সৈয়দ জিয়াউর রহমান
আমেরিকার একটি বিশিষ্ট দৈনিক পত্রিকা ‘শিকাগো ট্রিবিউন’-এর ওয়াশিংটন সংবাদদাতা হাওয়ার্ড ডেভিস এক সময় ভারতের দিল্লিতে ছিলেন এবং সেই সুবাদে তিনি ইন্টারনেটে ভারত-বাংলাদেশের পত্র-পত্রিকা পড়েন। আমার সঙ্গে তার প্রায়ই দেখা হয় ওয়াশিংটনের উপকণ্ঠে একটি বিপণি বিতানে এবং দেখা হলেই তিনি বাংলাদেশ-ভারতের নানা ঘটনা-পরিস্থিতি নিয়ে কথা বলেন। এবার তিনি প্রশ্ন তুললেন, বাংলাদেশের কিছু নেতা-নেত্রীর রাজনৈতিক প্রজ্ঞা নিয়ে, তাদের বক্তব্যের ওজন নিয়ে। এ প্রসঙ্গে বললেন, ‘তারা কি করে ভাবতে পারেন—স্যান্ডউইচ আর ওয়াইন খেয়ে নোবেল পুরস্কার অর্জন সম্ভব?’ আসলে তিনি ইন্টারনেটে ঢাকার ডেইলি স্টার পত্রিকার একটি খবর পড়েছেন, যাতে ছিল নোবেল জয়ী ডক্টর মুহাম্মদ ইউনূসকে ব্যঙ্গ করে স্থানীয় সরকারমন্ত্রী ও ক্ষমতাসীন দলের সাধারণ সম্পাদক সৈয়দ আশরাফুল ইসলামের কিছু মন্তব্য। আমিও পড়েছি ইন্টারনেটে বাংলাদেশের প্রধান ইংরেজি বাংলা পত্র-পত্রিকায় এই খবর।
সৈয়দ আশরাফের বাবা সৈয়দ নজরুল ইসলাম ছিলেন আমার পরম শ্রদ্ধেয় ও অত্যন্ত প্রিয় শিক্ষক। আজ থেকে ৬২ বছর আগে ১৯৫০ সালে আমি ছিলাম ময়মনসিংহে আনন্দ মোহন কলেজের ছাত্র এবং সৈয়দ নজরুল ইসলাম ছিলেন আমাদের ইতিহাসের শিক্ষক। সৈয়দ আশরাফ সম্ভবত তখনও ভূমিষ্ঠ হননি। সৈয়দ নজরুল ইসলামের অন্যতম ঘনিষ্ঠ ও স্নেহধন্য ছাত্র হিসেবে অত্যন্ত কাছে থেকে তাকে দেখার যে সুযোগ হয়েছে তাতে দেখেছি, তিনি ছিলেন খুবই উঁচুমানের একজন শিক্ষক ছাড়াও ভদ্র, মার্জিত, অমায়িক ও পরিশীলিত অনন্য এক ব্যক্তিত্বের অধিকারী। পরবর্তীকালে রাজনৈতিক জীবনেও তার এই চারিত্রিক মাধুর্য অটুট ছিল। ৯ মাসের মুক্তিযুদ্ধকালে এবং স্বাধীনতা-উত্তরকালে অস্থায়ী রাষ্ট্রপতির দায়িত্ব পালনের সময়ও তার চারপাশের সবাই তার মার্জিত, পরিশীলিত আচার-আচরণে মুগ্ধ হয়েছেন।
এই অসাধারণ মানুষটির ছেলে হিসেবে সৈয়দ আশরাফুল ইসলামের নাম যেদিন পত্র-পত্রিকায় দেখলাম এবং জানলাম যে, তিনি বাংলাদেশের নতুন মন্ত্রিসভায় একজন বিশিষ্ট মন্ত্রী ছাড়াও ক্ষমতাসীন দলের একটি গুরুত্বপূর্ণ নেতৃত্বে অধিষ্ঠিত হতে যাচ্ছেন সেদিন যথার্থই খুশি হয়েছিলাম ও উত্সাহিত বোধ করেছিলাম। কিন্তু সাম্প্রতিককালে তার কিছু কিছু বক্তৃতা-বিবৃতিতে আমি খুবই হতাশ হয়েছি এবং এগুলো নিয়ে দেশ-বিদেশে যথেষ্ট বিতর্কেরও সৃষ্টি হয়েছে।
সৈয়দ আশরাফ নোবেল শান্তি পুরস্কার বিজয়ী ও গ্রামীণ ব্যাংকের প্রতিষ্ঠাতা ডক্টর মুহাম্মদ ইউনূসের নোবেল জয়ের সমালোচনা করে জানতে চেয়েছেন, তিনি কোথায় কোন যুদ্ধে শান্তি স্থাপন করেছেন? সৈয়দ আশরাফের হয়তো জানা নেই। ১৯০১ সালে নোবেল শান্তি পুরস্কার প্রবর্তনের সময় থেকে এ পর্যন্ত যে ৯০ জনেরও বেশি নোবেল শান্তি পুরস্কার পেয়েছেন তাদের অধিকাংশই এই পুরস্কার বিজয়ী হন কোন যুদ্ধেই শান্তি স্থাপন না করে। তারা শান্তি পুরস্কার লাভ করেন নানা জনকল্যাণমুখী কার্যক্রমের দ্বারা শান্তির পথ প্রশস্ত করে। ১৯০১ সালে প্রথম নোবেল শান্তি পুরস্কার পান সুইজারল্যান্ডের হেনরি ডুনান্ট রেডক্রস প্রতিষ্ঠান স্থাপনের জন্য, ১৯৬৪ সালে মার্টিন লুথার কিং এই পুরস্কার অর্জন করেন কৃষ্ণাঙ্গদের অধিকার আদায়ের অহিংস আন্দোলনের জন্য, ১৯৭০ সালে নরম্যান বরলগ উন্নতমানের ও অধিক ফলনক্ষম গম উত্পাদন ব্যবস্থা প্রবর্তন করে, ১৯৭৯ সালে মাদার তেরেসা আর্তমানবতার সেবায়, ১৯৯১ সালে বার্মার অংসান সু চি গণতান্ত্রিক অধিকার আন্দোলনের জন্য, ১৯৯৩ সালে নেলসন ম্যান্ডেলা বর্ণবাদের অবসান ঘটিয়ে, ২০০২ সালে সাবেক প্রেসিডেন্ট জিমি কার্টার ও ২০০৩ সালে ইরানের শিরিন এবাদি মানবাধিকার আন্দোলনে, ২০০৭ সালে যুক্তরাষ্ট্রের সাবেক ভাইস প্রেসিডেন্ট আল গোর আবহাওয়া পরিবর্তনের মুখে করণীয় ব্যবস্থা গ্রহণের ক্ষেত্রে অনন্য অবদানের জন্য এবং অতিসম্প্রতি ২০১১ সালে আরব সমাজসেবী তাওয়াক্কাল কায়মান ও অপর দুই মহিলা নোবেল শান্তি পুরস্কার বিজয়ী হন নারী অধিকার প্রতিষ্ঠার আন্দোলনে। এছাড়া ২৩টি প্রতিষ্ঠানকে নোবেল শান্তি পুরস্কার দেয়া হয় মানবাধিকার, আর্ত মানবতার সেবা ও জনকল্যাণ প্রচেষ্টার কারণে। তাদের কারোরই কোনো যুদ্ধে শান্তি স্থাপন করতে হয়নি।
সৈয়দ আশরাফ ডক্টর ইউনূসের সমালোচনা করতে গিয়ে বলেছেন, তিনি অর্থনীতির ছাত্র হয়েও অর্থনীতিতে নোবেল পুরস্কার পেলেন না, পেলেন শান্তিতে। অর্থাত্ কথাটা এমন যে, অর্থনীতির তুলনায় শান্তিতে নোবেল নিম্নমানের এবং ডক্টর ইউনূস অর্থনীতিতে না পেয়ে একধাপ নিচের সম্মান পেয়েছেন! এ ক্ষেত্রেও সৈয়দ আশরাফের নোবেল পুরস্কার সম্পর্কে জানা-শোনার ঘাটতি সুস্পষ্ট। তার জেনে রাখা ভালো, বিজ্ঞানী আলফ্রেড নোবেলের উইল অনুসারে ১৯০১ সাল থেকে নোবেল পুরস্কার দেয়া হচ্ছে পাঁচটি ক্ষেত্রে— পদার্থ বিজ্ঞান, রসায়ন বিজ্ঞান, চিকিত্সা বিজ্ঞান, শান্তি ও সাহিত্যে। তার মধ্যে বিশ্ববাসী, প্রতি বছর অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করে শান্তি ও সাহিত্যে নোবেল পুরস্কার বিজয়ীর নাম শোনার জন্য। অর্থনীতিতে নোবলে পুরস্কার দেয়া শুরু হয় ১৯৬৯ সালে এবং তার অর্থায়ন আলফ্রেড নোবেলের রেখে যাওয়া সম্পদ থেকে করা হয় না। অর্থনীতিতে নোবেল পুরস্কারের অর্থ আসে সুইডেনের কেন্দ্রীয় ব্যাংক ‘রিকস্ ব্যাংক’ থেকে। ১৯৯২ সাল থেকে অর্থনীতিতে নোবেল পুরস্কারের নামকরণ করা হয়েছে—‘আলফ্রেড নোবেল স্মরণে অর্থনীতিতে রিকস্ ব্যাংক পুরস্কার।’ নরওয়ে ও সুইডেনের বেশ কিছু বুদ্ধিজীবী অর্থনীতির পুরস্কারকে নোবেল পুরস্কার নামকরণের বিরোধী। তাদের একজন আলফ্রেড নোবেলের প্রপৌত্র সুইডেনের প্রখ্যাত মানবাধিকার আইনজ্ঞ পিটার নোবেল।
সৈয়দ আশরাফ আরও বলেছেন, চিজ, স্যান্ডউইচ ও হোয়াইট ওয়াইন খেয়ে নোবেল পুরস্কার অর্জন করা চলে। দৈনিক প্রথম আলো পত্রিকায় এই সংবাদ সম্পর্কে পাঠকরা যেসব মন্তব্য করেছেন তার একটিতে একজন বলেছেন, তাহলে সৈয়দ আশরাফুল ইসলাম নিজে স্যান্ডউইচ, ওয়াইন খেয়ে দেড়শ’ কোটি টাকার নোবেল পুরস্কার লাভ করেন না কেন! আসলে তার এটা বোঝা উচিত যে, নোবেল পুরস্কার বাছাই করেন যে কমিটি তাদের কাছে চিজ, স্যান্ডউইচ নিয়ে কোন স্বার্থ উদ্ধার সম্ভব নয়। কারণ তা না হলে দীর্ঘ একশ’ বছরেরও বেশি সময় ধরে নোবেলের বিশ্বব্যাপী এই মর্যাদা ধরে রাখা সম্ভব হতো না।
সৈয়দ আশরাফ নোবেল পুরস্কারকে নিম্নমানের প্রমাণিত করার জন্য আয়ারল্যান্ডের যে দুই মহিলা পুরস্কার বিজয়ী ও তাদের প্রতিষ্ঠানের নাম উল্লেখ করেছেন তাতেও তার উপস্থাপিত তথ্যের গুরুতর ত্রুটি রয়েছে। ১৯৭৬ সালের নোবেল শান্তি পুরস্কার বিজয়ী আয়ারল্যান্ডের মেরিড করিগ্যান ও বেটি উইলিয়ামসের প্রতিষ্ঠানের নাম ‘মাদারল্যান্ড পিস’ নয়, তাদের প্রতিষ্ঠানের নাম প্রথমে ছিল ‘নর্দার্ন আয়ারল্যান্ড পিস মুভমেন্ট’ এবং পরে তা করা হয় ‘কম্যুনিটি অব পিস পিপল’। এছাড়া এই দুই পুরস্কার বিজয়ী তাদের পুরস্কারের অর্থ ভাগ করা নিয়ে কলহে লিপ্ত হন ও পরে তা আদালত পর্যন্ত গড়ায় বলে সৈয়দ আশরাফ যে গল্প ফেঁদেছেন তা সম্পূর্ণ ভিত্তিহীন। প্রথমত, কোনো নোবেল পুরস্কার যখন একাধিক ব্যক্তিকে দেয়া হয় তখন তা সমান ভাগ করেই নোবেল প্রতিষ্ঠানের পক্ষ থেকে যার যার যে পরিমাণ অর্থ প্রাপ্য তা-ই দেয়া হয়। সেখানে অর্থ নিয়ে দ্বন্দ্ব-কলহের কোনোই অবকাশ থাকে না। দ্বিতীয়ত, এই দুই মহিলা করিগ্যান ও উইলিয়ামস একে অপরের বিরুদ্ধে আদালতে যাওয়া দূরের কথা, এর দীর্ঘকাল পরেও ২০০৬ সালে নোবেলজয়ী শিরিন এবাদি, এডি উইলিয়ামস, ওয়াংগারি মাথাই, রিগোবার্তা মেনচু প্রমুখকে নিয়ে বিশ্বব্যাপী নারী অধিকার সম্পর্কে সচেতনতা সৃষ্টির উদ্দেশ্যে ‘নোবেল উইমেনস, ইনিশিয়েটিভ’ নামে একটি আন্দোলন-সংস্থা গড়ে তোলেন। সৈয়দ আশরাফ ঢাকায় তার ভাষণে নোবেল পুরস্কারকে ব্যঙ্গ করে বলেছেন, ‘নোবেল পুরস্কার কীভাবে দেয়া হয়, আপনারা তা জানেন!’ সত্যি কথা, সবাই জানেন, দুঃখের বিষয়, জানেন না কেবল সৈয়দ আশরাফুল ইসলাম। তিনি আরও জানেন না, ডক্টর মুহাম্মদ ইউনূস নিজের দেশে তাদের কাছে অসম্মানিত হলেও সম্মানিত বিশ্বব্যাপী। একথা আজ আর অস্বীকার করার উপায় নেই, বহির্বিশ্বে বাংলাদেশের এখন পরিচয় ‘নোবেল জয়ী ডক্টর ইউনূসের দেশ’ হিসেবে। ভয়েস অব আমেরিকা থেকে বেশ কয়েকবার আমাকে জাতিসংঘে যেতে হয়েছে নিউইয়র্ক থেকে সাধারণ পরিষদের অধিবেশনের খবরাখবর পরিবেশনের জন্য। সেখানে একবার ব্রাজিল ও আর্জেন্টিনার দুই সাংবাদিকের সঙ্গে আমার আলাপ হয়েছিল। তারা বলেছিলেন, বাংলাদেশ তাদের কাছে পরিচিত সেখানকার ক্ষুদ্রঋণ ব্যবস্থার উদ্যোক্তা নোবেল জয়ী মুহাম্মদ ইউনূসের নাম জেনে। তারা আরও বলেছিলেন, তাদের দেশেও এই ক্ষুদ্রঋণ ব্যবস্থা অনুসরণের আগ্রহ সৃষ্টি হয়েছে। এছাড়া সম্প্রতি স্কুলের ৬ষ্ঠ গ্রেডের পড়ুয়া আমার নাতনীকে আমেরিকায় প্রকাশিত একটি এনসাইক্লোপেডিয়া উপহার দেয়া হয়েছিল। তাতে বাংলাদেশের পরিচয় তুলে ধরা হয়েছে ডক্টর ইউনূসের দেশ হিসেবে।
সুতরাং বোঝা উচিত যে, বিশ্ব যেখানে ডক্টর ইউনূসকে সম্মানিত করছে সেখানে বাংলাদেশে তার অবমাননা হলে বাইরের দুনিয়ার সামনে নিজের দেশকেই হেয় প্রতিপন্ন করা হবে।
জ্ঞান-তাপস ডক্টর মুহম্মদ শহীদুল্লাহ একবার বলেছিলেন, ‘যে-দেশ তার গুণী মানুষকে সম্মান করতে জানে না সে দেশে গুণী মানুষেরই জন্ম হয় না।’
লেখক : সাংবাদিক ও ভয়েস অব আমেরিকার বাংলা বিভাগের সাবেক সিনিয়র এডিটর
সৈয়দ আশরাফের বাবা সৈয়দ নজরুল ইসলাম ছিলেন আমার পরম শ্রদ্ধেয় ও অত্যন্ত প্রিয় শিক্ষক। আজ থেকে ৬২ বছর আগে ১৯৫০ সালে আমি ছিলাম ময়মনসিংহে আনন্দ মোহন কলেজের ছাত্র এবং সৈয়দ নজরুল ইসলাম ছিলেন আমাদের ইতিহাসের শিক্ষক। সৈয়দ আশরাফ সম্ভবত তখনও ভূমিষ্ঠ হননি। সৈয়দ নজরুল ইসলামের অন্যতম ঘনিষ্ঠ ও স্নেহধন্য ছাত্র হিসেবে অত্যন্ত কাছে থেকে তাকে দেখার যে সুযোগ হয়েছে তাতে দেখেছি, তিনি ছিলেন খুবই উঁচুমানের একজন শিক্ষক ছাড়াও ভদ্র, মার্জিত, অমায়িক ও পরিশীলিত অনন্য এক ব্যক্তিত্বের অধিকারী। পরবর্তীকালে রাজনৈতিক জীবনেও তার এই চারিত্রিক মাধুর্য অটুট ছিল। ৯ মাসের মুক্তিযুদ্ধকালে এবং স্বাধীনতা-উত্তরকালে অস্থায়ী রাষ্ট্রপতির দায়িত্ব পালনের সময়ও তার চারপাশের সবাই তার মার্জিত, পরিশীলিত আচার-আচরণে মুগ্ধ হয়েছেন।
এই অসাধারণ মানুষটির ছেলে হিসেবে সৈয়দ আশরাফুল ইসলামের নাম যেদিন পত্র-পত্রিকায় দেখলাম এবং জানলাম যে, তিনি বাংলাদেশের নতুন মন্ত্রিসভায় একজন বিশিষ্ট মন্ত্রী ছাড়াও ক্ষমতাসীন দলের একটি গুরুত্বপূর্ণ নেতৃত্বে অধিষ্ঠিত হতে যাচ্ছেন সেদিন যথার্থই খুশি হয়েছিলাম ও উত্সাহিত বোধ করেছিলাম। কিন্তু সাম্প্রতিককালে তার কিছু কিছু বক্তৃতা-বিবৃতিতে আমি খুবই হতাশ হয়েছি এবং এগুলো নিয়ে দেশ-বিদেশে যথেষ্ট বিতর্কেরও সৃষ্টি হয়েছে।
সৈয়দ আশরাফ নোবেল শান্তি পুরস্কার বিজয়ী ও গ্রামীণ ব্যাংকের প্রতিষ্ঠাতা ডক্টর মুহাম্মদ ইউনূসের নোবেল জয়ের সমালোচনা করে জানতে চেয়েছেন, তিনি কোথায় কোন যুদ্ধে শান্তি স্থাপন করেছেন? সৈয়দ আশরাফের হয়তো জানা নেই। ১৯০১ সালে নোবেল শান্তি পুরস্কার প্রবর্তনের সময় থেকে এ পর্যন্ত যে ৯০ জনেরও বেশি নোবেল শান্তি পুরস্কার পেয়েছেন তাদের অধিকাংশই এই পুরস্কার বিজয়ী হন কোন যুদ্ধেই শান্তি স্থাপন না করে। তারা শান্তি পুরস্কার লাভ করেন নানা জনকল্যাণমুখী কার্যক্রমের দ্বারা শান্তির পথ প্রশস্ত করে। ১৯০১ সালে প্রথম নোবেল শান্তি পুরস্কার পান সুইজারল্যান্ডের হেনরি ডুনান্ট রেডক্রস প্রতিষ্ঠান স্থাপনের জন্য, ১৯৬৪ সালে মার্টিন লুথার কিং এই পুরস্কার অর্জন করেন কৃষ্ণাঙ্গদের অধিকার আদায়ের অহিংস আন্দোলনের জন্য, ১৯৭০ সালে নরম্যান বরলগ উন্নতমানের ও অধিক ফলনক্ষম গম উত্পাদন ব্যবস্থা প্রবর্তন করে, ১৯৭৯ সালে মাদার তেরেসা আর্তমানবতার সেবায়, ১৯৯১ সালে বার্মার অংসান সু চি গণতান্ত্রিক অধিকার আন্দোলনের জন্য, ১৯৯৩ সালে নেলসন ম্যান্ডেলা বর্ণবাদের অবসান ঘটিয়ে, ২০০২ সালে সাবেক প্রেসিডেন্ট জিমি কার্টার ও ২০০৩ সালে ইরানের শিরিন এবাদি মানবাধিকার আন্দোলনে, ২০০৭ সালে যুক্তরাষ্ট্রের সাবেক ভাইস প্রেসিডেন্ট আল গোর আবহাওয়া পরিবর্তনের মুখে করণীয় ব্যবস্থা গ্রহণের ক্ষেত্রে অনন্য অবদানের জন্য এবং অতিসম্প্রতি ২০১১ সালে আরব সমাজসেবী তাওয়াক্কাল কায়মান ও অপর দুই মহিলা নোবেল শান্তি পুরস্কার বিজয়ী হন নারী অধিকার প্রতিষ্ঠার আন্দোলনে। এছাড়া ২৩টি প্রতিষ্ঠানকে নোবেল শান্তি পুরস্কার দেয়া হয় মানবাধিকার, আর্ত মানবতার সেবা ও জনকল্যাণ প্রচেষ্টার কারণে। তাদের কারোরই কোনো যুদ্ধে শান্তি স্থাপন করতে হয়নি।
সৈয়দ আশরাফ ডক্টর ইউনূসের সমালোচনা করতে গিয়ে বলেছেন, তিনি অর্থনীতির ছাত্র হয়েও অর্থনীতিতে নোবেল পুরস্কার পেলেন না, পেলেন শান্তিতে। অর্থাত্ কথাটা এমন যে, অর্থনীতির তুলনায় শান্তিতে নোবেল নিম্নমানের এবং ডক্টর ইউনূস অর্থনীতিতে না পেয়ে একধাপ নিচের সম্মান পেয়েছেন! এ ক্ষেত্রেও সৈয়দ আশরাফের নোবেল পুরস্কার সম্পর্কে জানা-শোনার ঘাটতি সুস্পষ্ট। তার জেনে রাখা ভালো, বিজ্ঞানী আলফ্রেড নোবেলের উইল অনুসারে ১৯০১ সাল থেকে নোবেল পুরস্কার দেয়া হচ্ছে পাঁচটি ক্ষেত্রে— পদার্থ বিজ্ঞান, রসায়ন বিজ্ঞান, চিকিত্সা বিজ্ঞান, শান্তি ও সাহিত্যে। তার মধ্যে বিশ্ববাসী, প্রতি বছর অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করে শান্তি ও সাহিত্যে নোবেল পুরস্কার বিজয়ীর নাম শোনার জন্য। অর্থনীতিতে নোবলে পুরস্কার দেয়া শুরু হয় ১৯৬৯ সালে এবং তার অর্থায়ন আলফ্রেড নোবেলের রেখে যাওয়া সম্পদ থেকে করা হয় না। অর্থনীতিতে নোবেল পুরস্কারের অর্থ আসে সুইডেনের কেন্দ্রীয় ব্যাংক ‘রিকস্ ব্যাংক’ থেকে। ১৯৯২ সাল থেকে অর্থনীতিতে নোবেল পুরস্কারের নামকরণ করা হয়েছে—‘আলফ্রেড নোবেল স্মরণে অর্থনীতিতে রিকস্ ব্যাংক পুরস্কার।’ নরওয়ে ও সুইডেনের বেশ কিছু বুদ্ধিজীবী অর্থনীতির পুরস্কারকে নোবেল পুরস্কার নামকরণের বিরোধী। তাদের একজন আলফ্রেড নোবেলের প্রপৌত্র সুইডেনের প্রখ্যাত মানবাধিকার আইনজ্ঞ পিটার নোবেল।
সৈয়দ আশরাফ আরও বলেছেন, চিজ, স্যান্ডউইচ ও হোয়াইট ওয়াইন খেয়ে নোবেল পুরস্কার অর্জন করা চলে। দৈনিক প্রথম আলো পত্রিকায় এই সংবাদ সম্পর্কে পাঠকরা যেসব মন্তব্য করেছেন তার একটিতে একজন বলেছেন, তাহলে সৈয়দ আশরাফুল ইসলাম নিজে স্যান্ডউইচ, ওয়াইন খেয়ে দেড়শ’ কোটি টাকার নোবেল পুরস্কার লাভ করেন না কেন! আসলে তার এটা বোঝা উচিত যে, নোবেল পুরস্কার বাছাই করেন যে কমিটি তাদের কাছে চিজ, স্যান্ডউইচ নিয়ে কোন স্বার্থ উদ্ধার সম্ভব নয়। কারণ তা না হলে দীর্ঘ একশ’ বছরেরও বেশি সময় ধরে নোবেলের বিশ্বব্যাপী এই মর্যাদা ধরে রাখা সম্ভব হতো না।
সৈয়দ আশরাফ নোবেল পুরস্কারকে নিম্নমানের প্রমাণিত করার জন্য আয়ারল্যান্ডের যে দুই মহিলা পুরস্কার বিজয়ী ও তাদের প্রতিষ্ঠানের নাম উল্লেখ করেছেন তাতেও তার উপস্থাপিত তথ্যের গুরুতর ত্রুটি রয়েছে। ১৯৭৬ সালের নোবেল শান্তি পুরস্কার বিজয়ী আয়ারল্যান্ডের মেরিড করিগ্যান ও বেটি উইলিয়ামসের প্রতিষ্ঠানের নাম ‘মাদারল্যান্ড পিস’ নয়, তাদের প্রতিষ্ঠানের নাম প্রথমে ছিল ‘নর্দার্ন আয়ারল্যান্ড পিস মুভমেন্ট’ এবং পরে তা করা হয় ‘কম্যুনিটি অব পিস পিপল’। এছাড়া এই দুই পুরস্কার বিজয়ী তাদের পুরস্কারের অর্থ ভাগ করা নিয়ে কলহে লিপ্ত হন ও পরে তা আদালত পর্যন্ত গড়ায় বলে সৈয়দ আশরাফ যে গল্প ফেঁদেছেন তা সম্পূর্ণ ভিত্তিহীন। প্রথমত, কোনো নোবেল পুরস্কার যখন একাধিক ব্যক্তিকে দেয়া হয় তখন তা সমান ভাগ করেই নোবেল প্রতিষ্ঠানের পক্ষ থেকে যার যার যে পরিমাণ অর্থ প্রাপ্য তা-ই দেয়া হয়। সেখানে অর্থ নিয়ে দ্বন্দ্ব-কলহের কোনোই অবকাশ থাকে না। দ্বিতীয়ত, এই দুই মহিলা করিগ্যান ও উইলিয়ামস একে অপরের বিরুদ্ধে আদালতে যাওয়া দূরের কথা, এর দীর্ঘকাল পরেও ২০০৬ সালে নোবেলজয়ী শিরিন এবাদি, এডি উইলিয়ামস, ওয়াংগারি মাথাই, রিগোবার্তা মেনচু প্রমুখকে নিয়ে বিশ্বব্যাপী নারী অধিকার সম্পর্কে সচেতনতা সৃষ্টির উদ্দেশ্যে ‘নোবেল উইমেনস, ইনিশিয়েটিভ’ নামে একটি আন্দোলন-সংস্থা গড়ে তোলেন। সৈয়দ আশরাফ ঢাকায় তার ভাষণে নোবেল পুরস্কারকে ব্যঙ্গ করে বলেছেন, ‘নোবেল পুরস্কার কীভাবে দেয়া হয়, আপনারা তা জানেন!’ সত্যি কথা, সবাই জানেন, দুঃখের বিষয়, জানেন না কেবল সৈয়দ আশরাফুল ইসলাম। তিনি আরও জানেন না, ডক্টর মুহাম্মদ ইউনূস নিজের দেশে তাদের কাছে অসম্মানিত হলেও সম্মানিত বিশ্বব্যাপী। একথা আজ আর অস্বীকার করার উপায় নেই, বহির্বিশ্বে বাংলাদেশের এখন পরিচয় ‘নোবেল জয়ী ডক্টর ইউনূসের দেশ’ হিসেবে। ভয়েস অব আমেরিকা থেকে বেশ কয়েকবার আমাকে জাতিসংঘে যেতে হয়েছে নিউইয়র্ক থেকে সাধারণ পরিষদের অধিবেশনের খবরাখবর পরিবেশনের জন্য। সেখানে একবার ব্রাজিল ও আর্জেন্টিনার দুই সাংবাদিকের সঙ্গে আমার আলাপ হয়েছিল। তারা বলেছিলেন, বাংলাদেশ তাদের কাছে পরিচিত সেখানকার ক্ষুদ্রঋণ ব্যবস্থার উদ্যোক্তা নোবেল জয়ী মুহাম্মদ ইউনূসের নাম জেনে। তারা আরও বলেছিলেন, তাদের দেশেও এই ক্ষুদ্রঋণ ব্যবস্থা অনুসরণের আগ্রহ সৃষ্টি হয়েছে। এছাড়া সম্প্রতি স্কুলের ৬ষ্ঠ গ্রেডের পড়ুয়া আমার নাতনীকে আমেরিকায় প্রকাশিত একটি এনসাইক্লোপেডিয়া উপহার দেয়া হয়েছিল। তাতে বাংলাদেশের পরিচয় তুলে ধরা হয়েছে ডক্টর ইউনূসের দেশ হিসেবে।
সুতরাং বোঝা উচিত যে, বিশ্ব যেখানে ডক্টর ইউনূসকে সম্মানিত করছে সেখানে বাংলাদেশে তার অবমাননা হলে বাইরের দুনিয়ার সামনে নিজের দেশকেই হেয় প্রতিপন্ন করা হবে।
জ্ঞান-তাপস ডক্টর মুহম্মদ শহীদুল্লাহ একবার বলেছিলেন, ‘যে-দেশ তার গুণী মানুষকে সম্মান করতে জানে না সে দেশে গুণী মানুষেরই জন্ম হয় না।’
লেখক : সাংবাদিক ও ভয়েস অব আমেরিকার বাংলা বিভাগের সাবেক সিনিয়র এডিটর
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন