মঙ্গলবার, ৩ এপ্রিল, ২০১২

অনন্য নাম ভূপেন হাজারিকা


Kamallohani-fকামাল লোহানী

মানুষের জন্য মানুষ- সঙ্গীতে নয় কেবল, আদর্শেও তিনি বিশ্বাসী ছিলেন, সেই মহান গণশিল্পী ভূপেন হাজারিকা আজ আর নেই। ৮৬ বছর বয়সে তিনি ভারতের বোম্বে শহরের একটি হাসপাতালে গত ৫ নভেম্বর ২০১১ বৃহস্পতিবার শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেছেন। ভারতের এই মহান শিল্পী ভূপেন হাজারিকা যদিও আসামের মানুষ ছিলেন কিন্তু অহমিয়া ছাড়াও তিনি বাংলা এবং হিন্দিতে অসংখ্য গান করেছেন। তিনি যেমন গায়ক ছিলেন, তেমনি ছিলেন গীতিকার ও সুরকার। সঙ্গীত জগতের এই অসামান্য প্রতিভা ও কৃতিত্বের মানুষটি চলচ্চিত্র নির্মাণ এবং অভিনয়েও সুনাম অর্জন করেছিলেন। ভূপেন হাজারিকা আসাম সাহিত্যসভারও সভাপতি ছিলেন। সাংবাদিকতাও করেছেন বেশ কিছুদিন।
শিল্পী ভূপেন হাজারিকা ১৯২৬ সালের ৮ সেপ্টেম্বর জন্মগ্রহণ করেন। ৮৬ বছর বয়সে মৃত্যুবরণ করলেও জীবনকে মহীয়ান করেছিলেন নানা সৎ ও সাহসী কর্মে নিজেকে সম্পৃক্ত করে। তাঁর দার্শনিক গুরু ও বন্ধু ছিলেন প্রখ্যাত সঙ্গীতকার হেমাঙ্গ বিশ্বাস। তিনি জীবনের মধ্যগগনে যখন, তখন থেকেই প্রগতিশীল রাজনীতির সাথে জড়িত হয়েছিলেন। ভারতে যখন গণনাট্য সংঘ প্রবল প্রতাপে সাধারণ মানুষকে সংঘবদ্ধ করছে, ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে লড়ে যাচ্ছে, সেই স্বাধীনতার লড়াইয়ে যুবক ভূপেনও সামিল হয়েছিলেন তাঁর গান ও লেখার মাধ্যমে। সারা জীবন বাম রাজনীতির অনুসারী হিসেবে দুনিয়ার মুক্তি সংগ্রামী মানুষের প্রতি ছিলেন শ্রদ্ধাশীল।
একাত্তরে আমাদের মুক্তিযুদ্ধকালে আসামের কিছু মানুষ বাঙালির জনযুদ্ধকে সমর্থন জানায় নি বরং বিরোধিতা করতেই দেখেছি। কিন্তু প্রগতিশীল বাম শক্তির দলগুলোর সদস্যরা ছিলেন আমাদের দিকেই। তাই ভূপেন হাজারিকা সেদিন আমাদের সমর্থনেই দাঁড়িয়েছিলেন। ভূপেন হাজারিকা কেবল মানুষকে ভালবাসতেন তাই নয়, সাম্রাজ্যবাদী চক্রান্তে মানুষ হত্যার প্রচন্ড বিরোধী ছিলেন। তাঁর মধ্যে সাম্প্রদায়িকতা কোনোদিন আশ্রয় করতে পারেনি। কিন্তু আন্তর্জাতিক কমিউনিস্ট আন্দোলন বিভক্ত হয়ে গেলে তাঁর এতদিনের আদর্শিক বিশ্বাসে খানিকটা টান পড়ে। কিন্তু মন মানসিকতায় তিনি আদর্শিক পথ ছেড়ে যাননি। কিন্তু ক’বছর আগে আকস্মিকভাবে তাঁকে দেখলাম তিনি হিন্দুত্ববাদী বিজেপি নামের রাজনৈতিক দলে যোগদান করেন। এটা কেন করেছিলেন তা আমরা বলতে না পারলেও তিনি সুধীসমাজে প্রবলভাবে সমালোচিতও হয়েছিলেন। কিছুদিন পরে, যতদূর মনে পড়ে তিনি সেখানে আর থাকেন নি। এই সময় খানিকটা ভুল বোঝাবুঝির সৃষ্টি হয়েছিল। তবে তা কেটে যায়।
অশীতিপর কণ্ঠশিল্পী সেই ১০ বছর বয়সেই গান গাইতে শুরু করেছিলেন। তারপর কোনোদিন তাঁকে পেছন ফিরে তাকাতে হয়নি। জনপ্রিয়তার শীর্ষে উঠেছিলেন ভারতে, বাংলাদেশে, পৃথিবীর প্রায় সর্বত্র। সংস্কৃতি জগতের এক বিস্ময়কর প্রতিভা এই অহমিয়া শিল্পী তাইতো গেয়েছিলেন ‘আমি এক যাযাবর’, ‘দোলা হে দোলা’, ‘মানুষ মানুষের জন্য’, ‘সাগর সঙ্গমে’, ‘প্রতিধ্বনি শুনি’র মতো জনপ্রিয় গান।
শিল্পী তাঁর ছাত্রজীবনেও ছিলেন খ্যাতিমান। ১৯৪৬ সালে বেনারসে হিন্দু বিশ্ববিদ্যালয় থেকে রাষ্ট্রবিজ্ঞানে মাস্টার্স ডিগ্রি লাভ করেন। পিএইচডি করতে যান যুক্তরাষ্ট্রের কলাম্বিয়া ইউনিভার্সিটিতে ১৯৫২ সালে।
ভূপেন হাজারিকা চলচ্চিত্রে অমূল্য অবদানের জন্য দাদাসাহেব ফালকে’ পুরস্কারে ভূষিত হন। তিনি আগেই ‘অসম রত্ন’ হিসেবে পুরস্কৃত হয়েছিলেন। সঙ্গীত নাটক একাডেমি তাঁকে সম্মানিত করেছিল বিভিন্ন ক্ষেত্রে তাঁর অনন্য অবদানের জন্য। শিল্পীকে কতবড় সম্মান দিয়েছিল দেশমাতা, তারই প্রমাণ হলো আসাম রাজ্যের রাজধানী গৌহাটি শহরে ভূপেন হাজারিকার ভাষ্কর্য স্থাপন। ২০০৯ সালে এর আনুষ্ঠানিক উদ্বোধন তিনি নিজেই করেছিলেন।
কবি গীতিকার গণশিল্পী ভূপেন হাজারিকা মুক্তিযুদ্ধোত্তর বাংলাদেশের ছবি ‘সীমানা পেরিয়ে’তে সঙ্গীতকার শেখ সাদী খান যখন আবহ সঙ্গীতের কাজ করছিলেন কলকাতায়, তখন তাঁর অবিস্মরণীয় পরামর্শের কথা শ্রদ্ধাভরে স্মরণ করেছেন। তিনি তো এ বাংলায় এসেছেন বহুবার। ভূপেন হাজারিকা ‘চামেলি মেমসাহেব’ নামের বানীচিত্রের সঙ্গীত পরিচালক হিসেবে শ্রেষ্ঠত্বের পুরস্কার পেয়েছিলেন।
অমর এই শিল্পী দীর্ঘদিন থেকেই নানান জটিল রোগে আক্রান্ত হয়েছিলেন। ইদানীং শ্বাসকষ্ট দেখা দিয়েছিল প্রবলভাবে। মাঝে নিউমোনিয়া হবার পর থেকে শিল্পী অনেকটাই নাজুক হয়ে পড়েছিলেন। তাঁর দু’টো কিডনিই নষ্ট হয়ে গিয়েছিল। তাঁকে ডায়ালাইসিস দেওয়া হয়েছিল। তবে শরীর সাড়া দিচ্ছিল না। টিভি’র স্ক্রিনে দেখাচ্ছিল শিল্পীর অবস্থা আশঙ্কাজনক। তিনি বোম্বের আম্বানী হাসপাতালে বাংলাদেশ সময় বিকাল সাড়ে ৫টায় মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়েন। শেষ হয়ে যায় এক কিংবদন্তীর ইহলোক পরিক্রমা। এখন তিনি অমর হয়ে রইলেন তাঁর প্রিয় ভক্তজন আর সঙ্গীত-সাহিত্য জগতের মাঝে।
কামাল লোহানী: সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব।

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন