ড. ন জ রু ল ই স লা ম
ইতোপূর্বে উল্লেখ করা হয়েছে বঙ্গবন্ধুর রাজনৈতিক দর্শনে উত্সারিত আওয়ামী লীগের রাজনৈতিক দর্শনের মূর্ত প্রকাশ ঘটে ১৯৭২-এর মূল সংবিধানে। কিন্তু লক্ষণীয় যে, ১৯৭২-এর সংবিধানে প্রতিফলিত রাজনৈতিক দর্শনের পরিবর্তন সূচিত হয় বঙ্গবন্ধুর শাসনামলে এবং তার শাসনকালে সংবিধানে চারটি সংশোধনী আনয়ন করা হয়। এর মধ্যে দ্বিতীয় ও চতুর্থ সংশোধনী বঙ্গবন্ধু তথা আওয়ামী লীগের রাজনৈতিক দর্শনের পুরো বিপরীত অবস্থান। সুতরাং এককথায় বলা চলে, যে দর্শনের ওপর ভিত্তি করে ১৯৭২-এর সংবিধান রচিত হয়েছিল ১৯৭১ থেকে ১৯৭৫ সালের মধ্যে অর্থাত্ মাত্র সাড়ে তিন বছরের মধ্যে বঙ্গবন্ধুর রাজনৈতিক দর্শনের বিপরীত অবস্থান লক্ষ করা যায়। বঙ্গবন্ধুর সর্বশেষ রাজনৈতিক দর্শন ছিল চতুর্থ সংবিধানে বর্ণিত সংবিধান সংশোধনী বিলের ধারায় ধারায় এবং এই বিলের আলোকে আনীত প্রশাসনিক পরিবর্তনের পরিক্রমায়।
ইতোপূর্বে আরও উল্লেখ করা হয়েছে, ১৯৭৫ সালের ১৫ জানুয়ারি জাতীয় সংসদে চতুর্থ সংশোধনী বিল আনয়ন ও পাসের মধ্য দিয়ে ‘বাকশাল’ নামক একদলীয় শাসনব্যবস্থা চালু করা হয়। শুধু তাই নয়, সামরিক-বেসামরিক প্রশাসন-ব্যবস্থাকে রাজনৈতিক দলের (বাকশাল) আওতায় নিয়ে আসা হয়।
৫. ১৯৭২ সালের মূল সংবিধানে (আর্টিকেল ৯৫ (১) ধারামতে বলা হয়েছিল, রাষ্ট্রপতি প্রধান বিচারপতিকে নিয়োগ প্রদান করবেন এবং প্রধান বিচারপতির পরামর্শে (ধভঃবত্ পড়হংঁষঃধঃরড়হ) অন্যান্য বিচারপতি নিয়োগ প্রদান করবেন। কিন্তু সংবিধানের চতুর্থ সংশোধনীর মাধ্যমে বিচারপতি নিয়োগে প্রধান বিচারপতির পরামর্শ বিষয়টি বাদ দেওয়া হয়। এর পরিবর্তে বলা হয়, ‘প্রধান বিচারপতি ও অন্য বিচারপতিগণ রাষ্ট্রপতি কর্তৃক নিয়োগপ্রাপ্ত হইবেন।’ বিচারপতি নিয়োগে রাজনৈতিক হস্তক্ষেপ পরিহারে বা প্রতিরোধে প্রধান বিচারপতির সঙ্গে পরামর্শ বিষয়টি শক্তিশালী রক্ষাকবচ না-হলেও একটি রক্ষাকবচ ছিল। কিন্তু বাকশাল শাসনে সেই রক্ষাকবচটি চুরমার করে বিচারপতি নিয়োগে রাজনৈতিক প্রভাবের দরজা খুলে দেওয়া হয়-যার প্রতিফলন এখন পর্যন্ত চলছে। এর ক্ষতিকর প্রভাব যে বাংলাদেশের বিচার ব্যবস্থাকে কোথায় নিয়ে যাচ্ছে তা সকলেই অনুধাবন করেন এবং এ নিয়ে অনেক আলোচনা-সমালোচনা হলেও এই ব্যবস্থার কোনো পরিবর্তন আজও হয়নি।
৬. প্রতিটি জেলায় একজন করে গভর্নর নিয়োগ করা হয়। এই গভর্নরগণ অনির্বাচিত এবং তত্কালীন রাষ্ট্রপতি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব কর্তৃক সরাসরি নিযুক্ত। নবগঠিত বাকশালের নেতা-নেত্রীদের গভর্নর নিয়োগ করা হয়। শুধু তাই নয়, জেলা প্রশাসনকে গভর্নরের নিয়ন্ত্রণে নিয়ে আসা হয়। জেলা প্রশাসক, পুলিশ, বিচার বিভাগসহ জেলা সদরের সকল সরকারি কর্মকর্তাকে জেলা গভর্নরের অধীনস্থ করা হয়। জেলা গভর্নরগণ শুধু প্রশাসনিক নিয়ন্ত্রক হিসেবেই ক্ষমতাপ্রাপ্ত ছিলেন না, তাদের রাজনৈতিক নিয়ন্ত্রকের ক্ষমতা প্রদান করা হয়। সরকারের সর্বোচ্চ পর্যায় থেকে বলা হয়, জেলা গভর্নরগণ হবেন সরকার তথা বাকশালের চোখ, কান, নাক। অর্থাত্ তারা সমগ্র রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডকে অবলোকন, পর্যবেক্ষণ করবেন এবং এ সংক্রান্ত যাবতীয় তথ্য কেন্দ্রে প্রেরণ করবেন এবং কেন্দ্র প্রয়োজনীয় নিয়ন্ত্রকমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করবে।
৭. ১৯৭২ সালের সংবিধান অনুযায়ী একজন জাতীয় সংসদ সদস্য পাঁচ বছরের জন্য নির্বাচিত হবেন। অর্থাত্ জাতীয় সংসদের সাধারণ মেয়াদকাল পাঁচ বছর। চতুর্থ সংশোধনীর মাধ্যমে জাতীয় সংসদের মেয়াদকাল বৃদ্ধি করা হয়।
বঙ্গবন্ধুর রাজনৈতিক দর্শন আলোচনা করা খুবই কঠিন। শুধু বঙ্গবন্ধু কেন, আমাদের দেশের রাজনৈতিক নেতা-নেতৃত্বের রাজনৈতিক দর্শন আলোচনা বিপজ্জনকও বটে। সৃষ্টিকর্তাদের (বিভিন্ন ধর্মীয় বিশ্বাস অনুযায়ী) আলোচনা-সমালোচনা করা হলেও আমাদের দেশে রাজনৈতিক নেতাদের নিয়ে আলোচনা অনেকটা নিষিদ্ধ। ইতিহাসকে আদালতের ঘেরাটোপে বন্দি করার পর বিষয়টি আরও জটিল হয়ে গেছে। আলোচনা করতে গেলে সমালোচনা আসবেই। যে যত বড় তাকে নিয়ে আলোচনা-সমালোচনা সবচেয়ে বেশি হবে-এটাই নিয়ম। ক্ষুদ্র ও ক্ষুদ্রতমদের নিয়ে কোনো আলোচনা-সমালোচনা হয় না। কাজেই ক্ষুদ্ররা হারিয়ে যায়। বড়রা বেঁচে থাকে। কারণ তাদের নিয়ে আলোচনা-সমালোচনা হয়। আলোচনা-সমালোচনার মধ্যেই তারা এক প্রজন্ম থেকে অন্য প্রজন্ম পর্যন্ত টিকে থাকে। আলোচনা অর্থে যদি শুধু প্রশংসা হয় সেই আলোচনা এগোতে পারে না। সৃষ্টিকর্তা কোনো ভুল করতে পারেন না-এটা হল ঈশ্বরবাদীদের অনুমান। কিন্তু সৃষ্টিকর্তাকে নিয়ে যত আলোচনা-সমালোচনা হয় তা অন্য কোনো ব্যক্তি বা ঘটনা নিয়ে হয় না। কারণ সৃষ্টিকর্তার সমকক্ষ কেউ নয়। এ নিয়ে নিরীশ্বরবাদীদের ভিন্ন মতামত থাকতে পারে। তবে নিরীশ্বরবাদীরাও সৃষ্টিকর্তাকে অস্বীকার করতে গিয়ে তাকে নিয়েই আলোচনা করেন। অস্বীকার করতে গিয়ে আলোচনার মাধ্যমে তারা আসলে সৃষ্টিকর্তার অস্তিত্বকে স্বীকার করে নেন। যদি কোনো বস্তু বা ঘটনার অস্তিত্বই না-থাকে তাহলে তাকে স্বীকার বা অস্বীকার করা নিয়ে আলোচনার প্রয়োজন নেই।
এই বিশ্বচরাচরে মানুষ অন্যান্য লক্ষ কোটি প্রাণীর মধ্যে একটি প্রাণী। মানুষ নিজেরা নিজেদের অতি উন্নত প্রাণী মনে করে। মানুষ সৃষ্টিকর্তার সৃষ্টি। সৃষ্টিকে স্রষ্টার সঙ্গে তুলনীয় নয়। কিন্তু যখন দেখা যায়, স্রষ্টাকে সমালোচনা করা গেলেও সৃষ্টি অর্থাত্ মানুষকে সমালোচনা করা যাবে না এ একটা বিপজ্জনক প্রবণতা। মানুষ সে যত বড়ই হোক না কেন তিনি ভুলত্রুটির ঊর্ধ্বে নন। দোষেগুণে ভরা মানবজীবন। মানুষের ভালো দিকগুলো যেমন আলোচিত হতে পারে, তার খারাপ দিক অর্থাত্ ভুলত্রুটিগুলোও আলোচনা করা যেতে পারে।
আলোচনা-সমালোচনা করতে না-দিলে মানুষ তিনি যত বড় নেতাই হোন না কেন, একদিন ইতিহাস থেকে হারিয়ে যাবেন। ইতিহাস থেকে জাতীয় গুরুত্বপূর্ণ নেতা-নেত্রী- যাদের আদর্শ, দর্শন, জীবনাচরণ, কর্মকাণ্ড, সাহসিকতা জাতিকে চলার পথে এগিয়ে নিয়ে যেতে পারে, তাদের নিয়ে আলোচনা-সমালোচনা জাতীয় স্বার্থে প্রয়োজন। কিন্তু আমরা এমন এক অন্ধ অজ্ঞতার যুগে বসবাস করছি-আমাদের চিন্তা-চেতনা ক্রমশ যেভাবে অজ্ঞতার জালে বন্দি হচ্ছে এবং আমরা যেভাবে অজ্ঞতা ও কূপমণ্ডূকতার নিকট মাথানত করছি-তাতে ইতিহাস আমাদের কোনো কিছুই জানতে দেবে না। ইতিহাসে কোনো সঠিক কথা লেখা থাকবে না। সত্য কঠিন হলেও সত্যই সুন্দর।
এদেশের কোটি কোটি মানুষের সঙ্গে বঙ্গবন্ধুর রাজনৈতিক দর্শনের বা আদর্শের (বিশেষ করে সর্বশেষ দর্শন) মিল না-ও থাকতে পারে-কিন্তু বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে আবেগের সম্পর্ক রয়েছে। আবেগ দ্বারা কাউকে পর্যবেক্ষণ করতে গেলে, কোনো বিচার করতে গেলে তা নিরপেক্ষ হবে না। বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে আবেগের সম্পর্কে সম্পর্কিতদের পক্ষে সত্যিকার অর্থে বঙ্গবন্ধুর রাজনৈতিক দর্শন আলোচনা করা এই অর্থেই সম্ভব নয়। তবে বঙ্গবন্ধু সম্পর্কে যে কথাগুলো নির্দ্বিধায় বলা যায় তা হল-
* বঙ্গবন্ধুর বাঙালি ও বাংলাদেশের জনগণের জন্য ভালোবাসা ছিল অকৃত্রিম
* তিনি বাঙালির মুক্তির মহানায়ক
* তিনি ছিলেন প্রচণ্ড সাহসী ও স্বাধীনচেতা
* তিনি ছিলেন সমন্বয়বাদী-কখনও কখনও মাত্রা অতিরিক্ত সমন্বয়বাদী
* তিনি ছিলেন প্রচণ্ড আত্মবিশ্বাসী এবং তিনি যা সঠিক মনে করতেন তা থেকে তাকে টলানো যেত না
* বঙ্গবন্ধুর হূদয় ছিল বিশাল, তিনি তার পরম শত্রুকেও আপন করে নিতে কার্পণ্য করতেন না।
আচরণ বিজ্ঞানের ছাত্র হিসেবে জানি মানুষের প্রতিটি ক্রিয়ার দুটি বিপরীতমুখী প্রতিক্রিয়া রয়েছে। কোনো ক্রিয়ার প্রতিক্রিয়া হতে পারে ধনাত্মক, আবার ওই একই ক্রিয়ার প্রতিক্রিয়া হতে পারে ঋণাত্মক।
বঙ্গবন্ধু প্রচণ্ড আত্মবিশ্বাস ও অসীম সাহসিকতার কারণে তার ঋণাত্মক প্রতিক্রিয়াগুলো সম্পর্কে চিন্তা করেননি।
বঙ্গবন্ধু প্রচণ্ড সাহসী ও স্বাধীনচেতা ছিলেন একথা বলার প্রয়োজন নেই। কারণ তার সারা জীবন সাহসিকতা ও স্বাধীনতার কাব্য।
বঙ্গবন্ধুর রাজনৈতিক দর্শন ও জীবন নিয়ে বাংলাদেশ যতদিন থাকবে ততদিন আলোচনা চলবেই। আলোচনা মানে ভালোমন্দের আলোচনা। কোনো অজ্ঞতা যেন সেই আলোচনা-সমালোচনাকে থামিয়ে না-দিতে পারে সেদিকে দৃষ্টি রাখার প্রয়োজন উল্লেখ করে এই পর্বের সমাপ্তি টানছি। এর পরের পর্বগুলোতে আমরা বাংলাদেশের অন্যান্য রাজনৈতিক দল, বিশেষ করে বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল (বিএনপি) এবং এই দলের প্রতিষ্ঠাতা জিয়াউর রহমানের রাজনৈতিক দর্শনের ওপর আলোচনা অব্যাহত রাখব। (চলবে)
nazrul.islam.psy(a)gmail.com
এই প্রবন্ধ লিখতে বাংলাদেশের প্রাক্তন প্রধান বিচারপতি মোস্তফা কামাল-এর কামিনী কুমার দত্ত মেমোরিয়াল বক্তৃতা-১৯৯৪ ‘Bagladesh Constitution : Trend & Issues’ থেকে অনেক তথ্য ব্যবহার করা হয়েছে। আমি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করছি।
ইতোপূর্বে আরও উল্লেখ করা হয়েছে, ১৯৭৫ সালের ১৫ জানুয়ারি জাতীয় সংসদে চতুর্থ সংশোধনী বিল আনয়ন ও পাসের মধ্য দিয়ে ‘বাকশাল’ নামক একদলীয় শাসনব্যবস্থা চালু করা হয়। শুধু তাই নয়, সামরিক-বেসামরিক প্রশাসন-ব্যবস্থাকে রাজনৈতিক দলের (বাকশাল) আওতায় নিয়ে আসা হয়।
৫. ১৯৭২ সালের মূল সংবিধানে (আর্টিকেল ৯৫ (১) ধারামতে বলা হয়েছিল, রাষ্ট্রপতি প্রধান বিচারপতিকে নিয়োগ প্রদান করবেন এবং প্রধান বিচারপতির পরামর্শে (ধভঃবত্ পড়হংঁষঃধঃরড়হ) অন্যান্য বিচারপতি নিয়োগ প্রদান করবেন। কিন্তু সংবিধানের চতুর্থ সংশোধনীর মাধ্যমে বিচারপতি নিয়োগে প্রধান বিচারপতির পরামর্শ বিষয়টি বাদ দেওয়া হয়। এর পরিবর্তে বলা হয়, ‘প্রধান বিচারপতি ও অন্য বিচারপতিগণ রাষ্ট্রপতি কর্তৃক নিয়োগপ্রাপ্ত হইবেন।’ বিচারপতি নিয়োগে রাজনৈতিক হস্তক্ষেপ পরিহারে বা প্রতিরোধে প্রধান বিচারপতির সঙ্গে পরামর্শ বিষয়টি শক্তিশালী রক্ষাকবচ না-হলেও একটি রক্ষাকবচ ছিল। কিন্তু বাকশাল শাসনে সেই রক্ষাকবচটি চুরমার করে বিচারপতি নিয়োগে রাজনৈতিক প্রভাবের দরজা খুলে দেওয়া হয়-যার প্রতিফলন এখন পর্যন্ত চলছে। এর ক্ষতিকর প্রভাব যে বাংলাদেশের বিচার ব্যবস্থাকে কোথায় নিয়ে যাচ্ছে তা সকলেই অনুধাবন করেন এবং এ নিয়ে অনেক আলোচনা-সমালোচনা হলেও এই ব্যবস্থার কোনো পরিবর্তন আজও হয়নি।
৬. প্রতিটি জেলায় একজন করে গভর্নর নিয়োগ করা হয়। এই গভর্নরগণ অনির্বাচিত এবং তত্কালীন রাষ্ট্রপতি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব কর্তৃক সরাসরি নিযুক্ত। নবগঠিত বাকশালের নেতা-নেত্রীদের গভর্নর নিয়োগ করা হয়। শুধু তাই নয়, জেলা প্রশাসনকে গভর্নরের নিয়ন্ত্রণে নিয়ে আসা হয়। জেলা প্রশাসক, পুলিশ, বিচার বিভাগসহ জেলা সদরের সকল সরকারি কর্মকর্তাকে জেলা গভর্নরের অধীনস্থ করা হয়। জেলা গভর্নরগণ শুধু প্রশাসনিক নিয়ন্ত্রক হিসেবেই ক্ষমতাপ্রাপ্ত ছিলেন না, তাদের রাজনৈতিক নিয়ন্ত্রকের ক্ষমতা প্রদান করা হয়। সরকারের সর্বোচ্চ পর্যায় থেকে বলা হয়, জেলা গভর্নরগণ হবেন সরকার তথা বাকশালের চোখ, কান, নাক। অর্থাত্ তারা সমগ্র রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডকে অবলোকন, পর্যবেক্ষণ করবেন এবং এ সংক্রান্ত যাবতীয় তথ্য কেন্দ্রে প্রেরণ করবেন এবং কেন্দ্র প্রয়োজনীয় নিয়ন্ত্রকমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করবে।
৭. ১৯৭২ সালের সংবিধান অনুযায়ী একজন জাতীয় সংসদ সদস্য পাঁচ বছরের জন্য নির্বাচিত হবেন। অর্থাত্ জাতীয় সংসদের সাধারণ মেয়াদকাল পাঁচ বছর। চতুর্থ সংশোধনীর মাধ্যমে জাতীয় সংসদের মেয়াদকাল বৃদ্ধি করা হয়।
বঙ্গবন্ধুর রাজনৈতিক দর্শন আলোচনা করা খুবই কঠিন। শুধু বঙ্গবন্ধু কেন, আমাদের দেশের রাজনৈতিক নেতা-নেতৃত্বের রাজনৈতিক দর্শন আলোচনা বিপজ্জনকও বটে। সৃষ্টিকর্তাদের (বিভিন্ন ধর্মীয় বিশ্বাস অনুযায়ী) আলোচনা-সমালোচনা করা হলেও আমাদের দেশে রাজনৈতিক নেতাদের নিয়ে আলোচনা অনেকটা নিষিদ্ধ। ইতিহাসকে আদালতের ঘেরাটোপে বন্দি করার পর বিষয়টি আরও জটিল হয়ে গেছে। আলোচনা করতে গেলে সমালোচনা আসবেই। যে যত বড় তাকে নিয়ে আলোচনা-সমালোচনা সবচেয়ে বেশি হবে-এটাই নিয়ম। ক্ষুদ্র ও ক্ষুদ্রতমদের নিয়ে কোনো আলোচনা-সমালোচনা হয় না। কাজেই ক্ষুদ্ররা হারিয়ে যায়। বড়রা বেঁচে থাকে। কারণ তাদের নিয়ে আলোচনা-সমালোচনা হয়। আলোচনা-সমালোচনার মধ্যেই তারা এক প্রজন্ম থেকে অন্য প্রজন্ম পর্যন্ত টিকে থাকে। আলোচনা অর্থে যদি শুধু প্রশংসা হয় সেই আলোচনা এগোতে পারে না। সৃষ্টিকর্তা কোনো ভুল করতে পারেন না-এটা হল ঈশ্বরবাদীদের অনুমান। কিন্তু সৃষ্টিকর্তাকে নিয়ে যত আলোচনা-সমালোচনা হয় তা অন্য কোনো ব্যক্তি বা ঘটনা নিয়ে হয় না। কারণ সৃষ্টিকর্তার সমকক্ষ কেউ নয়। এ নিয়ে নিরীশ্বরবাদীদের ভিন্ন মতামত থাকতে পারে। তবে নিরীশ্বরবাদীরাও সৃষ্টিকর্তাকে অস্বীকার করতে গিয়ে তাকে নিয়েই আলোচনা করেন। অস্বীকার করতে গিয়ে আলোচনার মাধ্যমে তারা আসলে সৃষ্টিকর্তার অস্তিত্বকে স্বীকার করে নেন। যদি কোনো বস্তু বা ঘটনার অস্তিত্বই না-থাকে তাহলে তাকে স্বীকার বা অস্বীকার করা নিয়ে আলোচনার প্রয়োজন নেই।
এই বিশ্বচরাচরে মানুষ অন্যান্য লক্ষ কোটি প্রাণীর মধ্যে একটি প্রাণী। মানুষ নিজেরা নিজেদের অতি উন্নত প্রাণী মনে করে। মানুষ সৃষ্টিকর্তার সৃষ্টি। সৃষ্টিকে স্রষ্টার সঙ্গে তুলনীয় নয়। কিন্তু যখন দেখা যায়, স্রষ্টাকে সমালোচনা করা গেলেও সৃষ্টি অর্থাত্ মানুষকে সমালোচনা করা যাবে না এ একটা বিপজ্জনক প্রবণতা। মানুষ সে যত বড়ই হোক না কেন তিনি ভুলত্রুটির ঊর্ধ্বে নন। দোষেগুণে ভরা মানবজীবন। মানুষের ভালো দিকগুলো যেমন আলোচিত হতে পারে, তার খারাপ দিক অর্থাত্ ভুলত্রুটিগুলোও আলোচনা করা যেতে পারে।
আলোচনা-সমালোচনা করতে না-দিলে মানুষ তিনি যত বড় নেতাই হোন না কেন, একদিন ইতিহাস থেকে হারিয়ে যাবেন। ইতিহাস থেকে জাতীয় গুরুত্বপূর্ণ নেতা-নেত্রী- যাদের আদর্শ, দর্শন, জীবনাচরণ, কর্মকাণ্ড, সাহসিকতা জাতিকে চলার পথে এগিয়ে নিয়ে যেতে পারে, তাদের নিয়ে আলোচনা-সমালোচনা জাতীয় স্বার্থে প্রয়োজন। কিন্তু আমরা এমন এক অন্ধ অজ্ঞতার যুগে বসবাস করছি-আমাদের চিন্তা-চেতনা ক্রমশ যেভাবে অজ্ঞতার জালে বন্দি হচ্ছে এবং আমরা যেভাবে অজ্ঞতা ও কূপমণ্ডূকতার নিকট মাথানত করছি-তাতে ইতিহাস আমাদের কোনো কিছুই জানতে দেবে না। ইতিহাসে কোনো সঠিক কথা লেখা থাকবে না। সত্য কঠিন হলেও সত্যই সুন্দর।
এদেশের কোটি কোটি মানুষের সঙ্গে বঙ্গবন্ধুর রাজনৈতিক দর্শনের বা আদর্শের (বিশেষ করে সর্বশেষ দর্শন) মিল না-ও থাকতে পারে-কিন্তু বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে আবেগের সম্পর্ক রয়েছে। আবেগ দ্বারা কাউকে পর্যবেক্ষণ করতে গেলে, কোনো বিচার করতে গেলে তা নিরপেক্ষ হবে না। বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে আবেগের সম্পর্কে সম্পর্কিতদের পক্ষে সত্যিকার অর্থে বঙ্গবন্ধুর রাজনৈতিক দর্শন আলোচনা করা এই অর্থেই সম্ভব নয়। তবে বঙ্গবন্ধু সম্পর্কে যে কথাগুলো নির্দ্বিধায় বলা যায় তা হল-
* বঙ্গবন্ধুর বাঙালি ও বাংলাদেশের জনগণের জন্য ভালোবাসা ছিল অকৃত্রিম
* তিনি বাঙালির মুক্তির মহানায়ক
* তিনি ছিলেন প্রচণ্ড সাহসী ও স্বাধীনচেতা
* তিনি ছিলেন সমন্বয়বাদী-কখনও কখনও মাত্রা অতিরিক্ত সমন্বয়বাদী
* তিনি ছিলেন প্রচণ্ড আত্মবিশ্বাসী এবং তিনি যা সঠিক মনে করতেন তা থেকে তাকে টলানো যেত না
* বঙ্গবন্ধুর হূদয় ছিল বিশাল, তিনি তার পরম শত্রুকেও আপন করে নিতে কার্পণ্য করতেন না।
আচরণ বিজ্ঞানের ছাত্র হিসেবে জানি মানুষের প্রতিটি ক্রিয়ার দুটি বিপরীতমুখী প্রতিক্রিয়া রয়েছে। কোনো ক্রিয়ার প্রতিক্রিয়া হতে পারে ধনাত্মক, আবার ওই একই ক্রিয়ার প্রতিক্রিয়া হতে পারে ঋণাত্মক।
বঙ্গবন্ধু প্রচণ্ড আত্মবিশ্বাস ও অসীম সাহসিকতার কারণে তার ঋণাত্মক প্রতিক্রিয়াগুলো সম্পর্কে চিন্তা করেননি।
বঙ্গবন্ধু প্রচণ্ড সাহসী ও স্বাধীনচেতা ছিলেন একথা বলার প্রয়োজন নেই। কারণ তার সারা জীবন সাহসিকতা ও স্বাধীনতার কাব্য।
বঙ্গবন্ধুর রাজনৈতিক দর্শন ও জীবন নিয়ে বাংলাদেশ যতদিন থাকবে ততদিন আলোচনা চলবেই। আলোচনা মানে ভালোমন্দের আলোচনা। কোনো অজ্ঞতা যেন সেই আলোচনা-সমালোচনাকে থামিয়ে না-দিতে পারে সেদিকে দৃষ্টি রাখার প্রয়োজন উল্লেখ করে এই পর্বের সমাপ্তি টানছি। এর পরের পর্বগুলোতে আমরা বাংলাদেশের অন্যান্য রাজনৈতিক দল, বিশেষ করে বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল (বিএনপি) এবং এই দলের প্রতিষ্ঠাতা জিয়াউর রহমানের রাজনৈতিক দর্শনের ওপর আলোচনা অব্যাহত রাখব। (চলবে)
nazrul.islam.psy(a)gmail.com
এই প্রবন্ধ লিখতে বাংলাদেশের প্রাক্তন প্রধান বিচারপতি মোস্তফা কামাল-এর কামিনী কুমার দত্ত মেমোরিয়াল বক্তৃতা-১৯৯৪ ‘Bagladesh Constitution : Trend & Issues’ থেকে অনেক তথ্য ব্যবহার করা হয়েছে। আমি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করছি।
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন