শনিবার, ১৬ জুন, ২০১২

পোশাক খাত মারাত্মক সংকটে পড়বে



মো. সেলিম আহমেদ ডালিমঃ
রাষ্ট্রের গাফিলতির কারণে ভবিষ্যতে পোশাক খাত মারাত্মক পরিস্থিতির মুখে পড়বে। আর এর মূলে রয়েছে আমেরিকা। মার্কিন রাষ্ট্রদূতের এক বক্তব্যে তা স্পষ্ট হয়ে ওঠেছে। সে বিষয়ে সুনির্দিষ্ট কয়েকটি কারণ অবশ্য তিনি উল্লেখ করেছেন। শ্রমিক নেতা আমিনুল হত্যাকান্ডের ঘটনায় যুক্তরাষ্ট্রের শ্রমিক সংগঠনগুলো সোচ্চার হওয়ায় আমেরিকায় তৈরি পোশাকের যে সুবিধা পাওয়া গিয়েছিল তা এখন নস্যাৎ হতে বসেছে। এ বিষয় নিয়ে মার্কিন কংগ্রেসের অনেক সদস্য পররাষ্ট্রমন্ত্রীর কাছে চিঠি দিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন। মার্কিন সরকার সমর্থিত সলিডারিটি সেন্টার বাংলাদেশের জিএপি সুবিধা বাতিলের আবেদন পর্যন্ত করেছেন। তা বাতিল হলে বাংলাদেশ তৈরি পোশাক খাতে মারাত্মক বিপর্যয় নেমে আসবে বলে এ খাতের সাথে সংশ্লিষ্টরা মনে করেন। বাংলাদেশ এক পোশাক খাত থেকেই বড় কিছু অর্জন করা সম্ভব ছিল। কিন্তু পরিকাঠামোগত দিক নির্ধারণ করতে ব্যর্থ হওয়ায় গার্মেন্টস সেক্টর থেকে যে সুবিধা নেয়ার কথা ছিল তা নিতে পারেনি। গ্যাস ও বিদ্যুৎ সংকট এবং রাজনৈতিক অসহশীলতার কারণে যারা অন্যান্য দেশ থেকে ব্যবসা গুটিয়ে বাংলাদেশে এসেছিল সেই একই সমস্যায় তাদের জর্জরিত হতে হচ্ছে। আমেরিকার বাজারে পোশাক খাত নিয়ে যে সংশয় দেখা যাচ্ছে তা যদি এখন অন্যান্য দেশেও ছড়িয়ে পড়ে তাহলে ভবিষ্যতে এ খাতে অন্ধকার নেমে আসবে। প্রবৃদ্ধির ধারা থমকে যাবে। ইতিমধ্যে আমাদের অন্যান্য খাত থেকে যে বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন করা সম্ভব ছিল তা-ও এখন অর্ধেকে নেমে এসেছে প্রায়। অপরদিকে বাংলাদেশে যে শ্রমিকদের অধিকার যথাযথভাবে সুবিধাজনক অবস্থা নেই সেটাও ফলাও করে প্রকাশ পাবে। তার ফলে যে ক্ষতি হবে সেটা হবে দীর্ঘমেয়াদী। আর সে কারণেই মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে আগামীতে বাংলাদেশ তৈরি পোশাক খাতে সমস্যার সম্মুখীন হতে পারে। বাংলাদেশ-যুক্তরাষ্ট্র বাণিজ্য ও বিনিয়োগ-সহযোগিতা ফোরাম চুক্তি (টিকফা) সম্পাদনে দেরি হয়ায় বাংলাদেশ আন্তর্জাতিক শ্রম-সংক্রান্ত বাধ্যবাধকতা থেকে সরে এসেছে। জীবন যাত্রার সাথে বেতন অবকাঠামো না বাড়ানোর কারণে এবং শ্রমিক আমিনুল হত্যাকান্ডের ঘটনায় এবং অন্যান্য শ্রমিক হয়রানির ঘটনা যুক্তরাষ্ট্র গুরুত্বের সাথে নেয়ায় পরিস্থিতি বাংলাদেশের প্রতিকূলে চলে যাচ্ছে। যুক্তরাষ্ট্রের নেক্রট বাংলাদেশের রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতা বিরাজ করায় বাংলাদেশ থেকে তাদের কার্যক্রম এর আগে গুটিয়ে নিয়েছিল। কিন্তু তারা আবার আমাদের দেশের ক্রেতা হয়ে দেশের পোশাক খাতকে আরো গতিশীল করেছে। বর্তমানে সে পরিস্থিতি থেকে এখন তাদের আবার দূরে সরে যেতে হচ্ছে।
গার্মেন্টস খাতে বাংলাদেশের জন্যে অপার সম্ভাবনা বিরাজ করার কথা। কিন্তু কিছূ অবকাঠামোগত কারণের জন্যে সে খাত থেকে বিপুল পরিমাণ অর্থ অর্জন করা সম্ভবপর হয়ে ওঠছে না। পুরনো রফতানি কারকদের পাশাপাশি নতুন বায়ার দলবেঁধে ছুটে আসছে গার্মেন্টস খাতের দিকে। আর এটা সম্ভব হয়েছে অন্যান্য দেশে রাজনৈতিক পরিস্থিতি স্থিতিশীলতার অভাব থাকার কারণে। আগে বাংলাদেশ থেকে শুধু স্বল্পমূল্যের পোশাক কিনলেও এখন উচ্চমূল্য এবং গুণগত মানের পোশাক ক্রয়ের জন্যে বিশ্বের রফতানিকারকরা আমাদের দিকে ঝুঁকে আসছেন। রফতানিকারকরা তারা দলবেঁধে ছুটে আসায় আমাদের গার্মেন্টস মালিকরা তাদের অর্ডারের বিপরীতে চাহিদা মোতাবেক পোশাক সরবরাহ করতে চরমভাবে হিমশিম খাচ্ছে। অর্ডারের পরিমাণ আগের চেয়ে দ্বিগুণ-তিনগুণ বেড়ে যাওয়ায় কারখানা মালিকদের তাদের প্রতিষ্ঠানের আয়তন বৃদ্ধি করতে হচ্ছে। কিন্তু সে তুলনায় আমাদের গ্যাস ও বিদ্যুৎ সরকার সঠিকভাবে দিতে না পাড়ার কারণে এ খাত নিয়ে এখন সংশয় বিরাজ করছে। ভারত, পাকিস্তান এবং চীন ছাড়াও ইউরোপের বাজার এখন নতুন করে শুরু হয়েছে। বিশ্বজুড়ে মন্দা অবস্থা দেখা দিলে তখন গার্মেন্টস খাত নিয়ে দুশ্চিন্তা বিরাজ করছিল। কিন্তু সে মন্দা কেটে যাওয়ার সাথে সাথে এখন পূর্ণোদ্যমে শুরু হয়েছে গার্মেন্টস খাতের প্রবহমান ধারা। বিশ্বখ্যাত প্রতিষ্ঠানগুলো আমাদের দেশের ক্রেতা হওয়ার কারণে আমাদের সামনে আরো ব্যাপক অর্ডার দিন দিন বৃদ্ধি পাচ্ছে। জার্মানির বিশ্বখ্যাত হুগোবস এবং এ্যাডিস ব্র্যান্ড বাংলাদেশের পোশাক নেয়ার জন্যে কাজ করছে। সাধারণ পোশাক ক্রেতার সাথে সাথে জার্মানির এ্যাডিবায়ার, এস অলিভার, স্পিরিট, আমেরিকার ডি,কে,এন ওয়াই, কোল, জারা, টমিহিল ফিগার আমাদের বাজারকে আরো সমৃদ্ধিশালী করেছে। তাদের মধ্যে এ্যাডিবায়ার শ্রীংলকা থেকে মুখ ফিরিয়ে আমাদের ক্রেতা হয়েছেন। যুক্তরাষ্ট্রের নেক্রট বাংলাদেশ থেকে রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতা থাকার কারণে ব্যবসা গুটিয়ে চলে গিয়েছিল। এখন আবার এ কোম্পানি বাংলাদেশে প্রবেশ করছে। বাংলাদেশের বাজারে এনভয় গ্রুপ রোপ ডেনিম টেক্সটাইল মিল স্থাপন করে বাংলাদেশকে ব্যাপক সম্ভাবনার পথ প্রসারিত করে দিয়েছে। কিন্তু এ খাতে এখন শ্রমিকদের বেতন নিয়ে মালিক পক্ষ যে রকম গাফিলতি করছেন তাতে করে এখন এ খাত বিপর্যয়ের দিকে ধাবিত হচ্ছে। সরকার শ্রমিকদের বেতন কাঠামো নির্ধারণ করে দিলেও অনেক মালিক পক্ষ তা যথাযথভাবে প্রতিপালন না করায় সমস্যা তীব্র আকার ধারণ করছে। দেশ জুড়ে আবার যে রকম অস্থিতিশীল পরিবেশ বিরাজ করছে তাতে করে আমাদের শঙ্কিত না করে পারে না। রাজনীতির এ পরিবেশ গার্মেন্টস খাতের জন্যে অশনি সংকেত। গার্মেন্টস খাত থেকে বড় ধরনের বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন করা সম্ভব হলেও সরকারের দুরদর্শিতার অভাবে তা তিরোহিতই থেকে যাচ্ছে। বিশ্বখ্যাত ভিএফ করপোরেশন প্রেসিন্টে ও প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা ইরিক ওয়াইজম্যান, টেসকোর ক্রিস্টোফি ও ওয়াল মার্টের প্রধান নির্বাহী ডুগম্যাকমিলন বাংলাদেশ সফর করে গেছেন। এক ওয়ালমার্টই প্রায় একশো কোটি টাকার পোশাক ইতিমধ্যে নিয়ে গেছেন। তারা বাংলাদেশ থেকে আরো পোশাক নেয়ার ব্যাপারে দ্বিগুণ-তিনগুণ বৃদ্ধির কথা বলেছেন। এমনকি অন্যান্যদের আগ্রাহও ব্যাপক। কিন্তু তাদের মধ্যে একটা সংশয় রয়েই গেছে। তারা ৩০/৪০ শতাংশ বৃদ্ধি করলে বাংলাদেশ সময়মতো তা সরবরাহ করতে পারবে কিনা তা নিয়ে তাদের মনে একটা সন্দেহ দেখা দিয়েছে। তাছাড়া আমাদের দেশের জন্য ডেনিম পোশাক রফতানি হয়ে থাকে। প্রতি বছর ৩ শত ৫০ কোটি ডলারের ডেনিম পোশাক রফতানি হয় বিদেশে। ডেনিম কারখানায় উৎপাদন করার কারণে বিশ্বের বড় বড় কোম্পানিগুলো এখন বাংলাদেশে ভিড় করছে। অনেক কারখানা ইতিমধ্যে তাদের আয়তন বৃদ্ধি পর্যন্ত করেছেন। বিশ্বের প্রখ্যাত অরবিন্দ বাংলাদেশে তাদের কারখানা স্থাপন করেছেন। অনেক কোম্পানি ইতিমধ্যে তুরস্ক এবং ভিয়েতনামের বাজার ছেড়ে বাংলাদেশে ছুটে এসেছেন। কিন্তু সমস্যার অন্তরালে থেকে যাচ্ছে কয়েকটি প্রয়োজনীয় উপকরণ। বিদ্যুৎ, গ্যাস সংকটে গার্মেন্ট সেক্টরে যে প্রবৃদ্ধি হয়ার কথা তা থেকে কৌশলগত কারণে বাংলাদেশ এগুতে পারছে না। দুরদর্শিতার পরিচয় দিয়ে সরকার পোশাক খাতে যে প্রবৃদ্ধির ধারা প্রবাহিত হচ্ছে তা কিভাবে ধরে রাখা যায় তার যথাযথ ব্যবস্থা গ্রহণ করবে এবং আমেরিকার সাথে যে শ্রমিক আমিনুল হত্যাকান্ড নিয়ে সেখানকার বাজারে যে ঘোলাটে অবস্থা তৈরি হয়েছে তার সমাধানে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় বড় ধরনের ভূমিকা গ্রহণ করে আমাদের পোশাক রক্ষার্থে এগিয়ে আসবে সেটাই কামনা করি।
লেখক: সাংবাদিক ও কলামিস্ট

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন