শনিবার, ১৬ জুন, ২০১২

সরকার চায় না বলেই পুলিশের উন্নতি হয় না



 ড. মুহাম্মদ ইয়াহ্ইয়া আখতার  
একটি দেশ কতটা সভ্য সে বিষয়টি যাচাই করার কতিপয় সাধারণ পরিমাপক আছে। এ রকম দুটি পরিমাপক হল থানা এবং হাসপাতাল। গভীর রাতে সরকারি হাসপাতালে একজন রোগী নিয়ে গেলে যে আচরণ ও সেবা পাওয়া যায়; বা একই সময়ে বিপদে পড়ে পুলিশের শরণাপন্ন হয়ে প্রাপ্ত সহায়তার প্রকৃতি বিচার করে অনুধাবন করা যায় ওই দেশ কতটা সভ্য। সৃষ্টিকর্তার কাছে প্রার্থনা করি, বাংলাদেশ কতটা সভ্য হয়েছে তা যাচাই করতে কোন দেশি-বিদেশি সমাজ গবেষক যেন এ দুই পরিমাপক ব্যবহার না করেন। কারণ, এ দেশের স্বাস্থ্য এবং আইন-শৃংখলা খাতের যে ভয়াবহ পরিস্থিতি তাতে এ দুই পরিমাপকে সভ্যতার মাত্রা যাচাই করলে আমাদের মুখে চুনকালি পড়তে পারে। পাশ্চাত্যের অনেক দেশে স্কুল শিশুদের কাছে স্বপ্নের পুরুষ হিসাবে গণ্য হন দমকল বাহিনী এবং পুলিশ বাহিনীর সদস্যরা। এ দুই বাহিনীর সদস্যরা জীবন বাজি রেখে বিপদাপন্ন মানুষকে সহায়তা করার কারণেই এঁরা স্কুলশিশুদের হূদয়ে স্বপ্নের বীর পুরুষের জায়গাটি দখল করতে পারেন। কিন্তু বাংলাদেশের শিশু-কিশোরদের মধ্যে পুলিশ সম্পর্কে ধারণা একেবারেই বিপরীত। কেবলমাত্র শিশু-কিশোর নয়, দেশের সাধারণ মানুষের পুলিশ সম্পর্কিত ধারণাও অত্যন্ত নেতিবাচক। এরা বিপদাপদে পুলিশকে এড়িয়ে চলতে চান, আবার অনেকে পুলিশকেই বিপদ মনে করেন। নাগরিকদের পুলিশের কাছে যাওয়ার কথা, অথচ তারা হন পুলিশ থেকে বিকর্ষিত; আর ছিনতাইকারি সন্ত্রাসীদের পুলিশ থেকে দূরে থাকার কথা, কিন্তু তারা ধরা পড়লে দ্রুত পুলিশের নিয়ন্ত্রণে যেতে চান। এ রহস্য উন্মোচনে গোয়েন্দা হওয়া লাগে না। 
            পুলিশ হবে জনগণের বন্ধু। তারা নাগরিকদের বিপদাপদে তাদের পাশে দাঁড়াবে, জানমালের নিরাপত্তা দিয়ে নাগরিকদের সমস্যাহন্তার ভূমিকা পালন করে সমাজে সম্মানের আসন করে নেবে এটাই তো স্বাধীন দেশের পুলিশের নিকট থেকে কাম্য। কিন্তু বাংলাদেশে পুলিশ সে ভাবমূর্তি তৈরি করতে পারেনি। পুলিশ জনগণের জানমালের নিরাপত্তা দেয়ার পরিবর্তে তাদের জীবন দুর্বিষহ করে তুলেছে। এর পেছনে একটি কারণই কাজ করেছে। এ কারণটি হল, যখন যে সরকার দেশ পরিচালনা করেছে সে সরকারই পুলিশকে স্বাধীনভাবে কাজ করতে না দিয়ে রাজনৈতিক স্বার্থে ব্যবহার করেছে। এ ব্যাপারে সব রাজনৈতিক দলের আচরণ একই রকম। তবে যতই দিন যাচ্ছে রাজনৈতিক কারণে পুলিশকে ব্যবহারের মাত্রা ততই বৃদ্ধি পাচ্ছে এবং রাজনৈতিক প্রশ্রয় পেয়ে পুলিশও নাগরিকদের প্রতি ততই অমানবিক হয়ে উঠতে পারছে। পুলিশ বাহিনীর সংস্কার ও অপরাধী পুলিশ সদস্যদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি না হওয়ায় মহাজোট আমলে পুলিশের বাড়াবাড়ি চূড়ান্ত পর্যায়ে পৌঁছেছে। পুলিশ এখন জনগণের কাছে বন্ধু হিসাবে বিবেচিত না হয়ে মূর্তিমান আতঙ্ক হিসাবে গণ্য হচ্ছে। এ অবস্থা চলতে থাকলে সামাজিক শান্তি ও স্থিতিশীলতা ভেঙ্গে পড়তে পারে।
পুলিশের অপকর্ম ও বদনাম ছড়িয়ে পড়ায় সাধারণ মানুষ বিপদাপদেও পুলিশকে এড়িয়ে চলছে। সাধারণ মানুষকে দোষ দেয়া যায় না। কারণ, তারা যখন দেখেন, পুলিশ পবিত্র মাজার শরিফের টাকা লুট করে ধরা পড়ে, ঢাকা সিএমএম আদালত প্রাঙ্গণে বিচারপ্রার্থী তরুণীর শ্লীলতাহরণ করে, সাংবাদিকদের পিটিয়ে নির্যাতন করে, ফটো সাংবাদিকদেরকে লাঠিপেটা করে, সভা-সমাবেশ, বিক্ষোভ, হরতাল-মিছিলে রাজনৈতিক নেতা-কর্মীদের লাঠিপেটা করে রাজপথ থেকে বিতাড়িত করে, আন্দোলনকারী বেসরকারি স্কুল শিক্ষকদের পিটিয়ে তাদের ওপর গরম পানি ঢেলে দেয়, রাজনৈতিক নেতার বাসভবনে ঢুকে তার পারিবারিক সদস্যদের লাঠিপেটা করে, বিরোধী দলীয় চিফ হুইপকে পিটিয়ে অর্ধ উলঙ্গ ও আহত করে শাস্তির পরিবর্তে পদোন্নতি পায়, খুলনায় ছাত্রদল নেতাকে ফ্যানে ঝুলিয়ে ও চোখ বেঁধে নির্যাতন করে, প্রথম প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমেদের নাতি পরিচয় পেয়েও নির্দয়ভাবে প্রহার করে, তখন তারা পুলিশকে এড়িয়ে চলতে চান। নাগরিক সমাজ যখন দেখে জোট সরকারামলে দুর্নীতিকারী কিছু চাকরিচ্যুত পুলিশ সদস্যকে মহাজোটামলে নব্য আওয়ামী লীগার সেজে সরকার দলীয় নেতা-এমপির তদবিরে চাকরিতে পুনর্বহাল হয়, একটি বিশেষ জেলার পুলিশ সদস্যরা বিশেষ সুবিধা ভোগ করতে পারে, পুলিশের আট সদস্যের একটি শক্তিশালী সিন্ডিকেট পুলিশের পদায়ন, পদোন্নতি ও বদলি নিয়ন্ত্রণ করে, পেশাদারিত্বের সঙ্গে কাজ করার পরিবর্তে পুলিশ কর্মকর্তাগণ রাজনৈতিক লবিংয়ের দিকে ঝুঁকে পড়ে, চাঁদাবজি বন্ধ করার পরিবর্তে যখন পুলিশ নিজেই চাঁদাবাজি করে, তখন পুলিশ সম্পর্কে এ সমাজের ভাল ধারণা হওয়ার কথা নয়। দেশবাসী পুলিশের অন্যায়-অপরাধের প্রতি রাজনৈতিক নেতৃত্বের রক্তচক্ষু নিক্ষেপিত হতে দেখেন না; পরিবর্তে মাননীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীকে বলতে শোনেন, ‘পুলিশ আগের চেয়ে ভাল হয়েছে’; মাননীয় স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রীকে সাংবাদিকদের নসিহত করতে শোনেন— পুলিশ থেকে নিরাপদ দূরত্বে অবস্থান করার কথা বলে। ক্রসফায়ার প্রসঙ্গে মাননীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী সাংবাদিকদেও প্রশ্ন করে জানতে চান, সন্ত্রাসী ধরতে গেলে তারা যদি পুলিশকে লক্ষ্য করে গুলি ছোঁড়ে তাহলে পুলিশ কি করবে? কিন্তু মাননীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী গভীর রাতের ক্রসফায়ারে সন্ত্রাসীদের ওত পেতে থাকার, গোলাগুলি হবার পর দু-একটি অস্ত্র এবং কিছু গুলির খোসা পড়ে থাকা এবং কেবলমাত্র সন্ত্রাসী নিহত হবার পুরানো গল্পের আসল রহস্য উন্মোচন করেননি। তিনি বলেননি, কেন ক্রসফায়ারগুলো গভীর রাতে নির্জনে অনুষ্ঠিত হয়; কেন অন্ধকারে অনুষ্ঠিত হলেও কোনো ক্রসফায়ারে কোনদিন একজন সন্ত্রাসীও আহত হয় না; এবং কেন ক্রসফায়ারে কেবলমাত্র সন্ত্রাসীরাই নিহত হন। মাননীয় প্রতিমন্ত্রীর সাংবাদিকদের পুলিশ বাহিনী থেকে দূরে থাকতে বলা থেকে পুলিশ সদস্যগণ কি মেসেজ পেলেন তা কি তিনি ভেবে দেখেছেন?
তিনটি পদক্ষেপ নিয়ে পুলিশকে জনগণের বন্ধু, সমস্যাহন্তা ও সেবক রূপে গড়ে তোলা সম্ভব। প্রথমত, পুলিশের জন্য উন্নততর পৃথক বেতন স্কেল দিয়ে ঝুঁকি ভাতাসহ বিভিন্ন রকম সুযোগ-সুবিধা এমনভাবে বাড়িয়ে দিতে হবে যাতে তারা সমাজে সম্মানজনকভাবে বসবাস করতে পারেন। দ্বিতীয়ত, মান্ধাতার আমলের ১৮৬১ সালের পুলিশ আইন পরিবর্তন করে একটি নতুন সময়োপযোগী জনবান্ধব পুলিশ আইন তৈরি করতে হবে; এবং তৃতীয়ত, পুলিশকে রাজনৈতিক কারণে ব্যবহার করা যাবে না; পুলিশকে রাজনৈতিক প্রভাবমুক্ত হয়ে স্বাধীনভাবে কাজ করতে দিতে হবে। তৃতীয় কাজটি করা কঠিন। কারণ, যে দলই সরকারে থাকুক, তারা চায় পুলিশ তাদের হয়ে কাজ করুক। ফলে পুলিশকে সরকারি দলের নেতা-কর্মীদের অপরাধ না দেখার ভান করে বিরোধী দলীয় নেতা-কর্মীদের অপরাধ দমনে মনোযোগী হতে হয়; যে কারণে পুলিশের দুষ্টের দমন ও শিষ্টের পালন করার কাজটি বাধাগ্রস্ত হয়ে পড়ে। কারণ, সন্ত্রাসী বা অপরাধী পাকড়াও করার পর যদি পুলিশকে রাজনৈতিক সুপারিশে ছেড়ে দিতে হয় তাহলে পুলিশের পক্ষে সন্ত্রাস দমন করা সম্ভব হয় না। উল্লিখিত তিনটি কাজের সঙ্গে পুলিশ সম্পর্কে নাগরিক সমাজের সনাতনি নেতিবাচক প্রবণতার বিষয়টিও যোগ করা যায়। এ বিষয়ে তাদের এ মাইন্ডসেটে পরিবর্তন আনা জরুরি। স্বীকার্য, বেশিরভাগ পুলিশ সদস্যই অসত্, কিন্তু খুব কম হলেও পুলিশের মধ্যেও কিছু ভাল লোক আছেন। নাগরিক সমাজ কেবল পুলিশের নিন্দা করতেই পটু, কিন্তু পুলিশের ভাল কাজের প্রশংসায় তাদের কার্পণ্য রয়েছে। যে পুলিশ জীবন বাজি রেখে মাথায় গুলি খেয়ে শীর্ষ জঙ্গি নেতা শায়খ আবদুর রহমান এবং বাংলা ভাইকে গ্রেফতার করলো, নাগরিক সমাজের কেউ কি তাদেরকে একটি ধন্যবাদ দিয়েছিল? সাধারণ মানুষের এ মানসিকতার পরিবর্তন প্রয়োজন।  
রাজনৈতিক প্রশ্রয় না পেলে পুলিশের পক্ষে সন্ত্রাস-চাঁদাবাজি করা সম্ভব হয় না। সন্ধ্যার পর একটি ট্রাককে রাজধানীর এক প্রান্ত দিয়ে প্রবেশ করে অন্য প্রান্ত দিয়ে বের হতে কমপক্ষে ১০-১৫ স্থানে দাঁড়াতে হয়। আর প্রতিবার ট্রাফিক পুলিশ হাত উঁচু করলেই টাকা দিতে হয়। এহেন পুলিশি চাঁদাবাজিতে অতিষ্ঠ হয়ে বাংলাদেশ ট্রাক ও কাভার্ডভ্যান ড্রাইভার্স ইউনিয়নের সাধারণ সম্পাদক মাহমুদুল আলম মন্টু বলেন, ‘পুলিশি চাঁদাবাজির কারণে পরিবহন মালিক-শ্রমিকরা অসহায় হয়ে পড়েছেন। পুলিশ নানা অজুহাতে ট্রাক আটকে অর্থ আদায় করছে। ওভারলোড করে ট্রাক চলাচল করা নিষিদ্ধ হলেও পুলিশ ওইগুলো থেকে টাকা নিয়ে তা ছেড়ে দিচ্ছে। আর ওভারলোড করা না হলে তা আটকে রাখছে, কেন ওভারলোড করা হয়নি এই অজুহাতে।’ এ রকম চাঁদাবাজি বন্ধ করার জন্য তদন্ত কমিশন গঠনের প্রয়োজন নেই। মাননীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী বা মাননীয় স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী বা তাদের প্রতিনিধি যদি ট্রাকের হেলপার সেজে প্রতি মাসে দুই-তিন রাত ট্রাকে উঠে রাজধানী পাড়ি দেন এবং চাঁদাবাজ পুলিশদের পাকড়াও করে কঠোর শাস্তির ব্যবস্থা করেন, তাহলে মাত্র দুই-তিন মাসে এই চাঁদাবাজি বন্ধ করা সম্ভব। কিন্তু রাজনৈতিক সদিচ্ছা না থাকলে এ কাজ করা সম্ভব হবে না। ঘুষ-দুর্নীতি কমাতে ২০০৯ সালের ডিসেম্বরে শুরু করা দুদকের ফাঁদ অভিযান (ট্রাপ অপারেশন) এক বছর চলার পর ২০১০ -এর ডিসেম্বরে পুলিশের উপ-পরিদর্শক একজন এসআইকে ঘুষের টাকাসহ হাতেনাতে পাকড়াও করার পর দুদক ও পুলিশের মধ্যে দূরত্ব সৃষ্টি হওয়ার মধ্য দিয়ে পুলিশি অসহযোগিতার কারণে বন্ধ হয়ে যায়।
আইন-শৃংখলার উন্নতি ঘটাতে প্রতিশ্রুত মহাজোট সরকার ক্ষমতায় এসে পুলিশ বাহিনীর সংস্কারে মনোযোগ না দেয়ায় পুলিশ দুর্নীতি ব্যাপকতা পায় এবং পুলিশে রাজনৈতিক প্রভাব এবং জেলাপ্রীতি বৃদ্ধি পেয়ে পুলিশ প্রশাসনের চেইন অব কমান্ড ভেঙ্গে পড়ে। সরকারের সাড়ে তিন বছর পার হলেও পুলিশের উন্নয়নে কোন গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ গৃহীত হয়নি।  এ কারণে সমপ্রতি পুলিশ অধিক হারে সাংবাদিক নির্যাতন, রাজনৈতিক নেতা-কর্মী প্রহার ও নারীর শ্লীলতাহানির মত ঘটনায় যুক্ত হওয়ায় সরকার দিশেহারা হয়ে তাদের কাউন্সেলিংয়ের ব্যবস্থা করে। কিন্তু একদিকে ১৮৬১ সালের মান্ধাতার আমলের আইন দিয়ে পুলিশ বাহিনী পরিচালিত করে এবং রাজনৈতিক স্বার্থে পুলিশকে ব্যবহারের ধারা অব্যাহত রেখে, অন্যদিকে তাদেরকে কাউন্সেলিং করালে যে ভাল ফল পাওয়া যাবে না তা সরকারও জানে। অবশ্য পূর্ববর্তী জরুরি সরকারের সময় পুলিশ অ্যাক্ট ড্রাফটিং কমিটি দক্ষিণ এশীয় দেশগুলোর চলমান পুলিশ আইন পর্যালোচনা করে বাংলাদেশের জন্য উপযোগী একটি খসড়া পুলিশ অধ্যাদেশ-২০০৭ প্রণয়ন করলেও তা কার্যকরি হতে পারেনি। খসড়া অধ্যাদেশটি পর্যালোচনা করে দেখা যায়, এ অধ্যাদেশে পুলিশকে নিপীড়নকারী ভূমিকা থেকে বের করে একে দায়িত্বশীল, সেবাদানকারী, জনবান্ধব ও রাজনৈতিক প্রভাবমুক্ত পুলিশ বাহিনী হিসাবে গড়ে তুলতে উদ্যোগ নেয়া হয়েছিল। অধ্যাদেশটির চতুর্থ অধ্যায়ে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীকে চেয়ারপার্সন করে ১১ সদস্যবিশিষ্ট জাতীয় পুলিশ কমিশন এবং অষ্টম অধ্যায়ে সুপ্রীম কোর্টের আপিল বিভাগের একজন অবসরপ্রাপ্ত বিচারপতিকে চেয়ারপার্সন করে ৫ সদস্যবিশিষ্ট পুলিশ কমপ্লেইন্টস কমিশন গঠনের সুপারিশ ছিল। জাতীয় পুলিশ কমিশনের চেয়ারপার্সন পদে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীকে রাখার বিষয়টি ‘গণবিরোধী’ হিসাবে সমালোচিত হলেও সব মিলিয়ে এ অধ্যাদেশটি পুলিশকে গণমুখী করার জন্য মন্দ ছিল না। কিন্তু দুঃখের বিষয় ঐ জরুরি  সরকার শতাধিক অধ্যাদেশ পাস করলেও আলোচ্য অধ্যাদেশটি পাস না করেই এর অনির্ধারিত কার্যকাল শেষ করে। 
মহাজোট ক্ষমতায় এসে এত বেশি এজেন্ডা নিয়ে কাজ শুরু করে যে, পুলিশ সংস্কারের মত বিষয়টি এ সরকারের মনোযোগ পায়নি। তবে রাজনৈতিক বিরোধিতা নিয়ন্ত্রণে সরকার পুলিশ বাহিনীকে ব্যাপকভাবে ব্যবহার করেছে এবং এ কাজে পুলিশকে সরকার দলীয় এবং সরকারি দলের অঙ্গ সংগঠনের অ্যাকটিভিস্টরাও সহায়তা করেছে। বাংলাদেশ পুলিশ অধ্যাদেশ-২০০৭ পাস করে পুলিশকে রাজনৈতিক প্রভাবমুক্ত করতে এ সরকারের কোন আগ্রহ আছে বলে প্রতীয়মান হয় না। এ সরকারি মনোভাব অনুধাবন করে পুলিশ বাহিনীর সদস্যরা নাগরিক সমাজের ওপর জুলুম-নিপীড়ন বাড়িয়ে দিয়েছে। পুলিশের নির্যাতনের হাত থেকে রাজনীতিবিদ, এমপি, হুইপ, সাংবাদিক, ছাত্র, এমনকি নারীরাও রেহাই পাচ্ছেন না। পুলিশ অপরাধ করলে তার দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি হচ্ছে না। খুব বড় ধরনের অপরাধ হলে অপরাধী পুলিশ সদস্যকে পুলিশ হেডকোয়ার্টারে ক্লোজ করা হচ্ছে বা সাময়িকভাবে বরখাস্ত করা হচ্ছে। ফলে দেশবাসীর কাছে পুলিশের ভাবমূর্তি যেমন উল্লেখযোগ্য মাত্রায় হ্রাস পেয়েছে, তেমনি মাননীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর গ্রহণযোগ্যতাও হয়েছে প্রশ্নবিদ্ধ। পুলিশ সদস্য কর্তৃক নারীর শ্লীলতাহানির সামপ্রতিক ঘটনায় একজন তরুণ কলামিস্টের ক্ষোভ তার লিখনীতে এভাবে প্রতিফলিত হয়েছে:  ‘টনক নড়বে যেদিন পুলিশ, পুলিশ ক্লাবে মহিলার শ্লীলতাহানি ছেড়ে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীকে নিয়ে টানবে সেদিন। মনে রাখবেন সেদিন আর বেশি দূর নয়’ (ইত্তেফাক: ৩-৬-২০১২)। পুলিশ ও স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের কার্যক্রমে কত বেশি ক্ষুব্ধ হলে একজন তরুণ কলামিস্ট এমন কথা লিখতে পারেন তা অনুমানযোগ্য।   
নাগরিক সমাজ চায় সরকার পুলিশ প্রশাসনে শৃংখলা প্রতিষ্ঠা করে এ বাহিনীর ভাবমূর্তি রক্ষার্থে দ্রুত ব্যবস্থা গ্রহণ করুক। তারা মনে করেন, পুলিশ বাহিনীকে একটি পেশাদার, জনবান্ধব, দায়িত্বশীল পুলিশ বাহিনী হিসাবে গড়ে তোলার জন্য বাংলাদেশ পুলিশ অধ্যাদেশ-২০০৭ প্রয়োজন হলে আরও সময়োপযোগী করে পাস করে পুলিশকে একটি গণতান্ত্রিক দেশের রাজনৈতিক প্রভাবমুক্ত ও সেবাধর্মী পুলিশ বাহিনীতে রূপান্তরিত করতে সরকারের দ্রুত উদ্যোগী হওয়া উচিত। সব শেষে বলা যায়, দলীয় স্বার্থসিদ্ধির উদ্দেশ্যে পুলিশকে ব্যবহারের চিন্তা পরিহার করে সরকার যদি সত্যই পুলিশ বাহিনীর পেশাদারিত্ব ও উন্নতি চায়, তাহলে তা করা সম্ভব। কিন্তু সরকার চায় না বলেই পুলিশের উন্নতি হয় না। সরকার পুলিশের উন্নতি চাইলে ১৮৬১ সালের আইন দিয়ে পুলিশ পরিচালিত হয় কিভাবে?  
nলেখক: অধ্যাপক, রাজনীতিবিজ্ঞান বিভাগ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়।
 akhtermy@gmail.com

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন