বদরূল ইমাম
বাংলাদেশের দুটি গ্যাসক্ষেত্র সিলেট (হরিপুর) ও কৈলাসটিলায় ১৯৮০-এর দশকে তেল আবিষ্কার হয়। এর মধ্যে ১৯৮৬ সালের ডিসেম্বরে আবিষ্কৃত হরিপুর তেলক্ষেত্রে মাত্র একটি কূপ থেকে বাণিজ্যিকভাবে ছয় বছর তেল উৎপাদন করার পর বন্ধ হয়ে যায়। অন্য গ্যাসক্ষেত্র কৈলাসটিলায় তেল আবিষ্কার হয় ১৯৮৮ সালে। এটি অবশ্য বাণিজ্যিক কি না, তা জানা যায়নি, যেহেতু এই কূপে কারিগরি জটিলতার কারণে এখানে জরিপকাজ যথার্থভাবে সম্পন্ন করা যায়নি। এই দুটি গ্যাসক্ষেত্র থেকে ওই সময় প্রবাহিত তেলের নমুনা সংগ্রহ করে তা পেট্রোবাংলার সংগ্রহশালায় রাখা হয়, কেবল তা-ই নয়, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভূতত্ত্ব বিভাগের ল্যাবরেটরিতেও তা রক্ষিত আছে। এ কথাটি বলার উদ্দেশ্য হলো, যেকোনো ব্যক্তি যিনি এই তেল দেখতে আগ্রহ প্রকাশ করেন, তিনি যেন আমন্ত্রিত বোধ করেন (ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রবেশ করতে অনুমতির প্রয়োজন হয় না, পেট্রোবাংলার ক্ষেত্রে হতে পারে)। এই শেষোক্ত প্রসঙ্গটি উত্থাপন করার কারণ বাংলাদেশে তেল আবিষ্কার নিয়ে সাধারণ জনমনে আগ্রহ, সন্দেহ, প্রশংসাবোধ ও তাচ্ছিল্যবোধের যে অবারিত প্রকাশ তাকে সম্বোধন করা।
ওপরের বক্তব্য থেকে এটি দেখা যায় যে বাংলাদেশে তেল আবিষ্কার হয় আজ থেকে প্রায় ২৫ বছর আগে। কিন্তু এ আবিষ্কারটির ধারাবাহিকতায় তার পরবর্তী সময়ে বিশেষ কোনো কার্যক্রম আর লক্ষ করা যায়নি। কেন হরিপুর তেলক্ষেত্রটিতে তেল উৎপাদন বন্ধ হয়ে গেল, পুনরায় উৎপাদন শুরু করতে কী পদক্ষেপ নেওয়া প্রয়োজন ছিল, তেলক্ষেত্র উন্নয়নের বিধি মোতাবেক কি এখানে তেল উৎপাদন করা হয়েছিল, তবে কি হরিপুর অপমৃত্যুর শিকার? যদি তা-ই হয়ে থাকে তবে তার জন্য দায়ী কে? একইভাবে কৈলাসটিলায় কী ঘটেছিল, কেন আবিষ্কৃত তেলস্তরটিকে যথার্থভাবে জরিপ করে দেখা হয়নি? কেন দুটি স্তর থেকে তেল প্রবাহিত হওয়ার পরও তেলের জন্য নির্দিষ্ট করে বিশেষ খননকাজ হাতে নেওয়া হয়নি? এসবই কি বাংলাদেশে তেল কার্যক্রম নিয়ে ইতিপূর্বে কোনো স্বার্থান্বেষী মহলের বিশেষ স্বার্থ হাসিলের প্রয়াস?
আমাদের দেশে সাধারণ মানুষের মধ্যে তথ্যপ্রবাহ ঘটা কোনো কোনো ক্ষেত্রে দুরূহ প্রতীয়মান হয়। কিন্তু সঠিক তথ্যপ্রবাহ জনসচেতনতা গড়ে ওঠার মৌলিক উপাদান। বর্তমান প্রবন্ধে আলোচিত দুটি তেল আবিষ্কার সম্পর্কে কিছু মৌলিক তথ্য পরিবেশন করা হলো। এ তথ্যের সূত্র হলো বাংলাদেশ ও বিদেশি তেল-গ্যাস সংস্থার যৌথ কার্যক্রমের ভিত্তিতে প্রণীত রিপোর্টসমূহ।
কৈলাসটিলা তেল: ১৯৬১ সালে আন্তর্জাতিক তেল কোম্পানি শেল ওয়েল কৈলাসটিলা গ্যাসক্ষেত্র আবিষ্কার করে যা কি না, বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর কিনে নেয়। পরবর্তী সময়ে আবিষ্কার কূপ কৈলাসটিলা-১-এর তথ্য-উপাত্ত পুনঃ বিশ্লেষণ করে বিশেষজ্ঞ মত দেন যে গ্যাস স্তরের নিচে তেল থাকার চিহ্ন বিদ্যমান। ১৯৮৮ সালে কৈলাসটিলা-২ কূপটি খনন করে দুটি তেলের স্তরের সন্ধান পাওয়া যায়, যার একটি প্রায় ৩১০৬-৩১১৯ মিটার ও অন্যটি প্রায় ৩২০৮-৩২১৭ মিটার গভীরতায় বিদ্যমান। দুটি স্তর থেকেই তেলের প্রবাহ ঘটে, যদিও এ প্রবাহ ক্ষণস্থায়ী হয়। তবে এটি উল্লেখ করা হয় যে কূপের ভেতর সিমেন্ট-বাঁধন যথাযথ না হওয়ার কারণে ঠিক কোন স্থান থেকে তেলপ্রবাহ ঘটেছে, তা নিশ্চিত শনাক্ত করা যায়নি।
২০০৩ সালে আগের কূপ থেকে প্রাপ্ত তথ্য-উপাত্ত পুনর্মূল্যায়ন করে একটি জাতীয় তেল-গ্যাস প্রতিষ্ঠান ও তার বিদেশি পরামর্শক (এইচসিইউ/এনপিডি) কৈলাসটিলা তেল মজুদের একটি হিসাব দেয় (২০০৪ সালে প্রদত্ত রিপোর্ট) যা নিম্নরূপ: প্রাপ্ত দুটি তেলস্তরের মধ্যে ওপরের স্তরে ভূগর্ভস্থ তেলের পরিমাণ প্রায় ৩৮ মিলিয়ন ব্যারেল, যা থেকে উত্তোলনযোগ্য মজুদ প্রায় ১২ মিলিয়ন ব্যারেল এবং নিচের স্তরে ভূগর্ভস্থ তেলের পরিমাণ প্রায় ১১ মিলিয়ন ব্যারেল, যা থেকে উত্তোলনযোগ্য মজুদ প্রায় চার মিলিয়ন ব্যারেল। কৈলাসটিলায় আবিষ্কৃত তেলকূপের (কৈলাসটিলা-২) ভেতর কারিগরি সমস্যা (সিমেন্ট বন্ড দুর্বল) থাকার কারণে ওই সময় তেল উত্তোলন কার্যক্রম আর অগ্রসর হয় না। পরবর্তী সময়ে এটি অবাণিজ্যিক তেলস্তর বলে ব্যাখ্যা দেওয়া হয়।
ওপরের বর্ণনামতে, কৈলাসটিলা গ্যাসক্ষেত্রে আবিষ্কৃৃত তেলের আনুমানিক মজুদ নির্ধারণ এবং কাজটির ফলাফল আজ থেকে প্রায় ১০ বছর আগে সম্পাদিত হয় ও রিপোর্টে লিপিবদ্ধ হয়। বিস্ময়ের ব্যাপার যে তার পরবর্তী সময়ে এই আবিষ্কার বা রিপোর্টের সূত্র ধরে কৈলাসটিলায় আবিষ্কৃত তেল নিয়ে আর কোনো জরিপ বা কার্যকর কর্মপরিকল্পনার কথা জানা যায়নি। কৈলাসটিলার তেল মানুষের স্মৃতি থেকে মুছে যায়। সম্প্র্রতি পেট্রোবাংলা কৈলাসটিলা তেল নিয়ে পুনরায় আলোচনার সূত্রপাত করে এবং এ নিয়ে তার কর্মপরিকল্পনা প্রকাশ করে যে শিগগির তেল উত্তোলনের লক্ষ্যে কৈলাসটিলায় একটি কূপ খনন করা হবে।
হরিপুর তেল: সিলেট গ্যাসক্ষেত্রে ১৯৮৬ সালে ৭ নম্বর কূপ খননের মূল উদ্দেশ্য ছিল গ্যাস উৎপাদন করা। টার্গেট গভীরতায় পৌঁছানোর পর কর্মরত দেশীয় ভূতত্ত্ববিদ শিলা নমুনায় তেলের চিহ্ন শনাক্ত করেন এবং আরও গভীরে খননকাজ চালাতে কর্তৃপক্ষকে রাজি করান। কিছুদূর খনন করার পরই তেলের সাক্ষাৎ পাওয়া যায় এবং তেল প্রবাহিত হয়। এভাবেই আবিষ্কৃত হয় বাংলাদেশের প্রথম তেলক্ষেত্র হরিপুর (সিলেট গ্যাসক্ষেত্রের ঠিক নিচেই)। দিনটি ছিল ২৫ ডিসেম্বর ১৯৮৬। যদিও এই আবিষ্কার দেশীয় ভূতত্ত্ববিদের সাক্ষাৎ অবদান, আবিষ্কার-পরবর্তী তেলক্ষেত্র উন্নয়নকাজটি করার ক্ষেত্রে দেশীয় সংস্থাকে না দিয়ে সরকার সিমিটার অয়েল কোম্পানি নামের অখ্যাত একটি বিদেশি কোম্পানির হাতে তুলে দেয়। দেশের তেলক্ষেত্র বিদেশি কোম্পানি সিমিটারের হাতে সমর্পণ, তেলক্ষেত্র উন্নয়ন করতে সিমিটার কোম্পানির ব্যর্থতা ও এ কোম্পানি কর্তৃক চৌর্যবৃত্তির অভিযোগ ওঠার কারণে এটির বিরুদ্ধে সুশীল সমাজের সংঘবদ্ধ আন্দোলন গড়ে ওঠে। পরিশেষে সিমিটারের চুক্তি বাতিল হয় এবং কোম্পানিটি দেশ ত্যাগ করে। কিন্তু তত দিনে হরিপুর তেলক্ষেত্র উন্নয়নের সুষ্ঠু কারিগরি পরিকল্পনা ও বিধি মোতাবেক কার্যক্রম গড়ে না ওঠার কারণে দুর্বল পরিকল্পনায় কেবল একটি কূপ থেকে সীমিত আকারে তেল উৎপাদন হতে থাকে।
হরিপুর তেলক্ষেত্রে ভূপৃষ্ঠ থেকে ২০২০-২০৩৩ মিটার গভীরতায় একটি মাত্র তেলস্তর পাওয়া যায় এবং তা থেকে ছয় বছর (১৯৮৮-১৯৯৪) তেল উৎপাদিত হয়। বিদেশি তেল-গ্যাস পরামর্শক অয়েল অ্যান্ড মাইনিং সার্ভিসেস এই তেলক্ষেত্রে তেলের মজুদ নির্ধারণ করে দেখায় যে এটিতে ভূগর্ভস্থ তেলের পরিমাণ প্রায় ১০ মিলিয়ন ব্যারেল, যা থেকে ২০ শতাংশ তেল উত্তোলন করা যাবে। অর্থাৎ সে মতে, হরিপুরে উত্তোলনযোগ্য তেলের মজুদ প্রায় দুই মিলিয়ন ব্যারেল। অন্য মতে, ৪০ শতাংশ উত্তোলনযোগ্যতা ধরে নিলে উত্তোলনযোগ্য তেলের মজুদ প্রায় চার মিলিয়ন ব্যারেল। এ তেলক্ষেত্র থেকে ইতিপূর্বে ছয় বছরে মোট ৫৬০ হাজার (প্রায় অর্ধ মিলিয়ন) ব্যারেল তেল উৎপাদিত হয়।
ছয় বছরব্যাপী সীমিত মাত্রায় তেল উৎপাদিত হওয়ার পর হরিপুর তেলক্ষেত্রের অপমৃত্যু হয়। ১৯৯৪ সালে হরিপুর তেলক্ষেত্র থেকে তেল উৎপাদন বন্ধ হয়ে যাওয়ার পর এটিকে পুনরুজ্জীবিত করার কোনো কার্যকর পরিকল্পনা দেখা যায়নি। ইতিহাসের পাতা ঘুরে সরকার গঠনে একদল আসে, একদল যায়, হরিপুর তেলক্ষেত্র লোকচক্ষুর অগোচরেই থেকে যায়। সম্প্রতি পেট্রোবাংলা হরিপুর তেলক্ষেত্রকে পুনরায় আলোচনায় এনেছে ও সেখানে নতুন কার্যক্রম চালানোর পরিকল্পনা ঘোষণা করেছে।
কৈলাসটিলা-হরিপুর তেল ও পেট্রোবাংলা: সম্প্রতি পেট্রোবাংলা হরিপুর ও কৈলাসটিলার তেল নিয়ে নতুন কার্যক্রমের যে ঘোষণা দিয়েছে, তা উৎসাহব্যঞ্জক। ইতিমধ্যে কৈলাসটিলায় তেল উত্তোলনের জন্য কূপ খননের স্থান নির্ধারণ করা হয়েছে এবং এক বছরের মধ্যে কূপ খনন হবে বলে জানানো হয়েছে। বাংলাদেশে তেল অনুসন্ধান ও উন্নয়নের বিলুপ্তপ্রায় কর্মকাণ্ডকে কার্যকরভাবে পুনরুজ্জীবিত করতে পারলে তা প্রশংসার দাবিদার হবে। তবে পেট্রোবাংলা এ দুটি স্থানে তেল মজুদের যে হিসাব প্রচার করেছে, তাকে অনেক বিশেষজ্ঞ সংগত কারণেই গ্রহণযোগ্য মনে করেন না। বিশেষ করে কূপ খননের মাধ্যমে প্রস্তাবিত নতুন তেলস্তরের উপস্থিতি নিশ্চিত না করে তাকে উত্তোলনযোগ্য মজুদ হিসেবে অন্তর্ভুক্ত করা বিধিসম্মত হয়নি। তেল-গ্যাস উন্নয়নে বিদেশি তেল কোম্পানিনির্ভর না হয়ে জাতীয় কোম্পানিকে কাজে লাগানো জাতীয় স্বার্থ সমুন্নত রাখার মোক্ষম পন্থা। জনগণ আগ্রহ নিয়ে অপেক্ষায় রয়েছে যে পেট্রোবাংলা কবে নাগাদ তার ঘোষিত তেলকূপ খনন করে প্রকৃতপক্ষেই তেল উৎপাদন করে দেখাতে পারে। পেট্রোবাংলার উচিত এটিকে চ্যালেঞ্জ হিসেবে নিয়ে তার কর্মপরিকল্পনা বাস্তবায়ন করা।
ড. বদরূল ইমাম: অধ্যাপক, ভূতত্ত্ব বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।
বাংলাদেশের দুটি গ্যাসক্ষেত্র সিলেট (হরিপুর) ও কৈলাসটিলায় ১৯৮০-এর দশকে তেল আবিষ্কার হয়। এর মধ্যে ১৯৮৬ সালের ডিসেম্বরে আবিষ্কৃত হরিপুর তেলক্ষেত্রে মাত্র একটি কূপ থেকে বাণিজ্যিকভাবে ছয় বছর তেল উৎপাদন করার পর বন্ধ হয়ে যায়। অন্য গ্যাসক্ষেত্র কৈলাসটিলায় তেল আবিষ্কার হয় ১৯৮৮ সালে। এটি অবশ্য বাণিজ্যিক কি না, তা জানা যায়নি, যেহেতু এই কূপে কারিগরি জটিলতার কারণে এখানে জরিপকাজ যথার্থভাবে সম্পন্ন করা যায়নি। এই দুটি গ্যাসক্ষেত্র থেকে ওই সময় প্রবাহিত তেলের নমুনা সংগ্রহ করে তা পেট্রোবাংলার সংগ্রহশালায় রাখা হয়, কেবল তা-ই নয়, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভূতত্ত্ব বিভাগের ল্যাবরেটরিতেও তা রক্ষিত আছে। এ কথাটি বলার উদ্দেশ্য হলো, যেকোনো ব্যক্তি যিনি এই তেল দেখতে আগ্রহ প্রকাশ করেন, তিনি যেন আমন্ত্রিত বোধ করেন (ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রবেশ করতে অনুমতির প্রয়োজন হয় না, পেট্রোবাংলার ক্ষেত্রে হতে পারে)। এই শেষোক্ত প্রসঙ্গটি উত্থাপন করার কারণ বাংলাদেশে তেল আবিষ্কার নিয়ে সাধারণ জনমনে আগ্রহ, সন্দেহ, প্রশংসাবোধ ও তাচ্ছিল্যবোধের যে অবারিত প্রকাশ তাকে সম্বোধন করা।
ওপরের বক্তব্য থেকে এটি দেখা যায় যে বাংলাদেশে তেল আবিষ্কার হয় আজ থেকে প্রায় ২৫ বছর আগে। কিন্তু এ আবিষ্কারটির ধারাবাহিকতায় তার পরবর্তী সময়ে বিশেষ কোনো কার্যক্রম আর লক্ষ করা যায়নি। কেন হরিপুর তেলক্ষেত্রটিতে তেল উৎপাদন বন্ধ হয়ে গেল, পুনরায় উৎপাদন শুরু করতে কী পদক্ষেপ নেওয়া প্রয়োজন ছিল, তেলক্ষেত্র উন্নয়নের বিধি মোতাবেক কি এখানে তেল উৎপাদন করা হয়েছিল, তবে কি হরিপুর অপমৃত্যুর শিকার? যদি তা-ই হয়ে থাকে তবে তার জন্য দায়ী কে? একইভাবে কৈলাসটিলায় কী ঘটেছিল, কেন আবিষ্কৃত তেলস্তরটিকে যথার্থভাবে জরিপ করে দেখা হয়নি? কেন দুটি স্তর থেকে তেল প্রবাহিত হওয়ার পরও তেলের জন্য নির্দিষ্ট করে বিশেষ খননকাজ হাতে নেওয়া হয়নি? এসবই কি বাংলাদেশে তেল কার্যক্রম নিয়ে ইতিপূর্বে কোনো স্বার্থান্বেষী মহলের বিশেষ স্বার্থ হাসিলের প্রয়াস?
আমাদের দেশে সাধারণ মানুষের মধ্যে তথ্যপ্রবাহ ঘটা কোনো কোনো ক্ষেত্রে দুরূহ প্রতীয়মান হয়। কিন্তু সঠিক তথ্যপ্রবাহ জনসচেতনতা গড়ে ওঠার মৌলিক উপাদান। বর্তমান প্রবন্ধে আলোচিত দুটি তেল আবিষ্কার সম্পর্কে কিছু মৌলিক তথ্য পরিবেশন করা হলো। এ তথ্যের সূত্র হলো বাংলাদেশ ও বিদেশি তেল-গ্যাস সংস্থার যৌথ কার্যক্রমের ভিত্তিতে প্রণীত রিপোর্টসমূহ।
কৈলাসটিলা তেল: ১৯৬১ সালে আন্তর্জাতিক তেল কোম্পানি শেল ওয়েল কৈলাসটিলা গ্যাসক্ষেত্র আবিষ্কার করে যা কি না, বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর কিনে নেয়। পরবর্তী সময়ে আবিষ্কার কূপ কৈলাসটিলা-১-এর তথ্য-উপাত্ত পুনঃ বিশ্লেষণ করে বিশেষজ্ঞ মত দেন যে গ্যাস স্তরের নিচে তেল থাকার চিহ্ন বিদ্যমান। ১৯৮৮ সালে কৈলাসটিলা-২ কূপটি খনন করে দুটি তেলের স্তরের সন্ধান পাওয়া যায়, যার একটি প্রায় ৩১০৬-৩১১৯ মিটার ও অন্যটি প্রায় ৩২০৮-৩২১৭ মিটার গভীরতায় বিদ্যমান। দুটি স্তর থেকেই তেলের প্রবাহ ঘটে, যদিও এ প্রবাহ ক্ষণস্থায়ী হয়। তবে এটি উল্লেখ করা হয় যে কূপের ভেতর সিমেন্ট-বাঁধন যথাযথ না হওয়ার কারণে ঠিক কোন স্থান থেকে তেলপ্রবাহ ঘটেছে, তা নিশ্চিত শনাক্ত করা যায়নি।
২০০৩ সালে আগের কূপ থেকে প্রাপ্ত তথ্য-উপাত্ত পুনর্মূল্যায়ন করে একটি জাতীয় তেল-গ্যাস প্রতিষ্ঠান ও তার বিদেশি পরামর্শক (এইচসিইউ/এনপিডি) কৈলাসটিলা তেল মজুদের একটি হিসাব দেয় (২০০৪ সালে প্রদত্ত রিপোর্ট) যা নিম্নরূপ: প্রাপ্ত দুটি তেলস্তরের মধ্যে ওপরের স্তরে ভূগর্ভস্থ তেলের পরিমাণ প্রায় ৩৮ মিলিয়ন ব্যারেল, যা থেকে উত্তোলনযোগ্য মজুদ প্রায় ১২ মিলিয়ন ব্যারেল এবং নিচের স্তরে ভূগর্ভস্থ তেলের পরিমাণ প্রায় ১১ মিলিয়ন ব্যারেল, যা থেকে উত্তোলনযোগ্য মজুদ প্রায় চার মিলিয়ন ব্যারেল। কৈলাসটিলায় আবিষ্কৃত তেলকূপের (কৈলাসটিলা-২) ভেতর কারিগরি সমস্যা (সিমেন্ট বন্ড দুর্বল) থাকার কারণে ওই সময় তেল উত্তোলন কার্যক্রম আর অগ্রসর হয় না। পরবর্তী সময়ে এটি অবাণিজ্যিক তেলস্তর বলে ব্যাখ্যা দেওয়া হয়।
ওপরের বর্ণনামতে, কৈলাসটিলা গ্যাসক্ষেত্রে আবিষ্কৃৃত তেলের আনুমানিক মজুদ নির্ধারণ এবং কাজটির ফলাফল আজ থেকে প্রায় ১০ বছর আগে সম্পাদিত হয় ও রিপোর্টে লিপিবদ্ধ হয়। বিস্ময়ের ব্যাপার যে তার পরবর্তী সময়ে এই আবিষ্কার বা রিপোর্টের সূত্র ধরে কৈলাসটিলায় আবিষ্কৃত তেল নিয়ে আর কোনো জরিপ বা কার্যকর কর্মপরিকল্পনার কথা জানা যায়নি। কৈলাসটিলার তেল মানুষের স্মৃতি থেকে মুছে যায়। সম্প্র্রতি পেট্রোবাংলা কৈলাসটিলা তেল নিয়ে পুনরায় আলোচনার সূত্রপাত করে এবং এ নিয়ে তার কর্মপরিকল্পনা প্রকাশ করে যে শিগগির তেল উত্তোলনের লক্ষ্যে কৈলাসটিলায় একটি কূপ খনন করা হবে।
হরিপুর তেল: সিলেট গ্যাসক্ষেত্রে ১৯৮৬ সালে ৭ নম্বর কূপ খননের মূল উদ্দেশ্য ছিল গ্যাস উৎপাদন করা। টার্গেট গভীরতায় পৌঁছানোর পর কর্মরত দেশীয় ভূতত্ত্ববিদ শিলা নমুনায় তেলের চিহ্ন শনাক্ত করেন এবং আরও গভীরে খননকাজ চালাতে কর্তৃপক্ষকে রাজি করান। কিছুদূর খনন করার পরই তেলের সাক্ষাৎ পাওয়া যায় এবং তেল প্রবাহিত হয়। এভাবেই আবিষ্কৃত হয় বাংলাদেশের প্রথম তেলক্ষেত্র হরিপুর (সিলেট গ্যাসক্ষেত্রের ঠিক নিচেই)। দিনটি ছিল ২৫ ডিসেম্বর ১৯৮৬। যদিও এই আবিষ্কার দেশীয় ভূতত্ত্ববিদের সাক্ষাৎ অবদান, আবিষ্কার-পরবর্তী তেলক্ষেত্র উন্নয়নকাজটি করার ক্ষেত্রে দেশীয় সংস্থাকে না দিয়ে সরকার সিমিটার অয়েল কোম্পানি নামের অখ্যাত একটি বিদেশি কোম্পানির হাতে তুলে দেয়। দেশের তেলক্ষেত্র বিদেশি কোম্পানি সিমিটারের হাতে সমর্পণ, তেলক্ষেত্র উন্নয়ন করতে সিমিটার কোম্পানির ব্যর্থতা ও এ কোম্পানি কর্তৃক চৌর্যবৃত্তির অভিযোগ ওঠার কারণে এটির বিরুদ্ধে সুশীল সমাজের সংঘবদ্ধ আন্দোলন গড়ে ওঠে। পরিশেষে সিমিটারের চুক্তি বাতিল হয় এবং কোম্পানিটি দেশ ত্যাগ করে। কিন্তু তত দিনে হরিপুর তেলক্ষেত্র উন্নয়নের সুষ্ঠু কারিগরি পরিকল্পনা ও বিধি মোতাবেক কার্যক্রম গড়ে না ওঠার কারণে দুর্বল পরিকল্পনায় কেবল একটি কূপ থেকে সীমিত আকারে তেল উৎপাদন হতে থাকে।
হরিপুর তেলক্ষেত্রে ভূপৃষ্ঠ থেকে ২০২০-২০৩৩ মিটার গভীরতায় একটি মাত্র তেলস্তর পাওয়া যায় এবং তা থেকে ছয় বছর (১৯৮৮-১৯৯৪) তেল উৎপাদিত হয়। বিদেশি তেল-গ্যাস পরামর্শক অয়েল অ্যান্ড মাইনিং সার্ভিসেস এই তেলক্ষেত্রে তেলের মজুদ নির্ধারণ করে দেখায় যে এটিতে ভূগর্ভস্থ তেলের পরিমাণ প্রায় ১০ মিলিয়ন ব্যারেল, যা থেকে ২০ শতাংশ তেল উত্তোলন করা যাবে। অর্থাৎ সে মতে, হরিপুরে উত্তোলনযোগ্য তেলের মজুদ প্রায় দুই মিলিয়ন ব্যারেল। অন্য মতে, ৪০ শতাংশ উত্তোলনযোগ্যতা ধরে নিলে উত্তোলনযোগ্য তেলের মজুদ প্রায় চার মিলিয়ন ব্যারেল। এ তেলক্ষেত্র থেকে ইতিপূর্বে ছয় বছরে মোট ৫৬০ হাজার (প্রায় অর্ধ মিলিয়ন) ব্যারেল তেল উৎপাদিত হয়।
ছয় বছরব্যাপী সীমিত মাত্রায় তেল উৎপাদিত হওয়ার পর হরিপুর তেলক্ষেত্রের অপমৃত্যু হয়। ১৯৯৪ সালে হরিপুর তেলক্ষেত্র থেকে তেল উৎপাদন বন্ধ হয়ে যাওয়ার পর এটিকে পুনরুজ্জীবিত করার কোনো কার্যকর পরিকল্পনা দেখা যায়নি। ইতিহাসের পাতা ঘুরে সরকার গঠনে একদল আসে, একদল যায়, হরিপুর তেলক্ষেত্র লোকচক্ষুর অগোচরেই থেকে যায়। সম্প্রতি পেট্রোবাংলা হরিপুর তেলক্ষেত্রকে পুনরায় আলোচনায় এনেছে ও সেখানে নতুন কার্যক্রম চালানোর পরিকল্পনা ঘোষণা করেছে।
কৈলাসটিলা-হরিপুর তেল ও পেট্রোবাংলা: সম্প্রতি পেট্রোবাংলা হরিপুর ও কৈলাসটিলার তেল নিয়ে নতুন কার্যক্রমের যে ঘোষণা দিয়েছে, তা উৎসাহব্যঞ্জক। ইতিমধ্যে কৈলাসটিলায় তেল উত্তোলনের জন্য কূপ খননের স্থান নির্ধারণ করা হয়েছে এবং এক বছরের মধ্যে কূপ খনন হবে বলে জানানো হয়েছে। বাংলাদেশে তেল অনুসন্ধান ও উন্নয়নের বিলুপ্তপ্রায় কর্মকাণ্ডকে কার্যকরভাবে পুনরুজ্জীবিত করতে পারলে তা প্রশংসার দাবিদার হবে। তবে পেট্রোবাংলা এ দুটি স্থানে তেল মজুদের যে হিসাব প্রচার করেছে, তাকে অনেক বিশেষজ্ঞ সংগত কারণেই গ্রহণযোগ্য মনে করেন না। বিশেষ করে কূপ খননের মাধ্যমে প্রস্তাবিত নতুন তেলস্তরের উপস্থিতি নিশ্চিত না করে তাকে উত্তোলনযোগ্য মজুদ হিসেবে অন্তর্ভুক্ত করা বিধিসম্মত হয়নি। তেল-গ্যাস উন্নয়নে বিদেশি তেল কোম্পানিনির্ভর না হয়ে জাতীয় কোম্পানিকে কাজে লাগানো জাতীয় স্বার্থ সমুন্নত রাখার মোক্ষম পন্থা। জনগণ আগ্রহ নিয়ে অপেক্ষায় রয়েছে যে পেট্রোবাংলা কবে নাগাদ তার ঘোষিত তেলকূপ খনন করে প্রকৃতপক্ষেই তেল উৎপাদন করে দেখাতে পারে। পেট্রোবাংলার উচিত এটিকে চ্যালেঞ্জ হিসেবে নিয়ে তার কর্মপরিকল্পনা বাস্তবায়ন করা।
ড. বদরূল ইমাম: অধ্যাপক, ভূতত্ত্ব বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন