আফতাব চৌধুরী
সভ্যতার উন্নতির সঙ্গে সঙ্গে মানুষের প্রয়োজনের চাহিদা মেটাতে দেশের বিভিন্ন প্রান্তে গড়ে উঠছে অসংখ্য কলকারখানা, ইটভাটা ইত্যাদি। এ কলকারখানায় উত্পন্ন সালফার ডাই-অক্সাইড এবং নাইট্রোজেন ডাই-অক্সাইড গ্যাস বায়ুতে থাকা জলীয় বাষ্পের সঙ্গে মিশে অম্লবৃষ্টি সৃষ্টি হচ্ছে। এ অম্লবৃষ্টির প্রভাবে সৌন্দর্য স্মৃতি একদিকে যেমন— তাজমহল, বিভিন্ন স্থাপনা নষ্ট হচ্ছে, অন্যদিকে ভূপৃষ্ঠের পানির সঙ্গে মিশে বিভিন্ন রোগের সৃষ্টি হচ্ছে।
কলকারখানা ও যানবাহনে উত্পন্ন কার্বনডাই-অক্সাইড, কার্বন মনোক্সাইড, ক্লোরোফ্লোরো কার্বন প্রভৃতি গ্যাস সূর্যের আলোকরশ্মি শোষণ করে বায়ুমণ্ডলের উষ্ণতা ক্রমাগতভাবে বৃদ্ধি করছে, ফলে মেরু অঞ্চলের বরফ গলে সমুদ্রের জলভাগ বৃদ্ধি পেয়ে ভবিষ্যতে সমুদ্রের উপকূল ভূমি প্লাবিত হওয়ার আশঙ্কা দেখা দিচ্ছে। শীতক যন্ত্রে ব্যবহার করা ক্লোরোফ্লোরো কার্বন নামক পদার্থটি ওজোন স্তরের মধ্যে অসংখ্য ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র ছিদ্রের সৃষ্টি করছে। তাছাড়া অতি বেগুনি উড়োজাহাজগুলো বায়ুমণ্ডলে নাইট্রোজেন অক্সাইড উত্পন্ন করায় ওজোন স্তরের অবক্ষয় হচ্ছে। ফলে সূর্যের অতি বেগুনি রশ্মি সরাসরি জীবজগতে এসে পড়তে পারে। এ রশ্মি মানুষের দেহের ত্বকে ক্যান্সারসদৃশ রোগ ঘটাতে পারে। কলকারখানায় ব্যবহৃত বিভিন্ন ধাতব অ্যাসিড, লবণ, ক্যাডমিয়াম, আর্সেনিক, সিসা ও পারা প্রভৃতি মাটি ও পানির সঙ্গে মিশে মাটির গুণাগুণ নষ্ট করছে এবং নদী-নালার পানির সঙ্গে মিশে পানি দূষিত করছে। কম পরিমাণ কৃষি ভূমিতে অধিক উত্পাদন লাভের আশায় আধুনিক কৃষি কার্যে ব্যবহৃত বিভিন্ন রাসায়নিক সার, যেমন ইউরিয়া, সুপার ফসফেট, মিউরিয়েট অব পটাশ প্রভৃতি ব্যবহারের ফলে ভূমিগত পানি দূষিত হচ্ছে। এ পানি জীবজন্তু পান করায় বিভিন্ন রোগের সৃষ্টি হচ্ছে এবং সঙ্গে সঙ্গে জীবের সংখ্যা কমে যাচ্ছে। শস্য অনিষ্টকারী কীটপতঙ্গ ধ্বংস করার জন্য কীটনাশক দ্রব্য যেমন—ডিডিটি, ফিনাইল প্রভৃতি এবং অপ্রয়োজনীয় উদ্ভিদের বৃদ্ধিকে বাধা দেয়ার জন্য অপতৃণনাশক ডাইক্লোরিফিয়াস্কিন অ্যাসিটিক অ্যাসিড ব্যবহারে পানি ও বায়ু দূষিত হওয়ার ফলে পরিবেশের ওপর বিরূপ প্রভাব পড়ছে। আধুনিক কৃষি ব্যবস্থায় উন্নতমানের কৃষি সরঞ্জামের ব্যবহার পানিসিঞ্চন ব্যবস্থা এবং জুমচাষ পদ্ধতি প্রয়োগের ফলে কৃষি উপযোগী উর্বর মাটি ক্ষয় হয়ে নালা-নদীতে পতিত হয়ে বন্যার পরিমাণও বর্তমানে বৃদ্ধি পাচ্ছে। আজ আমাদের চার পাশে শব্দ আর শব্দ। যানবাহনে মোটর গাড়ির হর্ন, কলকারখানার অবিরাম আওয়াজ, হোটেল-রেস্তোরাঁয় ও সিডি ক্যাসেটের দোকানে উচ্চ স্বরে গান-বাজনা, মেলা বা হাটবাজারে ক্রেতাদের আকর্ষণে মাইকের আওয়াজ—এসব শব্দদূষণ গ্রামাঞ্চলে কিছুটা সহ্য হলেও শহরাঞ্চলের মানুষ কিন্তু অতিষ্ঠ। আমরা প্রয়োজনের চেয়ে অপ্রয়োজনে বেশি কথা বলি। সময়ের মূল্য সম্পর্কে আমাদের জ্ঞান কম থাকায় অনর্থক তর্কজুড়ে দিই। এক মিনিটের কথা ঘুরিয়ে-ফিরিয়ে ১০ মিনিটে বলে থাকি। অল্পেই উত্তেজিত হয়ে যাই, অযথা চিত্কার করি। অন্যের অসুবিধার কথা চিন্তা না করে অনেক মা-বাবা সন্ধ্যার লেখাপড়ার সময় উচ্চ শব্দে টিভি ছেড়ে বসে থাকেন। এতে ক্ষতি হয় নিজের সন্তানদের এবং পাশের বাড়ির সন্তানদেরও। শব্দদূষণ সম্পর্কে অনেকে অবগত না থাকায় প্রতিদিন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, হাসপাতাল ইত্যাদি স্থানে যেখানে জনসমাগম বেশি হয়, সেখানে শব্দদূষণ ঘটছে। মানব শরীরে শব্দের ধারণক্ষমতা মাত্র ৭০ ডেসিবেল, তার চেয়ে বেশি হলে চিকিত্সকের মতে, হৃদরোগ এবং লিভার সিরোসিসে আক্রান্ত হতে পারে মানুষ। হর্নের শব্দ ধমনীকে সংকুচিত করে হৃিপণ্ডের রক্ত সরবরাহ কমিয়ে দেয়। মাথাধরা, বিরক্তি, মেজাজ নষ্ট, ঘুমের ব্যাঘাত, কানে কম শোনা ও মনোসংযোগের অভাব অতিমাত্রায় শব্দদূষণের ফলে হয়ে থাকে। পৃথিবীতে যখন মানুষ প্রথম এসেছিল তখন একটি নির্মল বিশুদ্ধ পরিবেশে বাস করেছিল। তারপর জনসংখ্যা বৃদ্ধির সঙ্গে যন্ত্র ও সভ্যতার দ্রুত উন্নতির ফলে পরিবেশ দূষণ একটি বিরাট সমস্যা হয়ে দাঁড়িয়েছে।
* পরিবেশ দূষণমুক্ত রাখার প্রথম পদক্ষেপ হলো—গাছপালা অযথা কাটা বন্ধ করে বছরে প্রত্যেকের অন্তত একটি করে বৃক্ষ রোপণ বা আবশ্যিক হওয়া এখন দরকার। * জনসংখ্যা বৃদ্ধির হার কমিয়ে এটাকে স্থিতিশীল করে রাখতে হবে। * মানুষের চাহিদা মেটাতে যে বৃহত্ শিল্প গড়ে উঠেছে তা কমিয়ে ক্ষুদ্র শিল্প বা কুটির শিল্পের প্রতি জোর দিতে হবে। * কলকারখানার বর্জ্য পদার্থ নদীতে না ফেলে এর পুনর্ব্যবহার করা অতীব প্রয়োজনীয়। কলকারখানায় উত্পন্ন ধোঁয়া, ময়লা প্রভৃতি নিয়ন্ত্রণের জন্য যেসব শিল্প আইন আছে তা যথাযথভাবে পালন করতে হবে। * আধুনিক কৃষি ব্যবস্থায় ব্যবহৃত রাসায়নিক সার এবং কীটনাশক, বননাশক প্রভৃতি ব্যবহারের পরিবর্তে জৈবিক সার ও ওষুধ ব্যবহার করা দরকার। * পরিবেশ দূষণ ও তার প্রতিকার সম্পর্কে জনগণের মধ্যে সচেতনতা গড়ে তোলা আবশ্যক। * পরিবেশের সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে জনবসতি তৈরি করা এবং গ্রাম ও বস্তি উন্নয়নের প্রতি প্রচেষ্টা চালানো অতি গুরুত্বপূর্ণ বিবেচনা করতে হবে।
লেখক : সাংবাদিক ও কলামিস্ট, বৃক্ষ রোপণে জাতীয় পুরস্কার প্রাপ্ত।
কলকারখানা ও যানবাহনে উত্পন্ন কার্বনডাই-অক্সাইড, কার্বন মনোক্সাইড, ক্লোরোফ্লোরো কার্বন প্রভৃতি গ্যাস সূর্যের আলোকরশ্মি শোষণ করে বায়ুমণ্ডলের উষ্ণতা ক্রমাগতভাবে বৃদ্ধি করছে, ফলে মেরু অঞ্চলের বরফ গলে সমুদ্রের জলভাগ বৃদ্ধি পেয়ে ভবিষ্যতে সমুদ্রের উপকূল ভূমি প্লাবিত হওয়ার আশঙ্কা দেখা দিচ্ছে। শীতক যন্ত্রে ব্যবহার করা ক্লোরোফ্লোরো কার্বন নামক পদার্থটি ওজোন স্তরের মধ্যে অসংখ্য ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র ছিদ্রের সৃষ্টি করছে। তাছাড়া অতি বেগুনি উড়োজাহাজগুলো বায়ুমণ্ডলে নাইট্রোজেন অক্সাইড উত্পন্ন করায় ওজোন স্তরের অবক্ষয় হচ্ছে। ফলে সূর্যের অতি বেগুনি রশ্মি সরাসরি জীবজগতে এসে পড়তে পারে। এ রশ্মি মানুষের দেহের ত্বকে ক্যান্সারসদৃশ রোগ ঘটাতে পারে। কলকারখানায় ব্যবহৃত বিভিন্ন ধাতব অ্যাসিড, লবণ, ক্যাডমিয়াম, আর্সেনিক, সিসা ও পারা প্রভৃতি মাটি ও পানির সঙ্গে মিশে মাটির গুণাগুণ নষ্ট করছে এবং নদী-নালার পানির সঙ্গে মিশে পানি দূষিত করছে। কম পরিমাণ কৃষি ভূমিতে অধিক উত্পাদন লাভের আশায় আধুনিক কৃষি কার্যে ব্যবহৃত বিভিন্ন রাসায়নিক সার, যেমন ইউরিয়া, সুপার ফসফেট, মিউরিয়েট অব পটাশ প্রভৃতি ব্যবহারের ফলে ভূমিগত পানি দূষিত হচ্ছে। এ পানি জীবজন্তু পান করায় বিভিন্ন রোগের সৃষ্টি হচ্ছে এবং সঙ্গে সঙ্গে জীবের সংখ্যা কমে যাচ্ছে। শস্য অনিষ্টকারী কীটপতঙ্গ ধ্বংস করার জন্য কীটনাশক দ্রব্য যেমন—ডিডিটি, ফিনাইল প্রভৃতি এবং অপ্রয়োজনীয় উদ্ভিদের বৃদ্ধিকে বাধা দেয়ার জন্য অপতৃণনাশক ডাইক্লোরিফিয়াস্কিন অ্যাসিটিক অ্যাসিড ব্যবহারে পানি ও বায়ু দূষিত হওয়ার ফলে পরিবেশের ওপর বিরূপ প্রভাব পড়ছে। আধুনিক কৃষি ব্যবস্থায় উন্নতমানের কৃষি সরঞ্জামের ব্যবহার পানিসিঞ্চন ব্যবস্থা এবং জুমচাষ পদ্ধতি প্রয়োগের ফলে কৃষি উপযোগী উর্বর মাটি ক্ষয় হয়ে নালা-নদীতে পতিত হয়ে বন্যার পরিমাণও বর্তমানে বৃদ্ধি পাচ্ছে। আজ আমাদের চার পাশে শব্দ আর শব্দ। যানবাহনে মোটর গাড়ির হর্ন, কলকারখানার অবিরাম আওয়াজ, হোটেল-রেস্তোরাঁয় ও সিডি ক্যাসেটের দোকানে উচ্চ স্বরে গান-বাজনা, মেলা বা হাটবাজারে ক্রেতাদের আকর্ষণে মাইকের আওয়াজ—এসব শব্দদূষণ গ্রামাঞ্চলে কিছুটা সহ্য হলেও শহরাঞ্চলের মানুষ কিন্তু অতিষ্ঠ। আমরা প্রয়োজনের চেয়ে অপ্রয়োজনে বেশি কথা বলি। সময়ের মূল্য সম্পর্কে আমাদের জ্ঞান কম থাকায় অনর্থক তর্কজুড়ে দিই। এক মিনিটের কথা ঘুরিয়ে-ফিরিয়ে ১০ মিনিটে বলে থাকি। অল্পেই উত্তেজিত হয়ে যাই, অযথা চিত্কার করি। অন্যের অসুবিধার কথা চিন্তা না করে অনেক মা-বাবা সন্ধ্যার লেখাপড়ার সময় উচ্চ শব্দে টিভি ছেড়ে বসে থাকেন। এতে ক্ষতি হয় নিজের সন্তানদের এবং পাশের বাড়ির সন্তানদেরও। শব্দদূষণ সম্পর্কে অনেকে অবগত না থাকায় প্রতিদিন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, হাসপাতাল ইত্যাদি স্থানে যেখানে জনসমাগম বেশি হয়, সেখানে শব্দদূষণ ঘটছে। মানব শরীরে শব্দের ধারণক্ষমতা মাত্র ৭০ ডেসিবেল, তার চেয়ে বেশি হলে চিকিত্সকের মতে, হৃদরোগ এবং লিভার সিরোসিসে আক্রান্ত হতে পারে মানুষ। হর্নের শব্দ ধমনীকে সংকুচিত করে হৃিপণ্ডের রক্ত সরবরাহ কমিয়ে দেয়। মাথাধরা, বিরক্তি, মেজাজ নষ্ট, ঘুমের ব্যাঘাত, কানে কম শোনা ও মনোসংযোগের অভাব অতিমাত্রায় শব্দদূষণের ফলে হয়ে থাকে। পৃথিবীতে যখন মানুষ প্রথম এসেছিল তখন একটি নির্মল বিশুদ্ধ পরিবেশে বাস করেছিল। তারপর জনসংখ্যা বৃদ্ধির সঙ্গে যন্ত্র ও সভ্যতার দ্রুত উন্নতির ফলে পরিবেশ দূষণ একটি বিরাট সমস্যা হয়ে দাঁড়িয়েছে।
* পরিবেশ দূষণমুক্ত রাখার প্রথম পদক্ষেপ হলো—গাছপালা অযথা কাটা বন্ধ করে বছরে প্রত্যেকের অন্তত একটি করে বৃক্ষ রোপণ বা আবশ্যিক হওয়া এখন দরকার। * জনসংখ্যা বৃদ্ধির হার কমিয়ে এটাকে স্থিতিশীল করে রাখতে হবে। * মানুষের চাহিদা মেটাতে যে বৃহত্ শিল্প গড়ে উঠেছে তা কমিয়ে ক্ষুদ্র শিল্প বা কুটির শিল্পের প্রতি জোর দিতে হবে। * কলকারখানার বর্জ্য পদার্থ নদীতে না ফেলে এর পুনর্ব্যবহার করা অতীব প্রয়োজনীয়। কলকারখানায় উত্পন্ন ধোঁয়া, ময়লা প্রভৃতি নিয়ন্ত্রণের জন্য যেসব শিল্প আইন আছে তা যথাযথভাবে পালন করতে হবে। * আধুনিক কৃষি ব্যবস্থায় ব্যবহৃত রাসায়নিক সার এবং কীটনাশক, বননাশক প্রভৃতি ব্যবহারের পরিবর্তে জৈবিক সার ও ওষুধ ব্যবহার করা দরকার। * পরিবেশ দূষণ ও তার প্রতিকার সম্পর্কে জনগণের মধ্যে সচেতনতা গড়ে তোলা আবশ্যক। * পরিবেশের সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে জনবসতি তৈরি করা এবং গ্রাম ও বস্তি উন্নয়নের প্রতি প্রচেষ্টা চালানো অতি গুরুত্বপূর্ণ বিবেচনা করতে হবে।
লেখক : সাংবাদিক ও কলামিস্ট, বৃক্ষ রোপণে জাতীয় পুরস্কার প্রাপ্ত।
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন