শুক্রবার, ৮ জুন, ২০১২

ফরমালিন ও এর ক্ষতিকারক দিকগুলো



 ড. মো. রওশন আলম  
দু ধ, মাছ-মাংস, শাক-সবজি ও ফলমূলসহ নানাবিধ খাবারে ফরমালিন মিশিয়ে এবং সেগুলো বাজারে বিক্রির মাধ্যমে একশ্রেণীর অসাধু ব্যবসায়ী বেশ কয়েক বছর যাবত্ সাধারণ মানুষের সঙ্গে যেমন প্রতারণা করে আসছে তেমনি তাদের জীবনকে হুমকির মধ্যে ঠেলে দিচ্ছে। ফরমালিন মিশ্রিত খাবার ঢাকার নামি-দামি দোকান ও আড়তসহ সারা বাংলাদেশেই দেদারছে বিক্রি হচ্ছে। এর বিরুদ্ধে মাঝে-মধ্যে বিএসটিআইয়ের উদ্যোগে মোবাইল কোর্ট কিছুটা সক্রিয় থাকলেও তা সারাদেশের প্রয়োজনের তুলনায় অত্যন্ত অপ্রতুল। ঢাকার কাগজগুলোতে প্রায়শই এই বিষয়ের উপরে খবর প্রকাশিত হয়। মোবাইল কোর্টগুলো কেবলমাত্র কিছু জরিমানার মাধ্যমেই তাদের দায়িত্ব সীমিত রেখেছে বলে প্রতীয়মান হয়। যেমন গত ২২ মে ঢাকার নামি দুটি দোকান- আগোরা সুপার স্টোর ও প্রিন্স বাজার লিমিটেড এবং মিরপুর-১০, শ্যাওড়াপাড়া, বাদামতলী ও যাত্রাবাড়ী ফলের আড়তে  মোবাইল কোর্ট অভিযান চালিয়ে প্রচুর পরিমাণে ক্যালসিয়াম কার্বাইড এবং ফরমালিন মিশ্রিত ফলমূল উদ্ধার করে এবং ২৩ মে ফরমালিন মিশ্রিত ফলমূলের ছবিসহ দৈনিক ইত্তেফাকে খবর প্রকাশিত হয়। এসব বিক্রেতার বিরুদ্ধে লামছাম কিছু জরিমানা করে সাময়িক ব্যবস্থাও নেয়া হয়। কিন্তু এদের বিরুদ্ধে সরকারি তরফ থেকে কোনো কঠোর শাস্তি কার্যত পরিলক্ষিত হচ্ছে না এবং কোনো জনসচেতনতাও তৈরি হচ্ছে না। এসব বিষাক্ত পদার্থ মিশ্রিত খাবার খেয়ে ক্যান্সারসহ নানাবিধ রোগে আক্রান্ত হয়ে মানুষের দীর্ঘায়িত জীবন সংকুচিত হয়ে আসছে। বিষাক্ত ফরমালিন মিশ্রিত খাদ্যসামগ্রী বাজার থেকে চিরতরে কিভাবে নির্মূল করা যায়, সরকারিভাবে তার কোনো সুনির্দিষ্ট কার্যক্রম নেই। নাগরিকদের সচেতন করার জন্য কোনো সুপরিকল্পিত উদ্যোগও নেই। দুর্নীতি নামক ব্যাধিটি যেমন সারা সমাজকে গ্রাস করে ফেলেছে, ঠিক তেমনি বিষাক্ত ফরমালিন মিশ্রিত খাবার দেশের আনাচে- কানাচে ছড়িয়ে অজান্তে তা ভক্ষণের ফলে মানুষের শরীরকে দিনে দিনে স্তিমিত করে দিচ্ছে। এটা আমাদের সমাজের মধ্যেই লুকিয়ে থাকা একশ্রেণীর মানুষের নৈতিকতার আর এক চরম অবক্ষয়ের প্রতিফলন। তাই নিজেদের সচেতনতার মাধ্যমে এই অসাধু কুচক্রীমহলের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ গড়ে তোলা উচিত। সেজন্য আসুন আমরা ফরমালিন ও ফরমালিনের ক্ষতিকারক দিকগুলো সম্পর্কে প্রথমে নিজেরা সচেতন হই, তারপর অন্যকে সচেতন করতে সাহায্য করি এবং গণসচেতনতার মাধ্যমে এর বিরুদ্ধে প্রতিবাদ গড়ে তুলি ও নিজেদের সন্তান-সন্ততিসহ সমাজের সকল স্তরের মানুষকে সুস্থভাবে বেঁচে থাকতে সাহায্য করি। 
ফরমালিন হচ্ছে রাসায়নিক যৌগ ফরমালডিহাইডের জলীয় দ্রবণ। আর ফরমালডিহাইডের রাসায়নিক ফর্মুলা হচ্ছে HCHO অর্থাত্ হাইড্রোজেন, অক্সিজেন ও কার্বনের সমন্বয়ে সবচেয়ে সাধারণ এলডিহাইড, যা কক্ষ তাপমাত্রায় গ্যাসীয় অবস্থায় থাকে এবং পানিতে অতি দ্রবণীয়। ১০০% ফরমালিনের জলীয় দ্রবণে আয়তন অনুপাতে শতকরা ৪০ ভাগ অথবা ওজন অনুপাতে শতকরা ৩৭ ভাগ ফরমালডিহাইড গ্যাস দ্রবীভূত থাকে এবং সেইসংগে সামান্য পরিমাণে স্টেবিলাইজার (stabilizer) মিশ্রিত থাকে। স্টেবিলাইজার হিসাবে সাধারণত শতকরা ১০ থেকে ১২ ভাগ মিথানল ব্যবহার করা হয়। এগুলো ছাড়াও ফরমালিন দ্রবণে খুবই নগণ্য পরিমাণে ধাতব পদার্থ (trace amount of metallic impurities) মিশ্রিত থাকে। ফরমালিন ব্যাকটেরিয়াঘটিত বা সংক্রামক রোগজীবাণুনাশক হিসাবে ব্যবহূত হয়। ফরমালডিহাইডই মূলত ব্যাকটেরিয়াঘটিত বা সংক্রামক রোগজীবাণুনাশকের জন্য দায়ী; পানি সাধারণত এটার ঘনত্বকে কম শক্তিসম্পন্ন বা পাতলা করতে সাহায্য করে, যাতে করে নিরাপদে ফরমালিনকে ব্যবহার করা যায়। আর মিথানল ফরমালডিহাইডের র?্যাপিড অক্সিডেশন এবং পলিমারাইজেশন এড়াতে সাহায্য করে থাকে।  ক্ষতিকারক দিকগুলো:ফরমালিন বা ফরমালডিহাইডের জলীয় দ্রবণ অতি বিষাক্ত। শ্বাস-প্রশ্বাসের মাধ্যমে গৃহীত অতিমাত্রায় ফরমালডিহাইড শরীরের মারাত্মক ক্ষতিসাধন করে থাকে। ১০০ পিপিএম (ppm) ঘনত্বকে বিবেচনা করা হয় স্বাস্থ্য ও জীবনের জন্য অতি ঝুঁকিপূর্ণ (Immediately Dangerous to Life and Health)। ৩০ মিলিলিটার অথবা প্রায় এক আউন্স পরিমাণ ফরমালিন গলাধঃকরণে একজন পূর্ণ বয়স্ক মানুষের মৃত্যুর কারণ হতে পারে। কিছু কিছু লোকের ক্ষেত্রে সামান্য পরিমাণে ফরমালডিহাইড এক্সপজার স্বাস্থ্যের জন্য অত্যন্ত সংবেদনশীল, যদিও অন্যজনের ক্ষেত্রে ঐ একই লেভেল সংবেদনশীল নাও হতে পারে। গবেষণার প্রাপ্ত ফলাফল থেকে জানা যায় যে, বাতাসে যখন ফরমালডিহাইডের লেভেল কেবলমাত্র ০.১ পিপিএম অতিক্রম করে, তখন কিছু কিছু মানুষের জন্য পরিবেশ অনুকূল বিরুদ্ধ হয়, যেমন- চোখে পানি আসা, চোখ, নাক ও গলা ভীষণভাবে জ্বালা-পোড়া করা, কাশি, ব্রঙ্কাইটিস, চেস্ট পেইন, হাঁপানি রোগীর মতো করে শ্বাস ত্যাগ করা, বমি বমি ভাব, ত্বকের জ্বালা-পোড়া এবং এজমা।
 উপরন্তু আমেরিকার বিভিন্ন ল্যাবরেটরিতে পুরুষ ও মেয়ে প্রজাতির ইঁদুর ও হ্যামস্টারের উপরে বিভিন্ন এক্সপজার লেভেলে ফরমালডিহাইড প্রয়োগ করে যে ফলাফল পাওয়া যায়, তাতেও দেখা গেছে যে, এই প্রাণীগুলো যথেষ্টভাবে ন্যাসাল ক্যান্সারে আক্রান্ত। উপরের এই উদাহরণগুলোই কি যথেষ্ট নয় যে, ফরমালিন কত বড় একটি প্রাণঘাতী বিষাক্ত কেমিক্যালস, যা খাদ্যের মধ্যে মিশিয়ে এক ধরনের শ্লো পয়জনিংয়ের মাধ্যমে মানুষকে মৃত্যুর দিকে ক্রমেই ঠেলে দেয়া হচ্ছে? এর থেকে পরিত্রাণ পেতে হলে আমাদের আত্মসচেতন হওয়া উচিত। আমাদের জীর্ণ ও অবক্ষয়ে যাওয়া মানসিকতার পরিবর্তন আশু প্রয়োজন। নৈতিকতার উন্নয়ন সাধন ও সামাজিক আন্দোলনের মাধ্যমে এর দীর্ঘমেয়াদি পরিত্রাণের উপায় খোঁজা উচিত। আর সেজন্য সরকার ও সরকারি-বেসরকারি গণমাধ্যমগুলোকে ব্যাপক গণসচেতনতা তৈরির জন্য এগিয়ে আসা উচিত। পাশাপাশি সরকারকে আন্তরিকভাবে ও কঠোর হস্তে খাদ্যসামগ্রীর মধ্যে ফরমালিন প্রয়োগকারীর বিরুদ্ধে শাস্তি সুনিশ্চিত করা উচিত। 
n লেখক: যুক্তরাষ্ট্রের ওহাইও অঙ্গরাজ্যে ফার্মাসিউটিক্যাল প্রোডাক্টস প্রস্তুতকারী একটি ইন্ডাস্ট্রিতে সায়েন্টিস্ট পদে কর্মরত।

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন