মুহাম্মদ ইসমাইল হোসেন
৭ জুনের দৈনিক ইত্তেফাকে যুগপৎ তিনটি রিপোর্টে দেখা গেলÑ টঙ্গীতে পুলিশের চাঁদাবাজিতে যানজট, আশুলিয়ায় ঘুষের টাকা ভাগাভাগির সংঘর্ষে এএসআই কর্তৃক কনস্টেবলের মাথা ফাটানো, থানায় মামলা-জিডির ক্ষেত্রে বাদী-বিবাদী উভয়ের কাছ থেকেই ঘুষ আদায় ইত্যাদির তথ্য। একই দিনের একটি জাতীয় পত্রিকায় পুলিশের দুর্নীতি সংক্রান্ত তিনটি রিপোর্ট পড়ে বোঝা গেল, প্রায় সর্বস্তরেই পুলিশ বেপরোয়া হয়ে উঠেছে। আদালত প্রাঙ্গণে একজন মহিলার সঙ্গে তাদের কেমন আচরণ হওয়া উচিত, থানায় একজন নাগরিক জিডি বা মামলা করতে গেলে তাদের সঙ্গে আচার-আচরণ কেমন হওয়া উচিত, রাস্তাঘাটে গাড়ি থামিয়ে চাঁদাবাজি করতে গিয়ে যানজট সৃষ্টি করে জনজীবন অতিষ্ঠ করা উচিত কিনা, ঘুষের টাকা ভাগাভাগি করতে গিয়ে নিজেদের মধ্যে মাথা ফাটাফাটি করা উচিত কিনা, সাংবাদিকদের গড়া-পেটা করা উচিত কিনা ইত্যাদি কোন কিছুই তারা ভেবে দেখার প্রয়োজনীয়তা অনুভব করছেন না! এয়ারপোর্টের মতো গুর“ত্বপূর্ণ ¯’ানেও তারা যাত্রীদের সঙ্গে যেনতেন আচরণ করছেন। তদবির বাণিজ্যের মাধ্যমে থানাসহ বিভিন্ন গুর“ত্বপূর্ণ ¯’ানে পদায়ন লাভ করে দিনরাত তারা নিজেদের ভাগ্য গড়ার কাজে নিয়োজিত থাকায় তাদের প্রতি দেশের মানুষের আ¯’া এখন প্রায় শূন্যের কোঠায়। কোথাও কোন দুই-চারজন ভালো লোক থাকলেও জনস্বার্থে তাদের কর্মকাণ্ড প্রতিফলিত হ”েছ না। কারণ তারা কোণঠাসা অব¯’ায় আছেন। অথচ দুর্নামের অংশীদার তাদেরও হতে হ”েছ। বরং পুলিশের যেসব সদস্য অপকর্মে জড়িত, উপরের কর্তাব্যক্তিরা যেন তাদের ওপরই সš‘ষ্ট! কারণ এই শ্রেণীর দুর্নীতিগ্রস্ত অফিসাররা সদাসর্বদা উপর¯’দের তোয়াজ করাসহ যে দেবতা যে ফুলে তুষ্ট সেই ফুলেই অর্ঘ্য দান করেন। এক্ষেত্রে একদম ওপরে বসে যারা সার্বিকভাবে এ বাহিনীকে পরিচালনা করছেন, হয় তারা সব দেখেশুনে চুপচাপ বসে আছেন, অন্যথায় নিজেরা ক্লান্ত-শ্রান্ত-অবসন্ন হয়ে পড়েছেন। এসব দেখাশোনার সার্বিক ভার তথা দায়-দায়িত্ব নিয়ে এসব আমলা, মায় পুলিশের মন্ত্রী সাহেবরা যথাযথভাবে তাদের পরিচালনা করছেন, একথা বোধহয় এখন আর জোর দিয়ে বলা যায় না। মাঠে-ময়দানে প্রায় সর্বক্ষেত্রে তাই পুলিশ বাহিনীর ওপর তাদের নিয়ন্ত্রণ শিথিল হয়ে পড়েছে। তারা এখন নিজেদের মেজাজ-মর্জি মাফিক কাজ করে চলেছেন এবং এসব করার ক্ষেত্রে তারা নিজেদের স্বার্থকেই প্রাধান্য দি”েছন। উল্লেখ করা প্রয়োজন যে, স্বাধীনতার পর প্রায় সব গণতান্ত্রিক সরকারকেই পুলিশের ওপর নির্ভরশীল হয়ে পড়ার মাশুল গুনতে হয়েছে। বিশেষ করে ওইসব সরকারের শেষদিকে তারা সম্পূর্ণভাবে পুলিশনির্ভর হয়ে পড়ায় পুলিশও সেসব সুযোগের সদ্ব্যবহার করেছে। সরকারের নিজেদের অভ্যন্তরীণ দুর্নীতি এবং ক্ষেত্রবিশেষে সরকার পরিচালনায় অযোগ্যতার কারণে শেষ সময়ে এসে প্রায় প্রতিটি সরকারই নীতি-নৈতিকতায় দুর্বল হয়ে পড়ে এবং তখন তাদের একমাত্র অবলম্বন ও হাতিয়ার হয়ে দাঁড়ায় পুলিশ বাহিনী। অর্থাৎ পুলিশের ওপর সবকিছু ছেড়ে দিয়েই ওইসব সরকার শেষ দিকের সময়টা পার করে দিতে চান। এভাবে পুলিশকে ঢালাও লাইসেন্স দিয়ে সবকিছু নিয়ন্ত্রণের দায়িত্ব দেয়ার ফলে পুলিশও বেপরোয়া হয়ে ওঠে। পুলিশের অপকর্ম সংক্রান্ত উপরোক্ত তিন তিনটি রিপোর্ট আমাদের সেই ঘটনাই চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দি”েছ। বর্তমান সরকারও দিন দিন পুলিশের ওপর অতি নির্ভরশীল হয়ে পড়ায় পুলিশও এখন স্বমহিমায় আবির্ভূত হয়েছে। আর সব সরকারের আমলেই পুলিশের নিয়োগ, পদোন্নতি, পদায়ন ইত্যাদিতে দলীয়করণ হওয়ায় পুলিশও অনেকটা এখন একটি দলীয় বাহিনীতে পরিণত হয়েছে। তাদের মধ্যে এখন সব সময়ই একটি সরকারবিরোধী গ্র“প থেকেই যায়।
বিরোধী দলকে মোকাবেলা, দেশের আইন-শৃংখলা রক্ষাসহ অনেক ক্ষেত্রেই ওইসব বিরোধীদলীয় শক্তি স্যাবোটাজ করে সরকারকে বেকায়দায় ফেলে। আর সেসব কারণেও অনেক অঘটন ঘটে। এ অব¯’ায় সরকারের ভেতরে যদি যোগ্যতার ঘাটতি না থাকত, যদি মন্ত্রণালয়ের মন্ত্রী থেকে শুর“ করে সচিব ইত্যাদিসহ বড় বড় তক্মাওয়ালা পুলিশ কর্তারা যথাযথ যোগ্যতার পরিচয় দিয়ে মাঠ পর্যায়ের পুলিশ পরিচালনা করতেন, তাহলে বোধহয় এত বেশি অঘটনের ঘটনা ঘটত না। কিš‘ তা না হয়ে প্রায় প্রতিটি সরকারের শেষ দিকেই পুলিশের ওপর অতি নির্ভরতার ফল, যা হওয়ার তাই হ”েছ। আমরা জানি না কবে এসবের অবসান হবে? কবে কোন সরকার এবং তার উ”চতর আমলা বাহিনী যোগ্যতার পরিচয় দেবে আর দেশ ও জাতি পুলিশি রাষ্ট্রের কুফলমুক্ত হবে আমরা তাও জানি না!
মুহাম্মদ ইসমাইল হোসেন : কলামিস্ট, মুক্তিযোদ্ধা
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন