বুধবার, ১৩ জুন, ২০১২

সুশীল সমাজই কি রাজনীতির তৃতীয় শক্তি?


মোঃ আ বু সা লে হ সে কে ন্দা র
বাংলাদেশের রাজনীতিতে তৃতীয় শক্তির উত্থান সম্পর্কিত আলোচনা ইদানীং বেশ জোরেশোরে শুর“ হয়েছে। সম্প্রতি সুশীল সমাজের উদ্যোগে রাজধানীর ইঞ্জিনিয়ার্স ইন্সটিটিউশন মিলনায়তনে নাগরিক সমাবেশ থেকে আবারও রাজনীতিতে তৃতীয় ধারা সৃষ্টির আওয়াজ উঠেছে। উপ¯ি’ত সুশীল সমাজের কেউ কেউ আন্না হাজারের মতো অনশনে বসার এবং ৫০ হাজার লোক সমাগমের কথা বলেছেন। অবশ্য বাস্তবে মাঠপর্যায়ে ওই সুশীলদের কোন কার্যক্রম চোখে পড়ে না। উপরš‘, সম্প্রতি একটি জাতীয় দৈনিকে সুশীল সমাজের প্রতিনিধিদের মধ্যে যে অন্তর্™^ন্দ্বের খবর প্রকাশ পেয়েছে, তা যদি সত্যি হয় তবে সত্যিকার অর্থে এই তৃতীয় ধারা সৃষ্টির কুশীলবদের চেষ্টা অচিরেই মাঠে মারা যাবে, এতে সন্দেহ নেই। কারণ তখন জনগণের মধ্যে এ ধারণা প্রতীয়মান হবে যে, তারাও প্রচলিত রাজনীতিকদের মতো ব্যক্তিস্বার্থের ঊর্ধ্বে উঠতে ব্যর্থ হয়েছেন। তাছাড়া যারা তৃতীয় ধারা সৃষ্টির চেষ্টা করছেন, তাদের মধ্যে কোন ক্যারিশম্যাটিক নেতা নেই। ফলে অচিরেই এ প্রয়াস জনসমর্থন না পেয়ে মুখ থুবড়ে পড়লে অবাক হওয়ার কিছু থাকবে না।
এমনটি ভাবার প্রথম কারণ ওয়ান-ইলেভেনের অভিজ্ঞতা। বিগত সেনাসমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সময় ওই সুশীল সমাজের প্রতিনিধিদের দৌরাÍ্য বহু গুণে বেড়ে গিয়েছিল। তাদের কেউ কেউ নিজেকে ওয়ান-ইলেভেনের প্রধান উদ্যোক্তা বলেও জাহির করতে থাকেন। আবার কেউ কেউ তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রিয়ভাজন হতে নিজেকে সা”চা নিরপেক্ষ প্রমাণ করার চেষ্টা চালান। দ্বিতীয়ত, তাদের অনেকে আওয়ামী বা বিএনপিপš’ী বুদ্ধিজীবী হিসেবে সুধীসমাজে পরিচিত। আবার অনেকে উভয় ঘরানার সঙ্গে দীর্ঘদিন সুসম্পর্ক বজায় রেখেছেন। ফলে তারা এখন ভোল পাল্টে যতই নিজেদের সা”চা নিরপেক্ষ প্রমাণ করার চেষ্টা চালান, জনগণের কাছে গ্রহণযোগ্যতা পাবেন বলে মনে হয় না। ফলে আন্না হাজারের মতো ৫০ হাজার মানুষ জড়ো করা তাদের জন্য দুরূহ হবে বৈকি। তৃতীয়ত, তারা যেভাবে জনমত তৈরি করছেন তা খুব বেশি কার্যকর কোন পদ্ধতি বলে মনে হয় না। কারণ গ্রামের অধিকাংশ মানুষ এখনও প্রার্থী দেখে নয়, মার্কা দেখে ভোট দেয়। গোপালগঞ্জ, বগুড়া অথবা রংপুরের মতো অঞ্চলে মানুষ চোখ বুজে যথাক্রমে নৌকা, ধানের শীষ আর লাঙল ছাড়া অন্য কোথাও ভোট দেয়ার কথা ভাবতে পারে না। এ কথা ঠিক, সুশীল সমাজের প্রতিনিধিরা বিভিন্ন সেমিনার-টকশোয় অংশগ্রহণ করে সরকারের সমালোচনা করেন এবং নিজেদের গঠনমূলক চিন্তা-চেতনা তুলে ধরছেন। কিš‘ তাদের এ গঠনমূলক চিন্তা-ভাবনা অধিকাংশই সাধারণ মানুষের কাছে পৌঁছে না। কারণ এ দেশের অধিকাংশ নিু ও উ”চবিত্ত মানুষ এসব সেমিনার-সিম্পোজিয়ামে অংশগ্রহণ করে না। টকশো দেখে এমন মানুষের সংখ্যা হাতে-গোনা। তাই সাধারণত এই বুদ্ধিজীবী মহলের কথা শোনার মতো লোকের সংখ্যা একেবারে সীমিত। অন্যদিকে পত্রিকায় সুশীল সমাজের মানুষের লেখা কলামের পাঠকের সংখ্যা কয়েক লাখের বেশি হবে না। কারণ যারা নিয়মিত পত্রিকা পাঠ করেন, তাদের সংখ্যা যদি দুই কোটিও হয় তবে সেই পাঠকের সবাই আবার কলাম পড়েন না। ইলেকট্রনিক মিডিয়ার মতো প্রিন্ট মিডিয়ায়ও ভিন্ন ভিন্ন বিষয়ের পাঠক থাকে। অনেক পাঠক আছেন যারা বিনোদন পাতা অথবা খেলার পাতা ছাড়া অন্য পাতা পড়া তো দূরে থাক, উল্টিয়েও দেখেন না। চতুর্থত, কলাম লেখকরা কোন রাজনৈতিক দলের সদস্য না হওয়ায় অন্য রাজনৈতিক দলের মতো বিভিন্ন ইস্যুতে কর্মসূচি পালনের ক্ষেত্রে তাদের কিছু সীমাবদ্ধতা থাকবে। দলীয় কর্মী-সমর্থক সংকটের কারণে তাদের অরাজনৈতিক কর্মসূচিগুলোয় প্রাণের টানে আসা মানুষের সংখ্যা এক পলকেই গুনে দেখা যাবে। পঞ্চমত, আবালবৃদ্ধবনিতা বা চাকরিজীবী-কৃষক-শ্রমিকসহ সব শ্রেণীর মানুষের কাছে প্রধানমন্ত্রী অথবা বিরোধীদলীয় নেতার মতো ওইসব সংগঠনের নেতাদের পরিচিতি নেই। ফলে তাদের উদ্যোগগুলো সহজে জনগণের দোরগোড়ায় পৌঁছানো কঠিন হয়ে পড়বে। ষষ্ঠত, তাদের কোন সুদীর্ঘ রাজনৈতিক ইতিহাস না থাকায় রাজনীতিকদের বির“দ্ধে তারা খুব সহজে জনগণের সমর্থন পাবে এমনটি আশা করা যায় না। উপরোক্ত কারণে দেশব্যাপী তারা যে অব¯’ান তৈরি করতে চেয়েছেন, তা বাস্তবে রূপ দেয়া সহজ হবে না। সপ্তমত, সুশীল সমাজের প্রতি জনসমর্থন যদি দিন দিন বৃদ্ধি পেতে থাকে, তাহলে রাজনৈতিক সংগঠনগুলো এসব সংগঠনের প্রবল বিরোধিতা করবে। তারা সুশীল সমাজের প্রতিনিধিদের তাদের প্রতিপক্ষ মনে করে যদি বৈধ-অবৈধ শক্তি প্রদর্শন করে, তাহলে তখন এই সুধীজনরা কী করবেন? তারা কি রাজনৈতিক দলগুলো বা সরকারের সহিংস দমননীতির প্রতিবাদস্বরূপ গান্ধীর অহিংস আন্দোলন চালিয়ে যাবেন? নাকি তারাও গতানুগতিক রাজনৈতিক সংস্কৃতির মতো নিয়মিত হরতাল ডাকবেন অথবা জ্বালাও-পোড়াও রাজনীতির স্লোগান গ্রহণ করবেন! অর্থাৎ তারা কি শেষ পর্যন্ত তাদের নতুন আদর্শ নিয়ে টিকে থাকতে পারবেন, নাকি তারাও পেশিশক্তি ও অর্থনির্ভর রাজনীতির দিকে ঝুঁকবেন? যদি এমনটি হয় তবে তৃতীয় ধারা আঁতুড়ঘরে মারা যাবে। আর যদি সত্যিকার অর্থে তারা তাদের আদর্শ নিয়ে টিকে থাকতে চান, তবে নেলসন ম্যান্ডেলা অথবা অং সান সু চির মতো আÍত্যাগ করার মানসিক প্র¯‘তি থাকতে হবে। কিš‘ বয়সের ভারে ন্যুব্জ আমাদের তথাকথিত সুশীল সমাজের তা আছে কি?
এ কথা সত্য, তারা নিয়মিত বাংলাদেশের রাজনৈতিক দলগুলোর সমালোচনা করছেন এবং দেশ গঠনের জন্য কী ধরনের পদক্ষেপ নিলে ভালো হয়, তা তর“ণ সমাজের সামনে তুলে ধরছেন। আর তাদের এমন কার্যক্রমে অর্থাৎ পত্রিকায় কলাম লেখা অথবা সভা-সেমিনার ও টকশোয় বক্তব্য রাখার কারণে একদিকে রাজনৈতিক দলগুলো যেমন সদা তট¯’ থাকছে, তেমনি তর“ণ সমাজের মাঝে তারা একধরনের জনপ্রিয়তা অর্জন করতে সক্ষম হয়েছেন। কিš‘ এ অর্জন সীমিত পরিসরে, যাকে কোনভাবেই তৃতীয় ধারা বলা যাবে না। উপরš‘, এখনও আওয়ামী লীগ অথবা বিএনপির বাইরে কেউ নতুন ধারা সৃষ্টির চেষ্টা করে সাফল্য পায়নি। তাই সচরাচর কেউ নতুন এ ধারায় যোগ দেয়ার সৎসাহস দেখাবেন না। এছাড়া জনমনে এখনও একটি ধারণা প্রচলিত আছে যে, যারা তৃতীয় ধারা সৃষ্টি করতে চান, তাদের মূল লক্ষ্য সামরিক বাহিনীর ছত্রছায়ায় দেশশাসন অথবা শক্তিশালী বহিঃশক্তির পরোক্ষ সমর্থনে সরকার পরিচালনা। তাই জনগণ সহজে ওই তৃতীয় শক্তিকে বিশ্বাস করতে চাইবে না। তাহলে প্রশ্ন হতে পারে, বর্তমান প্রচলিত রাজনীতির বাইরে নতুন কোন ধারা সৃষ্টি করা কি অসম্ভব? এ প্রশ্নের সহজ উত্তরÑ ‘না’, অসম্ভব নয়। তবে তার জন্য দরকার ‘তর“ণ ক্যারিশম্যাটিক’ নেতৃত্ব। এখন প্রশ্ন হ”েছ, বর্তমানে যারা তৃতীয় ধারা সৃষ্টির জন্য চেঁচামেচি করছেন, তাদের মধ্যে কারও কি এমন নেতৃত্ব দেয়ার গুণ আছে?
এ কথা ঠিক, বাংলাদেশে অচিরে না হলেও সুদূর ভবিষ্যতে তৃতীয় কোন রাজনৈতিক ধারা নির্বাচিত হয়ে সরকার গঠন করতে পারে। এ সম্ভাবনা উড়িয়ে দেয়া যায় না। এ দেশের এক সময়ের সবচেয়ে জনপ্রিয় দল মুসলিম লীগ কালের অতলগহ্বরে হারিয়ে গেছে। অন্যদিকে সাধারণ ঘরের সন্তান তর“ণ শেখ মুজিব অল্প সময়ে বাংলার মানুষের অবিসংবাদিত নেতা হয়ে উঠেছিলেন। তেমন আওয়ামী লীগ ও বিএনপির জনপ্রিয়তায় ধস নামা অসম্ভব কিছু নয়। তবে এর জন্য প্রয়োজন শেরেবাংলা একে ফজলুল হক অথবা বঙ্গবন্ধুর মতো ক্যারিশম্যাটিক নেতা; যিনি মাসের পর মাস, বছরের পর বছর নিঃস্বার্থভাবে সংগ্রাম করবেন। জেল-জুলুম, অত্যাচারের কাছে মাথানত করবেন না। সত্যিকার অর্থে জনকল্যাণে নিজের জীবন উৎসর্গ করতে দ্বিধা করবেন না। আর এমনটি উপরোক্ত সুশীল সমাজের নেতাদের দ্বারা সম্ভব হবে বলে মনে হয় না।
সভ্যতার ইতিহাস বলে, তর“ণরাই সবসময় পরিবর্তন এনেছে। তাই যদি কোন তর“ণ নিকট-ভবিষ্যতে তার ক্যারিশম্যাটিক নেতৃত্বে তৃতীয় রাজনৈতিক ধারা সৃষ্টি করতে পারেন, তবেই এমনটি সম্ভব। প্রকৃতপক্ষে ওই তর“ণ নেতা যদি সাধারণ মানুষের দোরগোড়ায় তার লক্ষ্য-উদ্দেশ্যের কথা পৌঁছাতে পারেন, তাহলে বাংলার বাঘ শেরেবাংলা একে ফজলুল হক যেমন তার নবগঠিত কৃষক প্রজা পার্টির মাধ্যমে শক্তিশালী মুসলিম লীগকে পরাজিত করেছিলেন, তেমনি আওয়ামী লীগ-বিএনপির বাইরে নতুন কোন দলের নির্বাচনে জয়লাভ ও সরকার গঠন করার সম্ভাবনা উড়িয়ে দেয়া যায় না।
মোঃ আবুসালেহ সেকেন্দার : শিক্ষক, ইসলামের ইতিহাস ও সংস্কৃতি বিভাগ, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়
ংধষধয.ংধশবহফবৎ@মসধরষ.পড়স

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন