শনিবার, ৯ জুন, ২০১২

কালো টাকা সাদা করার আবশ্যকতা


মু হ ম্ম দ র“ হু ল আ মি ন
কালো টাকা সাদা করা প্রস্তাবিত জাতীয় বাজেটে একটি অত্যন্ত আলোচিত ও বিতর্কিত বিষয়। একটি দেশের উন্নয়নের অন্যতম কেন্দ্রীয় নির্ধারক হল তার অর্থনীতি। যুক্তির খাতিরে বা পরিসংখ্যানগত তথ্য-উপাত্তের ভিত্তিতে বাংলাদেশকে একটি উন্নয়নশীল রাষ্ট্র হিসেবে হয়তোবা প্রমাণ করা যায়। কিš‘ রাষ্ট্রের প্রতিটি স্তরে বিরাজমান দুর্নীতি, যার অস্তিত্ব অর্থমন্ত্রী, অর্থনীতিবিদ, নাগরিক সমাজ ও আন্তর্জাতিক সং¯’া স্বীকার করেন; তা অস্বীকার করার চেষ্টা নিতান্তই অযৌক্তিক। এখন প্রশ্ন হল, অনৈতিক বা দুর্নীতির মাধ্যমে উপার্জিত অর্থ, যা ‘কালো টাকা’ নামে পরিচিত, তা সাদা করার সরকারি সিদ্ধান্ত কতটুকু যুগোপযোগী? কালো টাকা হল আয়ের সেই অংশ, যার ওপর কর প্রদান অপরিহার্য; কিš‘ কৌশলে তার কর দেয়া হয় না, বরং কর কর্তৃপক্ষের নজরের বাইরে রাখা হয়। কালো টাকা সাদা করার বিষয়টি গণমাধ্যমসহ বিভিন্ন স্তরে আলোচিত হ”েছ। কেউ কেউ সাদা করার উদ্যোগকে স্বাগত জানালেও অনেক বিশ্লেষক, অর্থনীতিবিদ নানা কারণে এর সমালোচনায় পঞ্চমুখ। কারণগুলো হল : এক. এতে দুর্নীতিকে আরও উৎসাহিত করা হয়, দুই. দুষ্ট অর্থনীতির লালন করা হয়, তিন. রাজনৈতিক দুর্বৃত্তায়ন ঘটানো হয়, চার. নীতিবান ব্যবসায়ীদের প্রতি পক্ষপাতমূলক আচরণ করা হয়; পাঁচ. আয়বৈষম্য বৃদ্ধি পায় এবং ছয়. অর্থসংক্রান্ত দুর্নীতিকে আরও সম্প্রসারিত করা হয়। কোন কোন অর্থনীতিবিদ বিশ্বব্যাপী দুর্নীতির নিñিদ্র প্রহরী (ওয়াচডগ) হিসেবে খ্যাত বার্লিনভিত্তিক ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনালের রিপোর্টে ২০০১ থেকে ২০০৬ সাল পর্যন্ত দুর্নীতির বিশ্ব র‌্যাংকিংয়ে বাংলাদেশের ক্রমাগত প্রথম ¯’ান অধিকার করার বিষয়টিকেও উদ্ধৃত করেছেন। কেউ কেউ আবার কালো টাকা সাদা করাকে অর্থনৈতিকভাবে অফলপ্রসূ এবং অনৈতিক কাজ বলেও আখ্যায়িত করেন। কিš‘ ২০০১ থেকে ২০০৬ সাল পর্যন্ত তখনকার নির্বাচিত সরকার কতবার, কী পরিমাণ কালো টাকা সাদা করেছিল এবং সেটা দুর্নীতির বিশ্ব র‌্যাংকিংয়ে প্রথম ¯’ান আরোহণে কতটা ভূমিকা রেখেছিল, তা বিশ্লেষণের আগে এ ব্যাপারে কোন সিদ্ধান্ত নেয়া সমীচীন নয়। বাংলাদেশ প্রথমবারের মতো ১৯৭৫-৭৬ অর্থবছরের বাজেটে তখনকার হিসাবে ৭০ হাজার কোটি কালো টাকাকে স্বাভাবিক অর্থনীতিতে অন্তর্ভুক্ত করতে সাদা করার পদক্ষেপ গ্রহণ করে। জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের তথ্যানুসারে, ২০০৭-০৮ অর্থবছরে সবচেয়ে বেশি কালো টাকা সাদা হয়েছে। গত চার দশকে সরকার মাত্র ১৮ হাজার কোটি কালো টাকা সাদা করার মাধ্যমে ১ হাজার ৪০০ কোটি টাকা কর আকারে আদায় করেছে।
সম্প্রতি বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রতিবেদন থেকে জানা যায়, দেশে ২৩ হাজার ২১২ জন কোটিপতি আছেন। কিš‘ জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের তথ্যানুসারে, ২০১১-১২ অর্থবছরে ১ লাখ টাকা ব্যক্তি আয়কর দেয়ার মতো ১ হাজার ব্যক্তিও দেশে নেই। সম্প্রতি অর্থ মন্ত্রণালয়ের এক জরিপ থেকে জানা যায়, দেশে অঘোষিত বা কালো টাকার পরিমাণ মোট দেশজ উৎপাদনের ৮০ ভাগ, যা ১১০ বিলিয়ন মার্কিন ডলারের সমান। ২০১০ সালে বাজেট-উত্তর সংবাদ সম্মেলনে অর্থমন্ত্রী কালো টাকার পরিমাণ মোট দেশজ উৎপাদনের ৪৫ থেকে ৮১ ভাগ বলে উল্লেখ করেন। সুতরাং উল্লিখিত ২০০১-০৬ সময়ে বিশ্ব দুর্নীতিতে বাংলাদেশের প্রথম ¯’ান অধিকার করার ক্ষেত্রে কালো টাকা সাদা করার ভূমিকা নগণ্য, বরং সাদা টাকা কালো হওয়ার বিষয়টি ঢের বেশি ভূমিকা পালন করেছে বলে অনুমিত হয়।
বিশ্বের প্রতিটি রাষ্ট্রে কর ফাঁকি-সুদ-ঘুষের সংস্কৃতি বিদ্যমান রয়েছে। পার্শ্ববর্তী ভারতের কথা বলা যেতে পারে, যাদের ১৯৮৩ ও ’৮৪ সালে কালো টাকার (র“পির) পরিমাণ ছিল যথাক্রমে তাদের মোট দেশজ উৎপাদনের ১৯ ও ২১ ভাগ। দ্য টাইমস অব ইন্ডিয়ার তথ্যানুসারে (১৩ ফেব্র“য়ারি ২০১২), কালো টাকার মালিকরা ২৪ দশমিক ৫ লাখ কোটি কালো র“পি বিদেশে পাচার করেছেন। যদি তাদের কালো র“পির মাত্র ৫০ ভাগ দেশের স্বাভাবিক অর্থনীতিতে অন্তর্ভুক্ত করা যায়, তাহলে ভারত সরকার বছরে ২ হাজার বিলিয়ন র“পি অতিরিক্ত রাজস্ব আয় হিসেবে সংগ্রহ করতে পারবে। তবে এটা সর্বজনবিদিত যে, উদীয়মান বিশেষ করে বাংলাদেশের মতো অর্থনীতিতে উপরোক্ত বিষয়গুলো একটু বেশি পরিলক্ষিত হয়। কোন সরকারের পক্ষে এ সংস্কৃতি সমূলে উৎপাটন করা সম্ভব নয়। তবে একে কীভাবে উন্নয়ন কাজে ব্যবহারের কৌশল অবলম্বন করা যায়, সে ব্যাপারে সরকার যুগোপযোগী সিদ্ধান্ত নিতে পারে।
সরকারের কালো টাকা সাদা করার নীতিটি মন্দের ভালো এবং বোধহয় সময়েরও দাবি। অবৈধভাবে উপার্জিত অর্থ যদি আবারও বিনিয়োগ করানো যায়, তাহলে উন্নয়ন কিছুটা হলেও ত্বরান্বিত হবে, অপরাধপ্রবণতা ও মূল্যস্ফীতি হ্রাস এবং কর্মসং¯’ান বৃদ্ধি পাবে। এতে অর্থনীতির ওপর তুলনামূলকভাবে কম নেতিবাচক প্রভাব পড়বে। যদি কালো টাকার মালিক তার অর্থ বৈধ কোন খাতে বিনিয়োগ করার সুযোগ না পান, তাহলে কালো টাকা কালো জগতেই ব্যয় হবে এবং কালো অর্থনীতির বিস্তার, রাজনৈতিক দুর্বৃত্তায়ন, আইন-শৃংখলার অবনতি, মূল্যস্ফীতি, সামাজিক অ¯ি’রতা প্রভৃতি বৃদ্ধি পাবে। কালো টাকার মালিক কালো জগতে অর্থ ব্যয় না করলেও বেশির ভাগ ক্ষেত্রে বহির্বিশ্বের ব্যাংকে স্বল্প সুদে নিরাপদে রাখার জন্য পাচার করবেন। ট্র্যাজেডি হলÑ আমরাই আবার উন্নয়নের নামে বহির্বিশ্বের ব্যাংক থেকে উ”চ সুদে ঋণ গ্রহণ করে থাকি। যেটাকে একটু ঘুরিয়ে বললেÑ আমাদের পাচার করা টাকা-ই উ”চ সুদের হারে উন্নয়ন ঋণ হিসেবে আমাদের গ্রহণ করতে হ”েছ, যা বাংলাদেশের জন্য একটি ভয়াবহতম আর্থিক বিন্যাস। পরিসংখ্যানে দেখা যায়, মোট জাতীয় ব্যয়ের ২০ ভাগ কেবল সুদ পরিশোধের জন্য ব্যবহƒত হয় (৫ জুন ২০১২, প্রথম আলো)। 
তবে কালো টাকা সাদা করলেই সমস্যার সমাধান হবে না, বরং যেসব কারণে বা উপায়ে সাদা টাকা কালো হয় সেসব কারণ বা উপায় চিহ্নিত করে যথাযথ ব্যব¯’া নিতে হবে, যাতে নতুন কোন কালো টাকা উৎপাদিত না হতে পারে। এক্ষেত্রে কিছু পদক্ষেপ নেয়া যেতে পারেÑ ১. আকস্মিক ঘন ঘন অনুসন্ধানের মাধ্যমে কালো টাকা জব্দ করা, ২. কেনাবেচায় রেকর্ড সংরক্ষণ আবশ্যিক করা, ৩. গোঁজামিল বা কর ফাঁকি প্রমাণিত হলে শাস্তি নিশ্চিত করা, ৪. সরেজমিন জরিপ করে কর প্রদানে সক্ষম সবাইকে করের আওতায় আনা। ৫. দুর্নীতি দমন কমিশন ও বিচার বিভাগ শক্তিশালী করা এবং একে সব ধরনের রাজনৈতিক প্রভাব ও সুপারিশ থেকে মুক্ত রাখা, ৬. মন্ত্রী, সংসদ সদস্য ও সরকারি আমলার বির“দ্ধে তদন্ত বা অভিযোগ দায়েরের ক্ষেত্রে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষকে সক্ষমতা ও স্বাধীনতা প্রদান করা।
দুঃখজনক হল, সরকারি প্রভাবশালী ও ক্ষমতাবান ব্যক্তিদের কাজ (ঠিকা) পাইয়ে দেয়ার ‘হাদিয়া’, নাগরিকদের চাকরি দেয়ার নামে ঘুষ আদায় ইত্যাদির মতো কালো টাকার ভারি উৎসগুলো নিয়ে তেমন উ”চবাচ্য করতে দেখা যায় না। অথচ প্রবাসী শ্রমিকদের কষ্টার্জিত টাকার প্রতি অঙ্গুলি নির্দেশ করতে আমাদের মন্ত্রী বা সমমর্যাদাসম্পন্ন ব্যক্তিদের অতি তৎপর দেখা যায়। মনে রাখা দরকার, এ অর্ধশিক্ষিত, কম শিক্ষিত শ্রমিকরা অনেক কষ্টে অর্জিত টাকা দেশে পাঠিয়ে থাকেন, যা আমাদের জাতীয় অর্থনীতির সিংহভাগ দখল করে আছে। তারা হয়তো সহজে দেশে রেমিটেন্স পাঠানোর তাগিদে অবৈধ কোন পদ্ধতি নির্বাচন করতে বাধ্য হন। এক্ষেত্রে সরকারের উদ্যোগে সহজ ও বিনা খরচে তাদের উপার্জন দেশে আনার ব্যব¯’া করা দুরূহ কোন কাজ নয়। এতে তারা আরও বেশি রেমিটেন্স পাঠাতে উৎসাহিত হবেন, দেশে কালো টাকার উৎসও বন্ধ হবে।
পরিশেষে বলা যায়, বর্তমান বিশ্ব অর্থনৈতিক মন্দার পরিপ্রেক্ষিতে কালো টাকা অলস পড়ে থাকা এবং বিদেশে পাচার বা কালো জগতে ব্যবহƒত হওয়ার চেয়ে তাকে সাদা করে আবারও বিনিয়োগের ব্যব¯’া করা সংক্রান্ত সরকারের সিদ্ধান্তটি সময়োপযোগী ও প্রাসঙ্গিক। তবে এ অনুশীলন ক্রমাগতভাবে চলতে দিলে অন্যান্য সমস্যা দেখা দিয়ে জাতীয় অর্থনীতি মুখ থুবড়ে পড়তে পারে। কালো টাকার উৎস সন্ধান করে সেগুলোর বির“দ্ধে পদক্ষেপ নেয়াই আশু কর্তব্য এবং এজন্য দরকার সরকারের সদি”ছা। তা না হলে কালো বিড়ালগুলো ধরা যাবে না, দু-একটা ধরা পড়লেও কালোই থেকে যাবে, সাদা করা আর হয়ে উঠবে না।
মুহম্মদ র“হুল আমিন : সহযোগী অধ্যাপক, আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন