মর্জিনা আফসার রোজী
আমাদের রাজনীতিতে এটাই চরম ব্যর্থতা যে, সব সরকারই ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হওয়ার পর জনগণের উন্নয়ন, সমৃদ্ধি আর দেশপ্রেম ভুলে গিয়ে কেবল আসন চিরস্থায়ী করার অপপ্রয়াস চালিয়ে থাকে। বিরোধী দলকে শায়েস্তা করার জন্য সব শক্তি প্রয়োগ করে, অভ্যন্তরীণ যুদ্ধ ঘোষণা করে। একথা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক সৈয়দ আশরাফ নিজ মুখেই উচ্চারণ করেছেন। একথা সর্বজনজ্ঞাত, বাংলাদেশে সংসদীয় পদ্ধতির গণতান্ত্রিক সরকার ব্যবস্থা প্রচলিত রয়েছে। কিন্তু বাস্তবিক হচ্ছে অকার্যকর একদলীয় সরকার, আর গণতন্ত্রের বিন্দুমাত্র অবশিষ্ট নেই। যা ঘটছে তাকে স্বৈরশাসনের শীর্ষ পর্যায় বলে অভিহিত করা যায়। দেশে বিরাজমান সীমাহীন অব্যবস্থাপনায় মারাত্মক বিপর্যস্ত জনজীবন। যেখানে সাধারণ মানুষের জন্য অপরিহার্য পাঁচটি মৌলিক চাহিদারই প্রাপ্যতা নেই, সেখানে সরকার তাদের সব শক্তি ক্ষমতা ও অর্থ অপচয় করছে শানিত খড়গ নিয়ে বিরোধী দলের পেছনে ছুটতে। রাষ্ট্রীয় ক্ষমতার আর এতটুকু অবশিষ্ট নেই যা তারা প্রয়োগ করেনি। তার ওপর রয়েছে প্রধানমন্ত্রীসহ সব পর্যায়ের অদক্ষ, ভাষনসমৃদ্ধ মন্ত্রীদের কাণ্ডজ্ঞানহীন, উস্কানিমূলক এবং হাস্যকর উক্তি। যা বিশ্ব দরবারে বাংলাদেশের ক্ষুদ্রতা ও নীচতারই প্রমাণ দেয়। মাত্র পাঁচ বছরের জন্য ক্ষমতার মোহে আচ্ছন্ন হয়ে চিরস্থায়ী হওয়ার স্বপ্নে বিভোর হয়ে যায়। আর তখনই চরম স্বেচ্ছাচারী আর অনৈতিক পথকে সম্বল করে নেয়। যুগ যুগ ধরে একই ভুল করে থাকে ক্ষমতাসীন দল। গণতান্ত্রিক লেবাস পরে কোনো সরকার ক্ষমতায় এসে যখন বিরোধী দলকে নিয়মনীতির তোয়াক্কা না করে, অপশক্তি প্রয়োগ করে জুলুম-নির্যাতন চালিয়ে যায়, তখন সে সরকারের পতনও অতি কাছে চলে আসে। অতি সাধারণ মানুষও একথা বোঝেন, অথচ আন্তর্জাতিক জ্ঞানসমৃদ্ধ সরকারি দলের নীতিনির্ধারকরা সে কথাটি বুঝতে চান না। তাই তো মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা দাম্ভিক স্বরে জাতির সামনে বলেছেন, ‘বিরোধী দলকে কীভাবে সোজা রাস্তায় আনতে হয় আমরা সেটা জানি।’ আবার বলেছেন, ‘বিএনপিকে আওয়ামী লীগ সরকারের অধীনেই নির্বাচন করতে হবে।’ সাধারণ মানুষের প্রশ্ন, দেশের বিরোধী দলকে হামলা-মামলা, জুলুম-অত্যাচার করে সোজা পথে আনার এখতিয়ার তাদের কে দিয়েছে! গণতান্ত্রিক সরকার ব্যবস্থায় শক্তিশালী বিরোধী দল তো থাকবেই। গণতন্ত্রকেই যদি আমরা সমুন্নত রাখতে চাই তবে ভিন্ন মতাবলম্বীদের কণ্ঠ চেপে ধরে স্তব্ধ করে দেয়া তো সম্ভব নয়। এ প্রসঙ্গে বিখ্যাত দার্শনিক ডেল কার্নেগির একটি জনপ্রিয় উক্তি মনে পড়ে গেল। তিনি বলেছেন, ‘মানুষ মুখে যা বলে সেটা সে নয়, মানুষ যা করে সেটাই হলো সে।’ দেশের বৃহত্ জনগোষ্ঠী একথার সত্যতাই অবলোকন করছে। সরকার শীর্ষ ক্ষমতার অধিকারী হয়েও অবিরত জনসাধারণের সঙ্গে মিথ্যাচার, ধোঁকাবাজি আর ছলচাতুরি করে যাচ্ছে। যার বিরূপ প্রতিফলন সর্বত্রই স্পষ্ট হয়ে উঠছে। প্রধানমন্ত্রী তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থাকে দানব সরকার বলে আখ্যায়িত করেছেন। অথচ বর্তমানে তিনি ড্রাগন সরকার হিসেবে জনমনে অপরিসীম ভীতির সৃষ্টি করে আত্মপ্রকাশ করেছেন। মিথ্যা মামলা দিয়ে বিএনপির শীর্ষ ৩৩ নেতাসহ ১৮ দলীয় জোট নেতাদের আজ ১৮ দিন ধরে জেলে পুরে রেখেছেন। স্বভাবতই প্রশ্ন জাগে—কত দিন, আর কত জনকে আপনারা মিথ্যার আবরণে সত্যের সূর্যকে ঢেকে রাখবেন? আদৌ সেটা সম্ভব নয়। জেলখানাগুলোকে আরও অনেক বেশি স্বাস্থ্যসম্মত আর বাসযোগ্য করে তোলা প্রয়োজন এখনই। কারণ সময়ের বিবর্তনে আপনারা তো একদিন বিরোধী পক্ষে আসবেনই, সেদিন তো আপনাদের দেখানো রাস্তায়ই আপনাদের যেতে হবে। জেনেছি, কাশিমপুরে শীর্ষ সন্ত্রাসীদের জন্য নির্মিত বহুতল ভবনের আলো-বাতাসহীন ক্ষুদ্র কয়েকটি কামরায় বিএনপির ভারপ্রাপ্ত মহাসচিবসহ সিনিয়র নেতাদের বন্দি করে রেখেছেন। বয়োজ্যেষ্ঠ গণতন্ত্রকামী, উচ্চশিক্ষিত এসব নেতা জন্য যা কিনা চরম শাস্তি। তার ওপর পর্যাপ্ত বিদ্যুত্ প্রদানে ব্যর্থ আপনারা ওইসব নেতাকে সাজানো নাটক করে সীমাহীন দুর্ভোগ ও যন্ত্রণার মধ্যে পতিত করেছেন। সময় একদিন এসব অপরাধের মাশুল কড়ায়-গণ্ডায় বুঝে নেবে। ইতিহাস কাউকে নিস্তার দেবে না। গণতান্ত্রিক সরকার ব্যবস্থায় শক্তিশালী বিরোধী দল দেশের সমৃদ্ধি, উন্নয়ন আর অগ্রগতিকে ত্বরান্বিত করে। আর এক্ষেত্রে সরকারি দল ধৈর্য, সহিষ্ণুতা আর নম্রতার পরিচয় দেবে—এটাই স্বাভাবিক। অথচ বর্তমান সরকার দেশে গণতান্ত্রিক চর্চার পরিবর্তে একনায়কতান্ত্রিক শাসন ব্যবস্থা প্রবর্তন করেছে। যেখানে সরকারি দল ছাড়া আর কোনো দলের অস্তিত্ব থাকতে পারে না। রাষ্ট্রবিজ্ঞানী ডুভারজার বলেছেন, একনায়কতান্ত্রিক দলীয় ব্যবস্থা কোনো সুদৃঢ় মতবাদের ওপর প্রতিষ্ঠিত নয়, যা এর নিজস্ব জীবনদর্শন ঘোষণা করে এবং সমগ্র সমাজকে তা মানতে বাধ্য করে। আজ একটি বিষয় স্পষ্টই প্রমাণিত যে, আওয়ামী লীগ দলটির নীতিগত কাঠামোর মধ্যে এমন কিছু স্বার্থান্বেষী ব্যক্তি রয়েছে যাদের প্ররোচনায় দলটি পর্যায়ক্রমে আত্মঘাতী উদ্যোগ নিয়ে ধীর বিষক্রিয়ায় এর জনপ্রিয়তা শূন্যের কোঠায় নিয়ে ঠেকিয়েছে। অতি কৌশলে দলটিকে নির্লজ্জ স্বেচ্ছাচারী-জুলুমবাজ শাসকের সরকারের মূর্তি ধারণ করিয়েছে। যদিওবা ক্ষমতার জৌলুসের আড়ালে এ কর্মকাণ্ড সাময়িক আত্মতৃপ্তির উদ্রেক করে, তথাপি এর পরিণতি যে কখনোই শুভ হয় না তার অসংখ্য বাস্তব চিত্র রয়েছে। রাষ্ট্রের সর্বাধিক নির্ভরযোগ্য স্থান বিচার বিভাগকে এতটাই নাচের পুতুল বানিয়েছে যে, প্রতিষ্ঠানটির শীর্ষ ব্যক্তিটি একজন স্বকীয় মানুষ না হয়ে চাবি দেয়া পুতুলে পরিণত হয়েছেন। দেশের এই গণতন্ত্র হরণ করা, অসহিষ্ণু রাজনৈতিক পরিস্থিতি এবং দেশপ্রেমহীন-অদক্ষ রাষ্ট্র পরিচালনার কারণে আজ বিশ্ববিবেকের কাছে মাথা নিচু করে থাকতে হচ্ছে। অন্যায়-অত্যাচার আর অবিচারের মাত্রা এতটাই বেশি হয়েছে যে, ক্রমাগত সেটা মহাপাপে পরিণত হচ্ছে। আর পাপের বোঝা বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে একদিন তা ভেঙে চূর্ণ-বিচূর্ণ হয়ে যাবে। এতকিছুর পরও তারা এই দিবাস্বপ্নে বিভোর যে, এই সরকারের নিয়ন্ত্রণে কোনো প্রহসনের নির্বাচন হলে ১৬ কোটি মানুষ তা মেনে নেবে না—কিছুতেই না। বাংলাদেশ আয়তনে ছোট হতে পারে, কিন্তু এদেশের মানুষের রয়েছে ন্যায্য দাবি আদায়ে সংগ্রামী ভূমিকা। ভাষার জন্য, স্বাধীনতার জন্য, গণতন্ত্রের জন্য তারা অকাতরে তাজা রক্ত রাজপথে ঢেলে দিয়েছে। প্রয়োজনে আরেকবার গণতন্ত্রকে পুনরুদ্ধারের জন্য জীবনপণ করে সংগ্রামে অবতীর্ণ হবে। তবুও দেশের স্বাধীনতা-সার্বভৌমত্বকে বিপন্ন হতে দেবে না। বিরোধী দলের ন্যায়সঙ্গত দাবি আদায়ের আন্দোলনের সঙ্গে যখন দেশের সব শ্রেণীর পেশাজীবী সংহতি প্রকাশ করে ঘর ছেড়ে রাজপথে নেমে আসবে, তখন কিন্তু এক মহাপ্রলয়ের অবতারণা হবে। সে দিনটিই হবে এ সরকারের আমলে নজিরবিহীন অত্যাচারের শেষ দিন। সেদিনের অপেক্ষায়ই গণতন্ত্রকামী মানুষগুলো দিন গুনছে। দুর্ভাগ্যক্রমে এ ভূখণ্ডটি উন্নয়ন ও অবকাঠামোর দিক দিয়ে পিছিয়ে থাকলেও জনশক্তিতে মোটেও তুচ্ছ নয়। তাই দাম্ভিক শাসকগোষ্ঠীর একথা স্মরণ রাখা উচিত যে, বার বার পোড় খাওয়া সরল কাদামাটির জনগণ আর বেশিদিন তাদের ভাগ্যকে নিয়ে রসিকতা করে হোলি খেলার সুযোগ দেবে না। জনস্ফীতির দাবানল একবার প্রজ্বলিত হলে তা কেবল ওই অত্যাচারীর মসনদকে জ্বালিয়ে-পুড়িয়ে ছাই করে দিয়ে তবেই ক্ষান্ত হবে। বাংলাদেশের স্বাধীনতার পর ইতিহাসের উত্থান-পতনের দিকে দৃষ্টি ফেরালে এ বাস্তবতারই প্রতিফলন ঘটে। তাই বলছি, গোখরা সাপের ফণা ফুঁসে উঠেছে, এখনই নমনীয় হোন। নয়তো ইতিহাসের আঁস্তাকুড়ে নিক্ষিপ্ত হয়ে আজীবন মানুষের ঘৃণা আর অভিসম্পাতের ভাগীদার হয়ে, সাধের মানবজীবন চরম ব্যর্থতায় পরিণত হবে।
লেখক : প্রাবন্ধিক ও কথাসাহিত্যিক
লেখক : প্রাবন্ধিক ও কথাসাহিত্যিক
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন