন্ত্রী।
বঙ্গবন্ধু নন্দিনী, অনেক আশা বুকে নিয়ে হৃদয় উজাড় করে এ দেশের মানুষ ভোট দিয়েছিল আপনাকে। তিন-চতুর্থাংশ আসন উপহার দিয়ে পার্লামেন্টে অনেক ভারী করে দিয়েছে আপনার পাল্লা। ফলে আপনার যা খুশি তাই সিদ্ধান্ত নিতে পারেন পার্লামেন্টে। সংসদীয় পার্লামেন্টের জগতে আপনার মতো ভাগ্যবান নেতা খুব কম জন্মেছে পৃথিবীতে। আর সেই সুবাদে আপনিও একটি অপরিণামদর্শী সিদ্ধান্ত নিয়েছেন সংসদে। বলতে গেলে যে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের জননী আপনি, সেই সন্তানকে গলাটিপে হত্যা করলেন স্বহস্তে! মাননীয় প্রধানমন্ত্রী, তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থার ঘোরতর বিরোধী একটি মানুষ আমি। ২০০৪ সালের ২৩ সেপ্টেম্বরের কথা। দৈনিক আমার দেশ পত্রিকা ভূমিষ্ঠ হলো পৃথিবীতে। কর্তৃপক্ষের আগ্রহে আমার একটি বক্ষ্যমাণ নিবন্ধ ছাপা হলো উদ্বোধনী সংখ্যায়। শিরোনাম_ 'রাজনীতি : বাংলাদেশ প্রেক্ষিত'। নিবন্ধের একটি অনুচ্ছেদে বলেছি_ তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা হলো রাজনীতিবিদদের ব্যর্থতার কলঙ্ক তিলক। কলঙ্কের এ চিহ্ন মুছে ফেলতে হবে আমাদের পবিত্র সংবিধান থেকে। আজকে সেই 'আমি' বাধ্য হয়ে বিপরীত কথা বলছি পরিবর্তিত প্রেক্ষাপটে। সরকার এবং বিরোধী পক্ষের অবস্থান বিপরীতমুখী। দুই পক্ষই অনড়, অটল এবং যুদ্ধংদেহী। ক্রমশ উত্তপ্ত হচ্ছে সংঘাতময় পরিস্থিতি। ওয়ান-ইলেভেনের আগে যে অবস্থা বিরাজমান তার চেয়েও অবনতির দিকে ধাবমান বর্তমান সংকট। কোন ধরনের সরকারব্যবস্থার অধীনে হবে আগামী নির্বাচন? এ প্রশ্নের উত্তর মিলছে না আজ অবধি। সরকার বলেছে, বর্তমান নির্বাচিত আওয়ামী লীগের নেতৃত্বাধীন মহাজোট সরকারের অধীনেই হবে আগামী নির্বাচন। আর বিএনপির নেতৃত্বাধীন ১৮ দলীয় জোট বলছে, কোনো অবস্থাতেই দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচনে যাবে না বিরোধী দল। সরকার ইতোমধ্যে পার্লামেন্টে ব্রুট মেজরিটিবলে তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা মুছে ফেলেছে সংবিধান থেকে। সরকারের বক্তব্য, সুপ্রিমকোর্টের আদেশ অনুসারেই তারা সংশোধন করে ফেলেছে সংবিধান। আমার বক্তব্য হলো_ তত্ত্বাবধায়ক সরকার প্রশ্নে সুপ্রিমকোর্টের আদেশে আছে দুটি অংশ। প্রথমটিতে বলা হয়েছে_ তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা সংবিধান পরিপন্থী, তাই বর্জনীয়। দ্বিতীয় অংশে আছে_ বর্তমান রাজনৈতিক প্রেক্ষাপট বিবেচনায় আরও দুই টার্ম রাখা যেতে পারে তত্ত্বাবধায়ক সরকারপদ্ধতি। সুপ্রিমকোর্টের আদেশই যদি পালন করতে হয় তাহলে প্রথমটি পালন করবেন হুবহু, দ্বিতীয়টি নয় কেন? উত্তর সহজবোধ্য। বিশ্লেষণের অপেক্ষা রাখে না মাননীয় প্রধানমন্ত্রী।
বঙ্গবন্ধু তনয়া, আপনার সদয় জ্ঞাতার্থে বলছি, তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা প্রশ্নে আলোচ্য ঐতিহাসিক রায়টি দিয়েছেন সুপ্রিমকোর্টের সদ্য বিদায়ী প্রধান বিচারপতি এবিএম খায়রুল হক। তার একটি সাক্ষাৎকার বাংলাভিশনে প্রচারিত হয়েছে গত ৪ জুন। সাক্ষাৎকারটি গ্রহণ করেছেন বিশিষ্ট তরুণ সাংবাদিক বাংলাভিশনের স্পেশাল করেসপন্ডেন্ট বদরুল আলম নাবির। সাক্ষাৎকারে বিচারপতি খায়রুল হক দ্ব্যার্থহীন কণ্ঠে বলেছেন, তত্ত্বাবধায়ক সরকার সংবিধানের পরিপন্থী হওয়ায় তা পরিত্যাজ্য। তবে বিরাজমান রাজনৈতিক সংকট নিরসনের লক্ষ্যে আরও দুই টার্ম বহাল রাখতে হবে তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী, বিচারপতি খায়রুল হক বিগত ২৯ মার্চ স্বাক্ষর করে ছেড়ে দিয়েছেন ঐতিহাসিক রায়। আজ পর্যন্ত রায়ের কপি এলো না জনসম্মুখে। বিষয়টি কি প্রশ্নবোধক নয়?
মাননীয় প্রধানমন্ত্রী, প্রসঙ্গক্রমে এখানে উল্লেখ করতে চাই একটি ঐতিহাসিক ঘটনা। দ্বিতীয় মহাযুদ্ধে মিত্রশক্তির তিন মহানায়ক চার্চিল, রুজভেল্ট এবং স্টালিন। যুদ্ধ কৌশলের পারদর্শিতা, অসাধারণ মেধা এবং অতুলনীয় নেতৃত্বের কারণে ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী স্যার উইনস্টন চার্চিলের নামটি উচ্চারিত হয় সর্বাগ্রে। যুদ্ধ শেষ। অক্ষশক্তি পরাজিত। সারা বিশ্বে মহাবীরের সম্মানে ভূষিত হলেন চার্চিল। যুদ্ধবিধ্বস্ত ব্রিটেনকে জাতির ঐক্যবদ্ধ শক্তি দিয়ে পুনর্গঠনের লক্ষ্যে একটি জাতীয় সরকার গঠনের ইচ্ছা প্রকাশ করলেন তিনি। তার প্রস্তাবে রাজি হলো না বিরোধীপক্ষ শ্রমিক দল। জাতীয় সরকার গঠিত হলে রক্ষণশীল সরকারি দলের নেতা হিসেবে হয়তো তিনিই হতেন সরকারপ্রধান। এমনটিই প্রত্যাশা করেছিল তার দল। অন্যান্য দল সম্মতি দিয়েছিল চার্চিলের প্রস্তাবে। কিন্তু যেহেতু সম্মত হলো না বিরোধী পক্ষ, তাই চার্চিল বিনা দ্বিধায় প্রত্যাহার করে নিলেন জাতির জন্য মঙ্গলকামী তার শুভ প্রস্তাব। এরপর হলো নির্বাচন। চার্চিল পার্লামেন্টে এলেও সরকার গঠন করতে পারেনি তার কনজারভেটিভ পার্টি। ১৯৪১ থেকে ১৯৪৫ সাল পর্যন্ত যুদ্ধের পুরো সময় তিনি ছিলেন প্রধানমন্ত্রী। আবার ১৯৫১ সালে তিনি দ্বিতীয়বারের মতো প্রধানমন্ত্রী হলেন ব্রিটেনের। ব্রিটেনবাসী চার্চিলের তীব্র অভাব অনুভব করেছে পাঁচ বছর। তাই তার দলকে ভোট দিয়ে আবার '৫১ সালে স্যার চার্চিলকে প্রধানমন্ত্রী হিসেবে দেখে অপূর্ণ সাধ পূরণ করল ব্রিটেনবাসী। ১৯৫৩ সালে চার্চিল পেলেন সাহিত্যে নোবেল পুরস্কার। পাঁচ বছর প্রধানমন্ত্রিত্বের বাইরে থাকাকালীন তিনি রচনা করেছেন দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের ছয় খণ্ড ইতিহাস। এ ছাড়াও তার রয়েছে অনেক উপন্যাস, ছোট গল্প এবং প্রবন্ধ পুস্তক। তিনিই পৃথিবীর একমাত্র রাজনীতিবিদ যিনি সাহিত্যে পেয়েছেন নোবেল পুরস্কার।
মাননীয় প্রধানমন্ত্রী, পলিটিশিয়ান হিসেবে সাধারণত কেউ আখ্যায়িত করে না স্যার উইনস্টন চার্চিলকে। তিনি ছিলেন সব সংকীর্ণতার ঊধের্্ব। তাই তিনি শত্রু-মিত্র সবার কাছে হয়ে উঠেন স্টেটসম্যান। পৃথিবীর ইতিহাসে আমরা স্টেটসম্যান হিসেবে দেখেছি মহাত্দা মোহনদাস করমচাঁদ গান্ধীকে, দেখেছি জওয়াহেরলাল নেহেরু এবং ইন্দিরা গান্ধীকে। দেখেছি আব্রাহাম লিংকন, জর্জ ওয়াশিংটনকে। আরও দেখেছি নেলসন ম্যান্ডেলা, মাহাথির মোহাম্মদকে। সর্বশেষ আমরা দেখেছি আপনার বাবা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে। আপনি তো তারই সুযোগ্য কন্যা। পৃথিবীতে অনেক বড় বাবার সন্তান পিতার চেয়ে হয়েছে খ্যাতিমান। সম্রাট শাহজাহানের চেয়ে খ্যাতি পেয়েছেন তার পুত্র আওরঙ্গজেব, হুমায়ুনের চেয়ে আকবর। ষোড়শ শতাব্দীতে ইংল্যান্ডের দোর্দণ্ড প্রতাপশালী রাজা অষ্টম হেনরীর চেয়ে খ্যাতির শীর্ষে উঠেছেন তার কন্যা রানী এলিজাবেথ। পঁয়তালি্লশ বছর একনাগাড়ে ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের অধীশ্বরী ছিলেন চিরকুমারী রানী এলিজাবেথ। শুধু রাজ সিংহাসনে উপবিষ্ট থাকার কারণেই খ্যাতিমান হননি তারা। রাজশক্তি প্রয়োগ করে বাড়িয়েছেন রাজ্য সীমানা। আর সাম্রাজ্যের অখণ্ডতা ধরে রাখার জন্য হৃদয় দিয়ে জয় করেছেন প্রজাসাধারণের হৃদয়। শক্তি দিয়ে বিজয় অর্জন করলে তা হয় ক্ষণস্থায়ী। হৃদয় দিয়ে যে জয় তা হয় দীর্ঘস্থায়ী। হিংসা-বিদ্বেষ কিংবা ষড়যন্ত্র কোনোদিন, কোনো কালে বয়ে আনতে পারে না মানব কল্যাণ। প্রতিহিংসা ডেকে আনে প্রতিহিংসা, ষড়যন্ত্র সৃষ্টি করে ষড়যন্ত্র, ভালোবাসা জন্ম দেয় ভালোবাসা।
মাননীয় প্রধানমন্ত্রী, 'অনুরাগ বা বিরাগের বশবর্তী না হইয়া সকলের প্রতি আইন অনুযায়ী যথাবিহীত আচরণ করিব'_ প্রধানমন্ত্রিত্ব গ্রহণকালে উচ্চারিত এই শপথবাক্য জাতির চলমান সংকটকালে অক্ষরে অক্ষরে আপনি দয়া করে পালন করবেন এবং বিরোধী দলকে সঙ্গে নিয়ে একটি গ্রহণযোগ্য ফর্মুলায় আগামী নির্বাচন অনুষ্ঠানের দ্রুত প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করবেন_ আপনার কাছে আমার এটি বিনয়াবনত প্রত্যাশা। তাহলে আপনার বাবার মতো আপনিও স্টেটসম্যান হিসেবে ওঠে যাবেন খ্যাতির এভারেস্ট চূড়ায়। আর এমনটি যদি আপনি করতে ব্যর্থ হন তাহলে দেশের পথচলা আবার শুরু হতে পারে অসাংবিধানিক পথে।
লেখক : কথাসাহিত্যিক ও রাজনীতিবিদ।
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন