বৃহস্পতিবার, ১৪ জুন, ২০১২

জিয়ার আদর্শিক রাজনীতির প্রয়োজনীয়তা



মো. বেলায়েত হোসেন
১৯৭৫ সালের ৭ নভেম্বর এক অনিবার্য রাজনৈতিক বাস্তবতায় রাজনীতিতে আবির্ভাব ঘটে জিয়াউর রহমানের। এর আগে ১৯৭১ সালের ২৬ মার্চ জাতির এক কিংকর্তব্যবিমূঢ় অবস্থায় বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণার মাধ্যমে ইতিহাসে স্থান করে নেন জিয়াউর রহমান। স্বাধীনতার ঘোষণার মাধ্যমে জিয়া দৃশ্যত একজন রাজনৈতিক ব্যক্তিত্বে পরিণত হন এবং মাত্র কয়েক বছরে বাংলাদেশের প্রেসিডেন্ট হওয়ার গৌরব অর্জন করেন। কীভাবে তিনি স্বল্প সময়ে একটি বিধ্বস্ত রাষ্ট্রকে উন্নতির শিখরে নিয়ে যেতে সক্ষম হলেন, তা অন্তর্দৃষ্টিসম্পন্ন মানুষের কাছে রীতিমত বিস্ময়! দার্শনিক ও রাষ্ট্রনায়কোচিত চিন্তা ছাড়া এটি কোনোভাবেই সম্ভব নয়। কর্মোদ্যোগই ইতিহাসে একজন সরকার প্রধানকে রাষ্ট্রনায়কের আসনে অধিষ্ঠিত করে।
জিয়াউর রহমান বাংলাদেশের জন্য রেখে গেছেন এক স্বর্ণোজ্জ্বল ইতিহাস। তার আদর্শ, সততা, কর্মোদ্যোগ ও চিন্তা-চেতনা মিলেমিশে একাকার হয়ে আছে আমাদের জাতীয় জীবনে। বর্তমান ক্রান্তিকালে জিয়ার রাজনীতির প্রয়োজনীয়তা বাংলাদেশ গভীরভাবে অনুভব করছে। জিয়ার আদর্শিক রাজনীতিই চলমান সঙ্কট থেকে বাংলাদেশকে রক্ষা করতে পারে।
জাতিকে বড় করার সবগুণ জিয়ার মধ্যে ছিল। তিনি মানুষকে উদ্বুদ্ধ করেছেন বড় কিছু করতে। তার চিন্তা ছিল সুদূরপ্রসারী। জিয়া বাংলাদেশের রাজনীতি ও অর্থনীতির গতিপথ পরিবর্তন করেন। বাংলাদেশের তৈরি পোশাক শিল্প, জনশক্তি রফতানি, কৃষি উত্পাদন বৃদ্ধিতে জিয়ার সুস্পষ্ট অবদান রয়েছে। জিয়াই বাংলাদেশকে তলাবিহীন ঝুড়ির বদনাম থেকে মুক্ত করেন।
নৃতাত্ত্বিক ও আদর্শিক চেতনামিশ্র স্বতন্ত্র রূপ ও পরিচয় রাষ্ট্রীয়ভাবে বিশ্বের সামনে তুলে ধরতে জিয়া প্রবর্তন করেন নতুন রাজনৈতিক দর্শন ‘বাংলাদেশী জাতীয়তাবাদ’। এটি বাংলাদেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের ইতিহাসবোধ, অনুভূতি ও বিশ্বাসকে নাড়া দিয়েছে এবং প্রতিনিয়ত দিচ্ছে।
জিয়ার রাজনৈতিক দর্শনে একটি মধ্যপন্থী জাতি গঠনের সব উপাদান সন্নিবেসিত আছে। জিয়া যে একজন সত্যিকারের দার্শনিক ছিলেন, এর যথাযথ প্রতিফলন তার বাংলাদেশী জাতীয়তাবাদে খুঁজে পাওয়া যায়। জিয়া অনেক দূরের স্বপ্ন দেখেছিলেন, অন্তত ৫০ বছরের দূরের স্বপ্ন। জিয়ার দূরের স্বপ্নের ফসল হলো—বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল বিএনপি। বিএনপি প্রকৃতপক্ষেই একটি দর্শনভিত্তিক রাজনৈতিক দল।
হানাহানি, অনৈক্য ও বিভাজন চতুর্দিক দিয়ে দেশকে যখন গ্রাস করেছিল, ঠিক তখন এই ‘বাংলাদেশী জাতীয়তাবাদ’ জাতিকে ঐক্যবদ্ধ করেছিল; রাজনীতিবিদদের মধ্যে তৈরি করেছিল দেশ গড়ার এক অনবদ্য সোপান। জিয়া উপলব্ধি করেছিলেন, যুদ্ধবিধ্বস্ত সদ্য-স্বাধীন একটি দেশকে গড়তে হলে সর্বাগ্রে প্রয়োজন জাতীয় ঐক্য; ঐক্যছাড়া এটি কোনোভাবেই সম্ভব নয়, আর এই ঐক্য তৈরি হতে পারে একটি সার্বজনীন দর্শনের মাধ্যমে। ‘বাংলাদেশী জাতীয়তাবাদ’ সদ্য-স্বাধীন রাষ্ট্রের জন্য গবেষণালব্ধ ও সুদূরপ্রসারী চিন্তার একটি ফসল। এটি তত্কালীন বহুধাবিভক্ত এই জাতিকে ঐক্যবদ্ধ করেছিল, দূর করেছিল সব বিভাজন ও অনৈক্য।
নিজেকে এবং জাতিকে বড় করতে সব শক্তির ব্যবহার চাই—ইচ্ছাশক্তি, কল্পনাশক্তি, মেধাশক্তি, দৈহিকশক্তি ও মানসিক শক্তিসহ সবশক্তির। আর একটি সর্বগ্রহণযোগ্য দর্শনই পারে মানুষের সব অন্তর্নিহিত শক্তিকে জাগিয়ে তুলতে। জিয়া এই কাজটিই করেছিলেন অত্যন্ত সফলভাবে।
প্রতিটি সাধনা ও পরিশ্রমের সঙ্গে দর্শনের সংযোগ থাকে। এ সংযোগ একযোগে না হলে কাজে সফলতা আসে না। জিয়ার জ্ঞান-বিজ্ঞান ও দর্শন চিন্তার সঙ্গে যোগ স্থাপিত হয়েছিল এদেশের ছাত্র-তরুণ-যুবকসহ সব বয়সের এবং সব শ্রেণী-পেশার মানুষের। ফলে সবাই ‘১৯ দফা কর্মসূচি নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়েছিল দেশ গড়ার কাজে, দূর হয়ে গিয়েছিল সব বিভাজন ও অনৈক্য; সফলতাও এসেছিল খুব দ্রুত, এখানেই জিয়ার রাষ্ট্রনায়কোচিত ও দার্শনিক চিন্তার সার্থকতা।
স্বনির্ভর দেশ গড়তে এবং মানুষের জীবনে অর্থনৈতিক মুক্তি আনতে জিয়া ঘোষণা করেন ১৯ দফা কর্মসূচি। আমাদের কৃষিভিত্তিক সভ্যতার নিজস্ব স্বকীয়রূপ ফুটে উঠেছিল জিয়ার ১৯ দফা কর্মসূচির মাধ্যমে। তিনি গ্রামের পর গ্রাম, মাইলের পর মাইল হেঁটেছেন। নিজের হাতে কোদাল তুলে নিয়েছেন, খনন করেছেন খাল; তার দুই হাতের ছোঁয়ায় ফসলে ফসলে মাঠ ভরপুর হয়ে উঠেছিল, ঘটেছিল কৃষি বিপ্লব।
তলাবিহীন ঝুড়ির উপাধি পাওয়া দেশ পরিণত হয়েছিল ফুলে ফলে ও ফসলে ভরপুর এক দেশে, মানুষ পরিণত হয়েছিল কর্মমুখী মানুষে; গ্রামে গ্রামে সৃষ্টি হয়েছিল সামাজিক নেতৃত্ব। স্বনির্ভর গ্রাম ও স্বনির্ভর দেশ গড়তে জিয়ার ১৯ দফা কর্মসূচি এবং তার কর্মস্পৃহা বাংলাদেশের রাজনীতির ইতিহাসের পৃষ্ঠাকে অনেকটা উজ্জ্বল করে রেখেছে।
নির্দিষ্ট কোনো একটি ভাষা বা জাতিকে অথবা ধর্মকে প্রাধান্য দিয়ে সদ্য-স্বাধীন দেশে ‘জাতীয় ঐক্য’ প্রতিষ্ঠা করা কোনোভাবেই সম্ভব নয়। উদাহরণ, ১৯৭২ সালের সংবিধানে কোনো একটি ভাষা ও জাতিকে প্রাধান্য দেয়ায়; বাংলাদেশের এক-দশমাংশ এলাকা হাতছাড়া হওয়ার উপক্রম হয়েছিল।
জিয়ার দর্শন চিন্তা ও তার স্বপ্ন আজ ৩৫ বছর পর একশ’ ভাগ সফল প্রমাণিত হয়েছে। মুষ্টিমেয় কিছু লোক বাদে এদেশের প্রায় সব মানুষই জিয়ার রাজনৈতিক দর্শন ‘বাংলাদেশী জাতীয়তাবাদ’কে বাংলাদেশের ভৌগোলিক ও রাজনৈতিক বাস্তবতায় একটি কার্যকর রাজনৈতিক দর্শন হিসেবে মেনে নিয়েছে। আর এতেই প্রমাণিত হয়, জিয়া একজন সত্যিকারের দার্শনিক ছিলেন।
জিয়ার দর্শনের রাজনৈতিক গুরুত্ব বরাবরই উপেক্ষিত হয়েছে। একটি নতুন দর্শন হিসেবে এর যথাযথ রাজনৈতিক পৃষ্ঠপোষকতা হয়নি। গণমাধ্যমে এই দর্শনে বিশ্বাসী মানুষের সংখ্যা নেই বললেই চলে। অথচ বিএনপির হাত ধরেই বাংলাদেশের গণমাধ্যম আজ এ পর্যায়ে এসেছে।
একটি বৃহত্ রাজনৈতিক দল হিসেবে এখানে বিএনপির শক্তিশালী প্রভাব থাকা প্রয়োজন। আর এ ভূমিকা পালন করতে হলে জিয়ার দর্শনে বিশ্বাসী কিছু পরিপকস্ফ মানুষ তৈরি করা আবশ্যক।
রাজনৈতিক দলের কর্মী হওয়ার জন্য রয়েছে যুিক্ত ও ভিত্তি। আর এ যুিক্তর ভিত্তিটা হলো অপরাপর বিরোধী রাজনৈতিক দলের দর্শনকে যথাযথভাবে যুক্তি ও কর্মসূচিসহ মোকাবিলা করে স্বীয় জীবনবোধের আলোকে সমাজ ও জাতিকে গড়ে তোলা। তাতে মানুষের মধ্যে একটি সুষ্ঠু-সুন্দর চেতনাবোধ তৈরি হয়, তৈরি হয় যুগপোযোগী চিন্তা-চেতনা। দলের প্রত্যেকটি কর্মীকেই তার মতো করে গড়ে তুলতে সদা-সর্বদা সচেষ্ট ছিলেন জিয়া। এটি জিয়ার একটি সুদূরপ্রসারী স্বপ্নও ছিল। জিয়ার এই স্বপ্ন বাস্তবায়নের মধ্য দিয়েই তার প্রতি যথাযথ সম্মান ও কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করা সম্ভব।
স্বপ্ন নয় বাস্তবে, বক্তৃতা নয় কাজে; রাজনৈতিক প্রতিহিংসা নয়, স্থিতিশীল রাজনৈতিক পরিবেশ সৃষ্টির মাধ্যমে আমরা আমাদের দেশকে গড়ে তুলতে পারি। এর জন্য গগনের মতো উদারতা, সাগরের মতো বিশালতা ও জমিনের মতো প্রশস্ত মন নিয়ে রাজনীতিবিদদের এগিয়ে আসতে হবে। বাংলাদেশের গর্ব করার মতো অর্জনগুলোকে উন্নয়নের শীর্ষে নিয়ে যেতে সবাইকে জিয়ার মতো দেশপ্রেম ও দায়িত্বশীল ভূমিকা পালন করতে হবে। জিয়ার মতো মাঠে-ঘাটে ঘুরে সুদূরপ্রসারী পর্যালোচনা-বিশ্লেষণ ও নানামুখী গবেষণা চালিয়ে উন্নয়ন পরিকল্পনা গ্রহণ করতে হবে। তাহলেই বাংলাদেশ তার কাঙ্ক্ষিত লক্ষ্যে পৌঁছে যাবে, বাংলাদেশ হবে স্বনির্ভর সমৃদ্ধিশালী ও মধ্যম আয়ের দেশ।
৭০-এর দশকের গোড়ায় পর্যন্ত সদ্য-স্বাধীন দেশের তত্কালীন সরকার বিতর্কিত সংবিধান প্রণয়ন, একদলীয় বাকশালের প্রবর্তন ও রক্ষীবাহিনী গঠনসহ আরও নানা বিতর্কিত কাজের মাধ্যমে জাতীয় ঐক্যকে ভেঙে চুরমার করে দিয়েছিল। দেশ গভীর অন্ধকারে নিমজ্জিত হয়েছিল। জিয়ার রাজনীতি এই অন্ধকার দূর করে জাতিকে আশার আলো দেখিয়েছে। বর্তমানেও একই পরিস্থিতি দেশে বিরাজ করছে। সর্বক্ষেত্রেই দেশ এক ভয়াবহ অনৈক্য ও বিভাজনের দিকে ধাবিত হচ্ছে, জাতীয় পর্যায়ে তৈরি করা হচ্ছে শুধু ক্ষত আর ক্ষত; যার চূড়ান্ত পরিণতি রাষ্ট্রের জন্য কখনও সুখকর হবে না।
এ থেকে পরিত্রাণের পথ একটাই—জিয়ার আদর্শ ও দর্শন। দেশের ক্রান্তিকালে জিয়ার ‘বাংলাদেশী জাতীয়তাবাদ’
একটি শক্তিশালী অবলম্বন। জিয়ার আদর্শ জানতে হবে এবং
মানতে হবে।
লেখক : কলামিস্ট ও রাজনৈতিক বিশ্লেষক
belaYet_1@yahoo.com

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন