মাহবুব কামাল
কিছু বাংলা প্রবাদ-প্রবচন আছে, যেগুলো বাস্তবক্ষেত্রে সত্য বলে প্রমাণিত হয় না। যেমন একটি প্রবাদ এমনÑ কানে লোম কমিনের, নাকে লোম মমিনের। অর্থাৎ যাদের কানে লোম থাকবে, তারা কমিন বা শয়তান প্রকৃতির লোক আর যাদের নাকে লোম থাকে, তারা মমিন বা ঈমানদার। এবার দেখুন, বাস্তবে এটা সত্য কি-না। আমার থানার এক সময়কার ওসি অর্থাৎ ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তার নাকে লোম ছিল। প্রবাদের সূত্র অনুযায়ী, তিনি একজন ঈমানদার, এক কথায় ভালো মানুষ। তো আমার এলাকাটি সীমান্তবর্তী হওয়ায় প্রায়ই ভারত থেকে চোর-ডাকাত এসে চুরি-ডাকাতি করত। একবার ভারতের এক চোর অথবা ডাকাত ধরা পড়লে জনতা তাকে পিটিয়ে হত্যা করে। থানায় হত্যা মামলা করা হলে তদন্তকারী কর্মকর্তা তদন্ত শেষে তদন্ত প্রতিবেদন দাখিল করে। ওসি সাহেব তদন্ত প্রতিবেদন পড়ে বলে ওঠেনÑ কী আইও সাব, এত্তোবড় মামলা, আসামি মাত্র পাঁচজন! আরে মিয়া মাথাওয়ালা দেইখা সবাইরে গাইথা ফালাও, কোর্টে গিয়া খালাস পাউক।
আমাদের জেলার এক সময়কার এসপিরও নাকে লোম ছিল। এবার তার কাণ্ড দেখুন। তিনি জেলাধীন এক থানার ওসিকে ডেকে বললেনÑ ওসি সাহেব, এফআইআর-এ (এজাহার) তো দেখতাছি আসামি ১৫ জন। চার্জশিটে ১০ জন ক্যা? ফালান, ফালান, পাঁচটা ফালান। বলাবাহুল্য, পাঁচটা ফালান মানে পাঁচটি ১০০ টাকার বান্ডিল অর্থাৎ ৫০ হাজার টাকা তাকে দিতে হবে। পাঠক বুঝলেন নিশ্চয়ই, চার্জশিটে পাঁচজনকে বাদ দিয়ে ওসি সাহেব তাদের কাছ থেকে যে টাকা নিয়েছেন, সেখান থেকে ভাগ চা”েছন এসপি।
পুলিশ নিয়ে লিখতে গিয়ে আরও কিছু টুকরো স্মৃতি মনে পড়ছে। প্রথমে পুলিশের একজন ব্যতিক্রমী এসপি পুলিশ নিয়ে কী ভাবছেন, তা দেখুন। একবার কিছু লোক একত্র হয়ে এক জেলার সেই এসপি সাহেবের কাছে গিয়ে আবেদন করলেনÑ তাদের এলাকায় একটি পুলিশ ফাঁড়ির ব্যব¯’া করতে হবে। ওই এসপির নাকে লোম ছিল কি-না জানি না, তিনি বললেনÑ আপনারা চাইলে পুলিশ ফাঁড়ি দিতে পারি; কিš‘ সেটা না নেয়াই বোধহয় ভালো। সবাই কারণ জানতে চাইলে এসপি সাহেব বললেনÑ যেসব এলাকায় মাদ্রাসা আর পুলিশ ফাঁড়ি থাকে, সেসব এলাকায় অপরাধ বেশি হয়।
আমার এক পরিচিত পরিবারের (গ্রামের বাড়ি এলাকার) এক মেয়ে ধর্ষিত হল। থানায় মামলাও হল। কিš‘ আসামি আর ধরা পড়ে না। কিছুদিন যাওয়ার পর বাদীপক্ষ বুঝতে পারল, ধর্ষকের কাছ থেকে টাকা খেয়েছে ওসি। তারা থানায় গেল আসামিকে কেন ধরা হ”েছ না তা জানতে। ওসি সাহেব অনেক কথার পর বললেনÑ শুনতেছি মেয়েটিই নাকি খারাপ!
বাদী ও বিবাদী উভয়পক্ষ থেকে পুলিশের টাকা নেয়ার কৌশল কি জানেন পাঠক? খুব সোজা কৌশল। পুলিশ আসামির কাছ থেকে টাকা নেবে তাকে গ্রেফতার না করার শর্তে। আর বাদীকে বলবেÑ আপনি আগে বলবেন তো, আসামির উপরে লাইন আছে। এসপি সাহেবের খাতিরের লোক উনি। টাকা ছাড়া এসপিকে ম্যানেজ করা যাবে না।
পুলিশ এখন সাংবাদিক পেটা”েছ। না পেটানোর কোন কারণ নেই। সাংবাদিক সম্পর্কে পুলিশের ধারণা কেমন তা দেখুন। ১৯৯৫ সালের কথা। আমি তখনকার সর্বাধিক প্রচারিত একটি সাপ্তাহিকে কাজ করি, বেতনও ভালোই পাই। তো আমি যা”িছ গ্রামের বাড়ি। ফেরিতে উঠে (তখনও যমুনা ব্রিজ হয়নি) জানতে পারলাম, আমার থানার নবনিযুক্ত ওসিও ফেরিতে, জয়েন করতে যা”েছন থানায়। এক পরিচিত লোক ওসির সঙ্গে আমার পরিচয় করিয়ে দিয়ে বললেন, ইনি সাংবাদিক আর আমাকে বললেনÑ উনি আমাদের নতুন ওসি। ওসি সাহেব আমি সাংবাদিক শুনে জিজ্ঞেস করলেন, আপনি আর কী করেন? রীতিমতো অপমানজনক কথা। সাংবাদিকতা তাহলে এমন কোন পেশা নয়, যা দিয়ে পেট চালানো যায়! ওসি সাহেব নিশ্চয়ই তার অভিজ্ঞতায় যেসব মফস্বল সাংবাদিককে চেনেন, তাদের সঙ্গে আমাকে তুলনা করেছেন। আমি তাকে পাল্টা জিজ্ঞেস করলামÑ আপনি ওসিগিরি ছাড়া আর কী করেন? ওসি থতমত খেল। এবার আমি বললাম, আপনার অফিসিয়াল বেতন যা, তার প্রায় চারগুণ বেতন পাই আমি। আপনি যদি ওসিগিরি ছাড়া আর কিছু না করে থাকেন, তাহলে আমি করতে যাব কোন দুঃখে? আপনাদের যেমন আইজি আছে, আবার কনস্টেবলও আছে; আমাদেরও তেমন সম্পাদক আছে, আবার মফস্বল সাংবাদিকও আছে। আপনি কি আমাকে কনস্টেবল ভেবেছেন?
সামান্য প্রসাঙ্গান্তরে যাই। আমি একবার এক বেসরকারি ব্যাংকে স্যালারি লোন নিতে গেলাম। গিয়ে শুনি, তারা দুটি ক্যাটাগরি স্কিম থেকে বাদ রেখেছেন। উকিল ও সাংবাদিক এই দুই শ্রেণীকে লোন দেয়া হয় না। কারণ হিসেবে যা জানলাম, তার মর্মার্থ হলÑ উকিল হ”েছ ঘোরপ্যাঁচওয়ালা মানুষ। লোনের টাকা ফেরত না দিলে তারা প্যাঁচ খাটায়। আর সাংবাদিকরা নিয়মিত বেতন পান না, পেলেও তারা টাকা ফেরত না দিলে তাদের সঙ্গে কুলিয়ে ওঠা যায় না। ব্যব¯’া নিতে গেলে কাগজে লিখে দেয়ার ভয় দেখায়। আমি সোজা ম্যানেজারের র“মে গেলাম এবং তাকে বললামÑ আপনি যে আজ নির্বিঘেœ অফিসে আসতে পেরেছেন, কেউ আপনার পরনের কাপড় খুলে নেয়নি, এটা যে কিছু ইয়াং রিপোর্টারের অবদানের ফল, এটা কি আপনি বোঝেন? দেশটা যে এখনও রসাতলে যায়নি, এজন্য কি আমাদের কোনই কৃতিত্ব নেই? দ্বিতীয়ত, আপনি কত টাকা বেতন পান? দেশে এমন সাংবাদিক আছে, যারা আপনার চেয়ে বেশি বেতন পান। তাহলে তাদের লোন দেবেন না কেন? শেষ পর্যন্ত আমি লোনটা পেয়েছিলাম; কিš‘ সাংবাদিক সম্প্রদায়ের এমন ভাবমূর্তির প্রকৃত কারণ কী, তা এখনও বুঝে উঠতে পারিনি।
যাক, আমরা কথা বলছিলাম পুলিশ নিয়ে। আমেরিকা কিংবা ইংল্যান্ডে গিয়ে বা”চাদের সঙ্গে কথা বলার সময় আমি একটি কমন প্রশ্ন করতামÑ তুমি কী হতে চাও? অধিকাংশ ক্ষেত্রেই উত্তর পেয়েছিÑ আই উইল বি অ্যা পুলিশ অফিসার। কারণটা খুব সোজা। পুলিশ সেখানে সমাজের একটি মর্যাদাসম্পন্ন শ্রেণী। মানুষের নিরাপত্তা দেয়াÑ সে কী চাট্টিখানি কথা! সুতরাং তার মর্যাদাও বেশি। পুলিশ সেখানে কীভাবে মানুষের নিরাপত্তা দি”েছ, তার একটা উদাহরণ দিই। একদিন নিউইয়র্কের সাব-ওয়েতে ট্রেনের জন্য অপেক্ষা করছি। হঠাৎ দেখলাম, পাশেই এক যুবতী মূর্ছা গেছেন। সম্ভবত তিনি হিস্টিরিয়ার রোগী। যুবতী প্লাটফর্মে পড়ে কাতরা”েছন। আমি কী করব বুঝে উঠতে পারছিলাম না। ২/১ মিনিটেরই ব্যাপার। দেখি, পুলিশ এসে গেছে। তারা দ্র“ত তাকে তুলে নিয়ে গেল। ভাবতে থাকলাম, পুলিশ খবর পেল কীভাবে আর এত দ্র“ত এলোই বা কী করে? উত্তর সোজা। কেউ একজন কাছাকাছি থাকা পাবলিক টেলিফোন বুথ থেকে ৯৯৯ টিপে দিয়েছে। ট্রিপল ৯ টেপা মানেই পুলিশ বুঝে গেল কারও কিছু একটা বিপদ হয়েছে আর কোথায় যেতে হবে সেটাও মনিটরে উঠে গেছে। প্রশ্ন উঠতে পারে, উন্নত দেশগুলোয় কি তাহলে গণবিরোধী পুলিশ নেই? ওখানকার সবাই ধর্মপুত্র যুধিষ্ঠির? তা নয় নিশ্চয়ই। সেখানেও অপরাধী পুলিশ আছে, তবে একই সঙ্গে রয়েছে তাদের বির“দ্ধে শাস্তিমূলক ব্যব¯’া নেয়ার নিরন্তর প্রক্রিয়া। নিউইয়র্কের অপরাধ যখন বেড়ে গেল, ঠিক সেই সময় সিটি মেয়র নির্বাচিত হলেন জুলিয়ানি। তিনি নির্বাচিত হওয়ার কিছুদিনের মধ্যেই ম্যাজিকের মতো নিউইয়র্কের অপরাধ শূন্যে নামিয়ে আনলেন। কীভাবে সম্ভব হল এটা? খুব সোজা কাজ। তিনি ক্ষমতা নিয়েই অসৎ ও অযোগ্য দুই ধরনের পুলিশকে বরখাস্ত করেছিলেন। বলেছিলেনÑ অপরাধ মানেই সেখানে রয়েছে পুলিশের সম্পৃক্ততা। এ সম্পৃক্ততা দুই ধরনের। এক. অসৎ পুলিশ অপরাধীদের সঙ্গে নেক্সাস গড়ে তুলে তাদের ছাড় দেয়। দুই. পুলিশ সৎ হলেও সে যদি অযোগ্য হয়, তাহলে অপরাধ ও অপরাধী শনাক্ত করতে ব্যর্থ হয়। সুতরাং অসৎ ও অযোগ্য পুলিশকে বাদ দেয়া হলে সংশ্লিষ্ট এলাকায় অপরাধ বলে কিছু থাকবে না।
এতদঞ্চলের পুলিশ কবে থেকে গণবিরোধী ভূমিকা গ্রহণ করেছে, সেই ইতিহাস অতি পুরনো। আমরা ছোটবেলায় একটি চুটকি শুনেছিলাম। বাসের ড্রাইভার কনডাক্টরকে বলছে, দেখ তো ছাদের ওপর কয়জন মানুষ। কন্ডাক্টর দেখে বলল, ওস্তাদ দুইজন মানুষ আর একটা পুলিশ। স্বাধিকার আন্দোলনের সময় আমরা পাকিস্তানি পুলিশের বির“দ্ধে স্লোগান দিয়েছিÑ পুলিশ তুমি যতই মারো, তোমার বেতন একশ’ বারো। আবার সেই ব্রিটিশ আমল থেকেই পুলিশ সম্পর্কে একটা কথা চালু আছে, পুলিশ ছুলে ছত্রিশ ঘা। দেশ দুই দুইবার স্বাধীন হলেও ছত্রিশ অন্তত পঁয়ত্রিশে নামেনি। এখন পুলিশ ছুলে পঁয়ত্রিশ ঘা বলতে পারলে বোঝা যেত অব¯’ার কিছুটা হলেও উন্নতি হয়েছে। পুলিশের এই ঐতিহাসিক জনবি”িছন্নতার বির“দ্ধে মানুষ যুগে যুগেই প্রতিবাদ করেছে; কিš‘ কোন লাভ হয়নি। খালেদা জিয়ার প্রথম প্রধানমন্ত্রিত্বের আমলে দিনাজপুরের মেয়ে ইয়াসমিনকে পুলিশ ধর্ষণের পর হত্যা করলে সমগ্র দেশ বিক্ষোভে ফেটে পড়েছিল। অব¯’া এমন দাঁড়িয়েছিল, এই বুঝি খালেদা সরকারের পতন ঘটল। কিš‘ না, সরকারেরও পতন হয়নি, পুলিশ পরবর্তীকালে সংশোধিতও হয়নি। ব¯‘ত, পুলিশ একেকটি অপকর্ম ঘটায় আর কিছুদিনের জন্য মিডিয়া ও মানুষ প্রতিবাদমুখর থাকে। ব্যস, ওই পর্যন্ত। এরপর অপেক্ষা করতে হয় পুলিশের আরেকটি অপকর্মের জন্য।
আমাদের বোঝা হয়ে গেছে, এভাবে সংশোধিত হবে না পুলিশ। সদুপদেশ দিয়ে কোনকালেই বেপথুকে সুপথে ফিরিয়ে আনা যায়নি। আর তাই বিড়ালকে সদুপদেশ না দিয়ে মিটসেফের দরজা বন্ধ রাখি আমরা। পুলিশকেও সদুপদেশ না দিয়ে যেসব প্রক্রিয়া বা পদ্ধতি তাদের বিপথগামী করে, সেগুলো মেরামত করতে হবে। ব¯‘ত, গলদ রয়েছে সর্বত্রÑ রিক্রুটমেন্ট প্রক্রিয়া, প্রশিক্ষণ ও পরিচালনা পদ্ধতিতে। রিক্রুটমেন্ট প্রক্রিয়ায় দলীয় আনুগত্যের শর্ত পরিহার করতে হবে শতভাগ। যোগ্যতাই হতে হবে একমাত্র মাপকাঠি। পুলিশের যোগ্যতা বলতে কী বোঝায়? ইংরেজি চঙখওঈঊ শব্দটির ব্যুৎপত্তি জানি না, তবে এ শব্দের প্রতিটি বর্ণ পুলিশের একেকটি গুণাবলী নির্দেশ করে। চ নির্দেশ করে পুলিশের ঢ়ড়ষরঃবহবংং বা বিনয়, এমনিভাবে ঙ, খ, ও, ঈ, ঊ যথাক্রমে ড়নবফরবহপব বা জনগণের প্রতি আনুগত্য, ষরধনরষরঃু বা জনগণের প্রতি দায়বদ্ধতা, রহঃবষষরমবহপব বা বুদ্ধিমত্তা, পড়ঁৎধমব বা সাহস এবং বহবৎমু বা শক্তি নির্দেশ করে। পুলিশের রিক্রুটমেন্টের সময় এই ক্রাইটেরিয়া অনুসরণ করা বাঞ্ছনীয়।
পুলিশের প্রশিক্ষণেও রয়েছে গুর“তর গলদ। প্রকৃতপক্ষে, বর্তমানে পুলিশের যে প্রশিক্ষণ চালু রয়েছে, তা তাদের উদ্ধত করে তোলে। এই প্রশিক্ষণ তাদের শেখায়Ñ থানায় কেউ প্রবেশ করলে রাশভারি কণ্ঠে বলতে হবেÑ তুমি এখানে কী চাও? আসলে তাদের বলতে শেখাতে হবেÑ আমরা আপনাকে কীভাবে সাহায্য করতে পারি?
পুলিশকে যেভাবে পরিচালনা করা হয়, তা গৃহভৃত্য পরিচালনারই নামান্তর। পুলিশ প্রজাতন্ত্রের কর্মচারী হলেও সে হয়ে পড়ে সরকারের কর্মচারী। এই কর্মচারী যত না অপরাধ দমনে সচেষ্ট থাকে, তার চেয়ে বেশি পারঙ্গমতা দেখায় বিরোধী দলকে দমন করতে। পুলিশ আসলে কতটা স্বাধীনতা ভোগ করে? লাটাই হাতে থাকলে ঘুড়ির কি থাকে কোন স্বাধীনতা? সে জানে, আকাশের যেখানেই বিচরণ কর“ক না কেন, তাকে মর্ত্যে নামিয়ে ফেলতে কতক্ষণ? ই”ছামতো সুতা ছাড়লাম, আবার ই”ছা হল টেনে নিলামÑ এভাবে আর যা-ই হোক, পুলিশের স্বাধীনতা নিশ্চিত হয় না। আর স্বাধীনতা ছাড়া কে কবে কোথায় কোন্ মহৎ কাজ করতে পেরেছে?
মাহবুব কামাল : সাংবাদিক
সধযনঁনশধসধষ০৮@ুধযড়ড়.পড়স
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন