শনিবার, ৯ জুন, ২০১২

বাজেটে শিক্ষা : একটি প্রাথমিক পর্যবেক্ষণ


কা জী ফা র“ ক আ হ মে দ
অর্থমন্ত্রী এ এম এ মুহিত ৭ জুন জাতীয় সংসদে যে বাজেট উপ¯’াপন করেছেন, তার মধ্যে শিক্ষার অব¯’ান নিয়ে মূলত এ লেখা, যা প্রাথমিক পর্যবেক্ষণ হিসেবে বিবেচনাযোগ্য। শিক্ষা সমাজ-সংস্কৃতি নিয়ে ভাবেন আমার এমন এক বন্ধুর ভাষায়, বাজেট গদ্য পদ্য কোনটাই নয়। ভবিষ্যতের সম্ভাব্য আয়-ব্যয়ের হিসাব বিবরণীও নয়। দেশের জনগণের জন্য দিকনির্দেশনা, অপ্রাপ্তিকে প্রাপ্তিতে রূপান্তর, যে সম্পদ আপাত দৃষ্টিগোচর নয়, তাকে উজ্জ্বল সম্ভাবনায় প্রকাশ করে সামষ্টিক জাতীয় আ¯’াশীলতায় উপ¯’াপনের বিষয়টি এখানে মুখ্য। তবে বাজেটে সংযোজন-বিয়োজনের দাবি ও সে সংক্রান্ত জটিলতা, শিল্পপতি-ব্যবসায়ীদের সপক্ষে বৈষয়িক অনুকূল পরিবেশ এবং পেশাজীবীদের প্রত্যাশার প্রতিফলন, শিল্প ও কৃষি শ্রমিকের অনু”চারিত অস্তিত্ব রক্ষার আকুতিও এর মধ্যে অন্তর্ভুক্ত। অবশ্য বাজেটে কোথায় কী আছে তা খুঁজে বের করা, কোথায় ঠিক কোথায় বেঠিক বরাদ্দ হয়েছে, কোথায় এর সীমারেখাকে সম্প্রসারিত অথবা সঙ্কুচিত করা দরকার সেদিকে অঙ্গুলি নির্দেশ সহজ নয়। এক্ষেত্রে প্রয়োজন হয় বিষয়গত দক্ষতার, যা অর্থনীতির বইয়ে বাজেটের অধ্যায় পড়ে অথবা পড়িয়ে অর্জন সম্ভব নয়। বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর হওয়ার আগে ড. আতিউর রহমান এক সময় বাজেটের সরল পাঠের উদ্যোগ নিয়েছিলেন। সে উদ্যোগের গতি এখন কী হয়েছে জানি না। এবার বাজেট ঘোষণার পরদিন বরাবরের মতো বিভিন্ন পত্রিকায় বিভিন্ন শ্রেণী-পেশার মানুষের প্রতিক্রিয়া দেখলাম। এক শ্রমজীবী বললেন, বাজেট বড় লোকদের ব্যাপার। আমাদের কোন কাজে আসে না। এক মুদি দোকানির উক্তি, বাজেট ঘোষণা মানে তো জিনিসপত্রের দাম বৃদ্ধি, যা একবার বাড়লে আর কমে না। বাজেট সম্পর্কে জিজ্ঞাসিত ঢাকা মহানগরের এক দিনমজুরের প্রশ্ন, ‘বাজেটে কি তেল নুন মরিচের দাম কমেছে? চালের দাম তরকারির দাম কি কমবে?’ তার মতে, বাজেট সরকারের ব্যাপার। তবে পেশাজীবী-চাকরিজীবীদের মধ্যে কেউ কেউ বাজেট ঘোষণার পরদিন খবরের কাগজের পাতায় চোখ বুলান কোনটার দাম কমছে কোনটা বাড়ছে দেখতে। 
বাজেট নিয়ে জনগণের বিভিন্ন অংশের ভাবনায় ভিন্নতার পরিপ্রেক্ষিতে তাদের প্রতিনিধিদের অব¯’ান কোথায়? তৃণমূলের জনপ্রতিনিধি থেকে শুর“ করে জাতীয় নীতিনির্ধারণ, আইন প্রণয়নের দায়িত্ব যাদের হাতে ন্যস্ত, বাজেট প্রণয়নে তাদের ভূমিকা কতটুকু তা নিয়ে প্রশ্ন আছে। তাদের মত নিয়ে বাজেট পাস হলেও পূর্ণ বাজেট প্রক্রিয়ায় তাদের অংশগ্রহণ এখন জাতীয় আলোচনার বিষয়। এখন পর্যন্ত এটা মূলত এক শ্রেণীর অর্থনীতি বিশেষজ্ঞ ও প্রশাসক আমলাদের কাজ। সম্প্রতি ইউএনডিপির উদ্যোগে জনপ্রতিনিধিদের বাজেটের বিভিন্ন দিক অবহিতকরণের একটি কর্মসূচি নেয়া হয়েছে বলে জানা যায়। অন্যদিকে বাজেট প্রক্রিয়ার বিকেন্দ্রীকরণের কথা বললেও জনাব মুহিতের ২০১২-১৩ অর্থবছরের বাজেটেও এখন পর্যন্ত আমার পক্ষে যতটুকু দেখা সম্ভব হয়েছে, তার কোন কার্যকর ছাপ দেখতে পাইনি। শিক্ষা ও শিক্ষকদের নিয়েই আমার কাজ। বাজেট প্রসঙ্গে বলতে গেলে বিশেষ করে বেসরকারি স্কুল কলেজ মাদ্রাসা কারিগরি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে শিক্ষক-কর্মচারীদের জানার আগ্রহ কোন্ খাতে কী বরাদ্দ হল, কর্মসং¯’ান কতটুকু বাড়ল, বৈদেশিক মুদ্রা রিজার্ভ ওপরে উঠল কী নামল কিনা, তা নিয়ে নয়। আর্থিক বিশ্বমন্দার প্রভাব মোকাবেলায় সরকার কী করতে পারল না পারল, তাও তাদের বিবেচ্য নয়। যে শিক্ষক সরকার নির্ধারিত সব যোগ্যাতার শর্ত পূরণ করেও এখন পর্যন্ত এমপিও নামের সোনার হরিণটিকে হাতের মুঠোয় ধরতে পারেনি, যে শিক্ষক ২৫-৩০ বছর ধরে পদোন্নতি বঞ্চিত এবং এমপিওভুক্ত বেসরকারি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের পিওন থেকে প্রিন্সিপাল পর্যন্ত যাদের গত তিন যুগ ধরে বাড়ি ভাড়া ১০০ টাকা, তাদের কাছে বাজেট মানে তাদের চাহিদা পূরণ হল কী হল না সে বিবেচনাই বড়। আর এ দেশে দীর্ঘ প্রায় এক শতক ধরে শিক্ষকদের যে সাংগঠনিক প্রক্রিয়া, আন্দোলনের ধারা চলে আসছে সেখানে তাদের দাবিই মুখ্য, শিক্ষার মানে উন্নতি অবনতির প্রশ্ন গৌণ। এর ব্যতিক্রম নেই বলব না। তবে ধারাটি এখনও অতি ক্ষীণ। কিš‘ শিক্ষা নিয়ে দায়িত্বসহকারে কিছু বলতে গেলে বা দু’চার কলম লিখতে হলে দীর্ঘদিনের প্রচলিত বৃত্তের বাইরে আসতে সচেষ্ট হতে হয়। যদিও কাজটি কঠিন ও অপ্রিয়। 
এবারের বাজেট প্রস্তাবে অর্থমন্ত্রী মাথাপিছু জাতীয় আয় ৮৪৮ ডলারে উন্নীত হওয়ার সুখবরের সঙ্গে শিক্ষানীতির সুনির্দিষ্ট উল্লেখ করে ধাপে ধাপে তা বাস্তবায়নের উদ্যোগ, শিক্ষা ক্ষেত্রে বৈষম্য দূরীকরণের উদ্দেশ্য সামনে রেখে ২০১১-১২ অর্থবছর থেকে প্রাথমিক স্তরের পাশাপাশি সারা দেশে মাধ্যমিক, দাখিল, কারিগরি ও এবতেদায়ী স্তরে পাঠ্যপুস্তক বিতরণের সিদ্ধান্ত, তিন থেকে পাঁচ বছর বয়সী শিশুদের জন্য প্রাক প্রাথমিক শিক্ষা কার্যক্রম চালু, ২০১১ সাল থেকে সারা দেশে অভিন্ন পদ্ধতিতে প্রাথমিক শিক্ষাসমাপনী পরীক্ষা গ্রহণ, নিরক্ষরতা দূরীকরণের লক্ষ্যে উপানুষ্ঠানিক শিক্ষানীতির খসড়া প্রণয়ন এবং প্রাথমিক শিক্ষা সম্প্রসারণের পাশাপাশি এর গুণগত মান বৃদ্ধির লক্ষ্যে শিক্ষক শিক্ষার্থীর অনুপাত ১:৫০ থেকে ১:৪০ এ নামিয়ে আনার ও প্রাথমিক শিক্ষা উন্নয়ন কর্মসূচি পিইডিপি-৩ এর আওতায় ৪৭ হাজার ৬ শত ৮০ জন নতুন প্রাথমিক শিক্ষক নিয়োগের কথা বলেছেন। ৭৮০টি নতুন প্রাথমিক বিদ্যালয় ¯’াপন, ১২টি জেলা সদরে পিটিআই ¯’াপন, শিক্ষকদের প্রশিক্ষণ প্রদান এবং প্রাথমিক শিক্ষা ব্যব¯’াপনায় সংস্কার আনার কথা উল্লেখ করেছেন। শিক্ষা বিকেন্দ্রীকরণ, উ”চ শিক্ষা ক্ষেত্রে বিভিন্ন পদক্ষেপসহ প্রধানমন্ত্রীর শিক্ষা সহায়তা ফাউন্ডেশন কার্যক্রমের কথাও তার বাজেট বক্তৃতায় এসেছে। শিক্ষা এবং প্রাথমিক ও গণশিক্ষা খাতে উন্নয়ন ও অনুন্নয়ন মিলে গত বাজেটের চেয়ে টাকার পরিমাণও এবার বেড়েছে। এখন শিক্ষা মন্ত্রণালয় ও প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয় তা কিভাবে ব্যয় করবে বা করতে পারবে, সে সিদ্ধান্ত তাদের। তবে বরাদ্দকৃত অর্থ ব্যয়ে শিক্ষা মন্ত্রণালয়সহ বিভিন্ন মন্ত্রণালয়ের সক্ষমতা নিয়ে প্রশ্ন আছে। গত বছরের জুলাই থেকে এ বছরের এপ্রিল পর্যন্ত অব্যয়িত বরাদ্দের পরিমাণ প্রায় ৪০ শতাংশ। শিক্ষামন্ত্রী ও প্রাথমিক-গণশিক্ষা মন্ত্রী উভয়েই এবারের শিক্ষা খাতে বাজেট বরাদ্দকে মোটামুটি সন্তোষজনক বলেছেন বলে পত্রিকায় সংবাদ ছাপা হয়েছে। এখন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের উন্নয়ন ও শিক্ষক শিক্ষা কর্মীদের প্রত্যাশা বাস্তবায়নে তারা কতটুকু করতে পারবেন তা দেখার বিষয়। সুশীল সমাজ থেকে ইতিমধ্যেই বলা হয়েছে, গত বছরের তুলনায় বাজেটের মূল আর্থিক পরিমাণ বাড়লেও মোট বাজেটের হিসেবে শিক্ষা খাতে বরাদ্দ কমেছে। গত বছর যা ছিল ১২ ভাগের বেশি এবার তা ১১.৫ ভাগ। যদিও এর মধ্যে শিক্ষার্থীর সংখ্যা এবং কোন কোন ক্ষেত্রে প্রতিষ্ঠানের সংখ্যাও বেড়েছে। তারা ইতিমধ্যেই ২০১২-১৩ অর্র্থবছরের প্রস্তাবিত বাজেটকে অসম্পূর্ণ ও অসঙ্গতিপূর্ণ আখ্যায়িত করেছেন। যেখানে প্রতিশ্র“তি থাকলেও বাস্তবায়ন প্রক্রিয়ার প্রতিফলন নেই। 
এবারের বাজেটে কয়েকটি দিক আমার কাছে ইতিবাচক মনে হয়েছে। এর মধ্যে আছে নারী উদ্যোক্তাদের জন্য ১০০ কোটি টাকার থোক বরাদ্দ। তথ্যপ্রযুক্তি খাতে আগের চেয়ে ৩ গুণ বরাদ্দ। কর্মসং¯’ান সৃষ্টির লক্ষ্যে বিভিন্ন উদ্যোগ, দেশ ও বিদেশের কর্মবাজারে প্রবেশে ই”ছুক ব্যক্তিদের দক্ষতা বৃদ্ধির জন্য বরাদ্দ, সৃজনশীলদের জন্য বিশেষ প্রণোদনা ইত্যাদি। তবে ইন্টারনেট ব্যবহারে কর প্রয়োগের বিষয়টি সমর্থন করি না। অবশ্য মোবাইল টেলিফোনে যারা ঘণ্টার পর ঘণ্টা কথা বলে তাদের বেলায় একটানা ৫ মিনিটের বেশি বাক্যালাপের ক্ষেত্রে আমি কর আরোপের পক্ষে। এটা আমার ব্যক্তিগত মত।
ইংরেজিতে একটি কথা আছে, কেক কতটুকু ভালো তা বুঝতে হলে খেয়ে পরীক্ষা করতে হয়। বাজেটে শিক্ষা খাতে বরাদ্দ প্রসঙ্গে আমি মনে করি, বরাদ্দের সদ্ব্যবহারে সাফল্য অর্জন ও সক্ষমতা বৃদ্ধির বিষয়টি অত্যন্ত গুর“ত্বপূর্ণ। জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের সাবেক চেয়ারম্যান আবদুল মজিদের অর্থবছর পরিবর্তনের প্রস্তাব এবং পরনির্ভরতা পরিহার করে কাক্সিক্ষত মাত্রায় জাতীয় উন্নয়নের লক্ষ্যে করদাতার আওতা সম্প্রসারণের পক্ষে আমি। অনলাইনে ট্যাক্স পরিশোধের যে ব্যব¯’া বর্তমান সরকার চালু করেছে তা যুগোপযোগী। এতে বিদ্যুতের সিস্টেম লসের মতো অপচয় ও দুর্নীতির পরিমাণ কমবে। রাজনৈতিক দলসমূহের নেতৃত্বের শিক্ষা পরিকল্পনা প্রণয়ন ও কর্মসূচি গ্রহণের পক্ষে থাকলেও শিক্ষাকে দলীয় স্বার্থ বিবেচনার ঊর্ধ্বে রাখার আমি সমর্থক। এসএসসি, এইচএসসি পরীক্ষা চলাকালে হরতালের মতো কর্মসূচি দিয়ে পরীক্ষার্থী, অভিভাবক ও শিক্ষা ব্যব¯’ায় দুর্যোগ সৃষ্টি কোনভাবেই সমর্থন করা যায় না। একইভাবে সরকারের বাজেট উপ¯’াপনের আগে বাজেট না জেনে না পড়েই বাজেটের সমালোচনা সমর্থন করা যায় না। বাজেট তৈরির প্রক্রিয়া চলাকালে এমনকি বাজেট ঘোষণার কিছু আগেও হাতে সময় রেখে বাজেটে অন্তর্ভুক্তির প্রস্তাব দেয়া যেতে পারে। জাতীয় স্বার্থে ও যৌক্তিক বিবেচনায় সরকারকেও তা মেনে নিতে হবে। কিš‘ সরকারের বাজেট ঘোষণার আগেই ভবিষ্যদ্বাণীর মতো বাজেটের অগ্রিম সমালোচনা এবং সরকারের বাজেট ঘোষণার পর আবার প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করার মতো কার্যক্রম, তা সে যে বা যারাই কর“ক না কেন, অভিপ্রেত হতে পারে না। 
গতবারের বাজেটে শিক্ষানীতির সুনির্দিষ্ট উল্লেখ ছিল না। এবারে তা আছে। শিক্ষা খাতে বরাদ্দের পরিমাণও বেড়েছে। একক খাত হিসেবে বরাদ্দের দিক থেকে শিক্ষার অব¯’ান শীর্ষে। প্রতিরক্ষারও উপরে। শিক্ষার উন্নয়ন, শিক্ষার্থীর কল্যাণে, শিক্ষকদের প্রত্যাশা পূরণে তা কতটা কাজে লাগানো হয়, তাই এখন দেখার বিষয়। এবারের বাজেটের বিস্তারিত আলোচনা-পর্যালোচনায় অনেক অসম্পূর্ণতা খুঁজে পাওয়া যাবে সন্দেহ নেই। তবু এতে প্রত্যাশা ও প্রাপ্তির, প্রত্যাশা ও সামর্থ্যরে মধ্যে একটি ভারসাম্য রক্ষার, প্রাকৃতিক সম্পদ, জনসম্পদ, জ্ঞান-সম্পদ ও সম্ভাবনার মধ্যে সমন্বয় সাধনের প্রয়াস রয়েছে বলে মনে করি। প্রয়োজন বেশ কিছু ক্ষেত্রে স্পষ্টায়নের।
অধ্যক্ষ কাজী ফার“ক আহমেদ : মানব উন্নয়ন উদ্যোগের চেয়ারম্যান ও শিক্ষক আন্দোলনের নেতা
ঢ়ৎরহপরঢ়ধষয়ভধযসবফ@ুধযড়ড়.পড়স

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন