॥ সাদ সাকলান ॥
পুলিশের আইজি পদের মর্যাদা এক ধাপ (নাকি কয়েক ধাপ!) বৃদ্ধির কয়েক মাসের মধ্যে পুলিশের ভাবমূর্তি নিয়েও আবার প্রশ্ন দেখা দিয়েছে। এমনটি মাঝে মাঝেই হয়। কাগজে-কলমে আর পাঁচটি অধিদফতরের সাথে এর বিশেষ পার্থক্য নেইÑ ফলে অন্যান্য অধিদফতরের প্রধানগণ, বিশেষত ক্যাডার সার্ভিসের শীর্ষপদে আসীন ব্যক্তিরা সিনিয়র সচিব না হলেও সচিবের মর্যাদা চাইতেই পারেন। কৃষি ক্যাডার আমাদের অন্ন জোগায়, কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতরের ডিজি সচিবের মর্যাদা চাইতে পারেনÑ পাবেন কি না সেটা নির্ভর করে কতটা প্রেসার দিতে পারবেন, ঠিক তার ওপর, কিংবা সরকার তাকে নিজের কাজে কতটা গুরুত্বপূর্ণ মনে করে তার ওপর। আইজির পদকে সিনিয়র সচিব পদে উন্নীতকরণ থেকে সে রকমই মনে হয়। আশপাশের দেশে একজন হেড অব ডিপার্টমেন্টকে এই মর্যাদা দেয়ার নজির আছে কি না তা ওয়েবসাইটে দেখা যেতে পারে। যদিও পুলিশের দাবি ছিলÑ তিন বাহিনীর মতো পুলিশের প্রধানকে হেড অব পুলিশ হিসেবে উল্লেখ করা, হয়নি তা; হয়ে যাবে হয়তো। আরো দাবি ছিলÑ অন্তত দশটি সচিবতুল্য পদ। সেটিও বিবেচনাধীন বলে জানা যায়। জরুরি আইনের সময়ে সংস্কারের জন্য কিছু সুপারিশ প্রণয়ন করা হয়েছিল ইউএনডিপির অর্থে। কাজটি সম্পন্ন করেছিলেন কয়েকজন সাবেক আইজিপি, অনেক টাকার কনসালটেশন ছিল সেটি। কিন্তু দাবি সরকারের মনঃপূত হয়নি। খসড়া আইনে বলা হয়েছিলÑ এই আইন পুলিশ প্রধানের লিখিত অনুমতি ছাড়া সংশোধন করা যাবে নাÑ অর্থাৎ সরকারেরও ওপরে হেড অব পুলিশ। আরো ছিলÑ সচিব, মন্ত্রী, মন্ত্রণালয় কেউ পুলিশকে নিয়ন্ত্রণ করবে না। ভোটে জিতে আসা জনপ্রতিনিধিরা এটি কেন মানবেন! কারো কথাই যদি না শোনে, তবে রাজনৈতিক সরকার তাদের পুষবে কেন। তাই সেটি পাস হয়নি। যদিও জরুরি আইনের সময়ে বেশি আপন হতে গিয়ে তৎকালীন আইজিপি রাজনীতিকদেরও সমালোচনা করেছেনÑ এ নিয়ে সে সময় সম্পাদকীয় লিখেছিল কোনো কোনো কাগজ। কিছুই হয়নি।
পুলিশের ওপরের দিকে সুযোগ-সুবিধা বৃদ্ধি প্রকৃতপে বেশির ভাগ পুলিশের পে যায় না এবং দেখা গেছে সুযোগ-সুবিধা বৃদ্ধি স্বভাবের পরিবর্তন আনতে পারে না। সেটি কেবল পুলিশ নয়, এ দেশে সবার জন্য প্রযোজ্য। পুলিশের েেত্র দেখা গেছে, ওপরের দিকে বর্ধিত সুবিধা নিচের দিকে যায় না। কম পয়সায় তেল-চিনি-চালের সুযোগ কনস্টেবল থেকে ইনসপেক্টরের চেয়ে এএসপি থেকে আইজি অবধি বেশি যাচ্ছে। আদতে এএসপি থেকে আইজি পুলিশ নয়, তারা সিভিল সার্ভিসের সদস্য। সিভিল সার্ভিসের সদস্য হয়ে তারা রেশন পেলে কলেজের শিক কিংবা সমবায় ক্যাডারের কর্মকর্তাদের দোষ কোথায়! এ কথা বলার তাৎপর্য এই যে, কনস্টেবল থেকে ইন্সপেক্টর হচ্ছে পুলিশ। তাদের জন্য বিধিবিধানও ভিন্ন। এই স্তরের মানুষেরা যে কষ্ট করে, তা সবারই জানা। তাদের পদ-পদোন্নতি এবং সুযোগ-সুবিধা আরো বৃদ্ধি করা প্রয়োজন। কিন্তু হয় উল্টোটা। যে বরিশাল কিংবা সিলেট শহর একজন ওসি দিয়ে চলত। তাতে ডিআইজি, এডিআইজি, এআইজি ইত্যাকার ক্যাডার পদ কতগুলো বেড়েছে তা একটু হিসাব করলেই চোখে ভেসে উঠবে যে, ওপরের দিকে পদ কতটা বেড়েছে। লণীয়, আমাদের আইজিরা তাদের ক্যাডার নিয়ে যতটা চিন্তিত, ততটা সাধারণ পুলিশ নিয়ে নয় হয়তো। অনেক আগেই বলা হয়েছিলÑ থানায় তিন-চারটে ইনসপেক্টরের পদ সৃজনের; সিনিয়রজন ওসি হবেন, এরপর সেকেন্ড অফিসার, থার্ড অফিসার ইত্যাদিÑ যেভাবে তিনজন সাব-ইন্সপেক্টর ছিল থানায়। এই দাবি খুবই যৌক্তিক ছিল আর তাতে সহস্র সাব-ইনসপেক্টরের পদোন্নতির দ্বার উন্মুক্ত হতে পারত। কিন্তু তা হয় না। কারণ তারা তো মন্ত্রী, প্রধানমন্ত্রী অবধি যেতে পারেন না। পুলিশ সপ্তাহেও নিজেদের মতো করে বলতে পারেন না। ফলে যে পুলিশ প্রকৃতপে মাঠে-ময়দানে কাজ করে, তাদের ােভ প্রশমিত হয় না। মাঝে মধ্যে যে স্খলন তা এই ােভ থেকে কি না তাও ভেবে দেখার ব্যাপার।
স্বল্প বেতনের কারণে দুর্নীতিÑ তা কয়েকটি কারণের মধ্যে সবচেয়ে গৌণ। নিচের দিকে কম বেতন বলে দুর্নীতি হলে বড় সাহেবেরা এসব করে কেন! আর পদের মর্যাদা বৃদ্ধি যদি মানুষকে দায়িত্বশীল করে তোলে, তবে এএসপি থেকে আইজি পদকে আরো বেশি মর্যাদা দিতে আপত্তি কোথায়! সমস্যাটি অন্যত্র। বিশ্ববিদ্যালয়ের নামী ছাত্ররা পুলিশ-কাস্টম-কর-প্রশাসন-সাবরেজিস্ট্রার পদে যোগ দিয়ে একটি বছরও অপো করে না। মর্যাদা কিংবা সুযোগ-সুবিধা বৃদ্ধি কি এদের এ জায়গা থেকে একচুল নড়াতে পারবে? তা হলে কাস্টম ও করের ইন্সপেক্টরদের মর্যাদা বাড়িয়ে একটু পরীা করে দেখা যায়। তহশিলদারকে প্রথম শ্রেণীর অফিসার করে দিলে দুর্নীতি বন্ধ হবে, তা মনে করার কারণ দেখি না। পুলিশ ও কাস্টমসের কর্মকর্তারা ক্যাডারে যোগ দিয়েই নানা সুবিধা পেয়ে যান। বাবরীয় আমলে এক মাসে কয়েক শ’ গাড়ি কেনা হয়েছে পুলিশের জন্য। পুলিশের পদ বৃদ্ধির অবিশ্বাস্য দ্রুততা আলাদিনের আশ্চর্য প্রদীপকেও হার মানায়। বাংলাদেশে অন্য কোনো ডিপার্টমেন্টে এত দ্রুত অফিস আর পদ বৃদ্ধির নজির নেই। প্রধানমন্ত্রী চাইলেও হয় না।
কিন্তু লাভটা কী? এই যে চাইতেই নতুন থানা, মেট্রোপলিটান পুলিশ, হাইওয়ে পুলিশ, শিল্প পুলিশ, ডিসির পদ বৃদ্ধি, দশটি সচিবের মর্যাদা, আইজির জন্য পতাকা কিংবা আরো মর্যাদা বৃদ্ধিÑ এ দেশের মানুষের জন্য কী এনেছে, সেটা দেখতে হবে। দেশের মানুষের সংখ্যা, অপরাধপ্রবণতা ইত্যাদি বিবেচনায় আরো পুলিশ চাই, এই প্রত্যয়ের সাথে দ্বিমত নেই Ñএখানে প্রশ্ন আছে। রাস্তায় দায়িত্ব পালনের জন্য প্রয়োজনীয় পুলিশ নেই, থানায় থানায় পুলিশের সংখ্যা বৃদ্ধি করাও দরকার, কিন্তু জেলায়-বিভাগে এত রিজার্ভ ফোর্স কী জন্য? অফিসারদের বাসায়, গাড়িতে, বাগানের কাজে, স্কুলে বাচ্চা পাঠাতে, মেমসাহেবের সাথে বাজারে যেতে কিন্তু পুলিশের ঘাটতি নেই। কিন্তু দিন দিন পুলিশ মানুষের আস্থা হারাচ্ছে। মানুষ পুলিশকে বন্ধু ভাবা তো দূরের কথা, অতি প্রয়োজনে নির্ভরও করতে পারছে না। আরো ভয়াবহ যে, নির্ভর করতে ভয় পাচ্ছে। ঢাকা কিংবা অন্য কোনো বড় শহরে প্রতিদিন যতগুলো ছিনতাই হচ্ছে তার ক’জন থানামুখী হয়Ñ এই প্রশ্ন দিয়েই শুরু করা যায়। মজার ব্যাপার হচ্ছে, থানায় মামলা না হলেই আইনশৃঙ্খলা ভালো বলে ব্রিটিশীয় তত্ত্ব আজো বহাল আছে। ফলে থানা পুলিশ মামলা রেকর্ড করতে আগ্রহী হয় না। এর মধ্যেই শুভঙ্করের ফাঁকিটা লুকিয়ে আছে। একটি থানার আইনশৃঙ্খলা ‘ভালো হয়’ মামলা কম হলেÑ সংঘটিত অপরাধের গুরুত্ব আর সংখ্যার ওপরে নয়। আবার সংঘটিত অপরাধ থানা ছাড়া অন্যত্র রেকর্ড করার বিধান নেইÑ আছে আদালত, সেটি আরো ভেজালের, হয়রানির। থানা কিংবা আদালত ব্যতিরেকে যদি নিরপে কোনো ভেন্যু থাকত, যেখানে চুরি, ছিনতাই এসবের রেকর্ড হতো, তবেই বোঝা যেত দেশের আইনশৃঙ্খলার প্রকৃত চিত্র। পুলিশের বিরুদ্ধে অভিযোগ দায়েরেরও ভিন্ন কোনো জায়গা নেই। পুলিশের ভাগ্য ভালোÑ এখনো এই দাবি কেউ করেনি। তা হলে বেসরকারি মানবাধিকার সংগঠনের সাথে ক্রসফায়ার ও গুম নিয়ে সরকারের যে হিসাবের গরমিল হচ্ছে, ঠিক সেটিই পুলিশের সাথে হতো। এটা অবশ্য সহায়ক হতো আমাদের পুলিশের পারঙ্গমতা বুঝতে।
সাম্প্রতিক এবং নিকট অতীতে পুলিশের কিছু কার্যক্রম পর্যালোচনায় দেখা যায়, তাজউদ্দিনের ভাগ্নে পরিচয়ের পর মারটা যেন বেশিই হয়েছে। পুলিশের কাছে পরিচয় দিয়েও রেহাই নেই। কী জানি, কবে আবার তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক কোনো উপদেষ্টা, বর্তমান কিংবা ভূতপূর্ব সচিব মার খান! পরিচয় না পেলে পুলিশের হাল ডিআইজিও মার খেতে পারেন। হরতালের কিংবা রাজনৈতিক কর্মসূচির সময়ে সাধারণ পথচারীও বাদ যায় না। কী অদ্ভুত! মোদ্দা কথা রাস্তায় কেউ আর নিজেকে নিরাপদ মনে করে না। এই নিরাপত্তাবোধ কেবল সড়ক দুর্ঘটনা আর ছিনতাই ইত্যাদি নয়, বরং পুলিশের হাতে নিগৃহীত হওয়ার আশঙ্কা ও ভয়। অথচ রাস্তায় পুলিশই বড় সহায়ক হওয়ার কথা ছিল। সাংবাদিক সম্প্রতি মার খেয়েছে বলে কাগজ আর টিভি চ্যানেল এখন মুখর। পুলিশের হাতে এমন মার খাওয়ার ঘটনা প্রতিদিন সারা দেশে ঘটছে। বহু মানুষ অকারণে পুলিশের মারে সারা জীবন দুঃসহ ত বয়ে বেড়াচ্ছেÑ সেই মানুষেরা, তাদের আত্মীয়রা পুলিশকে মানুষ বলার চেয়ে পুলিশ বলতেই আগ্রহ দেখাবে। কিন্তু এই সংখ্যাটা বেড়েই চলছে, ফলে পুলিশ হয়তো মানুষ হওয়ার সুযোগটা হারাবে। দ্বিতীয়ত, মিথ্যাÑ বিশেষ করে ডাকাতি মামলায় এই দেশে কত মানুষ অকারণে জেলহাজতে আছে তা নিয়ে গবেষণা হতে পারে। পুলিশি মারের ও হয়রানির এ উদাহরণ বাড়িয়ে লাভ নেই, কাগজ খুললেই দেখা যায়। আবার মামলা করতে গেলে নানা হয়রানি। এমনিতেই অনেকে আমলযোগ্য অপরাধের বিচারের জন্যও থানা কিংবা কোর্টে যেতে চান না। যারা যান তারা দায়ে পড়েই যান কিন্তু সহজে মামলা দায়ের করতে পারেন না। গুরুতর মামলায় কেবল জিডি করেই ফিরতে হয় অনেককে, এই চিত্র বেড়েই যাচ্ছে যেন। মানুষের ধারণাÑ পুলিশ থেকে আইনানুগ সহায়তা পেতে ঊর্ধ্বতন অফিসারের ফোন নতুবা অন্য কোনো রেফারেন্সই একমাত্র ভরসা। ঢাকার বড় পুলিশ অফিসারেরা নিজ জেলায় নিজের পরিচয় না দিয়ে মামলার জন্য থানায় গিয়ে দেখতে পারেন, থানায় পাঠাতে পারেন একজন আপ্তজনকে।
পুলিশ রেগুলেশন ও ফৌজদারি কার্যবিধিতে সাধারণ মানুষের সাথে আচরণের অনুশাসন দেয়া আছেÑ জিজ্ঞাসাবাদের ধরন, গ্রেফতারের পদ্ধতি ইত্যাদি। প্রযোজ্য েেত্র কেবল লাঠিচার্জ করার কথা থাকলেও মারমুখী পুলিশের চেহারাটাই চোখে বারবার ভেসে আছে। শত শত মানুষ মার খেলে কিংবা পুলিশের হাতে নিগৃহীত হলে দোষের কিছু নেই, মামলাও হবে না। একজন পুলিশ মার খেলে কিংবা সামান্য আহত হলে শত মানুষের বিরুদ্ধে মামলা হবে, এমনকি একটি গ্রাম পুরুষশূন্য হয়ে পড়বে। একজন পুলিশ আহত হলে মন্ত্রীও তাকে দেখতে যান, অবশ্য এটি হওয়া উচিত। কিন্তু একের অধিক সাধারণ মানুষ পুলিশের হাতে মার খেলে কিংবা পুলিশের অত্যাচারে মরে গেলেও কোনো কর্তাব্যক্তিকে দেখা যায় নাÑ এমনই এক দুর্ভাগ্য আম-আদমীর! এখন রাস্তাঘাটে পুলিশ যেন কাউকে সম্মানও করতে চায় না। আচরণে এতটা বেপরোয়া ঠিক অতীতে দেখা যায়নি। অথচ এ নিয়ে কোনো ব্যবস্থাও নেয়া হয় না। হ্যাঁ, বলা হবে পরিসংখ্যান দিয়েÑ প্রতি বছর এত এত পুলিশের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া হয়েছে; হয়তো হচ্ছেও, কিন্তু পুলিশের আচরণের পরিবর্তন নেই। ফলে মানুষের আস্থা আর নির্ভরতা দিন দিন হ্রাস পাচ্ছে জাতীয় এই বাহিনীর ওপর।
পুলিশে ভালো মানুষের অভাব আছে তা মনে করার কারণ নেই। পুলিশের ভালো কাজের ফিরিস্তি অনেক দীর্ঘ। অপহরণের ২৪ কিংবা ৪৮ ঘণ্টার মধ্যে ভিকটিম উদ্ধার কিংবা ভিকটিমসহ আসামি ধরা, ডাকাতির কয়েক ঘণ্টার মধ্যে বমাল ডাকাত ধৃত, খুনিদের দ্রুত পাকড়াওÑ এমন উদাহরণ অনেক। আন্তর্জাতিক েেত্র আমাদের পুলিশ যে সুনামের ভাগীদার, তাতে এ জাতি গর্ববোধ করতে পারে। কিন্তু এসব অসংখ্য ভালো ভালো নজির মাঝে মাঝে বেশ ম্লান হয়ে পড়ে।
আমি ভালো অফিসারদের দু’টি দৃষ্টিগ্রহ্য বিষয় ল করেছি। প্রথমতÑ কোনো কিছু না ভেবেই অধস্তনদের রায় নেমে পড়া। দ্বিতীয়তÑ সাব-ইন্সপেক্টর আর ইন্সপেক্টর লেভেলের সব কথা নিশ্চিন্তে মেনে নেয়া, হোক সেটা উন্নত মানের ভালো গল্প। কোতোয়ালি এলাকায় যেটি ঘটলÑ সব কিছু না জেনে এডিসি টিভিতে বলেই দিলেন ওদের বাড়াবাড়ি; এখন যে মামলা হলো, তদন্তে দোষী সাব্যস্ত হতে চলছে কিংবা সাসপেন্ডও হয়েছেÑ এডিসি এখন কী বলবেন! দিনাজপুরে দু’জন পুলিশকে বাঁচাতে কী সব ঘটে গেল, কত নাটকের অবতারণা করলেন সেই সময়ের পুলিশ সুপার। না অপরাধী পুলিশদের বাঁচানো গেল, না নিজে বাঁচলেন। কিংবা চট্টগ্রামের সীমাÑ কষ্ট লাগে পুলিশ এসব থেকে কোনো শিাই নিচ্ছে না। তিনজন আলোকচিত্রী অকারণে মার খেল। প্রথমে মামলা নিলে এবং দোষীদের বিরুদ্ধে তাৎণিক ব্যবস্থা নিলে অনেক শোভনীয় হতো, সঠিক দায়িত্ব পালনেরও পরিচায়ক হতো। যখন পুলিশ আর সাধারণ মানুষ প্রতিপ হয় তখন ভালো অফিসারও পুলিশের প নেন। অধস্তনদের প নেয়াটাই স্বাভাবিক। কিন্তু দেখতে হবে বাস্তবে কী হয়েছে। সিভিল ড্রেসে একান্ত বিশ্বস্ত কাউকে নবাবগঞ্জের একটি ট্রাকে বসিয়ে দিলেই তো হয়। বেশির ভাগ মানুষের ধারণা, সব ধরনের চাঁদাবাজি, মাদক বিক্রি কিংবা অপরাধের সাথে একশ্রেণীর পুলিশ জড়িত কিংবা ওয়াকিবহাল।
সম্প্রতি কয়েকটি ঘটনায় পুলিশ আবারো ভাবমূর্তি সঙ্কটে, তা বলার অপো রাখে না। মাঝে মাঝে এমন হচ্ছে। দার্শনিক রবীন্দ্রনাথ সেই সময়ের পুলিশ দেখে বলেছিলেন, ‘উহাদের লালায় বিষ আছে।’ তখন দেশ পরাধীন ছিল। অনেক সময় পেরিয়েছে। আমাদের তরুণ, প্রতিশ্র“তিশীল এবং সৎ-মেধাবী বলে পরিচিত পুলিশেরা কী এত দিন পরও রবীন্দ্রনাথের সেই উক্তিকে মিথ্যা প্রতিপন্ন করে দিতে পারেন না! একটি গণতান্ত্রিক দেশে পুলিশের যে ভাবমূর্তি থাকা আবশ্যক, আমরা তার জন্য অধীর আগ্রহে অপো করে আছি। কিন্তু সরকারের তরফে কখনোই তেমন ভূমিকা দেখা যায় না; বরং ইদানীং হাইকোর্টের ভূমিকায় কিছু প্রতিকার দেখতে পাওয়া যায়।
পুলিশের হাতে আইনও আছে, লাঠি-অস্ত্রও আছে। তাই তাদের নিয়ন্ত্রণে আরো বেশি মনোযোগী হওয়া প্রয়োজন। এ জন্য নানা উপায় ভেবে দেখতে হবে আর কাজটা দ্রুত শুরু করা দরকার।
পুলিশের আইজি পদের মর্যাদা এক ধাপ (নাকি কয়েক ধাপ!) বৃদ্ধির কয়েক মাসের মধ্যে পুলিশের ভাবমূর্তি নিয়েও আবার প্রশ্ন দেখা দিয়েছে। এমনটি মাঝে মাঝেই হয়। কাগজে-কলমে আর পাঁচটি অধিদফতরের সাথে এর বিশেষ পার্থক্য নেইÑ ফলে অন্যান্য অধিদফতরের প্রধানগণ, বিশেষত ক্যাডার সার্ভিসের শীর্ষপদে আসীন ব্যক্তিরা সিনিয়র সচিব না হলেও সচিবের মর্যাদা চাইতেই পারেন। কৃষি ক্যাডার আমাদের অন্ন জোগায়, কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতরের ডিজি সচিবের মর্যাদা চাইতে পারেনÑ পাবেন কি না সেটা নির্ভর করে কতটা প্রেসার দিতে পারবেন, ঠিক তার ওপর, কিংবা সরকার তাকে নিজের কাজে কতটা গুরুত্বপূর্ণ মনে করে তার ওপর। আইজির পদকে সিনিয়র সচিব পদে উন্নীতকরণ থেকে সে রকমই মনে হয়। আশপাশের দেশে একজন হেড অব ডিপার্টমেন্টকে এই মর্যাদা দেয়ার নজির আছে কি না তা ওয়েবসাইটে দেখা যেতে পারে। যদিও পুলিশের দাবি ছিলÑ তিন বাহিনীর মতো পুলিশের প্রধানকে হেড অব পুলিশ হিসেবে উল্লেখ করা, হয়নি তা; হয়ে যাবে হয়তো। আরো দাবি ছিলÑ অন্তত দশটি সচিবতুল্য পদ। সেটিও বিবেচনাধীন বলে জানা যায়। জরুরি আইনের সময়ে সংস্কারের জন্য কিছু সুপারিশ প্রণয়ন করা হয়েছিল ইউএনডিপির অর্থে। কাজটি সম্পন্ন করেছিলেন কয়েকজন সাবেক আইজিপি, অনেক টাকার কনসালটেশন ছিল সেটি। কিন্তু দাবি সরকারের মনঃপূত হয়নি। খসড়া আইনে বলা হয়েছিলÑ এই আইন পুলিশ প্রধানের লিখিত অনুমতি ছাড়া সংশোধন করা যাবে নাÑ অর্থাৎ সরকারেরও ওপরে হেড অব পুলিশ। আরো ছিলÑ সচিব, মন্ত্রী, মন্ত্রণালয় কেউ পুলিশকে নিয়ন্ত্রণ করবে না। ভোটে জিতে আসা জনপ্রতিনিধিরা এটি কেন মানবেন! কারো কথাই যদি না শোনে, তবে রাজনৈতিক সরকার তাদের পুষবে কেন। তাই সেটি পাস হয়নি। যদিও জরুরি আইনের সময়ে বেশি আপন হতে গিয়ে তৎকালীন আইজিপি রাজনীতিকদেরও সমালোচনা করেছেনÑ এ নিয়ে সে সময় সম্পাদকীয় লিখেছিল কোনো কোনো কাগজ। কিছুই হয়নি।
পুলিশের ওপরের দিকে সুযোগ-সুবিধা বৃদ্ধি প্রকৃতপে বেশির ভাগ পুলিশের পে যায় না এবং দেখা গেছে সুযোগ-সুবিধা বৃদ্ধি স্বভাবের পরিবর্তন আনতে পারে না। সেটি কেবল পুলিশ নয়, এ দেশে সবার জন্য প্রযোজ্য। পুলিশের েেত্র দেখা গেছে, ওপরের দিকে বর্ধিত সুবিধা নিচের দিকে যায় না। কম পয়সায় তেল-চিনি-চালের সুযোগ কনস্টেবল থেকে ইনসপেক্টরের চেয়ে এএসপি থেকে আইজি অবধি বেশি যাচ্ছে। আদতে এএসপি থেকে আইজি পুলিশ নয়, তারা সিভিল সার্ভিসের সদস্য। সিভিল সার্ভিসের সদস্য হয়ে তারা রেশন পেলে কলেজের শিক কিংবা সমবায় ক্যাডারের কর্মকর্তাদের দোষ কোথায়! এ কথা বলার তাৎপর্য এই যে, কনস্টেবল থেকে ইন্সপেক্টর হচ্ছে পুলিশ। তাদের জন্য বিধিবিধানও ভিন্ন। এই স্তরের মানুষেরা যে কষ্ট করে, তা সবারই জানা। তাদের পদ-পদোন্নতি এবং সুযোগ-সুবিধা আরো বৃদ্ধি করা প্রয়োজন। কিন্তু হয় উল্টোটা। যে বরিশাল কিংবা সিলেট শহর একজন ওসি দিয়ে চলত। তাতে ডিআইজি, এডিআইজি, এআইজি ইত্যাকার ক্যাডার পদ কতগুলো বেড়েছে তা একটু হিসাব করলেই চোখে ভেসে উঠবে যে, ওপরের দিকে পদ কতটা বেড়েছে। লণীয়, আমাদের আইজিরা তাদের ক্যাডার নিয়ে যতটা চিন্তিত, ততটা সাধারণ পুলিশ নিয়ে নয় হয়তো। অনেক আগেই বলা হয়েছিলÑ থানায় তিন-চারটে ইনসপেক্টরের পদ সৃজনের; সিনিয়রজন ওসি হবেন, এরপর সেকেন্ড অফিসার, থার্ড অফিসার ইত্যাদিÑ যেভাবে তিনজন সাব-ইন্সপেক্টর ছিল থানায়। এই দাবি খুবই যৌক্তিক ছিল আর তাতে সহস্র সাব-ইনসপেক্টরের পদোন্নতির দ্বার উন্মুক্ত হতে পারত। কিন্তু তা হয় না। কারণ তারা তো মন্ত্রী, প্রধানমন্ত্রী অবধি যেতে পারেন না। পুলিশ সপ্তাহেও নিজেদের মতো করে বলতে পারেন না। ফলে যে পুলিশ প্রকৃতপে মাঠে-ময়দানে কাজ করে, তাদের ােভ প্রশমিত হয় না। মাঝে মধ্যে যে স্খলন তা এই ােভ থেকে কি না তাও ভেবে দেখার ব্যাপার।
স্বল্প বেতনের কারণে দুর্নীতিÑ তা কয়েকটি কারণের মধ্যে সবচেয়ে গৌণ। নিচের দিকে কম বেতন বলে দুর্নীতি হলে বড় সাহেবেরা এসব করে কেন! আর পদের মর্যাদা বৃদ্ধি যদি মানুষকে দায়িত্বশীল করে তোলে, তবে এএসপি থেকে আইজি পদকে আরো বেশি মর্যাদা দিতে আপত্তি কোথায়! সমস্যাটি অন্যত্র। বিশ্ববিদ্যালয়ের নামী ছাত্ররা পুলিশ-কাস্টম-কর-প্রশাসন-সাবরেজিস্ট্রার পদে যোগ দিয়ে একটি বছরও অপো করে না। মর্যাদা কিংবা সুযোগ-সুবিধা বৃদ্ধি কি এদের এ জায়গা থেকে একচুল নড়াতে পারবে? তা হলে কাস্টম ও করের ইন্সপেক্টরদের মর্যাদা বাড়িয়ে একটু পরীা করে দেখা যায়। তহশিলদারকে প্রথম শ্রেণীর অফিসার করে দিলে দুর্নীতি বন্ধ হবে, তা মনে করার কারণ দেখি না। পুলিশ ও কাস্টমসের কর্মকর্তারা ক্যাডারে যোগ দিয়েই নানা সুবিধা পেয়ে যান। বাবরীয় আমলে এক মাসে কয়েক শ’ গাড়ি কেনা হয়েছে পুলিশের জন্য। পুলিশের পদ বৃদ্ধির অবিশ্বাস্য দ্রুততা আলাদিনের আশ্চর্য প্রদীপকেও হার মানায়। বাংলাদেশে অন্য কোনো ডিপার্টমেন্টে এত দ্রুত অফিস আর পদ বৃদ্ধির নজির নেই। প্রধানমন্ত্রী চাইলেও হয় না।
কিন্তু লাভটা কী? এই যে চাইতেই নতুন থানা, মেট্রোপলিটান পুলিশ, হাইওয়ে পুলিশ, শিল্প পুলিশ, ডিসির পদ বৃদ্ধি, দশটি সচিবের মর্যাদা, আইজির জন্য পতাকা কিংবা আরো মর্যাদা বৃদ্ধিÑ এ দেশের মানুষের জন্য কী এনেছে, সেটা দেখতে হবে। দেশের মানুষের সংখ্যা, অপরাধপ্রবণতা ইত্যাদি বিবেচনায় আরো পুলিশ চাই, এই প্রত্যয়ের সাথে দ্বিমত নেই Ñএখানে প্রশ্ন আছে। রাস্তায় দায়িত্ব পালনের জন্য প্রয়োজনীয় পুলিশ নেই, থানায় থানায় পুলিশের সংখ্যা বৃদ্ধি করাও দরকার, কিন্তু জেলায়-বিভাগে এত রিজার্ভ ফোর্স কী জন্য? অফিসারদের বাসায়, গাড়িতে, বাগানের কাজে, স্কুলে বাচ্চা পাঠাতে, মেমসাহেবের সাথে বাজারে যেতে কিন্তু পুলিশের ঘাটতি নেই। কিন্তু দিন দিন পুলিশ মানুষের আস্থা হারাচ্ছে। মানুষ পুলিশকে বন্ধু ভাবা তো দূরের কথা, অতি প্রয়োজনে নির্ভরও করতে পারছে না। আরো ভয়াবহ যে, নির্ভর করতে ভয় পাচ্ছে। ঢাকা কিংবা অন্য কোনো বড় শহরে প্রতিদিন যতগুলো ছিনতাই হচ্ছে তার ক’জন থানামুখী হয়Ñ এই প্রশ্ন দিয়েই শুরু করা যায়। মজার ব্যাপার হচ্ছে, থানায় মামলা না হলেই আইনশৃঙ্খলা ভালো বলে ব্রিটিশীয় তত্ত্ব আজো বহাল আছে। ফলে থানা পুলিশ মামলা রেকর্ড করতে আগ্রহী হয় না। এর মধ্যেই শুভঙ্করের ফাঁকিটা লুকিয়ে আছে। একটি থানার আইনশৃঙ্খলা ‘ভালো হয়’ মামলা কম হলেÑ সংঘটিত অপরাধের গুরুত্ব আর সংখ্যার ওপরে নয়। আবার সংঘটিত অপরাধ থানা ছাড়া অন্যত্র রেকর্ড করার বিধান নেইÑ আছে আদালত, সেটি আরো ভেজালের, হয়রানির। থানা কিংবা আদালত ব্যতিরেকে যদি নিরপে কোনো ভেন্যু থাকত, যেখানে চুরি, ছিনতাই এসবের রেকর্ড হতো, তবেই বোঝা যেত দেশের আইনশৃঙ্খলার প্রকৃত চিত্র। পুলিশের বিরুদ্ধে অভিযোগ দায়েরেরও ভিন্ন কোনো জায়গা নেই। পুলিশের ভাগ্য ভালোÑ এখনো এই দাবি কেউ করেনি। তা হলে বেসরকারি মানবাধিকার সংগঠনের সাথে ক্রসফায়ার ও গুম নিয়ে সরকারের যে হিসাবের গরমিল হচ্ছে, ঠিক সেটিই পুলিশের সাথে হতো। এটা অবশ্য সহায়ক হতো আমাদের পুলিশের পারঙ্গমতা বুঝতে।
সাম্প্রতিক এবং নিকট অতীতে পুলিশের কিছু কার্যক্রম পর্যালোচনায় দেখা যায়, তাজউদ্দিনের ভাগ্নে পরিচয়ের পর মারটা যেন বেশিই হয়েছে। পুলিশের কাছে পরিচয় দিয়েও রেহাই নেই। কী জানি, কবে আবার তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক কোনো উপদেষ্টা, বর্তমান কিংবা ভূতপূর্ব সচিব মার খান! পরিচয় না পেলে পুলিশের হাল ডিআইজিও মার খেতে পারেন। হরতালের কিংবা রাজনৈতিক কর্মসূচির সময়ে সাধারণ পথচারীও বাদ যায় না। কী অদ্ভুত! মোদ্দা কথা রাস্তায় কেউ আর নিজেকে নিরাপদ মনে করে না। এই নিরাপত্তাবোধ কেবল সড়ক দুর্ঘটনা আর ছিনতাই ইত্যাদি নয়, বরং পুলিশের হাতে নিগৃহীত হওয়ার আশঙ্কা ও ভয়। অথচ রাস্তায় পুলিশই বড় সহায়ক হওয়ার কথা ছিল। সাংবাদিক সম্প্রতি মার খেয়েছে বলে কাগজ আর টিভি চ্যানেল এখন মুখর। পুলিশের হাতে এমন মার খাওয়ার ঘটনা প্রতিদিন সারা দেশে ঘটছে। বহু মানুষ অকারণে পুলিশের মারে সারা জীবন দুঃসহ ত বয়ে বেড়াচ্ছেÑ সেই মানুষেরা, তাদের আত্মীয়রা পুলিশকে মানুষ বলার চেয়ে পুলিশ বলতেই আগ্রহ দেখাবে। কিন্তু এই সংখ্যাটা বেড়েই চলছে, ফলে পুলিশ হয়তো মানুষ হওয়ার সুযোগটা হারাবে। দ্বিতীয়ত, মিথ্যাÑ বিশেষ করে ডাকাতি মামলায় এই দেশে কত মানুষ অকারণে জেলহাজতে আছে তা নিয়ে গবেষণা হতে পারে। পুলিশি মারের ও হয়রানির এ উদাহরণ বাড়িয়ে লাভ নেই, কাগজ খুললেই দেখা যায়। আবার মামলা করতে গেলে নানা হয়রানি। এমনিতেই অনেকে আমলযোগ্য অপরাধের বিচারের জন্যও থানা কিংবা কোর্টে যেতে চান না। যারা যান তারা দায়ে পড়েই যান কিন্তু সহজে মামলা দায়ের করতে পারেন না। গুরুতর মামলায় কেবল জিডি করেই ফিরতে হয় অনেককে, এই চিত্র বেড়েই যাচ্ছে যেন। মানুষের ধারণাÑ পুলিশ থেকে আইনানুগ সহায়তা পেতে ঊর্ধ্বতন অফিসারের ফোন নতুবা অন্য কোনো রেফারেন্সই একমাত্র ভরসা। ঢাকার বড় পুলিশ অফিসারেরা নিজ জেলায় নিজের পরিচয় না দিয়ে মামলার জন্য থানায় গিয়ে দেখতে পারেন, থানায় পাঠাতে পারেন একজন আপ্তজনকে।
পুলিশ রেগুলেশন ও ফৌজদারি কার্যবিধিতে সাধারণ মানুষের সাথে আচরণের অনুশাসন দেয়া আছেÑ জিজ্ঞাসাবাদের ধরন, গ্রেফতারের পদ্ধতি ইত্যাদি। প্রযোজ্য েেত্র কেবল লাঠিচার্জ করার কথা থাকলেও মারমুখী পুলিশের চেহারাটাই চোখে বারবার ভেসে আছে। শত শত মানুষ মার খেলে কিংবা পুলিশের হাতে নিগৃহীত হলে দোষের কিছু নেই, মামলাও হবে না। একজন পুলিশ মার খেলে কিংবা সামান্য আহত হলে শত মানুষের বিরুদ্ধে মামলা হবে, এমনকি একটি গ্রাম পুরুষশূন্য হয়ে পড়বে। একজন পুলিশ আহত হলে মন্ত্রীও তাকে দেখতে যান, অবশ্য এটি হওয়া উচিত। কিন্তু একের অধিক সাধারণ মানুষ পুলিশের হাতে মার খেলে কিংবা পুলিশের অত্যাচারে মরে গেলেও কোনো কর্তাব্যক্তিকে দেখা যায় নাÑ এমনই এক দুর্ভাগ্য আম-আদমীর! এখন রাস্তাঘাটে পুলিশ যেন কাউকে সম্মানও করতে চায় না। আচরণে এতটা বেপরোয়া ঠিক অতীতে দেখা যায়নি। অথচ এ নিয়ে কোনো ব্যবস্থাও নেয়া হয় না। হ্যাঁ, বলা হবে পরিসংখ্যান দিয়েÑ প্রতি বছর এত এত পুলিশের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া হয়েছে; হয়তো হচ্ছেও, কিন্তু পুলিশের আচরণের পরিবর্তন নেই। ফলে মানুষের আস্থা আর নির্ভরতা দিন দিন হ্রাস পাচ্ছে জাতীয় এই বাহিনীর ওপর।
পুলিশে ভালো মানুষের অভাব আছে তা মনে করার কারণ নেই। পুলিশের ভালো কাজের ফিরিস্তি অনেক দীর্ঘ। অপহরণের ২৪ কিংবা ৪৮ ঘণ্টার মধ্যে ভিকটিম উদ্ধার কিংবা ভিকটিমসহ আসামি ধরা, ডাকাতির কয়েক ঘণ্টার মধ্যে বমাল ডাকাত ধৃত, খুনিদের দ্রুত পাকড়াওÑ এমন উদাহরণ অনেক। আন্তর্জাতিক েেত্র আমাদের পুলিশ যে সুনামের ভাগীদার, তাতে এ জাতি গর্ববোধ করতে পারে। কিন্তু এসব অসংখ্য ভালো ভালো নজির মাঝে মাঝে বেশ ম্লান হয়ে পড়ে।
আমি ভালো অফিসারদের দু’টি দৃষ্টিগ্রহ্য বিষয় ল করেছি। প্রথমতÑ কোনো কিছু না ভেবেই অধস্তনদের রায় নেমে পড়া। দ্বিতীয়তÑ সাব-ইন্সপেক্টর আর ইন্সপেক্টর লেভেলের সব কথা নিশ্চিন্তে মেনে নেয়া, হোক সেটা উন্নত মানের ভালো গল্প। কোতোয়ালি এলাকায় যেটি ঘটলÑ সব কিছু না জেনে এডিসি টিভিতে বলেই দিলেন ওদের বাড়াবাড়ি; এখন যে মামলা হলো, তদন্তে দোষী সাব্যস্ত হতে চলছে কিংবা সাসপেন্ডও হয়েছেÑ এডিসি এখন কী বলবেন! দিনাজপুরে দু’জন পুলিশকে বাঁচাতে কী সব ঘটে গেল, কত নাটকের অবতারণা করলেন সেই সময়ের পুলিশ সুপার। না অপরাধী পুলিশদের বাঁচানো গেল, না নিজে বাঁচলেন। কিংবা চট্টগ্রামের সীমাÑ কষ্ট লাগে পুলিশ এসব থেকে কোনো শিাই নিচ্ছে না। তিনজন আলোকচিত্রী অকারণে মার খেল। প্রথমে মামলা নিলে এবং দোষীদের বিরুদ্ধে তাৎণিক ব্যবস্থা নিলে অনেক শোভনীয় হতো, সঠিক দায়িত্ব পালনেরও পরিচায়ক হতো। যখন পুলিশ আর সাধারণ মানুষ প্রতিপ হয় তখন ভালো অফিসারও পুলিশের প নেন। অধস্তনদের প নেয়াটাই স্বাভাবিক। কিন্তু দেখতে হবে বাস্তবে কী হয়েছে। সিভিল ড্রেসে একান্ত বিশ্বস্ত কাউকে নবাবগঞ্জের একটি ট্রাকে বসিয়ে দিলেই তো হয়। বেশির ভাগ মানুষের ধারণা, সব ধরনের চাঁদাবাজি, মাদক বিক্রি কিংবা অপরাধের সাথে একশ্রেণীর পুলিশ জড়িত কিংবা ওয়াকিবহাল।
সম্প্রতি কয়েকটি ঘটনায় পুলিশ আবারো ভাবমূর্তি সঙ্কটে, তা বলার অপো রাখে না। মাঝে মাঝে এমন হচ্ছে। দার্শনিক রবীন্দ্রনাথ সেই সময়ের পুলিশ দেখে বলেছিলেন, ‘উহাদের লালায় বিষ আছে।’ তখন দেশ পরাধীন ছিল। অনেক সময় পেরিয়েছে। আমাদের তরুণ, প্রতিশ্র“তিশীল এবং সৎ-মেধাবী বলে পরিচিত পুলিশেরা কী এত দিন পরও রবীন্দ্রনাথের সেই উক্তিকে মিথ্যা প্রতিপন্ন করে দিতে পারেন না! একটি গণতান্ত্রিক দেশে পুলিশের যে ভাবমূর্তি থাকা আবশ্যক, আমরা তার জন্য অধীর আগ্রহে অপো করে আছি। কিন্তু সরকারের তরফে কখনোই তেমন ভূমিকা দেখা যায় না; বরং ইদানীং হাইকোর্টের ভূমিকায় কিছু প্রতিকার দেখতে পাওয়া যায়।
পুলিশের হাতে আইনও আছে, লাঠি-অস্ত্রও আছে। তাই তাদের নিয়ন্ত্রণে আরো বেশি মনোযোগী হওয়া প্রয়োজন। এ জন্য নানা উপায় ভেবে দেখতে হবে আর কাজটা দ্রুত শুরু করা দরকার।
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন