বুধবার, ১৩ জুন, ২০১২

কালো টাকার পাচার বন্ধে বিনিয়োগের ব্যব¯’া কর“ন




ড. আর এম দেবনাথ
২০১২-১৩ অর্থবছরের বাজেটে কালো টাকা সাদা করার নয়া একটা বিধান করা হয়েছে। স্বাভাবিক কর এবং ১০ শতাংশ জরিমানা কর দিয়ে যে কেউ অপ্রদর্শিত টাকা সাদা করতে পারবে। দেখা যা”েছ নয়া বিধানটি একটু ভিন্ন। আগে বিভিন্ন সরকারের আমলে ১০ থেকে ১৫ শতাংশ কর দিয়ে কালো টাকা সাদা করার বিধান ছিল। এতে আপত্তি ছিল দুটি। প্রথমত, কালো টাকা সাদা করার বিধান অনৈতিক ও অযৌক্তিক। অধিকš‘ তা কম কর হারে সাদা করার বিধানটি ছিল আরও বৈষম্যসৃষ্টিকারী। এবার যখন স্বাভাবিক কর হার এবং জরিমানা কর প্রবর্তন করা হয়েছে তখনও আপত্তি থাকছেই। দেখা যা”েছ, কালো বা অপ্রদর্শিত টাকার ইস্যুতে দেশে দুটো অব¯’ান। বড় বড় রাজনৈতিক দল যারা ক্ষমতার স্বাদ পা”েছ পালাবদল করে, তারা কালো টাকা সাদা করাকে অনৈতিক মনে করে, কিš‘ তারা বাস্তবতা মেনে কালো টাকাকে অর্থনীতির প্রধান স্রোতে নিয়ে আসতে আগ্রহী। এ আলোকেই দেখা যায়, ১৯৭৫ সালের পর থেকে কিছুদিন বিরতি দিয়ে দিয়ে কালো টাকা সাদা করার ব্যব¯’া রাখা হ”েছ এবং কর হারও খুবই কম। এদিকে দেখা যা”েছ, তথাকথিত ‘সুশীল সমাজী’, আন্তর্জাতিক ‘সন্ন্যাসীদের’ সংগঠন ‘টিআইবি’সহ কিছু প্রতিষ্ঠান ও জনগোষ্ঠীর একাংশ কালো টাকা সাদা করার বিরোধী। তাদের মতে, এ ব্যব¯’া বৈষম্য সৃষ্টিকারী, এতে আইন অমান্যতা বৃদ্ধি পায় এবং সমাজে দুই নম্বরি লোকদের প্রাধান্য সৃষ্টি হয়।
এই দুই অব¯’ান থেকে একটি জিনিস পরিষ্কারÑ যারা নির্বাচিত, যারা জনগণের কাছে জবাবদিহি করেন, তারা কালো টাকাকে সাদা করার ব্যব¯’া করেন বাস্তবতার কারণে, বিনিয়োগ বাড়ানোর জন্য এবং টাকা পাচার বন্ধ করার জন্য। অন্যদিকে আমাদের দেশে যাদের কোনদিন ক্ষমতায় আসার সম্ভাবনা নেই তারা এবং আন্তর্জাতিক ‘সন্ন্যাসী’রা ও তাদের বশংবদরা কালো টাকা সাদা করার বির“দ্ধে।
আমি বিষয়টিকে ভিন্নভাবে বিচার করতে চাই। আমার কাছে কালো টাকা সাদা করার অনুমোদন দেয়া হবে কী হবে না তা দ্বিতীয় বিবেচ্য বিষয়। প্রথম বিবেচ্য, সময় কালো টাকার ‘জেনারেশন’। প্রতিদিন প্রতি মুহূর্তে বছরের পর বছর ধরে আমাদের দেশে কালো টাকা তৈরি হ”েছ। আমরা কালো টাকার যতই বিরোধিতা করছি ততই সমাজ ব্যব¯’া, অর্থনৈতিক ব্যব¯’া ও রাজনৈতিক ব্যব¯’া কালো টাকা তৈরি করছে আরও বেশি করে। এটা হ”েছ বিরামহীনভাবে এবং কালো টাকার উৎস ও কারণ হাজারটি। এই প্রক্রিয়া কি আজকের? ব্রিটিশ আমলে চালু একটা কথা আছেÑ চাকরিতে ‘উপরি’ কত? তারপর পাকিস্তান আমল গেছে। ৩০৩ জন সিভিল সার্ভেন্টের চাকরি যায় দুর্নীতির কারণে। তারপর বাংলাদেশ। বিগত কেয়ারটেকার সরকারের আমলে দিনের পর দিন কালো টাকার মালিকদের তালিকা ছাপা হয়েছে। তিতাস, ওয়াসা, টেলিফোন অফিস, ঢাকা মিউনিসিপালিটি, বিদ্যুৎ অফিস থেকে শুর“ করে বিভিন্ন অফিসের দুর্নীতিবাজের তালিকা দিনের পর দিন কাগজে ছাপা হয়েছে। এই তালিকায় কে নেই? প্রধান নির্বাহী থেকে শুর“ করে তালিকায় ছিলেন অফিসের পিয়ন পর্যন্ত। বাগানবাড়ি, হরিণওয়ালা বাড়ির তালিকা ছাপা হল। দেশবাসী আমরা এসব দেখলাম। শুধু আমাদের দেশে নয়, প্রতিবেশী দেশকে আমরা মনে করতাম গান্ধীজীর দেশ ভারত; নেহর“, ইন্দিরা, জ্যোতি বসু, জয়প্রকাশ নারায়ণ, মোরারজি দেশাই, জগজ্জীবন রামের দেশ ভারত। ভারত হ”েছ ন্যাংটা ফকিরের দেশ। এখন দেখা যা”েছ দুর্নীতিতে ছেয়ে গেছে ভারত। ট্রিলিয়ন ট্রিলিয়ন ডলার (১ ট্রিলিয়ন সমান ১ লাখ কোটি) ভারতীয়দের বিদেশী ব্যাংকে রক্ষিত। পাকিস্তান, শ্রীলংকা, মিয়ানমার, নেপালের দৃশ্য চোখের সামনে ভাসছে। প্রতিটি দেশ ভাসছে কালো টাকার উপর। সরকারি অর্থনীতির আকার যত, ঠিক তত অথবা বেশি হ”েছ কালো অর্থনীতি। সরকারিভাবে যা লেনদেন হয় তার চেয়ে বেশি লেনদেন হয় ‘হুন্ডিতে’, অবৈধভাবে। রেমিটেন্স যা আসে ব্যাংকিং চ্যানেলে, তার চেয়ে বেশি হুন্ডিতে। লাখ লাখ গর“ বেআইনিভাবে ভারত থেকে আসছে। তার টাকা দিতে হয় হুন্ডিতে। এসব দেখে বাংলাদেশ ব্যাংকের ‘পলিসি রিসার্চ ইউনিট’ একবার প্রস্তাব করেছিল ‘হুন্ডিকে’ বৈধ করে দিতে। চোরাচালান বন্ধ করতে না পারায় মাঝে মাঝেই কথা ওঠে অবাধ বাণিজ্যের। এতে লাভ হবে সরকারের। অতি সংক্ষেপে এই যে চিত্র আঁকলাম, তাতে দেখা যা”েছ কালো টাকার ওপর আমরা ভাসছি। ক’জন আমরা প্রকৃত আয়ের উপর কর দিই? ১০০ টাকা রোজগার করে ২৫ টাকা কর হিসাবে সরকারকে দেয়া এক কঠিন কাজ, বিশেষ করে যে সরকার করের বিনিময়ে করদাতাকে কোন সুবিধাই দেয় না। প্রকৃত আয়ের ওপর কর না দেয়া মানেই ‘অপ্রদর্শিত টাকা’ হ”েছ, যা সরকারের হিসাবের বাইরের থাকছে। এই সমস্যার আশু কেন, দূরবর্তী কোন সমাধানও দেখছি না।
কালো টাকা বন্ধে সরকার পদক্ষেপ কম নেয়নি। কড়াকড়ি কম করেনি। কঠিন একটা আইন করেছে ‘মানি লন্ডারিং প্রিভেনশন আইন’। এ আইনে সাদা টাকা কালো করা, কালো টাকা সাদা করা শাস্তিযোগ্য অপরাধ। ‘হুন্ডি’ শাস্তিযোগ্য অপরাধ। ব্যাংকে সাত লাখের বেশি জমা দিতে গেলে, সাত লাখের বেশি টাকা তুলতে গেলে ব্যাংক প্রশ্ন করে। টিটি, ডিডি, পে-অর্ডার করতে গেলে, টাকা জমা দিতে গেলে ব্যাংক টেলিফোন নম্বর চায়। রয়েছে দুর্নীতির জন্য বিভাগীয় বিচারের ব্যব¯’া। রয়েছে ‘দুদক’। কত রকমের ‘চেকের’ ব্যব¯’া। এসবের ফল কী? অন্য ফল জানি না, একটা ফল দেখতে পা”িছ। এই খবর দু’দিন পরপরই খবরের কাগজে ছাপা হয়। মালয়েশিয়ায় ‘সেকেন্ড হোম প্রকল্প’ আছে। সেখানে ওই প্রকল্পের অধীনে শত শত বাংলাদেশী বাড়ি-গাড়ি করেছে। তারা মালয়েশিয়ার সরকারের অতিথি নাগরিক। তারা সে দেশের সম্মানিত ¯’ায়ী বাসিন্দা। বাংলাদেশের লোক, চীনের লোক সেখানকার ¯’ায়ী বাসিন্দা, নাগরিক। কিভাবে? লাখ লাখ, কোটি কোটি টাকা নিয়ে বাংলাদেশীরা সেখানে গেছে। এরা দেশে নিন্দিত কালো টাকার মালিক বলে অথচ মালয়েশিয়ায় তারা সম্মানিত ব্যক্তি। প্রতিনিয়ত দেখছি, শুনছি এবং সবারই ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা আছে। লাখ লাখ বাংলাদেশী আজ আমেরিকা, কানাডা, অস্ট্রেলিয়া, বিলাত, জার্মানি, ইতালি ইত্যাদি দেশের নাগরিক। তাদের বাবা-মা সহায়সম্পদ বিক্রি করে ওই সব দেশে ছেলেমেয়েকে মাইগ্রেট করছে। তারা কি খালি হাতে যা”েছ? নিশ্চয়ই নয়। প্রচুর সংখ্যক লোকের টাকা বিদেশে। প্রচুর সংখ্যক বাংলাদেশী ব্যবসায়ী-শিল্পপতির বিনিয়োগ আছে বিদেশে। এসব কী করে হ”েছ? 
ওই সব দেশে কি বাংলাদেশ থেকে টাকা বিদেশে নেয়া যায় না। মানি লন্ডারিং প্রিভেনশন আইন নেই? যদি থেকে থাকে তাহলে বিদেশীরা গিয়ে কিভাবে সেখানে ‘অ্যাকাউন্ট’ খুলে, কী করে সম্পদ করে? এসবের কোন ব্যাখ্যা দরকার নেই। সবাই আমরা জানি। আসলে বিদেশীরা ডলার চায়। বিনিয়োগ চায়। দিতে পারলেই সেখানকার ¯’ায়ী বাসিন্দা, নাগরিকত্ব ও সে দেশের ভিসা। মজা হ”েছ, এরা স্বদেশে ‘সুশীল সমাজী’দের দৃষ্টিতে নিন্দিত ব্যক্তি, টিআইবির কাছে অপরাধী, এমনকি সরকারের অনেক আইনেও এরা অপরাধী। অথচ দেখাই যা”েছ টাকা বিদেশে পাচার হয়ে যা”েছ। যে দেশে হাজার রকমের ব্যব¯’া আছে কালো টাকা তৈরির অথচ তা বিনিয়োগ করা বা রাখার ব্যব¯’া নেই সে দেশে মানুষ টাকা রাখবে কেন? এই সহজ প্রশ্নটির জবাব আমি খুঁজছি বহুদিন ধরে। অথচ এর জবাব পা”িছ না। আমি কালো টাকা জেনারেশনের বিরোধী, এরপর আমি কালো টাকা সাদা করারও বিরোধী। কিš‘ প্রথমটি না করতে পারলে দ্বিতীয়টিতে বাধা দিয়ে কী লাভ হবে? অথচ দেখতে পা”িছ, প্রথমটি অর্থাৎ কালো টাকা অবিরত ‘জেনারেশন’ হ”েছ। যদি তা বন্ধ করা না যায় তাহলে এই টাকার কী হবে? মানুষ টাকা রাখবে কোথায়? বালিশের তলে, পুকুরে, লকারে, ডলারে, সোফায়, ছালায় ভর্তি করে? এসব কেউ করে না। টাকা আছে অর্থনীতিতে। জমিতে খাটছে, ব্যবসায় খাটছে, ফ্ল্যাটে খাটছে। ব্যাংকে আছে, সঞ্চয়পত্রের সঙ্গে। সমস্যা একটাই, এগুলোর উপর কর দেয়া নেই। দুদিন পরপর ধমক দেয়া হয়। তাই ওই টাকা রওনা দেয় বিদেশে। তাই নয় কি? এটাই বাস্তবতা। যদি তাই হয়, তাহলে কালো টাকা কালো টাকা বলে অহেতুক চিৎকার করে আতংক তৈরি করার প্রয়োজন আছে কি? টাকা যদি সন্ত্রাস, চোরাচালান, অস্ত্র চালানের না হয়, তাহলে সেই টাকা ব্যাংকে রাখার ব্যব¯’া করা যায়। সেই টাকা বিনিয়োগ করার অনুমতি দেয়া যায়। আর যদি সারাদিন কেবল জপা হয়Ñ টাকা পেলে কোথায়, টাকা পেলে কোথায়, তাহলে তাতে জনমনে আতংক সৃষ্টি হয়। অনুপার্জিত টাকা নিুবিত্ত, মধ্যবিত্ত, উ”চবিত্ত, বড় চাকরিজীবী, ব্যবসায়ী সবারই আছে। আবার তাদের উপার্জিত টাকাও আছে যার ওপর কর দেয়া নেই। ধীরে ধীরে তাদের করের আওতায় আসতে সহায়তা করাই সরকারের কাজ যাতে টাকা মালয়েশিয়া, অস্ট্রেলিয়া রওনা না দেয়। ওই সব দেশ যদি আমাদের ‘নিন্দিত’ ব্যক্তিদের বিনিয়োগ গ্রহণ করতে পারে প্রশ্ন না করে, তাহলে আমরা তা পারব না কেন?
আমার মাঝে মাঝে মনে হয়, আমাদের সমাজ প্রধানত ‘এন্টিমানি’। টাকা দেখলেই খালি সন্দেহ। সব বুঝি ঘুষের টাকা, সব বুঝি দুর্নীতির টাকা, সব বুঝি অবৈধ টাকা। এসব বিচার করলে প্রথম দফায় প্রায় লাখো কোটি টাকা অবৈধ হয়ে যায়। এই টাকা হ”েছ রেমিটেন্সের, যা আসছে বেসরকারিভাবে হুন্ডির মাধ্যমে। ‘হুন্ডি’ অবৈধ। বুঝুন ঠেলা! আমার মনে হয় অবাস্তব মানসিকতা, অবাস্তব আইন, এন্টিমানি মানসিকতা আমাদের প্রচুর ক্ষতি করছে। আমাদের বিনিয়োগ দরকার। তাই বিনিয়োগ বাড়ানোর জন্য মানুষকে আহ্বান জানানো হোক। কর“ক না তারা বিনিয়োগ। তাহলে তো সব সরকারি হিসাবে এসে যায়। পরে বাড়বে কর আয়, তাই নয় কি? এর বিকল্প হ”েছ ‘কালো টাকার জেনারেশন’ বন্ধকরণ। এর চেষ্টা তো ১৯৪৭ সাল থেকেই হ”েছ। কত আইন, কত বিধি আছে দেশে, আছে দুদক, আছে ‘সুজন’ সন্ন্যাসীরা। তারপরও তো এই ধরনের টাকার জš§ হ”েছ বেশি বেশি করে। যে প্রথম শ্রেণী পাওয়া ছেলেকে ৫-৬ লাখ টাকা খরচ করে চাকরি পেতে হয়, তার কাছে কোন বাণীই বাণী নয়। সে তা-ই করবে যা যা তার দরকার। তাই নয় কি? এমতাব¯’ায় বাস্তবতা মানলে কি ইজ্জত যাবে? নাকি নীতিকথার বেড়াজালে অনুন্নয়নের পথ ধরব? মুহিত সাহেবকে ধন্যবাদ তিনি অন্তত কালো টাকাকে স্বাভাবিক কর ও জরিমানা করের আওতায় এনেছেন। ফল কী হবে সে কথা ভিন্ন।
ড. আরএম দেবনাথ : সাবেক অধ্যাপক, বিআইবিএম
ৎসফবনহধঃয@ুধযড়ড়.পড়স 

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন