কনক জ্যোতি
বিখ্যাত ‘রিডার্স ডাইজেস্ট' ম্যাগাজিনে Norman Myers লিখিত 'Our Fellow Species: Going, Going...' প্রবন্ধে জেনেছিলাম: ঘণ্টায় পৃথিবীর শত শত প্রাণী-বৃক্ষের প্রজাতি লুপ্ত হচ্ছে। ২০০০ সালে বিশ্বের পাঁচ ভাগের এক ভাগ প্রাণীকুল বিলুপ্ত হয়ে ২০১০ সালে চার ভাগের এক ভাগ প্রাণী বা বৃক্ষ আর খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না প্রলয়ঙ্করী ধ্বংসযজ্ঞের তান্ডবে।
বাংলাদেশের নগরগুলোতে ধ্বংসের মতো অবশিষ্ট আর কিছু নেই। ধ্বংস বা লুপ্ত হওয়ার মতো সামান্য প্রাণী বা উদ্ভিদ টিকে আছে পার্বত্য চট্টগ্রামে, মধুপুরের বন-জঙ্গলে, উত্তরের বরেন্দ্র অঞ্চলের বিচ্ছিন্ন বনাঞ্চলে এবং অবশ্যই দক্ষিণের সমুদ্রবর্তী সুন্দরবনে। যে গভীর-ঘন-সুবিস্তৃত সুন্দরবন অতীতে হাতছানি দিত, সেটাও ক্রমশ ফিকে, পাতলা ও ন্যাড়া এবং পৃথিবীর আশ্চর্যজনক স্থানের প্রতিযোগিতার সময়ও অস্তিত্বের সঙ্কটে ন্যুব্জ।
বাংলাদেশের ক'জন গভীরভাবে সুন্দরবনকে দেখেছে, জেনেছে? সরাসরি ভ্রমণ বা সমীক্ষায় ‘গর্বের ধন সুন্দরবনকে' নিয়ে চর্চা-গবেষণাকারীর সংখ্যা কম, প্রকাশিত গ্রন্থের সংখ্যা আরো কম। এমন পরিস্থিতিতে পেলাম বিশিষ্ট স্থপতি, আলোকচিত্রি ও নগরবিদ আকিল চৌধুরীর ‘সবুজে সংগ্রামে সুন্দরবন' (প্রকাশক: অনন্যা, প্রচ্ছদ: ধ্রুব এষ) বইটি। বাংলাদেশেরই একটি গৌরবময় সাংস্কৃতিক ভূগোল বিক্রমপুরের সন্তান আকিল চৌধুরী এডভেঞ্চারের রোমাঞ্চে কয়েকদিনের জন্য গিয়েছিলেন সুন্দরবনের গভীরে। শিশু-কিশোর-মহিলা-বয়স্ক মিলে দলটি নৌকায় ভেসেছে দিনের পর দিন, আটকে গেছে ডুবোচরে, পর্যবেক্ষণ টাওয়ারে বসেছে, খুঁজেছে বাঘের পায়ের ছাপ, অনুভব করেছে দিন ও রাত্রির ছায়াপাত এবং প্রকৃতির সঙ্গে মানবাত্মার নন্দনতাত্ত্বিক সংযোগ। ভ্রমণ ও বীক্ষণের আঙ্গিকে উদ্ভাসিত হয়েছে স্থলবাসী কতিপয় মানুষের বনানীঘেরা সংক্ষিপ্ত জলজীবনের জ্যোতির্ময় রূপচ্ছটা; বনপথের দিশা, থাকা-খাওয়ার যাবতীয় তথ্যের সঙ্গে বিচ্ছুরিত হয়েছে শিল্প-সাহিত্য, কাব্যের স্ফূরণ, স্থানীয় লোককথা, প্রচলিত মিথ, কাহিনী ও সংগ্রামী জন-জীবনের নানা খলচিত্র। এবং প্রাণীকুল আর উদ্ভিদের বিবরণ মিলিয়ে নিজের চোখে সুন্দরবন দেখার এবং নিজের অস্তিত্ব দিয়ে সেখানকার প্রকৃতি ও পরিবেশকে অনুভব করার নিটল আমেজ খুঁজে পাওয়া গেছে। নাগরিক মানুষের প্রতি সুন্দরবনের আরণ্যক-মায়াবী-রোমাঞ্চের টান, আকিল চৌধুরী সাবলীল ভাষাশৈলী ও সচিত্র বর্ণনায় আরো সুতীব্র হয়ে উঠেছে।
সুন্দরবনের প্রকৃতি ও নিসর্গ, প্রাণী ও জীবজন্তু, উদ্ভিদ ও গুল্ম-লতা, মানবজীবন ও তাদের জীবন-সংগ্রাম, মাওয়ালি, জেলে, মাঝিসহ অসংখ্য পেশাজীবী সমাজ ও তাদের বিচিত্র জীবনাচার ও সংস্কৃতি মিলে মিশে সেখানে গড়ে ওঠেছে এক বহুবর্ণা ‘আরেকটি পৃথিবী'--আমাদের পৃথিবীর চেয়েও সৌন্দর্যে, আনন্দে, হর্ষে, বিষাদে, ভীতিতে, সাহসে কতই না আলাদা সেই অপরূপ জগত অনিন্দ্য কথাকাব্যে উন্মোচিত করার জন্য প্রকৃতিপ্রেমী আকিল চৌধুরী বিশিষ্ট হয়ে থাকবেন।
সুন্দরবনের সৌন্দর্য কেবল উন্মোচিত করলেই হবে না, এর সমস্যা ও সঙ্কটকে চিহ্নিত করে সেটাও মোকাবিলা করতে হবে। আমাদের সকলের চোখের সামনেই বন উজাড় হচ্ছে। আগের মতো আর বাঘ বা হরিণ দেখা যায় না। বহু প্রজাতির বৃক্ষ, উদ্ভিদ, পশু, পাখি নিধন হয়ে গেছে। এসব ব্যাপারে দায়িত্বশীলদের উদাসীনতা সত্যিই বেদনাদায়ক।
সুন্দরবনের প্রসঙ্গে আরো বন ও প্রকৃতি কেন্দ্রের কথা বলা যায়। বলা যায় নান্দনিক চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসের কথাও। যেমন চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে ১৭৬ প্রজাতির পাখি বাস করে বলে গবেষণায় প্রকাশ পেয়েছে। কিন্তু এসব পাখির সবগুলো টিকতে পারছে কি-না, সেটাও এক বড় জিজ্ঞাসা। বিচিত্র ও বিরল প্রজাতির বৃক্ষ, গুল্ম ও উদ্ভিদও ছিল এখানে। সেগুলো সংরক্ষণ আর বিরাট বড় দায়িত্ব।
চট্টগ্রামের পাহাড় কর্তন আর ভূ-প্রকৃতির ক্ষতি সাধনও প্রকৃতি বিনষ্টের অন্যতম প্রধান কারণ। একদার সুষমামন্ডিত সবুজ-শ্যামল চট্টগ্রাম এখন ক্রমে ক্রমে ধূসর হয়ে যাচ্ছে আমাদের চোখের সামনেই। এমন দুরবস্থা কিছুতেই মেনে নেয়া যায় না। একই বিপদ অপেক্ষা করছে প্রাকৃতিকভাবে সুন্দর সিলেটের জন্যেও। আশঙ্কা করা হচ্ছে যে, সাত মাত্রার ভূমিকম্পে ধসে পড়বে সিলেটের আশি ভাগ ভবন। আরেক প্রাকৃতিক স্থান কক্সবাজারের বেলাতেও রয়েছে আশঙ্কা। সেখানে অপরিকল্পিতভাবে নির্মাণাদি হওয়ায় সৈকতের সৌন্দর্য বিনষ্ট হচ্ছে। পাশাপাশি বিমান বন্দরের সূত্র ধরে ৪০ হাজার মানুষের উদ্বাস্তু হওয়ার মতো ভয়াবহ পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে।
অতএব দেখা যাচ্ছে, সুন্দরবনসহ বাংলাদেশের প্রাকৃতিক সম্পদকে রক্ষা করা আজ এক বড় জাতীয় দায়িত্ব। বিশ্বে যেভাবে উষ্ণায়ন হচ্ছে, তাতে প্রচুর বৃক্ষ আর সবুজ উদ্ভিদ লাগানো দরকার। একটি দেশে যে পরিমাণ সবুজ ও বনাঞ্চল থাকা দরকার বাংলাদেশে তার অর্ধেকও নেই। যা আছে, তা-ও বিচ্ছিন্ন। উত্তরে বরেন্দ্র অঞ্চলে, মধুপুরে, ভাওয়ালে এবং দক্ষিণের সুন্দরবনে। ঢাকা-চট্টগ্রামের মতো শহরগুলো তো নগরায়নের ধাক্কায় ন্যাড়া হয়ে গেছে। যেখানেই সুযোগ পাচ্ছে, ডেভেলপাররা সেটাকেই অক্টোপাশের মতো গিলে খাচ্ছে। জেলা শহরগুলোতেও চলছে ভূমিদস্যুদের দাপট। পক্ষান্তরে বৃক্ষ রোপণের ধারা খুবই সামান্য। আর যেসব বণাঞ্চল আছে, সেগুলোও গোপনে দখল হচ্ছে। এই অবস্থা আমাদের শান্তিপূর্ণ বসবাসের জন্যে ভয়ঙ্কর ক্ষতিকর। ফলে আমাদের বাঁচার স্বার্থেই প্রতিরোধ গড়তে হবে এইসব প্রকৃতিবিরোধী অনাচারের বিরুদ্ধে।
জীবন কত সুন্দর ও আনন্দময় সেটা অনুধাবণ করা যায় প্রকৃতি ও পরিবেশের দিকে তাকালে; আল্লাহর সৃষ্টির দিকে তাকালে; তাঁর অনুগ্রহের দিকে তাকালে। নদী, গাছ, মাঠ, প্রান্তর, পাহাড়, জঙ্গল ইত্যাদি প্রতিটি সৃষ্টিই নানাভাবে শ্রেষ্ঠ জীব মানুষের কল্যাণে কাজ করছে। আমরা দেখতে না পেলেও এটাই বৈজ্ঞানিকভাবে সত্য যে, ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র কীটপ্রতঙ্গ থেকে শুরু করে বিরাট বিরাট সৃষ্টিও নানাভাবে কাজে লাগছে মানবকুলের। আর আমরা নির্মম পাষন্ডের মতো সেগুলোরই ক্ষতি করছি। মানুষ যখন মানুষকেই ক্ষতি করতে পিছ পা হয় না, তখন প্রকৃতি আর পরিবেশই রক্ষা পায় কী করে! ক্ষমতার দম্ভে, শক্তি ও হিংসায়, রাজনৈতিক দূরভিসন্ধির কারণে আমাদের চারপাশে কী বর্বরতা হচ্ছে, সেটা তো প্রতিদিনই দেখতে পাওয়া যাচ্ছে। আদিম পাশবিকতা ও খলতা-ক্রুরতা হার মানছে এসব জঘন্য অনাচার ও অত্যাচারের সামনে। মানুষের প্রতি কতিপয় মানুষের শক্তি-ক্ষমতা-দম্ভের হিংস্রতা থেকেই কী মানুষ ক্রমে ক্রমে প্রকৃতি ও পরিবেশের প্রতি হিংস্র হাত বাড়িয়েছে? সমাজ ও মনস্তাত্ত্বিক গবেষকরা হয়তো এর উত্তর দিতে পারবেন। তবে এটা তো সত্য যে, মানুষ দেখে শেখে। কর্তা ব্যক্তিদের কাছ থেকে আম-জনতা ও গণ-মানুষ কি শিখছে সেটা তো লুকানো বিষয় নয়। এহেন (কু)শিক্ষা আমাদেরকে কোথায় নিয়ে যাবে কে জানে! আমরা সহ-নাগরিক, ভিন্নমতাবলম্বী ও বিরোধীদের নিয়েই থাকতে পারছি না; একদিন গাছ, পাখি, নদী নিয়ে থাকতে পারবো কি না সেটাও জানা নেই। সমাজে সঞ্চারিত অসহিষ্ণুতার আগুন কখন জানি সবাইকেই পুড়ে খাক করে দেবে!
এক কবি বলেছিলেন, নগরে আগুন লাগলে দেবালয় রক্ষা পায় না। এমন কথাও আছে যে, অন্ধ হলে প্রলয় বন্ধ থাকে না। আমরা প্রতিপক্ষের ঘরে আগুন দিয়ে নগরে আগুনের উৎসব করছি, সে আগুনে দেবালয়, বন-জঙ্গল বাঁচতে পারবে কি? সেই হিংসার আগুন দেখে সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষ চোখ করে অন্ধ সেজে রয়েছি, আগুনকে পাগলা হাতির মতো তান্ডব করতে দিচ্ছে। অতএব আমাদের জন্য আমরা যা বেছে নিচ্ছি, তা-ই এসে হানা দিচ্ছে আমাদের।
সুন্দরবন এতো কথার অবতারণা এজন্যেই যে, প্রকৃতি আর মানুষ পরস্পরের অপরিহার্য এবং পরিপূরক সত্তা। একটিতে আঘাত করলে অন্যটি আক্রান্ত হবে। বনের প্রতি আঘাতে যেমন বিবেকী মানুষ কষ্ট পায়; মনুষ্যত্বের নিধনেও কি প্রকৃতি কষ্ট পায় না। অবশ্যই পায়। চারিদিকে কষ্টের মহাযজ্ঞে বেঁচে থাকার সুন্দর অবলম্বন অনুসরণই শেষ ভরসা। যে ভরসা আমরা পাই পবিত্র কুরআনে, হাদিসে, সুন্নাতে এবং সংগ্রামী-মহামানবের জীবন-বৃত্তান্তে। বিশ্ব জেগেছে, আরব জেগেছে; আমাদের আর ঘুমানোর সুযোগ কই? বেঁচে থাকার সুন্দরতম প্রচেষ্টোয় জেগে ওঠার শপথে এই বুঝি প্রকম্পিত হলো সবুজে-সুন্দরের দক্ষিণ, শ্যামলের উত্তর, মায়াবী পূর্ব আর ঐতিহাসিক পশ্চিম...।
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন