শুক্রবার, ৮ জুন, ২০১২

বিশাল বপুর বাজেট : আবারও স্বপ্ন দেখানোর চেষ্টা



আহমদ আশিকুল হামিদ : 
বয়সের ভারে কিংবা অন্য কোনো কারণে কুঁজা হয়ে যাওয়া মানুষদের সম্পর্কে এদেশে একটা কথা প্রচলিত রয়েছে। বলা হয়, কুঁজার মনেও নাকি চিৎ হয়ে শোয়ার শখ জাগে! শুনতে ব্যঙ্গাত্মক মনে হলেও এর অন্তর্নিহিত অর্থ কিন্তু শিক্ষামূলক, যার মধ্য দিয়ে উপদেশও দেয়া হয়েছে। সে উপদেশের মূলকথা হলো, অসম্ভব কোনো কল্পনা না করাই ভালো।
কথা উঠেছে ২০১২-১৩ অর্থবছরের বাজেট নিয়ে। ৭ জুন জাতীয় সংসদে এক লাখ ৯১ হাজার ৭৩৭ কোটি টাকার বিশাল বপুর বাজেট পেশ করেছেন অর্থমন্ত্রী। বক্তৃতায় বাগাড়ম্বরও যথেষ্টই করেছেন তিনি। তা সত্ত্বেও মানুষের মনে আস্থা কিন্তু সৃষ্টি করতে পারেননি। এই না পারার প্রথম কারণ ৫২ হাজার ৬৮ কোটি টাকার ঘাটতি। বস্তুত বিশাল বপুর বাজেটের পাশাপাশি ঘাটতির পরিমাণকেও বিশাল না বলে উপায় নেই। এখানেই ধাক্কা খেতে হয়েছে। কারণ, টাকার খবর নেই তবু মানুষকে স্বপ্ন দেখানোর চেষ্টা করেছেন অর্থমন্ত্রী। প্রশ্ন উঠেছে, ঘাটতি পূরণের জন্য কল্পিত ৫২ হাজার ৬৮ কোটি টাকা যদি যোগাড় না করা যায় তাহলে কিভাবে উন্নয়নের জোয়ার বইয়ে দেবে সরকার? টাকা যোগাড়ের সম্ভাব্য খাতগুলোও লক্ষ্য করার মতো। যেমন দেশের ব্যাংকিং খাত থেকেই ২৩ হাজার কোটি টাকা ঋণ নেয়ার ঘোষণা দিয়েছেন অর্থমন্ত্রী। কথা ওঠার কারণ হলো, ব্যাংক ঋণের ক্ষেত্রে সরকার বহু আগেই রেকর্ড তৈরি করে ফেলেছে। সব সরকারকে ব্যাংক থেকে ঋণ নিতে হয় বলে জাবর কাটা হলেও শেখ হাসিনার নেতৃত্বে মুহিত সাহেবরা সীমা ছাড়িয়ে গেছেন। তারা দেশকেও ভয়ংকর বিপদের মুখে ঠেলে দিয়েছেন। যেমন ২০১১-১২ অর্থবছরে পাঁচ মাস না যেতেই ব্যাংক থেকে ২১ হাজার ৩২১ কোটি টাকা ঋণ নিয়ে ফেলেছিল সরকার। অথচ অর্থবছরের বাজেটে ব্যাংক ঋণের প্রাক্কলনই ছিল ১৮ হাজার ৯৫৭ কোটি টাকা। অর্থাৎ সরকার নিজেই নিজের নির্ধারিত সীমাকে অতিক্রম করেছে, তাও সাত মাস বাকি থাকতেই। এবার অবস্থার আরো অবনতি ঘটতে পারে। তাছাড়া ঋণ যেখানে ২৩ হাজার কোটি টাকা নেয়া হবে সেখানে ঋণের সুদই গুণতে হবে ২১ হাজার টাকা। পাঠকরাও হিসাব কষে দেখতে পারেন। বলা বাহুল্য, সরকার একাই ব্যাংক থেকে এত বিপুল পরিমাণ ঋণ নেয়ার ফলে ব্যাংকগুলো তো বিপন্ন হচ্ছেই, দেশের অর্থনীতিও মারাত্মক বিপর্যয়ের কবলে পড়েছে।
বলার অপেক্ষা রাখে না, ব্যাংক থেকে এত বিপুল পরিমাণ ঋণ নেয়ার বিষয়টি সরকারের অযোগ্যতাকেই সামনে এনেছে। সব সরকারই ঋণ নেয় বলে অর্থমন্ত্রী যে যুক্তি দেখিয়ে থাকেন সে যুক্তিও কিন্তু মেনে নেয়ার উপায় নেই। এটাই অবশ্য উদ্বেগের একমাত্র কারণ নয়। আসল কারণ আর্থিক ব্যবস্থাপনায় সরকারের ক্ষতিকর ব্যর্থতা। সরকারের দুর্নীতি ও অব্যবস্থাপনার কারণে দেশের পুঁজি বাজার থেকে অন্তত এক লক্ষ কোটি টাকা লোপাট হয়ে গেছে। লোপাট করেছে ক্ষমতাসীনদেরই লোকজন। কিন্তু নামকা ওয়াস্তে একটি তদন্ত কমিটি গঠন করলেও কারো বিরুদ্ধেই কোনো ব্যবস্থা নেয়া হয়নি। ফলে এ অভিযোগই প্রতিষ্ঠিত হয়েছে যে, সবকিছুর সঙ্গে ক্ষমতাসীনদের যোগসাজশ রয়েছে। শেয়ারবাজার লুণ্ঠিত হওয়ায় স্বাভাবিকভাবে দেশে নগদ অর্থের তীব্র সংকট সৃষ্টি হয়েছিল। সরকার বিপুল ঋণ নেয়ায় ব্যাংকগুলোকে উল্টো ২৩ শতাংশ সুদের বিনিময়ে কলমানি মার্কেট থেকে টাকা ধার করতে হয়েছিল। সে কারণে শিল্পপতি ও ব্যবসায়ীরা ব্যাংক থেকে ঋণ পাননি বললেই চলে। ফলে নতুন বিনিয়োগ তো হয়-ইনি, অনেকের পুরনো ব্যবসাও লাটে ওঠার অবস্থা হয়েছে। সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে দেশের রফতানি খাত। টাকা না পাওয়ায় হাজার হাজার কোটি টাকার অর্ডার বাতিল হয়ে গেছে। রফতানি আয়ের কোনো খাতই লক্ষ্য অর্জনের কাছাকাছি যেতে পারেনি। রফতানি আয় বরং ৫০ শতাংশ পর্যন্ত কমে গেছে। ওদিকে সরকারের দুর্নীতির কারণে বিশ্বব্যাংক ও আইএমএফসহ দাতাগোষ্ঠীও সাহায্যের দরজা বন্ধ করে দিয়েছে। এমন এক পরিস্থিতিতে দায়িত্ব যেখানে ছিল অর্থনীতির প্রতিটি খাতকে সচল করে তোলার চেষ্টা চালানো সেখানে সরকার একাই ২৩ হাজার কোটি টাকা ঋণ নেয়ার ঘোষণা দিয়ে উল্টো বিরাট প্রতিবন্ধকতা তৈরি করে বসেছে।
বাজেটকেন্দ্রিক আলোচনায় কালো টাকা সাদা করার সুযোগ দেয়ার বিষয়টি এসেছে বিশেষভাবে। এটাই স্বাভাবিক। কারণ, নির্বাচনী ইশতেহারে আওয়ামী লীগ দুর্নীতি উচ্ছেদের ঘোষণা দিয়েছিল। কিন্তু একই দলের অর্থমন্ত্রী মাত্র ১০ শতাংশ হারে কর দিয়ে কালো টাকা সাদা করার সুযোগ দিয়েছেন। এ সুযোগও পাওয়া যাচ্ছে সরকারের প্রথম বছর থেকে। অর্থাৎ কালো টাকার মালিকরা মাত্র ১০ শতাংশ হারে কর দিয়েই ‘সাধু' সাজার সুযোগ পাবে। বলা হচ্ছে, এটা কালো টাকার মালিকদের সঙ্গে ‘সহযোগিতামূলক দুর্নীতি' এবং ‘পাপের অর্থের বৈধতা দেয়ার প্রস্তাবনা'। প্রশ্ন উঠেছে, দেশের তরুণদের জন্য এ কোন আদর্শ রেখে যাচ্ছে আওয়ামী লীগ সরকার? কারণ, কালো টাকা সাদা করার সুযোগ দেয়াকে চরম অনৈতিকতা ও রাজনৈতিক অসততা ছাড়া আর কিছু বলা যায় না। ‘মন্দের ভালো' হিসেবে কালোটাকা সাদা করার সুযোগ দেয়াকে একটি পন্থা হিসেবে উল্লেখ করেছেন অর্থমন্ত্রী। কারণ, দেশে কালো টাকার পরিমাণ নাকি মোট জিডিপির প্রায় ৮২ শতাংশ পর্যন্ত। এই বিপুল অর্থ বিনিয়োগ করার মাধ্যমে সাদা করা হলে অর্থনীতির ঝুঁকি ও বিপদ কাটিয়ে ওঠা সহজ হতে পারে বলে অর্থমন্ত্রী মনে করেন। লক্ষ্যণীয় বিষয় হলো, অর্থমন্ত্রী কিন্তু জানাননি, এত বিপুল পরিমাণ কালো টাকার মালিক আসলে কারা? তাছাড়া এক পরিসংখ্যানে জানা গেছে, সরকার সুযোগ দেয়া সত্ত্বেও খুব বেশি টাকা সাদা করা হচ্ছে না। যেমন এখনো চলমান অর্থবছরে এক হাজার কোটি টাকার মতো কালো টাকা সাদা করা হয়েছে। এই পরিমাণকে মাত্র ছাড়া আর কিছুই বলা যায় না।
দ্বিতীয় একটি পথ বাতলাতে গিয়ে অর্থমন্ত্রী বলেছেন, দেশের ব্যাংকিং ব্যবস্থার দিকে তাকিয়ে না থেকে ব্যবসায়ী-উদ্যোক্তারা যদি বিদেশ থেকে ঋণ এনে সেই অর্থ দেশে বিনিয়োগ করেন তাহলে অর্থনীতির বিপদ কাটিয়ে ওঠা সম্ভব হতে পারে। অর্থাৎ সরকারের নিজের হাতে বিপদ কাটিয়ে ওঠার কোনো পথ বা উপায় নেই। এজন্য জাতিকে সম্পূর্ণরূপে নির্ভর করতে হবে কিছু ‘যদি' ও ‘তবে'র ওপর- ‘যদি' কালো টাকার মালিকরা নিজেদের অর্থ দেশে বিনিয়োগ করেন এবং ‘যদি' ব্যবসায়ী-উদ্যোক্তারা বিদেশ থেকে ঋণ এনে সে ঋণের অর্থ শিল্পে বিনিয়োগ করেন ‘তাহলে' সংকট কাটিয়ে ওঠা সম্ভব হলেও হতে পারে। লক্ষ্য করলে দেখা যাবে, এ দুটি ‘যদি'ও কিন্তু সর্বতোভাবেই অনিশ্চয়তা ও ঝুঁকিপূর্ণই। কারণ, প্রথমত, কালো টাকার মালিকরা তাদের অর্থ সাদা নাও করতে পারেন। দ্বিতীয়ত, শিল্প-কারখানা স্থাপনের পরিবর্তে বিনিয়োগও তারা আমদানি-রফতানি ধরনের ট্রেডিং-এ করতে পারেন, যার মাধ্যমে চাকরির সুযোগ সৃষ্টি হওয়ার সম্ভাবনা নেই বললেই চলে। তৃতীয়ত, ব্যবসায়ী-উদ্যোক্তারা বিদেশ থেকে ঋণ আনতে চাইবেন কি না, তারা চাইলেই বিদেশিরা ‘অনিশ্চয়তা ও ঝুঁকিপূর্ণ' কোনো দেশের ব্যবসায়ীদের ঋণ দেবেন কি না এবং দিলেও ঋণের সম্পূর্ণ অর্থ উৎপাদনশীল ও কর্মসংস্থান সৃষ্টিকারী খাতগুলোতে বিনিয়োগ করা হবে কি না- এ ধরনের অনেক প্রশ্নই রয়েছে। সরকার যেহেতু কিছু ‘যদি' ও ‘তবে'র ওপর ভরসা করে বসে আছে এবং বাজারে মনিটরিং ও নিয়ন্ত্রণের কোনো ব্যবস্থাই নিচ্ছে না সেহেতু দামই শুধু বাড়তে থাকবে না, একই সঙ্গে অর্থনৈতিক সংকটও হবে ভয়াবহ এবং দীর্ঘস্থায়ী।
বাজেটে কৃষি খাত মোটেই গুরুত্ব পায়নি। কৃষি ও কৃষকের ব্যাপারে বড় বড় কথা বললেও অর্থমন্ত্রী কৃষিতে ভর্তুকির পরিমাণ কমিয়েছেন, বরাদ্দ করেছেন মাত্র সাত দশমিক পাঁচ ভাগ। টাকার পরিমাণ নিয়েও কথা রয়েছে। কারণ, শুনতে ১৪ হাজার ৪৫৭ কোটি অনেক বেশি মনে হলেও কৃষির পাশাপাশি পাঁচটি মন্ত্রণালয়ের খরচও এর মধ্যেই ধরা হয়েছে। ফলে প্রকৃত কৃষি খাত এককভাবে খুব সামান্য অর্থই পাবে। অর্থমন্ত্রী ১৪ হাজার তিনশ কোটি টাকা কৃষি ঋণ দেয়ার ঘোষণা দিয়ে চমক সৃষ্টি করেছেন সত্য, কিন্তু কৃষকরা সত্যি ঋণ পেতে পারবে- এমন কোনো নিশ্চিত ব্যবস্থার কথা জানাননি। কথা ওঠার কারণ, এই ঋণ দেয়া হবে বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোর মাধ্যমে। আর ব্যাংকে গিয়েই কৃষকরা সাধারণত ভোগান্তির শিকার হয়ে থাকে। মাত্র এক হাজার টাকা ঋণ পেতেও একজন কৃষককে দুই থেকে আড়াইশ' টাকা ঘুষ দিতে হয়। তাছাড়া খুব কম ক্ষেত্রেই কৃষকরা চাষাবাদের জন্য প্রয়োজনীয় সময়ে ঋণের অর্থ পায়। ওদিকে চাষাবাদের যেহেতু নির্ধারিত সময় বা মৌসুম থাকে, কৃষকরা সেহেতু সুদখোর গ্রামীণ মহাজন ও এনজিওদের দ্বারস্থ হতে এবং অনেক উচ্চ হারে সুদ গুণতে বাধ্য হয়। সব মিলিয়ে সরকারের টাকায় কৃষকরা উপকৃত হতে পারে না। এজন্যই অর্থমন্ত্রীর ঘোষণায় আশাবাদের সৃষ্টি হয়নি। তাছাড়া সেচ ব্যবস্থার সংস্কার, গভীর ও অগভীর নলকূপ সরবরাহ ও মেরামতের মতো বিষয়গুলোতেও বাজেটে কোনো বরাদ্দ রাখা হয়নি। লাভজনক মূল্যে কৃষকের কষ্টের ফসল কেনার ব্যাপারেও কোনো অঙ্গিকার নেই বাজেটে। ফলে এই বাজেটের মাধ্যমে কৃষি ও কৃষকের তেমন লাভ হওয়ার সুযোগ নেই। অথচ তৈরি পোশাকসহ রফতানির মাধ্যমে আয় বাড়ানোর প্রচারণা চালানো হলেও জাতীয় অর্থনীতিতে এখনো কৃষিখাতের অবদান সবচেয়ে বেশি। সে খাতটিকেই অবহেলা করেছেন অর্থমন্ত্রী।
অর্থমন্ত্রী বিদ্যুৎ খাতে মোট বরাদ্দ রেখেছেন সাত হাজার ৮৯৬ কোটি টাকা। একই সঙ্গে আবার ছয় হাজার চারশ কোটি টাকা ভর্তুকির কথাও শুনিয়ে রেখেছেন তিনি। লক্ষ্যণীয় বিষয় হলো, পূর্ববর্তী অর্থবছরের তুলনায় এটা পাঁচ হাজার একশ কোটি টাকা বেশি। আর ভর্তুকির বিরাট অংশই যাবে জ্বালানি খাতে। অর্থাৎ আওয়ামী লীগের যারা রেন্টাল ও কুইক রেন্টাল বিদ্যুৎ উৎপাদন কারখানা স্থাপন করেছেন তাদের লাভের পরিমাণ বাড়ানোরই ব্যবস্থা নেয়া হয়েছে। তা সত্ত্বেও অর্থমন্ত্রী কিন্তু আগেই জানিয়ে রেখেছেন, বিদ্যুতই সরকারের ‘সবচেয়ে বড় বিপদ'! আপত্তির কারণ হলো, এমন এক সময়ে অর্থমন্ত্রী নিজেদের ‘সবচেয়ে বড় বিপদের' কথা শুনিয়েছেন এবং বাজেটের পরিকল্পনা সুদূর ২০২১ সাল পর্যন্ত টেনে নিয়ে গেছেন, জনগণ যখন বিদ্যুতের অভাবে ‘সবচেয়ে বড় বিপদের' মধ্যে রয়েছে! প্রতিদিন গড়ে অন্তত ছয় ঘণ্টা, কোথাও কোথাও ১০ ঘণ্টা পর্যন্ত লোডশেডিং করা হচ্ছে। শিল্প-কারখানার উৎপাদন ৬০/৭০ ভাগ পর্যন্ত কমে গেছে। কিন্তু এমন এক কঠিন অবস্থার মধ্যেও অর্থমন্ত্রী শুনিয়েছেন, তারা নাকি তিন হাজার তিনশ মেগাওয়াট বেশি বিদ্যুৎ উৎপাদন করেছেন! প্রশ্ন উঠেছে, এত বিদ্যুৎ যাচ্ছেটা কোথায়? বিদ্যুৎ সংকটের প্রকৃত কারণ হলো দু-চারটি মাত্র নয়, ৩৯টি বিদ্যুৎ কেন্দ্র অচল হয়ে পড়ে আছে। এসবের মধ্যে আওয়ামী রেন্টালওয়ালাদের কুইক রেন্টালেরও আছে ছয়টি। ১৮টি কেন্দ্র মুখ থুবড়ে পড়েছে তেল ও গ্যাসের অভাবে। ফলে বিদ্যুৎ উৎপাদনেও জোয়ার নয় বরং ভাটাই দেখা দিয়েছে। বিদ্যমান সরকারি বিদ্যুৎ কেন্দ্রগুলোর প্রতি চরম অবহেলা দেখিয়ে সরকার কেবল ডিজেল ও ফার্নেস অয়েলভিত্তিক কুইক রেন্টাল কেন্দ্রগুলোকে পৃষ্ঠপোষকতা দিয়েছে বলেই বিদ্যুৎ পরিস্থিতির চরম অবনতি ঘটেছে। এর ফলে ভর্তুকির পরিমাণ বেড়ে চলেছে আর ভর্তুকির নামে আসলে চলছে যথেচ্ছ লুটপাট।
অনুসন্ধানে জানা যাচ্ছে, দুনিয়ার যত পুরনো ও অকেজো ইঞ্জিন ও ঝালাই করা যন্ত্রপাতি দিয়ে কোনোভাবে কুইক রেন্টাল কেন্দ্রগুলো চালু করেছেন আওয়ামী রেন্টালওয়ালারা। এসবের কার্যক্ষমতাও ‘কুইকই'- অতি দ্রুতই কমে আসছে। ফলে এগুলোকে বেশিদিন চালু রাখা যাচ্ছে না। ১৩৩১ মেগাওয়াট ক্ষমতার কুইক রেন্টাল কেন্দ্র থেকে সাম্প্রতিক সময়ে কোনো কোনোদিন বিদ্যুৎ পাওয়া গেছে মাত্র ২৭৮ মেগাওয়াট। আপত্তির কারণ হলো, এই মুহূর্তে দরকার যখন ছিল সংকট সমাধানের বাস্তবসম্মত কোনো উপায় খুঁজে বের করা, সরকার তখন প্রথম থেকেই দাম বাড়ানোর সহজ পথে হাঁটতে শুরু করেছে। এরই ধরাবাহিকতায় মাত্র এক বছরের মধ্যে চতুর্থবারের মতো বিদ্যুতের দাম বাড়িয়েছে সরকার। ফলে মাত্র এক বছরের ব্যবধানেই মানুষকে ১০০ টাকার বিদ্যুৎ কিনতে হচ্ছে ১২৬ টাকায়। ভর্তুকি কমানোর অজুহাতকে সামনে আনা হলেও বাস্তবে জনগণের জন্য নয়, ভর্তুকি গুণতে হচ্ছে আসলে কুইক রেন্টাল কেন্দ্র থেকে বিদ্যুৎ কেনার কারণে। কোনো টেন্ডার না ডেকে এসব কেন্দ্র সরাসরি ক্ষমতাসীন দলের লোকজনদের দেয়া হয়েছে। তারা একদিকে অযৌক্তিক হারে- প্রতি ইউনিটের জন্য ১৪ টাকা হারে দাম আদায় করছে, অন্যদিকে উৎপাদনের জন্য জ্বালানি আমদানির নামে ব্যয় করছে বিপুল বৈদেশিক মুদ্রা। কিন্তু গত অর্থবছরে ২২ হাজার ৫৭১ কোটি টাকা পর্যন্ত ভর্তুকি দেয়ার পরও লোডশেডিং বেড়েই চলেছে।
স্থানীয় সরকার ও পল্লী উন্নয়নের নামে যে সাত দশমিক চার শতাংশ বরাদ্দ রাখা হয়েছে তা নিয়েও কথা উঠেছে। কারণ, এই বরাদ্দের সামান্যই কাজে লাগানা হয়। গত অর্থবছরেও বিভিন্ন প্রকল্প বাস্তবায়নের নামে খয়রাতি চাল, গম ও নগদ অর্থ নিয়ে হরিলুটের পালা দেখা গেছে। উদাহরণ দেয়ার জন্য কিছু তথ্য-পরিসংখ্যানের উল্লেখ করা যায়। প্রকাশিত রিপোর্টের পাশাপাশি পর্যালোচনায় দেখা গেছে, সারা বছর বেকার বসে থাকার পর সংসদে জাতীয় বাজেট পেশ হওয়ার প্রাক্কালে এসে সংশ্লিষ্টজনেরা হঠাৎ তৎপর হয়ে উঠেছিলেন। প্রকল্প বাস্তবায়িত হয়েছে দেখিয়ে মে মাসেই তারা চাল, গমসহ বরাদ্দকৃত অর্থ তুলে নিয়েছেন। দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয়ের ক্ষেত্রে দেখা গেছে, এপ্রিল পর্যন্ত  ২১ হাজার ২৯৩টি প্রকল্পের মধ্যে ১১ মাসে কাজ হয়েছে মাত্র ২০/২৫ শতাংশ। পরের এক মাস মে'তেই ৯০/৯৫ শতাংশ কাজ সম্পন্ন হয়েছে বলে দেখিয়েছেন কর্তাব্যক্তিরা। বরাদ্দের পরিমাণও আবার যেমন-তেমন নয়। কাবিখা'র আওতায় ৭৫ হাজার মেট্রিক টন গম ছাড়াও ছিল ২৭৪ কোটি ৫০ লাখ টাকা, টিআর কর্মসূচিতে ছিল এক লাখ মেট্রিক টন গম ও ২৭৯ কোটি টাকা এবং ভিজিএফ কর্মসূচির আওতায় ছিল সাড়ে পাঁচ লাখ মেট্রিক টন গম। এমনভাবেই ৯০/৯৫ শতাংশ পর্যন্ত বাস্তবায়নের রিপোর্ট হাজির করা হয়েছিল যেন কর্তাব্যক্তিরা আলাদীনের চেরাগ পেয়ে গিয়েছিলেন! না হলে ১১ মাসে যেখানে ২০/২৫ শতাংশের বেশি হয়নি সেখানে মাত্র এক মাসেই প্রায় সম্পূর্ণ প্রকল্প বাস্তবায়িত হলো কিভাবে? আসল রহস্য অবশ্য আড়াল করা যায়নি। টাকা ফেরত চলে গেলে নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিরা এবং ক্ষমতাসীন দলের লোকজন পকেট ভারি করবেন কিভাবে? এজন্যই অর্থ ফেরত দেয়ার পরিবর্তে কাগজেপত্রে প্রকল্পের বাস্তবায়ন ৯৫ শতাংশ পর্যন্ত সম্পন্ন হয়েছে বলে দেখিয়ে হরিলুটের ব্যবস্থা করা হয়েছিল।
উন্নয়ন হচ্ছে বলে গলা ফাটানো হলেও বাস্তবে দেশজুড়ে আসলে কি ঘটছে তারই কিছু চিত্র পাওয়া গেছে এসব তথ্য-পরিসংখ্যানে। মাঠে-ময়দানের বক্তৃতায় উন্নয়নের জোয়ারে ভাসিয়ে দেয়ার গালগল্প শোনানো হলেও বাস্তবে কাজের কাজ যে কিছুই হয়নি তার প্রমাণ তো দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয়ের বাস্তবায়ন চিত্র থেকেই পরিষ্কার হয়েছে। অন্য মন্ত্রণালয়গুলোতেও বিরাট কোনো ‘গড়' ওল্টানোর খবর পাওয়া যায়নি। কথা শুধু এটুকুই নয়। কাজ যা হয়েছে সেগুলোরও ঠিকাদারি পেয়েছে ক্ষমতাসীন দলের লোকজন। তাদের কাজ পাইয়ে দেয়ার জন্য সরকার এমনকি টেন্ডারের আইনেও পরিবর্তন করেছে। আগে দু'লাখ টাকা পর্যন্ত কাজের জন্য টেন্ডার লাগতো না। এখন আট কোটি টাকার কাজও বিনা টেন্ডারেই পাওয়া যাচ্ছে। পাচ্ছেও ক্ষমতাসীন দলের লোকজনই। মূলত এজন্যই মন্ত্রণালয়গুলোর পক্ষে সময় মতো উন্নয়ন কর্মসূচি বাস্তবায়ন করা সম্ভব হয়নি। মাঝখান দিয়ে ‘শ্রাদ্ধ' করা হয়েছে বিপুল পরিমাণ অর্থ ও খাদ্যের। এভাবে চলতে দেয়া হলে দেশে কোনো উন্নয়ন কর্মসূচিরই যে বাস্তবায়ন ঘটবে না সে কথা নিশ্চয়ই বলার অপেক্ষা রাখে না। এবারের বাজেটেও আওয়ামী লীগের কর্মিদের পকেট ভারি করার ব্যবস্থাই করেছেন অর্থমন্ত্রী। অভিজ্ঞতার ভিত্তিতে নিশ্চিতভাবে বলা যায়, পল্লী উন্নয়নের নামে যে বিপুল বরাদ্দ রাখা হয়েছে তার বিরাট অংশই চলে যাবে দলীয় লোকজনের পকেটে।
এভাবে খাত ধরে ধরে পর্যালোচনায় দেখা যাবে, সরকারের এবারের বাজেটও শেষ পর্যন্ত ‘অশ্বডিম্ব'ই প্রসব করবে- যদিও ক্ষমতাসীন দলের লোকজনের পকেট ভারি হবে যথেষ্ট পরিমাণেই। আমরা কিন্তু মনে করি, দেশপ্রেম থাকলে সরকারের উচিত ধার করে এত বেশি ঘি খাওয়ার পরিবর্তে জাতীয় অর্থনীতিকে নিশ্চিত ধ্বংসের মুখ থেকে ফিরিয়ে আনার জন্য সচেষ্ট হয়ে ওঠা। ব্যাংক থেকে বেশি বেশি ঋণ না নিয়ে সরকার যদি রফতানিকারকসহ শিল্পপতি ও ব্যবসায়ীদের জন্য ঋণ পাওয়ার ব্যবস্থা করে তাহলে সংকট কাটিয়ে ওঠা সম্ভব হতে পারে। এজন্য বিশেষ করে গার্মেন্ট শিল্পে গ্যাস ও বিদ্যুৎ সরবরাহ বাড়ানোর এবং সুষ্ঠু বন্দর ব্যবস্থাপনা নিশ্চিত করা দরকার। পাশাপাশি কিভাবে দাতা সংস্থাসহ বিদেশীদের আস্থা ফিরিয়ে আনা যায় সে চেষ্টাও চালানো দরকার।

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন