বৃহস্পতিবার, ১৪ জুন, ২০১২

বিপর্যস্ত অর্থনীতিতে সৌদি প্রিন্সের জ্বালানি, বিদ্যুৎ এবং পর্যটন খাতে বিনিয়োগ



মো. সেলিম আহমেদ ডালিম :
 দেশের বিনিয়োগ কমে গেছে আশঙ্কাজনক হারে। বৈশ্বিক পরিস্থিতির অবনতি, রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতা, বিনিয়োগ বান্ধব পরিবেশের অভাব, গ্যাস-বিদ্যুৎ সংকট দেখা দেয়ার কারণে মূলত দেশের বিনিয়োগে স্থবিরতা নেমে এসেছে। দেশে যখন বিনিয়োগে কর্মপরিধিতে স্থবিরতা দেখা দিয়েছে ঠিক সে সময় বিনিয়োগের জন্য আশির্বাদ হয়ে এসেছেন সৌদি প্রিন্স। জ্বালানি, বিদ্যুৎ ও পর্যটন খাতে ব্যাপক বিনিয়োগের চিন্তা করেই বাংলাদেশ সফর করে গেলেন এ সৌদি ধনকুবের। দেশের বেসরকারি খাত ভালো নেই। ব্যাংক ঋণ না পাওয়া, সুদের হার বেড়ে যাওয়া, বিদ্যুৎ ও গ্যাসের সংকটসহ নতুন নতুন সমস্যার কারণে কমে যাচ্ছে এ খাতে বিনিয়োগ। এছাড়া আইনশৃক্মখলা পরিস্থিতির অবনতি এবং রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতার কারণে দেশে বিনিয়োগ পরিস্থিতি নেতিবাচক ধারায় প্রবাহিত হচ্ছে। শিল্পপ্রতিষ্ঠানগুলোতে দেশী বিনিয়োগের মতই বিদেশী বিনিয়োগও কমে যাচ্ছে। গত অর্থবছরের চেয়ে চলতি অর্থবছরে স্থানীয় বিনিয়োগ কমেছে ১৬ হাজার ২০৩ কোটি টাকা। একইভাবে বিদেশী বিনিয়োগ কমেছে ৪৭৬ মিলিয়ন ডলার। বাংলাদেশের জাতীয় অর্থনৈতিক উন্নয়নে বেসরকারি খাত অত্যন্ত ইতিবাচক ও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করলেও বর্তমানে এ খাতকে অবহেলা করা হচ্ছে নানাভাবে। দু'টি কারণে দেশে বিনিয়োগ কমে যাচ্ছে। প্রথমত, বিদ্যুৎ-গ্যাস ও অবকাঠামো সমস্যা। দ্বিতীয়ত, দেশে রাজনৈতিক অনিশ্চয়তা বা অস্থিতিশীলতা বিরাজ করছে। এছাড়া সময়মতো ব্যাংক ঋণ না পাওয়া, সুদের হার বেড়ে যাওয়ায় বেসরকারি খাতে বিনিয়োগ কমে যাচ্ছে। এর ফলে দেশের অর্থনীতিতে বিরূপ প্রভাব পড়ছে। এর প্রভাবে প্রবৃদ্ধি কমে যাচ্ছে। প্রবৃদ্ধি কমার ফলে কর্মসংস্থানও কমে যাচ্ছে। ফলে সরকারের দারিদ্র্য বিমোচন কর্মসূচিতে নেতিবাচক প্রভাব পড়ছে। বাংলাদেশের মোট বিনিয়োগের প্রায় ৭৯ শতাংশই হচ্ছে বেসরকারি খাতে। ২০১০-১১ অর্থবছরে বেসরকারি খাতে মোট বিনিয়োগ ছিল ১ লাখ ৫৫ হাজার ৪৪৪ কোটি টাকা। ২০১১-১২ অর্থবছরে বেসরকারি খাতে সাময়িক হিসেবে বিনিয়োগের পরিমাণ ১ লাখ ৭৫ হাজার ১০৪ কোটি টাকা। ২০১১-১২ অর্থবছরে বেসরকারি খাতে ১ হাজার ৪৪৮টি প্রকল্পে ৭২ হাজার ৫৪০ কোটি টাকার কাজ চলছে। বেসরকারি খাতের মধ্যে অন্যতম তৈরি পোশাক, নিটওয়্যার ছাড়াও ভৌত অবকাঠামো খাতে বিশেষ করে মহাসড়ক, গণপরিবহন, ফ্লাইওভার, বাস টার্মিনাল, বিমানবন্দর, এভিয়েশন, সমুদ্র বন্দর, রেলওয়ে ভৌত অবকাঠামো এবং সেবা খাতে বেসরকারি উদ্যোক্তারা বিনিয়োগ করেছেন। খাতভিত্তিক স্থানীয় শিল্পে বিনিয়োগ নেতিবাচক প্রবৃদ্ধি হয়েছে। ২০১০-১১ অর্থবছরে স্থানীয়ভাবে বিনিয়োগ হয়েছিল ৫৫ হাজার ৩৬৯ কোটি টাকা। কিন্তু চলতি অর্থবছরে বিনিয়োগ হয়েছে ৩৯ হাজার ১৬৭ কোটি টাকা। এর মধ্যে টেক্সটাইল শিল্পে ২০১০-১১ অর্থবছরে স্থানীয়ভাবে বিনিয়োগ হয়েছিল ১৫ হাজার ৪০৩ কোটি ৬৫ লাখ টাকা। কিন্তু ২০১১-১২ অর্থবছরে এ খাতে বিনিয়োগ অর্ধেক কমে গিয়ে ৭ হাজার ৬৫১ কোটি ৪ লাখ টাকায় দাঁড়িয়েছে। একইভাবে ফুড অ্যান্ড এলাইড খাতে ২০১০-১১ অর্থবছরে বিনিয়োগ ছিল ১ হাজার ৭৪৪ কোটি ৪ লাখ টাকা। অথচ ২০১১-১২ অর্থবছরের এ খাতে বিনিয়োগ হয়েছে মাত্র ৬৬৮ কোটি ৫৬ লাখ টাকা। সার্ভিস শিল্পে ২০১০-১১ অর্থবছরে বিনিয়োগ ছিল ২২ হাজার ২৩১ কোটি ৭০ লাখ টাকা। অথচ ২০১১-১২ অর্থবছরে এ খাতে স্থানীয়ভাবে বিনিয়োগ হয়েছে মাত্র অর্ধেকেরও কম। অর্থাৎ ১০ হাজার ৯৯ কোটি ৬২ লাখ টাকা। গত অর্থবছরে ট্যানারি অ্যান্ড লেদার শিল্পে বিনিয়োগ হয়েছে ২০১ কোটি ৮৩ লাখ টাকা। আর চলতি অর্থবছরে এ খাতে বিনিয়োগ হয়েছে মাত্র ৮৩ কোটি ১৮ লাখ টাকা।
 বিদ্যুৎ ও গ্যাস সংকটের কারণে বেসরকারি খাতে বিনিয়োগ কমে যাচ্ছে। অথচ বিদ্যুতের ব্যাপারে এখনও কোন নিশ্চয়তা পাওয়া যাচ্ছে না। এছাড়া ব্যাংকঋণে উচ্চ সুদের হারও এ খাতে নেতিবাচক প্রভাব ফেলছে। সব মিলিয়ে টেক্সটাইল খাত ভালো নেই। বাংলাদেশে ২০১০ সালের চেয়ে ২০১১ সালে প্রত্যক্ষ বৈদেশিক বিনিয়োগ ৪৭৬ মিলিয়ন ডলার কম হয়েছে।  ২০১০ সালে প্রত্যক্ষ বৈদেশিক বিনিয়োগ হয়েছে ৯১৩ দশমিক ৩২ মিলিয়ন মার্কিন ডলার। আর ২০১১ সালে এসেছে ৪৩৬ দশমিক ৫২ মিলিয়ন মার্কিন ডলার। ২০১০ সালের তুলনায় ২০১১ সালে সমমূলধন কমে গেছে ৩৮৮ মিলিয়ন ডলার। ২০১০ সালে বিদেশি সমমূলধন এসেছে ৫২০ মিলিয়ন ডলার। আর ২০১১ সালে এসেছে মাত্র ১৩১ মিলিয়ন ডলার। একইভাবে ২০১০ সালে পুনঃবিনিয়োগ হয়েছে ৩৬৪ মিলিয়ন ডলার। আর ২০১১ সালে পুনঃবিনিয়োগ হয়েছে ২৩৩ মিলিয়ন ডলার। ২০১১-১২ অর্থবছরে মার্চ পর্যন্ত বিদেশী ও যৌথ বিনিয়োগে মোট ১৭১টি নতুন প্রকল্প নিবন্ধিত হয়েছে। যাতে প্রস্তাবিত বিনিয়োগের পরিমাণ প্রায় ৩৩ হাজার ৩৭৩ কোটি টাকা। ২০১০-১১ অর্থবছরের চেয়ে ২০১১-১২ অর্থবছরে স্থানীয় বিনিয়োগ ও বৈদেশিক বিনিয়োগ প্রস্তাবনার সংখ্যা কমে গেছে। গত অর্থবছরের চেয়ে চলতি অর্থবছরে ১৯ হাজার ৩৫৩ কোটি টাকার ৪৬৯টি যৌথ বিনিয়োগে প্রকল্প প্রস্তাবনা কমে গেছে। ২০১০-১১ সালে ৫৫ হাজার ৩৬৯ কোটি টাকার স্থানীয়ভাবে বিনিয়োগের জন্য প্রকল্প প্রস্তাবনা ছিল ১৭৪৬টি। কিন্তু ২০১১-১২ অর্থবছরে ৩৯ হাজার ১৬৭ কোটি টাকার প্রকল্প প্রস্তাবনা হয় ১২৭৭টি। একইভাবে ২০১০-১১ অর্থবছরে ৩৬ হাজার ৫২৪ কোটি টাকার বৈদেশিক বিনিয়োগের জন্য প্রকল্প প্রস্তাবনা ছিল ১৯৬টি। অথচ ২০১১-১২ অর্থবছরে ৩৩ হাজার ৩৭৩ কোটি টাকার বৈদেশিক বিনিয়োগের জন্য প্রকল্প প্রস্তাবনা এসেছে ১৭১টি। ২০১১-১২ অর্থবছরের এপ্রিল ১২ পর্যন্ত নিবন্ধিত নতুন বিদেশী ও যৌথ বিনিয়োগ প্রকল্পগুলোর অঞ্চল হিসেবে পশ্চিম এশীয় দেশগুলো থেকে প্রাপ্ত বিনিয়োগ প্রস্তাবনার পরিমাণ সর্বাধিক। এর পরে রয়েছে দক্ষিণ, পূর্ব ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া, ইউরোপীয় ইউনিয়ন, উত্তর আমেরিকা এবং সিআইএসভুক্ত অঞ্চল। গত অর্থবছরের চেয়ে চলতি অর্থবছরে কর্মসংস্থানও কমে গেছে। ২০১০-১১ অর্থবছরে বেসরকারি খাতে শিল্পপ্রতিষ্ঠানে কর্মসংস্থান হয়েছিল ৫ লাখ ৩ হাজার ৬৬২ জনের। অথচ চলতি ২০১১-১২ অর্থবছরের বিনিয়োগ বোর্ডে নিবন্ধিত প্রকল্পগুলো (মার্চ) পর্যন্ত শিল্পায়নের মাধ্যমে কর্মসংস্থান হয়েছে ৩ লাখ ৩৯ হাজার ৪৮৪ জন লোকের।  গ্যাস ও বিদ্যুতের দুরবস্থার কারণে বিনিয়োগ কমে যাচ্ছে। নতুনভাবে বিদ্যুৎ সংযোগ দেয়া হচ্ছে না। এছাড়া ব্যাংকঋণ পাওয়া যাচ্ছে না। যা পাওয়া যায় উচ্চ সুদে। এতে এ খাতের শিল্প-প্রতিষ্ঠান ধীরে ধীরে সঙ্কুচিত হচ্ছে। ফলে কর্মসংস্থানও কমে যাচ্ছে। বিশ্বের ১৮৩টি দেশের মধ্যে বাংলাদেশ হলো ১২২তম। তবে বিনিয়োগকারীদের সুরক্ষার ক্ষেত্রে বাংলাদেশের অবস্থান ২৪তম। তাছাড়া ঋণপ্রাপ্তির ক্ষেত্রে বাংলাদেশের অবস্থান ৭৮তম। ব্যবসা শুরুর ক্ষেত্রে ৮৬তম এবং কর প্রদানের ক্ষেত্রে ১০০তম স্থানে রয়েছে বাংলাদেশ। পরিসংখ্যানের আলোকে যে চিত্র পাওয়া গেল তা অত্যন্ত হতাশাজনক। এক পর্যটন খাত দিয়েই অনেক দেশ অর্থনীতিতে ভিত গড়তে সক্ষম হয়েছে। অনেক দেশের মূল আয়ই হলো পর্যটন খাত। আমাদের রয়েছে বিশ্বখ্যাত ম্যানগ্রোভ সুন্দর বন, রয়েছে দীর্ঘ সমুদ্র সৈকত। কিন্তু রাষ্ট্র ব্যবস্থাপনার সঠিক দিকনির্দেশনার অভাবে এ খাতে আমরা পিছিয়ে রয়েছি ব্যাপকভাবে। তাছাড়া জ্বালানি এবং বিদ্যুতে আমাদের অর্থনীতি এখন নিম্নমুখী। সেখানে সৌদি প্রিন্স যে লক্ষ্যমাত্রা নিয়ে আমাদের দেশের বিনিয়োগের হাতছানি দিয়ে গেছেন তা অত্যন্ত শুভ সংবাদ। তা যেন কোন গোষ্ঠী বা দলের অরাজনৈতিক সুলভ আচরণে তিরোহিত হয়ে না পড়ে।
-লেখক : সাংবাদিক ও কলামিস্ট
mdsalimahameddalim@gmail.com

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন