শনিবার, ১৬ জুন, ২০১২

বিশ্বের উষ্ণায়ন, জলবায়ুর পরিবর্তন ও বাংলাদেশ



॥ ড. মো: তারিকুল ইসলাম ॥

বিশ্বের উষ্ণায়ন তথা জলবায়ুর পরিবর্তন এবং এর সম্ভাব্য প্রতিক্রিয়া নিয়ে বিজ্ঞানী মহলে উদ্বেগের অন্ত নেই। সবশেষে কোপেনহেগেনে অনুষ্ঠিত ইন্টারন্যাশনাল সায়েন্টিফিক কংগ্রেস অন কাইমেট চেঞ্জের অনুষ্ঠানে উপস্থাপিত গবেষণাপত্রে তার প্রতিফলন দেখা যায়। জলবায়ু পরিবর্তন ও তার প্রভাব সম্পর্কে মতপার্থক্য থাকলেও বাস্তবে তা পরিলতি হচ্ছে। পৃথিবীতে উদ্ভিদ, প্রাণী, কীটপতঙ্গ, বাতাস, জল, মাটি এসব মিলে একটা সুন্দর ভারসাম্যপূর্ণ পরিবেশ বজায় থাকা প্রয়োজন। কিন্তু পৃথিবীর মানুষ এবং তার কৃতকর্মের জন্য পরিবেশ বিপর্যস্ত হচ্ছে। মানুষের সংখ্যাধিক্য, বন কেটে উজাড় করা আর বিভিন্ন উপায়ে কার্বন ডাই-অক্সাইড বেড়ে যাওয়ার কারণে পরিবেশ তিগ্রস্ত হচ্ছে। অনেক আগেই (১৯০০ সালে) পরিবেশবিদেরা সতর্ক করেছিলেন যে, মানুষ পরিবেশের ওপর নানা দিক থেকে যেভাবে নির্যাতন চালাতে শুরু করেছে তাতে আগামী ২৫ বছরের ভেতরে পৃথিবীর উষ্ণতা বৃদ্ধি চরম পর্যায়ের দিকে এগিয়ে যাবে। উষ্ণতা বৃদ্ধিহেতু (১) মেরুদেশের ও চির তুষারবৃত্ত পর্বতশৃঙ্গের বরফ প্রচুর পরিমাণে গলতে শুরু করবে এবং সমুদ্র ও নদীর পানি স্ফীত হয়ে উঠবে, (২) বৃদ্ধি পাবে বন্যা, ঘূর্ণিঝড় ও দাবানলের প্রকোপ, (৩) নানা ধরনের জীবাণুর সংক্রমণ ঘটবে এবং কিছু কিছু জীবাণু অতি মারাত্মক আকার ধারণ করবে ও (৪) উষ্ণতা বৃদ্ধিতে নাভিশ্বাস উঠবে পৃথিবীর প্রাণী জগতের। কোপেনহেগেনের সম্মেলন থেকে জানা যায়, ২১০০ সালের মধ্যে সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধির পরিমাণ এক মিটার হওয়ার সম্ভবনা রয়েছে। এই উচ্চতা আরো বেশিও হতে পারে। এর অর্থ হলো, আমরা যদি গ্রিন হাউজ গ্যাসের নির্গমন দ্রুত এবং উল্লেখযোগ্য পরিমাণে কমাতে না পারি, তাহলে আগামী দিনগুলোতে সাগরতীরবর্তী এলাকার প্রতি ১০টি বাসগৃহের মধ্যে একটি সমুদ্রের পানিতে প্লাবিত হবে। 
বাংলাদেশে নগরায়ন ও শিল্পায়নের ফলে নানা ধরনের পরিবেশ দূষণের সম্মুখীন হচ্ছে। এই দূষণগুলো থেকে দেশকে রা করতে বিজ্ঞানীসহ সর্বস্তরের লোকদের কাজ করতে হবে। পৃথিবীর উন্নত ও উন্নয়নশীল দেশের শিল্প, কলকারখানা, গাড়ি ও শীতাতপ নিয়ন্ত্রণ যন্ত্র থেকে নির্গত নানা ধরনের গ্রিন হাউজ গ্যাস যেমন কোরোফোরো কার্বন, মিথেন, কার্বন ডাই অক্সাইড, কার্বন মনোক্সাইড বায়ুমণ্ডলে জমা হচ্ছে। ফলে সূর্য থেকে আগত ুদ্র তরঙ্গ দৈর্ঘ্যরে রশ্মি যখন পৃথিবী পৃষ্ঠ থেকে প্রতিফলিত হয়ে দীর্ঘ তরঙ্গ দৈর্ঘ্যরে রশ্মি হিসেবে ফিরে যেতে চায় তখন এসব গ্যাসের কারণে পারে না। জলবায়ুবিদদের ধারণা, আগামী ২০৩০-২০৫০ সালের মধ্যে গ্রিন হাউজ প্রতিক্রিয়ার ফলে গড় তাপমাত্রা ২-৫ ডিগ্রি সেন্টিগ্রেড বৃদ্ধি পাবে এবং তা যদি হয় এই তাপমাত্রা বৃদ্ধির ফল হিসেবে গলবে মেরু অঞ্চলের বরফ এবং বৃদ্ধি পাবে সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা। বাংলাদেশের দণিাঞ্চলের দুই-তৃতীয়াংশ নিম্নভূমি সমুদ্রে তলিয়ে যাওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। বৃদ্ধি পাবে লবণাক্ততার পরিমাণ। দেখা দেবে খাদ্যাভাব আর মহামারী। ফলে দেশের বিপুল জনগোষ্ঠী উদ্বাস্তুতে পরিণত হবে। বাংলাদেশের পরিবেশবিষয়ক নানা ধরনের সমস্যার পাশাপাশি এটিও একটি গুরুত্বপূর্ণ সমস্যা। এ ধরনের সমস্যা সমাধান করতে না পারলে আমাদের অস্তিত্ব হুমকির মুখে পড়বে। 
পরিবেশ বিজ্ঞানীরা মনে করেন, বায়ুমণ্ডলে কার্বন ডাই-অক্সাইড, কোরাফোরো কার্বন, মিথেন, নাইট্রাস অক্সাইড, সালফার ডাই-অক্সাইডের পরিমাণ বেড়ে যাওয়ায় দেখা দিচ্ছে গ্রিন হাউজ প্রতিক্রিয়া এবং তিগ্রস্ত হচ্ছে ওজোন স্তর। নাইট্রোজেন ঘটিত অধিক সার ব্যবহারের ফলে তার থেকে নাইট্রোস অক্সাইড গ্যাস বেরোতে থাকে। এই গ্যাস ওপরে উঠে এসে পৃথিবী পৃষ্ঠের অনেক ওপরে অবস্থিত ওজোন স্তরের সাথে বিক্রিয়া শুরু করে দেয়। ওজোন স্তরটি এর সাথে পাতলা হতে শুরু করে। পৃথিবী পৃষ্ঠের ওপরিভাগের এই ওজোন স্তর খুবই গুরুত্বপূর্ণ। এই ওজোন স্তর থাকার ফলে আলট্রাভায়োলেট রশ্মি পৃথিবীতে প্রবেশ করতে পারে না। আলট্রাভায়োলেট রশ্মি জীবনের অন্যতম মূল উপাদান কার্বোহাইড্রেট, প্রোটিন ইত্যাদিরও বিনাস সাধন করে। এমনকি উদ্ভিদ, কীটপতঙ্গ, ডিএনএও এর হাত থেকে রেহাই পায় না। এ ছাড়া রেফ্রিজারেটরে ব্যবহৃত এরোসোল যার প্রধান উপকরণ হলো ফুরো কার্বন সেটাও ওজোন স্তরকে বিশেষভাবে তিগ্রস্ত করে। তাদের মধ্যে উল্লেখ্যযগ্যে হলো কোরোফোরো কার্বন। পরিবেশ গবেষকরা এক সমীায় দেখিয়েছেন, বিশ্বে ও উন্নত দেশগুলোতে উৎপন্ন ৮৫ শতাংশ কোরোফোরো কার্বন ও ৫০ শতাংশ কার্বন ডাই অক্সাইডের কারণেই ওজোন স্তরে য় ও ভূমণ্ডল উত্তপ্ত হওয়ার মতো বিপর্যয়ের সৃষ্টি হচ্ছে। ফলে বিগত ১০০ বছরে পৃথিবীর তাপমাত্রা ০.৩ ডিগ্রি থেকে ০.৮ ডিগ্রি সেলসিয়াসে গিয়ে পৌঁছেছে। আগামী ২০৩০ সাল নাগাদ পৃথিবীর তাপমাত্রা ১.৫ থেকে ৪.৫ ডিগ্রি পর্যন্ত বৃদ্ধি পাবে। তাতে উত্তর গোলার্ধে জমে থাকা বরফ গলতে শুরু করবে এবং সমুদ্রতলের উচ্চতা ২০-৩০ সেন্টিমিটার পর্যন্ত বেড়ে যাবে। ফলে ২০০৪ সালের সুনামি, ২০০৭ সালের সিডর, ২০০৮ সালের নার্গিসের মতো প্রাকৃতিক দুর্যোগের আশঙ্কা বাড়বে। 
আধুনিক বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির দ্রুত প্রসারের ফলে কলকারখানা, যানবাহন প্রভৃতি থেকে বায়ুদূষণের পরিমাণ প্রচুর বেড়ে গিয়েছে, কয়লা, জ্বালানি তেল ইত্যাদি পোড়ানোর ফলে নির্গত ধোঁয়া, ধূলিকণা, কয়লার সূক্ষ্ম গুঁড়ো, কারখানার চিমনি থেকে উৎপন্ন সালফার ডাই অক্সাইড গ্যাস, মোটরগাড়ির এক্সহস্ট থেকে উৎপ্তি হাইড্রোকার্বন বাষ্প, সীসা, নাইট্রোজেন অক্সাইড পদার্থগুলো বাতাসকে দূষিত করছে প্রতিনিয়ত। আধুনিক বড় বড় শিল্পনগরী থেকে যে ধোঁয়া বের হচ্ছে তার মধ্যে থেকে সূক্ষ্ম কঠিন কণা যার ওপর জলবিন্দু ও অন্যান্য তরল বস্তু পড়ে একটা অস্বচ্ছ ভারী বাতাসের আবরণ তৈরি করে। আবরণের সালফার ডাই অক্সাইড বাতাসের সংস্পর্শে এসে এরোসোল সৃষ্টি করে। এটা শ্বাস-প্রশ্বাসের অসুবিধা ঘটায় এমনকি এ থেকে ব্রঙ্কাইটিস রোগ পর্যন্ত হতে পারে। আবরণের মাঝে কিছু ওজোন গ্যাস থাকতে পারে সেটা উদ্ভিদের জন্য মারাত্মক, আবরণের নাইট্রোজেন ডাই অক্সাইড গ্যাস এবং বিষাক্ত রাসায়নিক বস্তু পেরোমি অ্যাসিটাইল নাইট্রেট (প্যান) উদ্ভিদ ও প্রাণীর চোখের তিসাধন করে। আবরণ বা ধোঁয়া বেশি হলে সূর্যালোকের স্বচ্ছ কিরণ ব্যাহত হয়ে উদ্ভিদের সালোকসংশ্লেষণ প্রক্রিয়াও মন্থর হতে পারে। আধুনিক বড় বড় শহর ও শিল্প নগরীতে বায়ুদূষণের অন্যান্য উপকরণ হলোÑ হাইড্রোকার্বন, বেনজিন, ক্যাডমিয়াম, পারদ, নাইট্রিক অ্যাসিড, নাইট্রাস অ্যাসিড, হাইড্রোজেন সালফাইড, হাইড্রোকোরিক অ্যাসিড, কোরিন, আর্সেনিক, ফরমাল্ডিহাইড, সালফিউরিক ্অ্যাসিড, সীসা, ম্যাঙ্গানিজ, নাইট্রিক অক্সাইড, নাইট্রাস অক্সাইড, সালফার ডাই অক্সাইড, পেরোমি অ্যাসিটাইল নাইট্রেট ইত্যাদি। এগুলো শ্বাসকষ্ট, মাথাব্যথা, চোখ জ্বালা করা, ক্যান্সার, উচ্চ রক্তচাপসহ নানাবিধ রোগের কারণ।
বাংলাদেশ একটি কৃষিপ্রধান জনবহুল দেশ। প্রায় ১৬ কোটি লোকের এই দেশে ৮.২ মিলিয়ন হেক্টর আবাদি জমিতে বছরে খাদ্য চাহিদা বর্তমানে প্রায় ২৪৫ লাখ মেট্রিক টন। অধিকমাত্রায় গ্রিন হাউজ গ্যাস নিঃসরণের ফলে বিশ্বতাপমাত্রা ক্রমেই বৃদ্ধি পচ্ছে এবং আশঙ্কা করা হচ্ছে ২০৭৫ সাল নাগাদ বিশ্বতাপমাত্রা ১.৩-২.৬০ সেলসিয়াস বাড়বে এবং হিমালয়ের বরফ গলার কারণে সমুদ্রের পানির উচ্চতা এক মিটার বৃদ্ধি পাবে এবং বাংলাদেশের এক-দশমাংশ দণি অঞ্চলের উপকূল এলাকা সমুদ্রের লবণাক্ত পানিতে প্লাবিত হবে। ফলে দুই কোটি লোক আবহাওয়াগত শরণার্থীতে পরিণত হবে। উপকূলীয় এলাকায় লবণাক্ত জমির পরিমাণ বৃদ্ধিসহ সারা দেশের কৃষিতে এর ব্যাপক প্রভাব পরিলতি হবে। দেশে বন্যা, খরা, টর্নেডো ইত্যাদিতে ঘটনমাত্রা বাড়বে। জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে বাংলাদেশের কৃষিতে বিভিন্ন ফসলের ফলন ১০-১৩ শতাংশ কমার আশঙ্কা করা হচ্ছে

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন