মঙ্গলবার, ৫ জুন, ২০১২

এবার কালো টাকা সাদা কার স্বার্থে?



॥ ইকতেদার আহমেদ ॥

আমাদের দেশে অর্থবছর ১ জুলাই থেকে ৩০ জুন পর্যন্ত বিস্তৃত। জাপানসহ কিছু দেশে অর্থবছর শুরু হয় ১ এপ্রিল, আবার অনেক দেশে অর্থবছর ইংরেজি বর্ষপঞ্জির অনুরূপ। অর্থবছর ঘুরে ১ জুলাই পূর্ববর্তী বাজেট ঘোষণা নিয়ে দেশের সচেতন জনগোষ্ঠীর আগ্রহ পরিলক্ষিত হয়। যদিও সাধারণ মানুষের প্রত্যাশা থাকে বাজেট জনজীবনে স্বস্তি বয়ে নিয়ে আসবে; কিন্তু বাস্তবে বাজেটই সাধারণ জনগণের জন্য দুর্ভোগ বয়ে আনে।
এ মাসেই সংসদের বাজেট অধিবেশন শুরু হচ্ছে। বাজেটে কী কী বিষয়ে করারোপ, কী কী বিষয়ে কর কমবে ও কী কী বিষয়ে কর মওকুফ করা হবে, তা নিয়ে জল্পনা-কল্পনার অবসান নেই। সব জল্পনা-কল্পনাকে দূরে ঠেলে এবারো যে কালো টাকা সাদা করার সুযোগ আসছে, সে নিশ্চয়তার বাণী ইতোমধ্যে বিভিন্নভাবে উচ্চারিত হচ্ছে। 
বাংলাদেশে ১৬ বার কালো টাকা সাদা করার সুযোগ দেয়া হয়েছে। এ সময়কালে কালো টাকা সাদা হয়েছে প্রায় ১৩ হাজার কোটি টাকার কাছাকাছি। আর এ থেকে সরকারের রাজস্ব আয় হয়েছে প্রায় এক হাজার ৩৭০ কোটি টাকার কাছাকাছি। অস্ট্রেলীয় অর্থনীতিবিদ ফ্রেডারিক স্নাইডার বর্তমানে কালো টাকা বিশেষজ্ঞদের অন্যতম। তার সমীক্ষা অনুযায়ী বাংলাদেশে কালো টাকার হার মোট দেশজ উৎপাদনের তথা জিডিপির ৩৭ শতাংশ। এ হিসাবে কালো টাকার পরিমাণ দাঁড়ায় প্রায় দেড় লাখ কোটি টাকা। তবে অর্থমন্ত্রণালয়ের সমীক্ষা অনুযায়ী বাংলাদেশে কালো টাকার হার মোট দেশজ উৎপাদনের (জিডিপি) ৪৬ থেকে ৮১ শতাংশ পর্যন্ত। আর এ ক্ষেত্রে কালো টাকার পরিমাণ দাঁড়ায় ১৯০ লাখ কোটি থেকে ৭৬০ লাখ কোটি টাকার মধ্যে। 
বর্তমান বিশ্বে বিভিন্ন রাষ্ট্রের অভ্যন্তরীণ, আঞ্চলিক ও আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড ব্যাপক থেকে ব্যাপকতর হওয়ার পরিপ্রেক্ষিতে বাণিজ্যিক ব্যাংকের চাহিদা, গুরুত্ব ও অবদান অপরিহার্য হয়ে পড়েছে। ব্যাংক ব্যবসায় বলতে সাধারণ অর্থে আমরা বুঝি গ্রাহকদের কাছ থেকে আমানত সংগ্রহ করে তা আবার বিভিন্ন লাভজনক কাজে বিনিয়োগ।
আমাদের দেশে সরকারি-বেসরকারি ও দেশী-বিদেশী মিলিয়ে তফসিলি ব্যাংকের সংখ্যা ৪৭টি। এর মধ্যে বেসরকারি ব্যাংকের সংখ্যাই বেশি। এ ৪৭টি ব্যাংকের মধ্যে রাষ্ট্রায়ত্ত বাণিজ্যিক ব্যাংক চারটি, বিশেষায়িত ব্যাংক চারটি, বেসরকারি বাণিজ্যিক ব্যাংক ৩০টি এবং বিদেশী ব্যাংক ৯টি। এর বাইরে প্রয়োজনাতিরিক্ত নন-ব্যাংকিং আর্থিক প্রতিষ্ঠান রয়েছে ৩০টি। বর্তমানে আমাদের দেশে জনসংখ্যা অনুপাতে তফসিলি ব্যাংকের শাখার যে অনুপাত তা আমাদের সার্কভুক্ত রাষ্ট্র ভারত ও পাকিস্তানের চেয়ে বেশি। সরকারি ও বেসরকারি ব্যাংকের কার্যক্রম সুচারুভাবে পরিচালনার জন্য প্রতিটি ব্যাংকেরই পরিচালনা পর্ষদ রয়েছে। সরকারি ব্যাংকের পরিচালনা পর্ষদের চেয়ারম্যান ও পরিচালক মনোনীত করে সরকার। অপর দিকে বেসরকারি ব্যাংকের পরিচালনা পর্ষদের চেয়ারম্যান ও পরিচালকেরা উদ্যোক্তা পরিচালক এবং ক্ষেত্রবিশেষে শেয়ারহোল্ডারদের মধ্য থেকে মনোনীত হয়ে থাকেন। বেসরকারি ব্যাংকের পরিচালকদের মধ্যে যিনি সর্বোচ্চসংখ্যক পরিচালকের আস্থাবান সাধারণত তিনি চেয়ারম্যানের দায়িত্ব পালন করে থাকেন।
আমাদের দেশে সরকারি ও বেসরকারি উভয় ব্যাংক ব্যবসায় সঠিকভাবে পরিচালিত না হওয়ায় জনসাধারণের মধ্য থেকে প্রায়ই পরিচালনা পর্ষদের কয়েকজন চেয়ারম্যান ও পরিচালকের বিরুদ্ধে অবৈধ সুযোগ সুবিধা নেয়ার মাধ্যমে আমানতকারীদের স্বার্থের প্রতিকূল অবস্থান নেয়ার অভিযোগ উত্থাপিত হচ্ছে। সরকারি ও বেসরকারি উভয় ব্যাংক থেকে বড় ধরনের ঋণ নেয়ার ক্ষেত্রে পরিচালনা পর্ষদের চেয়ারম্যান ও পরিচালকদের সম্মতির প্রয়োজন রয়েছে এবং বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই দেখা যায় পরিচালনা পর্ষদের প্রভাবে দেয়া ঋণ শর্ত অনুযায়ী আদায় না হয়ে কুঋণে পরিণত হচ্ছে। নতুন ঋণ দেয়া, খেলাপি ঋণ মওকুফ ও পুনঃতফসিলে পরিচালনা পর্ষদের কয়েক সদস্যের অবৈধ সুযোগ সুবিধা নেয়ার বিষয়টি আজ আর কারো অজানা নয়। বেসরকারি ব্যাংকের চেয়ারম্যান ও পরিচালকেরা ক্ষেত্রবিশেষে বেনামে ও আত্মীয়স্বজনের নামে ঋণ নিয়ে সময়মতো পরিশোধ না করে পুনঃতফসিলি করার মাধ্যমে সুদ অনারোপযোগ্য করে ১০-১৫ বছর মেয়াদি ঋণে পরিণত করার চাঞ্চল্যকর উদাহরণও রয়েছে। এভাবে পরিচালনা পর্ষদের সদস্যরা ঋণ পরিশোধে দেরি করলে এবং সুদ পরিশোধে বিরত থাকলে অবধারিতভাবে ব্যাংকে যে তারল্য সঙ্কট দেখা দেবে, তা আর বলার অপেক্ষা রাখে না। 
বাণিজ্যিক ব্যাংকের দৈনন্দিন কাজ, কর্মচারী নিয়োগ ও বদলি, ঋণদান, ঋণ পুনঃতফসিলি করা প্রভৃতিতে অনেক চেয়ারম্যান ও পরিচালকের হস্তক্ষেপের কারণে কোনো কোনো ক্ষেত্রে ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালকেরা স্বাধীনভাবে কাজ করতে না পারায় আত্মসম্মান রক্ষার্থে চুক্তির মেয়াদ শেষ হওয়ার আগেই চলে যাওয়ার একাধিক নজির রয়েছে। এমনও দেখা যায়, ব্যবস্থাপনা পরিচালকের কাজ চেয়ারম্যান করছেন। এ ক্ষেত্রে বাংলাদেশ ব্যাংকের পক্ষ থেকে সতর্ক করা সত্ত্বেও এ ধরনের প্রবণতা না কমে বরং বেড়ে যাওয়াই লক্ষ করা যায়। 
পরিচালনা পর্ষদের কিছু সদস্যের ব্যাংকের কাছে নিজস্ব ভবন ভাড়া এবং ক্ষেত্রবিশেষে কোটি কোটি টাকা অগ্রিম নেয়ার দৃষ্টান্ত রয়েছে। শাখা ও ব্যাংক ভবনের জমি কেনার ক্ষেত্রে বাজারমূল্যের চেয়ে কয়েকগুণ বেশি দামে কিনে বাড়তি অর্থ আত্মসাতের একাধিক চাঞ্চল্যকর ঘটনার কথা শোনা যায়। নতুন শাখার সাজসজ্জা ও আসবাবপত্র কেনায় পরিচালনা পর্ষদের কিছু সদস্যের অবৈধ প্রভাব খাটানো এক ধরনের চিরাচরিত নিয়মে পরিণত হয়েছে। নিয়মবহির্ভূতভাবে বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোর কর্মকর্তা ও কর্মচারীদের ভবিষ্যৎ তহবিল ও আনুতোষিকের অর্থ অন্যত্র সরানোর কারণে চাকরি থেকে অব্যাহতি নেয়া অনেক কর্মকর্তা প্রাপ্য অর্থপ্রাপ্তিতে অহেতুক বিড়ম্বনার শিকার হচ্ছেন। বিগত অর্থবছরে আটটি ব্যাংক বার্ষিক প্রতিবেদন তৈরিতে ব্যাপক অনিয়মের আশ্রয় নিয়েছে মর্মে সুনির্দিষ্ট অভিযোগ উঠলেও কেন্দ্রীয় ব্যাংকের কঠোর ব্যবস্থা নেয়ার কোনো পদক্ষেপ লক্ষ করা যায়নি।
বর্তমানে পৃথিবীর বিভিন্ন দেশ ব্যাংক ব্যবসায়কে গতিশীল, প্রতিযোগী ও জনকল্যাণমুখী করার মানসে ব্যাংকের সংখ্যা বাড়ানোর চেয়ে পর্যাপ্ত মূলধনের সংস্থান ও ঋণঝুঁকি ব্যবস্থাপনার ওপর সর্বাধিক গুরুত্বারোপ করছে। এর ফলে বিভিন্ন দেশে মার্জার ও অ্যাকুজিশনের মাধ্যমে ব্যাংকের সংখ্যা কমিয়ে আমানতকারী ও শেয়ারহোল্ডারদের স্বার্থ সংরক্ষণে অধিক মনোনিবেশ করা হচ্ছে। কিন্তু বাংলাদেশের ক্ষেত্রে এ বিষয়ে বাস্তবতার বিপরীতে বলা যায়, আমরা উল্টো পথে হাঁটছি। সরকার সম্প্রতি সম্পূর্ণ রাজনৈতিক বিবেচনায় নতুন ছয়টি বাণিজ্যিক ব্যাংক ও তিনটি অনাবাসী ব্যাংকের অনুমোদন দিয়ে লেটার অব ইনটেন্ট ইস্যু করেছে। এসব ব্যাংককে আগামী ছয় মাসের মধ্যে সংরক্ষিত তহবিলের ৪০০ কোটি টাকা করে দেশীয় ছয়টি ব্যাংকের ক্ষেত্রে দুই হাজার ৪০০ কোটি টাকা দেশীয় মুদ্রায় এবং তিনটি অনাবাসী ব্যাংকের ক্ষেত্রে এক হাজার ২০০ কোটি টাকা বৈদেশিক মুদ্রায় জমাদানের ব্যবস্থা করতে হবে। অনাবাসী তিনটি ব্যাংক এ অর্থ জমাদানের ক্ষেত্রে যেকোনো বড় ধরনের প্রতিবন্ধকতার মুখোমুখি হবে না, সে বিষয়টি অনেকটা নিশ্চিত। তবে তাদের টাকার উৎসের বিষয়ে কোনো প্রশ্ন করা হবে কি না, এ বিষয়টি এখনো স্বচ্ছ নয়। এখানে উল্লেখ্য, ইতঃপূর্বে রূপালী ব্যাংক ক্রয়সংক্রান্তে এক বিদেশী ক্রেতার অর্থ এ দেশ থেকে পাচার করা অর্থ বলে ধারণা করা হয়। বর্তমানে ওই অর্থ প্রায় হাজার কোটি টাকা নামবিহীন ব্যক্তির পাঠানো, যা বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্ধারিত খাতে জমা আছে। শেয়ারবাজার লুণ্ঠন, বিদ্যুৎকেন্দ্রের কমিশন, টেন্ডার বাণিজ্য ও নিয়োগ বাণিজ্যের কমিশনÑ এ তিনটি অনাবাসী ব্যাংকের জোগান হিসেবে যে আসবে না সে নিশ্চয়তা কোথায়? কালো টাকা সাদা করার সুযোগ দেয়া না হলে সংরক্ষিত তহবিলের দুই হাজার ৪০০ কোটি টাকার সংস্থান দেশীয় ছয়টি ব্যাংকের উদ্যোক্তারা করতে পারবেন কি না সে বিষয়ে অনেকেই সন্ধিহান এবং অনেকের ধারণা এ সুযোগ দেয়া না হলে একটি ব্যাংকও আলোর মুখ দেখবে না। উদ্যোক্তাদের মধ্যে অনেকেই কালো টাকা সাদা করার সুযোগ আবারো দেয়ার বিষয়ে তৎপর। তাই দেশের সচেতন জনগোষ্ঠী মনে করেন অর্থনীতির স্বার্থে একান্তই যদি কালো টাকা সাদা করার সুযোগ দিতে হয়, তবে এ সুযোগটি অনুমোদন পাওয়া নতুন ব্যাংকগুলোর মূলধনের টাকা জমা দেয়ার পর দেয়া হোক। কিন্তু পরিতাপের বিষয়, এনবিআর চেয়ারম্যান ইতোমধ্যে বাজেট ঘোষণার আগে কালো টাকা সাদা করার সুযোগ দেয়া হবে মর্মে ঘোষণা দিয়েছেন। বাজেট ঘোষণাপূর্ববর্তী আগাম এ ধরনের ঘোষণা যে উদ্দেশ্যপ্রণোদিত, এ বিষয়ে কারো কোনো সন্দেহ নেই। 
নতুন ব্যাংকের অনুমতি দেয়ার ক্ষেত্রে বাংলাদেশ ব্যাংকের সিদ্ধান্তই চূড়ান্ত, কিন্তু এ বিষয়ে বাংলাদেশ ব্যাংকের পরিচালনা পর্ষদের ভূমিকা নেতিবাচক থাকলেও কী কারণে বিশেষ করে ছয়টি দেশীয় ব্যাংকের অনুমতি দেয়ার ক্ষেত্রে পরিচালনা পর্ষদ ইতিবাচক ভূমিকা পালন করেছে, সে বিষয়ে দেশের সচেতন জনগোষ্ঠীর অনুসন্ধিৎসু প্রশ্ন রয়েছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের পরিচালনা পর্ষদ যখন শহরাঞ্চলে ব্যাংকের একটি নতুন শাখা খোলার বিষয়ে গ্রামাঞ্চলে একটি শাখা খোলার ওপর শর্তারোপ করে চলেছে এবং এর পাশাপাশি যখন দেশের অর্থনীতিবিদেরা কর্মসংস্থান সৃষ্টির ক্ষেত্রে নতুন ব্যাংকের অনুমোদনের চেয়ে বিদ্যমান ব্যাংকের শাখা সম্প্রসারণ অধিক কার্যক্ষম বিষয়ে অভিমত ব্যক্ত করছেন তখন কী করে বাংলাদেশ ব্যাংকের পরিচালনা পর্ষদ নিজ অবস্থান ও অর্থনীতিবিদদের অবস্থানের বিপরীতে অবস্থান নিয়েছে?
বাংলাদেশ ব্যাংকের বর্তমানে যে লোকবল ও কর্মদক্ষতা রয়েছে তা কোনোক্রমেই বিদ্যমান ব্যাংকগুলোর সুচারুরূপে তত্ত্বাবধান ও নিয়ন্ত্রণের জন্য পর্যাপ্ত নয়। এ বাস্তবতায় বাংলাদেশ ব্যাংকের লোকবল ও কর্মদক্ষতা না বাড়িয়ে ৯টি নব অনুমোদনপ্রাপ্ত ব্যাংকের কার্যাবলি পরিদর্শনে কেন্দ্রীয় ব্যাংক কতটা পারদর্শী হবে তা অতি সহজেই অনুমেয়। তা ছাড়া নতুন অনুমোদন পাওয়া ব্যাংকগুলোর পরিচালনা পর্ষদে যেসব প্রভাবশালীর অনুপ্রবেশ ঘটবে বলে ধারণা পাওয়া যায়, তাদের ক্ষেত্রে বাংলাদেশ ব্যাংকের নিয়ন্ত্রণ খুব একটা যে ফলপ্রদ হবে, এরূপ আশা না করাই ভালো।
নতুন ছয়টি ব্যাংকের প্রতিটিতে উদ্যোক্তা পরিচালকের সংখ্যা সর্বোচ্চ ২০ জনে নির্ধারণ করে দেয়া আছে। এ হিসাবে ৪০০ কোটি টাকা অনুমোদিত মূলধনে একজন উদ্যোক্তা পরিচালককে ২০ কোটি সাদা টাকার জোগান দিতে হবে। কিন্তু আয়কর ঘোষণাপত্রে যাদের সম্পদের পরিমাণ এক কোটির অধিক নয়, তারা কী করে ২০ কোটি টাকার জোগান দেবেনÑ এ প্রশ্নটি আজ জনমনে গভীর আলোড়ন সৃষ্টি করেছে। সদ্য অনুমোদন পাওয়া একটি বেসরকারি ব্যাংকের প্রস্তাবিত চেয়ারম্যান অর্ধশত কোটি টাকা আত্মসাৎ ও রফতানি বিল প্রত্যাবাসিত না করার ফলে যেখানে তার বিরুদ্ধে মানিলন্ডারিং আইনে মামলা হওয়ার কথা, সেখানে তা না করে বিষয়টি বাংলাদেশ ব্যাংকের গোচরীভূত থাকা সত্ত্বেও তাকে প্রস্তাবিত চেয়ারম্যান হিসেবে ব্যাংকটি কিভাবে অনুমোদন পেল বর্তমানে এটি একটি বড় প্রশ্ন হিসেবে দেখা দিয়েছে। এসব ব্যক্তির হাতে ব্যাংকের ভবিষ্যৎ কী হবে এবং আমানতকারীদের স্বার্থ কতটুকু নিরাপদ তা অনেককে ভাবিয়ে তুলছে। অনুমোদন পাওয়া অপর একটি বেসরকারি ব্যাংকের ঢাকার অভিজাত এলাকার কার্যালয়ে ভাবি উদ্যোক্তা পরিচালকদের হাতাহাতির ঘটনা ভবিষ্যতের বিশৃঙ্খল পরিস্থিতির ইঙ্গিতবহ। তা ছাড়া এ ছয়টি বেসরকারি বাণিজ্যিক ব্যাংকের কিছু উদ্যোক্তা পরিচালকের নামে বহু দালাল ব্যাংকে লোভনীয় চাকরি পাইয়ে দেয়ার আশায় অবৈধ অর্থ উপার্জনের ফাঁদ পেতেছেন। ইতোমধ্যে এ ফাঁদে ধরা দিয়ে অনেক চাকরিপ্রত্যাশী দাবি করা অর্থের আংশিক অথবা সম্পূর্ণ পরিশোধ করেছেন। এ ধরনের ব্যক্তি যদি রাজনৈতিক বিবেচনায় বাণিজ্যিক ব্যাংকের কর্ণধাররূপে আবির্ভূত হয়ে ব্যাংক স্থাপনের অনুমোদন পায়, সে ক্ষেত্রে বিস্মিত হয়ে দীর্ঘ নিঃশ্বাস ফেলা ছাড়া দেশপ্রেমিক জনগণের আর কী-বা করার আছে।
নব্বইয়ের দশকের মাঝামাঝি থেকে পরবর্তী ১০ বছর সময়ের মধ্যে খেলাপি ঋণ, দুর্নীতি, অনিয়ম ও সুশাসনের অভাবের কারণে কিছু বাণিজ্যিক ব্যাংক দেউলিয়া হওয়ার দ্বারপ্রান্তে চলে গিয়েছিল। সে সময়কালে বর্তমান গভর্নরের অব্যবহিত পূর্ববর্তী গভর্নরের পূর্ববর্তী দু’জন গভর্নর সিবিএ ও প্রভাবশালীদের দৌরাত্ম্য কমিয়ে ব্যাংকগুলোতে শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনতে সমর্থ হয়েছিলেন; কিন্তু সে শৃঙ্খলা আজ কোথায়? উল্লেখ্য, ওই সময়ে এক ওম প্রকাশ আগরওয়ালের ঘটনায় পাঁচটি বেসরকারি বাণিজ্যিক ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালকের চাকরি থেকে অপসারণের ঘটনা ঘটেছিল। তা ছাড়া অনিয়ম, দুর্নীতি ও স্বনামে-বেনামে নিয়মবহির্ভূত ঋণ নেয়ার কারণে ত্রিশাধিক পরিচালককে অপসারণ করা হয়েছিল। বর্তমানে বিভিন্ন বাণিজ্যিক ব্যাংকের অনিয়ম ও দুর্নীতির বিষয়ে পত্রপত্রিকায় সংবাদ ছাপা হলেও কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে কার্যকর ব্যবস্থা নেয়ার কোনো উদ্যোগ দৃশ্যমান নয়। 
বাংলাদেশ ব্যাংকের অনেক সৎ ও দক্ষ কর্মকর্তাকে অবসরপরবর্তী বেসরকারি ব্যাংকে আকর্ষণীয় বেতনভাতায় নিয়োগ দেয়ার প্রবণতা লক্ষ করা যাচ্ছে। কিন্তু কার্যক্ষেত্রে তাদের দক্ষতা কাজে না লাগিয়ে ব্যাংকগুলোর অনিয়ম বিষয়ে প্রতিকার বিধানের জন্য তাদেরকে কেন্দ্রীয় ব্যাংক অর্থাৎ বাংলাদেশ ব্যাংকে পাঠানো হয়ে থাকে। বাংলাদেশ ব্যাংকের অবসরপ্রাপ্ত কর্মকর্তারা বেসরকারি বাণিজ্যিক ব্যাংকে কাজ করতে এসে কর্র্তৃপক্ষের কাছ থেকে এ ধরনের নির্দেশনা পেয়ে হতাশ ও বিব্রত। 
১৯২২ সালের আয়কর আইন এবং ১৯৮৪ সালের আয়কর অধ্যাদেশের মাধ্যমে বিভিন্ন সময়ে নতুন শিল্প ও কলকারখানা স্থাপনে বিনিয়োগ, বিদ্যমান শিল্প-কলকারখানার উৎপাদন বাড়ানো বা আধুনিকায়ন, পুঁজিবাজারে বিনিয়োগ, ফ্যাটবাড়ি কেনা ও নির্মাণে বিনিয়োগ, শিল্পঋণ পরিশোধে বিনিয়োগ, ভূমি ক্রয়ে বিনিয়োগ, ব্যক্তিগত ব্যবহারে মোটরগাড়ি কেনা প্রভৃতিতে নির্ধারিত হারে কর দেয়া অথবা কর দেয়া ছাড়াই বিভিন্ন সময়ে কালো টাকা সাদা করার সুযোগ দেয়া হয়েছে। এ ছাড়াও জাতীয় রাজস্ব বোর্ড এসআরও-এর মাধ্যমে দু-তিনবার শতকরা ১০ টাকা হারে কর দেয়ার মাধ্যমে কালো টাকা সাদা করার সুযোগ দেয়া হয়েছিল। সরকারের উচ্চপর্যায়ের সংশ্লিষ্ট একজন মন্ত্রী ও সচিবের বক্তব্য থেকে আভাস পাওয়া যায়, এ বছরের বাজেটে সম্ভবত কালো টাকা সাদা করার সুযোগ দেয়া হচ্ছে; যদিও এ আভাসটি এনবিআর চেয়ারম্যানের বক্তব্যে ইতোমধ্যে সুস্পষ্ট হয়েছে। এ সুযোগটি যে কিছু বিশেষ ব্যক্তিকে নতুন অনুমোদন পাওয়া ব্যাংকের উদ্যোক্তা পরিচালক হিসেবে ৪০০ কোটি টাকা জমা দেয়ার পথকে সুগম করার জন্য করা হচ্ছে; সে বিষয়ে অর্থনীতিসংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের মধ্যে কোনো দ্বিমত নেই। 
একটি দেশের সংশ্লিষ্ট প্রভাবশালী মন্ত্রী যখন বলেন রেমিট্যান্সের ক্ষেত্রেও কালো টাকা উৎপাদন হয়, আর এর পাশাপাশি যখন তার অধীনস্থ সচিব বলেন কালো টাকার সাথে দুর্নীতির কোনো সম্পর্ক নেই, তখন উভয় মন্তব্যকে কষ্টার্জিত বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনকারী প্রবাসী শ্রমিক ও সৎ করদাতাদের সাথে প্রহসন বৈ আর কিছু কি বলা যায়? রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ পর্যায় থেকে এ দেশের জনগণ যত দিন এ ধরনের প্রহসনের বাণী শুনতে থাকবে, তত দিন আমাদের ব্যাংকিং খাতসহ অন্য কোনো খাতেই যে শৃঙ্খলা ফিরে আসবে না, তা বোধ করি দেশের সচেতন জনমানুষ অনুধাবন করতে সক্ষম। বিগত সরকারের প্রয়াত সংশ্লিষ্ট মন্ত্রী চাপের মুখে বাণিজ্যিক ব্যাংকের অনুমোদন না দিয়ে নিজের দৃঢ়তাকে অক্ষুণœ রাখতে সমর্থ হয়েছিলেন; কিন্তু বর্তমান সংশ্লিষ্ট মন্ত্রী জীবনের শেষ পর্যায়ে নৈতিকতাকে বিসর্জন দিয়ে রাজনৈতিক চাপের কাছে মাথা নত করে গণতান্ত্রিক সরকারকে অনেক ক্ষেত্রে আপস করতে হয়, এ কথা বলে তার সারা জীবনের অর্জন কী কারণে ভূলুণ্ঠিত করলেন তা তাকে ভাবিয়ে না তুললেও দেশবাসীকে ভাবিয়ে তুলেছে। তাই প্রশ্নÑ কেন ও কার স্বার্থে এবার এ সুযোগ প্রদান, যখন দেশের প্রধানমন্ত্রী স্বয়ং এ সুযোগ নেয়ায় তার প্রতিপক্ষকে তির্যক প্রশ্নবাণে জর্জরিত করে তুলছেন। 
লেখক : সাবেক জজ ও সাবেক রেজিস্ট্রার
সুপ্রিম কোর্ট
iktederahmed@yahoo.com

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন