বৃহস্পতিবার, ৭ জুন, ২০১২

আমেরিকায় নির্বাচন: ছি ছি, এত্তা জঞ্জাল!


বারাক ওবামা, মিট রমনি
বারাক ওবামা, মিট রমনি
হাসান ফেরদৌস

১৮৩১ সালে ফরাসি বুদ্ধিজীবী এলেক্সি দে তকভিল ও তাঁর বন্ধু গুস্তাভ দে বুমঁ প্রায় নয় মাস আমেরিকার শহর-গ্রাম ঘুরে মস্ত একখানা বই লিখেছিলেন। ডেমোক্রেসি ইন আমেরিকা নামের সে গ্রন্থ এখনো এ দেশে স্কুল-কলেজে পড়ানো হয় মূলত এ কথা বোঝানোর জন্য যে এই দেশটা সারা বিশ্বে কেন গণতন্ত্রের সেরা বরকন্দাজ। ‘আমরাই সেরা’—এ কথা এ দেশের রাজনীতিক ও পণ্ডিতকুল এতবার এতভাবে বলেছেন যে এ দেশে এমন মানুষের অভাব নেই যারা বিশ্বাস করে, দেশটা সত্যি সত্যি ‘সকল দেশের সেরা’। তকভিলের বইটি তাদের এ ক্ষেত্রে বেশ ভালোভাবেই কাজে লেগেছে।
অনেক কথার মধ্যে এমন একটা কথা তকভিল সে গ্রন্থে বলেছিলেন, যা এখনো অক্ষরে অক্ষরে সত্যি। সেই আদি যুগে বসেই তিনি টের পেয়েছিলেন আমেরিকায় টাকার ওপর অধিক সত্য আর কিছু নেই। টাকায় সেখানে বিকোয় না এমন কোনো দ্রব্য নেই। তকভিল লিখছেন, ‘এ দেশের মানুষের চরিত্রের একটু গভীরে গেলেই টের পাওয়া যায়, এই বিশ্বে মূল্যবান এমন যেকোনো কিছুই তারা শুধু একটি প্রশ্নের উত্তরে নির্ধারণ করতে চায়, আর তা হলো: ‘এ থেকে কী পরিমাণ মালকড়ি মিলবে?’
টাকা, টাকা, টাকা। আমেরিকায় ব্যক্তি জীবন বলুন আর রাজনীতিই বলুন, টাকাই মহেশ্বর।
আমাদের বিবেচ্য আমেরিকার রাজনীতি, অতএব সেদিকেই নজর দেওয়া যাক। এ দেশে কাগজে-কলমে যে কেউ নির্বাচিত হতে পারে। জাত-পাতের কোনো ব্যাপার নেই, এমনকি গাত্রবর্ণও এখন আর গুরুত্বপূর্ণ নয়। আব্রাহাম লিঙ্কন, আমেরিকার সবচেয়ে জনপ্রিয় প্রেসিডেন্টদের একজন, সাধারণ কৃষকের সন্তান। এলিজাবেথ ওয়ারেন নামে হার্ভার্ডের যে অধ্যাপক এ বছর মার্কিন সিনেটের নির্বাচনে জোর প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছেন, তাঁর বাবা ছিলেন সাধারণ ঝাড়ুদার। কিন্তু সমস্যা হলো, কৃষকের ছেলেই হোন বা ঝাড়ুদারের কন্যা, নির্বাচনে জিততে হলে আপনার চাই কাঁড়ি কাঁড়ি টাকা। যাঁর যত টাকা, তাঁর তত প্রচারণার জোর। এই টেলিভিশনের যুগে বিজ্ঞাপনের পেছনে যিনি যত টাকা ঢালতে পারবেন, তাঁর জেতার সম্ভাবনা তত বেশি।
আগামী নভেম্বরে আমেরিকায় প্রেসিডেন্ট নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে। প্রধান দুই প্রতিদ্বন্দ্বী—বারাক ওবামা ও মিট রমনি—এখন চোখ-কান বুজে শুধু টাকা কুড়িয়ে বেড়াচ্ছেন। ওবামার লক্ষ্য, নির্বাচনের আগে এক বিলিয়ন ডলারের ‘যুদ্ধ-ভান্ডার’ গড়ে তোলা। রাজ্যপাট চুলোয় গেছে, তিনি এখন এই শহর-সেই শহর চষে বেড়াচ্ছেন বড়লোক বন্ধুদের সঙ্গে খানাপিনা ও চাঁদা সংগ্রহে। আজ নিউইয়র্কে ওয়াল স্ট্রিটে কোনো ধনকুবের, তো কাল হলিউডে ফিল্মি তারকাদের মহফিলে। অঙ্কটা মোটেই তাঁর ধরাছোঁয়ার বাইরে নয়। ২০০৮ সালের নির্বাচনে একদম অজানা একজন প্রার্থী হয়েও ওবামা তুলেছিলেন প্রায় সাড়ে সাত শ মিলিয়ন ডলার। এখন তো তিনি দেশের রাজা!
খুব একটা পিছিয়ে নেই মিট রমনিও। তিনি এমনিতেই বহু বহু কোটিপতি, কোনো কাজ-কর্ম না করে ঘরে বসেই প্রতিবছর প্রায় ৫০ মিলিয়ন ডলার আয় করে থাকেন। ওবামা যদি তাঁর নির্বাচনী কাজের জন্য এক বিলিয়ন ডলার জোগাড় করতে পারেন, তো তিনি তার থেকে বেশি বৈ কম কুড়োবেন না। ওবামার বেশির ভাগ টাকা অবশ্য আসছে ২৫০ ডলার বা তার চেয়ে কম পরিমাণ চাঁদা দাতাদের কাছ থেকে, মুখ্যত সামাজিক যোগাযোগ (ফেসবুক ও টুইটার) মাধ্যমে। রমনি সে পথে না গিয়ে হাত বাড়িয়েছেন রাঘব বোয়ালদের পকেটে। মনে করা হচ্ছে, লাস ভেগাসের এক জুয়াখানার (ভদ্র ভাষায় ক্যাসিনো) মালিক শেলডন এডেলসন একাই হয়তো এক শ মিলিয়ন বা তার চেয়েও বেশি ডলার রমনির নির্বাচনী কমিটিকে দেবেন।
২০১০ সালে এ দেশের সুপ্রিম কোর্ট নির্বাচনী ব্যয়ের ক্ষেত্রে সব অর্গল তুলে দেওয়ার যে রায় ঘোষণা করে, তার পর থেকে এ দেশের রাজনীতিতে টাকার খেলায় এক সম্পূর্ণ নতুন মাত্রা যুক্ত হয়েছে। সে রায়তে সুপ্রিম কোর্ট এই সিদ্ধান্তে পৌঁছায় যে আমেরিকার করপোরেশনসমূহ নির্বাচনী প্রচারণায় কোনো প্রার্থী বা নির্বাচনী ইস্যুর পক্ষে-বিপক্ষে তাদের ইচ্ছামতো অর্থ ব্যয় করার অধিকার রাখে। এই রায়ের পর থেকে এ দেশের ধনকুবেরেরা ‘কিং মেকার’-এর ভূমিকায় নামার মওকা পেয়েছেন। এঁদের মধ্যে ওবামাকে মনে-প্রাণে ঘৃণা করেন এমন লোকের সংখ্যা কম নয়। তাঁদেরই দুজন হলেন কোক ব্রাদার্স। চার্লস ও ডেভিড কোক নামের এই দুই ভ্রাতা তাঁদের বাবার রেখে যাওয়া বিশাল সম্পদের একমাত্র উত্তরাধিকারী। খেটে খাওয়ার চিন্তা নেই, শুধু চিবিয়ে খেলেও যে পরিমাণ অর্থ তাদের আছে, চৌদ্দ পুরুষেও তা ফুরোবে না। এই দুই ভাই ঠিক করেছেন, যেভাবেই হোক, যে মূল্যেই হোক, ওবামাকে হোয়াইট হাউস থেকে তাড়াবেন। সে উদ্দেশ্যে যত অর্থ দরকার, তা ঢালতে তাঁরা দ্বিধা করবেন না। সুপ্রিম কোর্ট তো রায় দিয়ে বসেই আছে, তাঁদের টাকা ঢালতে সমস্যা কোথায়? ভাবা হচ্ছে, জর্জ বুশের সাবেক মন্ত্রণাদাতা (ও সব কাজের পাজি) কার্ল রোভের সঙ্গে হাত মিলিয়ে তাঁরা কম করে হলেও এক বিলিয়ন ডলার খরচ করবেন এ বছরের নির্বাচনে ওবামা ও ডেমোক্র্যাটদের পরাস্ত করতে।
শুধু টাকার খেলাই নয়। এবারের নির্বাচনে যেসব রাজ্যে রিপাবলিকান গভর্নর ও আইনি পরিষদ ক্ষমতায় সমাসীন, কীভাবে ডেমোক্র্যাটদের বাক্সে ভোট কমানো যায়, তাঁরা সে চেষ্টায় নাওয়া-খাওয়া ছেড়ে দিয়েছেন। তাঁদের হাতে যেসব দাওয়াই আছে তার একটা হলো ভোট গ্রহণের সীমানা নির্ধারণ। এ দেশে প্রতি ১০ বছর অন্তর জনসংখ্যা গণনার রেওয়াজ আছে। ১০ বছরে কোনো এলাকায় বসবাসরত মানুষের সংখ্যা কখনো কমে, কখনো বাড়ে। মোট জনসংখ্যার অনুপাত অনুসারে নতুন করে নির্বাচনী এলাকার মানচিত্র তৈরির দায়িত্ব অধিকাংশ অঙ্গরাজ্যের আইনসভার হাতে। যখন যে দল ক্ষমতায়, নিজেদের সুবিধামতো এই মানচিত্র তৈরির কাজটি তারা কখনো গোপনে, কখনো প্রকাশ্যে সেরে ফেলে। ২০১০ সালের নির্বাচনের পর এ দেশের অনেক রাজ্যই এখন রিপাবলিকানদের নিয়ন্ত্রণ। তারা যে নতুন নির্বাচনী মানচিত্র তৈরি করেছে, তাতে ২০ থেকে ২৫ বা তার চেয়েও বেশি আসনে ডেমোক্র্যাটদের তুলনায় রিপাবলিকানদের অবস্থান অধিক সুবিধাজনক।
এর চেয়েও নির্লজ্জভাবে যে কাজটি শুরু হয়েছে, তা হলো ডেমোক্র্যাটদের ভোটিং ব্লক বলে পরিচিত লোকজন, যেমন কৃষ্ণাঙ্গ, সংখ্যালঘু, অভিবাসী—তাদের ভোট দেওয়ার সুযোগ সংকুচিত করে আনা। এই গ্রুপভুক্ত মানুষজন দরিদ্র, অল্প শিক্ষিত, ভোটের ব্যাপারে কম উৎসাহী।
রিপাবলিকানরা চাইছে নানা রকম শর্ত আরোপ করে এদের ভোট প্রদানে নিরুৎসাহী করতে। এসব চেষ্টার একটা হলো প্রতিটি ভোটদাতার সরকারি পরিচয়পত্র থাকার বাধ্যবাধকতা। এমনিতে সরকারি আইডি পাওয়া কোনো কঠিন ব্যাপার নয়, কিন্তু সে জন্য উদ্যোগ নিয়ে সরকারি দপ্তরে যেতে হবে, ছবি তুলতে হবে, পরিচয় প্রমাণের জন্য নথিপত্র দেখাতে হবে। যাদের অহোরাত্রি পেটের কথা ভাবতে সময় যায়, তাদের কী এমন দায় পড়েছে কাজ-কম্ম ছেড়ে শুধু আইডি কার্ডের জন্য সরকারি অফিসে ধরনা দিতে হবে? ঠিক এই বিবেচনা থেকেই রিপাবলিকান-কর্তারা ভোটার আইডি নিয়ে নানা রকম ফন্দি-ফিকির শুরু করেছেন।
উদাহরণ হিসেবে ফ্লোরিডা অঙ্গরাজ্যের কথা ধরা যাক। ফ্লোরিডার গভর্নর বলেছেন, ভোটে কারচুপি ঠেকাতে ভোটার তালিকা থেকে আগাছা দূর করতে হবে। সে উদ্দেশ্যেই ভোটার আইডির নিশ্চয়তা করতে হবে। কথা হলো, ভোটার তালিকায় কী পরিমাণ ‘আগাছা’ ঢুকেছে যে হঠাৎ দরকার পড়ল নতুন করে তালিকা বানানোর? নিরপেক্ষ বিশেষজ্ঞরা বলছেন, তালিকায় ভুল নাম রয়েছে এমন সংখ্যা অতি সামান্য। এই ভুল কিছুটা কম্পিউটারের, কিছুটা নির্বাচনী কর্মীদের। ইচ্ছা করে নাম ঢোকানো হয়েছে এমন প্রমাণ কার্যত নেই। নাগরিক অধিকার নিয়ে কাজ করেন এমন একাধিক প্রতিষ্ঠান থেকে বলা হয়েছে, ভোটাধিকার শুদ্ধিকরণের নামে আসলে যা হচ্ছে তা হলো ডেমোক্র্যাটদের পক্ষাবলম্বন করে এমন মানুষদের ভোট প্রদানে অনুৎসাহিত করা। যেসব রাজ্যে দুই দলের প্রতিদ্বন্দ্বিতা তীব্র, সেখানেই ভোট নিয়ে এসব নয়ছয়ের চেষ্টা বেশি। ব্রেনান সেন্টার ফর জাস্টিস নামের একটি গবেষণা প্রতিষ্ঠান হিসাব করে বলেছে, এবারের নির্বাচনে কম করে হলেও ৫০ লাখ লোকের ভোট খোয়া যাওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। এই সেন্টারের নির্বাহী প্রধান ওয়েন্ডি ভাইজার মন্তব্য করেছেন, ‘এসব চেষ্টা বাস্তবায়িত হলে ভোটের পাল্লা এদিক-সেদিক হলে অবাক হওয়ার কিছু থাকবে না।’ তিনি আইন পরিষদের নির্বাচন নয়, প্রেসিডেন্ট পদে নির্বাচনের প্রতি ইঙ্গিত করেই এ মন্তব্য করেছেন।
আশার কথা এই যে, রিপাবলিকান গভর্নর ও আইন পরিষদের এই পাঁয়তারা মার্কিন বিচার বিভাগের নজরে এসেছে। তারা ফ্লোরিডা, টেক্সাস ও সাউথ ক্যারোলাইনা রাজ্য সরকারের ভোটাধিকার নিয়ন্ত্রণের চেষ্টার বিরুদ্ধে আপত্তি তুলেছে। এ নিয়ে জল আরও ঘোলা হবে বলেই মনে হয়।
তকভিল ফ্রান্স থেকে আমেরিকায় ভ্রমণ শেষে দেশটির অনেক ব্যাপারেই আশাবাদী হয়েছিলেন। আমেরিকা মহান, এমন কথা বলেছিলেন। তিনি এ কথাও বলেছিলেন, এ দেশের মানুষ তাদের অধিকারের ব্যাপারে অত্যন্ত সচেতন। অন্যের অধিকার যাতে লঙ্ঘিত না হয়, সে ব্যাপারে তারা সমান সজাগ, কারণ তারা জানে, অপরের অধিকার লঙ্ঘিত হলে, একসময় তাদের নিজেদের অধিকারও হুমকির মুখে পড়তে পারে। আজকের আমেরিকার গণতন্ত্রের বেহাল অবস্থা দেখে তকভিল নির্ঘাৎ তার কবরে এপাশ-ওপাশ করছেন আর বলছেন, ছি ছি, এত্তা জঞ্জাল!
হাসান ফেরদৌস: প্রাবন্ধিক ও কলাম লেখক।

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন