প লা শ কু মা র রা য়
বর্তমানে হিন্দু পারিবারিক আইন সংস্কারের তৎপরতা লক্ষ্য করা যা”েছ। কতিপয় নারীবাদী স্বে”ছাসেবী উন্নয়ন সং¯’া (এনজিও), আইন কমিশন এবং আইন মন্ত্রণালয় চায়, হিন্দু বিয়ে রেজিস্ট্রেশন, বিয়ে বি”েছদ এবং সম্পত্তিতে নারীর পূর্ণ অংশীদারিত্ব। হিন্দু ধর্মে বিয়ে একটি পবিত্র কর্তব্য এবং ঈশ্বরের অনুগ্রহ লাভের মুখ্য উপায়।
হিন্দু আইন হিন্দুদের ব্যক্তিগত আইন। ১৯৪৭ সালে ভারত বিভক্তির পূর্ব পর্যন্ত ব্রিটিশ ভারতে সংবিধিবদ্ধ সব আইন দেশ বিভাগের পরবর্তীকালেও ভারত ও তদানীন্তন পাকিস্তানে প্রযোজ্য ছিল। দেশ বিভাগের পর ভারতে হিন্দু আইনের ব্যাপক সংস্কার ও পরিবর্তন করা হয়েছে। ভারতে ১৯৫৫, ১৯৫৬, ১৯৬০ এবং ২০০৫ সালে হিন্দু আইনে ব্যাপক সংস্কার করা হয়। নেপালেও হিন্দু পারিবারিক আইন যুগোপযোগী করতে সময় সময় সংস্কার করা হয়েছে। ১৯৩৭ সালে সম্পত্তির ওপর হিন্দু নারীর অধিকার আইন প্রবর্তিত হওয়ার পর প্রথম যে ছয়জন মৃত ব্যক্তির সম্পত্তির উত্তরাধিকারী হয়, তারা হ”েছ : পুত্র, পৌত্র, প্রপৌত্র, মৃত ব্যক্তির বিধবা স্ত্রী; মৃত ব্যক্তির মৃত্যুর পূর্বে মৃত পুত্রের বিধবা স্ত্রী; মৃত ব্যক্তির পূর্বে মৃত পুত্রের পূর্বে মৃত পুত্রের বিধবা স্ত্রী। আইনের ছাত্র হিসেবে আমরা জানি, হিন্দু আইনের উৎস হল বেদ অথবা শ্র“তি, স্মৃতি; ব্যাখ্যা বা নিবন্ধ এবং প্রথা। ব্যাখ্যা বা নিবন্ধকের মধ্যে দুটি মতবাদ আছে, যথাÑ মিতাক্ষরা মতবাদ (সমগ্র বাংলাদেশ এবং ভারতের পশ্চিমবঙ্গ, ত্রিপুরা, মণিপুর ও আসাম রাজ্য ছাড়া সমগ্র ভারতে হিন্দু সম্প্রদায় মিতাক্ষরা মতানুসারী) এবং দায়ভাগ মতবাদ। পাঁচ শ্রেণীর নারী-পুর“ষদের কাছ থেকে উত্তরাধিকার সূত্রে সম্পত্তি পাওয়ার অধিকারী। যথা : বিধবা, কন্যা, মাতা, পিতামহী এবং প্রপিতামহী। হিন্দু উত্তরাধিকার (সংশোধন) আইন ১৯২৩ দ্বারা কন্যা, দৌহিত্রী এবং বোনও এ তালিকায় সংযোজিত হয়েছে। যেহেতু হিন্দু সমাজে যৌথ ও অবিভক্ত পরিবার গঠন এবং আহার ও উপাসনা একত্রে করার সাধারণ নীতি বিদ্যমান, তাই কোন নারী যখন উত্তরাধিকার সূত্রে কোন সম্পত্তি পায়, তখন ওই সম্পত্তি সীমিত অর্থাৎ জীবন স্বত্বে পায়। তাছাড়া দায়ভাগ (বাংলাদেশে প্রচলিত মতবাদ) মতে, তিন শ্রেণীর উত্তরাধিকারী যারা ক্রমান্বয়ে মৃত ব্যক্তির উত্তরাধিকারীর উপযুক্ত, যথা : সপিণ্ড; সকুল্য এবং সমানোদক।
১৯৭৬ সালে ভারতীয় বিয়ে আইন সংশোধনীর আওতায় নিুোক্ত কারণে স্বামী-স্ত্রী পৃথক বসবাসের সুযোগ পাবে। যথা : বিয়ের পর কোন পক্ষ যদি অপর কোন পুর“ষ বা স্ত্রীর সঙ্গে ব্যাভিচারী জীবনযাপন করে; আবেদনকারী যদি নিষ্ঠুরতার শিকার হয়, আবেদনকারীকে পরিত্যাগ করে অপর পক্ষ যদি একাদিক্রমে দুই বছর নির“দ্দেশ থাকে, আবেদনকারীর অপর পক্ষ যদি ধর্মান্তরিত হয়; আবেদনকারীর অপর পক্ষ যদি মারাÍক রোগে রোগাক্রান্ত হয়।
২১ মে ২০১২ সোমবার মন্ত্রিসভার সাপ্তাহিক নিয়মিত বৈঠকে হিন্দু বিয়ে নিবন্ধন বিলের খসড়া অনুমোদন করা হয়। আমরা যতদূর জেনেছি, চলতি বাজেট অধিবেশনে হিন্দু বিয়ে নিবন্ধন বিল ২০১২ পাস করা হবে। ওই বিলে হিন্দু বিয়ে নিবন্ধন বিলে নিবন্ধনের কথা বলা হলেও শাস্ত্রমতে বিয়ের বৈধতা ক্ষুণœ হবে না। তবে নিবন্ধন ব্যব¯’াকে আইনে বাধ্যতামূলক করা হয়নি। বিয়ে নিবন্ধনের ব্যব¯’াকে ঐ”িছক হিসেবে রাখা হয়েছে। হিন্দু বিয়ে নিবন্ধন করা কিংবা না করা এটা পক্ষগণের সিদ্ধান্তের ওপর নির্ভর করছে। যদিও ১৯৬৫ সালে ভারতে এবং ১৯৭২ সালে নেপালে হিন্দু বিয়ে নিবন্ধনের ব্যাপারটি বিয়ের আবশ্যিক অধ্যায় বলে আইন প্রণয়ন করা হয়েছে। জাতীয় সংসদে পাস হওয়ার পরই এ বিষয়ে বিধিমালা প্রণয়নসহ ৪৮২টি উপজেলায় হিন্দু বিবাহ রেজিস্ট্রার নিয়োগ দেয়া হবে। বাংলাদেশে বসবাসকারী হিন্দুদের নতুন এ ধরনের নিয়মনীতির সঙ্গে তাল মিলিয়ে নিতে বিয়ে নিবন্ধককে অবশ্যই শিক্ষিত, দায়িত্বশীল, নিষ্ঠাবান এবং ব্যক্তিত্বসম্পন্ন হিন্দু হতে হবে।
স্বাধীনতার চার দশক পর হিন্দু পারিবারিক আইন সংস্কারের উদ্যোগ সরকার গ্রহণ করল ঠিকই কিš‘ হিন্দু বিয়ে নিবন্ধন আইনটি ঐ”িছক (নিবন্ধন না করলেও চলবে) করা হল কেন? এমন প্রশ্ন অনেকের। সরকার কি এ ধরনের একটি সংবেদনশীল ও স্পর্শকাতর বিষয়ে ধীরে চল নীতি অনুসরণ করছে? তাই যদি হয়, তাহলে একটি ধর্মীয় গোষ্ঠীর ব্যক্তিগত বা পারিবারিক আইন সংশোধন বা সংস্কার করতে চাইলে শুর“তে কমিশন (ওই ধর্মের প্রাজ্ঞ ব্যক্তিদের নিয়ে) বা পরামর্শক পর্ষদ গঠনের নীতি সরকার অনুসরণ করল না কেন? দেশে হিন্দু বিয়ে নিবন্ধনের মতো হাজারও সমস্যা বিরাজমান। যেমন : সংখ্যালঘু মেয়ে/নারীদের জোরপূর্বক অপহরণ, ধর্ষণ এবং ধর্মান্তকরণ রোধে আইন প্রণয়ন; অর্পিত সম্পত্তি আইনের সুরাহা না হওয়া, সরকারি চাকরি এবং সংসদে সংখ্যালঘুদের জন্য সংখ্যানুপাতে কোটা ব্যব¯’া প্রবর্তন করা; সংখ্যালঘু উন্নয়নবিষয়ক মন্ত্রণালয় প্রতিষ্ঠা ইত্যাদি। আমরা বিশ্বাস করি, সরকার পর্যায়ক্রমে সংখ্যালঘুদের উপরোল্লিখিত সমস্যাবলী ¯’ায়ীভাবে সমাধানকল্পে জর“রি পদক্ষেপ নেবে।
বিয়ে নিবন্ধনের পাশাপাশি সম্পত্তিতে হিন্দু নারীর উত্তরাধিকারসংক্রান্ত ব্যাপারটিও বেশ জোরালো। এ প্রসঙ্গে সম্প্রতি ঢাকার একটি পারিবারিক আদালতের ঐতিহাসিক রায়ের কথা উল্লেখ করা যেতে পারে। কুমিল্লার মুরাদনগর উপজেলার মুরাপুর গ্রামের সীমা রানী দাস একই জেলার রতন দাসকে বিয়ে করে ১৯৯৩ সালে। বৈবাহিক জীবনে তাদের দুটি কন্যাসন্তানও রয়েছে। রতন দাস হঠাৎ স্ট্রোক করে ২০০৫ সালে মারা যায়। মৃত্যুকালে রতন দাস ঢাকার বাসাবো, সবুজবাগ এলাকায় ভাই ভাই স্টোর (মুদি দোকান) রেখে মারা যায়। সীমা দাস পারিবারিক আদালতে খোরপোষের মামলা করলে, আদালত সীমা ও তার নাবালিকা দুই কন্যার ভরণপোষণ বাবদ বিগত দিনগুলোর জন্য ৪ লাখ ২৮ হাজার ৫০০ টাকা দেয়ার নির্দেশ দেন। একই সঙ্গে আদালত বলেন, সীমা ও তার দুই কন্যা ওই যৌথ সম্পত্তি থেকে ভরণপোষণ লাভের অধিকারী হবে এবং ভাই ভাই স্টোর থেকে যে লভ্যাংশ আসবে, তার অংশবিশেষ তাদের জীবদ্দশায় ভোগ করবে (বিয়ে নিবন্ধন ও অন্যান্য দালিলিক প্রমাণপত্র না থাকার পরও সীমা এবং তার দুই মেয়ে আদালত থেকে যে রায় পেয়েছে, এটা একটা উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত বলা যেতে পারে)।
ব্রাহ্মণ মহাশয়ের সংস্কৃত মন্ত্র উ”চারণ ব্যতিরেকে হিন্দু বিয়ে সম্পন্ন হয় না। অনেকে আশংকা করেন, ভবিষ্যতে ব্রাহ্মণ পাওয়া যাবে কি না! যেহেতু তারা শিক্ষা-দীক্ষা গ্রহণ করে ব্যবসা কিংবা চাকরির পেশা বেছে নি”েছ। ন্যায়-নিষ্ঠাবান ব্রাহ্মণ সমাজকে টিকিয়ে রাখার দায়িত্বটাও কিš‘ সরকারের। সরকার চাইলে প্রতিটি বিভাগীয় শহর এবং ঢাকায় হিন্দু পুরোহিতদের প্রশিক্ষণালয় প্রতিষ্ঠা করে আধুনিক প্রশিক্ষণ ব্যব¯’ার আওতায় নিতে পারে। সদাশয় সরকার এসব শিক্ষিত পুরোহিতকে অঞ্চলভিত্তিক হিন্দু বিয়ে নিবন্ধক হিসেবে নিয়োগ দিতে পারে।
হিন্দু নারীর অধিকার তথা বিয়ে নিবন্ধন এবং সম্পত্তিতে ছেলেমেয়ের সমান অংশীদারিত্বের ব্যাপারে পক্ষে-বিপক্ষে মতামতদানকারী লোকজনের অভাব নেই। উভয়পক্ষই যৌক্তিকভাবে তাদের মতামত পেশ করে থাকে। উভয়পক্ষের মতামত এবং দাবি-দাওয়াকে উপেক্ষা করে সরকার একতরফাভাবে একটি ধর্মীয় গোষ্ঠীর ধর্মীয় বিশ্বাস ও মৌলিক চিন্তন পরিপš’ী আইন প্রণয়ন করলে, সেটা কতটা সুফল বয়ে আনবে তাও ভাবতে হবে। আমরা যতদূর শুনেছি, চলতি বাজেট অধিবেশনেই হিন্দু বিয়ে নিবন্ধন বিলটি সংসদে পাস করানো হবে। এ ধরনের আইন চূড়ান্তভাবে প্রণয়নের আগে দেশের বিদ্যমান অব¯’া বিবেচনা করে প্রয়োজনে প্রস্তাবিত বিলটি সংশোধন, পরিমার্জন করে যুগোপযোগী করতে হবে।
বিয়ে নিবন্ধক কে হবে? নিবন্ধকের দায়িত্বটা যেন ¯’ানীয় শিক্ষিত পুরোহিতরা পায় সেটা নিশ্চিত করতে হবে। রাজধানী ঢাকায় একজন সচিব পদমর্যাদার ব্যক্তিকে (অবশ্যই হিন্দু) দেশের সব নিবন্ধকের দেখভালের জন্য মহাপরিচালক হিসেবে দায়িত্ব পালন করতে দেয়া হোক। একই সঙ্গে চলতি বাজেট অধিবেশনে হিন্দু নারীসহ প্রান্তিক নারীগোষ্ঠীর দুর্ভোগ-দুর্দশা লাঘব করে রাষ্ট্রের মূল স্রোতধারার নারীদের সমান সুযোগ-সুবিধা নিশ্চিত করা হোক। সংখ্যালঘুসহ প্রান্তিক নারীর জন্য বাজেটে আলাদা থোক বরাদ্দ রাখা হোক। অনগ্রসর নারীদের শিক্ষা, স্বা¯’্যসহ অন্যান্য মৌলিক অধিকারগুলো বাস্তবায়ন করা হোক। পশ্চাৎপদ নারীগোষ্ঠীকে অর্থনৈতিকভাবে স্বনির্ভর, রাজনৈতিক ক্ষমতায়িত এবং সামাজিকভাবে উপযুক্ত মূল্যায়ন করা হোক। এগুলো সরকারকেই আন্তরিকতার সঙ্গে পর্যায়ক্রমে উদ্যোগ নিতে হবে। আর আমাদেরও কী কোন দায়দায়িত্ব নেই? হিন্দু শাস্ত্র মতে, নারীকে (স্ত্রী ছাড়া) মাতৃজ্ঞানে অর্ঘ্য নিবেদন করতে হবে। আসুন, সময়োপযোগী আইন প্রণয়নের পাশাপাশি আমরা ব্যক্তিগতভাবে নারীকে উপযুক্ত মর্যাদা এবং মূল্যায়ন করার ক্ষেত্রে দৃঢ় অঙ্গীকারাবদ্ধ হই।
পলাশ কুমার রায় : আইনজীবী, ঢাকা
ঢ়ধষধংযৎড়ু২০১২@ুধযড়ড়.পড়স
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন