॥ সিরাজুর রহমান ॥
ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী ডেভিড ক্যামেরন আর অর্থমন্ত্রী জর্জ অসবোর্ন একমত হয়েছেন যে জ্যেষ্ঠ ক্যাবিনেট মন্ত্রীদের আয় আর তারা কত কর দিয়েছেন তার বিবরণ প্রকাশ হওয়া উচিত। ক্ষমতায় আসার দু’বছরের মাথায় তাদের এই স্বচ্ছতার সিদ্ধান্তের দুটো কারণ আছে। প্রথমত, অর্থমন্ত্রী গত ২১ মার্চের বাজেটে আয়করের স্তরভেদের যেসব বিধান করেছেন সে সম্বন্ধে এখনো তুমুল বিতর্ক চলছে। দ্বিতীয়ত, আগামী ৩ মে লন্ডনের মেয়র নির্বাচন হবে। প্রধানমন্ত্রীর পরেই এটা ব্রিটেনের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ রাজনৈতিক পদ বলে বিবেচিত। বড় দুটো দলের প্রার্থীরা পরস্পরের বিরুদ্ধে আয়কর ফাঁকি দেয়ার অভিযোগ তুলেছিলেন। তার জের ধরে তারা এখন নিজ নিজ ট্যাক্স রিটার্নের বিবরণ প্রকাশ করেছেন।
বাংলাদেশের বর্তমান প্রধানমন্ত্রী রাজনীতিকদের সম্পদের ব্যাপারে কিছুকাল অগ্রবর্তী ছিলেন। ২০০৮ সালের নির্বাচনী ইশতেহারে তিনি বলেছিলেন, তার দল জয়ী হলে মন্ত্রীদের সম্পদের হিসাব প্রকাশ করা হবে। সবাই এখন জানে শেখ হাসিনার প্রতিশ্রুতিগুলো অর্থহীন, নিছক রাজনীতির কলাকৌশল মাত্র। ১০ টাকা কেজি দরে চাল খাওয়ানো, কৃষকদের বিনামূল্যে সার দেয়া, রাতারাতি বিদ্যুৎ সমস্যার সমাধান করে ফেলা ইত্যাদি আরো বহু প্রতিশ্রুতি তিনি দিয়েছিলেন গদি পাওয়ার আশায়। গদি তিনি পেয়েছেন, কিন্তু কোন প্রতিশ্রুতিটি তিনি পালন করেছেন?
গদি লাভের তিন বছর পর শেখ হাসিনা মন্ত্রীদের সম্পদের হিসাবের কথা উচ্চারণ করেছেন। কিন্তু সে হিসাব প্রকাশের কথা তিনি আর বলেননি, শুধু বলেছেন মন্ত্রীদের সম্পদের হিসাব তার কাছে জমা দিতে হবে। ২০০৮ সালের প্রতিশ্রুতি আর ২০১১ সালের নির্দেশের মধ্যে এই আকাশ-পাতাল গরমিল কেন? এ সরকারের আমলে দেশজোড়া দুর্নীতি ১৯৭২-৭৫ সালের মহাদুর্নীতিকেও ছাড়িয়ে গেছে। ভর্তিবাণিজ্য, টেন্ডার-বাণিজ্য, নিয়োগবাণিজ্যÑ এগুলো কয়েকটি দৃষ্টান্ত মাত্র। দুর্নীতি প্রমাণ করা কখনোই সহজ নয়। যারা দুর্নীতি করে তারা এত বোকা নয় যে সাক্ষী-প্রমাণ রেখে দুর্নীতি করবে। কিন্তু দেশের সব মানুষের উপলব্ধি এই যে দিনদুপুরে পুকুর চুরিই নয়, রীতিমতো দীঘি চুরি; এমনকি বঙ্গোপসাগর চুরিই চলছে এখন। নির্বাচন যখন হবে ভোটদাতারা তখন প্রমাণের জন্য অপেক্ষা করবে না, উপলব্ধি থেকে তারা ভোট দেবে; উপলব্ধিই তাদের প্রার্থী এবং দল নির্বাচনের জন্য যথেষ্ট হবে।
ভেবে দেখুন! এ সরকার ক্ষমতা পাওয়ার পর লে. ক. ফারুক খান যখন বাণিজ্যমন্ত্রী ছিলেন, তখন চাল-ডাল-তেল-নুন-আটা থেকে শুরু করে পেঁয়াজ আর কাঁচা লঙ্কার দামেও যে ফটকাবাজি চলেছে, সেসব কথা বাংলাদেশের মানুষ ভুলে যেতে পারবে? তাড়াতাড়ি বিদ্যুৎ সরবরাহ বাড়ানোর কথা বলে যেসব সিন্ডিকেট আর গ্রুপকে ২০ হাজার কোটি টাকার কন্ট্রাক্ট বিনা টেন্ডারে দেয়া হয়েছে এবং চুরির দায়দায়িত্ব থেকে তাদের অব্যাহতি দেয়ার আগাম মুচলেকা দেয়া হয়েছে, তাদেরও কোনো কোনোটির মালিক সরকারের উচ্চপদে আসীনদের আত্মীয়স্বজন অথবা দলের ভেতর ক্ষমতার খুঁটি বলে বিবেচিত কয়েকজন।
আরো দেখুন! দেশের ৩২-৩৩ লাখ স্বল্পবিত্ত ও মধ্যবিত্ত যেকোনো প্রকারেই হোক কিছু টাকা সংগ্রহ করে সুদিনের মুখ দেখার আশায় শেয়ারবাজারে লগ্নি করেছিল। সেসব টাকা কুমিরে খেয়েছে। তারা এখন পথে বসেছে, তাদের কেউ কেউ আত্মহত্যাও করেছে। সরকারের ভেতরের কিছু লোক এবং সরকারের দেশী-বিদেশী পৃষ্ঠপোষকেরা এই ৩২-৩৩ লাখ লোকের যথাসর্বস্ব লুটপাট করে বিদেশে পাচার করে দিয়েছে বলেই সবার বিশ্বাস। সরকারি উদ্যোগে বাংলাদেশ কৃষি ব্যাংকের চেয়ারম্যানের নেতৃত্বে একটা জরুরি তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছিল। সে কমিটি নাম ধরে দুর্বৃত্তদের তালিকাও সরকারের হাতে তুলে দিয়েছিল। কিন্তু সরকার কোনো ব্যবস্থা নেয়নি, এমনকি তস্করদের নামের তালিকা প্রকাশ করতেও তারা সাহস পায়নি।
দুষ্কৃতকারীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে সরকারের এই অনীহা থেকে দেশের মানুষ ঠিকই বুঝে গেছে এ সরকার তাদের কল্যাণ সাধনের জন্য নয়, দুর্নীতিবাজদের রক্ষা করতেই গদিতে এসেছে। আর হাসিনা কেন মন্ত্রীদের সম্পদের তালিকা চেয়েছেন? তারও কারণ আছে। সরকার এখন চতুর্থ বছরে পড়েছে। মন্ত্রীদের চাকরির মেয়াদ আর মাত্র দেড় বছর। আখের গুছিয়ে নিতে তাদের আর ধৈর্য সয় না। লুটপাটের ব্যাপারে তাদের কেউ কেউ বেপরোয়া হয়ে পড়েছেন। মাঝে মাঝে উচ্ছৃখলতা আর অবাধ্যতার ভাবও দেখাচ্ছেন কেউ কেউ। মন্ত্রীদের দুর্নীতি আর টাকার পাহাড়ের খোঁজখবর হাতে থাকলে রাশ টেনে ধরতেও সেই হিসাবকে ব্যবহার করা যাবে।
মন্ত্রীদের পেট এখন অনেকটা ভরে এসেছে। এ দিকে নির্বাচনের সময়ও এগিয়ে আসছে দ্রুত। সংসদ সদস্যদের পেটও এখন ভরানো দরকার। কাঁড়ি কাঁড়ি টাকা ছাড়া আগামী নির্বাচনে ভোট পাওয়ার উপায় নেই। যেকোনো প্রকারেই হোক তাদের খুশি করা না গেলে তারা বহু হাঁড়ি হাটেই ভেঙে দেবেন, শেষমুহূর্তে হয়তো ভাঙা নৌকা থেকে লাফিয়ে অন্য দলে চলে যাবেন কেউ কেউ, যেমন করে ডুবন্ত জাহাজ কিংবা নৌকা থেকে ইঁদুর-ছুঁচো লাফিয়ে পড়ে। তাদের বেশ কয়েকজনকে এখন ব্যাংক করার লাইসেন্স দেয়া হয়েছে। কিন্তু ব্যাংক করার পুঁজি তারা কোথায় পেলেন, বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর ড. আতিউর রহমান কি একবারও তার খোঁজ নিয়েছেন? জোর গুজব, ব্যাংকের লাইসেন্স দেয়ার ব্যাপারে দেদার টাকার হাতবদল হয়েছে। রেডিও, টেলিভিশন, টেলিকম লাইসেন্সের ব্যাপারেও কোটি কোটি টাকা হাতিয়ে নিয়েছেন সরকারের মন্ত্রীরা। শোনা যাচ্ছে নতুন নতুন ইন্স্যুরেন্স কোম্পানি খোলার জন্যও লাইসেন্স দেয়া হবে। সন্দেহ নেই যে সরকারের ভেতর মহলের কেউ কেউ আরো বহু কোটি টাকা হাতিয়ে নেবেন সেই সুবাদে।
দুর্নীতি তদন্তে সরকারের অনীহা
সাবেক যোগাযোগমন্ত্রী সৈয়দ আবুল হোসেনের বিরুদ্ধে দুর্নীতির বহু অভিযোগ মিডিয়ায়ও প্রচার হয়েছিল। এমনকি পদ্মা সেতু নির্মাণে দুর্নীতির প্রমাণও দিয়েছে বিশ্বব্যাংক। তখনো আমরা বলেছিলাম, সৈয়দ আবুল হোসেনকে বরখাস্ত করার সাহস সরকারের হবে না। আসলেও হয়নি। একাধিক কারণ আছে তার। দেশে ব্যাপক সন্দেহ আছে, যেকোনো কারণেই হোক ‘ওপরের’ শক্তিশালী সমর্থন আছে আবুল হোসেনের পেছনে। প্রচার-প্রচারণায় কান ঝালাপালা হয়ে যাওয়ার পর তাকে অন্য এমন একটি দফতরের দায়িত্ব দেয়া হয়েছে যেখানে দুর্নীতি করার সুযোগ বেশি বৈ কম নয়। বিশ্বব্যাংক এখন কানাডার একটি নির্মাণ কোম্পানিকে দুর্নীতির দায়ে পদ্মা সেতু নির্মাণের কাজে অযোগ্য ঘোষণা করেছে।
অনেক প্রবাদ আছে চোর ও চুরি সম্বন্ধে। একটা হচ্ছেÑ চোরেরও ধর্ম আছে। আরেকটা চোরে চোরে মাসতুতো ভাই। আসল কথা হচ্ছে, এক চোর অন্য চোরকে ধরিয়ে দেয় না। এবং আগেই বলেছি চোরেরা সাক্ষী-প্রমাণ রেখে চুরি করতে চায় না। আরেকটা প্রবাদÑ চুরি বিদ্যা মহাবিদ্যা যদি না পড়ে ধরা। সুরঞ্জিত সেনগুপ্তের দুর্ভাগ্য। তিনি ধরা পড়ে গিয়ে বিপাকে পড়েছেন বলেই সবার ধারণা।
অত্যন্ত নাটকীয় কিছু ঘটনা ঘটেছে ৯ এপ্রিল দিবাগত শেষ রাতে। চলমান একখানি গাড়ি হঠাৎ করে মোড় নিয়ে পিলখানায় বর্ডার গার্ড বাংলাদেশ (বিজিবি) বাহিনীর সদর দফতরে ঢুকে পড়ে। সেই গাড়ির আরোহীরা ছিলেন গাড়ির মালিক রেলমন্ত্রী সুরঞ্জিত সেনগুপ্তের সহকারী একান্ত সচিব (এপিএস) ওমর ফারুক তালুকদার, বাংলাদেশ রেলের পূর্বাঞ্চলীয় জেনারেল ম্যানেজার ইউসুফ আলী মৃধা আর রেলের নিরাপত্তা বাহিনীর কমান্ডেন্ট এনামুল হক। গাড়ির চালক ছিলেন আজম খান। পিলখানায় ঢুকেই আজম খান নাকি চিৎকার করে বলতে থাকেন গাড়িতে অনেক টাকা আছে। বিজিবির লোকেরা তল্লাশি করে নাকি ৭০ লাখ টাকা পান। এত রাতে তারা কোথায় যাচ্ছিলেন, এ প্রশ্নের জবাবে ড্রাইভার ও যাত্রীরা সবাই বিজিবিকে বলেন যে তারা রেলমন্ত্রীর বাড়িতে যাচ্ছিলেন। পরদিন মিডিয়াকেও তারা একই কথা বলেন। কিন্তু রেলমন্ত্রী সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত পরে দাবি করেন ওই তিনজন যাত্রী আজম খান চালিত গাড়িতে তার বাড়িতে যাচ্ছিলেন না, যাচ্ছিলেন তার একান্ত সচিব ওমর ফারুক তালুকদারের বাড়িতে।
সঠিক চিত্র এখনো পাওয়া যায়নি
অনেক কারণে সেই রাতের ঘটনাবলির একটা স্বচ্ছ চিত্র এখনো পাওয়া যায়নি। জেনারেল ম্যানেজার ইউসুফ আলী মৃধা বলেছিলেন, একটা স্টেশনে (শায়েস্তাগঞ্জ?) ট্রেন থামবে কি না আলোচনার জন্য তিনি রেলমন্ত্রীর বাড়িতে যাচ্ছিলেন। তাহলে গাড়িতে যে বস্তা বস্তা টাকা ছিল তার ব্যাখ্যা কী? একটা কথা তখনো শোনা গিয়েছিল গাড়িতে ৭০ লাখ নয়, চার কোটি ৭০ লাখ টাকা ছিল। অবশিষ্ট চার কোটি টাকা তাহলে গেল কোথায়? চার কোটি ৭০ লাখ অঙ্কটার কিছু প্রাসঙ্গিকতা আছে। মোটামুটি একই সময়ে খবর পাওয়া যায়, সুরঞ্জিতের পুত্র সৌমেন পাঁচ কোটি টাকায় একটা টেলিকম লাইসেন্স কিনেছেন। তার টাকার উৎসই বা কী? আরেকটা প্রশ্ন : ড্রাইভার আজম খান কি টাকার বখরার কারণে পিলখানায় ঢুকে পড়েছিলেন, নাকি দুর্নীতি দমনের নাগরিক দায়িত্ব থেকে যাত্রীদের তিনি বিজিবির হাতে ধরিয়ে দিতে চেয়েছিলেন? শোনা যাচ্ছে আজম খানকে এখন পাওয়া যাচ্ছে না, তার পরিবার তার নিরাপত্তার জন্য উদ্বিগ্ন। কোথায়, কেমন আছেন আজম খান?
গা বাঁচানোর জন্য সুরঞ্জিত সেনগুপ্তের চেষ্টাগুলো প্যাথেটিক। মূল অভিযোগ ছিল তার বিরুদ্ধে। নিজেকে নির্দোষ সাব্যস্ত করতে তিনি দুটো ‘এক ব্যক্তির’ তদন্ত কমিশন গঠন করেছিলেন তারই অধীনস্থ দু’জন কর্মকর্তার অধীনে। এপিএস ফারুক সম্বন্ধে তদন্তের ভার দেয়া হয়েছিল তারই সহকর্মী পিএস (একান্ত সচিব) আখতারুজ্জামানকে। আর জেনারেল ম্যানেজারের বিরুদ্ধে তদন্তের দায়িত্ব দেয়া হয় রেল মন্ত্রণালয়ের যুগ্মসচিব শশী কুমার সিংকে, যিনি মোটামুটি জেনারেল ম্যানেজারের সমমর্যাদার কর্মকর্তা। বর্তমান সরকারের আমলে ‘তদন্ত’ ব্যাপারটাই মূল্যহীন। কোনো তদন্তেই প্রকৃত সত্য উদঘাটিত হয় না।
সাংবাদিক দম্পতি মেহেরুন রুনি আর তার স্বামী সাগরের হত্যার তদন্ত তদারকির ভার নিয়েছিলেন স্বয়ং প্রধানমন্ত্রী। সেই হত্যারও কোনো সুরাহা হয়নি। শোনা গিয়েছিল বিনা টেন্ডারে বিদ্যুৎ উৎপাদনের কন্ট্রাক্টে ব্যাপক দুর্নীতি সম্বন্ধে তারা তদন্ত করছিলেন। আরো শোনা গিয়েছিল যে খুনিদের তাড়াতাড়ি আমেরিকায় পাঠিয়ে দেয়া হয়েছে। বর্তমান সরকারের সাড়ে তিন বছরে দুর্নীতি দমন কমিশন শাসক দলের কাউকে দুর্নীতির দায়ে দোষী সাব্যস্ত করেনি। এ সরকারের আমলে তদন্তের অন্য অর্থ হচ্ছে সময়ক্ষেপণ এবং সত্য উদঘাটন না হওয়া।
সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত পদত্যাগ করতে অস্বীকার করছিলেন। রাতের বেলায় প্রধানমন্ত্রী তাকে তলব করার পরের দিন সংবাদ সম্মেলন ডেকে তিনি পদত্যাগের ঘোষণা দেন। শেখ হাসিনার দুই মেয়াদের প্রধানমন্ত্রিত্বের সময় এই প্রথমবার একজন মন্ত্রী বরখাস্ত হলেন। শেখ হাসিনার অনুগত রাজনীতিক ও লেখকেরা চমৎকৃত হয়েছেন তাতে। সরকারের গৃহপালিত মিডিয়া এই পদত্যাগকে পুঁজি করে সরকার ও প্রধানমন্ত্রীর ইমেজ ঘষামাজা করার কাজে লেগে গেছে। এখানে প্রধানমন্ত্রীর নবজাগ্রত কোনো শুভবুদ্ধির পরিচয় আমি দেখতে পাই না। প্রকৃত ব্যাপার এই, সরকারের মধ্যে দুর্নীতির একটা সিন্ডিকেট আছে। ধারণা করা হয়, সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত ধরা পড়ে গিয়ে গোটা সিন্ডিকেটকেই বিপদগ্রস্ত করেছেন।
গত সাড়ে তিন বছরে রেলওয়ে বিভাগে সাড়ে সাত হাজার জনকে নিয়োগ দেয়া হয়েছে। রেল কর্মচারী, ইউনিয়ন সদস্য ও নেতা এবং চাকরিপ্রার্থীদের অনেকে অভিযোগ করেছেন, প্রতিটি নিয়োগের বেলায় নিয়োগকর্তারা দুই থেকে চার লাখ টাকা ঘুষ নিয়েছেন। এই নিয়োগবাণিজ্যের অভিযোগ তারা কর্তৃপক্ষ ও দুর্নীতি দমন কমিশনে পাঠিয়েছেন। কিন্তু তাতে কোনো ফল হয়নি। কেন হয়নি এখন আর কারো বুঝতে বাকি রইল না।
বিএনপি নেতা ইলিয়াস আলী গুম
মিডিয়ায় এবং অন্যত্র তার পদত্যাগের দাবিকে সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত ‘গণতন্ত্রের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র’ বলে দাবি করেছেন। সুরঞ্জিত বাবু বিরোধী দলের বিরুদ্ধে গা ঘিনঘিন করা দাঁত খিঁচানো ব্যঙ্গ দিয়ে এতকাল শুধু নিজেকেই আমোদিত করছিলেন। তার এই দাবিতে বহু মহলেই বিদ্রƒপের হাসি দেখা দেবে। এ সরকারের কাজে এবং কর্মে সুরঞ্জিত বাবু গণতন্ত্র কোথায় দেখলেন? কোন গণতন্ত্রের কথা বলছেন তিনি? ক্ষমতা পাওয়ার প্রথম দিন থেকে এ সরকার গদি চিরস্থায়ী করার জন্য ফ্যাসিস্ট পন্থায় সব রাজনৈতিক বিরোধিতাকে নির্মূল করার পরিকল্পিত অভিযান শুরু করেছে।
হত্যা, ধরপাকড় এখনো অব্যাহত গতিতে চলছে। জেলখানায় এদের স্থান করার জন্য ফাঁসির দণ্ডপ্রাপ্ত অপরাধীদের মুক্তি দিচ্ছে সরকার। বিচারবহির্ভূত হত্যার সাথে ইদানীং যুক্ত হয়েছে বিরোধীদলীয় নেতাকর্মীদের গুম করে ফেলা। ঢাকার কাউন্সিলর চৌধুরী আলমকে দিয়ে এই গুম করার প্রক্রিয়া শুরু হয়। সর্বশেষ গুম হয়েছেন বিএনপির সংসদ সদস্য, সিলেট জেলা বিএনপির প্রেসিডেন্ট ও বিএনপির সাংগঠনিক সম্পাদক ইলিয়াস আলী। দেশব্যাপী জোর গুজব এবং বিএনপি সরাসরি অভিযোগ করেছে যে সরকারই বিএনপি নেতা ইলিয়াস আলীকে গুম করেছে।
বিরোধী দলকে সভা-সমিতি ও মিছিল করার গণতান্ত্রিক অধিকার থেকে বঞ্চিত করা হচ্ছে। গত ১২ মার্চ বিএনপির আহূত ‘ঢাকা চলো’ কর্মসূচি বানচাল করতে সরকার যা করেছে সেটা রীতিমতো ন্যক্কারজনক। প্রধান বিরোধী দলের সদর দফতরকে কাঁটাতার দিয়ে ঘিরে রাখার দৃষ্টান্ত সম্ভবত নাৎসিরাও দেখাতে পারেনি। প্রশাসন, পুলিশ ও বিচার বিভাগ সম্পূর্ণ দলীয়করণ করা হয়েছে। এই তিনটি বিভাগকে বিরোধী দলের নির্যাতনের কাজে ব্যবহার করা হচ্ছে।
এ সরকারের আমলে যে ক’টি মেয়র নির্বাচন হয়েছে প্রতিটিতে সরকার সমর্থিত প্রার্থীরা শোচনীয়ভাবে পরাজিত হয়েছেন। রাজধানীতে পরাজয়ের গ্লানি এড়ানোর জন্য এখানের মেয়র নির্বাচন সরকার তিন বছর ঠেকিয়ে রেখেছিল। রাজধানীকে দুই টুকরো করে নির্বাচন আবারো পেছানো হয়েছে। তার পরও নির্বাচন কমিশন বিভক্ত ঢাকার নির্বাচনের তফসিল ঘোষণা করেছিল। আসন্ন নির্বাচন আরো তিন মাসের জন্য মুলতবি করেছেন আদালত। স্বয়ং প্রধানমন্ত্রী কটূক্তি করে বিরোধী দলের সংসদে উপস্থিতি অসম্ভব করে তুলেছেন। সুরঞ্জিত স্বয়ং যে ভাষায় বিরোধী দলকে ব্যঙ্গ-বিদ্রƒপ করেছেন সেটাকেও গণতন্ত্রের ভাষা বলা যায় না। এই যদি গণতন্ত্রের সংজ্ঞা হয় তাহলে সেই গণতন্ত্র কোনো সুস্থ বুদ্ধির মানুষের কাম্য হতে পারে না।
ভারতের চাপে সুরঞ্জিত আবার মন্ত্রী
পদত্যাগ করেও মাত্র ৩০ ঘণ্টা পর সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত আবার ক্যাবিনেটে স্থান পেয়েছেন দফতরবিহীন মন্ত্রী হিসেবে। তার পদত্যাগে সরকারের ইমেজ বেড়েছে বলে যেসব পত্রিকা নাচানাচি করছিল তারা এখন কী ব্যাখ্যা দেবে? বরং এটাই মনে হয় যে এ সরকার আপন স্বার্থে আপনজনদের ক্ষমতা-বলয়ের বাইরে যেতে দেবে না। তাহলে সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত কি ইতোমধ্যেই নির্দোষ প্রমাণিত হয়েছেন? সত্যি সত্যি যদি তিনি নির্দোষ হন তাহলে প্রধানমন্ত্রী তাকে পদত্যাগ করতে বাধ্য করেছিলেন কেন?
আসল ব্যাপার সেটা নয়। দেশব্যাপী জোর গুজব সুরঞ্জিতকে আবার মন্ত্রী করা হয়েছে ভারতের চাপে। আমরা আগেও অনেকবার লিখেছি, এ সরকারের আমলে বাংলাদেশে কী ঘটবে না ঘটবে সেটা স্থির হয় দিল্লিতে। আমরা বলেছি এবং বিশ্বব্যাপী আরো অনেকে বলেছেন, একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধে সর্বাধিক তিন লাখ মানুষ মারা গিয়েছিল। বর্তমান সরকার গায়ের জোরে প্রমাণ করতে চায় যে তিন মিলিয়ন, অর্থাৎ ৩০ লাখ নিহত হয়েছিল স্বাধীনতাযুদ্ধে। সঠিক সংখ্যা যা-ই হোক সে যুদ্ধে অজস্র প্রাণহানি হয়েছে। ভারতের অঙ্গুলি তাড়নে পরিচালিত হওয়ার জন্যই কি মুক্তিযোদ্ধারা প্রাণ দিয়েছিলেন?
বাংলাদেশের মানুষ জানে বিনা মেঘে বজ্রপাত কিংবা বিনা আগুনে ধোঁয়া হয় না। তারা এই সরকারকে দুর্নীতিবাজ বলে ভাবতে শিখেছে। তারা ধরে নিয়েছিল যে সুরঞ্জিতের পদত্যাগের ফলে অন্তত একটি ক্ষেত্রে দুর্নীতির প্রমাণ পাওয়া গেল। তাদের বিভ্রান্ত করার জন্যও শ্রী সেনগুপ্তকে আবার মন্ত্রিসভায় অন্তর্ভুক্ত করা প্রয়োজন ছিল। কিন্তু বাংলাদেশের মানুষ এত
বোকা নয়। এত সহজে তাদের সাথে প্রতারণা করা যাবে না।
(লন্ডন, ১৮.০৪.১২)
serajurrahman@btinternet.com
ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী ডেভিড ক্যামেরন আর অর্থমন্ত্রী জর্জ অসবোর্ন একমত হয়েছেন যে জ্যেষ্ঠ ক্যাবিনেট মন্ত্রীদের আয় আর তারা কত কর দিয়েছেন তার বিবরণ প্রকাশ হওয়া উচিত। ক্ষমতায় আসার দু’বছরের মাথায় তাদের এই স্বচ্ছতার সিদ্ধান্তের দুটো কারণ আছে। প্রথমত, অর্থমন্ত্রী গত ২১ মার্চের বাজেটে আয়করের স্তরভেদের যেসব বিধান করেছেন সে সম্বন্ধে এখনো তুমুল বিতর্ক চলছে। দ্বিতীয়ত, আগামী ৩ মে লন্ডনের মেয়র নির্বাচন হবে। প্রধানমন্ত্রীর পরেই এটা ব্রিটেনের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ রাজনৈতিক পদ বলে বিবেচিত। বড় দুটো দলের প্রার্থীরা পরস্পরের বিরুদ্ধে আয়কর ফাঁকি দেয়ার অভিযোগ তুলেছিলেন। তার জের ধরে তারা এখন নিজ নিজ ট্যাক্স রিটার্নের বিবরণ প্রকাশ করেছেন।
বাংলাদেশের বর্তমান প্রধানমন্ত্রী রাজনীতিকদের সম্পদের ব্যাপারে কিছুকাল অগ্রবর্তী ছিলেন। ২০০৮ সালের নির্বাচনী ইশতেহারে তিনি বলেছিলেন, তার দল জয়ী হলে মন্ত্রীদের সম্পদের হিসাব প্রকাশ করা হবে। সবাই এখন জানে শেখ হাসিনার প্রতিশ্রুতিগুলো অর্থহীন, নিছক রাজনীতির কলাকৌশল মাত্র। ১০ টাকা কেজি দরে চাল খাওয়ানো, কৃষকদের বিনামূল্যে সার দেয়া, রাতারাতি বিদ্যুৎ সমস্যার সমাধান করে ফেলা ইত্যাদি আরো বহু প্রতিশ্রুতি তিনি দিয়েছিলেন গদি পাওয়ার আশায়। গদি তিনি পেয়েছেন, কিন্তু কোন প্রতিশ্রুতিটি তিনি পালন করেছেন?
গদি লাভের তিন বছর পর শেখ হাসিনা মন্ত্রীদের সম্পদের হিসাবের কথা উচ্চারণ করেছেন। কিন্তু সে হিসাব প্রকাশের কথা তিনি আর বলেননি, শুধু বলেছেন মন্ত্রীদের সম্পদের হিসাব তার কাছে জমা দিতে হবে। ২০০৮ সালের প্রতিশ্রুতি আর ২০১১ সালের নির্দেশের মধ্যে এই আকাশ-পাতাল গরমিল কেন? এ সরকারের আমলে দেশজোড়া দুর্নীতি ১৯৭২-৭৫ সালের মহাদুর্নীতিকেও ছাড়িয়ে গেছে। ভর্তিবাণিজ্য, টেন্ডার-বাণিজ্য, নিয়োগবাণিজ্যÑ এগুলো কয়েকটি দৃষ্টান্ত মাত্র। দুর্নীতি প্রমাণ করা কখনোই সহজ নয়। যারা দুর্নীতি করে তারা এত বোকা নয় যে সাক্ষী-প্রমাণ রেখে দুর্নীতি করবে। কিন্তু দেশের সব মানুষের উপলব্ধি এই যে দিনদুপুরে পুকুর চুরিই নয়, রীতিমতো দীঘি চুরি; এমনকি বঙ্গোপসাগর চুরিই চলছে এখন। নির্বাচন যখন হবে ভোটদাতারা তখন প্রমাণের জন্য অপেক্ষা করবে না, উপলব্ধি থেকে তারা ভোট দেবে; উপলব্ধিই তাদের প্রার্থী এবং দল নির্বাচনের জন্য যথেষ্ট হবে।
ভেবে দেখুন! এ সরকার ক্ষমতা পাওয়ার পর লে. ক. ফারুক খান যখন বাণিজ্যমন্ত্রী ছিলেন, তখন চাল-ডাল-তেল-নুন-আটা থেকে শুরু করে পেঁয়াজ আর কাঁচা লঙ্কার দামেও যে ফটকাবাজি চলেছে, সেসব কথা বাংলাদেশের মানুষ ভুলে যেতে পারবে? তাড়াতাড়ি বিদ্যুৎ সরবরাহ বাড়ানোর কথা বলে যেসব সিন্ডিকেট আর গ্রুপকে ২০ হাজার কোটি টাকার কন্ট্রাক্ট বিনা টেন্ডারে দেয়া হয়েছে এবং চুরির দায়দায়িত্ব থেকে তাদের অব্যাহতি দেয়ার আগাম মুচলেকা দেয়া হয়েছে, তাদেরও কোনো কোনোটির মালিক সরকারের উচ্চপদে আসীনদের আত্মীয়স্বজন অথবা দলের ভেতর ক্ষমতার খুঁটি বলে বিবেচিত কয়েকজন।
আরো দেখুন! দেশের ৩২-৩৩ লাখ স্বল্পবিত্ত ও মধ্যবিত্ত যেকোনো প্রকারেই হোক কিছু টাকা সংগ্রহ করে সুদিনের মুখ দেখার আশায় শেয়ারবাজারে লগ্নি করেছিল। সেসব টাকা কুমিরে খেয়েছে। তারা এখন পথে বসেছে, তাদের কেউ কেউ আত্মহত্যাও করেছে। সরকারের ভেতরের কিছু লোক এবং সরকারের দেশী-বিদেশী পৃষ্ঠপোষকেরা এই ৩২-৩৩ লাখ লোকের যথাসর্বস্ব লুটপাট করে বিদেশে পাচার করে দিয়েছে বলেই সবার বিশ্বাস। সরকারি উদ্যোগে বাংলাদেশ কৃষি ব্যাংকের চেয়ারম্যানের নেতৃত্বে একটা জরুরি তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছিল। সে কমিটি নাম ধরে দুর্বৃত্তদের তালিকাও সরকারের হাতে তুলে দিয়েছিল। কিন্তু সরকার কোনো ব্যবস্থা নেয়নি, এমনকি তস্করদের নামের তালিকা প্রকাশ করতেও তারা সাহস পায়নি।
দুষ্কৃতকারীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে সরকারের এই অনীহা থেকে দেশের মানুষ ঠিকই বুঝে গেছে এ সরকার তাদের কল্যাণ সাধনের জন্য নয়, দুর্নীতিবাজদের রক্ষা করতেই গদিতে এসেছে। আর হাসিনা কেন মন্ত্রীদের সম্পদের তালিকা চেয়েছেন? তারও কারণ আছে। সরকার এখন চতুর্থ বছরে পড়েছে। মন্ত্রীদের চাকরির মেয়াদ আর মাত্র দেড় বছর। আখের গুছিয়ে নিতে তাদের আর ধৈর্য সয় না। লুটপাটের ব্যাপারে তাদের কেউ কেউ বেপরোয়া হয়ে পড়েছেন। মাঝে মাঝে উচ্ছৃখলতা আর অবাধ্যতার ভাবও দেখাচ্ছেন কেউ কেউ। মন্ত্রীদের দুর্নীতি আর টাকার পাহাড়ের খোঁজখবর হাতে থাকলে রাশ টেনে ধরতেও সেই হিসাবকে ব্যবহার করা যাবে।
মন্ত্রীদের পেট এখন অনেকটা ভরে এসেছে। এ দিকে নির্বাচনের সময়ও এগিয়ে আসছে দ্রুত। সংসদ সদস্যদের পেটও এখন ভরানো দরকার। কাঁড়ি কাঁড়ি টাকা ছাড়া আগামী নির্বাচনে ভোট পাওয়ার উপায় নেই। যেকোনো প্রকারেই হোক তাদের খুশি করা না গেলে তারা বহু হাঁড়ি হাটেই ভেঙে দেবেন, শেষমুহূর্তে হয়তো ভাঙা নৌকা থেকে লাফিয়ে অন্য দলে চলে যাবেন কেউ কেউ, যেমন করে ডুবন্ত জাহাজ কিংবা নৌকা থেকে ইঁদুর-ছুঁচো লাফিয়ে পড়ে। তাদের বেশ কয়েকজনকে এখন ব্যাংক করার লাইসেন্স দেয়া হয়েছে। কিন্তু ব্যাংক করার পুঁজি তারা কোথায় পেলেন, বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর ড. আতিউর রহমান কি একবারও তার খোঁজ নিয়েছেন? জোর গুজব, ব্যাংকের লাইসেন্স দেয়ার ব্যাপারে দেদার টাকার হাতবদল হয়েছে। রেডিও, টেলিভিশন, টেলিকম লাইসেন্সের ব্যাপারেও কোটি কোটি টাকা হাতিয়ে নিয়েছেন সরকারের মন্ত্রীরা। শোনা যাচ্ছে নতুন নতুন ইন্স্যুরেন্স কোম্পানি খোলার জন্যও লাইসেন্স দেয়া হবে। সন্দেহ নেই যে সরকারের ভেতর মহলের কেউ কেউ আরো বহু কোটি টাকা হাতিয়ে নেবেন সেই সুবাদে।
দুর্নীতি তদন্তে সরকারের অনীহা
সাবেক যোগাযোগমন্ত্রী সৈয়দ আবুল হোসেনের বিরুদ্ধে দুর্নীতির বহু অভিযোগ মিডিয়ায়ও প্রচার হয়েছিল। এমনকি পদ্মা সেতু নির্মাণে দুর্নীতির প্রমাণও দিয়েছে বিশ্বব্যাংক। তখনো আমরা বলেছিলাম, সৈয়দ আবুল হোসেনকে বরখাস্ত করার সাহস সরকারের হবে না। আসলেও হয়নি। একাধিক কারণ আছে তার। দেশে ব্যাপক সন্দেহ আছে, যেকোনো কারণেই হোক ‘ওপরের’ শক্তিশালী সমর্থন আছে আবুল হোসেনের পেছনে। প্রচার-প্রচারণায় কান ঝালাপালা হয়ে যাওয়ার পর তাকে অন্য এমন একটি দফতরের দায়িত্ব দেয়া হয়েছে যেখানে দুর্নীতি করার সুযোগ বেশি বৈ কম নয়। বিশ্বব্যাংক এখন কানাডার একটি নির্মাণ কোম্পানিকে দুর্নীতির দায়ে পদ্মা সেতু নির্মাণের কাজে অযোগ্য ঘোষণা করেছে।
অনেক প্রবাদ আছে চোর ও চুরি সম্বন্ধে। একটা হচ্ছেÑ চোরেরও ধর্ম আছে। আরেকটা চোরে চোরে মাসতুতো ভাই। আসল কথা হচ্ছে, এক চোর অন্য চোরকে ধরিয়ে দেয় না। এবং আগেই বলেছি চোরেরা সাক্ষী-প্রমাণ রেখে চুরি করতে চায় না। আরেকটা প্রবাদÑ চুরি বিদ্যা মহাবিদ্যা যদি না পড়ে ধরা। সুরঞ্জিত সেনগুপ্তের দুর্ভাগ্য। তিনি ধরা পড়ে গিয়ে বিপাকে পড়েছেন বলেই সবার ধারণা।
অত্যন্ত নাটকীয় কিছু ঘটনা ঘটেছে ৯ এপ্রিল দিবাগত শেষ রাতে। চলমান একখানি গাড়ি হঠাৎ করে মোড় নিয়ে পিলখানায় বর্ডার গার্ড বাংলাদেশ (বিজিবি) বাহিনীর সদর দফতরে ঢুকে পড়ে। সেই গাড়ির আরোহীরা ছিলেন গাড়ির মালিক রেলমন্ত্রী সুরঞ্জিত সেনগুপ্তের সহকারী একান্ত সচিব (এপিএস) ওমর ফারুক তালুকদার, বাংলাদেশ রেলের পূর্বাঞ্চলীয় জেনারেল ম্যানেজার ইউসুফ আলী মৃধা আর রেলের নিরাপত্তা বাহিনীর কমান্ডেন্ট এনামুল হক। গাড়ির চালক ছিলেন আজম খান। পিলখানায় ঢুকেই আজম খান নাকি চিৎকার করে বলতে থাকেন গাড়িতে অনেক টাকা আছে। বিজিবির লোকেরা তল্লাশি করে নাকি ৭০ লাখ টাকা পান। এত রাতে তারা কোথায় যাচ্ছিলেন, এ প্রশ্নের জবাবে ড্রাইভার ও যাত্রীরা সবাই বিজিবিকে বলেন যে তারা রেলমন্ত্রীর বাড়িতে যাচ্ছিলেন। পরদিন মিডিয়াকেও তারা একই কথা বলেন। কিন্তু রেলমন্ত্রী সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত পরে দাবি করেন ওই তিনজন যাত্রী আজম খান চালিত গাড়িতে তার বাড়িতে যাচ্ছিলেন না, যাচ্ছিলেন তার একান্ত সচিব ওমর ফারুক তালুকদারের বাড়িতে।
সঠিক চিত্র এখনো পাওয়া যায়নি
অনেক কারণে সেই রাতের ঘটনাবলির একটা স্বচ্ছ চিত্র এখনো পাওয়া যায়নি। জেনারেল ম্যানেজার ইউসুফ আলী মৃধা বলেছিলেন, একটা স্টেশনে (শায়েস্তাগঞ্জ?) ট্রেন থামবে কি না আলোচনার জন্য তিনি রেলমন্ত্রীর বাড়িতে যাচ্ছিলেন। তাহলে গাড়িতে যে বস্তা বস্তা টাকা ছিল তার ব্যাখ্যা কী? একটা কথা তখনো শোনা গিয়েছিল গাড়িতে ৭০ লাখ নয়, চার কোটি ৭০ লাখ টাকা ছিল। অবশিষ্ট চার কোটি টাকা তাহলে গেল কোথায়? চার কোটি ৭০ লাখ অঙ্কটার কিছু প্রাসঙ্গিকতা আছে। মোটামুটি একই সময়ে খবর পাওয়া যায়, সুরঞ্জিতের পুত্র সৌমেন পাঁচ কোটি টাকায় একটা টেলিকম লাইসেন্স কিনেছেন। তার টাকার উৎসই বা কী? আরেকটা প্রশ্ন : ড্রাইভার আজম খান কি টাকার বখরার কারণে পিলখানায় ঢুকে পড়েছিলেন, নাকি দুর্নীতি দমনের নাগরিক দায়িত্ব থেকে যাত্রীদের তিনি বিজিবির হাতে ধরিয়ে দিতে চেয়েছিলেন? শোনা যাচ্ছে আজম খানকে এখন পাওয়া যাচ্ছে না, তার পরিবার তার নিরাপত্তার জন্য উদ্বিগ্ন। কোথায়, কেমন আছেন আজম খান?
গা বাঁচানোর জন্য সুরঞ্জিত সেনগুপ্তের চেষ্টাগুলো প্যাথেটিক। মূল অভিযোগ ছিল তার বিরুদ্ধে। নিজেকে নির্দোষ সাব্যস্ত করতে তিনি দুটো ‘এক ব্যক্তির’ তদন্ত কমিশন গঠন করেছিলেন তারই অধীনস্থ দু’জন কর্মকর্তার অধীনে। এপিএস ফারুক সম্বন্ধে তদন্তের ভার দেয়া হয়েছিল তারই সহকর্মী পিএস (একান্ত সচিব) আখতারুজ্জামানকে। আর জেনারেল ম্যানেজারের বিরুদ্ধে তদন্তের দায়িত্ব দেয়া হয় রেল মন্ত্রণালয়ের যুগ্মসচিব শশী কুমার সিংকে, যিনি মোটামুটি জেনারেল ম্যানেজারের সমমর্যাদার কর্মকর্তা। বর্তমান সরকারের আমলে ‘তদন্ত’ ব্যাপারটাই মূল্যহীন। কোনো তদন্তেই প্রকৃত সত্য উদঘাটিত হয় না।
সাংবাদিক দম্পতি মেহেরুন রুনি আর তার স্বামী সাগরের হত্যার তদন্ত তদারকির ভার নিয়েছিলেন স্বয়ং প্রধানমন্ত্রী। সেই হত্যারও কোনো সুরাহা হয়নি। শোনা গিয়েছিল বিনা টেন্ডারে বিদ্যুৎ উৎপাদনের কন্ট্রাক্টে ব্যাপক দুর্নীতি সম্বন্ধে তারা তদন্ত করছিলেন। আরো শোনা গিয়েছিল যে খুনিদের তাড়াতাড়ি আমেরিকায় পাঠিয়ে দেয়া হয়েছে। বর্তমান সরকারের সাড়ে তিন বছরে দুর্নীতি দমন কমিশন শাসক দলের কাউকে দুর্নীতির দায়ে দোষী সাব্যস্ত করেনি। এ সরকারের আমলে তদন্তের অন্য অর্থ হচ্ছে সময়ক্ষেপণ এবং সত্য উদঘাটন না হওয়া।
সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত পদত্যাগ করতে অস্বীকার করছিলেন। রাতের বেলায় প্রধানমন্ত্রী তাকে তলব করার পরের দিন সংবাদ সম্মেলন ডেকে তিনি পদত্যাগের ঘোষণা দেন। শেখ হাসিনার দুই মেয়াদের প্রধানমন্ত্রিত্বের সময় এই প্রথমবার একজন মন্ত্রী বরখাস্ত হলেন। শেখ হাসিনার অনুগত রাজনীতিক ও লেখকেরা চমৎকৃত হয়েছেন তাতে। সরকারের গৃহপালিত মিডিয়া এই পদত্যাগকে পুঁজি করে সরকার ও প্রধানমন্ত্রীর ইমেজ ঘষামাজা করার কাজে লেগে গেছে। এখানে প্রধানমন্ত্রীর নবজাগ্রত কোনো শুভবুদ্ধির পরিচয় আমি দেখতে পাই না। প্রকৃত ব্যাপার এই, সরকারের মধ্যে দুর্নীতির একটা সিন্ডিকেট আছে। ধারণা করা হয়, সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত ধরা পড়ে গিয়ে গোটা সিন্ডিকেটকেই বিপদগ্রস্ত করেছেন।
গত সাড়ে তিন বছরে রেলওয়ে বিভাগে সাড়ে সাত হাজার জনকে নিয়োগ দেয়া হয়েছে। রেল কর্মচারী, ইউনিয়ন সদস্য ও নেতা এবং চাকরিপ্রার্থীদের অনেকে অভিযোগ করেছেন, প্রতিটি নিয়োগের বেলায় নিয়োগকর্তারা দুই থেকে চার লাখ টাকা ঘুষ নিয়েছেন। এই নিয়োগবাণিজ্যের অভিযোগ তারা কর্তৃপক্ষ ও দুর্নীতি দমন কমিশনে পাঠিয়েছেন। কিন্তু তাতে কোনো ফল হয়নি। কেন হয়নি এখন আর কারো বুঝতে বাকি রইল না।
বিএনপি নেতা ইলিয়াস আলী গুম
মিডিয়ায় এবং অন্যত্র তার পদত্যাগের দাবিকে সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত ‘গণতন্ত্রের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র’ বলে দাবি করেছেন। সুরঞ্জিত বাবু বিরোধী দলের বিরুদ্ধে গা ঘিনঘিন করা দাঁত খিঁচানো ব্যঙ্গ দিয়ে এতকাল শুধু নিজেকেই আমোদিত করছিলেন। তার এই দাবিতে বহু মহলেই বিদ্রƒপের হাসি দেখা দেবে। এ সরকারের কাজে এবং কর্মে সুরঞ্জিত বাবু গণতন্ত্র কোথায় দেখলেন? কোন গণতন্ত্রের কথা বলছেন তিনি? ক্ষমতা পাওয়ার প্রথম দিন থেকে এ সরকার গদি চিরস্থায়ী করার জন্য ফ্যাসিস্ট পন্থায় সব রাজনৈতিক বিরোধিতাকে নির্মূল করার পরিকল্পিত অভিযান শুরু করেছে।
হত্যা, ধরপাকড় এখনো অব্যাহত গতিতে চলছে। জেলখানায় এদের স্থান করার জন্য ফাঁসির দণ্ডপ্রাপ্ত অপরাধীদের মুক্তি দিচ্ছে সরকার। বিচারবহির্ভূত হত্যার সাথে ইদানীং যুক্ত হয়েছে বিরোধীদলীয় নেতাকর্মীদের গুম করে ফেলা। ঢাকার কাউন্সিলর চৌধুরী আলমকে দিয়ে এই গুম করার প্রক্রিয়া শুরু হয়। সর্বশেষ গুম হয়েছেন বিএনপির সংসদ সদস্য, সিলেট জেলা বিএনপির প্রেসিডেন্ট ও বিএনপির সাংগঠনিক সম্পাদক ইলিয়াস আলী। দেশব্যাপী জোর গুজব এবং বিএনপি সরাসরি অভিযোগ করেছে যে সরকারই বিএনপি নেতা ইলিয়াস আলীকে গুম করেছে।
বিরোধী দলকে সভা-সমিতি ও মিছিল করার গণতান্ত্রিক অধিকার থেকে বঞ্চিত করা হচ্ছে। গত ১২ মার্চ বিএনপির আহূত ‘ঢাকা চলো’ কর্মসূচি বানচাল করতে সরকার যা করেছে সেটা রীতিমতো ন্যক্কারজনক। প্রধান বিরোধী দলের সদর দফতরকে কাঁটাতার দিয়ে ঘিরে রাখার দৃষ্টান্ত সম্ভবত নাৎসিরাও দেখাতে পারেনি। প্রশাসন, পুলিশ ও বিচার বিভাগ সম্পূর্ণ দলীয়করণ করা হয়েছে। এই তিনটি বিভাগকে বিরোধী দলের নির্যাতনের কাজে ব্যবহার করা হচ্ছে।
এ সরকারের আমলে যে ক’টি মেয়র নির্বাচন হয়েছে প্রতিটিতে সরকার সমর্থিত প্রার্থীরা শোচনীয়ভাবে পরাজিত হয়েছেন। রাজধানীতে পরাজয়ের গ্লানি এড়ানোর জন্য এখানের মেয়র নির্বাচন সরকার তিন বছর ঠেকিয়ে রেখেছিল। রাজধানীকে দুই টুকরো করে নির্বাচন আবারো পেছানো হয়েছে। তার পরও নির্বাচন কমিশন বিভক্ত ঢাকার নির্বাচনের তফসিল ঘোষণা করেছিল। আসন্ন নির্বাচন আরো তিন মাসের জন্য মুলতবি করেছেন আদালত। স্বয়ং প্রধানমন্ত্রী কটূক্তি করে বিরোধী দলের সংসদে উপস্থিতি অসম্ভব করে তুলেছেন। সুরঞ্জিত স্বয়ং যে ভাষায় বিরোধী দলকে ব্যঙ্গ-বিদ্রƒপ করেছেন সেটাকেও গণতন্ত্রের ভাষা বলা যায় না। এই যদি গণতন্ত্রের সংজ্ঞা হয় তাহলে সেই গণতন্ত্র কোনো সুস্থ বুদ্ধির মানুষের কাম্য হতে পারে না।
ভারতের চাপে সুরঞ্জিত আবার মন্ত্রী
পদত্যাগ করেও মাত্র ৩০ ঘণ্টা পর সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত আবার ক্যাবিনেটে স্থান পেয়েছেন দফতরবিহীন মন্ত্রী হিসেবে। তার পদত্যাগে সরকারের ইমেজ বেড়েছে বলে যেসব পত্রিকা নাচানাচি করছিল তারা এখন কী ব্যাখ্যা দেবে? বরং এটাই মনে হয় যে এ সরকার আপন স্বার্থে আপনজনদের ক্ষমতা-বলয়ের বাইরে যেতে দেবে না। তাহলে সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত কি ইতোমধ্যেই নির্দোষ প্রমাণিত হয়েছেন? সত্যি সত্যি যদি তিনি নির্দোষ হন তাহলে প্রধানমন্ত্রী তাকে পদত্যাগ করতে বাধ্য করেছিলেন কেন?
আসল ব্যাপার সেটা নয়। দেশব্যাপী জোর গুজব সুরঞ্জিতকে আবার মন্ত্রী করা হয়েছে ভারতের চাপে। আমরা আগেও অনেকবার লিখেছি, এ সরকারের আমলে বাংলাদেশে কী ঘটবে না ঘটবে সেটা স্থির হয় দিল্লিতে। আমরা বলেছি এবং বিশ্বব্যাপী আরো অনেকে বলেছেন, একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধে সর্বাধিক তিন লাখ মানুষ মারা গিয়েছিল। বর্তমান সরকার গায়ের জোরে প্রমাণ করতে চায় যে তিন মিলিয়ন, অর্থাৎ ৩০ লাখ নিহত হয়েছিল স্বাধীনতাযুদ্ধে। সঠিক সংখ্যা যা-ই হোক সে যুদ্ধে অজস্র প্রাণহানি হয়েছে। ভারতের অঙ্গুলি তাড়নে পরিচালিত হওয়ার জন্যই কি মুক্তিযোদ্ধারা প্রাণ দিয়েছিলেন?
বাংলাদেশের মানুষ জানে বিনা মেঘে বজ্রপাত কিংবা বিনা আগুনে ধোঁয়া হয় না। তারা এই সরকারকে দুর্নীতিবাজ বলে ভাবতে শিখেছে। তারা ধরে নিয়েছিল যে সুরঞ্জিতের পদত্যাগের ফলে অন্তত একটি ক্ষেত্রে দুর্নীতির প্রমাণ পাওয়া গেল। তাদের বিভ্রান্ত করার জন্যও শ্রী সেনগুপ্তকে আবার মন্ত্রিসভায় অন্তর্ভুক্ত করা প্রয়োজন ছিল। কিন্তু বাংলাদেশের মানুষ এত
বোকা নয়। এত সহজে তাদের সাথে প্রতারণা করা যাবে না।
(লন্ডন, ১৮.০৪.১২)
serajurrahman@btinternet.com
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন