সৈয়দ ফখরুল হাসান মুরাদ
প্রতিবছরের মতো এবারও জাতীয় সংসদে ২০১২-১৩ অর্থবছরের বাজেট উপস্থাপিত হয়েছে। সংসদে এবং সংসদের বাইরে বাজেট নিয়ে বিশদ আলোচনার পর আশা করা হচ্ছে, এ মাসের শেষ নাগাদ তা চূড়ান্ত হবে এবং অনুমোদিত হবে। একটা বাজেট দেশের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। দেশবাসীর জীবনমান, আয়-ব্যয়, অর্থনৈতিক উন্নয়ন পরিকল্পনা বাজেট থেকে দেখা যায়। বাজেটের দিকনির্দেশনা থেকে শিল্পপতিরা বিনিয়োগ করে থাকেন, ব্যবসায়ীরা ব্যবসার স্ট্র্যাটেজি ঠিক করেন। তাই বাজেট ব্যবসায়ী-শিল্পপতিদের কাছে অনেক বেশি গুরুত্বপূর্ণ এবং এর প্রতি তাদের আগ্রহ বেশি থাকে। অর্থনীতিবিদরা বাজেটের চুলচেরা বিশ্লেষণ করেন, মতামত দিয়ে থাকেন। কিন্তু দেশের আপামর জনসাধারণের কাছে বাজেট ততটা গুরুত্ব বহন করে না, বরং অনেকাংশে ভীতির কারণ হয়ে থাকে।
দেশের বৃহত্তর জনগোষ্ঠী দিন আনে দিন খায়। তারা দেখে, বাজারের অবস্থার কী পরিবর্তন হলো; তারা দেখে, কোন জিনিসের দাম কমবে আর কোনটা বাড়বে। মূল্যস্ফীতির কারণে সাধারণ মানুষের কাছে কোনো জিনিসের দাম কমে না, বরং সব সময়ই বাড়তে থাকে। টাকার বিনিময় হার বৃদ্ধি পেলে আমদানি করা পণ্যের দাম বাড়ে। এর সঙ্গে পাল্লা দিয়ে স্থানীয়ভাবে উত্পাদিত পণ্যের দামও বাড়ে। কলার দাম প্রতিটি এখন আট থেকে দশ টাকা, ডিমের দামও তেমনি। এসব দেশেই উত্পাদিত হয়। দাম বেড়ে চলেছে চাল, ডাল, তেল, মরিচের। অন্য সবকিছুর তুলনায় চালের মূল্যবৃদ্ধি কম। অন্যদিকে সাধারণ মানুষকে বিদ্যুত্ ব্যবহার করতে হয়, যার মূল্যবৃদ্ধির সঙ্গে বাজেটের কোনো সম্পর্ক নেই, কোনো দিকনির্দেশনাও থাকে না। সংসদকে পাশ কাটিয়ে সময় সময় এর মূল্য বৃদ্ধি করা হয়। গ্রামবাংলা বা প্রত্যন্ত অঞ্চলে যারা বিদ্যুত্ ব্যবহারের মতো সৌভাগ্যবান নন, তাদের কেরোসিন কিনতে হয় উচ্চ মূল্যে, যার মূল্যবৃদ্ধিও সংসদের সিদ্ধান্তের বাইরে হয়। তাই বাজেটের প্রতি গ্রামবাংলার মানুষের আগ্রহ নেই।
গ্রামের মানুষ সাদা টাকা কালো টাকা বোঝে না। তারা বোঝে সরকারি দফতরে গিয়ে কাজ করতে, পুলিশের সাহায্য পেতে নগদ কড়ি দিতে হয়। শুধু ট্যাক্স বা খাজনা দিয়ে চলে না। আইন-আদালতে শুধু উকিল-মোক্তারকে নয়, অদৃশ্য খাতে মালপানি ঢালতে হয়। সরকারি হাসপাতালে চিকিত্সা পেতেও একই দশা। তাই চাকরি পেতে বস্তা ভর্তি টাকা দিতে হয়। রাস্তা, ভবন বা সেতু নির্মাণে অদৃশ্য আয় আছে অনেকের। বাজেট নিয়ে তাদের বোঝার কিছু নেই। তারা এটা বুঝতে চায় না—সঠিক পথে আয় করে শতকরা ১৫, ২০ বা ২৫ ভাগ আয়কর দিয়ে টাকা সাদা করতে হয়। এরা ঝুঁকি নিয়ে ব্যবসা করেন, কর দেন। কিন্তু কালো টাকার লোকজন তাদের অপ্রদর্শিত আয়, ভিন্ন পথে সংগৃহীত অর্থের মাত্র দশ ভাগ কর দিয়ে কালো টাকাকে সাদা করার সুযোগ রাখা হচ্ছে বাজেটে। প্রধানমন্ত্রী এবং অর্থমন্ত্রী চাইলে সংসদে আলোচনা হোক বা না হোক, সংসদ সদস্যদের সমর্থন থাকুক আর না থাকুক, কালো টাকা সাদা হবে। আর এর বিনিয়োগ গ্রামেগঞ্জে হবে না, হবে শহরে বা অন্য কোথাও। এরাই হয়তো সমাজ নিয়ন্ত্রণ করবে; সমাজের সাদা মানুষ হবে।
সাধারণ মানুষের জীবনধারণের ব্যয় বেড়েছে, আয়ও বেড়েছে। তবে আয়ের চেয়ে ব্যয় বেশি বলে প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষকদের পর্যন্ত রাস্তায় নামতে হয়। দরিদ্র এই জনগোষ্ঠীর দেশে করমুক্ত ন্যূনতম আয়ের সীমা এক লাখ আশি হাজার টাকা থেকে দুই লাখ বা আড়াই লাখ করা হয় না। কিন্তু ন্যূনতম করের পরিমাণ আড়াই হাজার থেকে তিন হাজারে লাফ দিচ্ছে, এটাই প্রস্তাব। মনে হচ্ছে, অর্থমন্ত্রীর ধারণা নিম্ন আয়ের মানুষের কর দেয়ার সক্ষমতা বেড়েছে। অর্থমন্ত্রী ঘাটতি বাজেট উপস্থাপন করেছেন। ফলে অনেকেরই সন্দেহ, ব্যাংক থেকে সরকারের ঋণ নেয়ার পরিমাণ বৃদ্ধি পাবে, অথবা উন্নয়ন প্রকল্পে ব্যয় হ্রাস পাবে। কিন্তু মন্ত্রী ভাবতে পারলেন কীভাবে—স্বল্প আয়ের মানুষ, যাদের নিত্যদিন একান্ত প্রয়োজনীয় ব্যয় কাটছাঁট করে জীবন অতিবাহিত করতে হয়, তারা তাদের দৈনন্দিন খরচ থেকে কীভাবে বর্ধিত কর প্রদান করবে? এদের কথা কে ভাববে? গ্রামে গ্রামে গড়ে উঠতে পারত কুটির শিল্প। কিন্তু অবকাঠামো এবং বিদ্যুতের অভাবে তা হচ্ছে না। বিকল্প বিদ্যুতের উত্পাদনের তেমন কোনো দিকনির্দেশনা বাজেটে নেই। বাজেটে উইন্ড মিল, সোলার, কয়লাভিত্তিক বিদ্যুেকন্দ্র নির্মাণের কথা নেই।
উন্নতমানের কয়লা দিয়ে আধুনিক পদ্ধতিতে বিদ্যুত্ উত্পাদন করলে কার্বন নিঃসরণ খুবই কম হয়, বিষয়টি নিয়ে কথা নেই। অন্যদিকে পৃথিবীজুড়ে দক্ষ শ্রমিকের অভাব। সে অভাব পূরণে দেশের বিশাল বেকার জনগোষ্ঠী গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখতে পারে, কিন্তু তাদের দক্ষ জনশক্তিতে রূপান্তরের কোনো আলোর দিশা বাজেটে নেই। অথচ এসব প্রবাসীদের আয়ে গ্রামবাংলার উন্নয়ন নিশ্চিত হতে পারত। গ্রামেগঞ্জে তথ্যপ্রযুক্তি পৌঁছে দেয়ার গালভরা কথা শোনা যায়, বলা হয় ডিজিটাল দেশ গড়া হবে, কিন্তু গ্রামেগঞ্জে বিদ্যুত্ না থাকলে ডিজিটাল বাংলাদেশ হবে কীভাবে? গ্রামের কৃষক হাঁস-মুরগির খামারি মোবাইলে কথা বলে তথ্য আদান-প্রদান করে লাভবান হতে চেষ্টা করে। সেই কথা বলার ওপরও করারোপ করা হলো। তাই গ্রামের মানুষ বোঝে না, বাজেট কী, বাজেট কার জন্য?
লেখক : অধ্যাপক সাউথইস্ট ইউনিভার্সিটি এবং ডিন (ভারপ্রাপ্ত), স্কুল অব সায়েন্স অ্যান্ড ইঞ্জিনিয়ারিং
trust_murad@yahoo.co.uk
দেশের বৃহত্তর জনগোষ্ঠী দিন আনে দিন খায়। তারা দেখে, বাজারের অবস্থার কী পরিবর্তন হলো; তারা দেখে, কোন জিনিসের দাম কমবে আর কোনটা বাড়বে। মূল্যস্ফীতির কারণে সাধারণ মানুষের কাছে কোনো জিনিসের দাম কমে না, বরং সব সময়ই বাড়তে থাকে। টাকার বিনিময় হার বৃদ্ধি পেলে আমদানি করা পণ্যের দাম বাড়ে। এর সঙ্গে পাল্লা দিয়ে স্থানীয়ভাবে উত্পাদিত পণ্যের দামও বাড়ে। কলার দাম প্রতিটি এখন আট থেকে দশ টাকা, ডিমের দামও তেমনি। এসব দেশেই উত্পাদিত হয়। দাম বেড়ে চলেছে চাল, ডাল, তেল, মরিচের। অন্য সবকিছুর তুলনায় চালের মূল্যবৃদ্ধি কম। অন্যদিকে সাধারণ মানুষকে বিদ্যুত্ ব্যবহার করতে হয়, যার মূল্যবৃদ্ধির সঙ্গে বাজেটের কোনো সম্পর্ক নেই, কোনো দিকনির্দেশনাও থাকে না। সংসদকে পাশ কাটিয়ে সময় সময় এর মূল্য বৃদ্ধি করা হয়। গ্রামবাংলা বা প্রত্যন্ত অঞ্চলে যারা বিদ্যুত্ ব্যবহারের মতো সৌভাগ্যবান নন, তাদের কেরোসিন কিনতে হয় উচ্চ মূল্যে, যার মূল্যবৃদ্ধিও সংসদের সিদ্ধান্তের বাইরে হয়। তাই বাজেটের প্রতি গ্রামবাংলার মানুষের আগ্রহ নেই।
গ্রামের মানুষ সাদা টাকা কালো টাকা বোঝে না। তারা বোঝে সরকারি দফতরে গিয়ে কাজ করতে, পুলিশের সাহায্য পেতে নগদ কড়ি দিতে হয়। শুধু ট্যাক্স বা খাজনা দিয়ে চলে না। আইন-আদালতে শুধু উকিল-মোক্তারকে নয়, অদৃশ্য খাতে মালপানি ঢালতে হয়। সরকারি হাসপাতালে চিকিত্সা পেতেও একই দশা। তাই চাকরি পেতে বস্তা ভর্তি টাকা দিতে হয়। রাস্তা, ভবন বা সেতু নির্মাণে অদৃশ্য আয় আছে অনেকের। বাজেট নিয়ে তাদের বোঝার কিছু নেই। তারা এটা বুঝতে চায় না—সঠিক পথে আয় করে শতকরা ১৫, ২০ বা ২৫ ভাগ আয়কর দিয়ে টাকা সাদা করতে হয়। এরা ঝুঁকি নিয়ে ব্যবসা করেন, কর দেন। কিন্তু কালো টাকার লোকজন তাদের অপ্রদর্শিত আয়, ভিন্ন পথে সংগৃহীত অর্থের মাত্র দশ ভাগ কর দিয়ে কালো টাকাকে সাদা করার সুযোগ রাখা হচ্ছে বাজেটে। প্রধানমন্ত্রী এবং অর্থমন্ত্রী চাইলে সংসদে আলোচনা হোক বা না হোক, সংসদ সদস্যদের সমর্থন থাকুক আর না থাকুক, কালো টাকা সাদা হবে। আর এর বিনিয়োগ গ্রামেগঞ্জে হবে না, হবে শহরে বা অন্য কোথাও। এরাই হয়তো সমাজ নিয়ন্ত্রণ করবে; সমাজের সাদা মানুষ হবে।
সাধারণ মানুষের জীবনধারণের ব্যয় বেড়েছে, আয়ও বেড়েছে। তবে আয়ের চেয়ে ব্যয় বেশি বলে প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষকদের পর্যন্ত রাস্তায় নামতে হয়। দরিদ্র এই জনগোষ্ঠীর দেশে করমুক্ত ন্যূনতম আয়ের সীমা এক লাখ আশি হাজার টাকা থেকে দুই লাখ বা আড়াই লাখ করা হয় না। কিন্তু ন্যূনতম করের পরিমাণ আড়াই হাজার থেকে তিন হাজারে লাফ দিচ্ছে, এটাই প্রস্তাব। মনে হচ্ছে, অর্থমন্ত্রীর ধারণা নিম্ন আয়ের মানুষের কর দেয়ার সক্ষমতা বেড়েছে। অর্থমন্ত্রী ঘাটতি বাজেট উপস্থাপন করেছেন। ফলে অনেকেরই সন্দেহ, ব্যাংক থেকে সরকারের ঋণ নেয়ার পরিমাণ বৃদ্ধি পাবে, অথবা উন্নয়ন প্রকল্পে ব্যয় হ্রাস পাবে। কিন্তু মন্ত্রী ভাবতে পারলেন কীভাবে—স্বল্প আয়ের মানুষ, যাদের নিত্যদিন একান্ত প্রয়োজনীয় ব্যয় কাটছাঁট করে জীবন অতিবাহিত করতে হয়, তারা তাদের দৈনন্দিন খরচ থেকে কীভাবে বর্ধিত কর প্রদান করবে? এদের কথা কে ভাববে? গ্রামে গ্রামে গড়ে উঠতে পারত কুটির শিল্প। কিন্তু অবকাঠামো এবং বিদ্যুতের অভাবে তা হচ্ছে না। বিকল্প বিদ্যুতের উত্পাদনের তেমন কোনো দিকনির্দেশনা বাজেটে নেই। বাজেটে উইন্ড মিল, সোলার, কয়লাভিত্তিক বিদ্যুেকন্দ্র নির্মাণের কথা নেই।
উন্নতমানের কয়লা দিয়ে আধুনিক পদ্ধতিতে বিদ্যুত্ উত্পাদন করলে কার্বন নিঃসরণ খুবই কম হয়, বিষয়টি নিয়ে কথা নেই। অন্যদিকে পৃথিবীজুড়ে দক্ষ শ্রমিকের অভাব। সে অভাব পূরণে দেশের বিশাল বেকার জনগোষ্ঠী গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখতে পারে, কিন্তু তাদের দক্ষ জনশক্তিতে রূপান্তরের কোনো আলোর দিশা বাজেটে নেই। অথচ এসব প্রবাসীদের আয়ে গ্রামবাংলার উন্নয়ন নিশ্চিত হতে পারত। গ্রামেগঞ্জে তথ্যপ্রযুক্তি পৌঁছে দেয়ার গালভরা কথা শোনা যায়, বলা হয় ডিজিটাল দেশ গড়া হবে, কিন্তু গ্রামেগঞ্জে বিদ্যুত্ না থাকলে ডিজিটাল বাংলাদেশ হবে কীভাবে? গ্রামের কৃষক হাঁস-মুরগির খামারি মোবাইলে কথা বলে তথ্য আদান-প্রদান করে লাভবান হতে চেষ্টা করে। সেই কথা বলার ওপরও করারোপ করা হলো। তাই গ্রামের মানুষ বোঝে না, বাজেট কী, বাজেট কার জন্য?
লেখক : অধ্যাপক সাউথইস্ট ইউনিভার্সিটি এবং ডিন (ভারপ্রাপ্ত), স্কুল অব সায়েন্স অ্যান্ড ইঞ্জিনিয়ারিং
trust_murad@yahoo.co.uk
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন