মুহাম্মদ জাহাঙ্গীর
কয়েকটি সংবাদপত্রে একজন বক্তার বিকৃত বা ভুল উদ্ধৃতি কী তুলকালাম কাণ্ড ঘটাতে পারে, সম্প্রতি অধ্যাপক আবদুল্লাহ আবু সায়ীদকে নিয়ে ঘটনাটি তার সর্বশেষ নজির। ঢাকা থেকে প্রকাশিত কয়েকটি দৈনিক পত্রিকায় অধ্যাপক আবদুল্লাহ আবু সায়ীদের বক্তৃতার একটি ভুল বা বিকৃত উদ্ধৃতি প্রকাশ করায় জাতীয় সংসদের অধিবেশনে কয়েকজন সাংসদ অধ্যাপক সায়ীদের কঠোর সমালোচনা করেছেন। শুধু সাংসদেরাই নন, ওই দিনের অধিবেশনে যিনি স্পিকারের দায়িত্ব পালন করছিলেন, তিনিও এই সমালোচনায় অংশ নেন। সংবাদপত্রগুলোতে লেখা হয়েছিল: অধ্যাপক সায়ীদ টিআইবি আয়োজিত এক সেমিনারে বলেছেন, ‘মন্ত্রী-এমপিদের কোনো নীতি নেই, তাঁরা চোর-ডাকাতের মতো আচরণ করেন।’ এই বক্তব্যের সমালোচনা করে কয়েকজন সাংসদ বলেছেন, ‘এই বক্তব্য সংসদ অবমাননা ও সংসদ সদস্যদের বিশেষ অধিকার ক্ষুণ্নে০র শামিল।’ (সূত্র: ইত্তেফাক, ৪ জুন, ২০১২)
কয়েকজন সাংসদ আরও বলেছেন, ‘এই অভিযোগে তাঁকে (অধ্যাপক সায়ীদ) সংসদে তলব করে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দেওয়া উচিত। সংসদে এসে দেশের ১৬ কোটি মানুষের কাছে তাঁর শর্তহীন ক্ষমা চাওয়া উচিত বলেও অধিবেশনের সভাপতি মন্তব্য করেন। (সূত্র: ওই)
কয়েকজন সাংসদ এই আলোচনার সূত্র ধরে অধ্যাপক সায়ীদ, সিভিল সোসাইটি, শিক্ষকদের বিলাসী জীবন, টিআইবির কাজের অধিকার, এনজিওদের অর্থের উৎস ইত্যাদি বিষয়ে তীব্র ভাষায় সমালোচনা করেছেন। পাঠক বিভিন্ন সংবাদপত্রে এই বিবরণ পড়েছেন বলে এখানে তা আর উদ্ধৃত করা হলো না। এই কলামের বিষয়বস্তুও তা নয়। তবে অন্যত্র সাংসদদের এসব মন্তব্য সম্পর্কে পৃথক আলোচনা করার ইচ্ছা রয়েছে।
আমরা এই সংবাদপত্রে বহুবার বলেছি, সাংবাদিকতা একটি খুব স্পর্শকাতর পেশা। খুব দায়িত্বশীল একটি পেশা। আজকাল অনেকে সাংবাদিকতা পেশাকে খুব হালকাভাবে নিয়েছেন। সংবাদপত্র ও টিভি চ্যানেলের সংখ্যার তুলনায় ঢাকায় দক্ষ সাংবাদিকের সংখ্যা কম বলে সামান্য পেশাগত জ্ঞান ও স্বল্প অভিজ্ঞতার ভিত্তিতে অনেকে বড় অঙ্কের বেতনে গণমাধ্যমে চাকরি করার সুযোগ পেয়েছেন। এতে অনেকের মধ্যে এমন ধারণার জন্ম হয়েছে যে, তাঁরা খুব বড় মাপের সাংবাদিক। কিন্তু সংবাদপত্র পড়ে বা টিভির খবর দেখে তাঁদের দক্ষতার বা অভিজ্ঞতার তেমন পরিচয় পাওয়া যায় না। তবে বিভিন্ন গণমাধ্যমে অনেকে দক্ষতার স্বাক্ষরও রেখেছেন, এ কথা স্বীকার করতেই হবে।
নানা রাজনৈতিক স্বার্থে ও আত্মীয়তার জোরেও অনেক অদক্ষ ব্যক্তি গণমাধ্যমে কাজ করার সুযোগ পেয়েছেন। তাঁদের হাতেও প্রতিদিন সাংবাদিকতা পেশার ক্ষতি হচ্ছে। গণমাধ্যমে রাজনৈতিক বা দলীয় স্বার্থ এত প্রকট হয়ে উঠেছে যে কোনটা কর্তৃপক্ষের ইচ্ছায় ঘটেছে, আর কোনটা সাংবাদিকের অদক্ষতায় ঘটেছে, তা চিহ্নিত করা মুশকিল। অধ্যাপক আবদুল্লাহ আবু সায়ীদের বক্তৃতার বিকৃত প্রতিবেদন নিয়েও এই বিভ্রান্তি রয়েছে।
টিআইবি আয়োজিত একটি সেমিনারে কয়েকজন বক্তার একজন ছিলেন অধ্যাপক আবু সায়ীদ। তাঁর বক্তব্যের বিকৃত উদ্ধৃতি নিয়ে কয়েকটি পত্রিকা সংবাদ প্রকাশ করেছে। আর তা নিয়ে জাতীয় সংসদে ঘটেছে তুলকালাম কাণ্ড। যেসব সাংবাদিক এই প্রতিবেদন লিখেছেন, তাঁদের দক্ষতা সম্পর্কে সন্দেহ জাগা স্বাভাবিক। তাঁরা এই সামান্য সেমিনার (বাংলা ভাষায় পরিচালিত) কভার করার যোগ্যতা রাখেন না। তাঁরা কত বড় দায়িত্বহীন সাংবাদিক, তা একটি প্রতিবেদন দিয়েই প্রমাণিত হয়েছে। জাতীয় সংসদের ঘটনার পরদিন অধ্যাপক সায়ীদ কয়েকটি সংবাদপত্রে সাক্ষাৎকার দিয়ে বলেছেন, ‘তিনি সাংসদদের সম্পর্কে কোনো কথাই বলেননি। পত্রিকায় প্রকাশিত উদ্ধৃতি তাঁর নয়। তাঁর কাছে বক্তৃতার অডিও রেকর্ড আছে, তা তিনি আবার শুনে নিশ্চিত হয়েছেন কয়েকটি পত্রিকায় প্রকাশিত উদ্ধৃতিটি তাঁর নয়। তিনি সেমিনারে সে রকম কোনো কথাই বলেননি।’
অধ্যাপক সায়ীদ সেমিনারে এ কথা না বললেও সাংসদেরা তাঁকে জাতীয় সংসদের অধিবেশনে তাঁর অনুপস্থিতিতে তুলাধোনা করে ছেড়েছেন। তা সংসদের কার্যবিবরণীতেও স্থান পেয়েছে, যা অন্তত কয়েক শ বছর ধরে থাকবে। স্পিকার দুঃখ প্রকাশ করলেও তাঁর সম্পর্কে উক্ত সব বক্তব্য কার্যবিবরণী থেকে বাতিল করেননি।
অধ্যাপক সায়ীদ প্রেস কাউন্সিলে ওই সব পত্রিকার বিরুদ্ধে মামলা করতে পারেন। যদিও মামলায় পত্রিকা ও প্রতিবেদক দোষী সাব্যস্ত হলেও তেমন কোনো শাস্তি হবে না। কারণ, প্রেস কাউন্সিলের শাস্তি দেওয়ার ক্ষমতাই নেই। তারা শুধু ‘ভর্ৎসনা’ করতে পারে ও ক্ষমা চাইতে বলতে পারে।
একসঙ্গে একাধিক সংবাদপত্রে একই রকম ভুল উদ্ধৃতি কীভাবে প্রকাশিত হয়েছে, তা এক বিরাট রহস্য। অধ্যাপক সায়ীদ এক সংবাদ সম্মেলনে (৫ জুন) বলেছেন, ‘রিপোর্টগুলো পড়ে তাঁর মনে হয়েছে, এসব রিপোর্ট একজনেরই লেখা।’ এ রকম মনে হওয়াই স্বাভাবিক। নইলে একই ভুল বা বিকৃত উদ্ধৃতি আট-নয়টি সংবাদপত্রে ছাপা হয় কীভাবে? প্রেস ইনস্টিটিউট এটা নিয়ে অনুসন্ধান চালাতে পারে। এ রকম ‘অপসাংবাদিকতা’ সচরাচর দেখা যায় না।
আমরা বহুবার এই পত্রিকার মাধ্যমে তথ্যমন্ত্রীর কাছে আবেদন করেছি, প্রেস কাউন্সিলকে শক্তিশালী করে দোষী (প্রমাণিত) সম্পাদক, প্রকাশক ও সাংবাদিককে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তিদানের ব্যবস্থা নেওয়া হোক। না হলে হলুদ সাংবাদিকতা ও দায়িত্বহীন সাংবাদিকতা বন্ধ করা সম্ভব হবে না। তথ্যমন্ত্রী এখনো প্রেস কাউন্সিলকে শক্তিশালী করার ব্যাপারে কোনো পদক্ষেপ নেননি।
কয়েকজন দায়িত্বহীন প্রতিবেদকের জন্য অধ্যাপক আবদুল্লাহ আবু সায়ীদের মতো শ্রদ্ধেয় ও সম্মানিত ব্যক্তিকে জাতীয় সংসদের অধিবেশনে নাজেহাল হতে হয়েছে। এ জন্য পত্রিকাগুলো ও প্রতিবেদকেরা কোনো শাস্তি না পেলে অধ্যাপক সায়ীদের প্রতি সুবিচার হবে না। এখানে শাস্তি বলতে আমরা কারাদণ্ড বোঝাচ্ছি না। তবে অর্থদণ্ড, অ্যাক্রিডিটেশন কার্ড বাতিল বা স্থগিত ধরনের শাস্তিও হতে পারে।
সংবাদপত্রে এ রকম দায়িত্বহীনতা শুধু এবারই নয়। মাঝেমধ্যেই আমরা বিভিন্ন সংবাদপত্রে এ রকম দেখেছি। প্রতিবেদকের অদক্ষতায় বা কোনো রাজনৈতিক এজেন্ডা বাস্তবায়নের জন্য অনেক সময় বক্তার বক্তব্য বিকৃতভাবে পত্রিকায় ছাপা হয়। বক্তা যা বলেননি তা-ও বক্তার মুখে বসিয়ে দেওয়া হয়। এসব তথ্য বা বক্তব্য বিকৃতি মন্ত্রী বা সাংসদদের নিয়ে সব সময় হয় না বলে তা নিয়ে তুলকালাম কাণ্ডও হয় না। বিষয়টা অনেকের দৃষ্টি আকর্ষণ করে না। অনেক বক্তা তা নীরবে হজম করেন। সংবাদপত্রের সঙ্গে বাদ-প্রতিবাদে লিপ্ত হতে চান না। কিন্তু এ ধরনের ঘটনা অতীতে অনেক ঘটেছে।
কোনো সেমিনার বা জনসভা কভার করার সময় প্রতিবেদককে অতিরিক্ত সচেতন থাকতে হয়, বিশেষ করে খ্যাতনামা ও গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিদের বক্তব্য শোনার সময়। আজকাল ছোট রেকর্ডার পাওয়া যায়। প্রত্যেক প্রতিবেদকের তা ব্যবহার করা উচিত। স্মৃতিশক্তি বা নিজের নোটের ওপর সব সময় আস্থা রাখা যায় না। তবে কোনো প্রতিবেদক উদ্দেশ্যমূলকভাবে বক্তার উদ্ধৃতি বিকৃত করে সংবাদে প্রকাশে ব্যবহার করতে চাইলে সেটা ভিন্ন কথা।
আমার একটা ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা পাঠক ও প্রতিবেদকদের সঙ্গে এই সুযোগে শেয়ার করতে চাই। ১৯৭৩ কি ৭৪ সালের কথা। আমি তখন দৈনিক বাংলার (অধুনালুপ্ত) জুনিয়র প্রতিবেদক। ঘটনাচক্রে আমাকে পাঠানো হয়েছে (পাঠানোর কথা নয়) অর্থমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদের একটি সভা (সেমিনার) কভার করার জন্য। সন্ধ্যায় ফিরে এসে আমি যথারীতি প্রতিবেদন লিখে জমা দিই। প্রতিবেদনের সূচনায় লিখেছিলাম, ‘অর্থমন্ত্রী জনাব তাজউদ্দীন আহমদ বলেছেন, প্রয়োজন হলে আমরা সাম্রাজ্যবাদী দেশের অর্থসহায়তাও নেব না।’ (যুদ্ধবিধ্বস্ত বাংলাদেশে তখন অর্থসহায়তা খুব প্রয়োজন ছিল।) আমাদের চিফ রিপোর্টার ও বার্তা সম্পাদক দুজনই আমাকে অর্থমন্ত্রীর এই বক্তব্যের ব্যাপারে নানা জেরা করেন। আমার নোট দেখতে চান। তাঁরা দুজনই মনে করেন, তাজউদ্দীন সাহেব এমন কথা বলতে পারেন না। এটা আত্মঘাতী। তাঁরা অন্য কয়েকটি কাগজে ফোন করে বিষয়টি জানতে চান। বিএসএসের কপির সঙ্গে আমার কপি মিলিয়ে দেখেন। প্রায় দুই ঘণ্টা চেক, ক্রস চেক করার পর অবশেষে প্রতিবেদনটি ছাপানোর সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছিল।
এর নাম সাংবাদিকতা। এরই নাম সংবাদপত্র। খুবই স্পর্শকাতর পেশা ও প্রতিষ্ঠান। প্রতিবেদক লিখে দিলেন আর সম্পাদক ছাপিয়ে দিলেন, তা হয় না। প্রতিটি খবর মনোযোগ দিয়ে পড়ে, সম্পাদনা করে তারপর ছাপাতে হয়। সংবাদপত্রে প্রতিটি শব্দের অনেক ওজন। সংবাদপত্রের একটি অসাবধান বাক্যের জন্য দেশে দাঙ্গা লেগে যেতে পারে। কবি দাউদ হায়দারের সেই ‘কবিতাটি’ যদি সংবাদপত্রে ছাপা না হয়ে শুধু তাঁর বইতে ছাপা হতো, হয়তো তাঁকে জেলে ও নির্বাসনে হতো না। অনেকে কবিতাটি খেয়ালই করত না।
আজকাল হলুদ ও অপসাংবাদিকতার প্রবণতা বাড়ছে। ঢাকায় দু-একটি পত্রিকা হলুদ সাংবাদিকতা করার ব্রত নিয়ে আত্মপ্রকাশ করেছে। এ রকম অবস্থায় প্রেস কাউন্সিলকে শক্তিশালী করা ও দোষী সাংবাদিককে শাস্তি দেওয়ার ক্ষমতা দেওয়া ছাড়া উপায় নেই।
অধ্যাপক আবদুল্লাহ আবু সায়ীদের বক্তৃতার বিকৃত উদ্ধৃতি ব্যবহার করার এই দুঃখজনক ঘটনা আমাদের প্রতিবেদকদের দায়িত্বশীল সাংবাদিকতার দিকে আরও সতর্ক ও সচেতন করবে, এটাই আশা করি। সংবাদপত্রে বক্তার একটি বিকৃত বা ভুল উদ্ধৃতি কী অনভিপ্রেত ঘটনার জন্ম দিতে পারে, তা আমরা সবাই দেখেছি। এ রকম ঘটনা যেন আর কখনো না ঘটে, সেটাই সবার প্রত্যাশা।
মুহাম্মদ জাহাঙ্গীর: মিডিয়া ও উন্নয়নকর্মী।
কয়েকটি সংবাদপত্রে একজন বক্তার বিকৃত বা ভুল উদ্ধৃতি কী তুলকালাম কাণ্ড ঘটাতে পারে, সম্প্রতি অধ্যাপক আবদুল্লাহ আবু সায়ীদকে নিয়ে ঘটনাটি তার সর্বশেষ নজির। ঢাকা থেকে প্রকাশিত কয়েকটি দৈনিক পত্রিকায় অধ্যাপক আবদুল্লাহ আবু সায়ীদের বক্তৃতার একটি ভুল বা বিকৃত উদ্ধৃতি প্রকাশ করায় জাতীয় সংসদের অধিবেশনে কয়েকজন সাংসদ অধ্যাপক সায়ীদের কঠোর সমালোচনা করেছেন। শুধু সাংসদেরাই নন, ওই দিনের অধিবেশনে যিনি স্পিকারের দায়িত্ব পালন করছিলেন, তিনিও এই সমালোচনায় অংশ নেন। সংবাদপত্রগুলোতে লেখা হয়েছিল: অধ্যাপক সায়ীদ টিআইবি আয়োজিত এক সেমিনারে বলেছেন, ‘মন্ত্রী-এমপিদের কোনো নীতি নেই, তাঁরা চোর-ডাকাতের মতো আচরণ করেন।’ এই বক্তব্যের সমালোচনা করে কয়েকজন সাংসদ বলেছেন, ‘এই বক্তব্য সংসদ অবমাননা ও সংসদ সদস্যদের বিশেষ অধিকার ক্ষুণ্নে০র শামিল।’ (সূত্র: ইত্তেফাক, ৪ জুন, ২০১২)
কয়েকজন সাংসদ আরও বলেছেন, ‘এই অভিযোগে তাঁকে (অধ্যাপক সায়ীদ) সংসদে তলব করে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দেওয়া উচিত। সংসদে এসে দেশের ১৬ কোটি মানুষের কাছে তাঁর শর্তহীন ক্ষমা চাওয়া উচিত বলেও অধিবেশনের সভাপতি মন্তব্য করেন। (সূত্র: ওই)
কয়েকজন সাংসদ এই আলোচনার সূত্র ধরে অধ্যাপক সায়ীদ, সিভিল সোসাইটি, শিক্ষকদের বিলাসী জীবন, টিআইবির কাজের অধিকার, এনজিওদের অর্থের উৎস ইত্যাদি বিষয়ে তীব্র ভাষায় সমালোচনা করেছেন। পাঠক বিভিন্ন সংবাদপত্রে এই বিবরণ পড়েছেন বলে এখানে তা আর উদ্ধৃত করা হলো না। এই কলামের বিষয়বস্তুও তা নয়। তবে অন্যত্র সাংসদদের এসব মন্তব্য সম্পর্কে পৃথক আলোচনা করার ইচ্ছা রয়েছে।
আমরা এই সংবাদপত্রে বহুবার বলেছি, সাংবাদিকতা একটি খুব স্পর্শকাতর পেশা। খুব দায়িত্বশীল একটি পেশা। আজকাল অনেকে সাংবাদিকতা পেশাকে খুব হালকাভাবে নিয়েছেন। সংবাদপত্র ও টিভি চ্যানেলের সংখ্যার তুলনায় ঢাকায় দক্ষ সাংবাদিকের সংখ্যা কম বলে সামান্য পেশাগত জ্ঞান ও স্বল্প অভিজ্ঞতার ভিত্তিতে অনেকে বড় অঙ্কের বেতনে গণমাধ্যমে চাকরি করার সুযোগ পেয়েছেন। এতে অনেকের মধ্যে এমন ধারণার জন্ম হয়েছে যে, তাঁরা খুব বড় মাপের সাংবাদিক। কিন্তু সংবাদপত্র পড়ে বা টিভির খবর দেখে তাঁদের দক্ষতার বা অভিজ্ঞতার তেমন পরিচয় পাওয়া যায় না। তবে বিভিন্ন গণমাধ্যমে অনেকে দক্ষতার স্বাক্ষরও রেখেছেন, এ কথা স্বীকার করতেই হবে।
নানা রাজনৈতিক স্বার্থে ও আত্মীয়তার জোরেও অনেক অদক্ষ ব্যক্তি গণমাধ্যমে কাজ করার সুযোগ পেয়েছেন। তাঁদের হাতেও প্রতিদিন সাংবাদিকতা পেশার ক্ষতি হচ্ছে। গণমাধ্যমে রাজনৈতিক বা দলীয় স্বার্থ এত প্রকট হয়ে উঠেছে যে কোনটা কর্তৃপক্ষের ইচ্ছায় ঘটেছে, আর কোনটা সাংবাদিকের অদক্ষতায় ঘটেছে, তা চিহ্নিত করা মুশকিল। অধ্যাপক আবদুল্লাহ আবু সায়ীদের বক্তৃতার বিকৃত প্রতিবেদন নিয়েও এই বিভ্রান্তি রয়েছে।
টিআইবি আয়োজিত একটি সেমিনারে কয়েকজন বক্তার একজন ছিলেন অধ্যাপক আবু সায়ীদ। তাঁর বক্তব্যের বিকৃত উদ্ধৃতি নিয়ে কয়েকটি পত্রিকা সংবাদ প্রকাশ করেছে। আর তা নিয়ে জাতীয় সংসদে ঘটেছে তুলকালাম কাণ্ড। যেসব সাংবাদিক এই প্রতিবেদন লিখেছেন, তাঁদের দক্ষতা সম্পর্কে সন্দেহ জাগা স্বাভাবিক। তাঁরা এই সামান্য সেমিনার (বাংলা ভাষায় পরিচালিত) কভার করার যোগ্যতা রাখেন না। তাঁরা কত বড় দায়িত্বহীন সাংবাদিক, তা একটি প্রতিবেদন দিয়েই প্রমাণিত হয়েছে। জাতীয় সংসদের ঘটনার পরদিন অধ্যাপক সায়ীদ কয়েকটি সংবাদপত্রে সাক্ষাৎকার দিয়ে বলেছেন, ‘তিনি সাংসদদের সম্পর্কে কোনো কথাই বলেননি। পত্রিকায় প্রকাশিত উদ্ধৃতি তাঁর নয়। তাঁর কাছে বক্তৃতার অডিও রেকর্ড আছে, তা তিনি আবার শুনে নিশ্চিত হয়েছেন কয়েকটি পত্রিকায় প্রকাশিত উদ্ধৃতিটি তাঁর নয়। তিনি সেমিনারে সে রকম কোনো কথাই বলেননি।’
অধ্যাপক সায়ীদ সেমিনারে এ কথা না বললেও সাংসদেরা তাঁকে জাতীয় সংসদের অধিবেশনে তাঁর অনুপস্থিতিতে তুলাধোনা করে ছেড়েছেন। তা সংসদের কার্যবিবরণীতেও স্থান পেয়েছে, যা অন্তত কয়েক শ বছর ধরে থাকবে। স্পিকার দুঃখ প্রকাশ করলেও তাঁর সম্পর্কে উক্ত সব বক্তব্য কার্যবিবরণী থেকে বাতিল করেননি।
অধ্যাপক সায়ীদ প্রেস কাউন্সিলে ওই সব পত্রিকার বিরুদ্ধে মামলা করতে পারেন। যদিও মামলায় পত্রিকা ও প্রতিবেদক দোষী সাব্যস্ত হলেও তেমন কোনো শাস্তি হবে না। কারণ, প্রেস কাউন্সিলের শাস্তি দেওয়ার ক্ষমতাই নেই। তারা শুধু ‘ভর্ৎসনা’ করতে পারে ও ক্ষমা চাইতে বলতে পারে।
একসঙ্গে একাধিক সংবাদপত্রে একই রকম ভুল উদ্ধৃতি কীভাবে প্রকাশিত হয়েছে, তা এক বিরাট রহস্য। অধ্যাপক সায়ীদ এক সংবাদ সম্মেলনে (৫ জুন) বলেছেন, ‘রিপোর্টগুলো পড়ে তাঁর মনে হয়েছে, এসব রিপোর্ট একজনেরই লেখা।’ এ রকম মনে হওয়াই স্বাভাবিক। নইলে একই ভুল বা বিকৃত উদ্ধৃতি আট-নয়টি সংবাদপত্রে ছাপা হয় কীভাবে? প্রেস ইনস্টিটিউট এটা নিয়ে অনুসন্ধান চালাতে পারে। এ রকম ‘অপসাংবাদিকতা’ সচরাচর দেখা যায় না।
আমরা বহুবার এই পত্রিকার মাধ্যমে তথ্যমন্ত্রীর কাছে আবেদন করেছি, প্রেস কাউন্সিলকে শক্তিশালী করে দোষী (প্রমাণিত) সম্পাদক, প্রকাশক ও সাংবাদিককে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তিদানের ব্যবস্থা নেওয়া হোক। না হলে হলুদ সাংবাদিকতা ও দায়িত্বহীন সাংবাদিকতা বন্ধ করা সম্ভব হবে না। তথ্যমন্ত্রী এখনো প্রেস কাউন্সিলকে শক্তিশালী করার ব্যাপারে কোনো পদক্ষেপ নেননি।
কয়েকজন দায়িত্বহীন প্রতিবেদকের জন্য অধ্যাপক আবদুল্লাহ আবু সায়ীদের মতো শ্রদ্ধেয় ও সম্মানিত ব্যক্তিকে জাতীয় সংসদের অধিবেশনে নাজেহাল হতে হয়েছে। এ জন্য পত্রিকাগুলো ও প্রতিবেদকেরা কোনো শাস্তি না পেলে অধ্যাপক সায়ীদের প্রতি সুবিচার হবে না। এখানে শাস্তি বলতে আমরা কারাদণ্ড বোঝাচ্ছি না। তবে অর্থদণ্ড, অ্যাক্রিডিটেশন কার্ড বাতিল বা স্থগিত ধরনের শাস্তিও হতে পারে।
সংবাদপত্রে এ রকম দায়িত্বহীনতা শুধু এবারই নয়। মাঝেমধ্যেই আমরা বিভিন্ন সংবাদপত্রে এ রকম দেখেছি। প্রতিবেদকের অদক্ষতায় বা কোনো রাজনৈতিক এজেন্ডা বাস্তবায়নের জন্য অনেক সময় বক্তার বক্তব্য বিকৃতভাবে পত্রিকায় ছাপা হয়। বক্তা যা বলেননি তা-ও বক্তার মুখে বসিয়ে দেওয়া হয়। এসব তথ্য বা বক্তব্য বিকৃতি মন্ত্রী বা সাংসদদের নিয়ে সব সময় হয় না বলে তা নিয়ে তুলকালাম কাণ্ডও হয় না। বিষয়টা অনেকের দৃষ্টি আকর্ষণ করে না। অনেক বক্তা তা নীরবে হজম করেন। সংবাদপত্রের সঙ্গে বাদ-প্রতিবাদে লিপ্ত হতে চান না। কিন্তু এ ধরনের ঘটনা অতীতে অনেক ঘটেছে।
কোনো সেমিনার বা জনসভা কভার করার সময় প্রতিবেদককে অতিরিক্ত সচেতন থাকতে হয়, বিশেষ করে খ্যাতনামা ও গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিদের বক্তব্য শোনার সময়। আজকাল ছোট রেকর্ডার পাওয়া যায়। প্রত্যেক প্রতিবেদকের তা ব্যবহার করা উচিত। স্মৃতিশক্তি বা নিজের নোটের ওপর সব সময় আস্থা রাখা যায় না। তবে কোনো প্রতিবেদক উদ্দেশ্যমূলকভাবে বক্তার উদ্ধৃতি বিকৃত করে সংবাদে প্রকাশে ব্যবহার করতে চাইলে সেটা ভিন্ন কথা।
আমার একটা ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা পাঠক ও প্রতিবেদকদের সঙ্গে এই সুযোগে শেয়ার করতে চাই। ১৯৭৩ কি ৭৪ সালের কথা। আমি তখন দৈনিক বাংলার (অধুনালুপ্ত) জুনিয়র প্রতিবেদক। ঘটনাচক্রে আমাকে পাঠানো হয়েছে (পাঠানোর কথা নয়) অর্থমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদের একটি সভা (সেমিনার) কভার করার জন্য। সন্ধ্যায় ফিরে এসে আমি যথারীতি প্রতিবেদন লিখে জমা দিই। প্রতিবেদনের সূচনায় লিখেছিলাম, ‘অর্থমন্ত্রী জনাব তাজউদ্দীন আহমদ বলেছেন, প্রয়োজন হলে আমরা সাম্রাজ্যবাদী দেশের অর্থসহায়তাও নেব না।’ (যুদ্ধবিধ্বস্ত বাংলাদেশে তখন অর্থসহায়তা খুব প্রয়োজন ছিল।) আমাদের চিফ রিপোর্টার ও বার্তা সম্পাদক দুজনই আমাকে অর্থমন্ত্রীর এই বক্তব্যের ব্যাপারে নানা জেরা করেন। আমার নোট দেখতে চান। তাঁরা দুজনই মনে করেন, তাজউদ্দীন সাহেব এমন কথা বলতে পারেন না। এটা আত্মঘাতী। তাঁরা অন্য কয়েকটি কাগজে ফোন করে বিষয়টি জানতে চান। বিএসএসের কপির সঙ্গে আমার কপি মিলিয়ে দেখেন। প্রায় দুই ঘণ্টা চেক, ক্রস চেক করার পর অবশেষে প্রতিবেদনটি ছাপানোর সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছিল।
এর নাম সাংবাদিকতা। এরই নাম সংবাদপত্র। খুবই স্পর্শকাতর পেশা ও প্রতিষ্ঠান। প্রতিবেদক লিখে দিলেন আর সম্পাদক ছাপিয়ে দিলেন, তা হয় না। প্রতিটি খবর মনোযোগ দিয়ে পড়ে, সম্পাদনা করে তারপর ছাপাতে হয়। সংবাদপত্রে প্রতিটি শব্দের অনেক ওজন। সংবাদপত্রের একটি অসাবধান বাক্যের জন্য দেশে দাঙ্গা লেগে যেতে পারে। কবি দাউদ হায়দারের সেই ‘কবিতাটি’ যদি সংবাদপত্রে ছাপা না হয়ে শুধু তাঁর বইতে ছাপা হতো, হয়তো তাঁকে জেলে ও নির্বাসনে হতো না। অনেকে কবিতাটি খেয়ালই করত না।
আজকাল হলুদ ও অপসাংবাদিকতার প্রবণতা বাড়ছে। ঢাকায় দু-একটি পত্রিকা হলুদ সাংবাদিকতা করার ব্রত নিয়ে আত্মপ্রকাশ করেছে। এ রকম অবস্থায় প্রেস কাউন্সিলকে শক্তিশালী করা ও দোষী সাংবাদিককে শাস্তি দেওয়ার ক্ষমতা দেওয়া ছাড়া উপায় নেই।
অধ্যাপক আবদুল্লাহ আবু সায়ীদের বক্তৃতার বিকৃত উদ্ধৃতি ব্যবহার করার এই দুঃখজনক ঘটনা আমাদের প্রতিবেদকদের দায়িত্বশীল সাংবাদিকতার দিকে আরও সতর্ক ও সচেতন করবে, এটাই আশা করি। সংবাদপত্রে বক্তার একটি বিকৃত বা ভুল উদ্ধৃতি কী অনভিপ্রেত ঘটনার জন্ম দিতে পারে, তা আমরা সবাই দেখেছি। এ রকম ঘটনা যেন আর কখনো না ঘটে, সেটাই সবার প্রত্যাশা।
মুহাম্মদ জাহাঙ্গীর: মিডিয়া ও উন্নয়নকর্মী।
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন