সৈয়দ আবদাল আহমদ
নতুন বাজেট ঘোষণা হয়েছে গতকাল। তবে বাজেটে নতুন আশার আলো নেই। বাজেট নিয়ে সাধারণ মানুষের একটি ধারণা হচ্ছে—দাম বাড়বে। নুতন বাজেটও এ শঙ্কার কথাই জানান দিয়েছে। ‘মরার উপর খাঁড়ার ঘা’ কোথায় কোথায় পড়বে সাধারণ মানুষ খুঁটে খুঁটে সেটাই দেখছে। নতুন বাজেটে যেখানে বড় শঙ্কা, সেটা হচ্ছে ৩৭টি পণ্যের দাম বাড়বে।
অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত গতকাল জাতীয় সংসদে ১ লাখ ৯১ হাজার ৭৩৮ কোটি টাকার বাজেট পেশ করেন। এর মধ্যে বাজেটে ৫২ হাজার ৬৮ কোটি টাকাই ঘাটতি দেখানো হয়েছে। এই ঘাটতি জিডিপির ৫ শতাংশ। ব্যাংক ঋণ ও বৈদেশিক অনুদান থেকে ঘাটতি মেটানোর কথা বলা হয়েছে। ব্যাংক ব্যবস্থা থেকে ঋণ নেয়া হবে ২৩ হাজার কোটি টাকা। বিদ্যুত্, সড়ক যোগাযোগ, বন্দর, ভৌত কাঠমো, কৃষি, মানবসম্পদ উন্নয়ন এবং সামাজিক নিরাপত্তা খাতকে অগ্রাধিকার দেয়ার কথা বলা হলেও এ থেকে কী সুবিধা কীভাবে আসবে, সে সম্পর্কে অর্থমন্ত্রীর বক্তব্যে কোনো ব্যাখ্যা নেই।
অর্থমন্ত্রী মূল্যস্ফীতি আগামীতে ৭ দশমিক ৫ শতাংশে নামিয়ে আনার কথা বলেছেন। কিন্তু এই মূল্যস্ফীতি তার দেয়া বর্তমান ১০ দশমিক ৮ শতাংশ মূল্যস্ফীতির সংখ্যা থেকে কিভাবে নামিয়ে আনা হবে, সে টার্গেট নেই। অর্থমন্ত্রীর বক্তব্যেই বার বার উচ্চারিত হয়েছে অর্থনীতি সম্পূর্ণ নিম্নমুখী। অর্থনীতিবিদরা বাজেট প্রাথমিকভাবে পর্যালোচনা করে বলেছেন, নতুন অর্থবছরটিতে অর্থনীতি এক বিপর্যয়কর অবস্থার সৃষ্টি করবে। দ্রব্যমূল্য সমস্যার সমাধানে কী ব্যবস্থা নেয়া হয়েছে, সরকারের কোনো দিকনির্দেশনা নেই। বিদ্যুত্-পানি-গ্যাসের দাম বাজেটের আগেও দফায় দফায় বাড়ানো হয়েছে, বাজেটের পরেও বাড়ার লক্ষণই অর্থমন্ত্রীর বক্তব্যে স্পষ্ট। সাধারণ মানুষের দুর্বিষহ অবস্থা যে কোনোভাবেই কাটছে না, সে কথাই নতুন বাজেট থেকে উচ্চারিত হয়েছে। গরিব মানুষকে কী কী সুবিধা দেয়া হবে, সে ব্যাপারে কোনো আশার আলো শোনানো হয়নি। প্রধান বিরোধী দল বিএনপির একটি উচ্চপর্যায়ের প্যানেল টেলিভিশনে অর্থমন্ত্রীর বাজেট উপস্থাপনা পর্যবেক্ষণ করে এ বাজেটকে এরই মধ্যে একটি অন্তঃসারশূন্য গণবিরোধী বাজেট হিসেবে উল্লেখ করেছে। প্যানেল বলেছে, অর্থমন্ত্রীর বক্তব্যে সরকারের দেউলিয়াপনাই প্রকাশ পেয়েছে—অর্থায়ন নেই, বিনিয়োগ নেই। অর্থনীতির সব সূচক নিম্নগামী। তাদের মতে, বাজেট বাস্তবায়ন করার মতো প্রশাসনিক সক্ষমতা এ সরকারের নেই। অর্থমন্ত্রী বলেছেন, এটি মহাজোট সরকারের সর্বশেষ পূর্ণাঙ্গ বাজেট। এই বাজেটে রাজনৈতিক ও নির্বাচনী দৃষ্টিভঙ্গি তুলে ধরা হয়েছে। তবে সাধারণ মানুষের বাজেট থেকে উপকৃত হওয়ার কোনো সুনির্দিষ্ট উচ্চারণ বাজেটে নেই, বরং করের আওতা ব্যাপক হারে বাড়ানোর কথাই বার বার উচ্চারিত হয়েছে। প্রবৃদ্ধির লক্ষ্যমাত্রা ৭.২ শতাংশ নির্ধারণ করার কথা বলা হলেও চলতি অর্থবছরে জিডিপি প্রবৃদ্ধি গত অর্থবছরের চেয়ে কমেছে। বিদ্যুত্ খাতে বরাদ্দ বাড়ানোর কথা অর্থমন্ত্রী বলেছেন, তবে লোডশেডিংয়ের যন্ত্রণা থেকে সাধারণ মানুষ বাঁচতে পাবে কি না—এ ধরনের আশাব্যঞ্জক কোনো কথা অর্থমন্ত্রী শোনাননি; বরং বলেছেন লোডশেডিং এখনও দুর্বিষহ অবস্থায় রয়েছে।
নতুন বাজেটে সুসংবাদ আছে নুতন ধান উত্পাদনে। আর আছে মানুষের আয়ু বৃদ্ধিতে। বন্যা, লবণাক্ততা ও খরাপ্রবণ এলাকায় ধানের আবাদ সম্প্রসারণ হয়েছে এবং নতুন জাতের ধান উদ্ভাবন করা হয়েছে। লবণাক্তসহিষ্ণু বিনা-৮ এবং ব্রি ধান-৪৭ আবাদ করা হচ্ছে। পাশাপাশি লবণাক্তপ্রবণ এলাকার জন্য ব্রি ধান-৫৩, ৫৪ ও বন্যাপ্রবণ এলাকার জন্য ব্রি-৫১ ও ৫২ জাতের ধান উদ্ভাবন করা হয়েছে। এগুলোর পাইলটিং কার্যক্রম চলছে এবং শিগগিরই আবাদ কার্যক্রম শুরু হবে। একই সঙ্গে আফ্রিকা থেকে খরাসহিষ্ণু নারিকা ধানের জাত সংগ্রহ করা হয়েছে। উত্তরবঙ্গের মঙ্গাপীড়িত অঞ্চলে বীনা-৭ ধান চাষের মাধ্যমে মঙ্গা দূর করার কথা বলা হয়েছে। এটা নিঃসন্দেহে সাধারণ কৃষকের জন্য আশার খবর।
বাংলাদেশের মানুষ যে কারণে দীর্ঘায়ূ হচ্ছে
আরেকটি আশার খবর হচ্ছে, বাংলাদেশের মানুষের আয়ু বাড়ছে। পুরুষের চেয়ে মহিলার আয়ু আরও বেশি বেড়েছে। শিশুমৃত্যু ও মাতৃমৃত্যুর হার কমেছে।
নতুন বাজেটের তথ্য পর্যালোচনা করে দেখা গেছে, মানুষের আয়ু অর্থাত্ জীবনকাল বাড়ছে। গত ৬২ বছরে বাংলাদেশের মানুষের গড় আয়ু প্রায় ৩৩.০৬ বছর বেড়ে গেছে। ১৯৫০ সালে মানুষের গড় আয়ু যেখানে ছিল ৩৭ বছর, সেখানে বর্তমানে ২০১২ সালে গড় আয়ু বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৭০.০৬ বছরে। আরও চমকপ্রদ তথ্য হচ্ছে, বাংলাদেশের মানুষের গড় আয়ু বিশ্ব গড় আয়ুর চেয়ে বেশি। সারাবিশ্বের ৭০০ কোটি মানুষের গড় আয়ু বর্তমানে ৬৭.২ বছর। গড় আয়ু নিয়ে ওয়ার্ল্ড ফ্যাক্ট বুক ২০১২ সমীক্ষায় এ তথ্য উল্লেখ করা হয়েছে। এদিকে বৃহস্পতিবার ২০১২ সালের বাজেট পেশকালে যে অর্থনৈতিক সমীক্ষা ২০১২ প্রকাশ করা হয়, তাতে উল্লেখ করা হয়—২০০৯ সালে বাংলাদেশে মানুষের প্রত্যাশিত গড় আয়ুষ্কাল ৬৭.৪ বছর। এর মধ্যে পুরুষের গড় আয়ু ৬৬.১ এবং মহিলার ৬৮.৭ বছর। অর্থাত্ বাংলাদেশের পুুরুষের চেয়ে মহিলার গড় আয়ু বেশি। ওয়ার্ল্ড ফ্যাক্ট বুক ২০১২-এর সমীক্ষায়ও বলা হয়, বাংলাদেশী পুরুষের চেয়ে মহিলার আয়ু বেশি।
বাংলাদেশের মানুষের আয়ু বাড়ার কারণ কী? বিশেষজ্ঞরা বলেন, দারিদ্র্য, ব্যাধি, অপুষ্টি ও চিকিত্সার অভাবে চল্লিশ-পঞ্চাশের দশকে এদেশে শিশু ও প্রসূতি মৃত্যু ছিল অস্বাভাবিক। অন্যদিকে ছিল উচ্চজন্মহার। বর্তমানে শিশু ও প্রসূতি মৃত্যু যেমন কমেছে, তেমনি কমে এসেছে জন্মহার। আর তাই বাড়ছে প্রত্যাশিত আয়ুষ্কাল। বিশেষজ্ঞরা বলেন, শিল্পবিপ্লবের সঙ্গে সঙ্গে পৃথিবীতে মৃত্যুহার কমতে শুরু করে। প্রথমে জন্ম ও মৃত্যুহার দুটোই ছিল বেশি। দ্বিতীয় পর্যায়ে মৃত্যুহার কমেছে; কিন্তু জন্মহার বেশিই ছিল। তৃতীয় পর্যায়ে পৃথিবীর দেশগুলোতে জন্ম এবং মৃত্যুহার দুটোই কমেছে। জনসাধারণের স্বাস্থ্যের ব্যাপারে নিত্য সজাগ দৃষ্টি, বিশ্বস্বাস্থ্য সংস্থার কার্যক্রম, বিশ্ব শিশু তহবিল (ইউনিসেফ) প্রতিষ্ঠা, ব্যাপক রোগ প্রতিষেধক ও মহামারী নিরোধক ব্যবস্থা আবিষ্কারের ফলে অবস্থার উন্নতি হয়। বাংলাদেশও এর আওতার বাইরে ছিল না। রোগ প্রতিষেধক ও মহামারী নিরোধক ব্যবস্থা এদেশে মৃত্যুহার শিল্পবিপ্লব-পূর্ব সময়ের তুলনায় দুই-তৃতীয়াংশ কমিয়ে দিয়েছে। শিশু মৃত্যুর হারও হ্রাস পেয়েছে।
এমন সময় গেছে, যখন বাংলাদেশে প্রসূতি মৃত্যুর হার ছিল অস্বাভাবিক। সন্তান জন্মের সময় অবৈজ্ঞানিক পদ্ধতিতে শিশুদের নাড়ি কাটা হতো। এতে মা এবং শিশু উভয়ই মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়ত। কিন্তু মৃত্যুর এ কারণ ছাড়াও ছিল রোগব্যাধি এবং অপুষ্টি। ১৯৬০ সালে প্রতি হাজারে ১৫১ শিশু মারা যেত। ২০১০ সালে শিশু মৃত্যুর হার নেমে পড়ে ৩৬ জনে (অর্থনৈতিক সমীক্ষা ২০১২)। ১৯৬২-৬৫ সালে জন্মহার ছিল হাজারে ৫১.৩, ১৯৭৩ সালে ৫০, ২০০২ সালে ২০.২১ আর ২০১০ সালে ১৯.২। তেমনি ১৯৫০ সালে গড় আয়ু ছিল ৩৭ বছর। এখন সেটা ৭০.০২ বছর।
কলেরা, গুটিবসন্ত, কালাজ্বর এবং ম্যালেরিয়ার মহামারী এখন আর নেই। গুটিবসন্ত এদেশ থেকে একেবারে নির্মূল হয়ে গেছে। কালাজ্বর নেই। ম্যালেরিয়া এখন শুধু পার্বত্য চট্টগ্রাম, সিলেট ও ময়মনসিংহের পহাড়ি অঞ্চলে সীমিত পরিসরে রয়েছে। কলেরা নেই। ডায়রিয়ার প্রকোপও নিয়ন্ত্রণে চলে এসেছে। বিশুদ্ধ পানি এবং স্যানিটেশন ব্যবস্থার উন্নতি হচ্ছে। অন্যদিকে অপুষ্টি সমস্যার উন্নতি ঘটছে। মানুষের ক্যালরি গ্রহণের পরিমাণও বাড়ছে।
মানুষের গড় আয়ু শুধু বাংলাদেশেরই নয়, পৃথিবীব্যাপীই বাড়ছে। ওয়ার্ল্ড ফ্যাক্ট বুক-২০১২ জরিপ অনুযায়ী মানুষের গড় আয়ু শিল্পোন্নত দেশগুলোয় সবচেয়ে বেশি। সবচেয়ে কম আফ্রিকার উপ-সাহারা অঞ্চলগুলোতে। এইডস রোগ মহামারী আকারে থাকার কারণে সেখানে গড় আয়ু সবচেয়ে কম। শিল্পোন্নত দেশগুলোর পর গড় আয়ু বেশি পূর্ব এশিয়া ও প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চল, লাতিন আমেরিকা ও ক্যারিবীয় অঞ্চল এবং সিইই-সিআইএস ও বাল্টিক রাষ্ট্রগুলোয়। অঞ্চল ভিত্তিতে উত্তর আমেরিকায় গড় আয়ু ৭৭.৬ বছর, ওশেনিয়া অঞ্চলে ৭৪.৬ বছর, ইউরোপ অঞ্চলের দেশগুলোতে ৭৪.৩ বছর, লাতিন আমেরিকা ও ক্যারিবীয় অঞ্চলে ৭১.৮ বছর, এশিয়া অঞ্চলের দেশগুলোতে ৬৭.৭ বছর এবং আফ্রিকায় ৫০.৬ বছর। দক্ষিণ এশিয়ার ৮টি দেশের মানুষের গড় আয়ু ৬৬.৪ বছর। ওয়ার্ল্ড ফ্যাক্ট বুক-২০১২ সমীক্ষার তথ্য অনুযায়ী বিশ্বের মানুষের গড় আয়ু ৬৭.২ বছর। বিশ্বের ২২২টি দেশের মধ্যে মানুষের গড় আয়ু সবচেয়ে বেশি মোনাকোর। মোনাকোর মানুষ গড়ে ৮৯.৭৩ বছর বাঁচেন। গড় আয়ু সবচেয়ে কম অ্যাঙ্গোলায় ৩৮.৮ বছর। সবচেয়ে বেশি গড় আয়ুর দেশের মধ্যে দ্বিতীয় অবস্থানে রয়েছে ম্যাকাও ৮৪.৪১ বছর। জাপানের মানুষের গড় আয়ু ৮২.২৫, সিঙ্গাপুর ৮২.১৪, হংকং ৮২.০৪, অস্ট্রেলিয়া ৮১.৮১, কানাডা ৮১.৩৮, ফ্রান্স ৮১.১৯, সুইজারল্যান্ড ৮১.০৭, ইসরাইল ৮০.৯৬, নিউজিল্যান্ড ৮০.৫৯, জার্মানি ৮০.০৭, যুক্তরাজ্য ৮০.০৫, জর্ডান ৮০.০৫, বেলজিয়াম ৭৯.৫১, ফিনল্যান্ড ৭৯.২৭, দক্ষিণ কোরিয়া ৭৯.০৫, ডেনমার্ক ৭৮.৬৩, যুক্তরাষ্ট্র ৭৮.৩৭, কুয়েত ৭৭.০৯, চীন ৭৪.৬৮, সৌদি আরব ৭৪.১১, মালয়েশিয়া ৭৩.৭৯, থাইল্যান্ড ৭৩.৬০, মিসর ৭২.৬৬, তুরস্ক ৭২.৫০ ও ইন্দোনেশিয়ার মানুষের গড় আয়ু ৭১.৩৩ বছর।
ওয়ার্ল্ড ফ্যাক্ট বুক-২০১২ অনুযায়ী দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর মধ্যে গড় আয়ু সবচেয়ে বেশি শ্রীলঙ্কার ৭৫.১৪ বছর। গড় আয়ু সবচেয়ে কম আফগানিস্তানে, ৪৯.৭২ বছর। এছাড়া মালদ্বীপের গড় আয়ু ৭৪.৬৯ বছর, বাংলাদেশ ৭০.০৬ বছর, ভুটানে ৬৭.৮৮ বছর, ভারতের ৬৭.১৪ বছর, নেপালের ৬৬.৪৬ বছর ও পাকিস্তানের ৬৬.৭২ বছর।
সবচেয়ে কম গড় আয়ুর দেশগুলো হচ্ছে—অ্যাংগোলা ৩৮.৮ বছর, আফগানিস্তান ৪৫ বছর, চাদ ৪৮.৩ বছর, গিনিবিসাও ৪৮.৭ বছর, দক্ষিণ আফ্রিকা ৪৯.৩ বছর, সোয়াজিল্যান্ড ৪৮.৭ বছর এবং জিম্বাবুয়ে ৪৯.৬ বছর।
বিশ্বস্বাস্থ্য সংস্থার (ডব্লিউএইচও) মতে, আগামী ২৫ বছরে দীর্ঘায়ু লোকের সমস্যা প্রকট আকার ধারণ করবে। পারিবারিক, সামাজিক, রাষ্ট্রীয় ও অর্থনৈতিক জীবনে, বিশেষ করে কর্মসংস্থান, স্বাস্থ্যসেবা ও পেনশন ব্যবস্থার ওপর এর বিরূপ প্রভাব পড়বে। এ সময় কর্মক্ষম লোকদের তুলনায় বৃদ্ধ লোকের সংখ্যা বেশি হবে। অর্থাত্ মানুষের যে আয়ু বাড়ছে, ভবিষ্যতে সেটিও আরেক সমস্যা হয়ে দাঁড়াবে।
লেখক : সাংবাদিক, কলামিস্ট
abdal62@gmail.com
অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত গতকাল জাতীয় সংসদে ১ লাখ ৯১ হাজার ৭৩৮ কোটি টাকার বাজেট পেশ করেন। এর মধ্যে বাজেটে ৫২ হাজার ৬৮ কোটি টাকাই ঘাটতি দেখানো হয়েছে। এই ঘাটতি জিডিপির ৫ শতাংশ। ব্যাংক ঋণ ও বৈদেশিক অনুদান থেকে ঘাটতি মেটানোর কথা বলা হয়েছে। ব্যাংক ব্যবস্থা থেকে ঋণ নেয়া হবে ২৩ হাজার কোটি টাকা। বিদ্যুত্, সড়ক যোগাযোগ, বন্দর, ভৌত কাঠমো, কৃষি, মানবসম্পদ উন্নয়ন এবং সামাজিক নিরাপত্তা খাতকে অগ্রাধিকার দেয়ার কথা বলা হলেও এ থেকে কী সুবিধা কীভাবে আসবে, সে সম্পর্কে অর্থমন্ত্রীর বক্তব্যে কোনো ব্যাখ্যা নেই।
অর্থমন্ত্রী মূল্যস্ফীতি আগামীতে ৭ দশমিক ৫ শতাংশে নামিয়ে আনার কথা বলেছেন। কিন্তু এই মূল্যস্ফীতি তার দেয়া বর্তমান ১০ দশমিক ৮ শতাংশ মূল্যস্ফীতির সংখ্যা থেকে কিভাবে নামিয়ে আনা হবে, সে টার্গেট নেই। অর্থমন্ত্রীর বক্তব্যেই বার বার উচ্চারিত হয়েছে অর্থনীতি সম্পূর্ণ নিম্নমুখী। অর্থনীতিবিদরা বাজেট প্রাথমিকভাবে পর্যালোচনা করে বলেছেন, নতুন অর্থবছরটিতে অর্থনীতি এক বিপর্যয়কর অবস্থার সৃষ্টি করবে। দ্রব্যমূল্য সমস্যার সমাধানে কী ব্যবস্থা নেয়া হয়েছে, সরকারের কোনো দিকনির্দেশনা নেই। বিদ্যুত্-পানি-গ্যাসের দাম বাজেটের আগেও দফায় দফায় বাড়ানো হয়েছে, বাজেটের পরেও বাড়ার লক্ষণই অর্থমন্ত্রীর বক্তব্যে স্পষ্ট। সাধারণ মানুষের দুর্বিষহ অবস্থা যে কোনোভাবেই কাটছে না, সে কথাই নতুন বাজেট থেকে উচ্চারিত হয়েছে। গরিব মানুষকে কী কী সুবিধা দেয়া হবে, সে ব্যাপারে কোনো আশার আলো শোনানো হয়নি। প্রধান বিরোধী দল বিএনপির একটি উচ্চপর্যায়ের প্যানেল টেলিভিশনে অর্থমন্ত্রীর বাজেট উপস্থাপনা পর্যবেক্ষণ করে এ বাজেটকে এরই মধ্যে একটি অন্তঃসারশূন্য গণবিরোধী বাজেট হিসেবে উল্লেখ করেছে। প্যানেল বলেছে, অর্থমন্ত্রীর বক্তব্যে সরকারের দেউলিয়াপনাই প্রকাশ পেয়েছে—অর্থায়ন নেই, বিনিয়োগ নেই। অর্থনীতির সব সূচক নিম্নগামী। তাদের মতে, বাজেট বাস্তবায়ন করার মতো প্রশাসনিক সক্ষমতা এ সরকারের নেই। অর্থমন্ত্রী বলেছেন, এটি মহাজোট সরকারের সর্বশেষ পূর্ণাঙ্গ বাজেট। এই বাজেটে রাজনৈতিক ও নির্বাচনী দৃষ্টিভঙ্গি তুলে ধরা হয়েছে। তবে সাধারণ মানুষের বাজেট থেকে উপকৃত হওয়ার কোনো সুনির্দিষ্ট উচ্চারণ বাজেটে নেই, বরং করের আওতা ব্যাপক হারে বাড়ানোর কথাই বার বার উচ্চারিত হয়েছে। প্রবৃদ্ধির লক্ষ্যমাত্রা ৭.২ শতাংশ নির্ধারণ করার কথা বলা হলেও চলতি অর্থবছরে জিডিপি প্রবৃদ্ধি গত অর্থবছরের চেয়ে কমেছে। বিদ্যুত্ খাতে বরাদ্দ বাড়ানোর কথা অর্থমন্ত্রী বলেছেন, তবে লোডশেডিংয়ের যন্ত্রণা থেকে সাধারণ মানুষ বাঁচতে পাবে কি না—এ ধরনের আশাব্যঞ্জক কোনো কথা অর্থমন্ত্রী শোনাননি; বরং বলেছেন লোডশেডিং এখনও দুর্বিষহ অবস্থায় রয়েছে।
নতুন বাজেটে সুসংবাদ আছে নুতন ধান উত্পাদনে। আর আছে মানুষের আয়ু বৃদ্ধিতে। বন্যা, লবণাক্ততা ও খরাপ্রবণ এলাকায় ধানের আবাদ সম্প্রসারণ হয়েছে এবং নতুন জাতের ধান উদ্ভাবন করা হয়েছে। লবণাক্তসহিষ্ণু বিনা-৮ এবং ব্রি ধান-৪৭ আবাদ করা হচ্ছে। পাশাপাশি লবণাক্তপ্রবণ এলাকার জন্য ব্রি ধান-৫৩, ৫৪ ও বন্যাপ্রবণ এলাকার জন্য ব্রি-৫১ ও ৫২ জাতের ধান উদ্ভাবন করা হয়েছে। এগুলোর পাইলটিং কার্যক্রম চলছে এবং শিগগিরই আবাদ কার্যক্রম শুরু হবে। একই সঙ্গে আফ্রিকা থেকে খরাসহিষ্ণু নারিকা ধানের জাত সংগ্রহ করা হয়েছে। উত্তরবঙ্গের মঙ্গাপীড়িত অঞ্চলে বীনা-৭ ধান চাষের মাধ্যমে মঙ্গা দূর করার কথা বলা হয়েছে। এটা নিঃসন্দেহে সাধারণ কৃষকের জন্য আশার খবর।
বাংলাদেশের মানুষ যে কারণে দীর্ঘায়ূ হচ্ছে
আরেকটি আশার খবর হচ্ছে, বাংলাদেশের মানুষের আয়ু বাড়ছে। পুরুষের চেয়ে মহিলার আয়ু আরও বেশি বেড়েছে। শিশুমৃত্যু ও মাতৃমৃত্যুর হার কমেছে।
নতুন বাজেটের তথ্য পর্যালোচনা করে দেখা গেছে, মানুষের আয়ু অর্থাত্ জীবনকাল বাড়ছে। গত ৬২ বছরে বাংলাদেশের মানুষের গড় আয়ু প্রায় ৩৩.০৬ বছর বেড়ে গেছে। ১৯৫০ সালে মানুষের গড় আয়ু যেখানে ছিল ৩৭ বছর, সেখানে বর্তমানে ২০১২ সালে গড় আয়ু বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৭০.০৬ বছরে। আরও চমকপ্রদ তথ্য হচ্ছে, বাংলাদেশের মানুষের গড় আয়ু বিশ্ব গড় আয়ুর চেয়ে বেশি। সারাবিশ্বের ৭০০ কোটি মানুষের গড় আয়ু বর্তমানে ৬৭.২ বছর। গড় আয়ু নিয়ে ওয়ার্ল্ড ফ্যাক্ট বুক ২০১২ সমীক্ষায় এ তথ্য উল্লেখ করা হয়েছে। এদিকে বৃহস্পতিবার ২০১২ সালের বাজেট পেশকালে যে অর্থনৈতিক সমীক্ষা ২০১২ প্রকাশ করা হয়, তাতে উল্লেখ করা হয়—২০০৯ সালে বাংলাদেশে মানুষের প্রত্যাশিত গড় আয়ুষ্কাল ৬৭.৪ বছর। এর মধ্যে পুরুষের গড় আয়ু ৬৬.১ এবং মহিলার ৬৮.৭ বছর। অর্থাত্ বাংলাদেশের পুুরুষের চেয়ে মহিলার গড় আয়ু বেশি। ওয়ার্ল্ড ফ্যাক্ট বুক ২০১২-এর সমীক্ষায়ও বলা হয়, বাংলাদেশী পুরুষের চেয়ে মহিলার আয়ু বেশি।
বাংলাদেশের মানুষের আয়ু বাড়ার কারণ কী? বিশেষজ্ঞরা বলেন, দারিদ্র্য, ব্যাধি, অপুষ্টি ও চিকিত্সার অভাবে চল্লিশ-পঞ্চাশের দশকে এদেশে শিশু ও প্রসূতি মৃত্যু ছিল অস্বাভাবিক। অন্যদিকে ছিল উচ্চজন্মহার। বর্তমানে শিশু ও প্রসূতি মৃত্যু যেমন কমেছে, তেমনি কমে এসেছে জন্মহার। আর তাই বাড়ছে প্রত্যাশিত আয়ুষ্কাল। বিশেষজ্ঞরা বলেন, শিল্পবিপ্লবের সঙ্গে সঙ্গে পৃথিবীতে মৃত্যুহার কমতে শুরু করে। প্রথমে জন্ম ও মৃত্যুহার দুটোই ছিল বেশি। দ্বিতীয় পর্যায়ে মৃত্যুহার কমেছে; কিন্তু জন্মহার বেশিই ছিল। তৃতীয় পর্যায়ে পৃথিবীর দেশগুলোতে জন্ম এবং মৃত্যুহার দুটোই কমেছে। জনসাধারণের স্বাস্থ্যের ব্যাপারে নিত্য সজাগ দৃষ্টি, বিশ্বস্বাস্থ্য সংস্থার কার্যক্রম, বিশ্ব শিশু তহবিল (ইউনিসেফ) প্রতিষ্ঠা, ব্যাপক রোগ প্রতিষেধক ও মহামারী নিরোধক ব্যবস্থা আবিষ্কারের ফলে অবস্থার উন্নতি হয়। বাংলাদেশও এর আওতার বাইরে ছিল না। রোগ প্রতিষেধক ও মহামারী নিরোধক ব্যবস্থা এদেশে মৃত্যুহার শিল্পবিপ্লব-পূর্ব সময়ের তুলনায় দুই-তৃতীয়াংশ কমিয়ে দিয়েছে। শিশু মৃত্যুর হারও হ্রাস পেয়েছে।
এমন সময় গেছে, যখন বাংলাদেশে প্রসূতি মৃত্যুর হার ছিল অস্বাভাবিক। সন্তান জন্মের সময় অবৈজ্ঞানিক পদ্ধতিতে শিশুদের নাড়ি কাটা হতো। এতে মা এবং শিশু উভয়ই মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়ত। কিন্তু মৃত্যুর এ কারণ ছাড়াও ছিল রোগব্যাধি এবং অপুষ্টি। ১৯৬০ সালে প্রতি হাজারে ১৫১ শিশু মারা যেত। ২০১০ সালে শিশু মৃত্যুর হার নেমে পড়ে ৩৬ জনে (অর্থনৈতিক সমীক্ষা ২০১২)। ১৯৬২-৬৫ সালে জন্মহার ছিল হাজারে ৫১.৩, ১৯৭৩ সালে ৫০, ২০০২ সালে ২০.২১ আর ২০১০ সালে ১৯.২। তেমনি ১৯৫০ সালে গড় আয়ু ছিল ৩৭ বছর। এখন সেটা ৭০.০২ বছর।
কলেরা, গুটিবসন্ত, কালাজ্বর এবং ম্যালেরিয়ার মহামারী এখন আর নেই। গুটিবসন্ত এদেশ থেকে একেবারে নির্মূল হয়ে গেছে। কালাজ্বর নেই। ম্যালেরিয়া এখন শুধু পার্বত্য চট্টগ্রাম, সিলেট ও ময়মনসিংহের পহাড়ি অঞ্চলে সীমিত পরিসরে রয়েছে। কলেরা নেই। ডায়রিয়ার প্রকোপও নিয়ন্ত্রণে চলে এসেছে। বিশুদ্ধ পানি এবং স্যানিটেশন ব্যবস্থার উন্নতি হচ্ছে। অন্যদিকে অপুষ্টি সমস্যার উন্নতি ঘটছে। মানুষের ক্যালরি গ্রহণের পরিমাণও বাড়ছে।
মানুষের গড় আয়ু শুধু বাংলাদেশেরই নয়, পৃথিবীব্যাপীই বাড়ছে। ওয়ার্ল্ড ফ্যাক্ট বুক-২০১২ জরিপ অনুযায়ী মানুষের গড় আয়ু শিল্পোন্নত দেশগুলোয় সবচেয়ে বেশি। সবচেয়ে কম আফ্রিকার উপ-সাহারা অঞ্চলগুলোতে। এইডস রোগ মহামারী আকারে থাকার কারণে সেখানে গড় আয়ু সবচেয়ে কম। শিল্পোন্নত দেশগুলোর পর গড় আয়ু বেশি পূর্ব এশিয়া ও প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চল, লাতিন আমেরিকা ও ক্যারিবীয় অঞ্চল এবং সিইই-সিআইএস ও বাল্টিক রাষ্ট্রগুলোয়। অঞ্চল ভিত্তিতে উত্তর আমেরিকায় গড় আয়ু ৭৭.৬ বছর, ওশেনিয়া অঞ্চলে ৭৪.৬ বছর, ইউরোপ অঞ্চলের দেশগুলোতে ৭৪.৩ বছর, লাতিন আমেরিকা ও ক্যারিবীয় অঞ্চলে ৭১.৮ বছর, এশিয়া অঞ্চলের দেশগুলোতে ৬৭.৭ বছর এবং আফ্রিকায় ৫০.৬ বছর। দক্ষিণ এশিয়ার ৮টি দেশের মানুষের গড় আয়ু ৬৬.৪ বছর। ওয়ার্ল্ড ফ্যাক্ট বুক-২০১২ সমীক্ষার তথ্য অনুযায়ী বিশ্বের মানুষের গড় আয়ু ৬৭.২ বছর। বিশ্বের ২২২টি দেশের মধ্যে মানুষের গড় আয়ু সবচেয়ে বেশি মোনাকোর। মোনাকোর মানুষ গড়ে ৮৯.৭৩ বছর বাঁচেন। গড় আয়ু সবচেয়ে কম অ্যাঙ্গোলায় ৩৮.৮ বছর। সবচেয়ে বেশি গড় আয়ুর দেশের মধ্যে দ্বিতীয় অবস্থানে রয়েছে ম্যাকাও ৮৪.৪১ বছর। জাপানের মানুষের গড় আয়ু ৮২.২৫, সিঙ্গাপুর ৮২.১৪, হংকং ৮২.০৪, অস্ট্রেলিয়া ৮১.৮১, কানাডা ৮১.৩৮, ফ্রান্স ৮১.১৯, সুইজারল্যান্ড ৮১.০৭, ইসরাইল ৮০.৯৬, নিউজিল্যান্ড ৮০.৫৯, জার্মানি ৮০.০৭, যুক্তরাজ্য ৮০.০৫, জর্ডান ৮০.০৫, বেলজিয়াম ৭৯.৫১, ফিনল্যান্ড ৭৯.২৭, দক্ষিণ কোরিয়া ৭৯.০৫, ডেনমার্ক ৭৮.৬৩, যুক্তরাষ্ট্র ৭৮.৩৭, কুয়েত ৭৭.০৯, চীন ৭৪.৬৮, সৌদি আরব ৭৪.১১, মালয়েশিয়া ৭৩.৭৯, থাইল্যান্ড ৭৩.৬০, মিসর ৭২.৬৬, তুরস্ক ৭২.৫০ ও ইন্দোনেশিয়ার মানুষের গড় আয়ু ৭১.৩৩ বছর।
ওয়ার্ল্ড ফ্যাক্ট বুক-২০১২ অনুযায়ী দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর মধ্যে গড় আয়ু সবচেয়ে বেশি শ্রীলঙ্কার ৭৫.১৪ বছর। গড় আয়ু সবচেয়ে কম আফগানিস্তানে, ৪৯.৭২ বছর। এছাড়া মালদ্বীপের গড় আয়ু ৭৪.৬৯ বছর, বাংলাদেশ ৭০.০৬ বছর, ভুটানে ৬৭.৮৮ বছর, ভারতের ৬৭.১৪ বছর, নেপালের ৬৬.৪৬ বছর ও পাকিস্তানের ৬৬.৭২ বছর।
সবচেয়ে কম গড় আয়ুর দেশগুলো হচ্ছে—অ্যাংগোলা ৩৮.৮ বছর, আফগানিস্তান ৪৫ বছর, চাদ ৪৮.৩ বছর, গিনিবিসাও ৪৮.৭ বছর, দক্ষিণ আফ্রিকা ৪৯.৩ বছর, সোয়াজিল্যান্ড ৪৮.৭ বছর এবং জিম্বাবুয়ে ৪৯.৬ বছর।
বিশ্বস্বাস্থ্য সংস্থার (ডব্লিউএইচও) মতে, আগামী ২৫ বছরে দীর্ঘায়ু লোকের সমস্যা প্রকট আকার ধারণ করবে। পারিবারিক, সামাজিক, রাষ্ট্রীয় ও অর্থনৈতিক জীবনে, বিশেষ করে কর্মসংস্থান, স্বাস্থ্যসেবা ও পেনশন ব্যবস্থার ওপর এর বিরূপ প্রভাব পড়বে। এ সময় কর্মক্ষম লোকদের তুলনায় বৃদ্ধ লোকের সংখ্যা বেশি হবে। অর্থাত্ মানুষের যে আয়ু বাড়ছে, ভবিষ্যতে সেটিও আরেক সমস্যা হয়ে দাঁড়াবে।
লেখক : সাংবাদিক, কলামিস্ট
abdal62@gmail.com
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন