শনিবার, ১৬ জুন, ২০১২

বিরসা মুণ্ডা ও আদিবাসীদের সংগ্রাম

রণেশ মৈত্র


বয়স তো আমার প্রায় ৮০-তে পৌঁছল। আর মাত্র সাড়ে তিন মাস পর ৪ অক্টোবর ৮০ বছরে পদার্পণ করতে চলেছি। বাল্যকাল থেকে স্কুল-কলেজে বক্তৃতা-বিতর্কে অংশগ্রহণ, পরবর্তীতে ছাত্র ও ন্যাপ নেতা হিসেবে অজস্র ছাত্র-জনসভায় বক্তৃতা এবং সর্বোপরি আজ থেকে ৬২ বছর আগে সাংবাদিকতার শুরু ও লেখালেখির সুবাদে ব্যাপকসংখ্যক মানুষেরই ধারণা- চারপাশের সব বিষয়ে আমার জ্ঞানের ভাণ্ডার বেশ সমৃদ্ধ। সমাজ-পরিস্থিতির তুলনামূলক বিচারে মনে মনে আমিও যে খানিকটা তেমন ভাবতাম না- তা ঠিক নয়। কিন্তু সে ধারণা আমার চূর্ণ-বিচূর্ণ হলো গত ৯ জুন পাবনার চাটমোহর থানার হাণ্ডিয়াল নামক অজপাড়াগাঁয় পাবনা জেলা আদিবাসী সমিতির এক বিরাট সমাবেশে যোগ দেওয়ার পর। জাতীয় আদিবাসী পরিষদের পাবনা জেলা সভাপতি শ্রী রামপ্রসাদ মাহাতোর আমন্ত্রণে সেদিন তাদের আয়োজিত সমাবেশে উদ্বোধক হিসেবে দায়িত্ব পালনের আমন্ত্রণ রক্ষা করতে যাই। দুপুর সাড়ে ১২টার দিকে সমাবেশস্থলে যাই। উপস্থিতি এবং আসন সংখ্যা দেখে বুঝলাম, আরও কিছুক্ষণ বিলম্ব হবে সমাবেশ শুরু হতে। দেখলাম মঞ্চে এক ব্যানার। তাতে লেখা '১১২তম বিরসা মুণ্ডা দিবস'। কে এই বিরসা, তার ১১২তম কী দিবস, ব্যানারে তা স্পষ্ট বুঝতে পারলাম না। খানিক পর হাতে একটি লিফলেট ধরিয়ে দিলেন আয়োজকরা। এতে ওদের জানা সব তথ্য লিখিত আছে। সে পরে আসছি।

পরে আরেকটি কাগজ হাতে পেলাম। তাতে ওই দিনের সমাবেশ কর্মসূচির বিবরণী লেখা আছে। সমাবেশস্থল বাঘলবাড়িকে আদিবাসী সেন্টার, হাণ্ডিয়াল, চাটমোহর, পাবনা, উদ্বোধক- রণেশ মৈত্র, প্রবীণ রাজনীতিক, সাংবাদিক ও কলাম লেখক। প্রধান অতিথি ফিরোজ শাহ, উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা, চাটমোহর, বিশেষ অতিথি অ্যাডভোকেট বাবুল রবি দাস, প্রেসিডিয়াম সদস্য ও জয়পুরহাট জেলা সভাপতি, জাতীয় আদিবাসী পরিষদ; সম্মানিত অতিথি (১) রমানাথ মাহাতো, নাটোর জেলা সভাপতি; (২) প্রদীপ রবিদাস, সাধারণ সম্পাদক, বগুড়া জেলা জাতীয় আদিবাসী পরিষদ; (৩) ব্রজেন্দ্রনাথ সিং, সাধারণ সম্পাদক সিরাজগঞ্জ জেলা জাতীয় আদিবাসী পরিষদ; (৪) হরেন্দ্রনাথ সিং, সভাপতি, আদিবাসী যুব পরিষদ, কেন্দ্রীয় কমিটি; (৫) সুভাষচন্দ্র হেমব্রম, সাধারণ সম্পাদক, আদিবাসী ছাত্র পরিষদ, কেন্দ্রীয় কমিটি; (৬) পরেশচন্দ্র সিং, সভাপতি, আদিবাসী যুব পরিষদ, সিরাজগঞ্জ জেলা কমিটি; (৭) শিপন রবিদাস, সভাপতি, আদিবাসী ছাত্র পরিষদ, বগুড়া জেলা কমিটি এবং (৮) সন্তোষ মাহাতো, সহ-সভাপতি, আদিবাসী ছাত্র পরিষদ, সিরাজগঞ্জ জেলা কমিটি। প্রধান অতিথি চাটমোহর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা অবশ্য ব্যস্ততার কারণে উপস্থিত হতে পারেননি।

এবার আসি বিরসা মুণ্ডা প্রসঙ্গে। অতীতে তার নাম শুনিনি- জ্ঞানভাণ্ডার আমার এমনই। ওই লিফলেটে প্রচারিত বিবরণী পাঠ করে জানলাম- বিরসা মুণ্ডা ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদবিরোধী আদিবাসী আন্দোলনের অন্যতম নেতা এবং তিনি ১৮৯৫-১৯০০ সালে অবিভক্ত ভারতে সংঘটিত মুণ্ডা বিদ্রোহের নেতৃত্বদানকারী। তদানীন্তন ভারতবর্ষে অনেক অংশেই আদিবাসীদের বাস ছিল। তখনকার ছোট নাগপুর ও তার আশপাশের এলাকায় মুণ্ডা আদিবাসীরা বনজঙ্গল পরিষ্কার করে চাষাবাদের জন্য জমি প্রস্তুত করেছিল। খুব সহজ-সরল ছিল মুণ্ডা আদিবাসীরা। তারই সুযোগে মুণ্ডা তথা আদিবাসীদের সঙ্গে প্রভাবশালীরা প্রতারণা শুরু করল। তাদের বসতি ছিল খুব ঘন- মিলেমিশে থাকত মুণ্ডারা। হঠাৎ নেমে এলো মুণ্ডাদের ওপর চরম অত্যাচার-নিপীড়ন। ইংরেজ শাসক, জমিদার, মহাজন সবাই মুণ্ডাদের শোষণ করতে শুরু করেছিল। অন্যদিকে মিশনারিরা খ্রিস্টধর্ম প্রচারের উদ্দেশ্যে ভারতবর্ষে এসে প্রথমেই এসব হতদরিদ্র আদিবাসীর মধ্যে ধর্ম প্রচার শুরু করে। নানা সুযোগ-সুবিধাও দেওয়া হয় ধর্মান্তরিত আদিবাসীদের। ফলে বেশ কিছুসংখ্যক আদিবাসী খ্রিস্ট ধর্ম গ্রহণও করে। কিন্তু তার পরিণতিতে আদিবাসীদের প্রতি ইংরেজদের অত্যাচার-নির্যাতন আদৌ কমেনি বরং দিন দিন বাড়তেই থাকে। ফলে একপর্যায়ে শোষণ, নির্যাতনের বিরুদ্ধে মুণ্ডারা বিদ্রোহ করতে বাধ্য হয়।

মুণ্ডা বিদ্রোহের নেতৃত্বে বিরসা মুণ্ডা কীভাবে অধিষ্ঠিত হলেন? মুণ্ডাদের ওপর যে অত্যাচার-নির্যাতন, শোষণ-জুলুম দীর্ঘকাল চলে আসছিল, তা প্রথমে কয়েকজন ধর্মান্তরিত মুণ্ডা, যারা কিছুটা শিক্ষা-দীক্ষার আলো পেয়েছিলেন, তারাই এসব অত্যাচারের হাত থেকে নিজ সম্প্রদায়ের মানুষকে রক্ষার কাজে ব্রতী হন। তারা যে পদ্ধতি অনুসরণ করেন তা হলো- প্রথমে তারা মিশনের কাছে তাদের অভিযোগ পেশ করে। কিন্তু মিশন আর ব্রিটিশ শাসক দুই-ই একে অপর থেকে ভিন্ন নয়। শুধু মুখোশ ছিল আলাদা। তাই মিশনারিরা অত্যাচারের শিকার মুণ্ডাদের কোনো সাহায্য-সহযোগিতা করল না। মুণ্ডারা তবুও ক্ষোভ-বিক্ষোভ জানিয়ে যেতে থাকে। যোগ্য নেতা খুঁজে পেতে তাদের বেশ কিছুকাল অপেক্ষা করতে হয়। মুণ্ডাদের এ প্রতীক্ষা শেষ হয় যখন বিরসা মুণ্ডার বয়স প্রায় বিশের কাছাকাছি পৌঁছায়। ১৮৭৩ সালের ১৫ জুন বিরসা মুণ্ডা জন্মগ্রহণ করেন। সেদিন ছিল বৃহস্পতিবার। তাই তার মা-বাবা আদর করে সন্তানের নাম রেখেছিলেন বিরসা। যতই বড় হতে থাকেন বিরসা ততই বুঝতে সক্ষম হন, মুণ্ডা জনগোষ্ঠীর লোকজন মিশনারি, জমিদার ও ব্রিটিশ শাসকদের কাছে জিম্মি হয়ে আছে এবং প্রতিনিয়ত মুণ্ডাদের তারা শোষণ করছে। বিরসা সেই অভিজ্ঞতা ও উপলব্ধি থেকে স্বপ্ন দেখতে শুরু করেন, মুণ্ডাদের এই দুরবস্থার হাত থেকে রক্ষা করতে হবে। বিরসা ওই স্বপ্ন বাস্তবায়নের জন্য গোপনে কাজ শুরু করেন। সে সময়ে মুণ্ডা জনগোষ্ঠীর মধ্যে প্রচলিত ধর্মে বিস্তর কুসংস্কার ছিল। বিরসা এসব কুসংস্কারের বিরুদ্ধে নিজ সম্প্রদায়ের লোকদের মধ্যে জনমত তৈরি করেন। তিনি বলেন, 'আমি তোমাদের নতুন ধর্ম শেখাব- আমি তোমাদের কোলে নিয়ে দুলাব না- ভুলাব না- বরং আমি তোমাদের মরতে এবং মারতে শেখাব'। বিরসার টার্গেট ইংরেজ ও তাদের দালালরা।

ধীরে ধীরে বিরসার নাম চারদিকে ছড়িয়ে পড়তে লাগল এবং মুণ্ডা জনগোষ্ঠীর লোকজন বিরসার নতুন ধর্মমন্ত্রে দীক্ষিত হয়ে 'বিরসাইত' নামে পরিচিতি অর্জন করল। বিরসার কর্মকাণ্ডের খবর ইংরেজ শাসকদের কাছে পৌঁছে যায়। ইংরেজরা মুণ্ডাদের মধ্যে বিভ্রান্তি ছড়ানোর অভিযোগে বিরসাকে গ্রেফতার করে। বিরসা হাজারীবাগ জেলে দীর্ঘদিন আটক থাকার পর ১৮৯৭ সালের ৩০ নভেম্বর কারাগার থেকে মুক্তি লাভ করেন। বিরসার মুক্তিতে মুণ্ডাসমাজ আনন্দে উল্লসিত হয়। বিরসা আবারও বিদ্রোহের প্রস্তুতি নিতে শুরু করেন। ১৮৯৯ সালের ২৪ ডিসেম্বর অর্থাৎ ঠিক বড়দিনের আগে বিরসা আর বিরসাইতদের নিয়ে শোষণ-বঞ্চনার বিরুদ্ধে প্রথম আঘাত হানেন। বিরসাইতরা নিজ অঞ্চলের মিশনগুলোকে আক্রমণ করে। আগুন জ্বলতে থাকে সমগ্র এলাকায়। এ সময় বহু ইংরেজ, মিশনারি ও চৌকিদার নিহত হয় মুণ্ডাদের অতর্কিত হামলায়। বিরসা মুণ্ডাদের বলেছিলেন, এদের হত্যা কর। ইংরেজ সাহেব আর মিশনারি সাহেব ও অফিসার সাহেবরা সব এক টোপি হ্যায়। বিরসার নেতৃত্বে পরিচালিত এ আন্দোলনে ব্রিটিশ শাসকগোষ্ঠী নড়েচড়ে বসে এবং বিদ্রোহ দমনের জন্য সাঁড়াশি অভিযান পরিচালনা করে। বিদ্রোহ চলাকালীন ১৯০০ সালের ১৩ ফেব্রুয়ারি বিরসা ইংরেজদের হাতে আবারও ধরা পড়েন। তার ধরা পড়ার পর অন্য বিদ্রোহী নেতারা ঘটনার আকস্মিকতায় মনোবল অনেকটা হারিয়ে ফেলে। আস্তে আস্তে তারাও ধরা পড়তে থাকে। বিরসা মুণ্ডাসহ বিদ্রোহীকে রাঁচি জেলে শিকল দিয়ে বেঁধে রাখা হয়েছিল। এ অত্যাচারের মুখে ১৯০০ সালের ৯ জুন কারাগারে বিরসার মৃত্যু হয়। কেন এমন মৃত্যু হলো- এর জবাবে কারা কর্তৃপক্ষ জানিয়েছিল, বিরসার কলেরা হয়েছিল। কিন্তু পরে ডাক্তারদের কাছ থেকে জানা যায়, তাকে বিষ প্রয়োগে হত্যা করা হয়েছিল।

এভাবেই শহীদ হয়েছিলেন বিরসা মুণ্ডা। যে কাহিনী আজও আমাদের অনেকের কাছে অজ্ঞাত। মুণ্ডা জাতিগোষ্ঠী তথা নিপীড়িত-নির্যাতিতদের মুক্তির স্বপ্ন দেখিয়েছিলেন বিপ্লবী বিরসা মুণ্ডা। ইংরেজ শাসকদের কামান-বন্দুককে ভয় পায়নি মুণ্ডা সম্প্রদায়ের তীর-ধনুক। বিরসা মুণ্ডা আজ ওই অঞ্চলে বিরসা ভগবান নামে আখ্যায়িত। ভারতে বিরসা মুণ্ডার স্মরণে বিরসা মুণ্ডা এয়ারপোর্ট নির্মিত হয়েছে। বিরসাকে নিয়ে ২০০৮ সালে 'গান্ধী সে পহেলে গান্ধী' শীর্ষক চলচ্চিত্র নির্মিত হয়েছে।

বাংলাদেশেরও বহু অঞ্চলে আদিবাসীরা ছড়িয়ে-ছিটিয়ে বসবাস করছেন। তারা প্রায় সবাই দরিদ্র, অশিক্ষিত কৃষক। তাদের ভাষা আছে, কিন্তু লিখিত রূপ পায়নি। তাদের মাতৃভাষা আজও উপেক্ষিত। 'সব ভাষার সমান মর্যাদা চাই'- ঐতিহাসিক ভাষা আন্দোলনের এই অমর স্লোগান আজও আদিবাসীদের কোনো কাজে আসেনি। সংবিধানের বিধান, 'সকল নাগরিকের সমান অধিকার' থেকেও আদিবাসীরা আজও বঞ্চিত। বরং পঞ্চদশ সংশোধনীর মাধ্যমে বর্তমান সরকার বাংলাদেশে আদিবাসীদের অস্তিত্ব অস্বীকার করেছে। বলা হচ্ছে, 'ক্ষুদ্র জাতিসত্তা'। তাই আজ আদিবাসীদের অস্তিত্বের প্রশ্ন, তাদের সাংবিধানিক স্বীকৃতির প্রশ্ন সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ণ।

শেখ হাসিনার সরকার আমলেই ১৯৯৭ সালে পার্বত্য চট্টগ্রাম শান্তিচুক্তি স্বাক্ষর হয়- তখন গোটা বিশ্বের অভিনন্দন কুড়াতে সক্ষম হয় ওই চুক্তিটি। তারই শর্ত অনুযায়ী সন্তু লারমার নেতৃত্বাধীন যোদ্ধারা সরকারের কাছে ঠিকই নির্ধারিত সময়ের মধ্যে অস্ত্র জমা দিলেও সরকারের তরফে আদিবাসীদের অনুকূলে চুক্তির অপরাপর শর্তগুলো, বস্তুত গোটা চুক্তিই আজও বাস্তবায়নের অপেক্ষায়। ফলে আদিবাসীদের মধ্যে গভীর অসন্তোষ দানা বাঁধছে। সন্তু লারমার নেতৃত্বের ওপর আস্থা হ্রাস পেতে চলেছে- ফলে সন্তু লারমা বলতে বাধ্য হয়েছেন- 'সরকার আগুন নিয়ে খেলছেন। অবিলম্বে চুক্তির প্রতিটি শর্ত কার্যকর করা না হলে, তারা পুনরায় অস্ত্র হাতে তুলে নিতে বাধ্য হবেন এবং সরকারই সে পরিস্থিতির জন্য দায়ী থাকবেন।' হাণ্ডিয়ালের সমাবেশ থেকেও অবিলম্বে পার্বত্য শান্তিচুক্তির পূর্ণাঙ্গ বাস্তবায়ন, সমতল ভূমিতে আদিবাসীদের ভূমির মালিকানা নির্ধারণ ও জটিলতা নিরসনে একটি ভূমি কমিশন গঠনের জন্য সরকারের প্রতি আহ্বান জানানো হয়। আদিবাসী নারী-পুরুষদের অনেকেই অভিযোগ করেছেন, তাদের আবাদি জমি বেদখল করেছে স্থানীয় প্রভাবশালীরা। চাটমোহরের ইউএনও এবং থানা রেভিনিউ কর্মকর্তাসহ সংশ্লিষ্টদের জরুরি ভিত্তিতে সমস্যাটির সমাধানের আহ্বান জানাই। যে আদিবাসীরা নেহাতই ভূমিহীন, তাদের তিন একর করে জমির স্থায়ী বন্দোবস্ত দিয়ে সমস্যার সমাধানে এগিয়ে আসারও আহ্বান জানাই।

লেখক : রাজনীতিক

E-mail : maitraranesh@gmail. com

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন