ম ন জু র আ হ ম দ
দুটি ঘটনা একসঙ্গে ঘটে চলেছে। একটি প্রকাশ্যে, পথেঘাটে। আরেকটি ভেতরে-অন্দরে, রুদ্ধদ্বার মজলিসে। রাস্তাঘাটে পুলিশ যখন প্রকাশ্যে সাংবাদিক পেটাচ্ছে তখন ভেতরে বসে মন্ত্রীমহল গণমাধ্যমের বিরুদ্ধে বিষোদ্গার করছে। ঢাকার রাজপথে যেদিন তিন আলোকচিত্র সাংবাদিককে পুলিশ বর্বরোচিতভাবে পেটালো, তার পরদিনই ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক স্থানীয় সরকারমন্ত্রী সৈয়দ আশরাফুল ইসলাম বললেন, প্রচারমাধ্যম বস্তুনিষ্ঠ নয়। উদাহরণ হিসেবে বললেন, প্রচারমাধ্যমে তাদের বক্তব্য পুরোপুরি উপস্থাপন করা হয় না। ফলে দেশের মানুষ তাদের কথা পুরো জানতে পারে না। সাংবাদিকদের সঙ্গে তার এই আলাপচারিতার একপর্যায়ে একটি টিভি চ্যানেলের ক্যামেরা তার চিত্র ধারণ ‘কাট’ বা স্থগিত করলে সৈয়দ আশরাফ তাত্ক্ষণিক দৃষ্টান্ত হিসেবে বিষয়টির প্রতি সবার দৃষ্টি আকর্ষণ করে বলেন, আমার বক্তব্য এটুকু নিয়েই ক্যামেরা বন্ধ করে দেয়া হলো। পুরো বক্তব্য জনগণের কাছে না পৌঁছালে আমাদের সম্পর্কে তাদের মধ্যে বিভ্রান্তির সৃষ্টি হয়।
সৈয়দ আশরাফের কথাগুলো বিবেচনায় নিলে তার অর্থ দাঁড়ায় তাদের বক্তব্যের ভিত্তিতে কোনো ‘খবর’ তৈরি করা যাবে না। সাংবাদিকরা তাদের পেশার এই মৌলিক কাজটা করতে পারবেন না। সৈয়দ আশরাফ যা বলবেন তার পুরোটাই অর্থাত্ ‘পূর্ণ বিবরণ’ ছাপতে হবে। তবে এবারে দেখছি আশরাফ সাহেবকে টেক্কা দিলেন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী সাহারা খাতুন। গত ১ জুন সাংবাদিকদের সঙ্গে মতবিনিময় সভায় সাংবাদিকদের অভিযুক্ত করে তিনি বলেছেন, তার এবং তার প্রতিমন্ত্রী জনাব টুকুর বক্তব্য বিকৃত করা হয়েছে। তিনি নাকি সাগর-রুনির হত্যাকারীদের ৪৮ ঘণ্টার মধ্যে গ্রেফতার করার ঘোষণা দেননি। আর টুকু সাহেবও নাকি সাংবাদিকদের পুলিশ থেকে দূরে থাকতে বলেননি।
হায় সাহারা খাতুন! এতদিন পরে এ কী শোনালেন আপনি? এতদিন কোথায় ছিলেন? এই দীর্ঘ সময়ে তো আপনার এই অমৃতবচন শোনা যায়নি। আর টুকু সাহেব আপনার মুখে চুন খাচ্ছেন কেন? তিনি নিজেই মুখ খুলে বলুন না, সাংবাদিকরা বিকৃত খবর পরিবেশন করে। কোনো কোনো ছোটখাটো মন্ত্রীও দেখছি প্রচার মাধ্যমকে এক হাত নিতে ছাড়ছেন না।
ক’দিন আগে মন্ত্রিসভার বৈঠকেও গণমাধ্যমের বিরুদ্ধে ক্ষোভ প্রকাশ করা হয়েছে। মন্ত্রীদের এইসব কথাবার্তাই পুলিশের জন্য সাংবাদিক পেটাতে ইন্ধন হিসেবে কাজ করছে। ‘সাংবাদিক পেটাইলে কিছু হয় না’—পুলিশের এসি শহীদুলের এই পরোয়াহীন দম্ভোক্তির মূলে রয়েছে মন্ত্রীদের এইসব উস্কানি। তবে মন্ত্রীদের কথাবার্তা বিক্ষিপ্ত বা পৃথকভাবে দেখার কোনো সুযোগ নেই। এসব কথাবার্তার দায় তো বর্তায় সার্বিকভাবে সরকারের ওপর। দেশের মানুষ দেখবে গণমাধ্যমের প্রতি সরকারের অসহিষ্ণুতা। মন্ত্রীদের বিষোদ্গার মানেই তো সরকারের মনোভাবের প্রকাশ। এরই ভয়ঙ্কর পরিণতি সাংবাদিকদের ওপর পুলিশের সর্বাত্মক নিগ্রহ। সাংবাদিক পেটালে তাদের কিছু হবে না বরং পুরস্কার মিলবে এমন কোনো মহার্ঘ বাণী তাদের কাছে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের কোনো বিজ্ঞপ্তি মারফত পৌঁছানো হয়েছে কিনা জানি না। তবে কথাটা যে মিথ্যা নয় সে প্রমাণ তো হাতেনাতেই পাওয়া গেল। এসি শহীদুলের শাস্তির দাবিতে সাংবাদিক সমাজসহ বিভিন্ন মহল যখন গর্জে উঠল তখন তাকে দ্রুত ‘প্রত্যাহার’ করে সঙ্গে সঙ্গে রাঙামাটিতে পোস্টিং দেয়া হলো। অর্থাত্ সাংবাদিক পিটিয়ে কিছু হয় না সেই প্রমাণই রাখল সরকার। কিন্তু সামাল দিতে পারেনি। চতুর্দিকের ধিক্কার ধ্বনিতে সরকার তাকে সাসপেন্ড ও ক্লোজড করে চট্টগ্রামে পাঠানোর কথা ঘোষণা করেছে। ঘটনা নিয়ে তদন্ত চলছে। এখন দেখার অপেক্ষা শহীদুলের ভাগ্যে কী আছে।
কিন্তু শুধু কি পুলিশ? পুলিশ তো রাষ্ট্রের বেতনভোগী একটি বাহিনী। সরকারের হুকুমে চলে। সরকারকে সেবা দেয়। শুরুতেই বলেছি, দুটি ঘটনা একসঙ্গে ঘটে চলেছে। সদরে সাংবাদিকদের ওপর পুলিশের হামলা আর অন্দরে গণমাধ্যমের বিরুদ্ধে সরকারি কর্তাব্যক্তিদের বিষোদ্গার। বলেছি, সরকারের কথাবার্তাই পুলিশকে উত্সাহিত করে তুলেছে সাংবাদিক নিগ্রহে বেপরোয়া হয়ে উঠতে। আরও সোজা করে নিশ্চয়ই বলা যায়, সাংবাদিকদের ওপর পুলিশি দমন-পীড়ন এই সরকারের অনুসৃত একটি নীতি। সরকারের এই নীতিরই বাস্তবায়ন লক্ষ্য করা যাচ্ছে বিভিন্ন ক্ষেত্রে এবং বিরামহীনভাবে। একটি ঘটনার রেশ কাটতে না কাটতেই ঘটানো হচ্ছে আর একটি ঘটনা। শুরু করেছিলাম তিন আলোকচিত্র সাংবাদিককে পেটানোর বিষয় দিয়ে, পরপরই ঘটে গেল বিডিনিউজ ডট কমে সাংবাদিকদের ওপর রক্তাক্ত হামলার ঘটনা, আদালত প্রাঙ্গণে সাংবাদিক ও আইনজীবীদের ওপর পুলিশের আর এক দফা লাঠিপেটার ঘটনা।
পুলিশের পাশাপাশি দেশজুড়ে সাংবাদিক নিগ্রহে উন্মত্ত হয়ে উঠেছে আরেকটি বিশেষ মহল, যারা বিবেচিত সরকারের রাজনৈতিক শক্তি হিসেবে। সরকারি পৃষ্ঠপোষকতাতেই তাদের যত আস্ফাালন। এদের জবাবদিহিতার কোনো বাধ্যতা নেই। এদের কৃতকর্মের কোনো বিচার হয় না। ক্ষমতায় তাদের সরকার থাকায় তারা সবাই অনেক ক্ষমতা ধরেন। বিডিনিউজ ডট কমে হামলার জন্য যাদের ধরা হয়েছে তারা নাকি সবাই আওয়ামী যুবলীগের সদস্য। আওয়ামী লীগ এবং তাদের সরকারের এই রাজনৈতিক শক্তি কিংবা স্বার্থসংশ্লিষ্ট কোনো মহল যারা সাগর-রুনির মতো সাংবাদিককে বাসায় ঢুকে হত্যা করছে তারা তো ধরা-ছোঁয়ার বাইরে থেকে যাচ্ছে। এদেরকে হিসাবে নেয়ার ব্যাপারে সরকারের নির্লিপ্ততা অনেক প্রশ্নের জন্ম দিয়েছে। সাগর-রুনির তদন্ত নিয়ে কী হচ্ছে? এই হত্যাকাণ্ড নিয়ে সরকার কি একতরফাভাবে পানি ঘোলা করে চলছে না? স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর ঘোষণা অনুযায়ী আটচল্লিশ ঘণ্টার মধ্যে হত্যা-রহস্যের কিনারা তো হয়-ইনি, এখন আটচল্লিশ মাসেও হবে কিনা সে ভরসাও করা যাচ্ছে না। উচ্চ আদালত পুলিশকে নির্দেশ দিয়েছিল তাদের তদন্তের অগ্রগতি জানাতে। পুলিশ আদালতকে নির্বিকার জানিয়ে দিল, এ হত্যা-রহস্যের কিনারা করতে তারা ব্যর্থ হয়েছে। অথচ পুলিশের আইজি হাসান মাহমুদ খন্দকার সংবাদ সম্মেলন করে জানিয়েছিলেন, তদন্তকাজে উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি হয়েছে। পুলিশের এই রহস্যজনক ও অভিনব ধরনের ব্যর্থতা স্বীকারের পর তদন্তভার এখন র্যাবের হাতে। র্যাব কতদূর এগিয়েছে সে তথ্য গোপনই রয়েছে। তারা ভিসেরা পরীক্ষার জন্য দু’জনের লাশ কবর থেকে তুলে আবার ময়নাতদন্ত করিয়েছে। সে ময়নাতদন্তের রিপোর্টে বলা হয়েছে, ওদের পেটে বিষাক্ত কিছু পাওয়া যায়নি। অর্থাত্ ওদের মৃত্যুর কারণ বিষপান নয়। এরপর র্যাব কি খুঁজবে? তদন্তের গতি কোনদিকে যাবে? কিছু কি জানা যাবে তাদের তদন্তের অগ্রগতি? কিছু কি প্রকাশ পাবে তাদের রহস্য উদ্ঘাটন বিষয়ে? হয়তো কিছু প্রকাশ পাবে না। হয়তো অদৃশ্য কালো গহ্বরে এসব তথাকথিত তদন্ত একদিন বিলীন হয়ে যাবে। তবে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী সাহারা খাতুন খুব খুশি। তিনি বলেছেন, তদন্তকাজে তিনি সন্তুষ্ট।
স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী সাহারা খাতুনের খুশির সীমা নেই তার আদরের ধন পুলিশ বাহিনী নিয়ে। এই পুলিশ বাহিনীর কর্মকাণ্ডে মনে হচ্ছে তিনি বেশ গৌরবান্বিত। সাংবাদিকদের কাছে বেশ গর্বের সঙ্গে বলেছেন, তার এই পুলিশ আগের যে কোনো সময়ের পুলিশের চেয়ে ভালো। এদের তিনি জনবান্ধব পুলিশ হিসেবে গড়ে তুলছেন। সাহারা খাতুনের ‘জনবান্ধব’ পুলিশের মাজেজা বোধ করি তার প্রতিমন্ত্রী শামসুল হক টুকু সমঝে উঠতে পারেননি। তিনি এই জনবান্ধব পুলিশ থেকে একশ’ হাত দূরে থাকার জন্য সাংবাদিকদের নসিহত করেছেন। তার বক্তব্য হচ্ছে, পুলিশ যখন পেটায় তখন সাধারণ মানুষ আর সাংবাদিকদের আলাদা করে দেখা সম্ভব হয় না।
কী বোঝাতে চাইলেন টুকু সাহেব এই কথায়? তিনি তো সোজা-সাপটা জানিয়েই দিলেন যে পুলিশ জনগণকে পেটাবেই। সাংবাদিকরা সে পিটুনি থেকে রক্ষা পেতে যেন পুলিশ থেকে একশ’ হাত দূরে থাকেন। টুকু সাহেবের কথা থেকে যে নির্মম সত্যটি বেরিয়ে এসেছে তা হচ্ছে, পুলিশ পেটাবে। জনগণের ভোটে নির্বাচিত তাদের গণতান্ত্রিক সরকারের জনবান্ধব পুলিশ জনগণকে পেটাবে। অবশ্য পুলিশ যাদের পেটাবে, যাদের ওপর জুলুম-নির্যাতন চালাবে, তারা ‘জনগণ’ নয়। তারা শান্তি-শৃঙ্খলা বিনষ্টকারী অরাজকতা-বিশৃঙ্খলা সৃষ্টিকারী, দুষ্কৃতকারী। আরও একটি ভয়ঙ্কর অভিযোগ তাদের বিরুদ্ধে রুজু করাই আছে, তারা ‘যুদ্ধাপরাধ’ বিচার বানচালের ষড়যন্ত্রে লিপ্ত। কাজেই এদের পেটানো এই সরকারের জন্য ন্যায়সঙ্গত।
এই ন্যায়সঙ্গত কাজটি করতে গিয়ে সরকার এখন নির্বিচারে পিটিয়ে চলেছে সর্বস্তরের মানুষকে। তাদের পিটুনি থেকে রেহাই পাচ্ছে না ছাত্র-শিক্ষক, আইনজীবী-রাজনীতিকরা। রেহাই পাচ্ছেন না সাংবাদিকরা। একথা এখন নির্দ্বিধায় বলা যায় সাংবাদিকদের সঙ্গে দুর্ব্যবহার, তাদের ওপর জুলুম-নিগ্রহ, মিডিয়ার প্রতি অসহিষ্ণুতা ইত্যাদি সব পরিস্থিতির মধ্য দিয়ে সরকার গণমাধ্যমকে তাদের প্রতিপক্ষে পরিণত করেছে। সরকার তার কার্যকলাপের কারণে মিডিয়ার সঙ্গে সৃষ্ট ব্যবধানকে ক্রমেই বাড়িয়ে চলেছে। আগামী দিনগুলোতে এই ব্যবধান হ্রাস পাওয়ার কোনো সম্ভাবনা আছে বলে মনে হয় না। গণমাধ্যমের প্রতি সরকারের ক্রমাগত বৈরী আচরণে আশঙ্কা হয়, বাকশাল জমানার মতো সংবাদপত্র বা প্রচারমাধ্যম আবার কোনো বড় ধরনের হামলার শিকার হতে যাচ্ছে নাতো!
লেখক : নিউইয়র্ক প্রবাসী প্রবীণ সাংবাদিক
সৈয়দ আশরাফের কথাগুলো বিবেচনায় নিলে তার অর্থ দাঁড়ায় তাদের বক্তব্যের ভিত্তিতে কোনো ‘খবর’ তৈরি করা যাবে না। সাংবাদিকরা তাদের পেশার এই মৌলিক কাজটা করতে পারবেন না। সৈয়দ আশরাফ যা বলবেন তার পুরোটাই অর্থাত্ ‘পূর্ণ বিবরণ’ ছাপতে হবে। তবে এবারে দেখছি আশরাফ সাহেবকে টেক্কা দিলেন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী সাহারা খাতুন। গত ১ জুন সাংবাদিকদের সঙ্গে মতবিনিময় সভায় সাংবাদিকদের অভিযুক্ত করে তিনি বলেছেন, তার এবং তার প্রতিমন্ত্রী জনাব টুকুর বক্তব্য বিকৃত করা হয়েছে। তিনি নাকি সাগর-রুনির হত্যাকারীদের ৪৮ ঘণ্টার মধ্যে গ্রেফতার করার ঘোষণা দেননি। আর টুকু সাহেবও নাকি সাংবাদিকদের পুলিশ থেকে দূরে থাকতে বলেননি।
হায় সাহারা খাতুন! এতদিন পরে এ কী শোনালেন আপনি? এতদিন কোথায় ছিলেন? এই দীর্ঘ সময়ে তো আপনার এই অমৃতবচন শোনা যায়নি। আর টুকু সাহেব আপনার মুখে চুন খাচ্ছেন কেন? তিনি নিজেই মুখ খুলে বলুন না, সাংবাদিকরা বিকৃত খবর পরিবেশন করে। কোনো কোনো ছোটখাটো মন্ত্রীও দেখছি প্রচার মাধ্যমকে এক হাত নিতে ছাড়ছেন না।
ক’দিন আগে মন্ত্রিসভার বৈঠকেও গণমাধ্যমের বিরুদ্ধে ক্ষোভ প্রকাশ করা হয়েছে। মন্ত্রীদের এইসব কথাবার্তাই পুলিশের জন্য সাংবাদিক পেটাতে ইন্ধন হিসেবে কাজ করছে। ‘সাংবাদিক পেটাইলে কিছু হয় না’—পুলিশের এসি শহীদুলের এই পরোয়াহীন দম্ভোক্তির মূলে রয়েছে মন্ত্রীদের এইসব উস্কানি। তবে মন্ত্রীদের কথাবার্তা বিক্ষিপ্ত বা পৃথকভাবে দেখার কোনো সুযোগ নেই। এসব কথাবার্তার দায় তো বর্তায় সার্বিকভাবে সরকারের ওপর। দেশের মানুষ দেখবে গণমাধ্যমের প্রতি সরকারের অসহিষ্ণুতা। মন্ত্রীদের বিষোদ্গার মানেই তো সরকারের মনোভাবের প্রকাশ। এরই ভয়ঙ্কর পরিণতি সাংবাদিকদের ওপর পুলিশের সর্বাত্মক নিগ্রহ। সাংবাদিক পেটালে তাদের কিছু হবে না বরং পুরস্কার মিলবে এমন কোনো মহার্ঘ বাণী তাদের কাছে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের কোনো বিজ্ঞপ্তি মারফত পৌঁছানো হয়েছে কিনা জানি না। তবে কথাটা যে মিথ্যা নয় সে প্রমাণ তো হাতেনাতেই পাওয়া গেল। এসি শহীদুলের শাস্তির দাবিতে সাংবাদিক সমাজসহ বিভিন্ন মহল যখন গর্জে উঠল তখন তাকে দ্রুত ‘প্রত্যাহার’ করে সঙ্গে সঙ্গে রাঙামাটিতে পোস্টিং দেয়া হলো। অর্থাত্ সাংবাদিক পিটিয়ে কিছু হয় না সেই প্রমাণই রাখল সরকার। কিন্তু সামাল দিতে পারেনি। চতুর্দিকের ধিক্কার ধ্বনিতে সরকার তাকে সাসপেন্ড ও ক্লোজড করে চট্টগ্রামে পাঠানোর কথা ঘোষণা করেছে। ঘটনা নিয়ে তদন্ত চলছে। এখন দেখার অপেক্ষা শহীদুলের ভাগ্যে কী আছে।
কিন্তু শুধু কি পুলিশ? পুলিশ তো রাষ্ট্রের বেতনভোগী একটি বাহিনী। সরকারের হুকুমে চলে। সরকারকে সেবা দেয়। শুরুতেই বলেছি, দুটি ঘটনা একসঙ্গে ঘটে চলেছে। সদরে সাংবাদিকদের ওপর পুলিশের হামলা আর অন্দরে গণমাধ্যমের বিরুদ্ধে সরকারি কর্তাব্যক্তিদের বিষোদ্গার। বলেছি, সরকারের কথাবার্তাই পুলিশকে উত্সাহিত করে তুলেছে সাংবাদিক নিগ্রহে বেপরোয়া হয়ে উঠতে। আরও সোজা করে নিশ্চয়ই বলা যায়, সাংবাদিকদের ওপর পুলিশি দমন-পীড়ন এই সরকারের অনুসৃত একটি নীতি। সরকারের এই নীতিরই বাস্তবায়ন লক্ষ্য করা যাচ্ছে বিভিন্ন ক্ষেত্রে এবং বিরামহীনভাবে। একটি ঘটনার রেশ কাটতে না কাটতেই ঘটানো হচ্ছে আর একটি ঘটনা। শুরু করেছিলাম তিন আলোকচিত্র সাংবাদিককে পেটানোর বিষয় দিয়ে, পরপরই ঘটে গেল বিডিনিউজ ডট কমে সাংবাদিকদের ওপর রক্তাক্ত হামলার ঘটনা, আদালত প্রাঙ্গণে সাংবাদিক ও আইনজীবীদের ওপর পুলিশের আর এক দফা লাঠিপেটার ঘটনা।
পুলিশের পাশাপাশি দেশজুড়ে সাংবাদিক নিগ্রহে উন্মত্ত হয়ে উঠেছে আরেকটি বিশেষ মহল, যারা বিবেচিত সরকারের রাজনৈতিক শক্তি হিসেবে। সরকারি পৃষ্ঠপোষকতাতেই তাদের যত আস্ফাালন। এদের জবাবদিহিতার কোনো বাধ্যতা নেই। এদের কৃতকর্মের কোনো বিচার হয় না। ক্ষমতায় তাদের সরকার থাকায় তারা সবাই অনেক ক্ষমতা ধরেন। বিডিনিউজ ডট কমে হামলার জন্য যাদের ধরা হয়েছে তারা নাকি সবাই আওয়ামী যুবলীগের সদস্য। আওয়ামী লীগ এবং তাদের সরকারের এই রাজনৈতিক শক্তি কিংবা স্বার্থসংশ্লিষ্ট কোনো মহল যারা সাগর-রুনির মতো সাংবাদিককে বাসায় ঢুকে হত্যা করছে তারা তো ধরা-ছোঁয়ার বাইরে থেকে যাচ্ছে। এদেরকে হিসাবে নেয়ার ব্যাপারে সরকারের নির্লিপ্ততা অনেক প্রশ্নের জন্ম দিয়েছে। সাগর-রুনির তদন্ত নিয়ে কী হচ্ছে? এই হত্যাকাণ্ড নিয়ে সরকার কি একতরফাভাবে পানি ঘোলা করে চলছে না? স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর ঘোষণা অনুযায়ী আটচল্লিশ ঘণ্টার মধ্যে হত্যা-রহস্যের কিনারা তো হয়-ইনি, এখন আটচল্লিশ মাসেও হবে কিনা সে ভরসাও করা যাচ্ছে না। উচ্চ আদালত পুলিশকে নির্দেশ দিয়েছিল তাদের তদন্তের অগ্রগতি জানাতে। পুলিশ আদালতকে নির্বিকার জানিয়ে দিল, এ হত্যা-রহস্যের কিনারা করতে তারা ব্যর্থ হয়েছে। অথচ পুলিশের আইজি হাসান মাহমুদ খন্দকার সংবাদ সম্মেলন করে জানিয়েছিলেন, তদন্তকাজে উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি হয়েছে। পুলিশের এই রহস্যজনক ও অভিনব ধরনের ব্যর্থতা স্বীকারের পর তদন্তভার এখন র্যাবের হাতে। র্যাব কতদূর এগিয়েছে সে তথ্য গোপনই রয়েছে। তারা ভিসেরা পরীক্ষার জন্য দু’জনের লাশ কবর থেকে তুলে আবার ময়নাতদন্ত করিয়েছে। সে ময়নাতদন্তের রিপোর্টে বলা হয়েছে, ওদের পেটে বিষাক্ত কিছু পাওয়া যায়নি। অর্থাত্ ওদের মৃত্যুর কারণ বিষপান নয়। এরপর র্যাব কি খুঁজবে? তদন্তের গতি কোনদিকে যাবে? কিছু কি জানা যাবে তাদের তদন্তের অগ্রগতি? কিছু কি প্রকাশ পাবে তাদের রহস্য উদ্ঘাটন বিষয়ে? হয়তো কিছু প্রকাশ পাবে না। হয়তো অদৃশ্য কালো গহ্বরে এসব তথাকথিত তদন্ত একদিন বিলীন হয়ে যাবে। তবে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী সাহারা খাতুন খুব খুশি। তিনি বলেছেন, তদন্তকাজে তিনি সন্তুষ্ট।
স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী সাহারা খাতুনের খুশির সীমা নেই তার আদরের ধন পুলিশ বাহিনী নিয়ে। এই পুলিশ বাহিনীর কর্মকাণ্ডে মনে হচ্ছে তিনি বেশ গৌরবান্বিত। সাংবাদিকদের কাছে বেশ গর্বের সঙ্গে বলেছেন, তার এই পুলিশ আগের যে কোনো সময়ের পুলিশের চেয়ে ভালো। এদের তিনি জনবান্ধব পুলিশ হিসেবে গড়ে তুলছেন। সাহারা খাতুনের ‘জনবান্ধব’ পুলিশের মাজেজা বোধ করি তার প্রতিমন্ত্রী শামসুল হক টুকু সমঝে উঠতে পারেননি। তিনি এই জনবান্ধব পুলিশ থেকে একশ’ হাত দূরে থাকার জন্য সাংবাদিকদের নসিহত করেছেন। তার বক্তব্য হচ্ছে, পুলিশ যখন পেটায় তখন সাধারণ মানুষ আর সাংবাদিকদের আলাদা করে দেখা সম্ভব হয় না।
কী বোঝাতে চাইলেন টুকু সাহেব এই কথায়? তিনি তো সোজা-সাপটা জানিয়েই দিলেন যে পুলিশ জনগণকে পেটাবেই। সাংবাদিকরা সে পিটুনি থেকে রক্ষা পেতে যেন পুলিশ থেকে একশ’ হাত দূরে থাকেন। টুকু সাহেবের কথা থেকে যে নির্মম সত্যটি বেরিয়ে এসেছে তা হচ্ছে, পুলিশ পেটাবে। জনগণের ভোটে নির্বাচিত তাদের গণতান্ত্রিক সরকারের জনবান্ধব পুলিশ জনগণকে পেটাবে। অবশ্য পুলিশ যাদের পেটাবে, যাদের ওপর জুলুম-নির্যাতন চালাবে, তারা ‘জনগণ’ নয়। তারা শান্তি-শৃঙ্খলা বিনষ্টকারী অরাজকতা-বিশৃঙ্খলা সৃষ্টিকারী, দুষ্কৃতকারী। আরও একটি ভয়ঙ্কর অভিযোগ তাদের বিরুদ্ধে রুজু করাই আছে, তারা ‘যুদ্ধাপরাধ’ বিচার বানচালের ষড়যন্ত্রে লিপ্ত। কাজেই এদের পেটানো এই সরকারের জন্য ন্যায়সঙ্গত।
এই ন্যায়সঙ্গত কাজটি করতে গিয়ে সরকার এখন নির্বিচারে পিটিয়ে চলেছে সর্বস্তরের মানুষকে। তাদের পিটুনি থেকে রেহাই পাচ্ছে না ছাত্র-শিক্ষক, আইনজীবী-রাজনীতিকরা। রেহাই পাচ্ছেন না সাংবাদিকরা। একথা এখন নির্দ্বিধায় বলা যায় সাংবাদিকদের সঙ্গে দুর্ব্যবহার, তাদের ওপর জুলুম-নিগ্রহ, মিডিয়ার প্রতি অসহিষ্ণুতা ইত্যাদি সব পরিস্থিতির মধ্য দিয়ে সরকার গণমাধ্যমকে তাদের প্রতিপক্ষে পরিণত করেছে। সরকার তার কার্যকলাপের কারণে মিডিয়ার সঙ্গে সৃষ্ট ব্যবধানকে ক্রমেই বাড়িয়ে চলেছে। আগামী দিনগুলোতে এই ব্যবধান হ্রাস পাওয়ার কোনো সম্ভাবনা আছে বলে মনে হয় না। গণমাধ্যমের প্রতি সরকারের ক্রমাগত বৈরী আচরণে আশঙ্কা হয়, বাকশাল জমানার মতো সংবাদপত্র বা প্রচারমাধ্যম আবার কোনো বড় ধরনের হামলার শিকার হতে যাচ্ছে নাতো!
লেখক : নিউইয়র্ক প্রবাসী প্রবীণ সাংবাদিক
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন