এ্যাডভোকেট ফিরোজ আহমেদ :
সড়কে মৃত্যুর মিছিলে আবারো সেবক এবং ঘাতক বিষয়ক বিতর্ক টক অব দ্যা কান্ট্রিতে পরিণত হয়েছে। জাতি চলচ্চিত্র নির্মাতা তারেক মাসুদ ও সাংবাদিক মিশুক মুনিরের সড়ক দুর্ঘটনায় মর্মান্তিক মৃত্যুর বেদনা ভুলতে না ভুলতেই রাজধানীতে সড়ক দুর্ঘটনায় দুই জন সাংবাদিকের বেদনাদায়ক প্রয়াণ ঘটেছে। তারা হচ্ছেন দ্যা ইন্ডিপিন্ডেন্ট পত্রিকার সিনিয়র সাংবাদিক বিভাস চন্দ্র সাহা এবং বরিশাল থেকে প্রকাশিত দৈনিক মতবাদ পত্রিকার ফটো সাংবাদিক শহিদুজ্জামান। গত ১১ই মে পত্রিকায় প্রকাশিত সংবাদ অনুসারে একই দিনে সিলেটে আওয়ামী লীগ নেতাসহ আটজন এবং গাইবান্ধায় সড়ক দুর্ঘটনায় আরো পাঁচজন নিহত হয়েছেন। সারা দেশের পুলিশের সাধারণ ডায়েরির খাতা দেখলে দুর্ঘটনায় নিহতের সংখ্যা আরো বৃদ্ধি পাবে। রাজধানীতে এই সড়ক দুর্ঘটনায় সাংবাদিকদ্বয়ের মৃত্যুর সংবাদে প্রেসক্লাবের সামনে যথারীতি সতীর্থরা মানববন্ধন করেছেন, দেশের মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শুধু দুঃখপ্রকাশ নয় দায়ী গাড়িচালকদের গ্রেপ্তারের নির্দেশ দিয়েছেন। বেদনাদায়ক হলেও সত্য দেশের নৌপরিবহনমন্ত্রী, পরিবহন শ্রমিক নেতা শাজাহান খান নারায়ণগঞ্জে এক পরিবহন শ্রমিক সমাবেশে গাড়ি চালকদের জনগণের সেবক হিসেবে অভিহিত করেছেন। তিনি বলেছেন, মুক্তিযুদ্ধে সড়ক পরিবহন শ্রমিকদের অবদান আছে, তারা জনগণের সেবক। তাদের হেয় বা তিরষ্কার না করে জনগণের সেবক হয়ে ওঠার সুযোগ দেয়া উচিত। বেশ কিছুদিন যাবত মাননীয় মন্ত্রী মহোদয় তার বক্তব্যে গাড়ির ড্রাইভারদের পত্র-পত্রিকায় ঘাতক সম্বোধন করায় উষ্মা প্রকাশ করে চলেছেন। একজন পরিবহন শ্রমিক গ্রেফতার হলে তার মুক্তির জন্য তার সহকর্মীরা ধর্মঘট করতে পারেন, দীর্ঘ যানজট সৃষ্টি করে জনগণের জীবন বিপর্যস্ত করতে পারেন, আন্দোলন করে সড়ক দুর্ঘটনায় মৃত্যুর অপরাধের শাস্তি কমাতে ও অভিযোগটি জামিনযোগ্য করতে পারেন। কিন্তু সাধারণ মানুষের মৃত্যুর পর তার স্বজনেরা কান্নাকাটি ছাড়া আর কিছুই করতে পারেন না।
ক'দিন আগে সড়ক দুর্ঘটনায় জাতীয় প্রেসক্লাবের সামনে পা হারিয়েছেন খুলনার ছেলে সাংবাদিক নিখিল ভদ্র। নিখিল আমার একান্ত স্নেহভাজন, ছাত্র জীবনে আমি যে ছাত্রসংগঠন ছাত্র ইউনিয়নের সঙ্গে যুক্তছিলাম, নিখিল একসময় সেই ছাত্র ইউনিয়নের খুলনা জেলা শাখার সভাপতি ছিল। নিখিল আহত হওয়ার পর সাংবাদিকরা মানববন্ধন করেছেন, নিখিল কলম সৈনিক ছিল বলে সরকারের বদান্যতায় বিদেশে চিকিৎসার সুযোগ পেয়েছে, জীবন বেঁচে গেলেও পঙ্গুত্ব বরণ করতে হয়েছে। ১৬ কোটি মানুষের দেশে নিখিলের মতো ভাগ্যবান কম। তারেক মাসুদ-মিশুক মুনির সড়ক দুর্ঘটনায় নিহত হবার পর গঠিত তদন্ত কমিটি তদন্ত প্রতিবেদন জমা দিয়ে বেশকিছু সুপারিশ করেছিল। কিন্তু গত নয় মাসে সেই সুপারিশ বাস্তবায়নের কাজ শুরু হয়নি। বুয়েট সড়ক দুর্ঘটনা গবেষণা ইনস্টিটিউট দুর্ঘটনা রোধে ২০০৯ সালে দেশের ২১৪টি স্থান ঝুঁকিপূর্ণ নির্বাচন করে ব্যবস্থা গ্রহণের সুপারিশ করেছিল। সে সব সুপারিশ মূলত কাগজেই রয়ে গেছে। দুর্নীতির অভিযোগে সাবেক যোগাযোগ মন্ত্রী আবুল হোসেনের সড়ক ও যোগাযোগ মন্ত্রণালয় থেকে পালটে যাওয়ার পর এককালীন তুখোড় ছাত্রনেতা এখন এই মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বে আছেন। সেই দক্ষ ছাত্রনেতা মন্ত্রী হবার পর সড়ক নির্মাণে ছোটাছুটি করছেন, কি‘ দুর্ঘটনা রোধে সাংবাদিকদের কাছে হতাশার সঙ্গে বলেছেন তার একার পক্ষে এটি করা কঠিন, যানবাহনের বেপরোয়া গতিরোধে সড়ক মহাসড়কে ভ্রাম্যমাণ আদালত বসিয়ে শাস্তিও ব্যবস্থা করার সুপারিশ করে তদন্ত কমিটি। ভুয়া লাইসেন্স বাতিল, ট্রাফিক আইন ও সংকেত সম্পর্কে চালকদের ধারণা আছে কিনা ও প্রয়োগ হয় কি না তা যাচাই করার সুপারিশও হয়েছিল। চালকদের জন্যে আলাদা বৃত্তিমূলক প্রতিষ্ঠান, ন্যূনতম প্রবেশিকা পরীক্ষা পাসের কথাও বলা হয়েছিল। মাননীয় মন্ত্রী শাজাহান খান এই সুপারিশের বিপক্ষে যুক্তি দিয়ে বলেছিলেন এটি অবাস্তব, কেননা মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর ড্রাইভার শুধুমাত্র ৮ম শ্রেণী পাস। মিরেরসরাইতে ৪০জন শিশু শিক্ষার্থীর সড়ক দুর্ঘটনায় মৃত্যুর পর মাননীয় প্রধানমন্ত্রী গাড়ি চালানোকালে মোবাইল ফোন ব্যবহার নিষিদ্ধ ঘোষণা করলেও চালকরা তা মানছেন বলে মনে হয় না। বিআরটিএ-এর হিসাব অনুযায়ী প্রায় ৫ লাখ চালক ভুয়া লাইসেন্স নিয়ে গাড়ি চালাচ্ছেন। এসব ভুয়া লাইসেন্স ধরতে গেলে যে বিপত্তি হবে তা অবর্ণনীয় ।
বুয়েটের শিক্ষক অধ্যাপক শামছুল হক ও রকিব হাসানের ২০০৭ সালের বঙ্গবন্ধু সেতু এলাকায় দশ বছরের সড়ক দুর্ঘটনার উপর তৈরি করা সমীক্ষায় বেরিয়ে এসেছে- দশ বছরের সড়ক দুর্ঘটনার সংখ্যা ১০১১টি। যার কারণে মারা গেছেন ২১৫৫ জন এর মধ্যে ১৬ শতাংশ দুঘটনা যান্ত্রিক ত্রুটির কারণে বাকি সব দুর্ঘটনা চালকের কারণে। অপর এক সমীক্ষায় জানা গেছে মৃত ব্যক্তিদের বয়স ১৬ থেকে ৩০ বছরের মধ্যে যে কারণে ২০০৪ সালে সড়ক ও জনপথ অধিদপ্তরের প্রতিবেদন অনুযায়ী বছরে প্রায় ৪২০০ কোটি টাকার ক্ষতি হয়। পুলিশের তথ্য অনুযায়ি ২০১১ সালের জানুয়ারি থেকে নবেম্বর পর্যন্ত সারা দেশে ২২৪১টি দুঘটনা হয়েছে, মারা গেছে ২১৪০ জন। সার্বিক বিবেচনায় সড়ক দুর্ঘটনা আমাদের দেশের জন্য মর্মান্তিক ও বেদনাদায়ক।
আমাদের দেশের একজন বিশিষ্ট চলচ্চিত্র শিল্পী ইলিয়াস কাঞ্চন তার স্ত্রীর সড়ক দুর্ঘটনায় মৃত্যুর পর ‘নিরাপদ সড়ক চাই' আন্দোলন চালিয়ে যাচ্ছেন। বিষয়টি প্রশংসনীয়। ইলিয়াস কাঞ্চনকে গালিগালাজ, তার ফাসি দাবি করা, এমনকি কুশপুত্তলিকা দাহের সময় আইনশৃক্মখলা রক্ষাকারী বাহিনী নীরব থাকলেও খুলনায় আবার মানবাধিকার লঙ্ঘনের প্রতিবাদে গত ১২ই মে'র কর্মসূচি ভন্ডুলের সময় নীরব ছিল না। তারাও আমাদের রাষ্ট্রের জনগণের সেবক হিসেবেই দায়িত্বরত। দেশের দন্ডবিধির ৩০৪ (বি) ধারা অনুযায়ী সড়ক দুর্ঘটনায় সর্বোচ্চ শাস্তি ৩ বছর কারাদন্ড এবং জামিনযোগ্য অপরাধ। পরিবহন শ্রমিকরা এরশাদ আমলে আন্দোলন করে এটা অর্জন করতে পেরেছে। একজন লোককে মেরে ফেলার জন্যে ভাড়াটে কিলার নিয়োগ না করে বুদ্ধিমানদের জন্য গাড়ির চালককে দায়িত্ব দেয়া উত্তম। ক'দিন আগে মাননীয় মন্ত্রী শাজাহান খান সড়ক দুর্ঘটনায় অল্পের জন্য রক্ষা পেয়েছেন। তিনি সবসময় ঘাতক না বলে গাড়ি চালকদের সেবক অভিহিত করতে চান । আমার বিনম্র প্রশ্ন- ১১ই মে সড়ক দুর্ঘটনায় নিহত সাংবাদিকদের মেরে ফেলার গাড়িচালকদের তার ভাষায় আমরা সেবক বললাম, কি মাননীয় মন্ত্রী যদি মারা যেতেন তাহলে দোষী ড্রাইভারকে আমরা কি বলে সম্বোধন করতাম? সেবক না ঘাতক?
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন