শনিবার, ২৮ এপ্রিল, ২০১২

ইলিয়াস আলীর দীর্ঘায়ু কামনা করি


আবদুল মান্নান | তারিখ: ২৮-০৪-২০১২

গত বছর এলডিপির নেতা কর্নেল (অব.) অলি আহমদ ভবিষ্যদ্বাণী করে বলেছিলেন, এই সরকার সেপ্টেম্বর পর্যন্ত টিকবে না। তারপর যখন সেপ্টেম্বর পর্যন্ত টিকেই গেল, তখন তিনি সরকারের আয়ু ডিসেম্বর পর্যন্ত বৃদ্ধি করলেন। না, তাতেও তাঁর ভবিষ্যদ্বাণী ফলল না। তারপর পরবর্তী মেয়াদ আগামী (মানে সামনের) বাজেট সেশনের আগ পর্যন্ত বৃদ্ধি করলেন। আগামী বাজেট জুন মাসের ৭ তারিখে সংসদে পেশ হওয়ার কথা রয়েছে। এখন দেশের মানুষকে সে পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হবে। কর্নেল সাহেব একজন বিচক্ষণ মানুষ। ছিলেন বিএনপির প্রতিষ্ঠাতা জেনারেল জিয়ার দক্ষিণহস্ত। তাঁর মৃত্যুর পর তাঁর স্ত্রী খালেদা জিয়ার সঙ্গ ছাড়েননি। একাধিকবার বলেছেন, তিনিই খালেদা জিয়াকে রাজনীতিতে এনেছেন। বিগত জোট সরকারের আমলে খালেদা জিয়ার ছেলে তারেক রহমান সঙ্গে কী-সব বিষয় নিয়ে তুমুল মতপার্থক্য হলো। বিএনপির সঙ্গ ত্যাগ করে নিজে এলডিপি নামের একটি নতুন দল বানালেন। সঙ্গে বিএনপির আরও কিছু মধ্যম সারির নেতাকে নিজ দলের পতাকাতলে সমবেত করলেন। ২০০৭ সালের নির্বাচনকে সামনে রেখে শেখ হাসিনার নেতৃত্বে মহাজোটের সঙ্গে অন্যদের মতো অলি আহমদও যোগ দিয়েছিলেন। কিন্তু অধ্যাপক ইয়াজউদ্দিন আহম্মেদের গোয়ার্তুমির কারণে সে নির্বাচনটি হতে পারেনি। ২০০৮ সালের নির্বাচনের আগেও তিনি শেখ হাসিনার সঙ্গে জোটবদ্ধ হয়ে নির্বাচন করতে চেয়েছিলেন। শেখ হাসিনা রাজি হননি। এখন মনে হচ্ছে, রাজি না হয়ে ভালোই করেছেন। নবম সংসদে এলডিপি মাত্র একটি আসনে জয়ী হয় এবং তিনি কর্নেল অলি আহমদ। এক দলের এক নেতা হয়েও তিনি একটি মন্ত্রণালয়ের সংসদীয় স্থায়ী কমিটির সভাপতি হন। তারপর এক দিন সস্ত্রীক খালেদা জিয়ার বাসভবনে গিয়ে ঘোষণা করলেন, এখন থেকে তিনি তাঁর সঙ্গে থাকবেন এবং সরকার পতন আন্দোলনে সহায়তা করবেন। জানামতে, কোনো রাজনৈতিক দলের প্রধানের খালেদা জিয়ার গুলশানের বাসভবনে গিয়ে তাঁর সঙ্গে সাক্ষাতের নজির এটিই প্রথম। সুতরাং বোঝা যায়, তিনি খালেদা জিয়ার দল ছাড়লেও তাঁর সঙ্গে ব্যক্তিগত সম্পর্ক সব সময় ছিল। দল ছাড়ার পর তিনি খালেদা জিয়া এবং তারেক রহমান সম্পর্কে বেশ কিছু কড়া কথা বলেছিলেন। এসব নিছকই ছিল কথার কথা। কর্নেল সাহেবের ভবিষ্যদ্বাণী ফলবে কি না, তা দেখার জন্য দেশের মানুষকে আর মাস খানেক অপেক্ষা করতে হবে। তবে বিএনপির সাংগঠনিক সম্পাদক ইলিয়াস আলীর ‘অন্তর্ধান’ নিয়ে দেশে যে জমজমাট নাটক শুরু হয়েছে, তা অনেকেই গণতন্ত্রের জন্য একধরনের অশনিসংকেত হিসেবে দেখছেন এবং মনে করছেন, এই নাটকের পরিকল্পনা ও মহড়া অনেক আগে থেকেই শুরু হয়েছে; কিন্তু ক্ষমতাসীন দল তা বুঝতে পারেনি। সময় থাকতে আওয়ামী লীগ অনেক কিছুই বুঝতে পারে না এবং তার জন্য শুধু দল নয়, দেশের মানুষকেও চড়া মূল্য দিতে হয়।
বিএনপির সাংগঠনিক সম্পাদক এবং সিলেট বিএনপির সভাপতি ইলিয়াস আলী তাঁর বনানীর বাসার কাছ থেকে ১৭ এপ্রিল মধ্যরাতের পর তাঁর গাড়ির চালকসহ গুম বা নিখোঁজ হলেন। এ পর্যন্ত তাঁর বা গাড়িচালকের কোনো খোঁজ মেলেনি। কারা তাঁকে গুম করেছে, তা-ও পরিষ্কার নয়। যদিও বিএনপি বলছে, তাঁকে সরকারি বাহিনী তুলে নিয়ে গেছে। ব্যারিস্টার রফিক-উল হক ইলিয়াস আলীর বাসায় গিয়ে বলে এসেছেন, ইলিয়াস আলী ভালো আছে এবং সুস্থ আছে। সরকার বলছে, ইলিয়াস আলীর গুম হওয়ার সঙ্গে সরকারের কোনো সম্পৃক্ততা নেই। ইলিয়াস আলী কেন, যেকোনো নাগরিকই গুম হওয়া গ্রহণযোগ্য নয়। সব নাগরিকের নিরাপত্তা দেওয়া সরকারের দায়িত্ব। আর ইলিয়াস আলী তো বিএনপির জন্য একজন খুবই গুরুত্বপূর্ণ নেতা, তাঁর অতীত যা-ই হোক না কেন। এই গুরুত্বপূর্ণ নেতাকে আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক মাহবুব উল আলম হানিফ ‘পিস্তল ইলিয়াস’ বলে সম্বোধন করলে বিএনপির ভারপ্রাপ্ত সাধারণ সম্পাদক মির্জা ফখরুল বেশ উত্তেজিত হয়ে বুধবার এক সভায় বলেছেন, ইলিয়াস আলী নব্বইয়ের এরশাদবিরোধী আন্দোলনে রাজপথের একজন লড়াকু সৈনিক ছিল। তিনি এরশাদকে উৎখাত করার জন্য পিস্তল হাতে নিয়েছিলেন। তিনি আরও বললেন, এক ইলিয়াস আলীর জন্য রোববার থেকে সারা বাংলায় আগুন জ্বলবে। তবে মির্জা বলেননি, কেন তাঁকে ১৯৮৭ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বহিষ্কার করা হয়েছিল। ১৯৯২ সালে ইলিয়াস আলী ছাত্রদলের সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হন। মাত্র তিন মাসের মাথায় কেন খালেদা জিয়া ছাত্রদলের নির্বাচিত কমিটি ভেঙে দিতে বাধ্য হন, তা-ও কিন্তু বলেননি মির্জা ফখরুল। তিনি এও বলেননি, কেন খালেদা জিয়া ক্ষমতায় থাকা সত্ত্বেও ইলিয়াস আলী দুই বছর কারাবাস করেন। বোধগম্য কারণেই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র থাকাকালে এই গুরুত্বপূর্ণ নেতার অনেক কীর্তির কথা বলা থেকে বিরত থাকলাম। সবকিছু বিস্তারিত লিখে আমি নিজে গুমের শিকার হতে চাই না। আমার মতো অভাজন গুম হলেও ইলিয়াস আলীকে নিয়ে দেশে যে রকম তোলপাড় হচ্ছে, তার কোনোটাই আমার জন্য হবে না।
রাজনৈতিক ব্যক্তিদের শত্রু থাকাটা বিচিত্র কিছু নয়। এই শত্রু সামান্য স্বার্থের দ্বন্দ্বে সৃষ্টি হতে পারে অথবা প্রতিপক্ষ যদি কোনো কারণে অন্যজনের রাজনৈতিক উত্থানের বাধার কারণ হয়, তখন প্রতিপক্ষও শত্রু হয়ে যেতে পারে। কিংবা রাজনৈতিক মতদ্বৈধতা এমন পর্যায়ে পৌঁছায়, তখন এক পক্ষ অন্য পক্ষের শত্রু হয়ে যেতে পারে। বঙ্গবন্ধুকে সপরিবারে হত্যার কথা বাদই দিলাম, বিগত চারদলীয় জোটের শাসনামলে চট্টগ্রামের বিএনপির নেতা জামালউদ্দিন গুম হয়ে গেলেন। পরিবারের সবার সে কী আহাজারি। তাঁরা দেখা করলেন তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়ার সঙ্গে। লাভ হলো না কিছুই। তাঁরা বললেন, নিজ দলের লোকজনই জামালউদ্দিনকে গুম করেছে। আওয়ামী লীগের নেতা আহসানউল্লাহ মাস্টারকে হত্যা করা হলো, সাবেক অর্থমন্ত্রী শাহ এ এম এস কিবরিয়া সিলেটের জনসভায় গ্রেনেড হামলায় নিহত হলেন, ২০০৪ সালের ২১ আগস্ট শেখ হাসিনাকে হত্যার উদ্দেশ্যে ছোড়া অসংখ্য গ্রেনেডের হামলায় শেখ হাসিনা বেঁচে গেলেও বর্তমান রাষ্ট্রপতি জিল্লুর রহমানের স্ত্রী আইভী রহমানসহ ২২ জন নিহত হলেন। তারপর কী হলো? বিএনপি এক ইলিয়াস আলীর জন্য যেভাবে দেশ অচল করে দিল, তার ছিটেফোঁটাও তো আওয়ামী লীগ তখন করতে পারল না। সম্ভবত তাঁরা কেউই ইলিয়াস আলীর মতো তেমন গুরুত্বপূর্ণ ছিলেন না!
বাংলাদেশের রাজনীতির জন্য ইলিয়াস আলী অপরিহার্য, সে কারণে সবাই সমবেদনা জানাতে ইলিয়াস আলীর বাসায় ছুটে গেছেন। তাঁকে উদ্ধারের জন্য এক দিন এক দিন করে বিএনপি লাগাতার তিন দিন হরতাল আহ্বান করল। হরতাল শুরুর আগের দিন একজন ঘুমন্ত বাস-ড্রাইভার বদর আলীকে নৃশংসভাবে পুড়িয়ে মারা হলো। পরদিন পিকেটারদের তাড়া খেয়ে পালাতে গিয়ে ক্যাব ড্রাইভার আবদুর রশিদ দুর্ঘটনার শিকার হয়ে মৃত্যুবরণ করলেন। ইলিয়াস আলীর নিজ এলাকায় বিশ্বনাথে পুলিশের গুলিতে তিনজন নিহত হলেন। তাঁদের জন্য কেউ তেমন একটা উচ্চবাচ্য করল না। কারণ, তাঁরা কেউই ইলিয়াস আলীর মতো গুরুত্বপূর্ণ নন। তিন দিনের হরতালে লক্ষাধিক শিক্ষার্থীর এইচএসসি পরীক্ষা তছনছ হলো। কারও কিন্তু এ ব্যাপারে মাথাব্যথা নেই। বৃহস্পতিবার মির্জা সাহেব বলেছেন, তাঁরা হরতাল দিতে চান না, কিন্তু দিতে বাধ্য হয়েছেন; কারণ দেশের মানুষ নাকি হরতাল চায় এবং পছন্দ করে। এ ব্যাপারে সহকর্মী মুনতাসীর মামুনের একটা মন্তব্য মনে পড়ল। হরতালের তৃতীয় দিনে কারওয়ান বাজারে পিকেটাররা ভোরে একটি নতুন প্রাইভেট গাড়িতে আগুন দিলে মামুন ফোনে আমাকে জানালেন, মনে হয়, জনগণ বিএনপির হরতাল পছন্দ করেছে। কারণ, একজন রাস্তায় তার নতুন গাড়িটা বের করে পিকেটারদের কেরোসিন ঢেলে আগুন লাগাতে দিয়েছে। তার সঙ্গে দ্বিমত করি কীভাবে? 
সবাই ইলিয়াস আলীর বাড়িতে সমবেদনা জানাতে ছুটে গেলেও একই পাড়ায় বসবাসরত খালেদা জিয়া কিন্তু যাওয়ার প্রয়োজন মনে করেননি। তিনি তাঁর ২৩ তারিখের সংবাদ সম্মেলনে ইলিয়াসের পরিবারকে তাঁর দপ্তরে হাজির থাকার ব্যবস্থা করেছেন। ইলিয়াস আলীর স্ত্রী প্রথম দিকে আইনপ্রয়োগকারী সংস্থার সঙ্গে বেশ সহযোগিতা করলেও খালেদা জিয়ার সঙ্গে হরতালের দ্বিতীয় দিন তাঁর সাক্ষাতের পর থেকে চুপচাপ হয়ে গেছেন। খালেদা জিয়া সংবাদ সম্মেলনে ঘোষণা করেছিলেন, তিনি সরকারকে শনিবার পর্যন্ত সময় দিচ্ছেন ইলিয়াস আলীকে হাজির করার জন্য। তা করতে ব্যর্থ হলে রোববার থেকে নতুন এবং কঠোর কর্মসূচি ঘোষণা করা হবে। কিন্তু তাঁর তর সইল না। ঠিক পরদিন ১৮ দলীয় মিত্রদের নিয়ে বিএনপি ঘোষণা করল, ইলিয়াস আলীবিহীন শনিবার পার হলেই পরের দুই দিন ফের হরতাল। আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক সৈয়দ আশরাফ সাংবাদিকদের ডেকে জানালেন, সরকার ইলিয়াস আলীকে জীবিত উদ্ধারের সব চেষ্টা অব্যাহত রেখেছে এবং তিনি আশা করছেন, এই নেতা দ্রুত উদ্ধার হবেন। না, যেহেতু জনগণ হরতাল পছন্দ করে, সেহেতু তা আগেভাগেই ঘোষণা করে দেওয়া ভালো। আসলে অনেকের মতে, ইলিয়াস আলী এখন বিরোধী দলের রাজনীতির জন্য একটি তুরুপের তাসের মতো। তাঁকে উদ্ধার করতে পারলে তখন বিএনপি কী নিয়ে রাজনীতি করবে? তাদের বলেছি, তারা নতুন একটা ইস্যু খুঁজে নেবে। অসুবিধা হবে না। 
সরকারকে বলি, এক ইলিয়াস আলীকে উদ্ধার করতেই যদি এত সময়ক্ষেপণ হয়, তাহলে দেশের মানুষের তো হতাশ হওয়ারই কথা। তাঁকে তো ইতিমধ্যে হিরো বানিয়ে দেওয়া হয়েছে। এখন তাঁকে দ্রুত খুঁজে বের করুন। আর বিএনপি সরকার উৎখাতের নতুন কোনো পথ খুঁজতে থাকুক, কারণ বাজেট সেশন তো এসে গেল। কর্নেল সাহেব তো ওই পর্যন্তই এ যাত্রায় সময় বেঁধে দিয়েছেন। ইলিয়াস আলীর অন্তর্ধানে আমি নিজেও তাঁর পরিবারের সঙ্গে সমব্যথিত, কারণ আমারও একটা পরিবার আছে। তবে অনেকের মতে, জীবিত ইলিয়াস আলীর চেয়ে মৃত ইলিয়াস বিরোধী দলের জন্য অনেক বেশি লাভজনক। আমি তাঁর দীর্ঘায়ু কামনা করি।
 আবদুল মান্নান: সাবেক উপাচার্য, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়।

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন