বৃহস্পতিবার, ৭ জুন, ২০১২

সুশাসনের জন্য প্রয়োজন সহনশীলতা

প্রফেসর আবুল ফজল হক


“শেখ হাসিনাকে তাই জোড় হাতে বলি, জেদ নয় ধৈর্য ও প্রজ্ঞার পরিচয় দিন। রাজা ক্যানিউটের মতো চাটুকার সভাসদদের কবল থেকে নিজেকে মুক্ত করুন। বোকা মিত্রের চাইতে বুদ্ধিমান শত্রুকে গুরুত্ব দিন। মন্ত্রিসভায় যেসব বেকুব সদস্য আছে, তাদের কম কথা বলতে বলুন, অথবা অপসারণ করুন। সমুদ্র জয়ের চাইতে দেশের মানুষের মন জয়ের ওপর গুরুত্ব দিন। ছাত্রলীগ, যুবলীগের দ্বারা ঘন ঘন সংবর্ধনা নেয়া বন্ধ করুন। অন্য সব কিছুর আগে বিদ্যুত, পানি, গ্যাসের সঙ্কট হ্রাস, সড়ক দুর্ঘটনায় নিত্য প্রাণ বলির সংখ্যা কমানোকে প্রায়োরিটি দিন।”

ওপরের উদ্ধৃতিটি প্রথিতযশা সাংবাদিক-কলামিস্ট আবদুল গাফ্ফার চৌধুরীর কলাম (জনকণ্ঠ, ৩০-৫-১২) থেকে নেয়া। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র হিসাবে আমরা ছিলাম তাঁর সমসাময়িক। দু’জনেই ছিলাম একই ছাত্র সংগঠনের সদস্য। অনেক দিন হলো দেখা-সাক্ষাত নেই। তবে আমি তাঁর লেখার নিয়মিত পাঠক। দেশের এ দুঃসময়ে তাঁর খোলামেলা উচ্চারণের জন্য তাঁকে আন্তরিক ধন্যবাদ জানাই। আমার বর্তমান লেখাটি তাঁর সঙ্গে একাত্মতা প্রকাশের সামান্য প্রয়াস।
রাজনীতির বাজারে একটা কথা চালু আছেÑ আওয়ামী লীগ সবার সমর্থন চায়, পরামর্শ চায় না। গাফ্ফার চৌধুরী লিখেছেন, “আমরা আওয়ামী লীগকে কেবল বলতে পারি। তারা শুনবে কি না, সতর্ক হবে কি না সেটা তাদের ব্যাপার। তবে দেশ ভয়ঙ্কর পরিস্থিতির মধ্য দিয়ে এগুচ্ছে।” তিনি আর লিখেছেন, “প্রধানমন্ত্রী যতই অভিজ্ঞ ও দক্ষ হোন, আনাড়ি মন্ত্রী নিয়ে দেশকে সুশাসন উপহার দিতে পারবেন না। এর প্রমাণ প্রধানমন্ত্রী যথেষ্ট পেয়েছেন। তবুও তিনি কি কেবল জেদের বশে মন্ত্রিসভা রদবদল করা থেকে বিরত রয়েছেন?” এ প্রসঙ্গে প্রধানমন্ত্রী হিসেবে শেখ হাসিনার প্রথম মেয়াদ ও বর্তমান মেয়াদের চিন্তা-ভাবনা ও কর্মকৌশলের তুলনা করা যেতে পারে। একটি ছোট্ট উদাহরণÑ ১৯৯৬ সালে মন্ত্রিসভা গঠনের অল্পদিনের মধ্যে রাজশাহী বঙ্গবন্ধু পরিষদের পক্ষ থেকে তৎকালীন সভাপতি প্রফেসর আবদুল খালেক (পরে ভিসি, রা.বি.) ও আমি (সাধারণ সম্পাদক) প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে দেখা করতে গিয়েছিলাম। ওই মন্ত্রিসভায় বৃহত্তর রাজশাহী অঞ্চল থেকে কোন মন্ত্রী নেয়া হয়নি। রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় ও স্থানীয় সুধী সমাজের আশা-আকাক্সক্ষা অনুযায়ী আমরা প্রধানমন্ত্রীকে অনুরোধ করেছিলাম খাইরুজ্জামান লিটনকে (বর্তমান রাজশাহীর সিটি মেয়র) মন্ত্রিসভায় গ্রহণ করতে। তিনি আমাদের অনুরোধ রাখেননি। তাঁর যুক্তি ছিল, সাধারণ নির্বাচনে পরাজিত কোন ব্যক্তিকে মন্ত্রিসভায় ঠাঁই দেয়া ঠিক হবে না। তাঁর এই নীতিগত সিদ্ধান্ত আমরা হৃষ্ট চিত্তে মেনে নিয়েছিলাম। সম্ভবত ১৯৯৮ সালে তিনি নির্বাচনে পরাজিত দু’জন আওয়ামী লীগ সিনিয়র নেতাকে মন্ত্রী বানিয়েছিলেন। প্রধানমন্ত্রীর এই সিদ্ধান্তকেও আমরা স্বাগত জানিয়েছি। কারণ, তৎকালীন বাস্তবতায় সুশাসনের স্বার্থে দলের দক্ষ ও অভিজ্ঞ ব্যক্তিদের মন্ত্রিসভায় অন্তর্ভুক্তি প্রয়োজন ছিল। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার এই নমনীয়তার নীতি তাঁর প্রথম মেয়াদের সাফল্যের অন্যতম কারণ হতে পারে।
কিন্তু এবারের চিত্রটা ভিন্ন, একেবারে শুরু থেকেই। মন্ত্রিসভায় নতুন নতুন মুখের ভিড়। আওয়ামী লীগ ও মহাজোটের সুপরিচিত অভিজ্ঞ নেতাদের অনেকে সেখানে অনুপস্থিত। সম্ভবত, মন্ত্রীদের অনভিজ্ঞতার ক্ষতিপূরণে আধ ডজনের বেশি অনির্বাচিত ব্যক্তিকে মন্ত্রীর পদমর্যাদায় উপদেষ্টা নিয়োগ দেয়া হয়। সুশাসন ও উন্নয়নে তাঁদের অবদান তেমন চোখে পড়ার মতো নয়। বরং কোন কোন ক্ষেত্রে কারও কারও অতিকথন বা অতিতৎপরতা জনমনে বিরূপ প্রতিক্রিয়ার জন্ম দেয়। কিন্তু তাঁরা সবাই বহাল তবিয়তে আছেন। মন্ত্রীরাও তথৈবচ। প্রধানমন্ত্রী কি এখনও মনে করেন, তাঁর সকল মন্ত্রী যথেষ্ট দক্ষতা ও সততার সঙ্গে তাঁদের দায়িত্ব পালন করছেন?
বছরখানেক আগে সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত বলেছিলেন, “বাঘে ধরলে বাঘে ছাড়ে, শেখ হাসিনা ধরলে ছাড়ে না। হ্যাঁ, শেখ হাসিনা যেমন সাহসী তেমনি জেদী। তাঁর অদম্য সাহস ও জেদই তাঁকে অন্যতম ‘আয়রন লেডি’ হিসেবে পরিচিতি দিয়েছে। এই কারণেই তিনি এক-এগারো-এর কুশীলবদের ভ্রুকুটি অগ্রাহ্য করে মহাসমারোহে দেশে ফিরতে পেরেছিলেন। নবম সংসদ নির্বাচনে তাঁর অসাধারণ বিজয়ের ভিত্ত বোধ হয় সেদিনই রচিত হয়েছিল। কিন্তু সব সময় বা সবার সঙ্গে জেদ সফল নাও হতে পারে। ‘এক-এগারো’-এর ডামাডোলে আওয়ামী লীগের কিছু প্রবীণ নেতা দলীয় নেত্রীর পাশে না দাঁড়িয়ে তাঁকে ‘সাইজ’ করতে চেয়েছিলেন। কিন্তু শেখ হাসিনার ব্যক্তি ইমেজ ও ব্যাপক জনপ্রিয়তার কারণে তাঁরা নিজেরাই ‘সাইজ’ হয়ে যান। শেখ হাসিনা তাঁর বিরুদ্ধবাদীদের ক্ষমা করে দেন, কিন্তু তাঁদের বিরুদ্ধাচরণ ভুলতে পারেননি বোধ হয়। তিনি তাঁদের প্রায় সবাইকে নবম সংসদ নির্বাচনে প্রার্থী হিসেবে মনোনয়ন দেন, দলীয় সংহতি রক্ষা পায়। কিন্তু তাঁদের কাউকে দলীয় নেতৃত্ব বা সরকারে পুনর্বাসিত করেননি। সরকারের সাড়ে তিন বছর পার হয়ে গেছে। তাঁরা ইতোমধ্যে দলের প্রতি, নেত্রীর প্রতি আনুগত্যের যথেষ্ট প্রমাণ রেখেছেন বলে প্রতীয়মান হয়। দেশে বিদ্যমান আর্থ-সামাজিক-রাজনৈতিক সঙ্কটকালে সুশাসন ও উন্নয়নের স্বার্থে দল ও জোটের মেধাবী সংসদ সদস্যদের অন্তর্ভুক্ত করে মন্ত্রিসভার পুনর্গঠন জরুরী হয়ে দাঁড়িয়েছে। দেশের মানুষ ভালো আছে বলে আত্মতুষ্টির অবকাশ নেই। সাধারণ মানুষের আয় বেড়েছে এটা ঠিক, কিন্তু জীবনযাত্রার ব্যয় বেড়েছে তুলনামূলকভাবে বেশি। ‘শেখ হাসিনা ধরলে ছাড়ে না’, সুরঞ্জিত সেনগুপ্তের এই কথা কি সর্বৈব সত্য? সুরঞ্জিত বাবু ও ওবায়দুল কাদেরকেও তো ধরেছিলেন নেত্রী। সম্প্রতি তাঁদের ছেড়ে দিয়েছেন। দু‘জনকেই মন্ত্রী বানিয়েছেন। রেল মন্ত্রণালয়ের কর্মচারী নিয়োগ নিয়ে দুর্নীতির অভিযোগ উঠলে স্বেচ্ছায় পদত্যাগ করে সুরঞ্জিত বাবু এদেশে নজির সৃষ্টি করেছিলেন। এখন তিনি দপ্তরবিহীন মন্ত্রী। এটাকি ভাল নজির? 
আরেক মন্ত্রী সৈয়দ আবুল হোসেন। আওয়ামী লীগের নেতা হিসেবে প্রায় অচেনা। তাঁকে দেয়া হয় রেল ও সড়ক বিভাগের সমন্বয়ে গঠিত বিরাট যোগাযোগ মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব। গত নির্বাচনে আওয়ামী লীগের প্রধান প্রতিশ্রুতি ছিল পদ্মা সেতু নির্মাণ। সব চাইতে ব্যয়বহুল এই নির্মাণ প্রকল্পের টেন্ডার প্রক্রিয়ায় মন্ত্রীকে জড়িয়ে দুর্নীতির অভিযোগ তোলে স্বয়ং বিশ্বব্যাংক, যারা এই প্রকল্প ব্যয়ের সিংহভাগ জোগান দেয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল। সরকারের দাবি এখানে কোন দুর্নীতি হয়নি। তাই সৈয়দ আবুল হোসেনকে যোগাযোগ মন্ত্রণালয় থেকে সরিয়ে নব সৃষ্ট একটি ছোট মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব দেয়া হলো? এর পরও কিন্তু বিশ্বব্যাংক প্রতিশ্রুত অর্থ ছাড় করেনি। দেশের স্বার্থে সৈয়দ আবুল হোসেনকে ‘স্যাক্রিফাইস’ করা কি খুবই কঠিন ছিল? পদ্মা সেতু প্রকল্পের জন্য বিকল্প তহবিল সংগ্রহের প্রাণপণ চেষ্টা করছে সরকার। বিশ্বব্যাংকের থাবা থেকে বেরিয়ে আসার এ প্রচেষ্টা একটি সাহসী পদক্ষেপ বটে। কিন্তু আমরা কি বিশ্বব্যাংকের মুরব্বিদের কূটকৌশল মোকাবিলা করার মতো শক্তি অর্জন করতে পেরেছি? এ ক্ষেত্রে সাফল্যের ওপর হাসিনা সরকারের ভবিষ্যত অনেকাংশে নির্ভর করবে।
প্রধানমন্ত্রী মহাজোটের শরিক দল জাতীয় পার্টি ও সাম্যবাদী দল থেকে একজন করে মন্ত্রী নিয়েছেন তাঁর বর্তমান মন্ত্রিসভায়। জাতীয় পার্টি কতদিন মহাজোটে থাকবে তার কোন ঠিক নেই। জেনারেল এরশাদ তো একাধিক বার ঘোষণা দিয়েছেন আগামী নির্বাচনে তাঁর দল পৃথকভাবে লড়বে বলে। তবে ১৪ দল একটি আদর্শভিত্তিক জোট। যুদ্ধাপরাধের বিচার ও ধর্মীয় সাম্প্রদায়িকতার বিরুদ্ধে লড়াই এই মুহূর্তে ১৪ দলীয় জোটের প্রধান এজেন্ডা। এ জন্য ১৪ দলের ঐক্য অটুট রাখা প্রয়োজন। কিন্তু এ জোটের অন্তর্ভুক্ত ছোট দলগুলো আওয়ামী লীগের ‘একলা চলো’ নীতির জন্য ক্ষুব্ধ। তারা অবহেলিত বোধ করে। ইতোমধ্যে সরকারের ব্যর্থতার অংশীদার হবে না বলে জানান দিয়েছে তারা। কেউ যদি মনে করেন, নিজ গরজেই তারা আগামী নির্বাচনে মহাজোটে থাকবে তাহলে বোধ হয় ভুল হবে। মহাজোটের নেতৃত্ব দানকারী আওয়ামী লীগকেই উদ্যোগ নিতে হবে জোটকে আরও সক্রিয় ও গতিশীল করার। ১৪ দলের অন্তর্ভুক্ত গুরুত্বপূর্ণ দুই দল জাসদ ও ওয়ার্কার্স পার্টির দুই ঝানু ও সুপরিচিত নেতাকে মন্ত্রিসভায় নিলে কি সরকার ও জোট অধিক শক্তিশালী হয় না? ছোট দলগুলোর ভোটের ঝুলি ছোট হলেও তাদের দক্ষ কর্মীবাহিনী আগামী নির্বাচনে ‘ওয়ার্কিং’ ফোর্স’ হিসেবে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখতে পারে।
জাতীয় পার্টি ও জোটভুক্ত দলগুলো যেমন সরকারের সমালোচনা করছে, অনেক আওয়ামী লীগ নেতা, কর্মী, সমর্থক ও সুহৃদও করছেন এবং সরকারকে ঠিক পথে চালানোর উদ্দেশ্যেই তা করা হচ্ছে। আসলে সমালোচনা শোনা ও তা বোঝার মানসিকতা থাকতে হবে নেতৃত্বের। এ মুহূর্তে জেদ নয়, ধৈর্য ও সহনশীলতা অত্যাবশ্যক।

লেখক : শিক্ষাবিদ ও গবেষক

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন