শনিবার, ৯ জুন, ২০১২

স্যাডিস্ট বনাম রাষ্ট্রদ্রোহিতা



এমএ নোমান
দেড় থেকে দুই বছর আগের কথা। পেশাগত কাজেই তথ্য অধিদফতরের একজন সিনিয়র তথ্য কর্মকর্তার কক্ষে গিয়েছিলাম। দেখে মনে হলো তিনি বেশ ইতস্তত ও চিন্তিত। কেমন আছেন, জানতে চাইলে দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বললেন, এই আছি! বেশ ভালোই আছি। আমি যতই খারাপ থাকি না কেন, দ্রব্যমূল্যের লাগামছাড়া ঊর্ধ্বগতির বাজারে গিয়ে যতই নাজেহাল হই না কেন, বাসায় গিয়ে তীব্র লোডশেডিং আর পানির অভাবে যতই হাহাকার করি না কেন, রাস্তায় যানজটে পড়ে যতই হাপিত্যেশ করি না কেন, ছেলে-মেয়ের পড়ালেখার খরচ যোগাতে গিয়ে যতই হিমশিম খাই না কেন, শেয়ারবাজারে যতই পুঁজি হারাই না কেন, সন্ত্রাসী আর চাঁদাবাজদের হুমকিতে যতই লুকিয়ে থাকি না কেন, চিত্কার করে বলব—ভালো আছি। আমি বেশ ভালো আছি। আমি ভালো নেই এ কথা বললেই আমার বিরুদ্ধে রাষ্ট্রদ্রোহ মামলা হবে। বুঝেন না? এ সময়ে খারাপ থাকাটাও রাষ্ট্রদ্রোহিতার শামিল। এই দেখেননি মাত্র কয়েকদিন আগে খারাপ থাকার নির্মম বর্ণনা দিয়ে কবিতা লেখার অপরাধে আমাদের তথ্য সচিবের চাকরি তো গেলই, উপরন্তু রাষ্ট্রদ্রোহ মামলার আসামি হিসেবে প্রতিনিয়ত তাকে এখন আদালতের কাঠগড়ায় গিয়ে হাজিরা দিতে হয়। একনাগাড়ে কথাগুলো বলে থামলেন ওই কর্মকর্তা।
ব্যক্তি জীবন নিয়ে তার এই আক্ষেপের কারণ জানতেই বললেন, আরে ভাই গত কয়েকদিন ধরে শীর্ষ সন্ত্রাসী সুইডেন আসলামের নামে টেলিফোন করে আমার কাছে দশ লাখ টাকা চাঁদা চাইছে। কারাগারে নাকি তার অবস্থা ভালো না। তাকে দ্রুত বের করে চিকিত্সা না দিলে সে নাকি মারা যাবে। এজন্য কয়েক কোটি টাকা ঘুষ দিতে হবে। আমার ভাগে পড়েছে দশ লাখ। বলেন তো, আমরা হচ্ছি ছা-পোষা কর্মচারী। একটু ভালো থাকার জন্য স্ত্রীর গয়না বিক্রি করে শেয়ারবাজারে বিনিয়োগ করেছিলাম। তাও শেষ। এখন নুন আনতেই পান্তা ফুরায়। তার ওপরে আবার চাঁদার দাবি! ভয়ে স্ত্রী ও ছেলেমেয়েরা বাসা থেকে বেরুচ্ছে না। অফিসে, বাসায় ও মোবাইল ফোনে অব্যাহত হুমকি। চাঁদা না দিলে নাকি সপরিবারে শেষ করে দেবে। নিজের প্রয়োজনের কথা না বলেই তাকে সান্ত্বনা ও সাহস দিয়ে চলে আসলাম।
বর্তমান সরকার ক্ষমতায় আসার পর থেকেই ‘রাষ্ট্রদ্রোহ ও রাষ্ট্রদ্রোহী’ শব্দ দু’টি বেশ পরিচিতি লাভ করে। সরকারের অগণতান্ত্রিক, ফ্যাসিবাদী ও বেআইনি কর্মকাণ্ডের সমালোচনা করলেই রাষ্ট্রদ্রোহ মামলা। বিরোধী দল ও মতের পরিচিত এবং শীর্ষস্থানীয় ব্যক্তিদের মধ্যে খুব কমই আছেন যারা এ সরকারের সময়ে রাষ্ট্রদ্রোহ মামলার শিকার হননি। সরকারের সমালোচনা করাই রাষ্ট্রদ্রোহ, মূলত এই নীতিই গ্রহণ করেছে সরকার। সর্বশেষ গত বছর সংবিধানে পঞ্চদশ সংশোধনী এনে এমন একটি অনুচ্ছেদ সংযোজন করা হয়েছে যার দ্বারা সরকার ইচ্ছা করলেই দেশের ১৬ কোটি মানুষকে রাষ্ট্রদ্রোহ মামলার আসামি করে কারাগারে ঢুকিয়ে দিতে পারে।
সরকার গত সাড়ে তিন বছরে বিদ্যুত্ খাতে ৩৪ হাজার কোটি টাকা ভর্তুকি দিয়েছে। কিন্তু বিদ্যুত্ খাতে আগের যে কোনো সময়ের তুলনায় এখন নাজুক পরিস্থিতি বিরাজ করছে। কুইক রেন্টাল বিদ্যুত্ কেন্দ্রসহ বিদ্যুত্ খাতের হাজার হাজার কোটি টাকা লুটপাট আর দুর্নীতি নিয়ে সরকারের ভেতরেও তুমুল ঝড় বইছে। অর্থমন্ত্রীও বিদ্যুত্ খাতের বিপর্যয়ের কথা স্বীকার করে বলেছেন যে, বিদ্যুত্ পরিস্থিতি আগের অবস্থায়ই রয়েছে। সাড়ে তিন বছরে আমরা বিদ্যুত্ খাতের কোনো উন্নতি করতে পারিনি। খাম্বা আর মিটারের রমরমা ব্যবসা আর লুটপাট নিয়ে সমালোচনার বহমান ঝড়ের মধ্যেই উপদেষ্টা ড. তৌফিক-ই-এলাহী চৌধুরী ঘোষণা দিলেন ‘যারা বিদ্যুত্ সঙ্কট আর কুইক রেন্টাল দুর্নীতি নিয়ে কথা বলে তারা হয় অজ্ঞ না হয় রাষ্ট্রদ্রোহী। উপদেষ্টার এই ঘোষণায় ভাবলাম এবার বিরোধী দলের পাশাপাশি সরকারি দলের লোকেরাও রাষ্ট্রদ্রোহী হিসেবে চিহ্নিত হতে চলেছেন।
এখন হাইকোর্টের একটি বিশেষ বেঞ্চ এ পর্যন্ত কতবার যে ‘রাষ্ট্রদ্রোহী’ শব্দটির প্রয়োগ করেছেন তার হিসাব কষা মুশকিল। খ্যাতিমান সাংবাদিক, আমলা, শিক্ষক, বুদ্ধিজীবী, আইনজীবী, চিকিত্সক, ব্যবসায়ী, প্রকৌশলীসহ দেশের এমন কোনো পেশা নেই যার প্রতিনিধিদের হাইকোর্টের ওই বেঞ্চে ডেকে নিয়ে এই তকমাটি দেয়া হয়নি। এমন অভিযোগ ভুক্তভোগীদেরই সম্প্রতি জাতীয় সংসদের স্পিকারও ওই বেঞ্চ থেকে রাষ্ট্রদ্রোহী উপাধি পেয়েছেন। জাতীয় সংসদের অধিবেশনে প্রবীণ ও নবীন সংসদ সদস্যরা তকমা প্রদানকারী ওই বিচারপতিকে মানসিক বিকারগ্রস্ত, উন্মাদ ও স্যাডিস্ট হিসেবে উল্লেখ করে তার অপসারণ দাবি করেছেন। ‘স্যাডিস্ট’ শব্দের ব্যাখ্যা দিয়ে বর্ষিয়ান রাজনীতিবিদ তোফায়েল আহমদ বলেছেন, যারা বিনা কারণে ক্ষমতার অপব্যবহার করে অন্যকে কষ্ট দিয়ে আনন্দ পায় এবং মনের বা পারিবারিক অশান্তি ও দুঃখ দূর করে তাদেরই স্যাডিস্ট বলা হয়। তোফায়েল আহমদের বক্তব্যের পর থেকেই সর্বত্র এখন বোমা মানিকের পাশাপাশি ‘স্যাডিস্ট’ শব্দটিও সমভাবে উচ্চারিত হচ্ছে।
দীর্ঘদিন পরে মনে পড়ল সিনিয়র সেই তথ্য কর্মকর্তাকে সুইডেন আসলামের নামে দেয়া হুমকির কথা। আমাদের দেশে সন্ত্রাসী ও মানসিক বিকারগ্রস্তদের বাহারি নামের তালিকা দিনদিনই দীর্ঘ হচ্ছে। ক্রাইম রিপোর্টারদের কাছে পিচ্চি হান্নান, কালা জাহাঙ্গীর, সুইডেন আসলাম, ডাকাত শহিদ, মুরগি মিলন, কুত্তামারা সেলিম, হাতকাটা বাবু, ঠোঁটকাটা সাত্তার, টোকাই সাগর, বোমা মানিক, টারমিনাল মুন্না ইত্যাদি নামগুলো বেশ পরিচিত। নিরীহ মানুষকে বিভিন্ন সময়ে হুমকি দিয়ে মাঝে মাঝে এসব বিশেষণযুক্ত নামগুলো মিডিয়ায় প্রধান খবরে পরিণত হয়। প্রবীণ সংসদ সদস্য তোফায়েল আহমেদের সৌজন্যে নতুন শব্দ ‘স্যাডিস্ট’এর সঙ্গে পরিচিত হলেন দেশের মানুষ।
লেখক : সাংবাদিক
nomansalimbd@yahoo.com

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন