রাস্তা থেকে বলছি
॥ এরশাদ মজুমদার ॥
জগৎজুড়ে ভাষার দ্রুত পরিবর্তন হচ্ছে বিজ্ঞান ও কম্পিউটারের কারণে। বিশেষ করে আমাদের মাতৃভাষা বাংলায় খুব সহজে নিত্যনতুন শব্দ প্রবেশ করছে এবং ভাষাকে করছে সমৃদ্ধ। বাংলা ভাষার বিরাট গুণ হচ্ছে, এ ভাষা খুব সহজে বিদেশী শব্দকে নিজের করে নিতে পারে। আমরা জানি, বাংলা ভাষায় বহু বিদেশী শব্দ রয়েছে, যা এখন আমাদের নিজেদের হয়ে গেছে। সবচেয়ে বেশি রয়েছে ফারসি শব্দ। প্রতিদিন আমরা যে শব্দে কথা বলি তার ভেতর হাজার হাজার বিদেশী শব্দ রয়েছে; যা কখনোই আপনার মনে হয়নি বিদেশী। এ দেশে সর্বশেষ বিদেশী শাসক ছিল ইংরেজেরা। ১৯০ বছর এরা ভারতবর্ষকে শাসন করেছে; ফলে আমাদের ভাষায় ইংরেজির প্রভাব খুব বেশি। তবে ইংরেজিকে বিশ্বের লিংগুয়া ফ্রাঙ্কা বলা হয়। ১৯০ বছরে ইংরেজেরা পুরো ভারতবর্ষ, বিশেষ করে বাংলাদেশকে সীমাহীন শোষণ করে লন্ডনকে গড়ে তুলেছে। এ দেশের কোটি কোটি মানুষকে হত্যা করেছে। সেই ইংরেজদের সাথে আমাদের এখনো সুসম্পর্ক। এখনো আমরা অনেক ক্ষেত্রে লন্ডনের কথা শুনি। উইলিয়াম হান্টারের বই পড়লে আমাদের নতুন প্রজন্ম বুঝতে পারবে আমাদের এ দেশটি সুজলা সুফলা শস্য শ্যামলা ছিল। জগতের ধনভাণ্ডার ছিল এখানে। তাই এ দেশে এসেছে আরব, ফরাসি, পর্তুগিজ ও ইংরেজেরা। অন্যরা ব্যবসায় করেছে। কিন' ইংরেজেরা ষড়যন্ত্র করে বাংলাদেশ দখল করে নেয়। পাকিসৱানি শাসকগোষ্ঠী বাংলাদেশকে শোষণ করেছে ২৩ বছর। ফলে বাংলাদেশের বাঙালি মুসলমানেরা অবাঙালি মুসলমানদের থেকে আলাদা হয়ে স্বাধীন বাংলাদেশ গড়ে তোলে। আলোচনার মাধ্যমে টেবিলে বসে এ সমস্যার সমাধান করা যেত। কিন' পাকিসৱানি শাসকগোষ্ঠীর যড়যন্ত্রের ফলে একাত্তরের রক্তক্ষয়ী মুক্তিযুদ্ধ শুরু হয়। ২৩ বছর অবাঙালি মুসলমানেরা বাঙালি মুসলমানদের শোষণ করেছে। এখন মানে ৪০ বছর ধরে একশ্রেণীর রাজনীতিক ও ব্যবসায়ীরা জোট বেঁধে দেশবাসীকে শোষণ করছে। ব্যাংকের কেরানি আজ ব্যাংকের চেয়ারম্যান। অফিসের পিয়ন এখন শিল্প প্রম্নপের মালিক।
আমাদের রাজনীতিতে এখন দু’টি বড় রাজনৈতিক দল। একটির জন্ম হয়েছে মুসলিম লীগ ত্যাগ করে ১৯৪৯ সালে ঢাকার রোজ গার্ডেনে। নতুন দলের নাম ছিল আওয়ামী মুসলিম লীগ। এই নামের সাথে একটি বাংলা শব্দও নেই। আওয়াম মানে জনতা। মুসলিম লীগ ইংরেজি শব্দ। মুসলমান শব্দটিও বাংলা নয়। এটি আরবি শব্দ। লীগ একেবারেই ইংরেজি শব্দ। নতুন দলের সভাপতি হয়েছিলেন আসাম মুসলিম লীগের সভাপতি মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানী। সাধারণ সম্পাদক ছিলেন সামশুল হক। এ দলটি সেকুলার হওয়ার জন্য ১৯৫৫ সালে মুসলিম শব্দ বাদ দিয়ে শুধু আওয়ামী লীগে পরিণত হয়। বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল বা বাংলাদেশ ন্যাশনালিস্ট পার্টির জন্ম হয় ১৯৭৮ সালে জেনারেল জিয়ার নেতৃত্বে। ইংরেজি নামের সংক্ষেপ করেই দলটির নাম হয়েছে বিএনপি। সৃষ্টিলগ্নে বিএনপির মেজর পার্টনার ছিল মওলানা ভাসানীর ন্যাপ। এখনো বিএনপিতে সাবেক ন্যাপ নেতাদের প্রভাব বেশি। মুসলিম লীগসহ আরো বহু ছোটখাটো দলের নেতারা জিয়ার আহ্বানে বিএনপিতে যোগ দেন। বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর তথাকথিত সেকুলার দল ছাড়া বাকি সব দল নিষিদ্ধ ঘোষণা করেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। ফলে দেশে আওয়ামী লীগ ছাড়া তেমন কোনো রাজনৈতিক দল ছিল না। বামপন'ী বলে পরিচিত কিছু নেতা বিভিন্ন দলের ব্যানারে কাজ করতেন। বামপন'ী দল এত বছর পরও সাধারণ মানুষের ভেতর তেমন শিকড় বিস-ার করতে পারেনি। তাদের গলা বড়, মিডিয়া তাদের বড় করে দেখায়। নিজেরা একা ভোটে দাঁড়ালে পাঁচ শ’ থেকে হাজারের বেশি ভোট পায় না। ২০০৮ সালের নির্বাচনে বামপন'ীরা সবাই দলবেঁধে নৌকা মার্কা নিয়ে ভোট করেছে। বর্তমান মন্ত্রিসভায় বামপন'ীদের দল ভারী। সারা দেশে বামপন'ীদের পাঁচ হাজার সমর্থক থাকলেও দল রয়েছে কমপক্ষে ২০টি। কেউ পাঁচ শতাধিক পান না। তবুও আওয়ামী লীগ কেন বামপন'ীদের এত গুরুত্ব দিচ্ছে তা আমার কাছে বোধগম্য নয়। ১৯৭৫ সালে বামপন'ীরা বঙ্গবন্ধুর কাঁধে চড়ে বাকশাল বানিয়েছিল। বাকশাল গঠন করে বঙ্গবন্ধু নিজের দল আওয়ামী লীগসহ সব রাজনৈতিক দল নিষিদ্ধ ঘোষণা করেছিলেন।
সাতচলিস্নশ ও সত্তরের আগে রাজনীতিতে যে ভাষা ব্যবহার হতো, এখন আর তেমন ভাষা নেই। পশ্চিম বাংলার কিংবদনিৱ নেতা জ্যোতি বসু একবার বলেছিলেন, তখনকার রাজনীতিতে নুরুল আমিন ছিলেন সবচেয়ে বিনীত রাজনীতিক। নুরুল আমিন অবিভক্ত বঙ্গদেশের সংসদের স্পিকার ছিলেন। পরে পূর্ব পাকিসৱানের গভর্নর ছিলেন। রাজনৈতিক কারণে বর্তমান বাংলাদেশে তিনি একজন নিন্দিত ব্যক্তি। ব্যক্তিগত জীবনে নুরুল আমিন ছিলেন একজন বিরল সৎ মানুষ। সেই সময়ে আরো অনেক মানুষ ছিলেন যারা ছিলেন খুবই সৎ এবং তাদের আদব কায়দা ছিল খুবই পরিশীলিত। অবিভক্ত বঙ্গদেশের সংসদ বিবরণী পড়লে আমরা জানতে পারব, এরা কী ভাষায় কথা বলতেন। প্রতিপক্ষকে কী ভাষায় আক্রমণ করা হতো তা জানার জন্য ওই সব বিবরণী পড়া অবশ্য কর্তব্য বলে আমি মনে করি। অবিভক্ত বঙ্গদেশে শেরেবাংলা, স্যার নাজিমুদ্দিন ও শহীদ সোহরাওয়ার্দী ছিলেন প্রধানমন্ত্রী। এই তিনজনকেই আমরা কিছুটা দেখেছি। আমাদের আগের জেনারেশন বা মুরুব্বিরা আরো বেশি দেখেছেন। তাদের ভাষা সম্পর্কেও আমাদের কিছু ধারণা আছে। এই তিনজন নেতাই ছিলেন খুবই উচ্চশিক্ষিত বিনয়ী। তাদের আদব কায়দা ছিল খুবই উচ্চমানের। এদের ভেতর মওলানা ভাসানী ছিলেন একটু ব্যতিক্রমধর্মী। মওলানা ভাসানী ছিলেন অতি সাধারণ মানুষের নেতা। কিন' তার সততা ও সাংগঠনিক ক্ষমতা ছিল অপরিসীম। তিনি সাতচলিস্নশের আগে ছিলেন আসাম মুসলিম লীগের সভাপতি। পূর্ব পাকিসৱানে ফিরে মুসলিম লীগ ছেড়ে দিয়ে গড়ে তুলেছিলেন আওয়ামী মুসলিম লীগ। মওলানা ভাসানী অনলবর্ষী বক্তা। পশ্চিমা মিডিয়া তাকে বলত- ‘ফায়ার ইটার’। তিনি ছিলেন ইসলামি সমাজতন্ত্রে বিশ্বাসী। ফলে তাকে আমেরিকা ও রাশিয়া উভয়েই ভুল বুঝত। মওলানা ভাসানীর জামানার সব রাজনীতিকই ভাষা ব্যবহারের ক্ষেত্রে খুবই সাবধান ছিলেন। প্রতিপক্ষকে কখনোই অশালীন ভাষায় আক্রমণ করতেন না। অশালীন কথা না বলা বা ভাষা ব্যবহার না করা ছিল তাদের সংস্কৃতি। তাই তাদের রাজনীতির ভাষা অনুসরণীয় ছিল। বঙ্গবন্ধু ও তার বন্ধুরা ছিলেন রাজনীতিতে শালীন ব্যবহারের শেষ জেনারেশন। সংসদ বা পার্লামেন্টের লাইব্রেরিতে গেলেই এর প্রমাণ পাওয়া যাবে।
১৯৭৩ সালের জাতীয় সংসদে বিরোধী দলের তেমন কোনো সদস্য ছিলেন না। আওয়ামী লীগ সম্ভবত ২৯৩ সিট দখল করতে পেরেছিল। শুনেছি খোন্দকার মোশতাক নির্বাচনে না জিতলেও তাকে নির্বাচিত ঘোষণা করা হয়েছিল। আমলারা ও চামচারা বঙ্গবন্ধুকে বুঝিয়েছিলেন একটি সিটও বিরোধী দলকে দেয়া যাবে না। কারণ, বিরোধী দল জিতলে বঙ্গবন্ধুর জনপ্রিয়তা নিয়ে প্রশ্ন উঠতে পারে। লোকে বলবে, ‘জাতির পিতার দলের জনপ্রিয়তা কমে গেছে’। বঙ্গবন্ধু আমলা ও চামচাদের কথায় সায় দিয়েছিলেন। কিন' ১৯৭৫ সালের পর সবাই তার দিক থেকে মুখ ফিরিয়ে নিয়েছিল। ওই সংসদেও ভাষা ব্যবহারের ক্ষেত্রে একটা সীমা ও শালীনতা ছিল। ১৯৭৯ সালের সংসদে আওয়ামী লীগসহ অন্যদের বেশ কিছু সিট ছিল। সেই সংসদে বিরোধী দলের নেতা ছিলেন আওয়ামী লীগের আসাদুজ্জামান। তিনি ছিলেন খুবই একজন পরিশীলিত মানুষ। সেই সংসদে আতাউর রহমান খান ও খুলনার সবুর খান ছিলেন। বেশ কয়েকজন নামী-দামি রাজনীতিক ওই সংসদের সদস্য ছিলেন। আতাউর রহমান ১৯৫৫ সালে পূর্ব পাকিসৱানের চিফ মিনিস্টার ছিলেন। আইয়ুবের আমলে সবুর খান ছিলেন সংসদের নেতা। ১৯৭৯ সালের জাতীয় সংসদের নেতা ছিলেন শাহ আজিজ। মেনন ও শাজাহান সিরাজ প্রথমবার সংসদে নির্বাচিত হয়েছিলেন। সেই সংসদেও ভাষার ব্যবহার ছিল শিক্ষণীয়। সত্যি কথা হলো, রাজনীতিতে ভাষার পতন শুরু হয়েছে বেশ কয়েক যুগ হলো। রাসৱার ভাষা আর সংসদের ভাষা যে এক নয়, তা এখনকার নির্বাচিত প্রতিনিধিরা জানেন না। এখন তো লেখাপড়া না জানলেও সংসদ সদস্য হওয়া যায়। যারা স্কুল-কলেজ পাস করেছেন, তারাও পেশিশক্তিতে বিশ্বাস করেন। শক্তিই এখন ক্ষমতার উৎস। তাই স্কুল-কলেজের সার্টিফিকেট পাওয়া মাসৱানরাই রাজনীতি করবে এবং ক্ষমতায় যাবে। রাষ্ট্রপতি সাহাবুদ্দীন একবার বলেছিলেন, ছাত্ররা আর লেখাপড়া করবে না; কারণ লেখাপড়া না করেই মন্ত্রী হওয়া যায়। এখন ধনী ব্যবসায়ীরাই সংসদ দখল করে রেখেছেন। এখন নাকি জাতীয় সংসদের সদস্য হতে গেলে খুব কম করে হলেও চার-পাঁচ কোটি টাকা লাগে। বাংলাদেশে কোনো ভদ্রলোকের পক্ষেই নির্বাচনে অংশ নেয়া সম্ভব হবে না। সত্তরের আগে ছাত্র রাজনীতিতে ভালো ছাত্ররা আসতেন। এমনকি দুটো ফার্স্ট ডিভিশন না থাকলে কোনো ছাত্র হল নির্বাচনে নমিনেশন পেতেন না। এ অবস'ার পতন হতে শুরু করেছে আইয়ুব আমল থেকে। আইয়ুব খান ও মোনেম খান ছাত্র রাজনীতিতে লাঠিসোটা, সাইকেল চেইন, সাপ, হকিস্টিক আমদানি করেছেন। তবে এর বিসৱৃতি বেশি ছিল না। এখন পিসৱল বন্দুক, দা, ছুরি, রামদা, লগি-বৈঠা নিয়ে দেশের রাজনীতি বেশ সামনের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে। সাম্প্রতিককালের টিভি আর পত্রিকার ছবি দেখলেই দেশবাসী বুঝতে পারেন আমাদের রাজনীতির ভাষা এখন অস্ত্রের ভাষায় পরিণত হয়েছে। লগি-বৈঠা আওয়ামী লীগের ব্র্যান্ড নৌকার সরঞ্জাম। এগুলো না হলে নৌকা চলে না। বঙ্গবন্ধুর কন্যা শেখ হাসিনা লগি-বৈঠার শ্রেষ্ঠ ব্যবহার করেছেন ২০০৬ সালের ২৮ অক্টোবর। লগি আর বৈঠার আঘাতে দেশের মূল্যবান কয়েকটি জীবন নষ্ট হয়েছে।
অস্ত্রের ভাষার কথা আমরা প্রথম শুনেছি জেনারেল আইয়ুবের মুখে। যদিও ছাত্রদের ভেতর অস্ত্রের ব্যবহার প্রথম শুরু করেছিলেন জেনারেল আইয়ুব স্বয়ং। আগেই বলেছি, এখন ছাত্র বা রাজনৈতিক কর্মীরা লাঠিসোটা আর হকিস্টিক ব্যবহার করেন না। স্বাধীনতার পর বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রথম সাত খুন হয় অটোমেটিক অস্ত্র দিয়ে। তখন ছাত্রলীগের এক গ্রম্নপ আরেক গ্রম্নপকে হত্যা করেছে অস্ত্র দিয়ে। এখনো আমরা মাঝে মধ্যে শুনতে পাই অস্ত্র জমা দিয়েছি কিন' ট্রেনিং জমা দিইনি। রাজনীতির কারণে এখন আমরা নানা মাত্রায়, নানা ডাইমেনশনে মুক্তিযুদ্ধকে দেখতে পাই। মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে রাজনীতি করতে করতে এখন দেখা যাচ্ছে চার-পাঁচ বছরের ছেলেমেয়েরাও মুক্তিযুদ্ধে অংশ নিয়েছে। চার-পাঁচ বছরের সেই শিশুর বয়স এখন ৪০ থেকে ৪৫ বছর। টিভিতে ইন্টারভিউ দিয়ে বলছে, আমি আমার বাবা বা দাদাকে লাঠি হাতে প্যারেড করতে দেখেছি। আমি দাদাকে পানি পান করিয়েছি। সম্মানিত কবীর চৌধুরী বলেছিলেন, এখন শুধু মুক্তিযুদ্ধের চেতনা থাকলেই চলবে। কিন' দেশবাসী আজো জানেন না মুক্তিযুদ্ধের চেতনাটা কী? আমাদের প্রধানমন্ত্রী প্রায়ই নানা ধরনের চেতনার কথা বলে থাকেন। স্বাধীনতার চেতনা, মুক্তিযুদ্ধের চেতনা আর একুশের চেতনা। আমি তো দেখছি এ চেতনার নানা মাত্রা বা ডাইমেনশন আছে। এ নিয়ে আওয়ামী লীগের চেতনা এক রকম আর আমার চেতনা আরেক রকম। বিএনপি বা সমমনা দলগুলো ভাবে অন্য রকম আর ভারত ভাবে আরো অন্য রকম।
হানাদার পাকিসৱান বাহিনীর অতর্কিত আক্রমণে প্রায় এক কোটি লোক দেশ ছেড়ে ভারতে চলে যায়। এই এক কোটি লোকের ৯০ শতাংশই সংখ্যালঘু সম্প্রদায়। ১০ ভাগ ছিলেন সংখ্যাগুরু সম্প্রদায়। স্বাধীনতার জন্য যুদ্ধ করেছেন বাঙালি সৈনিক, ইপিআর, আনসার ও পুলিশ। মুক্তিযুদ্ধের ট্রেনিং নিয়েছেন এ দেশের ছাত্র-জনতা। এদের ৯০ শতাংশই মুসলমান বা সংখ্যাগুরু সম্প্রদায়। যাদের জন্য স্বাধীনতা অপরিহার্য হয়ে উঠেছিল, তারা সবাই ছিলেন বাঙালি মুসলমান। এককালে তারাই চেয়েছিলেন পাকিসৱান। পাকিসৱানিদের জুলুম-নির্যাতনেই বাঙালি মুসলমানেরা বাধ্য হয়েই স্বাধীনতার দাবি তুলেছেন আর জান কুরবান করে মুক্তিযুদ্ধ করেছেন। সরাসরি মুক্তিযুদ্ধে সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের অংশগ্রহণ ছিল খুবই নগণ্য। এ কথা সত্য, মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে এরা নির্যাতিত হয়েছেন বেশি। একইভাবে সদা ভীতসন্ত্রসৱ ছিলেন এ দেশে থেকে যাওয়া সাড়ে ছয় কোটি মানুষ। এদের নিয়ে ১৯৭২ সালে ইংরেজি সাপ্তাহিক হলিডে লিখেছিল- ‘সিক্সটিফাইভ মিলিয়ন কোলাবোরেটরস’। তখন বঙ্গবন্ধু ও তার ভক্তদের হুঁশ এসেছিল যে, দেশের সাড়ে ছয় কোটি লোককে কোলাবোরেটর বানিয়ে দেশ চালানো যাবে না। আগেই বলেছি, কলকাতা বা বাংলাদেশ সীমানেৱর আশপাশের ভারতীয় রাজ্য ও জেলাগুলোতে আশ্রয় নিয়েছিলেন হিন্দু সম্প্রদায়ের লোকজন। এ কথা সত্য, সেই সময়ে হিন্দু সম্প্রদায়ের লোকেরা বেশি অত্যাচারিত হয়েছিলেন। এমনকি প্রতিবেশী অনেক মুসলমানও তাদের ওপর অত্যাচার করেছে। নামজাদা আওয়ামী নেতাদের অনেকেই ছিলেন কলকাতা শহরে। আওয়ামী লীগের প্রথম সারির নেতাদের এক ভাগও সরাসরি সশস্ত্র মুক্তিযুদ্ধে অংশ নেননি। তারা বক্তৃতা-বিবৃতি ও রাজনৈতিক লবিতে অংশ নিয়েছেন। সাংবাদিক, বুদ্ধিজীবীরাও তাই করেছেন। সীমানেৱ বা দেশের ভেতর প্রবেশ করে অস্ত্র নিয়ে যুদ্ধ করেছেন ছাত্র, যুবক, শ্রমিক, কৃষক ভাইয়েরা। তাদের নেতৃত্ব দিয়েছেন সেনাবাহিনীর অফিসার, জওয়ান, পুলিশ, ইপিআর ও আনসার বাহিনীর দেশপ্রেমিক শক্তি। বলা হয়ে থাকে, মুক্তিযুদ্ধে ৩০ লাখ লোক শহীদ হয়েছেন। যদিও এ সংখ্যা নিয়ে নানা জনে নানা মত প্রকাশ করছেন। তবুও এ সংখ্যাকে যদি সঠিক ধরে নিই তাহলে আওয়ামী লীগের নেতৃস'ানীয় এক ভাগ লোকও শহীদ হননি। কয়েকটি ডানপন'ী ও ইসলামি দল ছাড়া সব রাজনৈতিক দলই মুক্তিযুদ্ধে অংশ নিয়েছে। রাজনৈতিক কারণে ও ভারত সরকারের প্রভাবে আওয়ামী লীগ প্রবাসী সরকার গঠন করে ও নেতৃত্ব দেয়। যা হোক, এসব হলো প্রাসঙ্গিক কথা।
মাসখানেক ধরে রাজনীতির ভাষা নিয়ে পত্রিকা ও রাজনীতির মাঠ বেশ গরম। আমাদের প্রধানমন্ত্রীর ভাষা সব সময়েই একটু ব্যতিক্রমধর্মী। তিনি শালীন ও পরিশীলিত ভাষায় কথা বলতে হয়তো পারেন না। এখন সবাই ধরে নিয়েছেন যে প্রধানমন্ত্রী ও আওয়ামী নেত্রী ওভাবেই কথা বলেন এবং তিনি যা বলেন তা হয়তো তার অনৱরের কথা নয়। এর আগে আদালতও তাকে ‘রং হেডেড’ বলে আখ্যায়িত করেছেন। আওয়ামী লীগের অনেক নেতাই বলে থাকেন, নেত্রী যদি কম কথা বলতেন তাহলে দলের মঙ্গল হতো। কথা বলার ব্যাপারে নেত্রীর আদর্শকে অনুসরণ করে বেশ কয়েকজন মন্ত্রী ইতোমধ্যেই চ্যাম্পিয়নশিপ লাভ করেছেন। কেউ কেউ বলেন, ওভাবে কথা বললে প্রধানমন্ত্রী খুশি হন। ইদানীং এ ভাষার প্রভাব আদালত ও সংসদে বিস-ৃতি লাভ করেছে। আদালত কথায় কথায় প্রতিদিনই কাউকে না কাউকে পাকিসৱান পাঠানোর পরামর্শ দিচ্ছেন। সাংবাদিক সাগর-রুনির হত্যার ব্যাপারে সংবাদ পরিবেশনের ব্যাপারেও আদালত কথা বলেছেন; কিন' সাংবাদিকেরা বলেছেন, তারা আদালতের এই পরোক্ষ সেন্সরশিপ মানেন না। কিছু দিন থেকে আদালত এভাবে কথা বলে চলেছেন। সাংবাদিক সৈয়দ আবুল মাকসুদকেও আদালত হুমকি-ধমকি দিয়েছেন।
রাজনীতির অশালীন ভাষা এখন সংসদে ঢুকে পড়েছে। কেউ কেউ বলছেন, নিষিদ্ধ পলস্নীর ভাষা সংসদে ঢুকে পড়েছে। স্পিকার নিজেই এতে বিব্রত বোধ করছেন। বিষয়টির সূত্রপাত হয়েছে প্রধানমন্ত্রীর ভাষা নিয়ে আলোচনা করতে গিয়ে বিরোধীদলীয় কয়েকজন সদস্য নাকি নিয়মনীতি ভঙ্গ করেছেন। বিরোধীদলীয় চিফ হুইপ বলেছেন, এ ভাষা চালু করেছেন প্রধানমন্ত্রী ও তার দলীয় নেতারা। বিরোধীদলীয় সদস্যদের ভাষায় ক্ষুব্ধ হয়ে মোহাম্মদ নাসিম তাদের সদস্যপদ বাতিলের কথা বলেছেন। এখন আওয়ামী লীগ নেতাদের মধ্যে মাতম উঠেছে ভাষা নিয়ে। এত দিন তাদের ধারণা ছিল অশালীন ভাষা ব্যবহারের অধিকার তাদের একচেটিয়া। খালেদা জিয়ার সমস্যা তিনি ওই ভাষায় কথা বলতে পারেন না। এমনকি তার দলের ভারপ্রাপ্ত সেক্রেটারিও ওই ভাষা রপ্ত করতে পারেননি এখনো। রাজনীতিতে অশালীন ভাষার ব্যবহার ও প্রতিপক্ষকে অশ্রাব্য ভাষায় আক্রমণ করার যে রেওয়াজ চালু হয়েছে তা অবশ্যই অবিলম্বে বন্ধ হওয়া দরকার। আমার তো মনে হয় আওয়ামী লীগ শালীন ভাষায় ফিরে এলে সমস্যার সমাধান হয়ে যাবে। বিএনপির নেতা ও কর্মীদের এ অশালীন ভাষা আর শিখতে হবে না।
লেখক : কবি ও সাংবাদিক
ershadmz40@yahoo.com
জগৎজুড়ে ভাষার দ্রুত পরিবর্তন হচ্ছে বিজ্ঞান ও কম্পিউটারের কারণে। বিশেষ করে আমাদের মাতৃভাষা বাংলায় খুব সহজে নিত্যনতুন শব্দ প্রবেশ করছে এবং ভাষাকে করছে সমৃদ্ধ। বাংলা ভাষার বিরাট গুণ হচ্ছে, এ ভাষা খুব সহজে বিদেশী শব্দকে নিজের করে নিতে পারে। আমরা জানি, বাংলা ভাষায় বহু বিদেশী শব্দ রয়েছে, যা এখন আমাদের নিজেদের হয়ে গেছে। সবচেয়ে বেশি রয়েছে ফারসি শব্দ। প্রতিদিন আমরা যে শব্দে কথা বলি তার ভেতর হাজার হাজার বিদেশী শব্দ রয়েছে; যা কখনোই আপনার মনে হয়নি বিদেশী। এ দেশে সর্বশেষ বিদেশী শাসক ছিল ইংরেজেরা। ১৯০ বছর এরা ভারতবর্ষকে শাসন করেছে; ফলে আমাদের ভাষায় ইংরেজির প্রভাব খুব বেশি। তবে ইংরেজিকে বিশ্বের লিংগুয়া ফ্রাঙ্কা বলা হয়। ১৯০ বছরে ইংরেজেরা পুরো ভারতবর্ষ, বিশেষ করে বাংলাদেশকে সীমাহীন শোষণ করে লন্ডনকে গড়ে তুলেছে। এ দেশের কোটি কোটি মানুষকে হত্যা করেছে। সেই ইংরেজদের সাথে আমাদের এখনো সুসম্পর্ক। এখনো আমরা অনেক ক্ষেত্রে লন্ডনের কথা শুনি। উইলিয়াম হান্টারের বই পড়লে আমাদের নতুন প্রজন্ম বুঝতে পারবে আমাদের এ দেশটি সুজলা সুফলা শস্য শ্যামলা ছিল। জগতের ধনভাণ্ডার ছিল এখানে। তাই এ দেশে এসেছে আরব, ফরাসি, পর্তুগিজ ও ইংরেজেরা। অন্যরা ব্যবসায় করেছে। কিন' ইংরেজেরা ষড়যন্ত্র করে বাংলাদেশ দখল করে নেয়। পাকিসৱানি শাসকগোষ্ঠী বাংলাদেশকে শোষণ করেছে ২৩ বছর। ফলে বাংলাদেশের বাঙালি মুসলমানেরা অবাঙালি মুসলমানদের থেকে আলাদা হয়ে স্বাধীন বাংলাদেশ গড়ে তোলে। আলোচনার মাধ্যমে টেবিলে বসে এ সমস্যার সমাধান করা যেত। কিন' পাকিসৱানি শাসকগোষ্ঠীর যড়যন্ত্রের ফলে একাত্তরের রক্তক্ষয়ী মুক্তিযুদ্ধ শুরু হয়। ২৩ বছর অবাঙালি মুসলমানেরা বাঙালি মুসলমানদের শোষণ করেছে। এখন মানে ৪০ বছর ধরে একশ্রেণীর রাজনীতিক ও ব্যবসায়ীরা জোট বেঁধে দেশবাসীকে শোষণ করছে। ব্যাংকের কেরানি আজ ব্যাংকের চেয়ারম্যান। অফিসের পিয়ন এখন শিল্প প্রম্নপের মালিক।
আমাদের রাজনীতিতে এখন দু’টি বড় রাজনৈতিক দল। একটির জন্ম হয়েছে মুসলিম লীগ ত্যাগ করে ১৯৪৯ সালে ঢাকার রোজ গার্ডেনে। নতুন দলের নাম ছিল আওয়ামী মুসলিম লীগ। এই নামের সাথে একটি বাংলা শব্দও নেই। আওয়াম মানে জনতা। মুসলিম লীগ ইংরেজি শব্দ। মুসলমান শব্দটিও বাংলা নয়। এটি আরবি শব্দ। লীগ একেবারেই ইংরেজি শব্দ। নতুন দলের সভাপতি হয়েছিলেন আসাম মুসলিম লীগের সভাপতি মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানী। সাধারণ সম্পাদক ছিলেন সামশুল হক। এ দলটি সেকুলার হওয়ার জন্য ১৯৫৫ সালে মুসলিম শব্দ বাদ দিয়ে শুধু আওয়ামী লীগে পরিণত হয়। বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল বা বাংলাদেশ ন্যাশনালিস্ট পার্টির জন্ম হয় ১৯৭৮ সালে জেনারেল জিয়ার নেতৃত্বে। ইংরেজি নামের সংক্ষেপ করেই দলটির নাম হয়েছে বিএনপি। সৃষ্টিলগ্নে বিএনপির মেজর পার্টনার ছিল মওলানা ভাসানীর ন্যাপ। এখনো বিএনপিতে সাবেক ন্যাপ নেতাদের প্রভাব বেশি। মুসলিম লীগসহ আরো বহু ছোটখাটো দলের নেতারা জিয়ার আহ্বানে বিএনপিতে যোগ দেন। বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর তথাকথিত সেকুলার দল ছাড়া বাকি সব দল নিষিদ্ধ ঘোষণা করেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। ফলে দেশে আওয়ামী লীগ ছাড়া তেমন কোনো রাজনৈতিক দল ছিল না। বামপন'ী বলে পরিচিত কিছু নেতা বিভিন্ন দলের ব্যানারে কাজ করতেন। বামপন'ী দল এত বছর পরও সাধারণ মানুষের ভেতর তেমন শিকড় বিস-ার করতে পারেনি। তাদের গলা বড়, মিডিয়া তাদের বড় করে দেখায়। নিজেরা একা ভোটে দাঁড়ালে পাঁচ শ’ থেকে হাজারের বেশি ভোট পায় না। ২০০৮ সালের নির্বাচনে বামপন'ীরা সবাই দলবেঁধে নৌকা মার্কা নিয়ে ভোট করেছে। বর্তমান মন্ত্রিসভায় বামপন'ীদের দল ভারী। সারা দেশে বামপন'ীদের পাঁচ হাজার সমর্থক থাকলেও দল রয়েছে কমপক্ষে ২০টি। কেউ পাঁচ শতাধিক পান না। তবুও আওয়ামী লীগ কেন বামপন'ীদের এত গুরুত্ব দিচ্ছে তা আমার কাছে বোধগম্য নয়। ১৯৭৫ সালে বামপন'ীরা বঙ্গবন্ধুর কাঁধে চড়ে বাকশাল বানিয়েছিল। বাকশাল গঠন করে বঙ্গবন্ধু নিজের দল আওয়ামী লীগসহ সব রাজনৈতিক দল নিষিদ্ধ ঘোষণা করেছিলেন।
সাতচলিস্নশ ও সত্তরের আগে রাজনীতিতে যে ভাষা ব্যবহার হতো, এখন আর তেমন ভাষা নেই। পশ্চিম বাংলার কিংবদনিৱ নেতা জ্যোতি বসু একবার বলেছিলেন, তখনকার রাজনীতিতে নুরুল আমিন ছিলেন সবচেয়ে বিনীত রাজনীতিক। নুরুল আমিন অবিভক্ত বঙ্গদেশের সংসদের স্পিকার ছিলেন। পরে পূর্ব পাকিসৱানের গভর্নর ছিলেন। রাজনৈতিক কারণে বর্তমান বাংলাদেশে তিনি একজন নিন্দিত ব্যক্তি। ব্যক্তিগত জীবনে নুরুল আমিন ছিলেন একজন বিরল সৎ মানুষ। সেই সময়ে আরো অনেক মানুষ ছিলেন যারা ছিলেন খুবই সৎ এবং তাদের আদব কায়দা ছিল খুবই পরিশীলিত। অবিভক্ত বঙ্গদেশের সংসদ বিবরণী পড়লে আমরা জানতে পারব, এরা কী ভাষায় কথা বলতেন। প্রতিপক্ষকে কী ভাষায় আক্রমণ করা হতো তা জানার জন্য ওই সব বিবরণী পড়া অবশ্য কর্তব্য বলে আমি মনে করি। অবিভক্ত বঙ্গদেশে শেরেবাংলা, স্যার নাজিমুদ্দিন ও শহীদ সোহরাওয়ার্দী ছিলেন প্রধানমন্ত্রী। এই তিনজনকেই আমরা কিছুটা দেখেছি। আমাদের আগের জেনারেশন বা মুরুব্বিরা আরো বেশি দেখেছেন। তাদের ভাষা সম্পর্কেও আমাদের কিছু ধারণা আছে। এই তিনজন নেতাই ছিলেন খুবই উচ্চশিক্ষিত বিনয়ী। তাদের আদব কায়দা ছিল খুবই উচ্চমানের। এদের ভেতর মওলানা ভাসানী ছিলেন একটু ব্যতিক্রমধর্মী। মওলানা ভাসানী ছিলেন অতি সাধারণ মানুষের নেতা। কিন' তার সততা ও সাংগঠনিক ক্ষমতা ছিল অপরিসীম। তিনি সাতচলিস্নশের আগে ছিলেন আসাম মুসলিম লীগের সভাপতি। পূর্ব পাকিসৱানে ফিরে মুসলিম লীগ ছেড়ে দিয়ে গড়ে তুলেছিলেন আওয়ামী মুসলিম লীগ। মওলানা ভাসানী অনলবর্ষী বক্তা। পশ্চিমা মিডিয়া তাকে বলত- ‘ফায়ার ইটার’। তিনি ছিলেন ইসলামি সমাজতন্ত্রে বিশ্বাসী। ফলে তাকে আমেরিকা ও রাশিয়া উভয়েই ভুল বুঝত। মওলানা ভাসানীর জামানার সব রাজনীতিকই ভাষা ব্যবহারের ক্ষেত্রে খুবই সাবধান ছিলেন। প্রতিপক্ষকে কখনোই অশালীন ভাষায় আক্রমণ করতেন না। অশালীন কথা না বলা বা ভাষা ব্যবহার না করা ছিল তাদের সংস্কৃতি। তাই তাদের রাজনীতির ভাষা অনুসরণীয় ছিল। বঙ্গবন্ধু ও তার বন্ধুরা ছিলেন রাজনীতিতে শালীন ব্যবহারের শেষ জেনারেশন। সংসদ বা পার্লামেন্টের লাইব্রেরিতে গেলেই এর প্রমাণ পাওয়া যাবে।
১৯৭৩ সালের জাতীয় সংসদে বিরোধী দলের তেমন কোনো সদস্য ছিলেন না। আওয়ামী লীগ সম্ভবত ২৯৩ সিট দখল করতে পেরেছিল। শুনেছি খোন্দকার মোশতাক নির্বাচনে না জিতলেও তাকে নির্বাচিত ঘোষণা করা হয়েছিল। আমলারা ও চামচারা বঙ্গবন্ধুকে বুঝিয়েছিলেন একটি সিটও বিরোধী দলকে দেয়া যাবে না। কারণ, বিরোধী দল জিতলে বঙ্গবন্ধুর জনপ্রিয়তা নিয়ে প্রশ্ন উঠতে পারে। লোকে বলবে, ‘জাতির পিতার দলের জনপ্রিয়তা কমে গেছে’। বঙ্গবন্ধু আমলা ও চামচাদের কথায় সায় দিয়েছিলেন। কিন' ১৯৭৫ সালের পর সবাই তার দিক থেকে মুখ ফিরিয়ে নিয়েছিল। ওই সংসদেও ভাষা ব্যবহারের ক্ষেত্রে একটা সীমা ও শালীনতা ছিল। ১৯৭৯ সালের সংসদে আওয়ামী লীগসহ অন্যদের বেশ কিছু সিট ছিল। সেই সংসদে বিরোধী দলের নেতা ছিলেন আওয়ামী লীগের আসাদুজ্জামান। তিনি ছিলেন খুবই একজন পরিশীলিত মানুষ। সেই সংসদে আতাউর রহমান খান ও খুলনার সবুর খান ছিলেন। বেশ কয়েকজন নামী-দামি রাজনীতিক ওই সংসদের সদস্য ছিলেন। আতাউর রহমান ১৯৫৫ সালে পূর্ব পাকিসৱানের চিফ মিনিস্টার ছিলেন। আইয়ুবের আমলে সবুর খান ছিলেন সংসদের নেতা। ১৯৭৯ সালের জাতীয় সংসদের নেতা ছিলেন শাহ আজিজ। মেনন ও শাজাহান সিরাজ প্রথমবার সংসদে নির্বাচিত হয়েছিলেন। সেই সংসদেও ভাষার ব্যবহার ছিল শিক্ষণীয়। সত্যি কথা হলো, রাজনীতিতে ভাষার পতন শুরু হয়েছে বেশ কয়েক যুগ হলো। রাসৱার ভাষা আর সংসদের ভাষা যে এক নয়, তা এখনকার নির্বাচিত প্রতিনিধিরা জানেন না। এখন তো লেখাপড়া না জানলেও সংসদ সদস্য হওয়া যায়। যারা স্কুল-কলেজ পাস করেছেন, তারাও পেশিশক্তিতে বিশ্বাস করেন। শক্তিই এখন ক্ষমতার উৎস। তাই স্কুল-কলেজের সার্টিফিকেট পাওয়া মাসৱানরাই রাজনীতি করবে এবং ক্ষমতায় যাবে। রাষ্ট্রপতি সাহাবুদ্দীন একবার বলেছিলেন, ছাত্ররা আর লেখাপড়া করবে না; কারণ লেখাপড়া না করেই মন্ত্রী হওয়া যায়। এখন ধনী ব্যবসায়ীরাই সংসদ দখল করে রেখেছেন। এখন নাকি জাতীয় সংসদের সদস্য হতে গেলে খুব কম করে হলেও চার-পাঁচ কোটি টাকা লাগে। বাংলাদেশে কোনো ভদ্রলোকের পক্ষেই নির্বাচনে অংশ নেয়া সম্ভব হবে না। সত্তরের আগে ছাত্র রাজনীতিতে ভালো ছাত্ররা আসতেন। এমনকি দুটো ফার্স্ট ডিভিশন না থাকলে কোনো ছাত্র হল নির্বাচনে নমিনেশন পেতেন না। এ অবস'ার পতন হতে শুরু করেছে আইয়ুব আমল থেকে। আইয়ুব খান ও মোনেম খান ছাত্র রাজনীতিতে লাঠিসোটা, সাইকেল চেইন, সাপ, হকিস্টিক আমদানি করেছেন। তবে এর বিসৱৃতি বেশি ছিল না। এখন পিসৱল বন্দুক, দা, ছুরি, রামদা, লগি-বৈঠা নিয়ে দেশের রাজনীতি বেশ সামনের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে। সাম্প্রতিককালের টিভি আর পত্রিকার ছবি দেখলেই দেশবাসী বুঝতে পারেন আমাদের রাজনীতির ভাষা এখন অস্ত্রের ভাষায় পরিণত হয়েছে। লগি-বৈঠা আওয়ামী লীগের ব্র্যান্ড নৌকার সরঞ্জাম। এগুলো না হলে নৌকা চলে না। বঙ্গবন্ধুর কন্যা শেখ হাসিনা লগি-বৈঠার শ্রেষ্ঠ ব্যবহার করেছেন ২০০৬ সালের ২৮ অক্টোবর। লগি আর বৈঠার আঘাতে দেশের মূল্যবান কয়েকটি জীবন নষ্ট হয়েছে।
অস্ত্রের ভাষার কথা আমরা প্রথম শুনেছি জেনারেল আইয়ুবের মুখে। যদিও ছাত্রদের ভেতর অস্ত্রের ব্যবহার প্রথম শুরু করেছিলেন জেনারেল আইয়ুব স্বয়ং। আগেই বলেছি, এখন ছাত্র বা রাজনৈতিক কর্মীরা লাঠিসোটা আর হকিস্টিক ব্যবহার করেন না। স্বাধীনতার পর বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রথম সাত খুন হয় অটোমেটিক অস্ত্র দিয়ে। তখন ছাত্রলীগের এক গ্রম্নপ আরেক গ্রম্নপকে হত্যা করেছে অস্ত্র দিয়ে। এখনো আমরা মাঝে মধ্যে শুনতে পাই অস্ত্র জমা দিয়েছি কিন' ট্রেনিং জমা দিইনি। রাজনীতির কারণে এখন আমরা নানা মাত্রায়, নানা ডাইমেনশনে মুক্তিযুদ্ধকে দেখতে পাই। মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে রাজনীতি করতে করতে এখন দেখা যাচ্ছে চার-পাঁচ বছরের ছেলেমেয়েরাও মুক্তিযুদ্ধে অংশ নিয়েছে। চার-পাঁচ বছরের সেই শিশুর বয়স এখন ৪০ থেকে ৪৫ বছর। টিভিতে ইন্টারভিউ দিয়ে বলছে, আমি আমার বাবা বা দাদাকে লাঠি হাতে প্যারেড করতে দেখেছি। আমি দাদাকে পানি পান করিয়েছি। সম্মানিত কবীর চৌধুরী বলেছিলেন, এখন শুধু মুক্তিযুদ্ধের চেতনা থাকলেই চলবে। কিন' দেশবাসী আজো জানেন না মুক্তিযুদ্ধের চেতনাটা কী? আমাদের প্রধানমন্ত্রী প্রায়ই নানা ধরনের চেতনার কথা বলে থাকেন। স্বাধীনতার চেতনা, মুক্তিযুদ্ধের চেতনা আর একুশের চেতনা। আমি তো দেখছি এ চেতনার নানা মাত্রা বা ডাইমেনশন আছে। এ নিয়ে আওয়ামী লীগের চেতনা এক রকম আর আমার চেতনা আরেক রকম। বিএনপি বা সমমনা দলগুলো ভাবে অন্য রকম আর ভারত ভাবে আরো অন্য রকম।
হানাদার পাকিসৱান বাহিনীর অতর্কিত আক্রমণে প্রায় এক কোটি লোক দেশ ছেড়ে ভারতে চলে যায়। এই এক কোটি লোকের ৯০ শতাংশই সংখ্যালঘু সম্প্রদায়। ১০ ভাগ ছিলেন সংখ্যাগুরু সম্প্রদায়। স্বাধীনতার জন্য যুদ্ধ করেছেন বাঙালি সৈনিক, ইপিআর, আনসার ও পুলিশ। মুক্তিযুদ্ধের ট্রেনিং নিয়েছেন এ দেশের ছাত্র-জনতা। এদের ৯০ শতাংশই মুসলমান বা সংখ্যাগুরু সম্প্রদায়। যাদের জন্য স্বাধীনতা অপরিহার্য হয়ে উঠেছিল, তারা সবাই ছিলেন বাঙালি মুসলমান। এককালে তারাই চেয়েছিলেন পাকিসৱান। পাকিসৱানিদের জুলুম-নির্যাতনেই বাঙালি মুসলমানেরা বাধ্য হয়েই স্বাধীনতার দাবি তুলেছেন আর জান কুরবান করে মুক্তিযুদ্ধ করেছেন। সরাসরি মুক্তিযুদ্ধে সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের অংশগ্রহণ ছিল খুবই নগণ্য। এ কথা সত্য, মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে এরা নির্যাতিত হয়েছেন বেশি। একইভাবে সদা ভীতসন্ত্রসৱ ছিলেন এ দেশে থেকে যাওয়া সাড়ে ছয় কোটি মানুষ। এদের নিয়ে ১৯৭২ সালে ইংরেজি সাপ্তাহিক হলিডে লিখেছিল- ‘সিক্সটিফাইভ মিলিয়ন কোলাবোরেটরস’। তখন বঙ্গবন্ধু ও তার ভক্তদের হুঁশ এসেছিল যে, দেশের সাড়ে ছয় কোটি লোককে কোলাবোরেটর বানিয়ে দেশ চালানো যাবে না। আগেই বলেছি, কলকাতা বা বাংলাদেশ সীমানেৱর আশপাশের ভারতীয় রাজ্য ও জেলাগুলোতে আশ্রয় নিয়েছিলেন হিন্দু সম্প্রদায়ের লোকজন। এ কথা সত্য, সেই সময়ে হিন্দু সম্প্রদায়ের লোকেরা বেশি অত্যাচারিত হয়েছিলেন। এমনকি প্রতিবেশী অনেক মুসলমানও তাদের ওপর অত্যাচার করেছে। নামজাদা আওয়ামী নেতাদের অনেকেই ছিলেন কলকাতা শহরে। আওয়ামী লীগের প্রথম সারির নেতাদের এক ভাগও সরাসরি সশস্ত্র মুক্তিযুদ্ধে অংশ নেননি। তারা বক্তৃতা-বিবৃতি ও রাজনৈতিক লবিতে অংশ নিয়েছেন। সাংবাদিক, বুদ্ধিজীবীরাও তাই করেছেন। সীমানেৱ বা দেশের ভেতর প্রবেশ করে অস্ত্র নিয়ে যুদ্ধ করেছেন ছাত্র, যুবক, শ্রমিক, কৃষক ভাইয়েরা। তাদের নেতৃত্ব দিয়েছেন সেনাবাহিনীর অফিসার, জওয়ান, পুলিশ, ইপিআর ও আনসার বাহিনীর দেশপ্রেমিক শক্তি। বলা হয়ে থাকে, মুক্তিযুদ্ধে ৩০ লাখ লোক শহীদ হয়েছেন। যদিও এ সংখ্যা নিয়ে নানা জনে নানা মত প্রকাশ করছেন। তবুও এ সংখ্যাকে যদি সঠিক ধরে নিই তাহলে আওয়ামী লীগের নেতৃস'ানীয় এক ভাগ লোকও শহীদ হননি। কয়েকটি ডানপন'ী ও ইসলামি দল ছাড়া সব রাজনৈতিক দলই মুক্তিযুদ্ধে অংশ নিয়েছে। রাজনৈতিক কারণে ও ভারত সরকারের প্রভাবে আওয়ামী লীগ প্রবাসী সরকার গঠন করে ও নেতৃত্ব দেয়। যা হোক, এসব হলো প্রাসঙ্গিক কথা।
মাসখানেক ধরে রাজনীতির ভাষা নিয়ে পত্রিকা ও রাজনীতির মাঠ বেশ গরম। আমাদের প্রধানমন্ত্রীর ভাষা সব সময়েই একটু ব্যতিক্রমধর্মী। তিনি শালীন ও পরিশীলিত ভাষায় কথা বলতে হয়তো পারেন না। এখন সবাই ধরে নিয়েছেন যে প্রধানমন্ত্রী ও আওয়ামী নেত্রী ওভাবেই কথা বলেন এবং তিনি যা বলেন তা হয়তো তার অনৱরের কথা নয়। এর আগে আদালতও তাকে ‘রং হেডেড’ বলে আখ্যায়িত করেছেন। আওয়ামী লীগের অনেক নেতাই বলে থাকেন, নেত্রী যদি কম কথা বলতেন তাহলে দলের মঙ্গল হতো। কথা বলার ব্যাপারে নেত্রীর আদর্শকে অনুসরণ করে বেশ কয়েকজন মন্ত্রী ইতোমধ্যেই চ্যাম্পিয়নশিপ লাভ করেছেন। কেউ কেউ বলেন, ওভাবে কথা বললে প্রধানমন্ত্রী খুশি হন। ইদানীং এ ভাষার প্রভাব আদালত ও সংসদে বিস-ৃতি লাভ করেছে। আদালত কথায় কথায় প্রতিদিনই কাউকে না কাউকে পাকিসৱান পাঠানোর পরামর্শ দিচ্ছেন। সাংবাদিক সাগর-রুনির হত্যার ব্যাপারে সংবাদ পরিবেশনের ব্যাপারেও আদালত কথা বলেছেন; কিন' সাংবাদিকেরা বলেছেন, তারা আদালতের এই পরোক্ষ সেন্সরশিপ মানেন না। কিছু দিন থেকে আদালত এভাবে কথা বলে চলেছেন। সাংবাদিক সৈয়দ আবুল মাকসুদকেও আদালত হুমকি-ধমকি দিয়েছেন।
রাজনীতির অশালীন ভাষা এখন সংসদে ঢুকে পড়েছে। কেউ কেউ বলছেন, নিষিদ্ধ পলস্নীর ভাষা সংসদে ঢুকে পড়েছে। স্পিকার নিজেই এতে বিব্রত বোধ করছেন। বিষয়টির সূত্রপাত হয়েছে প্রধানমন্ত্রীর ভাষা নিয়ে আলোচনা করতে গিয়ে বিরোধীদলীয় কয়েকজন সদস্য নাকি নিয়মনীতি ভঙ্গ করেছেন। বিরোধীদলীয় চিফ হুইপ বলেছেন, এ ভাষা চালু করেছেন প্রধানমন্ত্রী ও তার দলীয় নেতারা। বিরোধীদলীয় সদস্যদের ভাষায় ক্ষুব্ধ হয়ে মোহাম্মদ নাসিম তাদের সদস্যপদ বাতিলের কথা বলেছেন। এখন আওয়ামী লীগ নেতাদের মধ্যে মাতম উঠেছে ভাষা নিয়ে। এত দিন তাদের ধারণা ছিল অশালীন ভাষা ব্যবহারের অধিকার তাদের একচেটিয়া। খালেদা জিয়ার সমস্যা তিনি ওই ভাষায় কথা বলতে পারেন না। এমনকি তার দলের ভারপ্রাপ্ত সেক্রেটারিও ওই ভাষা রপ্ত করতে পারেননি এখনো। রাজনীতিতে অশালীন ভাষার ব্যবহার ও প্রতিপক্ষকে অশ্রাব্য ভাষায় আক্রমণ করার যে রেওয়াজ চালু হয়েছে তা অবশ্যই অবিলম্বে বন্ধ হওয়া দরকার। আমার তো মনে হয় আওয়ামী লীগ শালীন ভাষায় ফিরে এলে সমস্যার সমাধান হয়ে যাবে। বিএনপির নেতা ও কর্মীদের এ অশালীন ভাষা আর শিখতে হবে না।
লেখক : কবি ও সাংবাদিক
ershadmz40@yahoo.com
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন