ড. ন জ রু ল ই স লা ম
ই তোপূর্বে উল্লেখ করা হয়েছে রাজনৈতিক দর্শন কোনো অপরিবর্তনীয় বিমূর্ত ধারণা নয়। এর মূর্ত প্রকাশ ঘটে লিখিত নীতিমালা, কর্মসূচি ও আচরণের মাধ্যমে। রাজনৈতিক দর্শনের লিখিত প্রকাশের সর্বোচ্চ রূপ হচ্ছে সংবিধান। ১৯৭২ সালের মূল সংবিধান বঙ্গবন্ধু উত্সারিত আওয়ামী লীগের রাজনৈতিক দর্শনের মূর্ত প্রকাশ, যাকে বাংলাদেশের জনগণের অভিপ্রায়ের চরম প্রকাশ বলে সংবিধানে বর্ণনা করা হয়েছে।
১৯৭২ সালের সংবিধানে রাষ্ট্র পরিচালনার মূলনীতি হিসেবে বাঙালি জাতীয়তাবাদ, গণতন্ত্র, সমাজতন্ত্র ও ধর্মনিরপেক্ষতাকে গ্রহণ করা হয়। মানুষের মৌলিক মানবাধিকার, গণতান্ত্রিক অধিকার সংবলিত ধারাগুলো স্থান পায়। কিন্তু এই বিষয়ে বঙ্গবন্ধু ও আওয়ামী লীগের রাজনৈতিক দর্শনের পরিবর্তন লক্ষ করা যায় স্বাধীনতাপরবর্তী তাদের রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড, আচার-আচরণ ও সর্বোপরি সংবিধান সংশোধনীর মাধ্যমে। সংবিধানের ২য় সংশোধনী অর্থাত্ জরুরি অবস্থা ঘোষণা ও নিবর্তনমূলক বিশেষ ক্ষমতা আইন পাসের মাধ্যমে বঙ্গবন্ধুর রাজনৈতিক দর্শনের ব্যাপক পরিবর্তনের প্রকাশ পায়। বঙ্গবন্ধুর রাজনৈতিক দর্শনের সবচেয়ে বড় পরিবর্তন প্রকাশ পায় ১৯৭৫ সালের ২৫ জানুয়ারি সংবিধানে ৪র্থ সংশোধনীর মাধ্যমে। এই সংশোধনীর মাধ্যমে দেশে যে শাসনব্যবস্থা জারি হয়, তাকে বাকশালী শাসন বলা হয় এবং বঙ্গবন্ধুর দর্শনের এই পরিবর্তনকে তার অনুসারীরা বা বাকশাল শাসনের সমর্থকরা একে এক নতুন দর্শন হিসেবে আখ্যায়িত করেন এবং তারা এই দর্শনের নাম দেন ‘মুজিববাদ’। তাদের মুখে উচ্চারিত হয় এক নতুন স্লোগান ‘বিশ্বে এলো নতুন বাদ, মুজিববাদ মুজিববাদ’। বঙ্গবন্ধু নিজে কখনও সংবিধানের ৪র্থ সংশোধনী-উত্তর রাষ্ট্র পরিচালনার ধারাকে ‘মুজিববাদ’ বলে আখ্যায়িত করেননি। কিন্তু তাকে খুশি করার জন্য একদল সুবিধাভোগী, যারা সবসময় সর্বকালে ক্ষমতার আশপাশে থাকেন, নিজেদের সুবিধা আদায়ে ক্ষমতাসীনদের খুশি করে সুযোগ-সুবিধা আদায়ের লক্ষ্যে কর্মকাণ্ড পরিচালনা করেন, তাদেরই উর্বর মস্তিষ্কপ্রসূত স্লোগান ছিল-‘বিশ্বে এলো নতুন বাদ, মুুজিববাদ মুজিববাদ’।
শুধু তাই নয়, এক ভদ্রলোক (লেখক) যার নাম এই মুহূর্তে মনে পড়ছে না, ‘মুজিববাদ’ নামে বালিশের ন্যায় এক মোটা বই লিখে ফেললেন। আমরা জানি, যিনি দর্শনের প্রবক্তা, তার লেখা গবেষণা-প্রবন্ধ থেকে তার দর্শনের প্রকাশ ঘটে-যেমন ঘটেছিল ম্যাকেইভালি, প্লেটো, মার্কস, লেনিন, মাও সেতুংয়ের ক্ষেত্রে। কিন্তু এর ব্যতিক্রম ঘটল ‘বঙ্গবন্ধুর’ ক্ষেত্রে। তার মতবাদ তিনি লিখলেন না, লিখলেন অন্য মানুষ। মানবচরিত্র অনুধাবন করার এক অসাধারণ ক্ষমতা ছিল বঙ্গবন্ধুর। তিনি নিশ্চয়ই তার দর্শন নিয়ে অন্যের লেখা ‘মুজিববাদ’ বইটি পড়ে মুচকি হেসেছিলেন। শুধু তাই নয়, অনেক জ্ঞানী-গুণী বলে সমাজে পরিচিত বা উপস্থাপিত কেউ কেউ বললেন মুজিববাদ হচ্ছে এমন এক দর্শন, যা সক্রেটিস, প্লেটো, অ্যারিস্টোটল, মার্কস, এঙ্গেলস, ভলটেয়ার, রুশো, মাও সেতুং সবার চিন্তা বা দর্শনের একক প্রকাশ। যা হোক, এ বিষয় থাক। এবার ফিরে আসা যাক সংবিধানের ৪র্থ সংশোধনীর দিকে। ৪র্থ সংশোধনী ছিল বঙ্গবন্ধুর সারাজীবনের রাজনৈতিক দর্শনের সম্পূর্ণ বিপরীত অবস্থান। যিনি সারাজীবন সংসদীয় গণতন্ত্র, মানবাধিকার, আইনের শাসনের প্রবক্তা ছিলেন এবং এই আদর্শের জন্য লড়াই করতে গিয়ে বছরের পর বছর কারাগারে অন্তরীণ থেকেছেন, অত্যাচার সহ্য করেছেন- তিনি ৪র্থ সংশোধনীর মাধ্যমে নিজের দর্শনের বদলে এমন এক দর্শন অবতারণা করলেন, যাকে ব্যাখ্যা করা যায় না।
অবশ্য ১৯৭২ সালের সংবিধানের রাষ্ট্র পরিচালনার মূলনীতির অন্তত দুটি নীতি ছিল পরস্পরবিরোধী। যেমন রাষ্ট্র পরিচালনার মূলনীতি হিসেবে গণতন্ত্র ও সমাজতন্ত্র ধারণা দুটি। গণতন্ত্র ও সমাজতন্ত্র একসঙ্গে চলে না। আবার গণতান্ত্রিক ধ্যান-ধারণা ও গণতান্ত্রিক সংস্কৃতির ধারক-বাহক দল ছাড়া যেমন গণতান্ত্রিক সমাজ বিনির্মাণ করা যায় না, তেমনি সমাজতান্ত্রিক আদর্শে বিশ্বাসী ধারক-বাহক দল ছাড়া সমাজতান্ত্রিক সমাজ নির্মাণ করা যায় না। আগেই উল্লেখ করা হয়েছে, বাংলাদেশের সংবিধানে ৪র্থ সংশোধনী আনয়নের মাধ্যমে গণতন্ত্র নামক ধারণাটির সাংবিধানিক মৃত্যু ঘটানো হয়। ৪র্থ সংশোধনী সম্পর্কে আলোচনা করলে পাঠক হয়তো অনুধাবন করতে পারবেন, কেন বলা হচ্ছে ৪র্থ সংশোধনীর মাধ্যমে গণতন্ত্রের সাংবিধানিক মৃত্যু ঘটানো হয়েছিল।
৪র্থ সংশোধনীর মাধ্যমে দেশে একদলীয় শাসনব্যবস্থা কায়েম করা হয়। দেশের সকল রাজনৈতিক দলকে নিষিদ্ধ ঘোষণা করা হয় এবং ‘বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ’ দলটির অবলুপ্তি ঘটিয়ে ‘বাংলাদেশ কৃষক শ্রমিক আওয়ামী লীগ’ নামক একটি নতুন দল গঠন করা হয়-যা সংক্ষেপে ‘বাকশাল’ নামে পরিচিতি লাভ করে বা পরিচয় করিয়ে দেওয়া হয়। ৪র্থ সংশোধনীর মাধ্যমে আনীত শাসনব্যবস্থা ‘বাকশাল’ শাসনব্যবস্থা হিসেবে পরিচিতি পায় এবং সাধারণ মানুষ একে ‘বাকশাল’ শাসন বলে অভিহিত করে। পাঠকদের বোঝার সুবিধার জন্য সংবিধানের ৪র্থ সংশোধনীর মাধ্যমে আনীত ব্যবস্থাকে এখানে ‘বাকশাল’ শাসন ব্যবস্থা হিসেবে উল্লেখ করব। এখন দেখা যাক বাকশালী শাসন ব্যবস্থা কী ছিল এবং এই ব্যবস্থাকে কেন গণতন্ত্রের সাংবিধানিক অপমৃত্যু বলা হল। এ বিষয়ে মন্তব্য বা বিশ্লেষণ ছাড়াই ‘বাকশালী’ শাসনব্যবস্থায় কী কী মূল সংবিধানিক পরিবর্তন আনয়ন করা হয়েছিল তা উল্লেখ করা হল।
১. সংবিধানের মৌলিক কাঠামো পরিবর্তন করে সংসদীয় পদ্ধতির সরকার ব্যবস্থার অবসান ঘটানো হয়। সংসদীয় ব্যবস্থার পরিবর্তে রাষ্ট্রপতি শাসিত সরকার ব্যবস্থা কায়েম করা হয়। নবপ্রবর্তিত রাষ্ট্রপতি শাসনে রাষ্ট্রপতি সরকার গঠন করবেন। তিনি উপরাষ্ট্রপতি নিয়োগ করবেন এবং তার নিজের ইচ্ছায় মন্ত্রিসভা গঠন করবেন। মন্ত্রিসভার সদস্যগণ রাষ্ট্রপতিকে বিভিন্ন বিষয়ে উপদেশ দেবেন। অর্থাত্ মন্ত্রিসভার সদস্যদের ভূমিকা শুধু রাষ্ট্রপতিকে উপদেশ প্রদান। রাষ্ট্রপতির খুশির ওপর নির্ভর করবে কোনো মন্ত্রীর মন্ত্রিত্ব। মূল সংবিধানে সংসদের অধিবেশন বিরতি সর্বোচ্চ ৬০ দিন ছিল। নতুন ব্যবস্থায় সংসদের অধিবেশন বছরে ২ বার বসবে বলে বিধান করা হয়।
৪র্থ সংশোধনীতে রাষ্ট্রপতি নির্বাচনের বিধান থাকলেও বঙ্গবন্ধু প্রধানমন্ত্রীর পদ থেকে সরাসরি রাষ্ট্রপতি পদে আসীন হন এবং বলা হয় বঙ্গবন্ধু রাষ্ট্রপতি পদে আসীন হলেন এবং ধরে নেওয়া হবে যে তিনি রাষ্ট্রপতি পদে নির্বাচিত হয়েছেন।
২. আওয়ামী লীগ ও অন্যান্য দলের হাতেগোনা যে কয়েকজন সংসদ সদস্য ছিলেন তাদের নবগঠিত বাকশালে যোগদান বাধ্যতামূলক করা হয়। আরও বিধান করা হয় যে বাকশালে যারা যোগদান করবেন না, তারা সংসদ সদস্যপদ হারাবেন। আওয়ামী লীগের সংসদ সদস্য ব্যারিস্টার মইনুল হোসেনসহ কয়েকজন বাকশালে যোগদান না করায় সংসদ সদস্যপদ হারান। জনগণের ভোটে নির্বাচিত সংসদ সদস্যদের কলমের খোঁচায় সংসদ সদস্য থেকে অপসারণ বা সদস্যপদ কেড়ে নেওয়া কি গণতন্ত্র! অথচ বাকশাল শাসনে রাষ্ট্র পরিচালনার মূলনীতি হিসেবে তখন গণতন্ত্র বহাল ছিল।
৩. বাকশাল ব্যতীত সকল রাজনৈতিক দল নিষিদ্ধ করা হয়। অর্থাত্ দেশে একদলীয় শাসন ব্যবস্থা কায়েম করা হয়। শুধু তাই নয়, যেকোনো সংগঠন ও সমিতি করার অধিকার কেড়ে নেওয়া হয়। আবার বাকশালে যোগদান সীমিত করা হয়। বলা হয়, বঙ্গবন্ধুর অনুমতি ছাড়া কেউ বাকশালের সদস্য হতে পারবেন না। দেশের কোটি কোটি মানুষ কীভাবে বঙ্গবন্ধুর অনুমতিপ্রাপ্ত হয়ে বাকশালের সদস্য হবেন সে হিসাব মাথায় আসে না।
৪. চারটি পত্রিকা বাদে সকল পত্রিকার প্রকাশ নিষিদ্ধ করা হয় এবং এই চারটি পত্রিকাও জাতীয়করণ করা হয়। এই চারটি পত্রিকা বাদে কোনো ধরনের রাজনৈতিক পুস্তিকা, লিফলেট বা অন্য যেকোনো ধরনের লেখা প্রকাশ নিষিদ্ধ করা হয়।
(চলবে)
nazrul.islam.psy(a)gmail.com
এই প্রবন্ধ লিখতে বাংলাদেশের প্রাক্তন প্রধান বিচারপতি মোস্তফা কামাল-এর কামিনী কুমার দত্ত মেমোরিয়াল বক্তৃতা-১৯৯৪ ‘Bagladesh Constitution : Trend & Issues’ থেকে অনেক তথ্য ব্যবহার করা হয়েছে। আমি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করছি।
ই তোপূর্বে উল্লেখ করা হয়েছে রাজনৈতিক দর্শন কোনো অপরিবর্তনীয় বিমূর্ত ধারণা নয়। এর মূর্ত প্রকাশ ঘটে লিখিত নীতিমালা, কর্মসূচি ও আচরণের মাধ্যমে। রাজনৈতিক দর্শনের লিখিত প্রকাশের সর্বোচ্চ রূপ হচ্ছে সংবিধান। ১৯৭২ সালের মূল সংবিধান বঙ্গবন্ধু উত্সারিত আওয়ামী লীগের রাজনৈতিক দর্শনের মূর্ত প্রকাশ, যাকে বাংলাদেশের জনগণের অভিপ্রায়ের চরম প্রকাশ বলে সংবিধানে বর্ণনা করা হয়েছে।
১৯৭২ সালের সংবিধানে রাষ্ট্র পরিচালনার মূলনীতি হিসেবে বাঙালি জাতীয়তাবাদ, গণতন্ত্র, সমাজতন্ত্র ও ধর্মনিরপেক্ষতাকে গ্রহণ করা হয়। মানুষের মৌলিক মানবাধিকার, গণতান্ত্রিক অধিকার সংবলিত ধারাগুলো স্থান পায়। কিন্তু এই বিষয়ে বঙ্গবন্ধু ও আওয়ামী লীগের রাজনৈতিক দর্শনের পরিবর্তন লক্ষ করা যায় স্বাধীনতাপরবর্তী তাদের রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড, আচার-আচরণ ও সর্বোপরি সংবিধান সংশোধনীর মাধ্যমে। সংবিধানের ২য় সংশোধনী অর্থাত্ জরুরি অবস্থা ঘোষণা ও নিবর্তনমূলক বিশেষ ক্ষমতা আইন পাসের মাধ্যমে বঙ্গবন্ধুর রাজনৈতিক দর্শনের ব্যাপক পরিবর্তনের প্রকাশ পায়। বঙ্গবন্ধুর রাজনৈতিক দর্শনের সবচেয়ে বড় পরিবর্তন প্রকাশ পায় ১৯৭৫ সালের ২৫ জানুয়ারি সংবিধানে ৪র্থ সংশোধনীর মাধ্যমে। এই সংশোধনীর মাধ্যমে দেশে যে শাসনব্যবস্থা জারি হয়, তাকে বাকশালী শাসন বলা হয় এবং বঙ্গবন্ধুর দর্শনের এই পরিবর্তনকে তার অনুসারীরা বা বাকশাল শাসনের সমর্থকরা একে এক নতুন দর্শন হিসেবে আখ্যায়িত করেন এবং তারা এই দর্শনের নাম দেন ‘মুজিববাদ’। তাদের মুখে উচ্চারিত হয় এক নতুন স্লোগান ‘বিশ্বে এলো নতুন বাদ, মুজিববাদ মুজিববাদ’। বঙ্গবন্ধু নিজে কখনও সংবিধানের ৪র্থ সংশোধনী-উত্তর রাষ্ট্র পরিচালনার ধারাকে ‘মুজিববাদ’ বলে আখ্যায়িত করেননি। কিন্তু তাকে খুশি করার জন্য একদল সুবিধাভোগী, যারা সবসময় সর্বকালে ক্ষমতার আশপাশে থাকেন, নিজেদের সুবিধা আদায়ে ক্ষমতাসীনদের খুশি করে সুযোগ-সুবিধা আদায়ের লক্ষ্যে কর্মকাণ্ড পরিচালনা করেন, তাদেরই উর্বর মস্তিষ্কপ্রসূত স্লোগান ছিল-‘বিশ্বে এলো নতুন বাদ, মুুজিববাদ মুজিববাদ’।
শুধু তাই নয়, এক ভদ্রলোক (লেখক) যার নাম এই মুহূর্তে মনে পড়ছে না, ‘মুজিববাদ’ নামে বালিশের ন্যায় এক মোটা বই লিখে ফেললেন। আমরা জানি, যিনি দর্শনের প্রবক্তা, তার লেখা গবেষণা-প্রবন্ধ থেকে তার দর্শনের প্রকাশ ঘটে-যেমন ঘটেছিল ম্যাকেইভালি, প্লেটো, মার্কস, লেনিন, মাও সেতুংয়ের ক্ষেত্রে। কিন্তু এর ব্যতিক্রম ঘটল ‘বঙ্গবন্ধুর’ ক্ষেত্রে। তার মতবাদ তিনি লিখলেন না, লিখলেন অন্য মানুষ। মানবচরিত্র অনুধাবন করার এক অসাধারণ ক্ষমতা ছিল বঙ্গবন্ধুর। তিনি নিশ্চয়ই তার দর্শন নিয়ে অন্যের লেখা ‘মুজিববাদ’ বইটি পড়ে মুচকি হেসেছিলেন। শুধু তাই নয়, অনেক জ্ঞানী-গুণী বলে সমাজে পরিচিত বা উপস্থাপিত কেউ কেউ বললেন মুজিববাদ হচ্ছে এমন এক দর্শন, যা সক্রেটিস, প্লেটো, অ্যারিস্টোটল, মার্কস, এঙ্গেলস, ভলটেয়ার, রুশো, মাও সেতুং সবার চিন্তা বা দর্শনের একক প্রকাশ। যা হোক, এ বিষয় থাক। এবার ফিরে আসা যাক সংবিধানের ৪র্থ সংশোধনীর দিকে। ৪র্থ সংশোধনী ছিল বঙ্গবন্ধুর সারাজীবনের রাজনৈতিক দর্শনের সম্পূর্ণ বিপরীত অবস্থান। যিনি সারাজীবন সংসদীয় গণতন্ত্র, মানবাধিকার, আইনের শাসনের প্রবক্তা ছিলেন এবং এই আদর্শের জন্য লড়াই করতে গিয়ে বছরের পর বছর কারাগারে অন্তরীণ থেকেছেন, অত্যাচার সহ্য করেছেন- তিনি ৪র্থ সংশোধনীর মাধ্যমে নিজের দর্শনের বদলে এমন এক দর্শন অবতারণা করলেন, যাকে ব্যাখ্যা করা যায় না।
অবশ্য ১৯৭২ সালের সংবিধানের রাষ্ট্র পরিচালনার মূলনীতির অন্তত দুটি নীতি ছিল পরস্পরবিরোধী। যেমন রাষ্ট্র পরিচালনার মূলনীতি হিসেবে গণতন্ত্র ও সমাজতন্ত্র ধারণা দুটি। গণতন্ত্র ও সমাজতন্ত্র একসঙ্গে চলে না। আবার গণতান্ত্রিক ধ্যান-ধারণা ও গণতান্ত্রিক সংস্কৃতির ধারক-বাহক দল ছাড়া যেমন গণতান্ত্রিক সমাজ বিনির্মাণ করা যায় না, তেমনি সমাজতান্ত্রিক আদর্শে বিশ্বাসী ধারক-বাহক দল ছাড়া সমাজতান্ত্রিক সমাজ নির্মাণ করা যায় না। আগেই উল্লেখ করা হয়েছে, বাংলাদেশের সংবিধানে ৪র্থ সংশোধনী আনয়নের মাধ্যমে গণতন্ত্র নামক ধারণাটির সাংবিধানিক মৃত্যু ঘটানো হয়। ৪র্থ সংশোধনী সম্পর্কে আলোচনা করলে পাঠক হয়তো অনুধাবন করতে পারবেন, কেন বলা হচ্ছে ৪র্থ সংশোধনীর মাধ্যমে গণতন্ত্রের সাংবিধানিক মৃত্যু ঘটানো হয়েছিল।
৪র্থ সংশোধনীর মাধ্যমে দেশে একদলীয় শাসনব্যবস্থা কায়েম করা হয়। দেশের সকল রাজনৈতিক দলকে নিষিদ্ধ ঘোষণা করা হয় এবং ‘বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ’ দলটির অবলুপ্তি ঘটিয়ে ‘বাংলাদেশ কৃষক শ্রমিক আওয়ামী লীগ’ নামক একটি নতুন দল গঠন করা হয়-যা সংক্ষেপে ‘বাকশাল’ নামে পরিচিতি লাভ করে বা পরিচয় করিয়ে দেওয়া হয়। ৪র্থ সংশোধনীর মাধ্যমে আনীত শাসনব্যবস্থা ‘বাকশাল’ শাসনব্যবস্থা হিসেবে পরিচিতি পায় এবং সাধারণ মানুষ একে ‘বাকশাল’ শাসন বলে অভিহিত করে। পাঠকদের বোঝার সুবিধার জন্য সংবিধানের ৪র্থ সংশোধনীর মাধ্যমে আনীত ব্যবস্থাকে এখানে ‘বাকশাল’ শাসন ব্যবস্থা হিসেবে উল্লেখ করব। এখন দেখা যাক বাকশালী শাসন ব্যবস্থা কী ছিল এবং এই ব্যবস্থাকে কেন গণতন্ত্রের সাংবিধানিক অপমৃত্যু বলা হল। এ বিষয়ে মন্তব্য বা বিশ্লেষণ ছাড়াই ‘বাকশালী’ শাসনব্যবস্থায় কী কী মূল সংবিধানিক পরিবর্তন আনয়ন করা হয়েছিল তা উল্লেখ করা হল।
১. সংবিধানের মৌলিক কাঠামো পরিবর্তন করে সংসদীয় পদ্ধতির সরকার ব্যবস্থার অবসান ঘটানো হয়। সংসদীয় ব্যবস্থার পরিবর্তে রাষ্ট্রপতি শাসিত সরকার ব্যবস্থা কায়েম করা হয়। নবপ্রবর্তিত রাষ্ট্রপতি শাসনে রাষ্ট্রপতি সরকার গঠন করবেন। তিনি উপরাষ্ট্রপতি নিয়োগ করবেন এবং তার নিজের ইচ্ছায় মন্ত্রিসভা গঠন করবেন। মন্ত্রিসভার সদস্যগণ রাষ্ট্রপতিকে বিভিন্ন বিষয়ে উপদেশ দেবেন। অর্থাত্ মন্ত্রিসভার সদস্যদের ভূমিকা শুধু রাষ্ট্রপতিকে উপদেশ প্রদান। রাষ্ট্রপতির খুশির ওপর নির্ভর করবে কোনো মন্ত্রীর মন্ত্রিত্ব। মূল সংবিধানে সংসদের অধিবেশন বিরতি সর্বোচ্চ ৬০ দিন ছিল। নতুন ব্যবস্থায় সংসদের অধিবেশন বছরে ২ বার বসবে বলে বিধান করা হয়।
৪র্থ সংশোধনীতে রাষ্ট্রপতি নির্বাচনের বিধান থাকলেও বঙ্গবন্ধু প্রধানমন্ত্রীর পদ থেকে সরাসরি রাষ্ট্রপতি পদে আসীন হন এবং বলা হয় বঙ্গবন্ধু রাষ্ট্রপতি পদে আসীন হলেন এবং ধরে নেওয়া হবে যে তিনি রাষ্ট্রপতি পদে নির্বাচিত হয়েছেন।
২. আওয়ামী লীগ ও অন্যান্য দলের হাতেগোনা যে কয়েকজন সংসদ সদস্য ছিলেন তাদের নবগঠিত বাকশালে যোগদান বাধ্যতামূলক করা হয়। আরও বিধান করা হয় যে বাকশালে যারা যোগদান করবেন না, তারা সংসদ সদস্যপদ হারাবেন। আওয়ামী লীগের সংসদ সদস্য ব্যারিস্টার মইনুল হোসেনসহ কয়েকজন বাকশালে যোগদান না করায় সংসদ সদস্যপদ হারান। জনগণের ভোটে নির্বাচিত সংসদ সদস্যদের কলমের খোঁচায় সংসদ সদস্য থেকে অপসারণ বা সদস্যপদ কেড়ে নেওয়া কি গণতন্ত্র! অথচ বাকশাল শাসনে রাষ্ট্র পরিচালনার মূলনীতি হিসেবে তখন গণতন্ত্র বহাল ছিল।
৩. বাকশাল ব্যতীত সকল রাজনৈতিক দল নিষিদ্ধ করা হয়। অর্থাত্ দেশে একদলীয় শাসন ব্যবস্থা কায়েম করা হয়। শুধু তাই নয়, যেকোনো সংগঠন ও সমিতি করার অধিকার কেড়ে নেওয়া হয়। আবার বাকশালে যোগদান সীমিত করা হয়। বলা হয়, বঙ্গবন্ধুর অনুমতি ছাড়া কেউ বাকশালের সদস্য হতে পারবেন না। দেশের কোটি কোটি মানুষ কীভাবে বঙ্গবন্ধুর অনুমতিপ্রাপ্ত হয়ে বাকশালের সদস্য হবেন সে হিসাব মাথায় আসে না।
৪. চারটি পত্রিকা বাদে সকল পত্রিকার প্রকাশ নিষিদ্ধ করা হয় এবং এই চারটি পত্রিকাও জাতীয়করণ করা হয়। এই চারটি পত্রিকা বাদে কোনো ধরনের রাজনৈতিক পুস্তিকা, লিফলেট বা অন্য যেকোনো ধরনের লেখা প্রকাশ নিষিদ্ধ করা হয়।
(চলবে)
nazrul.islam.psy(a)gmail.com
এই প্রবন্ধ লিখতে বাংলাদেশের প্রাক্তন প্রধান বিচারপতি মোস্তফা কামাল-এর কামিনী কুমার দত্ত মেমোরিয়াল বক্তৃতা-১৯৯৪ ‘Bagladesh Constitution : Trend & Issues’ থেকে অনেক তথ্য ব্যবহার করা হয়েছে। আমি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করছি।
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন