ড. এ কে এম শাহনাওয়াজ
অ নেকদিন পর কাদের ভাইয়ের সাথে দেখা। কাদের ভাই বিখ্যাত কেউ নন। অতি সাধারণ ছাপোষা মানুষ। সরকারি কর্মচারী ছিলেন। সমপ্রতি অবসর নিয়েছেন। চতুর্থ শ্রেণীর কর্মচারী হিসেবে তারুণ্যের শুরুতে চাকরি নিয়েছিলেন, এখন প্রৌঢ়ত্বের ছুঁই ছুঁই বয়সে তৃতীয় শ্রেণীর কর্মচারীর মর্যাদা নিয়ে অবসর গ্রহণ করেছেন। কাদের ভাই আমার বিরুদ্ধে অভিযোগ উত্থাপন করে কথা শুরু করলেন। পত্রিকা পড়ার অভ্যাস তার আগেও ছিল। এখন অবসরে শহরের পাবলিক লাইব্রেরিতে গিয়ে অনেকগুলো কাগজ পড়েন। হয়তো পরিচয় ও সখ্যতার সূত্রে আমার কলাম ছাপা হলে তিনি মনোযোগ দিয়ে পড়েন। এ কারণেই আমার প্রতি অভিযোগ তার। বলেন- রাজনীতিকদের এত মোলায়েম ভাষায় সমালোচনা করেন কেন। কঠিন করে বকা-ঝকা দিতে পারেন না। আমি মনে মনে প্রমাদ গুণলাম। এমনিতেই সাংবাদিক কলামিস্টরা (অতি সরকার সমর্থক না হলে) সরকারি দলের নেতা আর সরকার প্রধান ও মন্ত্রী-প্রতিমন্ত্রীদের শত্রুপক্ষ। সর্ববিষয়ে সরকারের গুণকীর্তন না করায় বা সরকারের ভুলত্রুটি ধরিয়ে দেয়ায় ক্ষুব্ধতা প্রকাশ করেন তারা। বিরোধী রাজনীতিকরা চান তাদের সকল কাজে বাহবা দেই। সেখানে আরো কড়া ভাষায় লিখলে আমাদের ইহকাল-পরকাল দুটোই যে হারাতে হবে একথা কেমন করে কাদের ভাইকে বোঝাই।
কাদের ভাই আমাকে বললেন- মুক্তিযুদ্ধের সময় রাজাকার আর পাকসেনাদের অনেক অত্যাচার সয়েছে আপনাদের পরিবার। আপনাদের সহায়-সম্পত্তি ধ্বংস হয়েছে। আজ মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের রাজনৈতিক দল সরকার পরিচালনা করছে। এই সরকারকে সুপথ দেখানোর দায়িত্ব তো আপনারই। নরম ভাষা এরা বুঝে না, তাই শক্ত কথাই বলতে হবে। এতক্ষণে কাদের ভাইয়ের আসল বক্তব্য বুঝতে পারলাম। কাদের ভাই মুক্তিযোদ্ধা ছিলেন। সরাসরি যুদ্ধ করেছেন। কিন্তু তার কোনো সার্টিফিকেট নেই। এজন্য তার মনে কোনো কষ্টও নেই। এই সাদা মনের মানুষটির ভাষায়: দেশ স্বাধীন করা ছাড়া কোনো কিছু পাওয়ার জন্য তিনি মুক্তিযুদ্ধ করেননি। তাই সার্টিফিকেটের মূল্য তার কাছে নেই।
সারাটা জীবন কাদের ভাই আর্থিক কষ্টে কাটিয়েছেন। এখন পেনশনের টাকা আর প্রাইভেট কোম্পানিতে কেরানীর কাজ করা বড় ছেলেটির আয়ে টেনে-টুনে সংসার চালান। তিনি বলেন- একই মানের কেনাকাটায় প্রতিমাসে বাজেট ঘাটতি হচ্ছে আর সরকারের বড়-ছোট মালিকরা প্রতিদিন বলে বেড়াচ্ছেন- মানুষ তেমন কষ্টে নেই। তারা কোন স্বর্গে বাস করেন বলতে পারবেন? রসিক কাদের ভাই নিজেই উত্তর দিয়ে বললেন- এই গরমে আমাদের যখন হাঁস-ফাঁস তখন অনেক মন্ত্রী আর বিরোধী দলের কোনো কোনো নেতা যখন স্যুট-টাই পরে ঘুড়ে বেড়ান তখন বুঝা যায় নিচের দিকে তাকানোর ফুরসত্ নেই। নিজেদের ভালো থাকা দেখে দেশবাসীর সুখ খুঁজে নিয়েছেন।
কাদের ভাই আরো অনেক বিষয়ে তার আক্ষেপ প্রকাশ করলেন। বললেন তারা সুখী বাংলাদেশ গড়ার স্বপ্নে দেশ স্বাধীন করলেন আর অসত্ রাজনীতিকদের হাতে ভেঙ্গে খান খান হচ্ছে সকল সুখ-স্বপ্ন। আমি কেন—আমার মত দলান্ধ নন এমন মুক্তমনের সকলেই কাদের ভাইয়ের অনুভবকে সমর্থন দেবেন। আমাদের মনে হয় রাষ্ট্রক্ষমতায় থাকা ও ক্ষমতা কেন্দ্রের দিকে ছুটে বেড়ানো অধিকাংশ রাজনীতিকই এখন ছন্দ হারিয়ে সাধারণ মানুষের আস্থার জায়গা থেকে অনেকটা দূরে সরে গেছেন। মানুষ বিশ্বাস করতে চায় রাজনীতিতে এখন আর গণতন্ত্র চর্চা নেই। কঠিন দলতন্ত্র সকল অন্যায়কে প্রশ্রয় দিতে বাধ্য হচ্ছে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ক্ষমতায় আসার পরপর যখন বিএনপি ও বিএনপি নেত্রীর সমালোচনা করতেন তখন তাতে অনেক মানুষই খুশি হতো। তিনি তারেক-কোকোর দুর্নীতি আর মানি লন্ডারিংয়ের কথা বলতেন। প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রীর কালো টাকা সাদা করার কথা বলতেন। মানুষ হাততালি দিয়ে বলতো- উচিত কথা বলেছেন প্রধানমন্ত্রী। পাশাপাশি এ ধারার সমালোচনা শুনে মানুষ মনে করেছিল এবার কালো মেঘ কেটে সুদিন আসবে। আওয়ামী লীগের দিন বদলের স্লোগান বাস্তবায়িত হবে। দুর্নীতির কবর বুঝি রচিত হলো। কিন্তু আওয়ামী লীগের সরকার পরিচালনার সাড়ে তিন বছর পর প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা যখন একইভাবে বেগম জিয়া আর তাঁর পুত্রদের দুর্নীতির কথা গণমাধ্যমে বলেন, তখন সচেতন মানুষের মনে ভিন্ন প্রতিক্রিয়া তৈরি হয়। হয়তো ব্যক্তি হাসিনা ব্যক্তি খালেদা জিয়া ও তাঁর পরিবারের মত অসত্ হিসেবে পরিচিত হননি। কিন্তু তাতে কি আর যায় আসে। তিনি সরকার আর দলের পরিচালক। সর্বময় ক্ষমতার অধিকারী। দুর্নীতির বাড়বাড়ন্তকে তিনি থামাতে পেরেছেন ? পদ্মা সেতু থেকে নানা পর্যায়ে এই আমলের দুর্নীতির খবর আন্তর্জাতিক প্রচার পেয়েছে। বিএনপি আমলের দলীয়করণের কুদৃষ্টান্ত এখন আরো প্রবলভাবে প্রতিষ্ঠিত। প্রশাসন পরিচালনার অদক্ষতা পদে পদে সংকটে ফেলছে দেশটিকে। গণতন্ত্ররক্ষীদের হাতে গণতন্ত্র বিপন্ন হচ্ছে। যে সাংসদরা সংসদে যাওয়ার দায়িত্ব পালন করেন না, সংসদে কোরাম সংকট ঘটান, সংসদে অনুপস্থিত থাকার জন্য মাননীয় প্রধানমন্ত্রীকে উষ্মা প্রকাশ করতে হয়। নির্বাচিত এলাকায় যাদেরকে ভোটাররা নানা নিদানে খুঁজে পান না। সাংসদের অহমিকায় জনগণের ওপর পিস্তল তাক করেন। চাকরি দেয়ার নামে ঘুষ নেয়ার কথা পত্রিকায় ছাপা হয়।
তাদের প্রতিনিধি বিবেক জাগানিয়া সাংসদরা এসবের জন্য আত্মসমালোচনা বা ধিক্কার জানান না সংসদে। গণতান্ত্রিক চেতনায় তাড়িত হয়ে মানুষের কাছে ক্ষমা প্রার্থনা করেন না। আবার আমার শিক্ষক সর্বজনশ্রদ্ধেয় আবদুল্লাহ আবু সাইয়িদ স্যারের বক্তব্যের অপব্যাখ্যা খুঁজে বের করে তাঁকে সংসদে লাঞ্ছিত করার মত ধৃষ্টতা দেখান, সামান্য সৌজন্য ও সম্ভ্রমবোধ কাজ করে না। মাননীয় ডেপুটি স্পিকার মহোদয় উদারতা দিয়ে দুঃখ প্রকাশ করায় অতি স্পর্শকাতর সাংসদদের দায় অনেকটা লাঘব করে আমাদের বাঁচিয়ে দিয়েছেন। এজন্য তাঁর প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করছি। সাংসদরা জনগণের ভোটে নির্বাচিত। তাঁরা সম্মানিত। সাংবিধানিকভাবে ক্ষমতাবান। কিন্তু গণতান্ত্রিক বোধ নিয়ে ভাবা প্রয়োজন তাঁদের যারা ক্ষমতাবান করেছে তারা জনগণ। তাই সবচেয়ে বড় ক্ষমতাবান সাধারণ মানুষ। জনগণকে খাটো করার অধিকার কারো নেই।
রাজনীতি শব্দটি এবং এর অবয়ব বরাবরই ইতিবাচক। রাজনীতির হাত ধরে মানুষ তার মুক্তি খোঁজে। সেই রাজনীতির নৌকোর হাল যদি ভেঙ্গে যায় তবে নাবিকরা তো দিশেহারা হতেই পারেন। দলীয় রাজনীতি থেকে মানুষের রাজনীতিতে রূপান্তর করতে ব্যর্থ হয়ে তাই হালভাঙ্গা নাবিকেরা আজ হতাশ। এ কারণেই হতাশ বিরোধী দল নিয়মতান্ত্রিক আন্দোলন শানাতে ব্যর্থ হচ্ছে। দেশজুড়ে ডেকে আনছে অরাজকতা। সরকারি দল ও সরকার পরিচালকরা সুশাসন প্রতিষ্ঠা করতে ব্যর্থ হচ্ছেন। নির্বাচন পদ্ধতি নিয়ে এখনো দু’পক্ষ দু’মেরুতে অটল। এই অবস্থা সংঘাতের পথকে কেবল পাকা করছে। আর গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার পথকে করছে সুদূরপরাহত।
শুনেছি দুঃখের রাত একদিন কেটে যায়। সুখের সূর্য আকাশে ওঠে। এদেশের বিপন্ন মানুষ এসব শুনে আশাবাদী হতে চায়। তবে রাজনীতিকদের চলমান গড়ন দেখে খুব বেশি ভরসা করতে পারে না। অবশ্য আমার মত আশাবাদী মানুষরা এখনো মনে করি দেশপ্রেমের সুপ্ত অনুভূতির তাড়নায় একদিন নিশ্চয়ই বোধোদয় হবে রাজনীতির দণ্ডমুণ্ডের কর্তাদের।
n লেখক: অধ্যাপক, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়
shahnawazju@yahoo.com
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন